ওরহান পামুক সাক্ষাৎকার । শফিউল জয়
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ আগস্ট ২০১৬, ৯:২০ পূর্বাহ্ণ, | ৪৭২৯ বার পঠিত
ওরহান পামুকের জন্ম ১৯৫২ সালে ইস্তানবুলে, — যেখানে তার বেড়ে ওঠা পাশ্চাত্যঘেঁষা উচ্চবিত্ত পরিবারে। দাদা রেইলরোড নির্মাণের দরুন তুর্কিশ রিপাব্লিকের প্রথম দিককার অবস্থাসম্পন্ন শ্রেণির প্রতিনিধি। পরবর্তীতে তিনি পড়াশোনা করেন সেক্যুলার পশ্চিমা তরিকার রবার্ট কলেজ ও ইস্তানবুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে। প্রথম জীবনে চিত্রশিল্পী হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও লেখালেখিকেই বেছে নেন পরবর্তীতে। সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছে ২০০৪ সালের মে ও ২০০৫ সালের এপ্রিলে, — লন্ডনে তাঁর বই প্রকাশনীর অনুষ্ঠানে। দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকারগ্রহণের সময় পামুককে বেশ অস্বাভাবিক লাগছিল; কারণ তার দুই মাস আগেই এক স্যুইস পত্রিকায় তিনি বলেছিলেন — ‘ত্রিশ হাজার কুর্দ আর দশ লাখ আর্মেনিয়ান মারা হয়েছে এই ভূমিতে, কিন্তু কেউ সাহস করে কিছু বলে না।’ তুরস্কের জাতীয় পত্রিকাগুলোতে এর পর পামুকের প্রতি অনৈতিক বিরুদ্ধাচার শুরু হয়। তুরস্ক সরকার সবসময় ১৯১৫ সালের এই গণহত্যা অস্বীকার করে এসছে এবং আইন তৈরি করে চলমান কুর্দিসংঘাত নিয়ে আলোচনা বন্ধে উদ্যোগী হয়েছে। তুরস্কের পেনাল কোডের আর্টিকেল ৩০/১১ ধারায় তার বিরদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় যার শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছরের জেল। অবশেষে দুই হাজার পাঁচ সালের ২৯ ডিসেম্বর এই অভিযোগ বাতিল করা হয়। এই সাক্ষাৎকারটাতে প্রধানত পামুকের প্রথম দিককার কিছু বই নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ফলে তার উল্লেখযোগ্য আরও কিছু বই — ‘দ্য মিউজিয়াম অফ ইনোসেন্স’, ‘দ্য সাইল্যান্ট হাউজ’ কিংবা সর্বশেষ প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাস ‘অ্যা স্ট্রেইঞ্জনেস ইন মাই মাইন্ড’ এর কোনো উল্লেখ নেই। তবে পামুকের ছেলেবেলা, বেড়ে ওঠা, লেখালেখি, অনুপ্রেরণা ও ইস্তানবুল শহর, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্ব — এইসব ঘুরেফিরে এসেছে।
প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস : সেভডেট বে অ্যান্ড হিস সন্স, ১৯৮২
শেষ প্রকাশিত উপন্যাস : অ্যা স্ট্রেইঞ্জনেস ইন মাই মাইন্ড, ২০১৫ওরহান পামুক, দ্য অ্যার্ট অফ ফিকশন ১৮৭, দ্য প্যারিস রিভিয়্যু
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী : অ্যাঞ্জেল গুর্যাআ কুঈন্তানা
ওরহান পামুক সাক্ষাৎকার ।। ভূমিকা ও ভাষান্তর : শফিউল জয়
প্রশ্ন : সাক্ষাৎকার দেয়ার অনুভূতিটা কেমন?
পামুক : অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি খুব দায়সারাভাবে দেই, তাই মাঝে মাঝে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ি। ইংরেজি বা তার্কিশ — দুই ভাষাতেই এমন হয়। তার্কিশে খুব শুদ্ধভাবে গুছিয়ে সুন্দর বাক্যে বলতে পারি না। তুরস্কে আমার বইয়ের জন্যে যত-না আক্রমণের শিকার হয়েছি, তার থেকে অনেক বেশি হয়েছি সাক্ষাৎকারের জন্যে। রাজনৈতিক পলেমিসিস্ট আর কলামিস্টরা সেখানে উপন্যাস পড়েন না।
প্রশ্ন : ইউরোপ আর আমেরিকায় তো আপনার বইয়ের বেশ পজিটিভ সমালোচনা হয়। তুরস্কে আপনাকে কীভাবে গ্রহণ করা হয় ক্রিটিক্যালি?
পামুক : ভালো দিনগুলা চলে গেছে। যখন আমার প্রথম বই প্রকাশ করি, আগের প্রজন্মের লেখকেরা প্রায় নিভে যাচ্ছিল। তাই আমাকে স্বাগত জানানো হয়েছিল নতুন লেখক হিশেবে।
প্রশ্ন : আগের প্রজন্মের বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন?
পামুক : যেসব লেখকরা একটা সামাজিক দায়িত্ব নিয়ে লিখত, মনে করত সাহিত্য নৈতিকতা আর রাজনীতির জন্যে। তারা নিষ্প্রাণ বাস্তববাদী ছিলেন, নিরীক্ষাধর্মী না। অন্যান্য গরীব দেশের লেখকদের মতো তারা তাদের মেধা নষ্ট করেছিলেন জাতিকে সেবা করতে গিয়ে। আমি কখনোই তাদের মতো হতে চাইতাম না। তরুণ বয়স থেকেই ফকনার, ভার্জিনিয়া উলফ আর প্রুস্তকে ভালো লাগত; গোর্কি-স্টেইনবেকের মতো সামাজিক-বাস্তববাদী লেখক না। ষাট আর সত্তরের দশকের সাহিত্যগুলা তখন নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ, ফলে একজন নতুন প্রজন্মের লেখক হিশাবে আমাকে গ্রহণ করা হয়েছিল।
মাঝ-নব্বইয়ে আমার বইয়ের বিক্রি যখন তুর্কির মানুষের কল্পনার চেয়েও বেড়ে যায়, যেটা কখনো কেউ ভাবতেই পারে নাই — সেই থেকেই তুর্কির প্রেস আর বুদ্ধিজীবীদের সাথে মধুচন্দ্রিমার দিনগুলার ইতি ঘটছে। ক্রিটিক্যাল রিসিপশানগুলা শুরু হয় পাব্লিসিটি আর আমার বইবিক্রির উপর ভিত্তি করে, বইয়ের বিষয়ের উপরে না। এখন দুর্ভাগ্যবশত আমি আমার রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্যে কুখ্যাত; যেগুলার বেশিরভাগই উদ্ধৃত করা হয় কোনো আন্তর্জাতিক সাক্ষাৎকার থেকে, এবং তারপর তুর্কি জাতীয়তাবাদী কোনো সাংবাদিক তার ইচ্ছামতো সাজায়া উপস্থাপন করেন। এতে করে আমাকে খুব র্যাডিক্যাল আর রাজনৈতিক অজ্ঞ হিশাবে তুলে ধরা যায়; আমি যতটা-না তার থেকেও বেশি করে।
প্রশ্ন : তাহলে আপনার জনপ্রিয়তার সাথে একটা বিরোধপূর্ণ মনোভাব আছে?
পামুক : এটা আমার বই বিক্রির পরিমাণ আর রাজনৈতিক বক্তব্যের শাস্তি। কিন্তু কথাটা এভাবে বলতে চাই না, মনে হচ্ছে আমি আত্মরক্ষা করছি। সম্পূর্ণ ছবিটাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার একটা সম্ভাবনা এসে যায়।
প্রশ্ন : আপনি কোথায় লেখালেখি করেন সাধারণত?
পামুক : আমি সবসময়ই মানি, ঘুমানো হয় যেখানে অথবা আমার সঙ্গিনীর সাথে যেখানে থাকি তার থেকে পড়ার জায়গাটা আলাদা রাখা উচিত। আটপৌরে অভ্যাস আর খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলা কল্পনাকে নষ্ট করে ফ্যালে। ভেতরের দানবটারও মৃত্যু হয় তখন। ঘরোয়া, ম্লানময় দৈনন্দিনতায় কল্পনাশক্তির অভাবে অন্য দুনিয়াটাও ঝাপসা হয়ে আসে। ফলে কাজের জন্যে সবসময়ই আলাদা অফিস বা ছোট্ট একটা জায়গা ছিল, অন্য একটা বাসা।
কিন্তু আমার প্রাক্তন স্ত্রী যখন কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে যায়, আমাকে প্রায় এক সেমস্টার বিবাহিত ছাত্রছাত্রীদের অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে হয়েছিল। তখন আমাকে একই জায়গায় লিখতে এবং ঘুমাতে হইছে। মনে হতো পারিবারিক জীবনে ফিরে গেছি। ব্যাপারটা হতাশজনক হয়ে গেল। প্রত্যেকদিন সকালবেলা স্ত্রীকে বিদায় জানায়া বের হয়ে যেতাম এমন ভাব করে যেন অফিসে যাচ্ছি। তারপর বাসা থেকে বের হয়ে কয়েক ব্লক ঘুরাঘুরি করে আবার এমনভাবে ঢুকতাম বাসায় যাতে মনে হয় অফিসে ঢুকতেছি। দশ বছর আগে বসফরাসের পাশে একটা ফ্ল্যাট পাই যেখান থেকে পুরানো শহরটা দ্যাখা যেত। সম্ভবত ইস্তানবুলের সবচেয়ে মনোরম দৃশ্যটা পেতাম এখান থেকে। আমি যেখানে থাকি তার থেকে পঁচিশ মিনিটের হাঁটার পথদূরত্ব। বইভর্তি এই বাসায় আমার ডেস্কটা থেকে সেই সম্পূর্ণ ভিয়্যুটা পাওয়া যায়। দৈনিক গড়ে প্রায় দশ ঘণ্টা সেখানে কাটাতাম।
প্রশ্ন : দৈনিক দশ ঘণ্টা!
পামুক : হ্যাঁ, আমি খুব কর্মঠ। আমার ভালো লাগে। লোকজন বলে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, হয়তো কিছুটা সত্যতাও আছে। কিন্তু আমি যা করি সেটা ভালোবাসি। আমার ভালো লাগে ডেস্কের উপর বসে থাকতে, বাচ্চারা যেমন খেলনা নিয়ে খ্যালে ওই-রকম। এটা কাজ, একই-সাথে আনন্দদায়ক এবং এক-ধরনের খেলাও কিন্তু!
প্রশ্ন : ওরহান, ‘স্নো’ বইয়ে আপনার নামধারী চরিত্র আর বর্ণনাকারীও নিজেকে একজন কেরানি হিশাবে বর্ণনা করে, যে দিনের পর দিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে ডেস্কে বসে থাকে। লেখালেখির জন্যে আপনার শৃঙ্খলাও কি তেমন?
পামুক : আমি উপন্যাসিকদের কেরানিগিরিটাই তুলে ধরার চেষ্টা করছিলাম, যেটা একজন কবির ক্ষেত্রে পুরাপুরি উল্টা। তুরস্কে কবিদের তো বিপুল প্রতিপত্তি। একজন কবি হওয়া এইখানে খুবই জনপ্রিয়তা আর সম্মানের ব্যাপার। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান আর হর্তাকর্তারা কবি ছিলেন, যদিও আমরা কবিতা বলতে যা বুঝি তাদের ধারণা তেমন ছিল না। শতবছর ধরে এটা ছিল নিজেকে বুদ্ধিজীবী হিশাবে প্রমাণ করার রাস্তা। এইসব কবিতা সংগ্রহ করা হতো ডিভান নামের পাণ্ডুলিপিতে। এবং ওসমানীয় প্রেমের কবিতাকে ডিভান কবিতাই বলা হয়ে থাকে। মন্ত্রী-আমলাদের অর্ধেকের মধ্যে কবিতা লেখার চল ছিল। ব্যাপারটা ছিল নিয়ম-কানুন মেনে খুব মার্জিত আর স্বভাবসিদ্ধ রুচিশীলতার বহিঃপ্রকাশ এবং খুব শাদামাটা আর পুনরুক্তিময়। পশ্চিমা চিন্তাভাবনা আসার পর রোম্যান্টিকতা আর আধুনিকতার ভাবে হয়ে গেল — কবি বলতে বোঝায় এমন একজনকে, যিনি সত্যের জন্যে আগুনে পুড়তেও দ্বিধাবোধ করেন না। এই ধারণাটাও কবিদের আরেক ধাপ প্রতিপত্তি বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে উপন্যাসিক হচ্ছে এমন একজন যে কী-না পিঁপড়ার মতো ধৈর্য নিয়ে অনেক লম্বা পথ পাড়ি দ্যান। একজন উপন্যাসিকের শক্তির জায়গা তার দানবীয় বা রোম্যান্টিক প্রকাশে না, তাঁদের জন্যে চ্যালেঞ্জটা ধৈর্যের।
প্রশ্ন : আপনি কি কখনো কবিতা লিখেছেন?
পামুক : আমাকে প্রায়ই এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করা হয়। আঠারো বছর বয়সে কিছু কবিতা ছাপাই তুরস্কে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। আমার ব্যাখ্যাটা হচ্ছে — কবির মাধ্যমে ঈশ্বর কথা বলেন। কবিতা ভর করতে হবে। চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু বুঝলাম ঈশ্বর আমার সাথে কথা বলতেছেন না। খারাপ লাগত এটা নিয়ে খুব। তারপর কল্পনা করার চেষ্টা করলাম — ঈশ্বর যদি আমার সাথে কথা বলতেন তাহলে উনি কী বলতেন আমাকে। খুব সাবধানে লেখা শুরু করলাম। ধীরে… কীভাবে এই উত্তরটা পাওয়া যায় তা মাথায় রেখে। সেটাই হচ্ছে গদ্য লেখা, কথাসাহিত্য লেখা। তাই কেরানির মতো কাজ করছি। কোনো কোনো লেখক এটা অসম্মানজনক মনে করেন। কিন্তু আমি মেনে নিছি; আমার কাজটা কেরানির।
প্রশ্ন : তাহলে আপনি কি বলবেন সময়ের সাথে সাথে গদ্য লেখাটা আপনার কাছে সহজসাধ্য হয়ে উঠতেছে?
পামুক : দুর্ভাগ্যবশত না। মাঝেমাঝে অনুভব করি চরিত্রগুলার একটা রুমে প্রবেশ করা উচিত, কিন্তু আমি এখনও জানি না কীভাবে তাঁদেরকে প্রবেশ করাব। আগের থেকে আত্মবিশ্বাসটা হয়তো বেশি, কিন্তু সেটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ তাহলে তুমি ঝুঁকিটা নিচ্ছ না, জাস্ট লিখে যাচ্ছো তোমার কলমের আগায় যা আসতেছে। গত ত্রিশ বছর ধরে গদ্য লিখছি যেহেতু, কিছুটা উন্নতি তো করতে পারছিই। কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে ভাবের এমন প্রান্তে আসি যখন মনে হয় একজনকেও নিতে পারব না। একটা চরিত্র ঢুকতে পারতেছে না রুমে, এবং আমি জানি না কী করতে হবে। এখনো!! ত্রিশ বছর পরেও।
বইয়ের অধ্যায়বিন্যাসটা আমার চিন্তার জন্যে খুব প্রয়োজনীয়। বেশিরভাগ সময়ে আগে থেকেই গল্পের বিন্যাসটা জানা থাকে, সেগুলোকে ভাগ করে নেই। তারপর ডিটেইলে ভাবি কোনটায় কী হবে। সবসময় ধারা মেনে চ্যাপ্টারগুলো লেখা হয় না। ব্লক হয়ে যাওয়া আমার জন্যে খুব কষ্টকর কিছু না, কারণ তখন যা মনে হয় তা-ই লিখি। এক নাম্বার চ্যাপ্টার থেকে পাঁচ নাম্বার চ্যাপ্টার পর্যন্ত লেখার পর যদি দেখি ভালো লাগতেছে না, তখন স্কিপ করে পনেরো নাম্বার চ্যাপ্টারে গিয়ে সেখান থেকে লেখা শুরু করি।
প্রশ্ন : তার মানে পুরা বইটার ছক আগে থেকেই মাথায় থাকে?
পামুক : সবকিছুই। ‘মাই নেইম ইজ রেড’-এর কথা বলা যায়। এই বইয়ে অনেকগুলা চরিত্র আছে এবং প্রত্যেকটা চরিত্র একেকটা চ্যাপ্টারে অন্তর্ভুক্ত। যখন আমি লিখতাম, যে-কোনো একটা ক্যারেক্টার হিশাবে ভাবা শুরু করতাম — ‘বিয়িং’। ফলে যখন শেকুরের চ্যাপ্টার লেখা শুরু করি, সম্ভবত সাত নাম্বার, সেটা লেখার পর স্কিপ করে এগারোতে চলে যাই, কারণ সেখানে আবার শেকুরে। শেকুরে হতে আমার ভালো লাগছিল। এক চরিত্র থেকে আরেক চরিত্রে স্কিপ করা হতাশাজনকও মাঝে মাঝে।
কিন্তু শেষ চ্যাপ্টারটা সবসময়ই শেষেই লিখি। সেটা সবসময়ই এক। নিজেকে প্রশ্ন করি — শেষটা ক্যামন হতে পারে। একবারই পারি সেটা। আর শেষের দিকে আসতে আসতেই থামি; পূর্ববর্তী চ্যাপ্টারগুলো পুনরায় লেখা শুরু করি, বদলাই।
প্রশ্ন : এমন কেউ আছেন যাকে প্রথমে আপনার লেখাগুলো পড়তে দেন?
পামুক : আমার সাথে যিনি আছেন সঙ্গিনী হয়ে তাঁকে সবসময় আগে পড়তে দেই। খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করি যখন সে আমাকে বলে — আর কী কী লিখছো দেখাও। এটা শুধু একটা বাড়তি দায়বদ্ধতা না, এক-ধরনের নিশ্চয়তাও বটে! অনেকটা যেন বাবা-মা পিঠ চাপড়ে বলতেছে : ভালো হয়েছে! মাঝে মাঝে সে এও বলে তার ভাল্লাগেনাই। এই ছোটখাটো রিচুয়ালগুলো ভালো লাগে। থমাস মানকে আমি আদর্শ মানি। তিনি তার ছয় সন্তানের পুরা পরিবারকে সামনে বসিয়ে নিজের লেখা পড়তেন। বাবাদের এইভাবে গল্প বলার অভ্যাসটা ভালো লাগে।
প্রশ্ন : তরুণ বয়সে আপনি চিত্রশিল্পী হতে চাইতেন। চিত্রশিল্পী না হয়ে লেখক হবেন — এই পরিবর্তনটা কখন আসলো?
পামুক : বাইশ বছর বয়সে। সাত বছর বয়স থেকেই চিত্রশিল্পী হতে চাইতাম এবং পারিবারিকভাবে সবাই মেনে নিয়েছিল। সবাই ভাবত একদিন নিশ্চয়ই অনেক বড় চিত্রশিল্পী হব। কিন্তু হুট করে কিছু হলো, বুঝতে পারলাম মাথার একটা স্ক্রু ঢিলা। সেই মুহূর্তেই ছবি আঁকা বাদ দিয়ে আমার প্রথম উপন্যাস লেখা শুরু করি।
প্রশ্ন : স্ক্রু ঢিলা? একটু খুলে বলবেন?
পামুক : গুছিয়ে হয়তো বলতে পারব না। সম্প্রতি আমার একটা বই বের হয়েছে যার অর্ধেক হচ্ছে সেই মুহূর্তটা পর্যন্ত যখন সিদ্ধান্ত নেই চিত্রশিল্পী হব। বাকি অর্ধেকটা হচ্ছে শিশুর চোখে ইস্তানবুল শহরটার বর্ণনা। একটা শহরের ইমেইজ আর ল্যান্ডস্কেইপের বর্ণনা, তার সাথে শহরের অন্তর্গত যাবতীয় রসায়ন, শিশুর উপলব্ধি থেকে তার আত্মজীবনী। বইটার শেষ বাক্যটা হচ্ছে — “আমি চিত্রশিল্পী হতে চাই না’ … ‘আমি একজন লেখক হতে যাচ্ছি।” আর কোনো ব্যাখ্যা নেই, যদিও পুরো বইটা পড়ে হয়তো কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন : পরিবার থেকে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়েছিল?
পামুক : মা বেশ আশাহত হয়েছিল। আমার বাবা ব্যাপারটা কিছুটা বুঝতে পারছিলেন, কারণ তরুণ বয়সে সে কবি হতে চাইত। ভ্যালেরিকে তার্কিশে সে অনুবাদও করেছিল। কিন্তু তার বড়লোক বন্ধুদের ঠাট্টা-বিদ্রুপে ছেড়ে দেয় এসব। সামাজিকভাবে বাবা আর তার বন্ধুরা একই শ্রেণিতে ছিলেন।
প্রশ্ন : আপনার পরিবার চিত্রশিল্পী হওয়াকে মেনে নিয়েছিল, কিন্তু উপন্যাসিক হিশেবে না?
পামুক : হ্যাঁ, কারণ তারা কেউই ভাবে নাই আমি ফুলটাইম পেইন্টার হব। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আমাদের পরিবারের একটা রেওয়াজ ছিল। আমার দাদা ছিলেন একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার যে রেইলরোড করে বেশ অবস্থাসম্পন্ন হয়েছিলেন। বাবা এবং চাচারা প্রায় সবকিছুই হারায়, কিন্তু তারাও একই প্রকৌশল স্কুলে পড়েছেন — ইস্তানবুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি। সবাই ধরে নিছিল আমিও সেইখানেই পড়ব। কিন্তু যেহেতু চিত্রশিল্পী হতে চাই — তাই আর্কিটেকচারে পড়াই আমার জন্যে ভালো হবে বলে মনে করল, অস্বস্তিও তেমন ছিল না। কিন্তু প্রকৌশল বিদ্যালয়ের মাঝপথে ছবি আঁকা ছেড়ে দেই এবং উপন্যাস লেখা শুরু করি।
প্রশ্ন : আপনার ভাবনায় আগে থেকেই কি প্রথম উপন্যাসটা ছিল? যার জন্যে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হলো?
পামুক : যতদূর মনে পড়ে, কী লিখব এটা ভাবার আগেই উপন্যাসিক হতে চাইছিলাম। বলতে গেলে, এর মধ্যে দুই তিনবার শুরু করার চেষ্টা করেছি। নোটগুলো আমার কাছে এখনও আছে। কিন্তু ছয়মাস পর আমি বড়সড় প্রস্তুতি নিয়ে উপন্যাস লেখা শুরু করি যা শেষ পর্যন্ত ‘সেভডেট বে অ্যান্ড হিজ সন্স’ নামে প্রকাশিত হয়।
প্রশ্ন : সেটা তো ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়নি।
পামুক : এই উপন্যাস পারিবারিক কাহিনিকে কেন্দ্র করে, থমাস মানের বাডেনব্রুক্স কিংবা ফোরসাইট সাগার মতো। লেখার পর আফসোস হয়েছিল, মনে হয়েছিল পুরানা ধাঁচের উপন্যাস লিখছি। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের দিকে ভাবা শুরু করলাম যে আমাকে একজন আধুনিক লেখক হতে হবে। এরই মধ্যে ত্রিশ বছর বয়সে উপন্যাসটা যখন শেষপর্যন্ত বের হয়, ততদিনে লেখা অনেক নিরীক্ষাধর্মী হয়ে উঠেছিল।
প্রশ্ন : এই আধুনিক, নিরীক্ষাধর্মী হয়ে উঠতে চাওয়ার পেছনে কারো প্রভাব ছিল?
পামুক : ওই সময়ে মহান লেখক বলতে যা বুঝতাম, সেই তালিকায় তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, স্টেন্ডহ্যাল অথবা থমাস মান ছিল না আর। আমার হিরোরা ছিল ভার্জিনিয়া উলফ আর ফকনার। এখন সেই তালিকায় আরও দুইজন যোগ করতে চাই — প্রুস্ত এবং নবোকভ।
প্রশ্ন : দ্য নিউ লাইফ বইয়ের শুরুর লাইন — ‘একদিন আমি একটা বই পড়লাম এবং সমগ্র জীবন বদলে গেল।’ কোন বইয়ের এমন প্রভাব ছিল আপনার ওপর?
পামুক : একুশ-বাইশ বছর বয়সে ‘দ্য সাউন্ড অ্যান্ড দ্য ফিউরি’ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। পেঙ্গুইনের এডিশনটা কিনেছিলাম, দুর্বল ইংরেজিজ্ঞান নিয়ে বইটা বোঝা বেশ কঠিন। কিন্তু এই বইটার বিস্ময়কর তার্কিশ অনুবাদ ছিল। ফলে তার্কিশ আর ইংরেজি বইটা টেবিলে পাশাপাশি রেখে একটা থেকে এক অনুচ্ছেদ, আরেকটা থেকে আরেকটা অনুচ্ছেদ পড়েছিলাম। বইটা দাগ কেটেছিল। নিজস্ব স্বর তৈরি হওয়া সেটারই ফল। তারপর থেকে আমি উত্তম পুরুষে লেখা শুরু করি। নামপুরুষে লেখার থেকে অন্য কেউ হয়ে লেখার ছন্দটা ভালো লাগে।
প্রশ্ন : প্রথম উপন্যাস বের হতে তো অনেক সময় লেগেছিল।
পামুক : বিশের কোঠায় আমার কোনো বন্ধু ছিল না, ইস্তানবুলের কোনো সাহিত্যদলের সাথেও ছিলাম না। বই প্রকাশ করার একমাত্র উপায় তুরস্কের কোনো সাহিত্যপ্রতিযোগিতায় পাণ্ডুলিপি জমা দেয়া। তাই করলাম, এবং পুরস্কারটা পেলাম। ভালো, বড় একটা প্রকাশনা সংস্থা সেটা। সেই সময় তুরস্কের অর্থনীতি খুব খারাপ যাচ্ছিল। তারা বলল, চুক্তি হবে — কিন্তু উপন্যাসটা বের হতে একটু দেরি হতে পারে।
প্রশ্ন : দ্বিতীয় উপন্যাস বেশ দ্রুতই বের হয়।
পামুক : দ্বিতীয় বইটা রাজনৈতিক ঘরানার। প্রোপ্যাগান্ডা না। প্রথম বই বের হওয়ার আগেই এটা লিখা শুরু করেছিলাম, দুই/আড়াই বছর লাগে শেষ করতে। হুট করে ১৯৮০ সালের এক রাতে মিলিট্যারি ক্যু হয়। পরের দিন প্রথম বইয়ের প্রকাশ; আমাকে বলল, বই প্রকাশিত হবে না। চুক্তি থাকা সত্ত্বেও। তখন বললাম, আমার দ্বিতীয় বইটাও আর পাঁচ-ছয় বছরে প্রকাশ করা সম্ভব না, কারণ মিলিট্যারি অনুমতি দিবে না। তাহলে ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় : বিশের শুরুতে ভাবতাম বই বের করব, উপন্যাসিক হব এবং সাত বছর ধরে একটা উপন্যাস লিখলাম। কিন্তু প্রায় ত্রিশে পৌঁছানোর পর বুঝলাম কিছু প্রকাশ করার সম্ভাবনা নাই। আড়াইশো পৃষ্ঠার ওই অসমাপ্ত উপন্যাসটা এখনো ড্রয়ারে পড়ে আছে।
যেহেতু হতাশ হইতে চাই নাই, মিলিট্যারি ক্যু’র ঠিক পরে তৃতীয় উপন্যাসটা লিখি — ‘দ্য সাইলেন্ট হাউজ’ নামের। বিরাশি সালে প্রথম উপন্যাস বের হওয়ার সময় আমি এই উপন্যাসের উপর কাজ করছিলাম। সেভডেট বেশ সাড়া ফ্যালে, যার মানে আরও বই প্রকাশ করতে পারব। তাই আমার প্রকাশিত দ্বিতীয় বইটা আসলে তৃতীয় বই।
প্রশ্ন : মিলিট্যারি শাসনের সময় আপনার বই প্রকাশ করা হয় নাই কী কারণে?
পামুক : চরিত্রগুলা সব ছিল সমাজের উঁচুশ্রেণির মার্ক্সিস্ট। তাঁদের বাবা-মা’রা হয়তো গ্রীষ্ম-অবকাশযাপনকেন্দ্রগুলোতে যেত, তাঁদের বিশাল বাড়ি আছে এবং মার্ক্সিস্ট হওয়াটা তারা উপভোগ করত। তারা একজন আরেকজনকে দেখতে পারত না, ভীষণ পরশ্রীকাতর আর ছক কষত কীভাবে প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করা যায়।
প্রশ্ন : সংঘবদ্ধ বৈপ্লবিক দল?
পামুক : উচ্চবিত্ত তরুণেরা যারা ধনীদের জীবনযাপনে অভ্যস্ত, তারা আল্ট্রার্যাডিক্যাল হওয়ার ভাব ধরত। কিন্তু কোনো নৈতিক বিচারে যাইনি তাদের নিয়ে। শুধু আমার তারুণ্যকে একটু রোম্যান্টিসাইজ করছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে বোমা মারা হলে অবশ্যই আমার বই নিষিদ্ধ করা হবে ধরনের।
তো এই উপন্যাসটা শেষ করিনি। এবং বই লিখলে সবাই বদলে যায়, আগের ব্যক্তিতে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। একটা লেখকের বইটা আসলে তার ক্রমবিকাশের নির্দিষ্ট সময়ের ছাপ। একজনের উপন্যাসকে তার সেই সময়ের আত্মের স্মারক হিশেবে ধরে নেয়া যায়। ফলে সেখানে আর কখনোই ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। কথাসাহিত্যের ওই স্থিতিস্থাপকতার মৃত্যু হলে, তা আর সচল রাখা সম্ভব না।
প্রশ্ন : আপনি যখন কোনো ভাব নিয়ে নিরীক্ষা শুরু করেন, ফর্মটা কীভাবে নির্বাচন করা হয়? ইমেইজ দিয়ে শুরু করেন, বাক্য দ্বারা?
পামুক : ধ্রুব কোনো সূত্র তো নাই। কিন্তু নিশ্চিত করি একই কাঠামোতে যাতে দুটা উপন্যাস না লিখা হয়। অনেক পাঠক অভিযোগ করেন, আপনার অমুক উপন্যাসটা অনেক ভালো লাগছে, কিন্তু অন্যগুলো অত ভালো হয় নাই। কিংবা, আমার কখনোই আপনার কোনো উপন্যাস ভালো লাগে নাই অমুকটা লেখা পর্যন্ত। ব্ল্যাক বুক সম্পর্কে এই কথাটা সবচেয়ে বেশি শুনি। এটা শুনতে বিরক্ত লাগে। আঙ্গিক, শৈলী, ভাষা, আমেজ, কিংবা ব্যক্তিরূপ নিয়ে পরীক্ষা করা খুবই আনন্দের, চ্যালেঞ্জের মতো। প্রত্যেকটা বই নিয়ে আলাদাভাবে ভাবি।
বইয়ের বিষয়বস্তুর উৎস নানা জায়গা থেকে হতে পারে। মাই নেইম ইজ রেড-এ নিজের চিত্রশিল্পী হওয়ার বাসনা থেকে লিখতে চাইছিলাম। ফল্স্ স্টার্ট হয়েছিল। মানে প্রথমে একজন চিত্রশিল্পীর মনোগ্রাফিক বই লেখা শুরু করেছিলাম। পরে এক চিত্রশালার নানা চিত্রশিল্পীর ওপর ভিত্তি করে লিখলাম। দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলে গেল, কারণ সেখানে অন্য চিত্রশিল্পীরাও কথা বলছে। প্রথমে ভাবছিলাম সমসাময়িক চিত্রশিল্পীদের নিয়ে লিখব, কিন্তু পরে মনে হলো তুরস্কের চিত্রশিল্পীরা খুব বেশি পশ্চিমপ্রভাবিত সামগ্রিক জায়গা থেকে, ফলে আমি মিনিয়েচারিস্টদের নিয়ে লেখা শুরু করলাম। আর এইভাবেই বিষয়টা পেয়ে গেলাম।
ভিন্ন চরিত্রগুলোই গল্পটা বলার প্রয়োজনীয় কৌশল আর উদ্ভাবনীগুলো বাতলে দিলো। যেমন বলা যায়, মাঝে মাঝে কেউ হয়তো কিছু দেখে, প’ড়ে, কিংবা কোনো মুভি দেখতে গিয়ে বা পত্রিকা পড়ে মনে করল সে একটা আলুকে দিয়ে কথা বলাবে, কিংবা একটা কুকুর বা গাছকে দিয়ে। একবার এ-রকম কিছু পেয়ে গেলে উপন্যাসের সিমেট্রি আর ধারাবাহিকতার ভাবনাটা মাথায় আসা শুরু করবে; এবং মনে হয় — বিস্ময়কর! এইভাবে আগে কেউ তো করে নাই!
একেবারে শেষে বলা যায়, জিনিশগুলো নিয়ে বছরের পর বছর চিন্তা করি। হয়তো কিছু মনে হচ্ছে এ-রকম, কাছের বন্ধুদের ডেকে বলব কথাটা। আমার সাথে প্রচুর নোটবুক রাখি এই ভেবে যে যে-কোনো সময় উপন্যাস লেখা দরকার হতে পারে। হয়তো লিখি না, কিন্তু একবার নোট নেয়া শুরু করলে উপন্যাসটা লেখার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই হয়তো একটা উপন্যাস লিখছি যেটার একেবারে গভীরে ডুবে আছি এবং দুই মাস পর সেটা শেষ করে অন্যটা লেখা শুরু করি।
.
প্রশ্ন : অনেক উপন্যাসিক তাঁর কাজের অগ্রগতি নিয়ে কোনো আলোচনা করেন না। আপনার কাছেও সেটা কি গোপনীয়?
পামুক : গল্পটা নিয়ে কখনো আলোচনা করি না। আনুষ্ঠানিক জায়গাগুলোতে, যেখানে কিছু বলতেই হয়, তার জন্যে একটা বাক্য আছে আমার — সমসাময়িক তুরস্ক নিয়ে উপন্যাস। খুব কম মানুষের সামনে আমি প্রকাশ করি ব্যাপারগুলো, যারা আমাকে হয়তো কোনো কষ্ট দিবে না। যেটা করা হয় সেটা হলো, মানুষজন কথা বলতে পারে এমন ব্যাপার নিয়ে গিমিক করি তাদের রিয়্যাকশন দ্যাখার জন্যে। একটা খুবই শিশুতোষ যদিও। ইস্তানবুল লেখার সময় অনেকবার করছি এটা। বাচ্চা যখন তার বুদ্ধি দেখাতে চায় বাবাকে, এক্ষেত্রে আমার মনও তেমন।
প্রশ্ন : গিমিক শব্দটার তো একটা নেতিবাচক অর্থ আছে।
পামুক : আপনি গিমিক দিয়ে শুরু করলেন, কিন্তু যদি এর সাহিত্যিক এবং নৈতিক গুরুত্বে বিশ্বাস করেন — শেষমেশ এটা নতুন উদ্ভাবনী হিশেবে দাঁড়ায়। সাহিত্য-বিবৃতির মতো।
প্রশ্ন : সমালোচকেরা আপনার উপন্যাসকে পোস্টমডার্ন ঘরানায় ফেলতে চান। যা-ই হোক, আমার কাছে মনে হয়, খুব ট্র্যাডিশনাল উৎস থেকেই বর্ণনাভঙ্গিটা আয়ত্ত করেন। আপনি ‘দ্য থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস’ এবং আরও অনেক প্রাচ্য ঐতিহ্যের ক্ল্যাসিক থেকে উদ্ধৃত করেন।
পামুক : সেটা শুরু হয়েছিল ব্ল্যাক বুক থেকে, যদিও তার আগেই আমি বোর্হেস আর ক্যালভিনোর সাথে পরিচিত হয়েছি। ১৯৮৫ সালে আমার স্ত্রীর সাথে যুক্তরাষ্ট্রে যাই। সেখানে গিয়ে প্রথম অ্যামেরিকান সংস্কৃতির বিশিষ্টতা আর বিশাল ঐশ্বর্যের সাথে পরিচিত হই। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা একজন টার্ক হিশেবে নিজের লেখকসত্তাকে প্রতিষ্ঠা করাতে গিয়ে বিচলিত হয়ে পড়ি। ফলে নিজের ‘শেকড়’-এ প্রত্যাবর্তন করতে হলো। উপলব্ধি করলাম আমার প্রজন্মের জন্যে একটা আধুনিক জাতীয় সাহিত্যধারা আবিষ্কার করতে হবে।
বোর্হেস এবং ক্যালভিনো আমাকে সেই অবস্থা থেকে মুক্তি দেন। ইসলামিক সাহিত্য-ঐতিহ্যের একটা প্রতিক্রিয়াশীল, খুব রাজনৈতিক অর্থ আছে, যেটা রক্ষণশীলরা খুব পুরনো কায়দায় চর্চা করত। আমার কখনোই মনে হয় নাই এখান থেকে ভালো কিছু করা সম্ভব। কিন্তু স্টেইটসে যাওয়ার পর আমি বোর্হেস আর ক্যালভিনোর মানসিক কাঠামোটা বুঝতে সক্ষম হই। আমাকে ধর্মীয় আর সাহিত্যসম্বন্ধীয় ভাবার্থগুলোকে আলাদা করে নিতে হয়েছে। এতে আমি খেলার টাকা, গিমিক আর প্যারাবলগুলো মানানসই করে নিতে পারি। অলংকারসাহিত্যের খুব উঁচুদরের ঐতিহ্য তুরস্কের ছিল। কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধ লেখকেরা তখন আমাদের এই প্রকারের উদ্ভাবনী আধেয়গুলোকে শূন্য করে দিছিল।
চিন, ভারত, পার্সিয়ার মুখে মুখে গল্পবলার ঐতিহ্যে অনেক উপমা বারবার ঘুরেফিরে আসে। সিদ্ধান্ত নিলাম সেগুলোকে সমসাময়িক ইস্তানবুলের প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করব। দ্যা ব্ল্যাক বুক ছিল ডাডাইস্ট কোলাজের মতন, মানে অনেকগুলো জিনিশ একসাথে স্থাপন করা হয়েছে। মাঝেমাঝে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, আবার হয়তো সেখান থেকে নতুন কিছু বের হয়ে আসে। পুনঃপুনঃ-লেখা এই গল্পগুলোকে আমি একটা গোয়েন্দা গল্পের কাঠামোতে বসাই। ব্ল্যাক বুক এভাবেই লিখা হইছে। কিন্তু এর উৎসে আছে অ্যামেরিকান সংস্কৃতি আর একজন লেখক হিশেবে নিরীক্ষাধর্মী প্রবণতা। তুরস্কের সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে আমার মতামত লিখতে পারতাম না, আমি তাদের দ্বারা আতঙ্কিত ছিলাম। তাই ভিন্ন কিছু ভাবতে হয়েছে।
প্রশ্ন : সাহিত্য দিয়ে আপনার রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচারের চেষ্টা করেছেন কখনো?
পামুক : না। আমি সবসময়ই এই ব্যাপারে খুব প্রতিক্রিয়া দেখাতাম, বিশেষ করে আশির দশকের লেখকদের প্রতি। সম্মানপূর্বক বলছি — উনাদের বিষয়বস্তু অপ্রশস্ত এবং সংকীর্ণ।
প্রশ্ন : ব্ল্যাক বুক-এর আগে যাওয়া যাক। দ্য হোয়াইট ক্যাসেল লেখার অনুপ্রেরণা কি ছিল? এটা আপনার প্রথম উপন্যাস যেখানে একটা থিম পুরো উপন্যাসজুড়ে ঘুরেফিরে আসে — নানা ভঙ্গিতে। আপনার লেখায় এই ব্যাপারটা প্রায়ই লক্ষ করা যায়।
পামুক : এটা খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার একজন পিঠাপিঠি ভাই আছে যে আমার থেকে আঠারো মাসের বড়। একদিক থেকে সে আমার বাবা — আমার ফ্রয়েডিয়ান বাবা। সে ছিল পামুকের অল্টার ইগো — কর্তৃত্বের প্রতিভূ। আরেকদিক থেকে আমাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতামূলক এবং ভাই-ভাই কমরেডশিপও ছিল। খুবই জটিল ব্যাপারটা। ইস্তানবুলে এই ব্যাপারটা আমি বারবার বলার চেষ্টা করছি। আমি ছিলাম খুবই সাদামাটা একজন তার্কিশ ছেলে, যে কী না ভালো ফুটবল খেলতে পারে এবং যে-কোনো ধরেনর প্রতিযোগিতা আর খেলাধুলায় আগ্রহী। বড়ভাই আমার থেকে সফল ছিল স্কুলে। পরস্পরের ভেতর এক-ধরনের দ্বন্দ্ব কাজ করত এসব নিয়ে। সে পরিমিতিবোধসম্পন্ন ছিল এবং দায়িত্বশীল — বড়রা এভাবেই বলতেন। আমি যখন খেলাধুলায় মন দেয়া শুরু করলাম, সে মন দিলো নিয়ম-কানুনের দিকে। সবসময় আমাদের মধ্যে উত্তেজনা কাজ করত। আমি সবসময়ই তার মতো হতে চাইতাম, তার আদলে। হিংসা, ঈর্ষা আমার আন্তরিক অনুভূতি। মাঝেমাঝে ভাবি ভাইয়ের শক্তি আর সাফল্য আমার ওপর কতটা প্রভাব ফেলছে। এটা আত্মের অংশ। সেটা নিয়ে সচেতন থাকার কারণে একটা সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় ‘আমি’ থেকে সেই অনুভূতিগুলো আলাদা রাখতে। জানি সেগুলো খারাপ, তাই একজন সভ্য মানুষ হিশেবে সেগুলোর বিরুদ্ধতা করার অভিপ্রায় থাকে। এবং অবশ্যই, সেগুলোই আমার গল্পের বিষয়বস্তু। য়োয়াইট ক্যাসেলের প্রধান দুই চরিত্রের স্যাডোম্যাসোকিস্ট সম্পর্কটার ভিত্তি আমার সাথে ভাইয়ের সম্পর্ক।
অন্যদিক থেকে, তুর্কিরা যখন পশ্চিমের মুখোমুখি হয়ে নিজেদের ভঙ্গুরতা উপলব্ধি করে, অন্যের ভূমিকায় অভিনয় করার এই ব্যাপারটা তখন প্রতিফলিত হয়। এই উপন্যাসটা শেষ করার পর বুঝতে পারলাম উদ্বিগ্নতা আর ঈর্ষার এই রূপটা আসলে তুরস্কের সাথে পশ্চিমের সম্পর্কটা তুলে ধরে। মানে জিনিশটা দাঁড়ায়, পশ্চিমা হতে চাচ্ছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খাঁটি পশ্চিমাও হতে পারছি না। চেষ্টা করছি পশ্চিমের স্পিরিটটাকে ধরতে, কিন্তু আবার অনুকরণের ব্যাপারটা নিয়ে দোষী-দোষীও লাগছে নিজেকে। এই উত্থান-পতনের আমেজটা আসলে দুই প্রতিযোগী ভাইয়ের স্মৃতি বহনকারী।
প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয়? তুরস্কে পূর্ব-পশ্চিমের তাড়নাজনিত এই ক্রমসংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব?
পামুক : আমি আশাবাদী। একই সাথে দুই ধারণা, দুই সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করার মধ্যে দুশ্চিন্তার কিছু দেখি না। সিজোফ্রেনিয়া আপনাকে বুদ্ধিমান করে তোলে। বাস্তবতার সাথে হয়তো সম্পর্ক হারাতে পারেন — কিন্তু একজন কথাসাহিত্যিক হিশেবে মনে হয় এর ভেতরে খারাপ কিছু নাই — কিন্তু আপনার সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে চিন্তার কিছু নাই। আপনি যদি বারবার ভাবেন আপনার এক অংশ আরেক অংশকে হত্যা করবে, তাহলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। সেটা রোগটার থেকেও খারাপ। এটাই আমার থিওরি যা আমি তার্কিশ রাজনীতিতে প্রচার করার চেষ্টা করি, যেখানে ধরে নেয়া হয় দেশের ভেতর শুধু এক স্থির আত্মাই থাকবে এবং তাকে অবশ্যই প্রাচ্য, পশ্চিম কিংবা জাতীয়তাবাদ — এ-রকম একটাকিছু বেছে নিতে হবে। এ-রকম অদ্বৈতবাদী ধারণার সাথে একমত না।
প্রশ্ন : তুরস্কে আপনার এই ধারণাকে কীভাবে নেয়া হচ্ছে?
পামুক : যত বেশি গণতন্ত্র, উদারতাবাদ সম্পর্কে মানুষ সচেতন হচ্ছেন — ততই আমার চিন্তাভাবনা গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। তুরস্ক এই দূরদৃষ্টি নিয়েই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিতে পারে। এটা জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার মতো, কিংবা ইউএসের রেটোরিকের বিরুদ্ধে তাদের মুখোমুখি হওয়া।
প্রশ্ন : এবং তারপরেও ইস্তানবুল পড়ে মনে হয় — আপনার শহরকে রোম্যান্টিসাইজ করার পেছনে ওসমানিয় সাম্রাজ্যের পতনের কষ্ট অনেকটাই মুখ্য।
পামুক : আমি কখনোই শোকাহত না। আমি পশ্চিমের গুণগ্রাহী। খুশি যে পাশ্চাত্যকরণ হয়েছিল। আমার সমালোচনা শুধু সেই রুলিং এলিটদের — মানে আমলাতন্ত্র এবং নব্য ধনীদের উপর, এবং তারা পাশ্চাত্যকরণ বলতে যা বুঝেছে সেটার প্রতি। স্বীয় প্রতীক আর আচারানুষ্ঠানের ঐশ্বর্যের উপর ভিত্তি করে জাতীয় সংস্কৃতি গঠনের আত্মবিশ্বাস তাদের ছিল না। তারা কখনো চেষ্টা করে নাই প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের একটা প্রণালি তৈরি করতে, শুধু পাশাপাশি দুটা জিনিশ একসাথে রেখে দিছে। অবশ্যই শক্তিশালী ওসমানীয় সংস্কৃতি ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তার ঔজ্জ্বল্য কমে আসছিল। তাদের যেটা করা উচিত ছিল এবং যা করে নাই তা হলো অতীতের প্রাচ্য আর বর্তমানের পশ্চিমের ভেতর দৃঢ় একটা স্থানীয় সংস্কৃতি সৃষ্টি করা : যেটার সমন্বিত বৈশিষ্ট্য থাকবে, অনুকরণ না। একই জিনিশ আমার বইয়ের ভেতরে করার চেষ্টা করি। ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিলে তার্কিশ আত্মপরিচয়ের কোনো ক্ষতি হবে না, বরং তার্কিশ সংস্কৃতির বিকাশ হবে বলে মনে করি। এটা আমাদের স্বাধীনতা এবং আত্মবিশ্বাসের সীমানা বাড়িয়ে দিবে। ফলে তার্কিশ সংস্কৃতির নতুন রূপ আবিষ্কার করতে পারব। আমার ধারণা পরবর্তী প্রজন্ম তা করবে। দাসের মতো পশ্চিমাদের কিংবা মৃত ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অনুকরণ কোনো সমাধান আনবে না। এসব নিয়ে কিছু করতে হবে যাতে তাদের মতো একজন হয়ে যাওয়া নিয়ে উৎকণ্ঠা কাজ না করে।
প্রশ্ন : ইস্তানবুল পড়ে কিন্তু মনে হয় আপনি একজন বিদেশি, পশ্চিমার দৃষ্টি দিয়ে নিজের শহরের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে আছেন।
পামুক : কিন্তু আমি এটাও ব্যাখ্যা করেছি কেন তার্কিশ বুদ্ধিজীবী পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে তাকান — ইস্তানবুলের শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াটা পশ্চিমের সাথে যুক্ত। দ্বিবিভাজনটা সবসময়ই ছিল, আপনি প্রাচ্যের ক্রোধের জায়গা থেকেও তাকাতে পারেন। সবাই কমবেশি পশ্চিমা, সবাই আবার প্রাচ্যের। বলা যায় একটা ক্রমবিনিময়। এডওয়ার্ড সেঈদের অরিয়েন্টালিজমের ভাবটা ভালো লাগে, কিন্তু তুরস্ক যেহেতু কখনোই উপনিবেশ ছিল না, তাই রোম্যান্টিসাইজ করতে কোনো সমস্যা নাই। পশ্চিমারা আমাদেরকে কখনোই সেভাবে অপদস্থ করে নাই, যেভাবে করা হয়েছে ভারতীয়দের কিংবা আরবদের। ইস্তানবুল দখল করা হয়েছিল দুই বছরের জন্যে। শত্রুর নৌকাগুলো যেভাবে এসছিল, সেভাবেই চলে গেছে জাতীয় উদ্যমে কোনো গভীর ক্ষত তৈরি করা ছাড়াই। যা ক্ষত সৃষ্টি করেছে সেটা হচ্ছে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন। তাই আমার সেই উৎকণ্ঠাটা নাই যাতে মনে হয় কেউ আমাকে নিচু চোখে দেখছে। তবে রিপাব্লিক প্রতিষ্ঠার পর তুরস্ককে পাশ্চাত্যকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, বেশিদূর আগানো সম্ভব হয়নি। ফলে একটা সাংস্কৃতিক হীনতাভাব গেড়ে বসে, যেটা মাঝেমাঝে আমারও থাকতে পারে।
অন্যদিক থেকে, ক্ষতচিহ্ন এতটাও গভীর না যতটা দুইশত বছরের শাসনের ফলে হয়েছে কলোনিগুলোতে। তুর্করা কখনো পশ্চিমা শক্তি দ্বারা অত্যাচারিত ছিল না। যে অত্যাচারের যন্ত্রণা তুর্করা ভোগ করছে তা স্বআরোপিত। আমরা নিজেদের ইতিহাস মুছে ফেলছি কারণ এটা খুবই বাস্তবিক ছিল। এই ধরনের দমনে ভঙ্গুরতা থাকে, কিন্তু স্বআরোপিত পাশ্চাত্যকরণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ভারতীয়রা তাদের অত্যাচারকারীদের সামনাসামনি দেখছে। তুরস্ক খুব অদ্ভুতভাবে পশ্চিমা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন যাদেরকে তারা কী না অনুকরণ করেছিল। পঞ্চাশ এমনকি ষাটের দশকেও কোনো পশ্চিমা ইস্তানবুল হিল্টনে অবস্থান করলে সেই খবর সকল পত্রিকায় ছাপা হতো।
প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয় কোনো ক্যানোন আছে বা কখনো ছিল? আমরা পাশ্চাত্যের ক্যানোনের কথা শুনেছি, কিন্তু অ-পশ্চিমা ক্যানোন সম্পর্কে কিছু বলবেন?
পামুক : হ্যাঁ। আরেকটা ক্যানোন আছে। এর ভেতরটা খুঁজে দেখতে হবে, ক্রমোন্নত, আলোচনা করতে হবে এবং গ্রহণ করতে হবে। এই মুহূর্তে প্রাচ্যের ক্যানোনগুলো ধ্বংসের কাছাকাছি। গৌরবময় টেক্সটগুলো এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে, কিন্তু একত্র করার কেউ নাই। পার্সিয়ান ক্ল্যাসিক থেকে শুরু করে ভারতীয়, চৈনিক এবং জাপানিজ টেক্সটগুলোর সমালোচনামূলক বিচার করতে হবে। ক্যানোন সব এখন পশ্চিমা স্কলারদের হাতে। সেটাই বিতরণ আর যোগাযোগের কেন্দ্র।
প্রশ্ন : উপন্যাস তো খুবই পশ্চিমা সাংস্কৃতিক ফর্ম। প্রাচ্যের ঐতিহ্যে এর স্থান কোথায়?
পামুক : আধুনিক উপন্যাস মহাকাব্য থেকে আলাদা হয়ে ওঠা নন-ওরিয়েন্টাল প্রপঞ্চ। কারণ উপন্যাসিক হচ্ছেন এমন একজন যিনি কোনো গোত্রভুক্ত নন, যিনি সমাজের মৌলিক প্রবণতাগুলোর অংশ নন, এবং যিনি ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে সব চিন্তা এবং বিচার করছেন; মানে যে-সংস্কৃতি তার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বাইরের। একবার চেতনা যখন গোত্রবদ্ধতা থেকে বের হয়ে আসে, যেখানে তার বাস, সে নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠে। তার লেখার ঐশ্বর্য ওই বহিরাগতের গুপ্ত দর্শনশক্তি থেকেই উৎসারিত।
একবার কেউ যদি সেই দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবী দেখতে পারেন, এবং সেইভাবে লিখেন, তাহলে সে-ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এই মডেল মাথায় রেখেই আমি স্নো লিখা শুরু করি।
প্রশ্ন : স্নো আপনার প্রকাশিত সবচেয়ে রাজনৈতিক বই। এর ভাবনাটা কীভাবে আসলো?
পামুক : নব্বইয়ের মাঝামাঝিতে যখন জনপ্রিয় হয়ে উঠি, কুর্দিস গেরিলাদের বিপক্ষে যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। পুরনো বাম আর আধুনিক উদারতাবাদীরা চাইতেন, যাতে পিটিশনে স্বাক্ষর করে তাদের সাহায্য করি। আমাকে এমন সব রাজনৈতিক কাজ করার প্রস্তাব দেয়া শুরু করল যার সাথে আমার লেখালেখির কোনো ধরনের সম্পর্ক নাই।
খুব শিঘ্রি এশটাব্লিশমেন্ট আমার চরিত্রহননে নেমে প্রতিআক্রমণ শুরু করে। আমাকে আজেবাজে নামে ডাকা শুরু হয়। খুবই ক্রোধান্বিত হয়ে উঠছিলাম। পরে অবাক হয়ে ভাবছিলাম নিজের আত্মিক সংকট নিয়ে একটা রাজনৈতিক উপন্যাস লিখলে ক্যামন হয়! যেখানে উচ্চমধ্যবিত্ত জায়গা থেকে সংকটগুলোকে অনুসন্ধান করে দ্যাখা হবে। যাদের রাজনৈতিক কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই তাদের প্রতি একটা দায়িত্ব অনুভব করছিলাম। উপন্যাসের শিল্পরূপে আমার আস্থা আছে। খুব অদ্ভুতভাবে তা যে-কাউকে বহিরাগত করে ফেলবে। তারপর ভাবলাম রাজনৈতিক উপন্যাস লিখব। মাই নেইম ইজ রেড লেখা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আমি শুরু করি লেখা।
প্রশ্ন : কার্সের মতো ছোট একটা শহরকে কেন বেছে নেয়া হলো উপন্যাসের জন্যে?
পামুক : শহরটা তুরস্কের অন্যতম ঠাণ্ডা শহর বলে কুখ্যাত। এবং সবচেয়ে গরিব। আশির শুরুর দিকের বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পাতায় কার্সের দারিদ্র্য নিয়ে রিপোর্ট থাকত। কেউ-একজন হিশেব করছিল পুরো শহরটাকে মোটামুটি একমিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে ফ্যালা সম্ভব। আমি যখন যেতে চাইলাম সেখানকার রাজনৈতিক অবস্থা বেশ সংকটজনক। শহরের নিকটবর্তী অঞ্চলগুলোতে কুর্দরা থাকত বেশিরভাগ, কিন্তু কেন্দ্রে ছিল কুর্দ, আজারবাইজানের লোকজন, তুর্ক এবং আরও অনেকে। সেখানে জার্মান আর রাশিয়ানরাও থাকত। ধর্মীয় পার্থক্যও ছিল — শিয়া আর সুন্নি। তুরস্কের সরকার এত হিংস্রভাবে কুর্দ গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল যে ট্যুরিস্ট হিশেবে যাওয়া ছিল অসম্ভব। উপন্যাসিক হিশেবে আমার সেখানে যাওয়া সম্ভব ছিল না, ফলে পত্রিকার একজন সম্পাদকের দারস্থ হয়ে তার কাছে থেকে প্রেস পাস নেই জায়গাটা ঘুরে দ্যাখার জন্যে। সে প্রভাবশালী ছিল এবং আমি যে যাচ্ছি সেটা নিজে ফোন দিয়ে শহরের মেয়র আর পুলিসকে জানিয়েছিল।
ওইখানে পৌঁছিয়েই সেখানকার মেয়র আর পুলিসপ্রধানের সাথে দ্যাখা করে হাত মিলাই যাতে রাস্তা থেকে আমাকে তুলে নিয়ে না যায়। আসলে, বেশকিছু পুলিস যারা জানত না আমি ওইখানে আছি, আমাকে তুলে নিয়ে গেছিল টর্চারের উদ্দেশ্যে। খুব দ্রুত আমার পরিচয় দেই তারপর বলি মেয়রকে চিনি, চিফকে চিনি… খুবই সন্দেহজনক চরিত্র ছিলাম। যদিও তাত্ত্বিকভাবে তুরস্ক স্বাধীন দেশ, কিন্তু নিরানব্বইয়ের আগ পর্যন্ত যে-কোনো বিদেশিকেই সন্দেহের তালিকায় রাখা হতো। আশাপ্রদ এ-ই, সাম্প্রতিক সময়ের অবস্থা আগের থেকে অনেক সহজ।
প্রায় সব চরিত্র এবং স্থানের বর্ণনা বাস্তব থেকেই নেয়া হয়েছে। যেমন বলা যায়, স্থানীয় যে পত্রিকাটা প্রতিদিন আড়াইশো কপি বিক্রি হয় তা সত্য। আমি কার্সে গিয়েছিলাম একটা ভিডিওক্যামেরা নিয়ে। আমি সব ভিডিও করছিলাম এবং তারপর সেগুলো এনে বন্ধুদের দেখিয়েছি। সবাই ভাবছে আমি পাগল হয়ে গেছি। এছাড়াও আরও অনেককিছু হয়েছিল। যেমন এক জায়গায় এক পত্রিকার সম্পাদক ‘কা’-কে বলে কা গতকাল কী করছিল সারাদিন। কা অবাক হয়ে বলে, সে কীভাবে জানল! সম্পাদক উত্তর দেয়, সে আসলে পুলিসের ওয়াকিটকি শুনছিল এবং পুলিস সারাদিন ‘কা’-এর পেছনেই ছিল। পুলিস এভাবে আমাকেও ফলো করেছে।
স্থানীয় এক উপস্থাপক আমাকে টিভিতে দেখিয়ে বলল, আমাদের বিখ্যাত লেখক জাতীয় পত্রিকার জন্যে একটা আর্টিকেল লিখছেন। এটা সহায়ক ছিল। মিউনিসিপ্যাল ইলেকশন যেহেতু কাছেই ছিল, তাই কার্সের লোকজন আমার জন্যে তাদের দরোজা খুলে দিলো। তারা সরকারকে জানাতে চাচ্ছিল তারা গত গরিব। জানত না আমি আসলে উপন্যাস লিখছি, ভাবছে আর্টিকেল লিখব। স্বীকার করি, এ-রকম করাটা বিবেচনাপ্রসূত হয়নি। যদিও আমি ভাবছিলাম আর্টিকেল লিখলেও মন্দ হয় না।
ছোটাছুটি করতে করতে চার বছর চলে গেল। ছোট্ট একটা কফিশপে আমি প্রায়ই লেখালেখি করতাম এবং খসড়া তৈরি করতাম। আমার সাথে একজন ফটোগ্রাফার বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিলাম কার্সের তুষারপাতের ছবি তোলার জন্যে। একদিন সে শুনতে পেল কফিশপে কেউ আলাপ করতেছে — কী আর্টিকেল লিখে যে এত সময় লাগতেছে। তিন বছর হয়ে গেছিল প্রায়, উপন্যাস লেখার জন্যে যথেষ্ট। তা না হলে হয়তো সবাই বুঝে যেত।
প্রশ্ন : বই প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়া ক্যামন ছিল?
পামুক : তুরস্কে রক্ষণশীল এবং রাজনৈতিক ইস্লামিস্ট — কেউই খুব-একটা খুশি হতে পারে নাই, যদিও তারা চায় নাই বই ব্যান কিংবা সরাসরি আঘাত করতে। কিন্তু নিয়মিত কলাম লেখা শুরু করে জাতীয় পত্রিকাগুলোতে। সেকুলাররা অখুশি কারণ আমি লিখছিলাম তুরস্কে সেকুলার র্যাডিক্যাল হতে গেলে তার বিনিময়ে সবাই ভুলে যায় তাদের একজন ডেমোক্র্যাটও হতে হবে। তুরস্কে সেকুল্যারদের শক্তিটা প্রধানত আর্মি থেকে আসে। এটা তুরস্কের গণতন্ত্র আর সহনশীলতার সংস্কৃতিটা ধ্বংস করে দিছে। আর্মির প্রতি একেবারে বেশি নির্ভরশীল হয়ে গেলে সবাই আত্নবিশ্বাসটা হারাতে শুরু করে, আর সবকিছুতেই সেনাবাহিনীকে টেনে নিয়ে আসে। লোকজন বলে, দেশ আর দেশের অর্থনীতির অবস্থা খুব খারাপ, সেনাবাহিনী এসে সব ঠিক করুক। তারা সবকিছু ঠিকঠাক করার সাথে সাথে সহনশীলতার জায়গাটাও ধ্বংস করে দেয়। অনেক সন্দেহভাজনকে অত্যাচার করা হয়েছে, হাজার হাজার মানুষকে জেলে পুরা হয়েছে। এটাই নতুন মিলিটারি ক্যু-র রাস্তাটা তৈরি করে দেয়। প্রায় দশ বছর অন্তর অন্তর একই কাহিনি। সেজন্যে সেক্যুলারিস্টদের প্রতি একটা সমালোচনামূলক মনোভাব রাখছিলাম। আমি যে ইস্লামিস্টদের মানুষের মতো করে দেখছি, এটাও তাদের ভালো লাগে নাই একেবারেই।
রাজনৈতিক ইসলামিকদের ভালো লাগে নাই কারণ আমি এমন-সব ইস্লামিস্টদের নিয়ে লিখছি যারা বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কে জড়ায়। এই ধরনের সরলীকরণ ছিল তাদের আমাকে নিয়ে। তারা আমাকে খুবই সন্দেহের চোখে দেখত কারণ তাদের সংস্কৃতি থেকে আমি আসি নাই এবং আমার কথাবার্তা চালচলন সব পশ্চিমের সুবিধাভোগী লোকজনের মতো। তাদের তো নিজেদেরই সমস্যা আছে প্রতিনিধিত্বের, তাহলে সে আমাদের নিয়ে লেখে কীভাবে? সে কিছুই বোঝে না। এই সংকটগুলোও উল্লেখ করছি উপন্যাসে।
কিন্তু আর বাড়িয়ে বলতে চাই না। আমি শেষপর্যন্ত টিকে ছিলাম। সবাই আমার বই পড়েছে। তারা হয়তো খুবই ক্রোধান্বিত, কিন্তু এটা ক্রমবর্ধমান উদারনৈতিক আচরণ যে সবাই আমার বই পড়ছে এবং আমাকে এবং বইকে মেনে নিছে। কার্সের পত্রিকাগুলার প্রতিক্রিয়াও মিশ্র ছিল। কেউ কেউ বলছে, হ্যাঁ ঠিক আছে। অন্যরা, বিশেষ করে তুরস্কের জাতীয়তাবাদীরা, খুবই বিচলিত ছিল আর্মেনিয়ানদের উল্লেখ থাকায়। ওই টেলিভিশন-উপস্থাপকটা, সে আমাকে বইটা প্রতীকী কালো ব্যাগে ভরে পাঠিয়েছিল এবং একটা প্রেস কনফারেন্সে দাবি করেছিল — এটা আর্মেনিয়ান প্রোপ্যাগান্ডা। কথাটা খুবই ভ্রান্তিপূর্ণ। আমাদের সংস্কৃতি এত জাতীয়তাবাদী আর সংকীর্ণ!
প্রশ্ন : বইটা কি কোনো বিশাল বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল রুশদির মতো?
পামুক : নাহ। একেবারেই না।
প্রশ্ন : এটা তো খুবই ধূসর, নৈরাশ্যবাদী বই। একমাত্র লোক ‘কা’ — যে কী-না সবার কথা শুনে, শেষপর্যন্ত সবার দ্বারা ঘৃণিত হয়।
পামুক : সম্ভবত উপন্যাসিক হিশেবে তুরস্কে আমার জায়গাটা খুব নাটকীয় করে ফেলছি। যদিও সে সবার অবজ্ঞার পাত্র হয়, তবুও সবার সাথে কথোপকথনের সুযোগটা সে রক্ষা করতে পারে। তার উদ্বর্তনের ইচ্ছাটাও প্রবল। কা’কে পরিত্যাগ করা হয় কারণ সবাই ধরে নেয় সে পশ্চিমা গোয়েন্দা, যেটা আমাকে বারবার ভাবা হয়েছে।
ধূসরতা সম্পর্কে আমি একমত। কিন্তু হিউমারও তো আছে। যখন আমাকে কেউ বলে বইটা খুবই নিরানন্দ, জিজ্ঞেস করি — এটা মজার না? আমার ধারণা এর মধ্যে হিউমার আছে। সেটাই আমার উদ্দেশ্য ছিল।
প্রশ্ন : উপন্যাসের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা তো নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন করেছে আপনাকে। এবং আরও সম্ভাবনাও আছে বিপদে পড়ার। আবেগের জায়গাগুলো থেকেই আপনি লিখছেন। কিন্তু খুব চড়া দাম দিতে হচ্ছে।
পামুক : হ্যাঁ, কিন্তু ব্যাপারটা খুবই চমৎকার। যখন ঘুরে বেড়াই নিজের ডেস্কে না থেকে, কিছুক্ষণ পরই আমি হতাশ হয়ে পড়ি। রুমে একা থাকা আমার পক্ষে সুখকর। শিল্প কিংবা শিল্পের কৌশল থেকে রুমে একাকী থাকার প্রতি দায়বদ্ধতাটা আমার জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই অভ্যাসটা রপ্ত করেছি। মগ্ন থাকি এই ভেবে, যা করছি একদিন তা প্রকাশিত হবে। এভাবেই আমার দিবাস্বপ্নগুলোকে ন্যায্যতা দেই। উন্নতমানের কাগজ আর ফাউন্টেইন পেনের সাথে আমার নির্জন মুহূর্ত দরকার, যেমন কারো হয়তো পিল দরকার তার স্বাস্থ্যের জন্যে। আমি এসবের প্রতি খুবই দায়বদ্ধ।
প্রশ্ন : তাহলে কার জন্যে লিখছেন আপনি?
পামুক : জীবন যত ছোট হয়ে আসছে, এই প্রশ্নটা আমার দিকে ততই ধেয়ে আসছে। সাতটা উপন্যাস লিখেছি আমি, আরও সাতটা লিখে যেতে চাই। কিন্তু, তারপরেও, জীবন কিন্তু ছোট। আরও উপভোগ করতে চাই। মাঝে মাঝে নিজেকে বোঝাতে হয় — কী করছি আমি, এসবের অর্থ কী? প্রথমটা যেমন বলেছি — একা থাকার সহজাত প্রবৃত্তি আমার আছে। দ্বিতীয়ত, আমার মধ্যে একটা প্রতিযোগী বালক বাস করে যে আরও ভালো বই লিখতে চায়। আমি লেখকের তুলনামূলক কম চিরস্থায়িত্বে বিশ্বাসী। দুইশো বছর আগে লেখা বইগুলোর খুব কমই আমরা পড়ে থাকি। সবকিছু এত দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে যে আজকে যে-বই বের হচ্ছে, তা একশো বছর পর পড়া হবে কী-না সন্দেহ। খুব কমই পড়া হবে। দুইশো বছর পর হয়তো আজকের সময়ের পাঁচটা বই পড়া হবে। আমি কি নিশ্চিত সেই পাঁচটা বইয়ের একটা আমি লিখছি? কিন্তু এটাই কি লেখালেখির অর্থ? দুইশো বছর পর আমার বই পড়া হবে কী হবে না এটা নিয়ে আমাকে কেন চিন্তা করতে হবে? জীবন নিয়ে চিন্তিত হওয়াই কি বেশি অর্থবহ না? না কী আমার সেই সান্ত্বনা দরকার দুইশো বছর পর আমার বই পড়া হবে? এইসবই আমি ভাবি লেখার সময়। লিখে যাই। উত্তরটা জানা নেই,, কিন্তু হাল ছেড়ে দেই না কখনো। কারো বইয়ের প্রভাব আজ থেকে দুইশো বছর পরেও থাকবে — এই বিশ্বাসটাই জীবনকে সুখী করার একমাত্র সান্ত্বনা।
প্রশ্ন : আপনি তুরস্কের একজন বেস্ট-সেলিং লেখক, কিন্তু সংখ্যার বিবেচনায় দেশের বাইরে তার থেকেও বেশি বিক্রি হয়। চল্লিশটা ভাষায় অনূদিত হয়েছে আপনার বই। আপনি কি লেখার সময় এখন বিস্তৃত বৈশ্বিক পাঠকের কথা মাথায় রাখেন? আপনি কি একটা ভিন্ন পাঠকশ্রেণির জন্যে লিখছেন?
পামুক : আমার পাঠকশ্রেণি যে শুধু তুরস্কে সীমাবদ্ধ নেই তা নিয়ে আমি সচেতন। কিন্তু লেখা শুরুর সময়ও হয়তো আমি নানা শ্রেণির পাঠকের কাছে পৌঁছে যেতাম। আমার বাবা তার কিছু তার্কিশ লেখক বন্ধুদের আড়ালে বলতেন — ‘এরা শুধু জাতীয় পাঠকদের কথা ভেবে লিখছে’।
পাঠকশ্রেণি নিয়ে সচেতন থাকলে কিছু সমস্যা আছে, তা জাতীয় বা বৈশ্বিক যা-ই হোক না কেন। সেই সমস্যাগুলো আমি এড়াতে পারছি না আর। আমার শেষ দুইটা বই দেশ-বিদেশ মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ পাঠক পড়েছেন। অস্বীকার করতে পারি না তাদের অস্তিত্ব আমার মাথায় নাই। কিন্তু কখনোই তাদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা আমি করি নাই। বিশ্বাস করি সেটা করলে আমার পাঠক ধরে ফেলবেন। এটাই আমার কাজ লেখালেখির শুরু থেকে, মানে যখনই কেউ তাদের এক্সপেক্টেশন আমার কাঁধে চাপায়া দেয়ার চেষ্টা করেছে, আমি পালিয়ে আসছি। আমার বাক্যবিন্যাসেও চেষ্টা করি তাদেরকে বিস্মিত করতে, যেভাবে তারা ভাবেননি সেইভাবে লিখে। সেজন্যেই দীর্ঘ বাক্য হয়তো আমার প্রিয়।
প্রশ্ন : নন্-তার্কিশ পাঠকদের কাছে আপনার তার্কিশ সেটিং-এর মৌলিকত্বের প্রশ্নটা নেই। কিন্তু তুরস্কের সেটিং এ আপনি এটা আলাদা করেন কীভাবে?
পামুক : হ্যারল্ড ব্লুম এটাকে বলেছিলেন ‘প্রভাবিত হওয়ার উৎকণ্ঠা’। তরুণ বয়সে আমারও এই ভয়টা ছিল। তিরিশের কোঠায় মনে হতো আমি তলস্তয় আর থমাস মান দ্বারা প্রভাবিত। তাঁদের মতো নির্মল, অভিজাত গদ্যে লিখব। কিন্তু শেষমেশ যা হলো, যদিও পরবর্তীতে আমার টেকনিকে অনেক ভিন্নতা আসছে, তারপরেও ভাবতাম বিশ্বের এই প্রান্তে বসে, ইউরোপ থেকে এত দূরে, অন্তত তখন তা-ই মনে হতো — এত বিচিত্র ধরনের পাঠকদের সমাবেশে ভিন্ন একটা সংস্কৃতি আর ইতিহাসের ধারায় যা লিখব তা-ই হয়তো আমার মৌলিকত্বের প্রশ্নটাকে উৎরে দিবে, এমনকী খুব শস্তা হলেও। কিন্তু এটাও সহজ ছিল না, লেখার টেকনিক অনুবাদ করা যায় না কিংবা এত সহজে হাতে আসে না।
মৌলিকত্বের প্রশ্নটা আমার কাছে বেশ সহজবোধ্য। এমন দু’টা জিনিশকে একসাথে আনা যাক যা আগে ছিল না। ইস্তানবুল-এ লক্ষ করবেন, বইটাতে দেখানোর চেষ্টা করেছি কীভাবে ফ্লব্যেয়ার, নেরাল, গ্যোতিয়ে-র মতো কিছু বিদেশী লেখক একদল তার্কিশ লেখকদের প্রভাবিত করেছেন। এই গদ্যটার সাথেই ইস্তানবুলের রোম্যান্টিক ল্যান্ডস্কেপের বর্ণনাই একটা আত্মজীবনী। এটা কেউ আগে সেভাবে করেনি। ঝুঁকি নিলে নতুন কিছু করা হয়তো সম্ভব। ইস্তানবুলকে আমি মৌলিক গ্রন্থ হিশেবে লিখতে চেয়েছিলাম, জানতাম না সফল হবো কী না। ব্ল্যাক বুকও তাই ছিল — নস্ট্যালজিক প্রুস্তিয়ান বিশ্বের সাথে ইসলামী উপমা, গল্প, এবং ঠাট। এর সবকিছুই ইস্তানবুলের প্রেক্ষাপটে বসিয়ে দেখতে চাইলাম কী হয়।
প্রশ্ন : ইস্তানবুল পড়ে মনে হয় আপনি সবসময়ই একজন নিঃসঙ্গ ব্যক্তি ছিলেন। লেখক হিশেবে অবশ্যই একাকী এই আধুনিক তুরস্কে। এমন পরিবেশে বড় হলেন এবং পরবর্তীতে বাস করলেন যার সাথে আপনি বিচ্ছিন্ন।
পামুক : যদিও আমি বেশ সদস্যবহুল একটা পরিবারে জন্মগ্রহণ করি যেখানে সমাজকে উপভোগ করতে শেখানো হয়, কিন্তু পরবর্তীতে ভেঙে বের হয়ে যাওয়াটা রপ্ত করেছিলাম। এটা আত্মবিধ্বংসী প্রবণতা। উত্তেজনা কিংবা ক্রোধান্বিত হয়ে আমি এমন অনেক কিছুই করি যা আমাকে আমার সুখকর চারপাশের সাথে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। প্রথম জীবনে বুঝতে পেরেছিলাম সমাজ আমার কল্পনাকে ধ্বংস করে ফ্যালে। নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণাটা আমার দরকার ছিল কল্পনাকে সচল রাখার জন্যে। এবং তারপর আমি সুখী। কিন্তু একজন তুর্ক হিশেবে সমাজের সান্ত্বনাময় কোমল দিকগুলোর কথা মাথায় রাখতে হবে, যা ধংস করে ফেলছি। ইস্তানবুল আমার সাথে মায়ের সম্পর্ক নষ্ট করেছে — আমাদের আর দ্যাখা হয় না। এবং খুব কমই আমার ভাইয়ের সাথে দ্যাখা হয়। সাম্প্রতিক বক্তব্যের জন্যে তুরস্কের মানুষের সাথেও সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না।
প্রশ্ন : আপনি নিজেকে কতখানি তার্কিশ মনে করেন?
উত্তর : প্রথমত, জন্মগতভাবে আমি একজন তুর্ক এবং এ নিয়ে আমি সুখী। আমি যত-না তার্কিশ, আন্তর্জাতিকভাবে তার থেকেও অনেক বেশি দেখানো হয়। একজন তুর্কি লেখক হিশেবে আমার পরিচিতি। প্রুস্ত যখন ভালোবাসা নিয়ে লিখেন তখন সেটা হয়ে যায় বৈশ্বিক ভালোবাসা। প্রথমদিকে যখন প্রেম নিয়ে লিখতাম, সবাই বলত আমি তার্কিশ প্রেম নিয়ে লিখছি। আমার লেখা যখন অনূদিত হওয়া শুরু হলো, তুর্করা খুবই গর্বিত ছিল। তারা আমাকে নিজেদের বলে ধরে নিলো, যেন আমি তুর্ক হিশেবে লিখছি। একবার কেউ আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হয়ে গেলে, তার তার্কিশ পরিচয়টার ওপর বারবার গুরুত্ব দেয়া হয়, এবং তারপর তুরস্কের লোকজন আপনার প্রতি তাদের দাবিটা জানান দেয়। জাতীয় পরিচয়টা তখন অন্য কারো হাতে চলে যায়, আপনার হাতে থাকে না আর। এখন আমার শিল্পের থেকে তুরস্কের উপস্থাপনটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এটাই দেশে প্রচুর সমস্যার সৃষ্টি করে। তারা জনপ্রিয় কাগজগুলোতে যা পড়ে সেটা নিয়েই চিন্তিত হয়ে যায় যে আসলে আমি দেশের বাইরে গিয়ে দেশ নিয়ে কী বলছি। আমার বই সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর রাখেন না এমনিতে। সাহিত্য ভালো-মন্দ, সুর-অসুর সবকিছু নিয়েই, কিন্তু তারা শুধু চিন্তিত আমার অসুর নিয়ে।