ওসমান সমাচার– পর্ব ১২ । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ আগস্ট ২০১৬, ১১:৪৬ অপরাহ্ণ, | ৩৮৯৩ বার পঠিত
‘রাং রাজওয়া’ ইন্দ্রজাল : পিট সায়েব ও বাইজি-কন্যা সমাচার (৪)
সায়েব বিন্দুবিসর্গ না জেনে রমণীকে জল্পনা করে। তবে তার জল্পনা পুরোটা মিথ্যে নয়। খৈনিকণ্ঠি রমণী বাইজি বা নতর্কী না হলেও বাইজিকলায় পারঙ্গম। সে এই শহরের মেয়ে নয়। পিতৃসূত্রে বাঙালি এবং মাতৃসূত্রে আগ্রাওয়ালি। তার জন্ম ওই পুরাতন শহরে। যমুনার তীর ঘেঁষে সে বেড়ে উঠেছে। তাজমহল ও কুতুব মিনার দেখে যুবতী হয়েছে। ফতেহপুর সিক্রির বাদশাহী খিলানে দুরন্ত বালিকা রূপে একদিন বিচরণ করেছে। রামবাগের সুগন্ধি শুঁকে বাইজিকলায় তালিম নিয়েছে। মা আগ্রার নামকরা গায়িকা ও নতর্কী ছিল। মায়ের সুবাদে মির্জা গালিব ও মীর-তকি-মীর রমণীর রক্তে খৈয়ের মতো ফোটে। আমির খসরু ও শাহ হোসেনে তার কণ্ঠ মদির হয়। ছোট অঙ্গের খেয়াল-গানে পিলু ও দাদরার বোল তোলে। সে নাচতে ও নাচাতে জানে। তবে মায়ের মতো পেশাদার বাইজি নয়। বাইজিকলায় পরাদর্শী করে তুললেও মা তাকে রূপের পসারিণী করে গড়েনি। নিজের বিড়ম্বিত জীবনের ভাগিদার করেনি। সাকিমত্ত রইস আদমির রক্ষিতা হওয়ার নিয়তি থেকে মেয়েকে প্রাণপণে আগলে রেখেছে। পিতা নয়, মাতৃরক্তে মেয়ের সকল অনুরাগ। মা হচ্ছে তার জীবন-পিপাসা। দিশারী ও পাথেয়। মা ছাড়া অন্য কোনো অস্তিত্বে নিজেকে সে আপন ভাবে না।
পিট সায়েবের খৈনিকণ্ঠি প্রেমিকার জনকটি বাঙালি। সে রইস ও সুদর্শন আদমি ছিল। পাকেচক্রে যমুনার তীরে কিছুদিন কাটিয়েছে। ইয়ার-দোস্তের পাল্লায় পড়ে সুরা ও বাইজিসঙ্গের নেশা ধরে মনে। সব কাজ শিকেয় তোলে বাইজিরসে নিজেকে বিভোর করে। খৈনিকণ্ঠির মায়ের সঙ্গে পরিচয়ের এই হলো সূত্রসার। এক গানের আসরে দুজনের পরিচয় ঘটেছিল। ভেতো বাঙালির মধ্যে বিশ্বস্ত এক প্রেমিক সত্তার দেখা পেয়ে রমণী চমকে ওঠে। বাঙালি বাবুটি মারাঠি বা পাঞ্জাবির মতো দাপুটে নয়। রাজপুতের প্রমত্ত সাহস তার নেই। সে কোমলপ্রাণ ও বিশ্বস্ত। উত্তর প্রদেশের কেতা ধারণ করলেও সেখানে স্বচ্ছন্দ ও স্থির নয়। কোথায় যেন আশ্রয়-প্রবণ! বাঙলার বর্ষার মতো সজল। রমনী ওতেই মজে।
রইসকে পরখ করে রসিক বাইজির মনে প্রণয়ের দোলা লাগে। পুরুষটিকে ঘরোয়া ও বিশ্বস্ত ভাবতে ইচ্ছে করে। দুজনের প্রণয় ও বিবাহে তাই বিলম্ব ঘটে না। গায়িকা নতর্কী এবার বাইজিগিরি ছেড়ে ঘরণী হওয়ার রঙ্গরসে মাতে। স্রোতের প্রতিকূলে ভেসে রইস বাঙালিকে নিকা করে ফেলে। উভয়ের প্রণয় দেখে মনে হচ্ছিলো সম্পর্কটি টিকে যাবে। বাইজির রূপ ও কণ্ঠের মোহজালে বাঙালি চিরকাল বিভোর থাকবে। কিন্তু মানুষের সব অনুমান সঠিক হয় না। রইস বাঙালি অচিরে যমুনা ও তাজমহলে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। রামবাগে বিরক্তি আসে। আগ্রার লু হাওয়া তার বাঙালি মনকে খরখরে করে ফেলে। রইসগিরি ছেড়ে অঝোর বর্ষায় নিজেকে সিক্ত করার জন্য সে ব্যাকুল হয়। নিস্তরঙ্গ এক শহরে ফিরে যাবার টান তার রক্তে ঘন হয়ে জমে।
রইসের ভিতরে ঘরকুনো ব্যাং এবার হল্লা মাচায়। আত্মীয়-পরিজনের জন্য সে উতলা হয়। দরবারি কাফি ও খেয়াল-অঙ্গের গজল তাকে আটকে রাখতে পারে না। আউলা-বাউলা ভাটিয়ালির রাগ-রাগিনী বাঙালিকে টানে। শহরের সরু ও লম্বা নদীটি স্বপ্নে তাকে ইশারা করে। নিজের নিবাসে ফেরত যেতে সে উতলা হয়। পরিবার থেকে বাইজি-সঙ্গ ছাড়ার চাপ প্রবল হয়ে ওঠে। বাঙালি বুঝে ফেলে ‘যমুনা কে তীর’ কেন যেন তাকে আর টানছে না।
বাঙালির কন্যাটি তখন টলমল পা ফেলে দুজনের মধ্যে হাঁটছে। ভবিষ্যতের খৈনিকণ্ঠি হতে আগ্রার সরু গলিতে বিচরণ করছে। দূর ভবিষ্যতে এক ইংরেজ সায়েবকে জখম করার জন্য যমুনা ও রামবাগের ঝাপটা তার গায়ে এসে লাগছে। এদিকে নিজের শহরে ফেরার চাপ বাঙালি আর নিতে পারে না। রইস তাই হার মানে। বাইজির কাছে নিজের অক্ষমতা অকপটে প্রকাশ করে। ঘরণী হওয়ার সুখে বিভোর রঙ্গিনীর জন্য আঘাতটি মারাত্মক ছিল। বাঙালিকে সে অন্যদের থেকে আলাদা ভেবেছিল। পুরুষটির কালো চোখের মধ্যে আশ্রয় ও নিরাপত্তার আশ্বাস তাকে সুখী করেছিল। এখন সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালি প্রেমিক না হয়ে রইস হয়েছে। আজীবনের সঙ্গী না হয়ে দুদিনের খদ্দের বলে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছে। রমণীর হৃদয় ভাঙে বাঙালির প্রতারণায়।
বাইজিকে আসলে প্রেমে পড়তে নেই। প্রেম তার জন্য নয়। বাইজিরা হলো রইস আদমির মন তুষ্ট করার খেলনা। রইসদের কাছে বাইজি-কণ্ঠ হচ্ছে প্রসাধন। নতর্কীরা ভোগের জন্য,-ঘরের জন্য নয়। গৃহিণীরা বাইজি হয় না এবং বাইজিরা গৃহিণী হওয়ার ভাগ্য করে ধরায় আসে না। বাঙালির ‘ঘরে ফেরা’র তাড়ার মধ্য দিয়ে পুরোনো সত্যটি নতুন করে নিশ্চিত হয়। খৈনিকণ্ঠি তখন দুজনের মধ্যে টলমল পায়ে হাঁটছে। মেয়েকে কোলে তুলে বাইজি ম্লান হাসে:-
‘মে সুচা থা তুম আলগ্ হো। মুঝে সাচুমুচ্ পিয়ার কিয়া। মেরা সুচ গলদ্ নিকলা। মে তুমে নেহি রোকঙ্গী। তুম যা সাকতে হো। লেকিন এক বাত ইয়াদ রাখ্ না,-তুম মুঝে রান্ডি বানা দিয়া। বাইজি কাভি রান্ডি নেহি হোতি। খোদা উসকো রান্ডি বানা কেলিয়ে নেহি ভেঝা। বাইজি এক কালাকার হোতি হ্যায়। ও কাভি রান্ডি নেহি হোতি। মাগার পিয়ার উসে রান্ডি বানা দিয়া। তুম মুঝে কালাকার সে রান্ডি বানা দিয়া। আব্ যা সাকতে হো। মেয়নে তুমে পিয়ার সে আজাদ কর দিয়া।’
বাঙালির জন্য এই আজাদি বিব্রতকর ছিল। আগ্রার বাইজি-বিলাসী রইস থেকে সে ভিন্ন হতে পারেনি। খরপোষের আপসনামায় সই করে নিজের শহরে ফিরেছে। বিয়ে-থা করে নতুন সংসার যাপন করছে। পাকা মাথার বৈষয়িক হয়েছে। আশরাফ আদমি রূপে শহরে তার জেল্লা এতোটুকু কমেনি। ইংরেজ সায়েবদের কাছে সম্ভ্রান্ত নেটিভ বলে সুনাম কিনেছে। নিজেকে বিনোদিত করার জন্য এখনো বাইজিসঙ্গ করে। শিল্পরসিক রইস হিসাবে অভিজাত সমাজে নাম ফাটে। যদিও বাইজি থেকে রান্ডি হওয়া রমণীর জন্য মাঝেমধ্যে তার মন পোড়ে। অনুতাপ ও অনুশোচনা চিত্তকে বিকল করে রাখে। ভবিষ্যতের খৈনিকণ্ঠিকে একবার দেখতে মন চায়। এতোদিনে সে নিশ্চয় যুবতী হয়ে উঠেছে! মায়ের মতো চপলা ও রঙ্গিনী হয়েছে!
বাঙালি তার কল্পনায় সুকণ্ঠি এক বাইজিকে দেখে। নিজের আত্মজার মধ্যে যমুনার কলধ্বনি শুনতে পায়। যুবতীর ভ্রমরকালো চোখে রামবাগের বসরাই গোলাপ সুগন্ধি বিলায় দেখে শিউরে ওঠে। তবে কি মেয়েটি বাইজি হয়ে গেছে! বিনোদনের খেলনা হয়ে রইস আদমির বাহবা কুড়াচ্ছে। তার কন্যা কি তবে বাইজি থেকে রান্ডি বনে গেছে! বিস্ময়বোধ বাঙালিকে আড়ষ্ট রাখে। ভেতরে কষ্টের মেঘ ঘনায়। নিজেকে পাপী ভেবে পীড়ন করে। ইচ্ছে হয় সব ছেড়েছুঁড়ে রমণীর সমুখে গিয়ে দাঁড়ায়। অবনত মস্তকে তার জানু ধরে কাঁদে। করজোড়ে ক্ষমাভিক্ষা মাগে,-‘মুঝে গলতি হো গায়ি। পুরানা বাতে ভুল যাও। আব্ ঘর চলো।’
বাইজিকে ঘরে ফেরানোর ইচ্ছা বাঙালির মনে জাগে এবং সেখানে ঘুমায়। আগ্রায় পা রাখার সাহস তার হয় না। সে কলকাতা ও লখনৌ ভ্রমণ করে। বম্বে ও করাচি সফর করে। ভুলেও আগ্রায় পা ফেলে না। বাইজির সমুখে পড়ার আতংক তাকে তাড়া করে। ওর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস তার নেই। ‘যমুনাকে তীর’ রইস বাঙালির জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। অতীত প্রেমিকার ঠিকানা সংগ্রহ করে খরপোষ পাঠায়। অবরে-সবরে মেয়ের খবর করে গোপনে। বাইজির ঘরে মেয়েটি চমৎকারভাবে বড়ো হচ্ছে শুনে পরিতোষ বোধ করে। তবু অপরাধবোধ তার পিছু ছাড়ে না। হৃদয় কুড়ে খায় অনুতাপে।
জীবন-সূর্য ঢলে পড়ার ক্ষণে বাঙালি বুঝতে পারে বাইজির চেয়ে অধিক ভালো সে কাউকে বাসেনি। তার জীবনে এখন সংসার ও কর্তব্য রয়েছে,-প্রেম নেই। বাইজির সঙ্গে ওটা সে রামবাগে কবর দিয়ে এসেছে। পিষ্ট করেছে টাঙ্গাওয়ালার চাকায়। সে বুঝতে পারে ‘যমুনাকে তীর’ তার প্রথম ও শেষ প্রেম ছিল। জাহাঙ্গীরের নূরজাহান ও শাজাহানের মমতাজ সেখানে ঘুমিয়ে আছে। নূরজাহানের সাধিফলকে জাহাঙ্গীর রক্ত দিয়ে লিখে রেখেছে,-‘গরিব গোরে ফুল দিও না/দীপ জ্বেলো না কেউ ভুলে/শামা পাখির পাখ্ না পুড়ে/দাগা না পায় বুলবুলে।’ রইস বাঙালি ইদানীং এটা বোঝে সে আর প্রেমিক নেই। বাইজিকে ছেড়ে আসার দিনে তার প্রেম আগ্রায় নিভে গেছে!
ভেতো বাঙালি রইস হলেও প্রেমিক হতে পারেনি। আকবরের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আনারকলিকে সে ভালোবেসেছে, তবে সেলিম হতে পারেনি। মমতাজকে ভালোবাসার স্পর্ধা করলেও শাজাহান হতে পারেনি। প্রেমে নির্লজ্জ হতে হয়। প্রয়োজনে কঠিন ও নিষ্ঠুর হওয়া লাগে। শাজাহান প্রেমের নেশায় নিষ্ঠুর হয়েছিল। তাজমহল গড়তে গিয়ে সম্রাট দেশে দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে। পারস্যবাসী এক শিল্পী ছিল এই স্বপ্নপুরীর রচয়িতা। অতুল শিল্পীর দুহাত কেটে ফেলার আদেশ করে সম্রাট। অকম্পিত কণ্ঠে হুকুম করে,-‘মহান শিল্পীর দুই হাত কেটে ফেলো। তাকে দিয়ে কোনো বণিক ও সম্রাট যেন তাজমহলের মতো দ্বিতীয় স্থাপনা গড়তে না পারে।’
শাজাহানের এই অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতা এক রমণীর জন্য বরাদ্দ ছিল। নিষ্ঠুর হয়ে সে প্রমাণ করেছে রমণীরা স্বর্ণগুণের অধিকারী। স্বর্ণকে পেতে গেলে ডর-ভয় ছাড়তে হয়। লোকলজ্জা ত্যাগ করতে হয়। পরিবার এবং প্রতিবেশীর ঘৃণা বা অসন্তোষের পরোয়া করলে চলে না। কারণ প্রেম ভয় ও ঘৃণার অধীন নয়। তার স্বভাব নির্লজ্জ। লালসায় ঘনীভূত ও অন্ধ না-হলে প্রেম জাগে না। নিজেকে নির্লজ্জ না-করতে পারলে ওটা কপালে জোটে না। ইন্দ্রজাল বিধান জারি করেছেন,-জগতে প্রেমিক-প্রেমিকারা নির্লজ্জ হবে। বিচার ও বিবেচনা করে প্রেম হবে না। রইস বাঙালি নির্লজ্জ হতে পারেনি। তার জন্য আগ্রা তাই চিরনিষিদ্ধ এক শহরে পরিণত হয়েছে। মনে সাধ জাগে সেখানে ফেরার, অথচ ফিরতে সাহস করে না।
খৈনিকণ্ঠি মেয়ের জীবনে তার বাঙালি পিতা এক নামগ্রোত্রহীন অস্তিত্বে পরিণত হয়েছে। বাইজি মায়ের কাছে বাপের অনেক গল্প শুনেছে, কিন্তু চর্মচক্ষে দেখেনি। পিতার স্নেহ ও শাসনের অভিজ্ঞতা কন্যা তার মাকে দিয়ে মিটিয়েছে। সে শুধু এটুক বুঝে বাঙালিকে ভালোবেসে তার মা একদিন ঘরণী হয়েছিল। এখনো তাকে ভালোবাসে। প্রতারিত হওয়া সত্ত্বেও ভেতো পুরুষটিকে তার মা ভালোবাসে। নিষ্ঠুর পুরুষটির জন্য মমতার ফল্গুধারা হৃদয়ে ধারণ করে। একদিন কথাচ্ছলে মাকে জিজ্ঞেস করে:-
‘আম্মা, উস্ আদমি তুমে দাগা দিয়া। মচ্ছর কি তারা ফেক্ দিয়া। তুমে ছোড় কর বাঙ্গালমে চলি গায়ি। ফির কিউ উস্ আদমিকে লিয়ে তড়াপতি রহো। উসে ভুল না পাও! কিউ?’
সুকণ্ঠি বাইজি মেয়েকে খেয়াল গানের তালিম দিতে ব্যস্ত ছিল। তার কণ্ঠে বেহাগ রাগ ভর করেছে। রাগটি বড়ো সুমধুর। প্রেমের রস ও শিহরণে হৃদয়ে ঢেউ তোলে। আলাপের ঘনঘটা থেকে বিস্তারের তুঙ্গে উঠার ক্ষণে রাগের নাটকীয় পালাবদল শ্রোতাকে চমকিত রাখে। ‘আলী মাওলার’ জন্য মনে আবেশ জাগে। পরমপ্রিয়কে আলিঙ্গনের বাসনায় হৃদয়ে আবেগ উথলে ওঠে। বাইজি তখন আলাপ শুরু করেছে। ‘তুম কুনঠে আলী মাওলা’ বলে নিজেকে সারগামে বিদীর্ণ করার প্রাক-প্রস্তুতি হচ্ছে এই আলাপ। আলাপ ও বিস্তারের যুগলবন্দি বেহাগকে নাটকীয় করে। বিস্তার ঘনালে তবলার বোল তীব্র হয়। গায়কের কণ্ঠ উচ্চনাদে ওঠে। মনে হয় পিনাকপানির টঙ্কার লেগেছে রক্তে। বড়ো মধুর এই বেহাগ রাগ! কন্যার আচমকা প্রশ্নে বেহাগে ছেদ পড়ে।
বেহাগ রাগে আলাপ বেশ দীর্ঘ হয়ে থাকে। সেখান থেকে বিস্তারে যাওয়ার রাস্তা তখনো বহু দূরে। কন্যার আচমকা প্রশ্নে বাইজির চমক লাগে। চোখ বুজে নিজের মাঝে মগ্ন হয়। মুখে অজানা বিষাদ ভর করে। মৃদু কণ্ঠে মেয়েকে শুধায়,-‘বেটিয়া, তুম রুমি’কো পেহ্চানতি হো? উনকা কালাম সুনা তুমনে?’ কন্যা আমির খসরু’র কালাম জপ করেছে। মতিচ্ছন্ন গালিব ও মীর-তকি’র গজলে প্রেমের সুরা পান করেছে। সন্ত কবিরের ভজন শুনে ইন্দ্রজালকে প্রণতি জানিয়েছে। পাঞ্জাব দেশের ওয়ারিস শাহ’র হীর ও রনজার প্রেম-কাহিনী শুনে কতোবার চোখের জল ফেলেছে! পাঞ্জাবের শেখ ফরিদ ও বুল্লে শাহ্’র মরমি কালাম মা’কে মাঝেমধ্যে গাইতে শুনে। আগ্রায় শীত ঘনালে মা শেখ ফরিদকে স্মরণ করে। কেন করে কন্যা সেটা আজো জানে না। শীতের মিষ্টি আলো গায়ে মেখে তার শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। রক্তে আলসেমি ভর করে। মা সেটা হতে দেবে না। সকালের প্রার্থনা শেষে ঘুমের আমেজে বিভোর কন্যার কানে শেখ ফরিদ জপ করে:-
‘উঠ্ ফরিদা শুত্থিয়া দুনিয়া বিখার যা/শায়েদ কোই মিল যায়ে বখশিয়া তু ভি বখশিয়া যা।/…তুরিয়া তুরিয়া যা ফরিদা, তুরিয়া তুরিয়া যা।’
ভরা শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে জগতের সবাইকে ক্ষমা ও করুণা বখশানোর আহবান কন্যাকে ফরিদা করতে পারে না। ত্বরা করে ঘুম থেকে উঠতে প্রলোভিত করে না। কম্বল মুখে টেনে ঘুমে ডুব দেয়। কিন্তু মা নাছোড়বান্দা। মেয়েকে ঘুম থেকে তুলবেই। কর্মের অনুরাগে ক্ষমা ও ভালোবাসা বিলানোয় কন্যাকে ফরিদা করে ছাড়বেই। দরবেশীর এটা হলো সারার্থ। বাইজির কণ্ঠ তখন বেদনাবিধুর:-
‘ফরিদা কালা মেরা কাপড়া কালা মেরা বেশ/গুণহীন ভাড়ায়া মেয়নে ফির লোগ কহে দরবেশ/… তুরিয়া তুরিয়া যা ফরিদা, তুরিয়া তুরিয়া যা।’
সুরের জাদুকরি প্রবাহে কন্যা আর অলস সুখে ঘুম দিতে পারে না। ফরিদা হওয়ার জন্য আরামের ঘুম ছেড়ে তাকে উঠতে হয়। কন্যা ঘর ঝাট দেয়। চুলায় আগুন ধরায়। তার কণ্ঠে ‘তুরিয়া তুরিয়া যা…’ জাদু বিস্তার করে। শীতের মিষ্টি সকাল প্রসন্ন হয় শেখ ফরিদের কালামে। পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে সে শেখ ফরিদ ও শাহ হোসেইনকে টের পায়। রুমি’কে পায় না। মা হঠাৎ এই মরমি সাধকের প্রসঙ্গ কেন তুলছে সেটা বোধগম্য হয় না। রুমি’কে মায়ের কণ্ঠে আজ-অব্দি গাইতে শোনেনি। ‘মসনবি শরিফ’ নিয়ে কখনো কথা বলতে দেখেনি। বাইজিমহলে এই মরমি সাধকের প্রয়োজন পড়ে না। মায়ের প্রশ্ন শুনে কন্যা মাথা নাড়ে,-‘রুমি! নেহি তো! মাগার কিউ?’ তার সরল স্বীকারোক্তি শুনে মা মৃদু হাসে। বোঝা যায় মেয়েকে সে আজ প্রেমের নতুন সবক শেখাবে।
মেয়ের চুলে বাইজি নীরবে হাত বুলায়। মৃদু হাসি বজায় রেখে কণ্ঠ গাঢ় করে:-
‘সুন্ বেটিয়া, ইশক্ আজিব চিজ হোতি হ্যায়। ইয়ে সাচ হ্যায়, তেরে পিতাজি মুঝে ধোঁকা দিয়া। দাগা দিয়া মুঝে। পার ইয়ে ভি সাচ হ্যায়, মে উস আদমিকো পিয়ার কিয়া থা। তেরে পিতাজি মেরা পিয়ার মেওসুস নেহি কিয়া। মিট্টিকি কী তারাহ গির গায়ি। ইয়ে উসকা গলতি। মেরা নেহি। তেরে পিতাকে লিয়ে মেরা পিয়ার সাচ্ থা। ইসিলিয়ে মে উসে আভি পিয়ার করতা হু। শায়েদ ও না করে।
প্রেমরোগ কা রীত এয়সাই হোতি হ্যায় বেটিয়া। যব্ তুম সমঝ্ জাও গি, তুমহারি রোগ অওর বাড় যায়েগি। প্রেম জ্বালি হুয়ি অঙ্গার সে জিয়াদা কিমত্ রাখতি হ্যায়। মেরা দিল্ এক জ্বালি হুয়ি অঙ্গার বন গায়ি। মে উসে নিভা না সাকে। প্রেম নিভতা নেহি বেটিয়া। হারগিজ জ্বলতি রাহি। তু ইয়ে মাত্ ভুলনা।’
কন্যা দেখে মায়ের চোখে অশ্রু ঝরছে। প্রবঞ্চনার বিষে নীল মুখের রেখা তির-তির করে কাঁপছে। গানের জলসায় বাইজি প্রেমের গান করে। সারগামের আলাপ ও বিস্তারে দর্শকের হৃদয়ে প্রেমরসের জোয়ার তোলে। দর্শককে বিচিত্র ঠাটের রাগ-রাগিনীতে মাতিয়ে তোলে। কাওয়ালির জিকিরে তাকে উতলা করে। গজলের তূরীয় আবেশে মনকে প্রেমাতুর করে। দর্শক তখন বাইজির প্রেমে পড়ে। উন্নতবক্ষা নতর্কী তাকে প্রেমের সাকি পিলায়। কিন্তু নিজে পান করে না। এই সাকি তার জন্য নিষিদ্ধ। ময়রা মিষ্টি তৈরি করলেও সেটা ছুঁয়ে দেখে না। রসিকের মনে প্রেমের ক্ষুধা জাগিয়ে তুললেও বাইজি নিজে ক্ষুধার্ত হয় না। তার সংবিধানে প্রেমের জন্য ক্ষুধার্ত হতে মানা।
বাইজির জন্য প্রেম নিষিদ্ধ। এতে চিত্ত বিকল হয়। সে আর বাইজি থাকে না। রক্ষিতা হয়ে পড়ে। কালাকার থেকে রান্ডি বনে যায়। বাইজি এক কুশলী অভিনেত্রী। অভিনয়ের জাদু দিয়ে দর্শককে বিনোদিত করা তার ধর্ম। সে নিয়মের লঙ্ঘন ঘটলে তার শিল্পীসত্তা বিপন্ন হয়। ঘরণী হওয়া শিল্পীর ধর্ম নয়। তার জন্য এটা স্ববিরোধিতার কুণ্ড। ঘরণী হতে গিয়ে সে আর শিল্পী থাকতে পারে না। আবার শিল্পী হওয়ার কারণে ঘরামিতে মন টিকে না। না শিল্পী ও না গৃহিণী রূপে তার দিন কাটে। বাইজি এক মহান শিল্পী। তার জন্য প্রণয় সর্বনাশা, আর বিবাহ হচ্ছে অভিশাপ!
মাকে কাঁদতে দেখে কন্যা নিমিষে তার মনের বেদন বুঝে ফেলে। এই রমণী ঘরণী হতে গিয়ে কালাকার হওয়ার সন্তোষ হারিয়েছে। প্রেমের আগুনে নিজেকে সপে দিয়ে জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়েছে। তার কণ্ঠ এখনো সুরেলা। কিন্তু রসিক শ্রোতার আসরে ঘরণী বাইজির কদর ফুরিয়েছে। সে এখন না ঘরণী, না বাইজি। না প্রেমী, না শিল্পী। মায়ের এই নীরব বলিদানের কথা ভেবে কন্যার চক্ষু দিয়ে জল গড়ায়। অদেখা জনকের প্রতি অজানা ক্ষোভে মন বিষিয়ে ওঠে। ইচ্ছে করে রইস বাঙালির সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,-‘আপ্ এয়সা কিউ কিয়া? কিউ হামে একেলা ছোড় গায়ি?’ ইচ্ছে করে বাপকে শুনিয়ে বলে,-‘আপকা দিল্ মে জেহের ভরি হুয়ি। আপ্ প্রেমী নেহি, জেহের থি। উসি পিলা দিয়া হামে!’
জনকের প্রতি ক্ষোভে বাইজি-কন্যার ফর্সা মুখ গনগন করে। মেয়ের মধ্যে আগুনে শিখা টের পেয়ে বাইজি ম্লান মুখে হাসে। তাকে প্রবোধ জোগায়:-
‘সুন্ বেটিয়া, তেরে পিতা সুতে হুয়া আদমি থা। আপনাকো জাগা না সাকে। ইয়ে মেরা বদনসিব, মে এক সুতে হুয়া আদমি পার লাচাক গায়ি। প্রেমকো মেওসুস করনা ইতনা আহসান নেহি বেটিয়া। যিস্ তারাহ হামে আল্লাকো মেওসুস কিয়া, প্রেমকো ইস্ তারাহ মেওসুস করনা চাহিয়ে। তব্ তুম প্রেমী হো জাওগি।’
মায়ের বচনে কন্যা প্রবোধ মানে না। চোখে-মুখে বাপের প্রতি ক্ষোভ জেগে থাকে। মায়ের প্রেমে পড়ার রীতি তার কাছে আজব ঠেকছে। একপেশে এই ভালোবাসার কোনো অর্থ সে খুঁজে পায় না। তার কাছে ভালোবাসা এক দ্বি-পাক্ষিক অভিজ্ঞতা। এক হাতে তালি বাজানোয় সে বিশ্বাস করে না। দুটো হাত সমানভাবে যুক্ত হলে প্রেম ঘটে। অন্যথায় ওটা একতরফা হতে বাধ্য। দুঃখ ও মনস্তাপ ছাড়া কপালে কিছু জোটে না। মায়ের নির্বুদ্ধিতা তাকে হতবাক করে। তার মনে হয় মা সব গুলিয়ে ফেলেছে। প্রেমের প্রশ্নে মানুষ ও খোদাকে এক কাতারে ফেলে বিচার করছে। আফসোস!
কন্যা ভাবে, খোদাকে আমরা দেখি না। পরম নিরাকার রূপে শুধু অনুভব করি। হৃদয়ে সেই নিরাকারের শক্তি টের পাই। ফলে খোদার সঙ্গে মানুষের ভালোবাসা বায়বীয় ও একতরফা হতে বাধ্য। কিন্তু মানুষকে আমরা দেখতে পাই। তাকে জানা ও বোঝার চেষ্টা করি। মনের মধ্যে অনুরাগ জন্ম নেয়। এই অনুরাগ কিছুতেই বায়বীয় ও একতরফা নয়। দুটি মানুষের মনের মিলন থেকে ভালোলাগা হয়। রক্তে প্রেমের টান জাগে। কিন্তু মা যেটা করছে সেটা কি প্রেম! বিস্ময় চাপা দিয়ে কন্যা তার মাতৃদেবীকে বোঝায়:-
‘আম্মা, তুম গলদ সুচা। ঝুটা ইনসানকো খোদা বানা দিয়া। পিতাজি এক ঝুটা ইনসান থা। বাসনা পুরা কেলিয়ে তুমে শাদি কিয়া। ইস্ মে পিয়ার নেহি থা। লালচ্ থি। তুম পিয়ারমে লাচাক গায়ি। মাগার ও আদমি বাসনা পার লাচাক গায়ি। বাসনা খতম হোনেকে বাদ্ তুমে ছোড় দিয়া। ভাগ গায়া বাঙ্গালমে।’
প্রেমের মতো গোলমেলে বিষয়ে কন্যার যুক্তি মাকে হাসায়। যুবতী মেয়েটি অনভিজ্ঞা। তার জীবনে প্রেমের বসন্ত এখনো আসেনি। স্থান-কাল-পাত্র গুলিয়ে ফেলার ঘটনাটি ঘটেনি। মানুষ প্রেমে পড়ে নির্বোধ হয়,-এই প্রবচনের সারার্থ অনুভব করার জন্য তাকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। মেয়ের সরলীকরণে মা তাই মৃদু হাসে। মনে-মনে আমোদ বোধ করে। কোলের উপর মুখ রাখা মেয়ের কপালে আদরের হাত বুলায়:-
‘ইশক্ এক খঞ্জর হোতি হ্যায় বেটিয়া। তেরে পিতা খঞ্জর চালা দিয়া মুঝ্ পার। খুন বহা দিয়া মেরে দিল্ পে। আব্ মে ক্যায়সে ইয়ে খুন রোক সাকে! হযরত রুমি এহি বাত কাহা উনকা কালাম মে,-‘মে তুমনে আপনি কাহানি কেহনে জা রাহাতা,/চারদরদ-কি লেহরো মে মেরা আওয়াজ ডুব গায়ি।/মেয়নে প্রয়াস কিয়া শবদ্ কেহনে কা,/পার মেরে বিচার,/নাজুক ও সিসে কী তারা টুট্ গায়ি।/বা-জাহাজ ভি ডুব সাকতা হ্যায়/প্রেম কে সাগর মে উঠা পবনদর সে।’ মেরে বেটিয়া, মেরা জাহাজ ডুব গায়ি প্রেমকি সাগর মে উঠা পবনদর সে! আব্ বল্ মে কিয়া করু!’
প্রেমে পড়ার বিস্ময় ও বোকামিতে বাইজি রমণীর চোখ দুটো মেদুর হয়ে আসে। একদা এক ভেতো বাঙালি তার জীবনে প্রেমিকের বেশ ধরে প্রবেশ করে। আস্তিন থেকে ছুরিকা বের করে রমণীর বক্ষে বসিয়ে দেয়। বাঙালি তাকে আঘাত করে পালায়, রমণীর তবু জখম সারে না। প্রবঞ্চনার খুনে তার বক্ষ ভাসে। চোখে নিরবধি অশ্রু ঝরে। রমণী নিজের পরিচয় ও প্রসাধন হারিয়ে ফেলে। তার প্রেমের খিদা তবু মিটে না। ঘাতকের জন্য আজো মন পোড়ে। ঘরণী ও বাইজির দোটানায় নিঃস্ব হওয়ার দিনেও পোড়ে। প্রেমের বিষে রমণী নীল হতে থাকে! তবু এটা তার পিছু ছাড়ে না।
বাইজি তার মেয়েকে কী করে বোঝায় বিশ্বাস ছাড়া প্রেম ঘনীভূত হয় না। প্রতারণা ছাড়া প্রেমের স্বরূপ বোঝা যায় না। প্রেম হলো বিশ্বাসঘাতক। প্রতারণা তার স্বভাব। প্রতারিত হলে প্রেমী নিজেকে চিনতে পারে। প্রেমের প্রতি নিজের বাসনা ও লালসাকে বুঝতে শিখে। প্রতারণার মাধ্যমে প্রেম সম্পূর্ণ হয়। প্রতারিত হওয়ার ফলে প্রেমী খণ্ড থেকে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠে। এতোদিন তার হারানোর ভয় ছিল। এখন নিজেকে ছাড়া হারানোর কিছু নেই। এতোদিন না-পাওয়ার ভয় ছিল। এখন খোদাকে ছাড়া পাওয়ার কিছু নেই।
বাইজির পক্ষে মেয়েকে বোঝানো কঠিন,-বাঙালি প্রেমিকের কাছে সর্বস্বান্ত হওয়ার পর জীবনকে সে ফিরে পেয়েছে। জীবনের গন্তব্য যেখানে গিয়ে শেষ হয়, সেই অচিন নিরাকারে সমর্পিত হওয়ার ভয় তার কেটে গেছে। প্রেম মানুষকে পরনির্ভর করে রাখে। ওটা কেটে গেলে মানুষ স্বনির্ভর হয় জগতে। বাইজি এখন নির্ভয়া। কাল কী হবে এ-নিয়ে ভাবে না। আজ কী করা দরকার সেটা তাকে ব্যস্ত রাখে। তার কাছে এটাই হলো প্রেমের সারার্থ!
রমণীর পক্ষে প্রেমের সারার্থ মেয়েকে বোঝানো মুশকিল। তার বয়স অল্প। বিষ দিয়ে বিষ ঝাড়ার ওঝাগিরি এখনো শিখেনি। বাসনা দিয়ে বাসনাকে নির্বিষ করার দরবেশী রপ্ত করার বয়সে পৌঁছায়নি। সময় হলে সে বুঝবে মানুষ হচ্ছে প্রতারক। পৃথিবীতে প্রতারণার চেয়ে সহজাত কিছু নেই। প্রতারিত হওয়ার পর মানুষের জ্ঞানচক্ষু খোলে। প্রতারকের স্বভাব বুঝতে পেরে সে তখন ফরিদা হয়ে পড়ে। তাকে খুন করার জন্য ঘুম থেকে ত্বরা করে উঠে না। উলটো ক্ষমা ও প্রেম বখশানোর জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। বাইজি ভবিষ্যতের খৈনিকণ্ঠি কন্যার চুলে বিলি কাটে। তাকে প্রেমের অমোঘ মন্ত্রে দীক্ষিত করে:-
‘পিয়ার থোড়াসা আজিব হোতি হ্যায় বেটিয়া। তেরে পিতাকে লিয়ে মেরে দিল্ মে লালচ্ থি। হযরত রুমি’কা বাসনা থি শামস তিবরিজকে লিয়ে। এক ইনসানকি চেহরে পার মুঝে প্রেম নজর আয়ি। তিবরিজকা চেহরে পার রুমি’কো দিল্ মে খোদা প্রকট হুয়ি। প্রেমকো সমঝ লিয়া উনে। প্রেমীকো কেহ্ দিয়া,-‘…যব্ মে তুমহারা চেহারা দেখতা হু/বন্ধ কর লেতা হু আপনে আঁখি/মে তুমহারা ওজুদ সে ভরা হু/মে হু শরাবি তেরে হোনে সে/মিল সাকে মুঝে সুলেমানকি মোহর/মে বিগলতা হু মোম কি তারাহ/যব্ তুমহারা চেহারা দেখতা হু/মে আপনি দ্রবতা সমরপিত করতা হু/অর বন্ যাতা হু আঁখ/তেরে হঠোকি।’
এ-কথা ইতিহাস লেখে শামস তিবরিজের প্রেম রুমিকে উতলা করে তুলেছিল। এক সাধক পুরুষের মধ্যে তিনি ইন্দ্রজালকে প্রকটিত হতে দেখেছিলেন। তিবরিজ ছিল ইন্দ্রজালের কায়া। তার প্রতি রুমির আবেগ দেখে আপনজনরা ঈর্ষা বোধ করতে থাকে। তাদের মনে মনে হয় তিবরিজ ছাড়া রুমি আর কাউকে চোখে দেখছে না। তারা ঈর্ষান্বিত হলো তিবরিজে। ঈর্ষা মানুষকে ক্রোধী ও হঠকারী করে। রুমির অনুসারী ও প্রিয়জনরা তিবরিজকে গোপনে হত্যা করে। তার কায়াকে ধ্বংস করে দিয়ে তারা ভাবে,-এবার নিশ্চয় রুমির হুঁশ ফিরবে। আপনজনের ছায়ায় সে সুস্থির হবে।
প্রিয়জনদের ভাবনায় ভুল ছিল। তিবরিজের বিরহ রুমিকে আরো উতলা করে তোলে। সাধক তিবরিজে সে খোদাকে প্রকটিত হতে দেখেছে। নিরাকার রূপে বিরাজিত এক ‘অনামা’কে ক্রীড়া করতে দেখছে। বিরহী প্রেমিক এবার তিবরিজে পাগল হয়। তার কায়া ভেদ করে নিজেকে নিরাকারে বিলীন করে। প্রেমের রীতি এমন-ই হয়! দমাতে গেলে খালি বাড়ে। দাবানল ছড়িয়ে পড়ে প্রেমীর হৃদয়ে। রুমি ব্যতিক্রম হতে যাবে কোন দুঃখে! নশ্বর তিবরিজের প্রতি তার প্রেমের সমাধি ঘটে অবিনশ্বর এক তিবরিজে নিজেকে ফিদা করে। রুমির আঁখি গিয়ে মিশে তিবরিজের আঁখিতে। আসলে তার আঁখি মিশে যায় অতলান্ত এক নিরাকারে। মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে ইন্দ্রজাল সেই নিরাকারে বিরাজ করেন।
আপনজনের ঈর্ষা রুমির জন্য উপকারী প্রমাণিত হয়েছে। মরমি কবি প্রেমের স্বরূপ চিনতে পেরেছেন। নশ্বর প্রেম থেকে অবিনশ্বর প্রেমে সুস্থির হয়েছেন। মানুষের দোটানা ও প্রতারণা ভুলে এবার তিনি ডুব দিলেন অথৈ প্রেমের সাগরে। নিজেকে ভালো করে চিনলেন। বুঝতে পারলেন তিবরিজ তার হাতের নাগালে রয়েছে। কায়া রূপে হয়তো নেই, কিন্তু ছায়া রূপে হৃদয়ে বিহার করছে। সুতরাং তিবরিজের ঠিকানা নিয়ে ‘সওয়াল পুছা’ নিরর্থক:-
‘তুম মেরা হাতো মে থে/অওর মে ঢুনতা রাহা তুমে অন্ধ আদমি কী তারা/মে তেরে হাতো মে/অওর সাওয়াল পুছতা রাহা।’
তিবরিজের কায়া ধ্বংস হয়ে মায়া প্রকটিত হলো। রুমি বুঝতে পারলেন তিবরিজকে খোঁজার জন্য দিল্লী-লাহোর যেতে হয় না। সে হাতের কাছে নড়েচড়ে। প্রেমচক্ষু উন্মিলিত হলে আপনা থেকে প্রেমীর হৃদয়ে ধরা দেয়। অস্থির রুমি সুস্থির হলেন প্রেমে! তার বিভ্রান্তি কেটে গেছে। উদভ্রান্তি দূরীভূত হয়েছে। তিনি এখন শান্ত ঊর্মিমালা। তার হৃদয়ে ইনসান ও খোদা এক বরাবর। দুজনের মাঝে তফাত ঘুচে গেছে।
রুমিকে অনুভব করে বাইজি রমণীর মনের বেদন শান্ত হয়ে আসে। প্রতারক বাঙালিকে ভালোবেসে ক্ষমা করে। রমণী এখন ফরিদা হয়ে গেছে। শেখ ফরিদে নিজেকে সমর্পণ করেছে। আত্মজার কানে ফরিদা হওয়ার মন্ত্র জপে:-
‘হযরত রুমি মুঝে প্রেম শিখায়া বেটিয়া। উনকা কালাম সে মেয়নে সিখা,-প্রেম ইনসানকি দিল্ মে রাজ করতি হ্যায়। ইনসানকি দিমাগমে রেহতি হ্যায়। তেরে পিতা আপনা দিমাগসে সে মুঝে ছোড় গায়ি। গলতি কিয়া। প্রেমকো ফেক্ দিয়া অন্দর সে। আচ্ছি হুয়ি ফেক্ দিয়া। লেকিন মে কিউ ফেক্ দো!
সুন বেটিয়া, মে কোই সুতে হুয়া আদমি নেহি থা। মেরে দিল্ মে প্রেম আভি তক রাজ করতি হ্যায়। লেকিন ও তেরে পিতাকে লিয়ে নেহি। ধোঁকেবাজকে লিয়ে মে রুতি নেহি বেটিয়া। মেরা পিয়ার এক ইনসানকো ঢুনতা রাহি। ইনসানকি দিল্ মে খোদাকো ঢুনতা মে। ধোঁকেবাজকি দিল্ সে খোদা নজর নেহি আতি। মাগার ইনসানকি দিল্ পার খোদা নজর আতি।
তেরি ধোঁকেবাজ পিতাকো মে পিয়ার নেহি কিয়া। মেরা পিয়ার ধোঁকেবাজিকা পর্দা হটা কর এক ইনসানকো নিকলা দিয়া। মে উস্ আদমিসে পিয়ার কিয়া থা। রুমি’কা ইয়ে বাত ইয়াদ রাখনা চাহিয়ে বেটিয়া,-‘হাম তো গির গায়ি হ্যায়/প্রেম কি হাতো মে/তুম আভি তক্ তুমহারি হাত হি হো/সুতে রহো।’ ইয়ে বাত তেরি পিতা আভি নেহি সমঝি। যব্ সমঝেগি, উসকা জিনা হারাম হো যায়েগি। তেরে লিয়ে ও রুয়েগি। কাশ মেরে লিয়ে ভি!’
বাইজি-কন্যার জীবনে দিনটি স্মরণীয় ছিল। কাঁচা বয়সে পরিণত বয়সের অভিজ্ঞতা ধারণ করা মুশকিল। মায়ের সব কথা সেদিন বুঝতে পারেনি। তার কাছে প্রেমকে ভীষণ গোলমেলে মনে হয়েছে। মনে-মনে শপথ করেছে মায়ের ভুলটি সে করবে না। পুরুষের প্রতারণার ফাঁদে নিজেকে নিঃস্ব হতে দেবে না। প্রয়োজনে পুরুষকে প্রতারিত করবে কিন্তু নিজে প্রতারিত হবে না। মায়ের কোলে মুখ ডুবিয়ে কন্যা শপথ করে প্রেমরোগকে সে প্রশ্রয় দেবে না। গোলমেলে রোগের খপ্পরে নিজেকে অসুস্থ করার দরকার কি বাবা! ওটা থেকে শত হস্ত দূরে থাকা নিরাপদ।
কন্যা যখন এমন শপথ করছে, সাত আসমানের উপরে বসে ইন্দ্রজাল তখন হাসছেন। চপলা যুবতীর শপথ শুনে মনে-মনে অঢেল আমোদ পাচ্ছেন। মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে যুবতীর মনে প্রেমের বাসনা জাগাতে দেবদূতকে ইশারা করেন। তার ষড়যন্ত্রে বাইজি-কন্যা অচিরে নিজের শপথ ভুল মেরে বসে। শহরের এক সাহেবজাদার নজরে পড়ে সে। চারচোখের মিলন ঘটতে বিলম্ব হয় না। কন্যা এবার মায়ের পথ ধরে। সাহেবজাদার অন্দরমহলে ঢোকার নেশায় নিজেকে সে উতলা করে।
মানুষ নিজেকে খুব শক্তিমান বলে ভাবে। কিন্তু সে আসলে অতোটা শক্তিমান নয়। বাইজি-কন্যা কখনো ভাবেনি প্রেম তাকে কাবু করবে। মায়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা সে কদাপি ভোলেনি। তবু প্রেম এসে তার উপরে ঢলে পড়ে। প্রেমরসের কারবারি হওয়ার কারণে তার পক্ষে ওটা এড়ানো মুশকিল হয়। যে প্রেমকে বাইজি অভিশাপ বলে স্বীকার করে সেই প্রেম তাকে মরণ অব্দি তাড়া করে ফিরে। প্রতারিত হচ্ছে জেনেও রঙ-রঙ্গিনীর মনে ঘরামি হওয়ার সাধ ঘোচে না। ঘরামি হতে গিয়ে রক্ষিতা হয়, তবু সাধ সঙ্গ ছাড়ে না। বাইজিরা দেহশিল্পী। যতোই খসরু ও গালিব আওরাক, দেহে ধস নামলে শিল্পীর কদর ফুরায়। তাকে কেউ পুছে না। রইসরা সহায় হয় না। বনিতা ও বাইজি এক কাতারে দাঁড়িয়ে পড়ে। জীবন ধারণের এই অনিশ্চয়তা হয়তো শিল্পীকে পুরুষের প্রলোভনে ধরা দিতে প্ররোচিত করে।
বাইজি-কন্যার মা জানতো তার আত্মজা প্রেমের টান এড়াতে পারবে না। রইস আদমির প্রলোভন তাকে টানবে। এটা বাইজির নিয়তি যে নিজের রূপ ও কণ্ঠ তার শত্রু হয়ে ওঠে। রইসের চোখ তাকে শিকার করে। সাহেবজাদার শখ ও খেয়াল তাকে ঘরে ঢোকায়। রূপের টান ধসে গেলে ঘরের বাইরে নিক্ষিপ্ত হতে হয়। প্রেমরসিক কালাকার জীবন শুরু করে একা। সে বিকচিত হয় একা। এবং পরিশেষে একা অস্ত যায়। তার শবযাত্রায় রইস ও রসিকের দেখা মিলে না। জীবনের শুরু ও শেষের মধ্যপথে ঘরামি হওয়ার দুঃস্বপ্ন শুধু শিল্পী-হৃদয়ে হানা দেয়। এই বাইজির জন্য রুমি ও শেখ ফরিদরা অপেক্ষা করেন। নিঃস্ব রমণী ফরিদা হয়। মানুষ ছেড়ে খোদার ঘরামি করে। নিয়তি মেনে বাইজি তার আত্মজার প্রেমরোগ অনুমোদন করে। না করে উপায় থাকে না।
বাইজি-কন্যাকে সাহেবজাদা বশ করে এক গানের জলসায়। বহুদিন পর বাইজির মনে কালাকার হওয়ার শখ জেগেছে। কন্যাকে গানের তালিম দিতে গিয়ে এই খেয়াল তার মাথায় চাপে। বাইজি কেন কালাকার সেটা প্রমাণের রোখ চাপে মনে। নিজের ঘরে তাই গানের জলসা বসায়। শহরের রইস আদমিকে দাওয়াত করে সেখানে। বাঙালির সঙ্গে দুর্ঘটনার পর শহরে তার কদর কমে গেছে। এঁটো শিল্পীকে কেউ পুছে না। তবু নিমন্ত্রণ পেয়ে অনুরাগীরা অনেকে বাইজি সদনে ভিড় করে। তারা শুনেছে বাইজির কন্যাটি বড়ো রূপবতী হয়েছে। মায়ের তালিম পেয়ে প্রেম-রঙ্গিনী হয়ে উঠছে। কণ্ঠে নাকি জাদু ধরে! নাচের মুদ্রায় চিত্ত অবশ করতে জানে। মা ও মেয়েকে পরখ করার বাসনায় রইসরা সেখানে ভিড় করে।
(ক্রমশ)
পুনশ্চ: এই আখ্যানে কাহিনীর প্রয়োজনে আনন্দমূর্তি গুরুমা কর্তৃক হিন্দি ভাষায় অনূদিত মাওলানা রুমির কবিতার কতিপয় স্তবক ব্যবহার করা হয়েছে। গুরুমা প্রায় নিয়মিত-ই বিভিন্ন সৎসঙ্গে রুমিকে পাঠ করে থাকেন। অনলাইন সূত্রে পাওয়া রুমির বিচ্ছিন্ন এই পঙক্তিগুলোর জন্য তাঁর ঋণ স্বীকার করছি।