ওসমান সমাচার – পর্ব ১১ । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ আগস্ট ২০১৬, ১২:০২ অপরাহ্ণ, | ২৯৯৮ বার পঠিত
‘রাং রাজওয়া’ ইন্দ্রজাল : পিট সায়েব ও বাইজি–কন্যা সমাচার (৩)
মেঘে হেলান দিয়ে ইন্দ্রজাল আত্মমগ্ন হয়ে পড়েন। দেবদূতরা এতোক্ষণ সম্মোহিত ছিল। ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। ইন্দ্রজালকে মগ্ন হতে দেখে তাদের ঘোর ভেঙে যায়। অস্ফুট-স্বরে সবাই মাথা দোলায়,-‘আপনার ইচ্ছা সর্বোত্তম প্রভু। এই শহরে অশান্তি ঘনিয়েছে। নেটিভ রমণীকে পাওয়ার জন্য সায়েব নিজেকে ধ্বংস করছে। আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ওদিকে শহরে লোকজন নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারছে না। ইংরেজ সায়েবদের অধীনে তারা থাকতে ইচ্ছুক নয়। সায়েব খেদানোর তাড়না দিন-দিন প্রবল হয়ে উঠছে। সায়েবরা অবশ্য শহর ছাড়তে রাজি নয়। অশান্তি ও নৈরাজ্য শহরে ছায়া ফেলেছে। এই উভয় সংকটে আমাদের করণীয় কী সেটা বুঝতে পারছি না। আপনি আদেশ করুন প্রভু।’
দেবদূতরা বিহ্বল দেখে ইন্দ্রজাল মুচকি হাসেন। হাতের ইশারায় মেঘরাজকে বৃষ্টি নামাতে নিষেধ করেন। শুধু বায়ুকে শান্তভাবে প্রবাহিত হওয়ার নির্দেশ দেন। ইন্দ্রজালের ইশারা পেয়ে বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা বাতাসে দোলে। বাতাস পেয়ে সায়েবের বুটিদার জামা পতপত করে ফুলতে থাকে। সায়েব এখন গাছের গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। ইন্দ্রজাল তার চোখে নিদ্রা গাঢ় করেছেন। তার ইচ্ছা সায়েবটি আজ এই বৃক্ষের নিচে রাত্রি যাপন করুক। সকাল হলে ফাজিল ছোকরার দল তাকে খুঁজে নেবে। তারা তাকে গৃহে পৌঁছে দেবে। আপাতত সে গাছতলায় ঘুমাক।
রাত শেষ হতে বেশি বাকি নেই। গাছের ডালে ত্রিকালজ্ঞ প্যাঁচা এসে বসেছে। মাথা নিচু করে সায়েবকে দেখছে। প্যাঁচা দিনে ভালো দেখতে পায় না। রাতে তার চোখ সূক্ষ্ম কীট-পতঙ্গ সহজে দেখে ফেলে। এটা তাকে বিজ্ঞ করে তুলেছে। বিজ্ঞরা অন্ধকারে আলোর ইশারা দেখতে পায়। দিনের আলোয় কোনোকিছু গোপন থাকে না। যিনি বিজ্ঞ তার এটা বিব্রতকর। সবকিছু দেখতে গিয়ে কোনোকিছু দেখা হয় না। অনেককিছু খেয়াল করতে গিয়ে আরো অনেককিছু বাকি থেকে যায়। দিনের আলো তাই বিজ্ঞতার প্রতিপক্ষ। বিজ্ঞ প্যাঁচা দিনে চোখ বুজে ঘুমায়। ইন্দ্রজালের ইশারায় বিশ্রামে থাকে। রাতে জগৎ ঘন আঁধারে ঢাকা পড়ে। প্যাঁচা তখন চোখ খোলে। তার তীক্ষ্ণ চোখ প্রতিটি খুঁটিনাটি পরিষ্কার দেখতে পায়। অন্ধকার ভেদ করার এই ক্ষমতা প্যাঁচাকে বিজ্ঞ ও প্রবীণ করে তুলেছে। শহরে এখন অন্ধকার ঘনীভূত হয়েছে। লোকজন গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত। গাছের নিচে ইংরেজ সায়েবের উপর নিদ্রা ভর করেছে। তার অশান্ত হৃদয় নিদ্রার ঘন রসের প্রভাবে শান্ত ও সুস্থির হয়ে ঘুমাচ্ছে।
নিদ্রাঘন এই রাতে শুধু প্যাঁচা ও ইন্দ্রজাল জেগে আছেন। প্যাঁচা মুখ নিচু করে সায়েবকে পাহারা দিচ্ছে। সূক্ষ্ম কোনো কীট যদি সায়েবকে বিরক্ত করে প্যাঁচা তাকে আক্রমণ করতে দেরি করবে না। এটা ইন্দ্রজালের আদেশ। প্যাঁচা এখন অজ্ঞ সায়েবের পাহারাদার। মেঘে হেলান দিয়ে ইন্দ্রজাল রাতের শহর দেখছেন। ভোর হতে বেশি বাকি নেই। ঘুমশান্ত শহরটি অশান্ত হতে খুব বেশি দেরি নেই। গাছের নিচে সায়েব ঘুমের ঘোরে বিড়িবিড় করে,-‘অয়ি রমণী, আমারে দেখা তুমি দিবেই। আইজ দেখা না দিলে আগামীকল্য নিশ্চয় দেখা দিবে। তুমারে আমি হৃদয় দিয়া পিষিবো। চাপ দিয়া গুঁড়া করিবো। সুগন্ধ দিয়া তুমারে প্রলোভিত ও ধ্বংস করিবো। দেখি তুমি কেমন করিয়া নিজেরে গোপন রাখো।’
সায়েবকে বিড়বিড় করতে দেখে প্যাঁচা ‘ভূত ভূত ভূতুম’ বলে ডানা ঝাপটায়। ইন্দ্রজাল রাতকে ইশারা করেন দ্রুত সরে যেতে। রাত এখন ভোরের দিকে সরে যাচ্ছে। ক্ষীণ চাঁদ ডুবে গিয়ে দিবাকর কমলা রঙে আভাসিত হয়েছে দিগন্তে। দিবাকরের উদয় টের পেয়ে প্যাঁচা চোখ বুজে ফেলে। ডানা ঝাপটে শূন্যে উড়াল দেয়। গাছের পাতারা চোখ মেলতে শুরু করেছে। শাখা-প্রশাখার ফোকর দিয়ে কমলা রঙের আলো সায়েবের ফর্সা মুখে পড়ে। তার ঘুমশান্ত মুখটিকে অপরূপ লাগছে। অপরূপ সায়েব থেকে আধ কিলোমিটার দূরে হোটেল মালিক তার ঝাঁপি খোলে। মস্ত বড়ো মাটির চুলোয় আগুন ধরানো হয়েছে। বড়ো হাঁড়িতে পানি টগবগ করে ফোটে। ময়দার খামি ও সেদ্ধ চালের গন্ধ বাতাসে ভাসে। একটু পরে লোকজনে হোটেলটি গমগম করবে। তার আভাস এই ভোররাত্রি।
ইন্দ্রজাল চঞ্চল হয়ে পড়েছেন। তার বিশ্রামে যাবার সময় হয়েছে। মেঘ ছেড়ে অনন্ত উদ্যানে ঢুকবেন। মেঘরাজকে সরে যেতে ইশারা করেন। তার ইশারা পেয়ে মেঘরাজ নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। আকাশ এখন মেঘমুক্ত নীল। কমলা রঙকে ফালি-ফালি করে কেটে ইস্পাত-স্বচ্ছ আলো দিগন্তে আভাসিত হয়েছে। সেই আলো সায়েবের মুখে এসে পড়ে। সড়ক থেকে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ ভেসে আসছে। শহর জেগে উঠেছে। লোকের কলরব ঘন হচ্ছে সড়কে। সায়েবের প্রায় নিকট দিয়ে এক গান্ধীভক্ত চলেছে। নিজের মধ্যে সমাহিত হয়ে হাঁটছে। এই সাত সকালে তার কণ্ঠ জগদিশ্বরের বন্দনায় ভরে উঠেছে। গান্ধীজি প্রতিদিন সকালে প্রভুকে স্তব করেন। আত্মমগ্ন হয়ে জগতের মঙ্গল কামনা করেন। তার কণ্ঠ ভরে ওঠে রঘুপতির বন্দনায়। ভক্তের কণ্ঠে তিনি এখন প্রতিধ্বনি তুলছেন। দুই হাত জড়ো করে ভক্তটি গাইছে-‘রঘুপতি রাঘব রাজারাম/পতিত পাবন সীতারাম/ঈশ্বর-আল্লা তেরো নাম/সবকো সুম্মতি দে ভগবান।’
বন্দনায় নিমগ্ন ভক্ত চোখ মুদে সায়েবকে অতিক্রম করে। তাকে সে দেখতে পায়নি। দিনের আলোয় অনেককিছু দেখা যায় না। কোলাহল ও কলরবের কারণে অনেককিছু ঠাহর হয় না। গাছের নিচে ঘুমন্ত সায়েবকে সে দেখেনি। ইন্দ্রজালের ইশারা টের পায়নি। দিবাকর প্রবল হলো দেখে শহরের ফাজিল ছোকরাদের তিনি ইশারা করেন। সায়েবকে তারা ঘিরে ধরে। পরস্পরের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়। সায়েবকে সকলে ধরাধরি করে কাঁধে উঠায়। পাগলাটে সায়েবের স্বভাব সম্পর্কে তারা অবগত। কাঁধে করে বাড়ি পৌঁছে দিতে তাই বিলম্ব করে না।
ইন্দ্রজাল উপর থেকে সব দেখছেন। সায়েব এখন ছোকরাদের কাঁধে চড়ে বাড়ি ফিরছে। তার ঘুম পুরোপুরি কাটেনি। খৈনিকণ্ঠি রমণী চেতনা অবশ করে রেখেছে। ঘুমের ঘোরে বিড়িবিড় করছে,-‘কিতনা চাহিয়ে?’ নিজেই উত্তর দিচ্ছে,-‘কুছ্ নেহি।’ ছোকরারা সেই উত্তর শুনতে পায় না। তারা এখন পালকি-বেহারা হতে ব্যস্ত। আজব এক ইংরেজ সায়েবকে কাঁধে করে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার উত্তেজনায় ছটফট করছে। সায়েবের তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে বিড়বিড় করেই যাচ্ছে,-‘অয়ি রমণী, তুমারে আমি গুঁড়া করিবো। পোশাক ও সুগন্ধ দিয়া প্রলোভিত করিবো। চাপ দিয়া ভাঙিবো তুমারে।’ বেহারার দল বয়সের চাঞ্চল্যে খৈয়ের মতো ফোটে। জ্বলজ্যান্ত এক ইংরেজ সায়েবকে কাঁধে বহন করার ঘটনায় তারা অঢেল আমোদ পাচ্ছে। বেহারাদের ‘উ-হুম-না’ তালে সুড়কিফেলা রাস্তায় নেমে পড়ে।
সায়েববাহী ছোকরাদের পাশে একদল স্বাধিকারমত্ত যুবকের আবির্ভাব ঘটেছে। অদ্ভুত দৃশ্যটি দেখে তারা থেমে পড়ে,-‘এই কী হয়েছে রে? কে ওটা?’ সাত সকালে যুবকদের দেখা পেয়ে ছোকরাদের উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। তাদের কাঁধে সায়েব, পাশে স্বাধিকারমত্ত বিপ্লবীরা চলেছে। ইন্দ্রজাল দূর থেকে সব দেখছেন। দেবদূতরা তাকে ঘিরে ধরেছে। তারাও দেখছে। ছোকরারা বিব্রতমুখে উত্তর করে,-‘পিট সায়েব গো। চিনতে পারছো না! নেশা করে গাছ তলায় পড়ে ছিল। বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।’
যুবকদের মুখে মেঘ ঘনিয়ে ওঠে,-‘হুম! ধন্য করেছো! ভর সকালে মাতাল সায়েবকে কাঁধে বইছো। যাও বাড়ি পৌঁছে দাও। শেষবার বাড়িতে ঘুমিয়ে নিক। আর তো বেশি দেরি নেই। সায়েব এবার গঙ্গাযাত্রায় যাবে!’ ছোকরাদের পাশ ঠেলে যুবকরা সামনে এগোয়। তাদের কণ্ঠে মুকুন্দ দাস ভর করেছে। স্বাধীনতার প্রেরণায় সকলে উদ্দীপ্ত হয়ে আছে। প্রেরণাভরে গাইছে,-‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।/হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।’ সায়েব খেদানোর মন্ত্রে দীক্ষিত যুবকরা চারণকবিকে সঙ্গী করে মূল সড়কে উঠে পড়ে।
যুবকদের ঠেসমারা কথা সায়েববাহী ছোকরাদের মনঃপুত হয় না। তারা পেছন থেকে ভেংচি কাটে,-‘উঃ! ভারি আমার বিপ্লবী এসেছেন! সায়েব খেদাবেন! পিটকে গঙ্গাযাত্রা করাবেন! গাছে কাঁঠাল আর গোঁফে তেল। ভারি আমার স্বরাজী হয়েছেন!’ স্বাধিকারমত্ত যুবকদের মুখ ভেংচি দিলেও মুকুন্দ দাস সকলের প্রিয়। ডানপিটে বেহারার দল তাই সায়েব তাড়ানিয়া গান ধরে। তাদের কাঁধে সায়েব। তারা গাইছে সায়েব খেদানো রণসঙ্গীত। কোরাসগানে ভরে উঠেছে দাপুটে সকাল। কোরাসকন্ঠি ছোকরার দল সমতালে গাইছে,-‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে/মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমররঙ্গে/তা থৈ তা থৈ দ্রিমি দ্রিমি দ্রম দ্রম॥/ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে॥/ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে/মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমররঙ্গে।।’
মেঘমুক্ত আকাশে তখন অন্য খেলা শুরু হয়েছে। ছোকরাদের গানে তাল দিয়ে আকাশে চিল পাক খায়। শিকারি পাখির দল শো করে সায়েবের নিকটে নেমে আসে। সায়েবকে একপলক দেখে নিয়ে ফের ডানা ঝাপটে উপরে ওঠে। পাক খায় নিঃসীম নীলের সাগরে। অনেক উঁচু থেকে ইন্দ্রজাল চিল ও ছোকরাদের খেলাটি দেখছেন। চিলের গোত্তা খেয়ে মাটিতে নেমে আসা ও পুনরায় উঁচুতে উঠে পড়া তাকে ভাবিয়ে তোলে। শিকারি পক্ষীর আচরণে কীসের যেন ইঙ্গিত পাচ্ছেন! দেবদূতদের ডেকে জিজ্ঞেস করেন,-‘কী ব্যাপার বলো তো? এই ভর সকালে আকাশে চিল পাক খাচ্ছে কেন? ঘটনা কী?’
ইন্দ্রজালের মতো দেবদূতরাও চিলকে দেখতে পেয়েছে। তারা উত্তর করে,-‘লক্ষণ শুভ নয় প্রভু। শহরে অশান্তি ঘনিয়েছে। যুবকদের দেখলেন তো! শান্ত-স্বভাবী ছেলেগুলো কেমন মারমুখো হয়ে পড়েছে!’ ইন্দ্রজাল ক্ষণিক মৌন থাকেন। ফাজিল ছোকরার দল ততোক্ষণে সায়েবের বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়েছে। তাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে বিছানায় শোয়ানোর তোড়জোর চলে। তাদের দিকে তাকিয়ে ইন্দ্রজাল এবার আদেশ করেন,-‘তবে আর দেরি কেন! শহরে অশান্তি ঘনাও।’
ইন্দ্রজালের ইশারায় শহরে অশান্তি ঘনায়। শান্ত শহরটি হঠাৎ সরগরম হয়ে ওঠে। সায়েবের দাপট দেখে অভ্যস্ত লোকেরা সায়েব খেদানো গানে মুখরিত হয়। পিটার সায়েবের রঙদার ঘটনা সেই উত্তেজনার তোড়ে চাপা পড়ে। গাছতলায় তার রাত্রিযাপন নিয়ে লোকে অবশ্য কানাকানি করে। পিটারের বাহানায় ইংরেজ সায়েবদের ঠেস দিয়ে কথা বলে:—
: ‘পিট তো গাছতলায় শুয়েছে। কালেকটর কোথায় শোবে কেউ বলতে পারো?’
— ‘না ভাই! কোথায় শোবে কালেকটর?’
: ‘কেন জানো না? সায়েব শোবে শেওড়াতলায়!’
—‘আরে না, ভুল বলছো। সায়েব শেওড়াতলায় শোবে না। ভূত হয়ে ঝুলবে শেওড়া গাছে।’
ডাকাবুকো কালেকটরকে শেওড়া গাছে ভূত করার আমোদে হাসির ধুম পড়ে শহরে। ভূতের লাইন ক্রমশ দীর্ঘ হয়। কালেকটর থেকে পুলিশ সুপার, এমনকি শ্রদ্ধেয় ফাদার পর্যন্ত সে ভূতের মিছিলে যোগ দেয়। শান্ত শহরে নেটিভ ও সায়েব এখন মুখোমুখি। নেটিভের মনে সায়েব বর্জনের রোখ চেপেছে। শৌখিন নেটিভের ঘরে বিলেতি কেতা পরিহারের আওয়াজ উঠছে। স্বদেশী ও স্বরাজী শহর জুড়ে গুনগুন করে। সেই ভ্রমর-গুঞ্জনে সুদর্শন পিটার সায়েবের প্রতি লোকের মন বিষায়।
শহরে পিট সায়েবের আবেদন আগের মতো নেই। ‘খামখেয়ালি হলেও সায়েবের মনটি ভালো! দেখতে কী সুন্দর! যেন রাজপুত্তুর!’-বাক্যগুলো এখন আর আগের মতো প্রশ্রয় পায় না শহরে। তাকে নিয়ে লোকের কৌতূহল কৌতুকে রূপ নিয়েছে,-‘শুনেছো, সায়েব বিলেত থেকে নতুন স্কার্ট আমদানি করেছে। মেমরা নাকি পরবে। আমি বলি সায়েবকে খাদি পরাও। আর মেমদের শাড়ি পরিয়ে শহরে ঘোরাও। দুজনে খুব মানাবে!’ লোকের মনে এখন চরকার জোয়ার বইছে। তাঁতিরা আবার শহরে ফিরেছেন। বিলেতি পোশাক ও সুগন্ধে লোকের রুচি কমছে। শৌখিনতার কারবারি পিট সায়েবের জন্য সময়টি মন্দ বৈকি!
এই শহরে একদিন তাঁতিদের রাজত্ব ছিল। চরকা ঘুরতো ঘরর ঘর্। লোকে তাঁতবোনা জামা গায়ে চড়িয়ে পোশাকের প্রয়োজন ও শখ মেটাতো। তাঁতিরা ছিল শহরের বস্ত্রকার। সায়েবরা আসার পর তাদের কপাল পুড়ে। বাজার ছেয়ে গেলো শস্তা সুতোর বিলেতি পোশাকে। ওটা শস্তা হলেও টেকসই। চটজলদি তৈয়ার হতে ও বাজারে আসতে সময় লাগে না। তাঁতির চরকা এখন আর আগের মতো ঘোরে না। ঘরে বউ-ছেলে উপোস করে মরে। দধি ও সরু চালের পায়েসান্ন দূরে থাক্, মোটা চালের ভাত জোটে না ঘরে। চরকার জোরে বস্ত্রকার বেশ স্বচ্ছল ছিল। ওটা ঘুরিয়ে আলতা পায়ের রমণীর জন্য কস্তাপেড়ে শাড়ি বোনা করতো। সেই শাড়ি গায়ে চড়িয়ে রমণীরা দিব্যি মা লক্ষ্মী হয়ে উঠতেন। তাঁতির জন্য সেটা সুখের দিন ছিল। দর্জির জন্য মনোরম ছিল সেই দিন।
‘যায় দিন ভালো’,-এই প্রবাদবাক্যটি তাঁতির ক্ষেত্রে বেশ খাটে। শাড়ি, চোলি ও ঘাগড়া তখন রমণীর মন কেড়ে নিতো। বনেদি ঘরের লক্ষ্মীমন্ত বউয়ের জন্য তাঁতি চরকা কাটতো। সাহেবজাদির জন্যও তার চরক সমানে ঘুরেছে। আবার আমজনতার জন্য চরকা ঘোরাতে বস্ত্রকারের শুচিবায় ছিল না। তাঁতি ও খলিফারা ছিল শহরের অংশ। রমণীর আবদার ও অভিমান পূরণের কারিগর। সায়েবরা এলো নতুন কারিগর নিয়ে। চরকা নির্বাপতি হলো কারখানায়। তাঁতি তার চরকা গুটিয়ে শহর ছেড়ে পালালো। ঢুকে গেলো গহীন গ্রামে। বিলেত যেখানে পৌঁছায়নি ভালো করে! শহর ভরে উঠলো সায়েবি সুতির গন্ধে। সম্পন্ন নেটিভ রমণীর চোখে বিলেতি পরার নেশা। খলিফাকে বিলেতি ছাদের সেলোয়ার ও কামিজের অর্ডার করে। শহরে দিন এলো সায়েবিয়ানার।
সায়েবি হওয়ার দিনগুলোয় পিট সায়েবের আগমন ঘটে। লোকে দেখে রাজপুত্রের মতো সুদর্শন এক সায়েব শহরে পা রেখেছে। চোগা প্যান্টের সঙ্গে বুটিদার শার্ট পরে অলি-গলি ঘুরছে। শার্টের উপরে হাফহাতা জ্যাকেট চড়িয়ে ইংরেজ ও বনেদি নেটিভের ঘরে জাঁকিয়ে বসেছে। সায়েব দেখতে সুন্দর। কমনীয় বচনে নতুন পোশাক ও সুগন্ধির খবর শোনায়। তার ঝোলা থেকে মনোহর জুয়েলারি বেরিয়ে আসে। ভূ-বর্ষের গয়নার মতো সেগুলো ভারী ও জমকালো নয়। এই জুয়েলারী হালকা। ইংরেজ মেমের ন্যায় রাজহংসিনী। গলায় ও আঙুলে পরলে নিজেকে রাজহংসী বলে ভ্রম হয়। বিলেতি পোশাক ও সুগন্ধে সায়েব শহরকে রঙিন করে তোলে। পলকা জুয়েলারির ছটায় লক্ষ্মীমন্ত বধূর মনে চমক লাগায়। সাহেবজাদিকে আহ্লাদী করে তোলে। এটা সত্য, পিট সায়েবের চাপে পড়ে শহরে সায়েবি রীতির প্রচলন ঘটে। পুরোনো কেতা ভুলে লোকে সায়েব হওয়ার মহড়া দিতে নামে। ভদ্র ঘরের নেটিভ মেয়েরা ঘরের ভিতরে বিলেতি ছাদের পোশাক পরেন। ফুলহাতা ব্লাউজ ও শেমিজ পরার চল ঘটে।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি সকল দিকে অগ্রণী। রবি কবির পিতামহ ব্যবসাদার ছিলেন। ভূ-বর্ষে কল-কারখানা জোরালো করার স্বপ্ন দেখতেন। ব্যবসা ও আভিজাত্য একত্রে সামাল দিয়েছেন। জনশ্রুতি বলে প্যারিসের রাজন্যরা নাকি তাকে লাল গালিচায় সম্বর্ধিত করেছিল। রবি কবির পিতা দেবেন্দ্রনাথ জরাজীর্ণ হিন্দু ধর্ম সংস্কারে মন দিয়েছেন। কেশব সেনকে সেই মন্ত্রে মাতিয়েও তুলেছেন। বোলপুরে আশ্রম খুললেন দেবেন্দ্রনাথ। নিরাকার ব্রহ্মের আরাধনায় সেখানে বুঁদ হয়ে থাকেন। উপনিষদের মনোরম ইন্দ্রজালে কিশোর রবির হাতেখড়ি পিতার মাধ্যমে ঘটে। বোলপুরের আশ্রমে বসে আদরের রবিকে গ্রহ-তারা-নক্ষত্র চেনাতেন।
রবির বড়ো ভাই সত্যেন্দ্রনাথ সায়েব–সুবোর প্রশাসনে প্রথম আইসিএস হয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। তার স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী এবার শাড়ির সঙ্গে শেমিজ ও ব্লাউজ পরতে শুরু করলেন। শাড়ির উপর ভিক্টোরিয় ছাদের জ্যাকেট পরার চল ঘটালেন। ভদ্রঘরের রমণীদের এটা মাতিয়ে তুলেছিল। শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ রমণী-অঙ্গে জায়গা করে নিলো। কালের পালাবদলে দেশী ও বিলেতির মিলমিশ আরো নিবিড় হয়েছে। সালোয়ার ও কামিজের সঙ্গে শেমিজ পরা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। শীতের কুয়াশা ঘন হলে বুটিদার শাল ফেলে অনেকে এখন কার্ডিগান পরে। আলতা-চুড়ির সঙ্গে নেকলেস ও লিপস্টিক কদর পায়। গন্ধকেশী তেলের পাশে বিলেতি শ্যাম্পু বউ-বিনিদের শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছে। ধুতি-পাঞ্জাবি ও আচকানের সঙ্গে তাল দিয়ে ফ্যানেল স্যুট জনপ্রিয়তা লাভ করছে। শৌখিনতার ফেরিওয়ালা পিটার শহরকে বিলেতি সজ্জা ও প্রসাধনে মাতিয়ে তুলেছে।
মোদ্দা কথা পিট সায়েবের জামানায় এসে বিলেতির দিকে সম্ভ্রান্ত নেটিভদের প্যাশন চরমে উঠছে। ফ্লেচার টি শপ এখনো বহাল রয়েছে। তার পাশে ‘পিটার ক্লথস এন্ড জুয়েলারি’ নিজের জায়গা বুঝে নিয়েছে। সিনে-পর্দায় নির্বাক যুগ শেষ হওয়ার পথে। টকির যুগ এসে গেছে। বম্বে টকিজে বুঁদ হওয়ার দিন শুরু হলো বলে। প্রথম সবাক টকি ‘আলমআরা’র জন্য অচিরেই লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। শরৎচন্দ্রের রাজত্ব যথারীতি চলছে। ভদ্রঘরের গিন্নিরা ‘দেবদাস’ ও ‘শেষ প্রশ্ন’ পাঠ করে চোখের জল মোছেন। জমিদার-নন্দন প্রমথেশ বড়ুয়ার নায়ক ও পরিচালক হয়ে শহর-মাতানোর যুগ প্রায় সমাগত। কলকাতার মঞ্চে নটে শিশির কুমার ভাদুড়ি ও নটরাজ উদয় শঙ্করের দিন শুরু হয়ে গেছে।
ওদিকে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও আয়েত আলী খাঁ ধ্রূপদ-খেয়ালের জাদুকরি গমকে রসিক শ্রোতাকে এখনো ধরে রেখেছেন। দুই কিংবদন্তির সুরজালে রইস আদমিরা মুগ্ধ হয়ে আছে। নাবাল কিশোর রবিশঙ্কর অচিরে বয়েত নেবেন আলাউদ্দিন খাঁর শ্রী-চরণে। সেই প্রস্তুতি চলছে। আমির খান ও বেলায়েত খানের যুগ শুরু হতে বড়ো দেরি নেই। লখনৌ নিবাসী সঙ্গীত-রসিক ধূর্জটিপ্রসাদ কলকাতা সফরে এলে গানের জলসা বসে। রবি ঠাকুর ও অতুলপ্রসাদের আগমন সেখানে একপ্রকার ধরাবাঁধা। শরৎচন্দ্র মাঝেমধ্যে সেই জলসায় ঢুকে পড়েন। শহরের বিদ্বৎসমাজ এইসব মানি-গুণী নিয়ে কলরব করে। সায়েব–সুবোর জাঁকালো দাপটের মধ্যে ভূ–বর্ষে তৈরি হয় মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির এক নতুন ইতিহাস।
কলের গান শহরে জাঁকিয়ে বসেছে। টমাস আলভা এডিসনের আশ্চর্য আবিষ্কারে ইন্দু ও কুন্দুবালা সমানে বাজেন। বাইজি কাননবালার আবির্ভাব ঘটলো বলে। কে. এল. সায়গলের নায়ক ও গায়ক হতে বেশি বিলম্ব নেই। রেডিও সিলোনে তার গান বাজা সময়ের অপেক্ষা মাত্র। রবি বাবুর গান শহরে বেশ প্রচলতা পেয়েছে। নজরুলের শ্যামা বন্দনায় অনেকে মুগ্ধ হয়। প্রমত্ত বিদ্রোহী এক শহর থেকে অন্য শহরে চষে বেড়ায়। ঠোঁট পানের রসে রঙিন। পদ্মপলাশ চোখ দুটো বিদ্রোহের বহ্নিশিখায় দামাল। প্রেমের আবেগে চঞ্চল ও অভিমানী। অস্থির এই ধূমকেতুকে সরোজিনী নাইডু বড়ো স্নেহ করেন। সায়েব তাড়ানোর গানে মত্ত ধূমকেতু অনশন করলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। প্রতিভার সাগর রবি ঠাকুর তাকে উৎসর্গ করেন ‘বসন্ত’ নাটিকা। মায়ের স্নেহে সরোজিনী অনশন ভাঙান। নজরুলকে রোখে সাধ্যি কার!
নজরুল এক চিরচঞ্চল শিশু। রূপের পূজারী নটরাজের প্রাণখোলা হাসির তরঙ্গে রমণী-হৃদয় চমকিত হয়। গায়ক ও নায়ক কবিকে দেখে রক্তে পুলক জাগে। সে এক প্রমত্ত নটরাজ। হাবিলদার ও কবির মাঝে তফাত মানে না। ‘শনিবারে চিঠি’তে সজনিকান্ত ‘হাঁড়িচাচা’ বলে তাকে খোঁচা মারেন। শহরের বিদ্বানরা সেই খবর শুনে হাসে। প্রবাসীর সঙ্গে শনিবারের পাতা উলটায়। হাঁড়িচাচার এতে থোড়াই কেয়ার! সজনিকান্তকে লক্ষ করে কথার তুবড়ি ছোটায়,-‘রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,/তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা।/বড় কথা বড় ভাব আসে নাকো মাথায়, বন্ধু, বড় দুঃখে!/অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছো সুখে!’
নজরুল এক দামাল শিশু! অস্থির সময়ের উত্তেজনা তার মধ্যে ধরা পড়ে। নাক ঝাঁঝিয়ে উঠে সায়েব খেদানো বারুদের গন্ধে। কবি এক খেয়ালি দেবদূত। নিজেকে বশে রাখতে অনিচ্ছুক। ঈশ্বর তাকে অঢেল দিয়েছেন। প্রতিভার রসে টইটুম্বুর করে ধরায় পাঠিয়েছেন। খেয়ালি দেবদূত প্রতিভা বোঝে না। সাধনায় নিজেকে গাঢ় করতে তার ইচ্ছে করে না। সে হলো ডানপিটে। অপচয় তার রক্তে অহর্নিশ মাতন তোলে। সব ফেলে-ছড়িয়ে যেদিকে খুশি ধায়। প্রাণের আবেগে সারাদিন কলরব করে। নজরুল চির-উচ্ছৃংখল, চির-অশান্ত এক নাবাল কিশোর। তার অস্থিরতা তাকে ক্লান্ত করে। বিদ্রোহের বহ্নি ও রূপ সম্ভোগের ক্ষুধা রক্তে ঘোঁট পাকায়। চির-অশান্তের মনে নির্বেদ ঘন হয়। অশান্ত কবি শ্রান্ত হয় গান করে,-‘মুছাফির মোছ রে আঁখিজল/ফিরে চল আপনারে নিয়া/আপনি ফুটেছিল ফুল/গিয়াছে আপনি ঝরিয়া।।’
সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মত্ত হাবিলদার কোষ থেকে তরবারি বের করে। রমণীর আলতারঙা পায়ে নাঙ্গা তলোয়ার সমর্পণ করে,-‘হে মোর রানী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।/আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।/আমার সমর-জয়ী অমর তরবারি/দিনে দিনে ক্লান্তি আনে, হয়ে ওঠে ভারী,/এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি,/এই হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে॥’
সমরজয়ী কবি লড়াই করে ক্লান্ত। প্রাণের বন্যায় সব ফেলে-ছড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার নেশায় ক্লান্ত। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত। বৈষম্য ও অনাচারের বিরুদ্ধে ধূমকেতু হওয়ার ভার অসহ্য হয়ে পড়ছে দিন-দিন। কবির হৃদয় ভরে উঠেছে অভিমানের বিষে,-‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিবো না,/কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিবো না।/নিশ্চল-নিশ্চুপ/আপনার মনে পুড়িবো একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।’
এটা কাকতালীয় বটে রবি ঠাকুরের অন্তিম প্রয়াণের পর অশান্ত কবি আর দেরি করেনি। ‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্ত পথের কোলে/শ্রাবণের মেঘ ছুটে এল দলে দলে উদাস গগন-তলে।/বিশ্বের রবি ভারতের কবি,/শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি।…বাঙালি ছাড়া কি হারাল বাঙালি কেহ বুঝিবে না আর,/বাংলা ছাড়া এ পৃথিবীতে এত উঠিবে না হাহাকার।…’-রবিকিরণের প্রতি নিজের অর্ঘ্য ঢেলে বিদ্রোহী নিজেও বাকরহিত হয়ে পড়ে! শহর আর তাকে শুনতে পায় না। ছেলে বুলবুল মারা গেছে সেই কবে! শিশুটির মধ্যে প্রতিভার দ্যুতি ও চমক ছিল। ছোট্ট শিশুর বিরাট হওয়ার সম্ভাবনায় কবি চমকে উঠেছিল। ইন্দ্রজাল তাকে অকালে উঠিয়ে নিলেন। কাতর কবির কোলে শিশুর মৃতদেহ। তাকে কোলে করে কবি গাইছে,-‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি।/করুণ চোখে চেয়ে আছে সাঁঝের ঝরা ফুলগুলি।’
কবির কণ্ঠে গান। চোখে বাঁধনহারা অশ্রু নেমেছে। সেই অশ্রু আর থামেনি। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মত্ত কবি এখন শান্ত। তার চোখ দিগন্তে নির্বিকার। বুঝি ইন্দ্রজালকে তালাশ করছে মনে–মনে! ঠোঁট দুটো আগের মতো পান ও গানের রসে উচ্ছল নয়। কেউ সামনে বসে গান করলে মাখা নাড়ায়। বিড়িবিড় করে কী বলে সে একমাত্র ঈশ্বর জানেন! গান ভুল করে গাইলে চোখ ঘুরিয়ে তাকায়। মুখের রেখায় রাগী ও খ্যাপাটে মানুষের ছবি ফুটে ওঠে। এই নজরুলকে দেখে শহরের লোক কষ্ট পায়। সজনিকান্তের বুক হয়তো অচেনা বিষাদে ভার হয়। বুদ্ধদেব বসু দামাল কিশোরকে নীরবে প্রণতি জানান। প্রতিভা বসুর হয়তো মনে পড়ে, সেই কবে চঞ্চল দেবদূত তাদের বাড়িতে পা রেখেছিল। প্রতিভাকে পাকড়াও করে বলেছিল,-‘আসো তোমাকে গান শেখাই।’ প্রতিভা বড়ো মুগ্ধ হয়েছিলেন কবির বাঁধনহারা রূপের উল্লাসে।
ইন্দ্রজাল কবির কণ্ঠ ও বোধ কেড়ে নিয়েছেন। ভেতরে সুরের অস্থির তরঙ্গ থামানো যায়নি। ওটা থামানো সম্ভব নয়। কারণ, তাকে তিনি অস্থির করে মর্ত্যে পাঠিয়েছেন। বিধান জারি করেছেন, সে অস্থির থাকবে চিরকাল। প্রাণের বন্য আবেগে চলবে। স্থির পায়ে কোথাও দাঁড়াবে না। নজরুল ইন্দ্রজালের আদেশের অধীন। সে তাই চির অস্থির। লেটোর দলে গান করার দিনে অস্থির। কমরেড মোজাফফরের সান্নিধ্যে অস্থির। তাকে তিনি সাম্যবাদী হওয়ার দীক্ষা দিয়েছেন। স্থিতধী কমরেডের সাধ্য কী নাবাল কিশোরকে বশে রাখে! কমরেডের সান্নিধ্যে নজরুল খ্যাপা দুর্বাসা হয়। প্রাণচঞ্চল কবি স্বপ্নের ঘোরে হুইটম্যানকে দেখে ফেলে। তার রক্তে বিদ্রোহী ছলকে ওঠে। নিজের আমিত্বকে সাড়ম্বরে ঘোষণা করে,-‘আমি কভু প্রশান্ত,-কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী/আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!’
নাবাল কিশোরের আমিত্বের দর্পে কমরেড চমকে উঠেন। নজরুল এক দামাল শিশু। সকল বিবেচনা ও বিচারের বাইরে ঘুরে। যুক্তির সুস্থিরতা পায়ে পিষে সৃষ্টিসুখের গান ধরে,-‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে/মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে/আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।/আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে/বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার-ভাঙা কল্লোলে!/আসল হাসি, আসল কাঁদন, মুক্তি এল, আসল বাঁধন,/মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।/ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে-/আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!’
কৃমিকীট সমালোচকের পক্ষে এমন উল্লাস-প্রবণ নটরাজের নাগাল পাওয়া মুশকিল। ইন্দ্রজাল তাকে সমালোচকের বাইরে রেখে গড়েছেন। কাব্য ও অনুপ্রাসের অংক দিয়ে নজরুলকে মাপামাপি তাই নিরর্থক। কবিতার মূল্য ও পরিমিতি দিয়ে তাকে বিচার করা হয়তো অর্থহীন। সমালোচক জানে না, নজরুল হচ্ছে ইন্দ্র্রজালের অবোধ সত্তা। মাটির পুত্তুলিকে জীবন দেয়ার ক্ষণে ওর কানে তিনি মন্ত্র পড়েছেন,-‘তুই আমার দামাল শিশু। নিয়ম-কানুন তোকে পাবে না। বিরাট এই জগতে তুই থাকবি দামাল শিশু হয়ে।’ এটা তোর নিয়তি।
নজরুল সত্যি দামাল। খিল খিল হেসে ইন্দ্রজালের বুকে লাথি মারে,-‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,/আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!’ তাকে লাথি ছুঁড়তে দেখে ইন্দ্রজাল হাসেন। তার চেতনায় নিজেকে বিরাট ও বিস্তৃত করেন। শিশু এবার বিরাটকে দেখে বিমোহিত হয়। জগৎ নিয়ে তার ভাঙা-গড়ার খেলাটি তাকে আশ্চর্য করে। দামাল শিশুর কণ্ঠে স্তুতি ঘনায়,-‘খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে/বিরাট শিশু আনমনে।’
এতো স্পর্ধা ও বিস্ময় যার হৃদয়ে তাকে আটকানোর সাধ্যি মানুষের থাকে না। সে তাই চির অস্থির। ‘বিদ্রোহী’ লেখার ক্ষণে অস্থির। ধ্যানমগ্ন রবি ঠাকুরের তপোবনে আচমকা হাজির হয়ে তাকে ‘গুরুদেব’ বলে চমকে দেয়ার দিনে অস্থির। ইন্দ্রজালের আদেশে নির্বাক হওয়ার দিনগুলোয় সে অস্থির। তার হাত এখন কাঁপে। ঠোঁট দুটো অকারণে বিড়বিড় করে। নজরুলের এই ভাষা শহরে কেউ বোঝে না। ইন্দ্রজাল হয়তো বোঝেন। তাকে তিনি দামাল শিশু করে গড়েছেন। এখন, অবোধ শিশু করে তুলে নিচ্ছেন উপরে!
এই শহর আগের চেয়ে শৌখিন হয়েছে। নতুন কলরবে ফেনিল হয় প্রতিদিন। সায়েব খেদানোর গান আরো তীব্র হয়েছে। ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে/লঙ্ঘিতে হবে রাত্রিনিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার।’-এই আহবান প্রচণ্ডতা পায় প্রতিদিন। শুধু নজরুল সেখানে নেই! সে থেকেও নেই। গন্ধবিধূর ধূপ ক্রমে নিভে যাচ্ছে। ইন্দ্রজাল তাকে ধূমকেতু করে মর্ত্যে পাঠিয়েছিলেন। এবার তাকে ফিরিয়ে নিচ্ছেন,-উপরে!
নজরুল থেকেও নেই। তবে বাকিরা রয়েছে। শহরে ছ্যাকরা গাড়ি এখনো চলে। সুদূর আমেরিকা থেকে ক্যাডিলাক চলে এসেছে দু’একটা। সুড়কিফেলা রাস্তায় বনেদি সায়েব মুখে পাইপ ঠেসে ক্যাডিলাকে বিহার করে। লোকেরা অবাক হয়ে যান্ত্রিক সেই মটরযান পরখ করে। সেইসঙ্গে ফিটন গাড়ি তার বাবুয়ানা ধরে রেখেছে। কলকাতার গড়ের মাঠে লোকে ফিটনে চড়ে হাওয়া খায়। বাবুয়ানা বুঝিয়ে দিতে এই শহরে লোকে ফিটন ভাড়া করে। চার চাকার অশ্বযানে রাস্তা পার হওয়ার সময় বনেদি ঘরের নেটিভ রমণী আড়চোখে পিট সায়েবের দোকানটি দেখে নিতে ভোলে না। গিনি-করা ভারী হারের বদলে হালকা নেকলেস পরার শখ জাগে। অধর-রঞ্জকে নিজেকে রক্তিম করার ঢেউ উঠে মনে।
পিটার সায়েবের যুগে এসেও নেটিভ ঘরের মেয়েরা মোটের উপর ঘরবন্দি। ইংরেজ সায়েবের রমণী-প্রীতি নিয়ে অনেক কেচ্ছা-কাহিনী তাদের কানে আসে। খবিশ সায়েবকে এক নজর দেখার কৌতূহল হয়। সুযোগ সহজে জোটে না। তবে বিলেতি রুচির বরদের পাল্লায় পড়ে সম্ভ্রান্ত ঘরগুলো খানিক পালটেছে। রমণীরা এই সুযোগে গুরুজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পিটারের দোকানে একপাক ঘুরে আসতে ভুল করে না। যদিও এই ভুল একদিন বিপত্তি তৈরি করে। পিট সায়েবের দিন ঘনিয়ে আসে শহরে।
পিটার উইলিয়াম শৌখিন মানুষ। ফ্লেচারের মতো আকাঠ নয়। নেটিভ রমণীরা তার দোকানে ঢুকলে অভিজাত ইংরেজদের মতো নাক উঁচু করে না। বণিকের ধর্ম মেনে সেলসম্যান বনে যায়। ফুলহাতা ব্লাউজ ও কস্তাপেড়ে শাড়ি পরা রমণীর সলাজ কাঠামো পড়ার চেষ্টা করে। তার চোখ দুটি তখন সত্যি পিট-পিট করে। রমণীরা নেকলেস নাড়াচড়া করে। অধর-রঞ্জকে কোমল হাত বুলায়। নয়া জামানার শ্যাম্পু ও সুগন্ধে বিভোর হয়। পিটারের দোকানটি সুগন্ধ ও অলংকারের নবীন দুনিয়া। রমণীরা নিজের বরের জন্য ফ্লানেলের কাপড় বাছাই করে। সিল্ক, কটন ও বয়েলে ঘোরাঘুরি করে। আড়চোখে সায়েবকে দেখে। নিজেরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। তাদের এই সলাজ চাপল্য পিটারের ভালো লাগে। মনে-মনে ভাবে:-
‘এই রমণীরা বিলেতি হইয়া উঠিলে শহরটি অগ্রসর হইবে। সায়েব ও নেটিভে দূরত্ব কমিবে। উহাদিগকে সায়েবি কেতায় অভ্যস্ত করা প্রয়োজন। ভারী ও জবরজং গহনা পড়িয়া আর কতোকাল জবুথবু রহিবে। রমণীদের চঞ্চলা রাজহংসী করিতে হইবে। উহারা রাজহংসী হইলে পুরুষরা পালটাইবে। সায়েব ও নেটিভের সম্পর্ক নতুন যুগে প্রবেশ করিবে। সায়েবদের আপন বলিয়া জানিবে। ভয় ও আতংকের স্থলে শ্রদ্ধা, সমীহ ও প্রীতি বিস্তার লাভ করিবে। অন্তঃপুর হইতে উঁকি মারিয়া সায়েব দেখিবার প্রয়োজন হইবে না। সায়েবের সমুখে বসিয়া গল্প করিতে শিখিবে। টি-পট হইতে চা ঢালিয়া দিবে। অধর-রঞ্জকে ঠোঁট রক্তিম ও গোলাপি করিবে। বেশ লাগিবে দেখিতে।’
নেটিভ ও সায়েবে ব্যবধান ঘোচানোর ভাবনা পিটারকে কাবু করে রাখে। তার দোকানে নেটিভ রমণীর আগমন নিয়মিত ঘটনা নয়। গুটিকয় আসে চুপিসারে। দ্রুতপদে ঘুরেফিরে। লাজুক নয়নে দরদাম শেষে ছ্যাকরা বা ফিটনে গিয়ে ওঠে। পর্দা টানে ফিটনের। রমণীদর জন্য পিটার ক্লথস এন্ড জুয়েলারি এক নিষিদ্ধ রঙমহল। সেখানে চুপিসারে গমন করতে হয়। আড়চোখে আশপাশ দেখে নিয়ে তবে ঢুকতে হয়। তাদের এই লজ্জাঘন গমনাগমন পিটারকে মাতিয়ে রাখে। সায়েবের জল্পনা রমণীদের সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত পোশাক ভেদ করে গভীরে ঢোকে। ননির মতো তনুর ইশারা পেয়ে হৃদয়ে রাক্ষস জেগে ওঠে। সায়েব মনে-মনে ভাবে:-
‘বিলেতে রমণীরা বন্য হইয়া থাকে। খানিক চাপ দিলে কিছু দিতে বাকি রাখে না। এই শহরে রমণীরা বড়ো ছল করে! মুখে লাজ ও পেটে খিদা নিয়া ঘোরে। চাপ দিলে নিশ্চয় ভাঙ্গিবে!’
শহরের সম্ভ্রান্ত রমণীদের লজ্জা ভাঙার নেশা পিটারকে চঞ্চল রাখে সারাদিন। এবং, এইভাবে একদিন খৈনিকণ্ঠি তার হৃদয়ে হানা দেয়। নেটিভ রমণী অকস্মাৎ তার চিত্তে ঢুকে পড়ে। সায়েবকে প্রেমের লালসায় বিকল করে তোলে। ভোগের আবেশে দেবদাস করে। সায়েব ব্যবসাদার থেকে কল্পতরু হয়ে পড়ে। ‘কিতনাওয়ালি’র পদতলে নিজের সর্বস্ব উজাড় করার বাসনা তাকে পেয়ে বসে। সে আর সায়েব থাকে না। প্রেমলোভী রাক্ষস হয়ে পড়ে।
পিটারের দোকানে খৈনিকণ্ঠির প্রথম আগমন সত্যি ভোলার নয়। রমণী আসে ফিটনে চড়ে। পড়ন্ত বিকেলে তার অশ্বযান সায়েবের দোকানে এসে থামে। ফিটন থেকে সে দ্রুতপদে নেমে পড়ে। দুয়ার ঠেলে ভিতরে ঢোকে। সায়েব তখন চুরুট ফুঁকছে। ধোঁয়ার হালকা তরঙ্গ গুটলি পাকিয়ে উঁচু সিলিংয়ে মিশে যাচ্ছে। সায়েব দেখে তার দোকানে অপূর্ব এক রমণীর আবির্ভাব ঘটেছে। রমণী খানিক গুরুগম্ভীরা। যদিও তার পায়ের গোড়ালি চঞ্চলা। সে শাড়ি পরিহিত নহে। সেলোয়ার ও কামিজ পরেছে। চুমকি-বসানো পাঞ্জাবী ওড়না দিয়ে ফুলহাতা কামিজ ঢেকে রেখেছে। ভেতরে শেমিজ পরেছে বোঝা যায়। মুখটি নেকাবে ঢাকা। রমণী আবৃত হলেও তাকে কেন যেন আবরণহীন লাগছে। নগ্নিকা বলে ভ্রম জাগছে। চঞ্চলা রমণীর হাতের আঙুল কাস্মীরি আচারদানা। কোমরে বন্য বাঁক তুলে পোশাক ও প্রসাধনে ঘোরে। সায়েবের মনে হয় বলকান ও আন্দালুসিয়ার জিপসি রমণী পথ ভুলে শহরে চলে এসেছে। তুড়ি বাজালে গান ধরবে। তার সেলোয়ারটি নিমিষে ঘাগড়ায় রূপ নেবে। কামিজ পালটে যাবে চোলির বাহারে। আর জিপসি রমণী গোড়ালিতে ঘূর্ণি তোলে ফ্ল্যামেঙ্কো নাচতে শুরু করবে। সায়েবের চোখে জিপসিরা জাদু বিস্তার করে। দোকানের প্রতি কোণে গোড়ালির ছন্দ দেখে মনে ঘোর লাগে। রমণী নতর্কী হয় বটে!
সায়েব তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে। সে এখন রইস আদমি বনে গেছে। তার রক্তে বোখারা ও ফারাগানের প্রবাহ বইছে। সমরখন্দ থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে আচমকা শহরে ঢুকে পড়েছে। লুটপাট শেষে এখানকার বাদশাহ বনে গেছে। বিরাট সভাকক্ষে আমির-ওমরাহ তাকে ঘিরে রাখে। বাদশাহ সঙ্গীত ও নৃত্যরসিক হয়েছে। আঙুলে চুটকি বাজিয়ে নতর্কীকে নাচতে ইশারা করে। নতর্কী লঘুছন্দে বাদশাহর নিকটে এসে মাথা ঝোঁকায়। বাইজি-আঙুল তুলে সভাকে তসলিম করে। তার চোখে মদির কটাক্ষ। শিঞ্জনী-পরা পায়ের গোড়ালি অতিকায় সভাকক্ষে ঢেউ তুলছে। গানের সুরে তাল দিয়ে নতর্কী নাচতে থাকে। কোমরের বাঁক ও চোখের ইশারায় সভাকে নিমিষে ঘায়েল করে।
সভা এখন নতর্কীর বশীভূত। ‘বহুত খুব্’ বলে বাদশাহ বাহবা দেয়। সভাসদরা ‘মাশাআল্লা। বহুত খুবসুরত’ বলে কণ্ঠ মিলায়। নেটিভ রমণী সায়েবকে জল্পনায় ঘন ও প্রলম্বিত করে চলে। রমণীর ঈষৎ পৃথুলা কোমরে সুদর্শন সায়েব সম্বিত হারায়। তার ভিতরে কে যেন তালিয়া বাজায়। মনের অজান্তে সায়েব বিড়বিড় করে,-‘বহুত খুব্। বড়ি খুবসুরত হো তুম্। বহুত আচ্ছি!’ রমণী সায়েবকে বিভোর ও বিহ্বল রাখে। তার মনে থাকে না ইংরেজি ছেড়ে সে হিন্দি বচন কইছে। সায়েবের চোখ রমণীর পাহাড়ি নিতম্বের খাঁজে আঠার মতো সেঁটে থাকে। হৃদয় হোঁচট খায় কোমরের বন্য উজানে।