ওসমান সমাচার – পর্ব ১০ । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ আগস্ট ২০১৬, ৯:৪৬ পূর্বাহ্ণ, | ২৬৩৩ বার পঠিত
‘রাং রাজওয়া’ ইন্দ্রজাল : পিট সায়েব ও বাইজি-কন্যা সমাচার (২)
পিটার সায়েব এই মুহূর্তে একা। লঘু পায়ে জটলায় ঘুরছে। অতিথিরা পান-ভোজনে মশগুল। কালেকটরকে ঘিরে সায়েব ও নেটিভদের গল্প জমে উঠেছে। ব্রিটিশ রাজের প্রশাসনে নেটিভদের সংখ্যা বাড়ানোর দাবি নিয়ে তারা আলাপ করে। শহরে ট্যাক্সের নতুন নিয়ম নিয়ে বাতচিত তুঙ্গে ওঠে। কালেকটর সবাইকে আশ্বস্ত করে। এই কর যেন বোঝা না হয় সেটা বিবেচনার প্রতিশ্রুতি দেয়। দরবেশবাবার মাজার সংলগ্ন এলাকা যথারীতি করমুক্ত থাকছে বলে জানায়। সেইন্টদের প্রতি ইংরেজরা শ্রদ্ধাশীল। সুতরাং কর আরোপের প্রশ্ন এখানে আসে না। পিটার এইসব বাতচিতে নিজেকে জড়ায় না। সে হলো চঞ্চল ভ্রমর। কালেকটর কন্যাকে চুপিসারে বগলদাবা করে বারান্দায় পায়চারি করছে। ঘড়ির কাটা দশের ঘর ছুঁই-ছুঁই করে। মেঘহীন আকাশে আজ ক্ষীণ চাঁদ উঠেছে। তারাগুলো দূর থেকে মিটমিট করে আলো দিচ্ছে। গ্যাসল্যাম্পের আলো চুঁইয়ে পড়ছে বারান্দায়। তবে অন্ধকার মুছে দিতে পারছে না। খণ্ডিত আলোর মধ্যে খণ্ড-খণ্ড অন্ধকার নকশা বুনেছে বারান্দা জুড়ে। সাদা-কালোর নকশা দুজনকে ঘিরে রাখে। এক খণ্ড সাদার উপর পা ফেলে সায়েব দাঁড়িয়ে আছে। কালেকটর কন্যা কালোর উপরে দাঁড়িয়ে। সায়েবের মুখে শীর্ণ চাঁদের আলো এসে পড়েছে। কালেকটর কন্যার মুখটি ঘন অন্ধকার। আলো ও অন্ধকার চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রহসঘন অনুভূতির শিয়রে।
সায়েবের ঘোর এখনো কাটেনি। কবি শেলী মাটির পৃথিবীতে নামেনি। কালেকটরের বারান্দা থেকে মূল সড়কের একাংশ দেখা যায়। সড়কটি নির্জন। ঘোড়ায় টানা ছ্যাকরা ও ফিটন গাড়ি অন্ধকারে গা ডুবিয়ে হাঁই তুলছে। কোচোয়ানরা ঘুম তাড়াতে একে অন্যের সঙ্গে গুলতানি মারে। কেশর-ফুলানো ঘোড়াগুলোকে বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে না। তবে হ্রেষাধ্বনি বুঝিয়ে দিচ্ছে তারা জীবিত। চারিধারে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। সেইসঙ্গে জোনাকি এসে জুটেছে। রাস্তা ও ঝোঁপঝাড়ে মিটমিট করে জ্বলে। ঝিঁঝিঁ, জোনাকি ও হ্রেষা বলে দিচ্ছে রাত গভীর হয়েছে। অতিথিরা বের হলে ছ্যাকরা ও ফিটন নিজের পথ ধরতে পারে। ঘনীভূত অন্ধকারে কালেকটর কন্যা সায়েবের বুকে নিষ্কম্প মাথা রেখে লুকোচুরির সুখ নিচ্ছে। কন্যার মুখ অন্ধকারে ঢাকা।
কবির মনে হলো অন্ধকারের মধ্যে সর্বোত্তম অন্ধকার হচ্ছে এই রমণী। আলোর মধ্যে আলোকিত তার দ্যুতি। কবির মুখ দিয়ে আপনা-থেকে বেরিয়ে এলো,-‘And all that’s best of dark and bright/Meet in her aspect and her eyes:/Thus mellowed to that tender light/Which Heaven to gaudy day denies.’
কন্যা নিষ্কম্প দাঁড়িয়ে। একঝাঁক জোনাকি এইমাত্র উড়ে গেলো সে-মুখের পাশ দিয়ে। যুবতীর গণ্ডদেশে চুম্বনের দাগ। কচি অধর সিক্ত হয়েছে চুম্বনে। কন্যা নিষ্কম্প মোম হয়ে ধরা দিয়েছে সায়েবি আলিঙ্গনে। সায়েব এখনো ঘোরে। মুখের রেখায় অচেনা বিষাদ। বুকের ভিতরে ‘মন কেমন করা’ পিপাসা। অজানা প্রেমের বিষাদে হৃদয় ভার হয়ে আছে। কালেকটর কন্যার যুবতী কেশে আঙুল চালায়। কন্যা তার পিচফল আঙুল দিয়ে সায়েবের কোমর জড়িয়ে ধরে। গ্যাস ল্যাম্পের আলো সেই আঙুলে চুঁইয়ে পড়ছে। যুবতীর আঙুলগুলো দৃশ্যমান,-দেহটি অদৃশ্য। তাকে দেখা যাচ্ছে এবং যাচ্ছে না। সে আছে অন্ধকারে এবং সে নেই অন্ধকারে। বাইরে রাত গভীর হয়েছে। ঝিঁঝিঁরা ঘনীভূত হচ্ছে কোরাসে।
ঘরের ভেতরে অতিথিরা গুঞ্জন করে। ওয়াল্টজ্ নাচের ঘূর্ণি রাত বাড়ার সঙ্গে তীব্র হয়ে উঠেছে। সেই ঘূর্ণি বারান্দায় তরঙ্গ তোলে। কিন্তু পিটার ও কালেকটর কন্যাকে প্রভাবিত করতে পারে না। দুজনে এখন পরস্পরের মধ্যে নিমগ্ন। আরেকদফা চুম্বন বিনিময় শেষে আলো ও অন্ধকারে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিষ্কম্প মোম হয়ে পরস্পরের হাত ধরেছে। দুজনে মিলে মেঘমুক্ত আকাশ দেখছে। ভ্রুক্ষেপহীন এই মগ্নতা একটি পরিবেশ তৈরি করেছে বারান্দায়। পরিবেশটি বায়রনময়। যুবতীর পিচফল আঙুল আবারো পিটের দখলে চলে গেছে। আঙুলে মৃদু চাপ দিয়ে সায়েব বায়রন আওরায়,-‘She walks in Beauty, like the night/Of cloudless climes and starry skies;’।
কবি পিটার এখন কবি বায়রনে একীভূত। সেই কবে আশ্চর্য এক সন্ধ্যা এসেছিল বায়রনের জীবনে। বন্ধু জেমস ওয়েবস্টারের সঙ্গে লেডি সারা ক্যারোলিনের বাড়িতে নৈশভোজে যোগ দিয়েছিলেন। পরিচিত আত্মীয় ও ইয়ার-দোস্তরা ছিল সেখানে। অতিথিদের মধ্যে এনি বিয়েট্রিক্স উইলমট’কে দেখে চমকে উঠলেন কবি। বায়রনের চাচাতো ভাই রবার্ট উইলমটের স্ত্রী হলো এনি। রমণী কবিকে অবশ করে দিলো। তার মনে হলো সৌন্দর্য চুঁইয়ে পড়ছে ভরা মজলিশে। দ্যুতি বিস্তার করেছে প্রতিটি হৃদয়ে। এই সুন্দরকে দাঁড় করিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এক হৃদয় থেকে অন্য হৃদয়ে সে অবিরাম পিছলে যাচ্ছে। মিশে যাচ্ছে মেঘমুক্ত রাতের দেশে। তার দ্যুতি বিলীন হচ্ছে তারকাখচিত আকাশে। বায়রনের মনে হলো রমণীর এই সৌন্দর্য প্রচলিত সৌন্দর্য নয়। রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে একে ধারণ করা মুশকিল। বাঁধাধরা উপমায় ভর করে এর ব্যাখ্যা হয় না। এটা অপার্থিব! দিনের বিপরীতে রাতকে ধারণ করেছে। আলোর বিপরীতে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। কবির মনে হলো অন্ধকারের মধ্যে সর্বোত্তম অন্ধকার হচ্ছে এই রমণী। আলোর মধ্যে আলোকিত তার দ্যুতি। কবির মুখ দিয়ে আপনা-থেকে বেরিয়ে এলো,-‘And all that’s best of dark and bright/Meet in her aspect and her eyes:/Thus mellowed to that tender light/Which Heaven to gaudy day denies.’
রূপের পূজারী পিটার এখন বায়রনময়। কালেকটর কন্যার আঙুলকে খৈনিকণ্ঠির আঙুল ভেবে ধরে আছে। ইংরেজ মেমের ফর্সা ত্বকে নেটিভ মেমের শ্যামল ত্বক দেখছে। রাতের মতো সুন্দরী এক রমণী সায়েবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। রাত্রিসুন্দরীর দ্যুতির আবেশে তার হৃদয় ভরেছে। সুন্দরী অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকার। আলোর মধ্যে আলোকিত তার দ্যুতি। জোনাকিরা পাক খাচ্ছে সেই ভ্রমরকালো কেশে। মিটমিট করে জ্বলছে ওই কুচযুগলে। ঢুকে পড়ছে সঘন জঘনে। রমণী এখন জোনাকগন্ধি। মিটমিট করে জ্বলছে মেঘমুক্ত রাতের দেশে।
চাঁদের আলো সায়েবের মুখ থেকে সরে গেছে। সে ঢাকা পড়েছে অন্ধকারে। গ্যাস ল্যাম্পের এক টুকরো আলোকখণ্ড তার পায়ের পাতায় ছলকে উঠছে। মুখের রেখা ঘন আঁধারে ডোবানো। সায়েব একটু করে ডেবে যাচ্ছে রাত্রিসুন্দরীর কুচযুগলে। সে ডেবে যাচ্ছে সুন্দরীর সঘন জঘনে। তার মুখের রেখায় কামনা ভর করেছে। অধরে আবেশ ঘনিয়েছে। রাত্রিসুন্দরীর কুচযুগলে মুখ ডুবিয়ে উক্তি করে,-‘ও প্রিয়তমা, আর কতোকাল অন্ধকার রহিবে! অধমকে দয়া করো। ফিরিয়া আসো। আমি তুমার মইদ্যে জীবন দিয়া মরি!’
কালেকটর সাহেবের নৈশভোজ শেষ হয় মধ্যরাতে। পান-ভোজনের পালা চুকেছে। মৌজ-মাস্তি ও খোশগল্প শেষে অবসন্ন অতিথিরা একে-একে বিদায় নিচ্ছে। মেঘমুক্ত আকাশে একখণ্ড মেঘ হঠাৎ কোথা থেকে ভেসে আসে কে জানে! বাতাস জোরে বইতে থাকে। এই শহরে গ্রীষ্মকালের এটাই ধারা! মেঘহীন আকাশে হুটহাট মেঘ চলে আসে। বৃষ্টির পূর্বাভাস পেয়ে কোচোয়ান ‘হেই হেট হেট’ বলে ছ্যাকরা ও ফিটনের দড়ি টানে। ছ্যাকরা চলে দুলকি চালে, ফিটন চলে বেগে। অতিথিরা তন্দ্রায় ঢুলুঢুলু। মদের কড়া ঝাঁঝে বেসামাল। ঘোড়ার খুরের দাপটে সুড়কিফেলা রাস্তায় ধূলি উড়ছে। মাটি এখন মেঘের গন্ধে ভারী। রাস্তার ঢালে ব্যাংয়ের হল্লা বাড়ছে। ব্যাং ডাকছে ঘ্যাংঙর ঘ্যাং। বৃষ্টি নামতে খুব দেরি নেই। ছ্যাকরা ও ফিটনকে কোচোয়ান তাড়া লাগায়। ঘোড়া টগবগিয়ে এগোয়।
পাগলা পিটার ছ্যাকরা বা ফিটনের কোনোটায় চড়েনি। নেশাগ্রস্ত পায়ে টলমল করে হাঁটছে। বিদায় নেবার ক্ষণে কালেকটরের রূপবতী স্ত্রী কানে মন্ত্র পড়ে,-‘আজ কিছু হইলো না পিটার। ঘরভর্তি লোকজন। কী আর করা! সময় হইলে আমি তুমারে ডাকিবো।’ কন্যাটি মুখভার করে মৃদু স্বরে আওরায়,-‘আজ কী পাগলামি করিলে বলো তো! ওহ ইশ্বর! মা যদি টের পাইতো! এরকম করিলে আমি আর ধরা দিবো না। দোকানে থাকিও। আমি সুযোগ বুঝিয়া খবর করিবো।’
মা ও মেয়ের কানমন্ত্রে পিটারের আজ উৎসাহ নেই। খৈনিকণ্ঠি তাকে অবিরত চোখ ঠারছে। মন অভিভূত হয়ে আছে নেটিভ রমণীর বিজলি-চমকে। ঘাড় থেকে বায়রন এখনো নামেনি। খৈনিকণ্ঠিকে রাত্রিসুন্দরী ভাবার ভ্রম কাটেনি। মন বিষাক্ত হয়ে আছে অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকার এক রমণীর কথা ভেবে। কণ্ঠে বায়রন নেমেছে,-‘Yet still, my girl, this bleeding breast/Throbb’d, with deep sorrow, as thine own.’ সায়েব এখন রাত্রিসুন্দরীর দুঃখে কাতর। আহারে! বায়রন ঠিক ধরেছে, সায়েবের কাছে ফিরতে না পারার দুখে রাত্রিসুন্দরীর রক্তঝরা বক্ষ ধুকপুক করছে। ওর সঙ্গে সায়েবের বক্ষেও রক্ত ঝরে। ওটা ধড়াস-ধড়াস করে এই রাত-নিশীথে!
পিটারকে রাস্তা দিয়ে টলমল পায়ে চলতে দেখে এক ইংলিশম্যান হাঁক পাড়ে,-‘হেই পিটার! ইচ্ছা করিলে আমার ফিটনে উঠিতে পারো।’ ভদ্রলোক শহরের সম্মানিত শল্য-চিকিৎসক। রাত্রিসুন্দরীর ঘোরে বেহঁশ পিটার হাত নাড়ে,-‘না, লাগিবে না। আমার বাড়ি অধিক দূরে নহে। পদব্রজে যাইতে পারিবো। তুমাকে ধন্যবাদ।’ ফিটন পিটারকে পাশ কাটিয়ে এগোয়। শল্য-চিকিৎসক কোচোয়ানকে মন্তব্য করে,-‘ব্যাটা মদে চুর হইয়াছে। সে এখন নিজের মইদ্যে নাই। করুক যা খুশি। তুমি জোরে চালাও। বৃষ্টি নামিবার আগে ঘরে ফিরিতে হইবে।’
পিটার সত্যি মদে চুর হয়েছে। বেসামাল চুম্বনে কালেকটর কন্যাকে বিব্রত ও সুখী করার পালা চুকিয়ে হলঘরে ঢুকেছিল। সেখানে জমিয়ে মদ টেনেছে। ওয়াল্টজ্ নেচেছে কিছুক্ষণ। মদ ও ওয়াল্টজ্ একসঙ্গে রক্তে ক্রিয়া করছে। সায়েব আসলে হাঁটছে না, খৈনিকণ্ঠিকে বুকে চেপে ওয়াল্টজ্ নাচছে। তার মনে রোখ চেপেছে, ‘কিতনাওয়ালি’কে জোর করে হলেও ওয়াল্টজ্ নাচাবে। রক্তঝরা বুকে চেপে তাকে পিষে মারবে। মদের ঘোরে আবারো বায়রন বকতে শুরু করে,-‘And yet, my girl, we weep in vain,/In vain our fate in sighs deplore;/Remembrance only can remain,/But that, will make us weep the more.’
খ্যাপাটে সায়েব আজ বায়রনের পিছে পড়েছে। রাত্রিসুন্দরী হয়েছে খৈনিকণ্ঠি। আর খৈনিকণ্ঠি দুষ্টা রমণীতে পালটে গিয়েছে। মাতাল সায়েব তাকে বায়রন বোঝায়,-‘দুষ্টা রমণী, এইসব অনর্থ তুমার জন্য হইলো। তুমি বক্ষে আসিলে আমি শান্ত হইবো। না-আসিলে এই পথে পড়িয়া মরিবো। আমি মরিলে তুমি কি বাঁচিবে? আমার মতন খেদ ও মনস্তাপে পথেই মরিবে। দুষ্টা রমণী, আমরা বৃথা ক্রন্দন করি। তুমারে পাইবার অভিলাষে আমি কাঁদি। আমারে না দেখিয়া তুমি চক্ষে অশ্রু বহাও। নিষ্ফল ক্রন্দনে মোরা ভাগ্যদেবীর পায়ে মাথা কুটি। দেবীর নিকটে খেদ ও মনস্তাপ করি। লাভ নাই প্রিয়া। আমাদের দীর্ঘশ্বাস শুনিবার অবসর দেবীর নাই। বৃথা ক্রন্দন শেষে স্মৃতিরা শুধু জাগিয়া রহে! ওইটা আমাদের অধিক কাঁদাইবে। আরো বেশি নিষ্ফল ক্রন্দনে দুজনে মাথা কুটিয়া মরিবো। ওগো দুষ্টা রমণী, একবার দোকানে দেখা দিও। একবার তোমারে দেখিয়া নয়ন জুড়াই। এই দেখো তুমার বক্ষে রক্ত ঝরিতেছে। এই দেখো, আমিও রক্তঝরা বক্ষে তুমার সম্মুখে আসিয়াছি। আইসো পরস্পরে আলিঙ্গন করিয়া রক্তের তৃষ্ণা মিটাই!’
নেশার ঘোরে সায়েব এখন মতিচ্ছন্ন। রাত্রিসুন্দরীকে খৈনিকণ্ঠি ভেবে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষকে আলিঙ্গন করে। সায়েব দেবদাস দেখে বৃক্ষের হয়তো দয়া হয়। সে সজোরে শাখা দোলায়। তাকে শাখা দোলাতে দেখে সায়েবের উপর ইন্দ্রজালের নজর পড়ে। মতিচ্ছন্ন প্রেমিককে তিনি দয়া করেন। মনে-মনে ভাবেন,-‘না, এ দেখছি গোল্লায় যাবে! এই শহরের লোক হলে কথা ছিল। চিত্ত দুর্বল। প্রেমের মার সইতে পারে না। অল্পতে ভেঙে পড়ে। ওরা অবশ্য সবতাতে ভেঙে পড়ে। সায়েবদের মার খেয়ে ভেঙে পড়ে। প্রেমের জ্বালা সইতে না-পেরে ভাঙে। কিন্তু সায়েব তো ইংরেজ! দুনিয়া চষে খায়। সায়েবসুবোকে এতো দুর্বল হলে চলে! নাহ! এর একটা বিহিত করা প্রয়োজন।’
ইন্দ্রজালের দায়িত্বের শেষ নেই। উৎকণ্ঠার ঠিক-ঠিকানা নেই। অখ্যাত শহরের অখ্যাত এক ইংরেজ সায়েবকে দেবদাসের হাত থেকে উদ্ধার করার উপায় নিয়ে তাকে ভাবতে হচ্ছে। একবার ভাবেন ওসমানের পিতামহকে ডাক দেবেন। রাক্ষসটিকে ইশারা করবেন সায়েবকে ভয় দেখাতে। এতে ওর মদের ঘোর কাটবে। খৈনিকণ্ঠির বদলে জ্বলজ্যান্ত রাক্ষসকে চোখের সামনে দেখে হঁশ হয়তো ফিরবে। কিন্তু ভাবনটা নিজেই বাতিল করেন,-নাহ, রাক্ষস ডেকে লাভ হবে না। এতে বরং হিতে বিপরীত হবে। রাক্ষসের মেজাজ-মর্জির বালাই নেই। কখন কী করে বসে ঠিক নেই। তিনি ইশারা করবেন ভয় দেখাতে। কিন্তু ওটা যে করবে সে নিশ্চয়তা নেই। ভয় দেখাতে গিয়ে দেবদাসকে গপ করে গিলে ফেলতে পারে। সায়েবটি রমণী হলে ভালো ছিল। রাক্ষসরা রমণীভাবিক। দেবদাসীর প্রেমে কাতর হয়। গিলে ফেলার আগে দশবার ভাবে। তবে দেবদাসের বেলায় ভাবাভাবির ধার ধারবে না। মানবলোকে পুরুষ দেবদাস রাক্ষস দুচোখে দেখতে পারে না। এতে তার প্রতিদ্বন্ধীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং ঝুঁকি বাড়িয়ে লাভ নেই।
রাক্ষসকে ডাকার ভাবনা ইন্দ্রজাল স্থগিত করেন। সায়েবের মতিগতি ভালো নয়। প্রেম ও পরকীয়া তাকে দখলে নিয়েছে। রাক্ষসকে হয়তো রাত্রিসুন্দরী ভেবে জড়িয়ে ধরবে! এর পরিণাম চিন্তা করে তিনি শিউরে উঠেন। সায়েব তাকে ফ্যাসাদে ফেলে দিয়েছে। উৎকণ্ঠায় সব কাজকর্ম লাটে উঠছে। নেশামত্ত দেবদাসের উপরে তিনি কিছুটা বিরক্ত। আবার তার মধ্যে বাসনার ভ্রান্তি ও টানাপোড়েন দেখে মায়া লাগছে। এতোটা হবে জানলে তাকে সায়েব করে পাঠাতেন না। নিরাকার রেখে দিতেন। মানুষকে নিয়ে এই এক বিপদ! মতিগতির ঠিক নেই। বাসনাকে বশে রাখতে পারে না। কোথাকার এক খৈনিকণ্ঠি! তার জন্য পাগল হয়েছে। ঠোঁটের ফাঁকে খৈনি গুঁজে সেই তখন থেকে ভুলভাল বকে যাচ্ছে! গাছের গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়েছে। ইন্দ্রজাল এখন কী করেন! ভাবনাটি তাকে উতলা করে তোলে।
ইন্দ্রজাল মানুষকে স্বাধীন করে ধরায় পাঠিয়েছেন। নিজের বশীভূত হয়ে চলার জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। বিচার করার শক্তি ও স্বাধীনতা দিয়েছেন। এতে হস্তক্ষেপের কোনো বাসনা তার নেই। সে যদি নিজেকে বশ মানিয়ে চলে তবে এর ফল হয় একরকম। ইন্দ্রজালের হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু মানুষ বড়ো আজব প্রকৃতির! সারাক্ষণ উলটাসিধা পথে চলছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানে না। বিচার-বুদ্ধি বা বিবেচনাকে সংকীর্ণ কামনা-বাসনা মেটানোর কাজে ব্যবহার করে। নিজের স্বার্থ সাধন করতে গিয়ে দশজনের স্বার্থে বিঘ্ন ঘটায়। গায়ে গা লাগিয়ে ঝগড়া করে। যেচেপড়ে অন্যের পায়ে ল্যাং মারে। কেন মারে সে এক আজব রহস্য বটে! অন্যকে ল্যাং মেরে মানুষের কী উপকার হয় সেটা নিয়ে ইন্দ্রজাল অনেক ভেবেছেন। কুলকিনারা পাননি। তিনি শুধু দেখছেন, একজনের পায়ে ল্যাং মারতে গিয়ে মানুষ আরেকজনের ল্যাং খায়। অন্যের ক্ষতি করে নিজের ক্ষতি ডেকে আনে। জগতে অশান্তি বাড়ায়। ইন্দ্রজালকে বাধ্য হয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এটা তার নীতি ও সংকল্পের সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু কী আর করা! তাকে হস্তক্ষেপ করতেই হয়। না-করে উপায় থাকে না।
ইন্দ্রজাল ঠিক করেছিলেন মানুষের কোনো কাজে বাগাড়া দেবেন না। সে করুক যা-খুশি, চলুক যেমন ইচ্ছা,-তিনি এতে নাক গলাবেন না। শুধু সময় হলে তাকে টুপ করে তুলে নেবেন। তার কাজের পাওনা তাকে বুঝিয়ে দেবেন। যে-কারণে তিনি নির্বিকার ও উদাসীন থাকার চেষ্টা করেন। সবকিছু দেখেও দেখেন না। সাত আসমানের উপরে অন্যরকম এক বাগান করেছেন। সেই বাগানের কোনো সীমানা নেই। ওটা অনন্ত। প্রসারিত এক নিরাকারের মাঝে আকার রূপে বিরাজ করে। মানুষের কাজ-কারবারে বিরক্তি এলে ইন্দ্রজাল সেই বাগানে প্রবেশ করেন। মানুষকে ভুলে থাকতে চেষ্টা করেন। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারেন না। তার কৌতূহল তাকে বাগান থেকে বের করে আনে। মেঘের ফাঁকে উঁকি দিয়ে মানুষের কাণ্ড দেখেন। তারা আজব ও ভয়ংকর। প্রতিদিন উদ্ভট সব কাণ্ড ঘটায়। তাদের কাজ-কারবার দেখে রাগে তার পিত্তি জ্বলে। কিন্তু মানুষের স্বাধীন আচরণে হস্তক্ষেপ করা নীতি ও সংকল্পের বিরোধী বলে প্রায়শ নির্বিকার থাকেন। মানুষকে নিয়ে মাঝেমধ্যে রঙ্গ করলেও তার কাণ্ড-কারখানায় উদাসীন থাকা ইন্দ্রজালের রীতি। কিন্তু আজ সেটা সম্ভব হচ্ছে না। সায়েবটি তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাকে নিয়ে কী করা যায় সেটা মন দিয়ে ভাবছেন।
সুদর্শন পিটার উইলিয়াম ইন্দ্রজালকে ভাবিয়ে তুলেছে। তার পাগলাটে বাসনার কোনো তল পাওয়া যাচ্ছে না। ওদিকে আকাশে মেঘ করেছে। মুষলধারে নামার জন্য মেঘরাজ ইশারার অপেক্ষায় আছে। সায়েব বরফের দেশ থেকে এসেছে। বৃষ্টির ঢল সহ্য করার শক্তি আছে বলে ভরসা হয় না। শেষে কঠিন জ্বর বাঁধিয়ে বসবে। যমদূতকে পাঠাতে হবে শিয়রে। ওটা একটা পুলিশ। ধরে আনতে বললে বেঁধে নিয়ে আসে। শিয়রে বসতে বললে জান কবজ করে। পইপই করে তাকে বুঝিয়েছেন ইশারার আগে যেন কবজ না করে। শুনলে তো সে কথা! বহুবার এটা ঘটেছে,-তিনি ইশারা করার আগে কম্মো সাবাড়। মাঝেমধ্যে উলটো কাণ্ড করে। ইশারা পাওয়ার পরেও জান কবজ না-করে চলে আসে। তাকে বকাঝকা করে লাভ হয় না। কালো ডানা ঝাপটে মুখ করুণ করে তোলে,-‘ভুল হয়েছে প্রভু। মানুষটাকে দেখে এতো মায়া হলো! খুব চাইছে থাকতে। আমার ডানা ধরে কান্নাকাটির বাকি রাখেনি। এবারের মতো ক্ষমা করে দিন প্রভু। আর এমনটি হবে না।’ যমদূত নামের পুলিশটার স্মরণশক্তি খারাপ। এক ভুল বারবার করে। তাকে ক্ষমা করে তিনি নিজে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তবু তার হুঁশ ফেরে না!
ইন্দ্রজাল আরেকটা জিনিস লক্ষ করেছেন। অন্যের পায়ে ল্যাং মারা যাদের স্বভাব তাদের প্রতি পুলিশটার পক্ষপাত রয়েছে। তার ভুলের তালিকায় এই লোকগুলোর সংখ্যাই বেশি। তিনি পাঠান জান কবজ করতে। সে ফিরে আসে আরো কিছুদিন আয়ু বরাদ্দ করে। তিনি চাইলে এটা লঙ্ঘন করতে পারেন। পলকের মধ্যে আয়ু খতম করে দিতে পারেন। কিন্তু কাজটি তার রীতি ও পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এতে শৃঙ্খলা বিপন্ন হয়। সৃষ্টি ও ধ্বংসের ভারসাম্য ভেঙে পড়ে। অগত্যা পুলিশের উপর খামোশ হয়ে আয়ুবৃদ্ধির অনুমতি দান করেন।
অপোগণ্ডটা মানুষের সংস্পর্শে এসে বিগড়ে গেছে। মাঝেমধ্যে তাকে অব্যাহতি দেয়ার কথা ভাবেন। মায়া হয়। এতোদিন ধরে করছে। হাজার হোক ওর কাজটা কঠিন। মানুষকে জন্ম দেয়া সহজ হলেও খুন করা কঠিন। অন্য দেবদূতরা শুভ্র ডানা পরে উড়ে। যমদূত সেখানে কালো ডানায় উড়ে মানুষ খুন করে। কঠিন এই কাজটা আর কেউ পারবে বলে ভরসা হয় না। সব ভেবেটেবে তাকে চাকরিতে বহাল রেখেছেন। তার পুলিশগিরি সহ্য করছেন। তবে এই মুহূর্তে সায়েবের কাছে পুলিশ পাঠানোর কোনো ইচ্ছে তার নেই। ইংরেজ সায়েবকে আরো কিছুদিন পৃথিবীতে রাখতে চান। ওর পাগলামি তাকে কৌতূহলী করে তুলেছে। সায়েবকে পরখ করে দেখতে চান। খৈনিকণ্ঠির সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটানোর ইচ্ছে ইন্দ্রজালের মনে প্রবল হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল ‘কী হয়’ সেটা দেখার আগ্রহ হচ্ছে। সায়েবের একটা গতি করার জন্য দেবদূতদের সঙ্গে তিনি শলা-পরামর্শের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। তাদেরকে তার নিকটে বসতে ইশারা করেন।
ইন্দ্রজাল এখন মেঘে হেলান দিয়ে দেবদূতদের সঙ্গে কথা বলছেন। মানুষের আচরণে তিনি বিরক্ত। গাছের নিচে বসা মদো লোকটির উপর বিরক্ত। দেবদূতদের কাছে মানুষের উলটাসিধা আচরণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন,-‘দেখলে তোমরা, ব্যাটাদের কাণ্ড দেখলে! মনে হয় ভস্ম করে দেই।’ তার রাগ টের পেয়ে দেবদূতরা মৃদু হাসে,-‘প্রভু, ওদের ব্যাপারে আপনি কিন্তু ‘নির্বিকার থাকা’র সংকল্প করেছেন। সেটা ভঙ্গ করা কি উচিত হবে?’
দেবদূতের কথায় ইন্দ্রজাল নিজের রাগ সম্বরণ করেন,-‘হ্যাঁ, তোমরা ঠিক বলেছো। ইচ্ছে করলে মানুষকে আমি চেপে ধরতে পারি। কিন্তু সবকিছুর একটা সময়সীমা রয়েছে। সেটা পূরণ হওয়ার আগে কিছু করা ঠিক হবে না। কিন্তু মানুষ আমাকে বড়ো হতাশ করে তুলেছে। কী নেই তার মধ্যে! কী আমি দিইনি তার মধ্যে! অথচ দেখো, নিজেকে বশে রাখতে পারে না। উলটো অন্যকে বশীভূত করার ফন্দি খুঁজে। অশান্তি বাড়ায়। মানুষকে স্বাধীনতা দেয়া আমার ভুল হয়েছে। এখন সেটা হুট করে ফিরিয়ে নিতে পারছি না। ফিরিয়ে নিলে জগতের উপকার হতো। বাকিরা স্বস্তিতে নিজের আয়ু যাপন করতে পারতো।’
দেবদূতরা মৃদু হাসি অব্যাহত রাখে,-‘প্রভু, আমাদের ক্ষেত্রে আপনি কোনো স্বাধীনতা অনুমোদন করেননি। আমরা আপনার বিশ্বস্ত সেবক ও আজ্ঞাবাহক রূপে দায়িত্ব পালন করি। আমরা এতে সুখী। কিন্তু মানুষকে আপনি স্বাধীনতা দিয়ে তৈরি করেছেন। তাদের মাধ্যমে স্বাধীনতার সারার্থ ও শক্তি পরীক্ষা করতে চেয়েছেন। যে স্বাধীন সে নিজের বিবেচনায় চলবে। এটা হলো স্বাধীনতার মূল নীতি। আপনি নিজের বিবেচনায় চলেন। কারো নির্দেশ ও উপদেশ আপনার ক্ষেত্রে খাটে না। খাটতে পারে না। মানুষ স্বাধীন বিবেচনার অধিকারী। সেই শক্তি দিয়ে আপনি তাদেরকে তৈরি করেছেন। সুতরাং মানুষের উপর আপনার নির্দেশ ও উপদেশ খাটে না। তারা যদি মানে তো ভালো! যদি না মানে, ধৈর্য ধারণ করা উত্তম। সময় হলে আপনি যমদূতকে পাঠিয়ে দেবেন। আমাদের মতে এটা আপনার মহান অস্তিত্বের পক্ষে সম্মানজনক হয়।’
দেবদূতদের যুক্তি ইন্দ্রজালকে প্রভাবিত করে,-‘তোমরা বেশ চিন্তাশীল। যদিও তোমাদের সৃষ্টি করার সময় ‘চিন্তাশীল হওয়া’র ক্ষমতা আমি দিয়েছি বলে মনে হয় না। তাই নয় কি?’ এই প্রশ্নের উত্তরে তারা মাথা নাড়ে। ইন্দ্রজাল আবার শুরু করেন,-‘হুম! বুঝেছি! এটা সম্ভবত অভিজ্ঞতার ফল। মানুষের কাণ্ড-কীর্তি তোমাদের মাঝে চিন্তাশীলতার জন্ম দিয়েছে। এখন তোমরা আবার স্বাধীনতার জন্য খেপে উঠো না যেন! সেক্ষেত্রে আমি ভয়ংকর হতে বাধ্য হবো।’
ইন্দ্রজালের আশংকায় দেবদূতরা ম্লান হাসে,-‘না প্রভু, মানুষকে দেখে স্বাধীনতার শখ আমাদের মিটে গেছে। এরচেয়ে আপনার অধীন হয়ে থাকা ভালো। নিজেকে বশে রাখার সীমারেখা ঠিক করতে না পারলে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়। মানুষ স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচার করে। নিজের স্বাধীনতার জন্য অন্যের স্বাধীনতাকে সে হত্যা করে। অন্যকে নিজের অধীন করতে চায়! সে আসলে আপনার প্রতিরূপ হয়ে উঠতে চাইছে। ময়ূরের পেখম পরলে দাঁড়কাক ময়ূর হয়ে যায় না, এই সহজ কথাটি ভুলতে বসেছে। ময়ূরপুচ্ছধারী কাক নামে সকলে তাকে বিদ্রূপ করে। অন্যের নকল করার মাঝে কোনো সন্তোষ নেই। আমরা এই বেশে বেশ আছি।’
চিরকালের আজ্ঞাবহ দেবদূতদের কথায় ইন্দ্রজাল চমকে উঠেন,-‘তোমরা অতি বিচক্ষণ! আচ্ছা একটা কথার উত্তর দাও দেখি,-তোমাদের কী মনে হয়? আমি কি আমার প্রতিরূপ হওয়ার জন্য মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছিলাম? আমাকে নকল করার জন্য তুচ্ছ এই মাটির পুত্তুলি তৈরি করেছিলাম? তার মধ্যে জীবনীশক্তি ফুঁকে দিয়েছিলাম?’
ইন্দ্রজালের প্রশ্নে দেবদূতরা খানিক নীরব থেকে উত্তর করে,-‘এটা আপনি ভালো জানেন প্রভু। আমাদের পক্ষে আপনার পরিকল্পনার নাগাল পাওয়া কঠিন। তবে অনুমান বলছে এই সংকল্প আপনার ছিল না। মানুষকে তার নিজের ভাগ্যবিধাতা করে জগৎকে আপনি বৈচিত্র্যে ভরিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মর্ত্যকে এই মেঘরাজ্যে ঢাকা অনন্তের চেয়ে মনোহর করতে চেয়েছিলেন। কারণ স্বাধীনতার ভিতরে সৃষ্টিশীলতার বীজ লুকিয়ে থাকে। যে স্বাধীন সে কৌতূহলী ও সৃষ্টিশীল হয়। জিজ্ঞাসু হয়ে ওঠে। নিজেকে বুঝতে আগ্রহ বোধ করে। আপনার সঙ্গে তার সম্পর্ক অনুভব করতে মরিয়া হয়। যে নিজেকে বিবেচনা করতে পারে সে অন্যকে বিবেচনা করার ক্ষমতা অর্জন করে। এটা হলো স্বাধীনতার মৌল সত্য। মানুষের সমস্যা হলো অন্যকে বিবেচনা করতে গিয়ে অহরহ তাকে বিচার করে বসে। আপনার মতো করে ‘বিবেচনা’ ও ‘বিচার’-এর পার্থ্যকটি তারা ধরতে পারে না।
‘বিবেচনা’ ও ‘বিচার’-এর ব্যবধান বুঝতে পারাটা স্বাধীনতার জন্য জরুরি। মানুষ এটা পারে না বলে গোল বাঁধে। তার স্বাধীনতা তখন স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়। অন্যকে অযথা পীড়ন করে মানুষ সুখ পায়। নিজের ক্ষমতা তাকে অন্যের প্রতি অন্ধ ও বধির রাখে। মানুষ ভাবে আমি এক ইন্দ্রজাল। জগৎ আমায় কুর্নিশ করুক। তার এই ভ্রান্তি আপনাকে সহ্য করতে হবে প্রভু। কারণ কোনোকিছু আপনার সংকল্প ও পরিকল্পনার আগে ঘটতে পারে না। আপনি মানুষকে স্বাধীন বিকাশের ক্ষমতা দিয়েছেন। লড়াই করে টিকে থাকার শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা দান করেছেন। তাকে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। মানুষের কর্মফলের উপর তার আয়ু নির্ভর করে,-এই বিধানটি আপনিই ঘোষণা করেছেন। কর্মফলে বিবেচনা থাকলে ফল একরকম হবে। মানুষের সঙ্গে জগতের আয়ু বাড়বে। কর্মফলে বিচার দেখা দিলে ফল অন্যরকম হবে। জগতের সঙ্গে মানুষের আয়ু শেষ হবে। সে মুছে যাবে নিরাকারে। প্রবেশ করবে আপনার সীমানাহীন অনন্ত উদ্যানে!
মানুষকে সময় দিতে আপনি বাধ্য প্রভু। আপনার সংকল্প ও আদেশের গুণে সে এখন স্বয়ংক্রিয় হয়ে গেছে। তাকে সংহার করার প্রয়োজন আপনার নেই। ওটা মোল্লা-পুরুতরা বলে। আপনার নামে ভয়ংকর সব কথা ছড়ায়। আপনার ভয় দেখিয়ে মানুষকে জিম্মি করে রাখে। আপনাকে নিয়ে তারা ব্যবসা ও মুনাফা করে। মানুষকে আরো বেশি পাপ করতে প্ররোচিত করে। মানুষ তার কর্মের গুণে আয়ু পাবে অথবা ধ্বংস হবে। এটা হচ্ছে আপনার বিধান। জগৎকে সংহার করার যুক্তি বা কারণ আপনার নেই। যমদূতকে দিয়ে শিঙ্গা ফোঁকার কাহিনীটি মিথ্যে। মোল্লা-পুরুতরা এসব গল্প বলে মানুষকে ভয় দেখায়। তারা পচা মাংসের কারবারি। মানুষ পচলে বা পুড়লে খুশি হয়। তাদের ব্যবসা জমে ওঠে। মোল্লা-পুরুত মিলে আপনাকে ধ্বংসকে পরিণত করেছে। যেন ধ্বংস ছাড়া আপনার কোনো কাজ নেই! বিষয়টি সত্যি দুঃখজনক।
এই লোকগুলো মূর্খ প্রভু। আপনার মহান সংকল্প ও নীতির মধ্যে মানুষকে সংহার করার কোনো ব্যাপার নেই। আপনি তাকে স্বাধীনতা দিয়ে স্বয়ংক্রিয় করেছেন। বিবেচনা দিয়ে শক্তিশালী করেছেন। স্বাধীনতা ও বিবেচনার মতো অমূল্য রত্নের সঠিক ব্যবহার জানলে মানুষ টিকবে। তার আয়ু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হবে। রত্নকে নিছক অলংকার ভেবে রমণীর গলায় পরালে কালের নিয়মে এতে জং ধরবে এবং মাটিতে পরিণত হবে। এটাই আপনার বিধান। এখানেই আপনার মহত্ত্ব। মানুষ যদি এটা বুঝে তবে আপনাকে অনুভব করা তার জন্য সহজ হবে। মানুষ তখন নিজের তাগিদে ইন্দ্রজালের নিয়মে চলবে। সে রত্ন না মাটি হবে সেটা দেখার জন্য আপনি নির্বিকার রূপে অনন্তে বিরাজ করেন। তাকে সংহার করার জন্য নয়।’
দেবদূতদের বাচন ইন্দ্রজালকে চমৎকৃত করে,-‘তোমাদের আমি পরাধীন করে গড়েছি। তবে অভিজ্ঞতা অর্জনে বাধা দেইনি। এখন দেখছি সেটা ভালো হয়েছে। অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে তোমরা বিবেচনা করতে শিখেছো। তোমাদের দেখে আমি সুখী বোধ করছি। এখন বলো এই সায়েবের কী করা। আজ আমি তোমাদের পরামর্শ শুনবো।’
ইন্দ্রজাল তাদের পরামর্শ চাইছেন দেখে দেবদূতরা খানিক বিব্রত বোধ করে,-‘প্রভু, আমরা আপনার আজ্ঞাবহ। আপনার পরিকল্পনা ও ইশারা অনুসারে চলি। আপনাকে পরামর্শ দানের যোগ্যতা রাখি না। আমরা শুধু অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। সায়েবের মন প্রেমের লালসায় অস্থির হয়ে আছে। লালসা তার চেতনাকে দখল করে রেখেছে। লালসা ঘন হলে প্রেম গভীর হয়, আর প্রেম গভীর হলে বাসনা জোরালো হয়ে পড়ে। বাসনা জোরালো হলে মানুষের বিবেচনাশক্তি লোপ পায়। তার মনে বিচারশক্তি তীব্র হয়ে ওঠে। সায়েবটি বাসনায় অন্ধ হয়েছে। এটা তাকে দুর্বল করে দিয়েছে। যদিও সায়েব সেটা বুঝতে পারছে না।
শহরের এক নেটিভ রমণী তার ভিতরে লালসা জাগিয়েছে। রমণীর রূপ-সম্ভোগের জন্য সে অধির হয়ে আছে। তাকে সে একবার মাত্র দেখেছে। দুজনে বিশেষ কথাবার্তা হয়নি। রমণীর বিন্দুবিসর্গ সে জানে না। অথচ তাকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে! নেটিভ রমণী তার চোখে ঘোর এনেছে। বিবেচনাশক্তির স্থলে বিচারশক্তিকে প্রকট করে তুলেছে। সায়েব বিশ্বাস করে রমণীর প্রতি তার বাসনা একতরফা কোনো ঘটনা নয়। রমণী নিজেও সেটা চায়। প্রথম সাক্ষাতে ওর দেহ ও চোখের ভাষায় সায়েব নাকি সেই ইঙ্গতটি পড়তে পেরেছে! যদিও রমণী দোকানে কেন আসে না সে-ব্যাখ্যা তার কাছে নেই। সায়েব মনে করে রমণী সঙ্কোচবশে দোকানে আসছে না। অথবা সে তাকে পরীক্ষা করছে। দেখতে চাইছে সায়েব সত্যি তাকে ভালোবাসে, নাকি ক্ষণিকের মোহ এটা! দুদিন পরে কেটে যাবে। যে-কারণে রমণী ইচ্ছে করে সময় নিচ্ছে। দেখতে চাইছে সায়েব তাকে পাওয়ার জন্য কতোদূর যেতে পারে। সায়েব বিশ্বাস করে সময় হলে সে দেখা দিবে এবং প্রেমের পাওনা সুদে-আসলে মিটিয়ে নেবে!’
দেবদূতদের কথা শুনে ইন্দ্রজাল মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে কী যেন ভাবেন। তাদেরকে কথা চালিয়ে যেতে ইশারা করেন। তারা অগ্রসর হয়,-‘মানুষের মতিগতি বড়ো আজব প্রভু। সায়েব তার নিজেকে দিয়ে রমণীকে বিচার করছে। নিজের ভাবনা ও জল্পনা রমণীর উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এতে করে সে যে অন্ধ ও বধির হয়ে যাচ্ছে সেই জ্ঞানটি পর্যন্ত নেই! মানুষের মাঝে অনেকে আপনাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। পাগলের মতো আপনার প্রেমে পড়ে। তারা আপনাকে দেখতে পায় না। অথচ বিশ্বাস করে দেখছে। আপনার অস্তিত্বের অতুল সৌন্দর্য ও ক্ষমতা নিয়ে জল্পনার রাজ্যে বিহার করে। নিজেদের ভাবনা ও বিশ্বাস আপনার উপরে চাপায়। তারা মনে করে দেখা না-দিলেও আপনি তাদের ভালোবাসেন। এই বিশ্বাসে ভর করে আপনার জন্য দেওয়ানা হয়। ঘরবাড়ি ছাড়ে। ফকির ও পাগলের বেশে ঘোরে। প্রাণ বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না। নিজের বিচারশক্তিকে তারা এভাবে প্রয়োগ করে। নিজেকে বিলীন করে অটল নিরাকারে।
এক্ষেত্রে আপনার প্রেমিক ও রমণী-প্রেমিক সায়েবের মাঝে মিল রয়েছে। দুজনে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে নিজের কাম্য প্রেমকে পেতে চাইছে। প্রেমের এটা হলো সারার্থ প্রভু। বিবেচনা বজায় রেখে প্রেম করা যায় না। বিবেচনা দিয়ে সম্পর্ক ও বোঝাপড়া হয়, কিন্তু মনের ভিতরে প্রেমের বাসনা ঘন হয় না। বিবেচনা দিয়ে রমণ ও প্রজনন হতে পারে, প্রেম হওয়া সম্ভব নয়। নিজেকে অন্ধ ও বধির না করলে প্রেম হয় না। বিবেচনাশক্তি জাগরুক রেখে প্রেমের লালসায় শহিদ হওয়া যায় না। নিজেকে নিঃস্ব করা যায় না। নেটিভ রমণীর জন্য সায়েব নিজেকে নিঃস্ব করতে পিছপা হবে না। এর অর্থ হলো সে আপনার সংকল্প অনুসারে চলছে না। নিজের স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছাচারে পরিণত করেছে। তার পতনের বেশি বাকি নেই। আপনি তাকে যে আয়ু বরাদ্দ করেছিলেন সেটা পূরণ হওয়ার আগে তাকে মরতে হবে। যদিও সেটা তাকে ভাবিত করছে না। সায়েবের এই অকালমৃত্যু আপনার পরিকল্পনাকে বিপন্ন করে তুলেছে। একমাত্র আপনি ইচ্ছা করলে সে বাঁচবে। নয়তো এই গাছের নিচে তার মরণ ঘনাবে।’
দেবদূতদের কথা শেষ হলে ইন্দ্রজাল গুম হয়ে পড়েন। মেঘে হেলান দিয়ে নিজের ভাবনা ও সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেন,-‘তোমাদের কথাগুলো যুক্তিসঙ্গত। এর সঙ্গে আমি দ্বি-মত করবো না। সায়েবটি আমায় কৌতূহলী করেছে। ওর মধ্যে আমি স্বেচ্ছাচারের ক্ষুধা দেখতে পাচ্ছি। আমার পরিকল্পনা সম্পর্কে ঔদাসিন্য টের পেয়েছি। তোমরা বলছো নিজের বিচারবোধকে সে রমণীর উপর প্রয়োগ করেছে। না, ওটা সে করেনি। বিবেচনা ও বিচারবোধ সম্পর্কে সে আসলে উদাসীন। স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচার নিয়েও সমান উদাসীন। সায়েব এক অবোধ শিশু। রমণীর অস্তিত্বে নিজের অস্তিত্বকে সে যাচাই করছে। তার কাছে রমণীরা হলো স্বাধীনতার ছাড়পত্র। স্বেচ্ছাচারের চাবি। এই চাবিটি দিয়ে সে মানুষের তালা খোলে। তোমরা তাকে বিকারগ্রস্ত বলেছো। কারণ সে অন্য পুরুষের রমণীতে আসক্তি প্রকাশ করে। ভালোবাসার নামে ওইসব রমণীকে প্রতারিত করে। রমণীরা সব বোঝার পরেও সায়েবের প্রতি আকৃষ্ট হতে দ্বিধা করে না। তাকে নিষিদ্ধ প্রণয়ে তৃপ্ত করে। নিজেরাও প্রণয়ের তৃষ্ণা মেটায়। এতে করে সায়েবের দোষ কাটাকাটি হয়ে যায়। বিষয়টিকে আমি এভাবেই দেখছি।
রমণীরা এই সায়েবটিকে কেন এতো লাই দিচ্ছে? কারণ, নিজের পুরুষের উপর তারা সন্তুষ্ট নয়। সায়েব সেই সুযোগে নিজের বাসনা পূরণ করছে। দুই পক্ষ দোষী হওয়ার কারণে ওটা আর পরকীয়া থাকছে না। প্রেম লালসায় পরিণত হয়েছে। তোমরা বলেছো বিবেচনা করে প্রেম হয় না। আমিও তাই মনে করি। প্রেম আসলে নির্লজ্জ। সায়েব আমাকে ছেড়ে রমণীতে মত্ত হয়েছে। আমার পরিবর্তে তুচ্ছ রমণীর জন্য নির্লজ্জ হচ্ছে। এতে আমার কষ্ট হলেও কিছু করার নেই। মানুষ স্বাধীন। তাকে আমি নিজের ইচ্ছাধীন করে গড়েছি। আমাকে বাদ দিয়ে আমার সৃষ্টির জন্য সে নির্লজ্জ হয়েছে। মন্দ কী! দেখি সে কতোদূর নির্লজ্জ হতে পারে। এর জন্য আমি তাকে শাস্তি দিতে অধীর নই। আমার কাছে নির্লজ্জের নিজস্ব ব্যাখ্যা রয়েছে। সে যদি ওটা পূরণ করে, তাকে আমি তিরস্কার করবো না। তার এই রমণীমোহ মেনে নেবো।
হে দেবদূতগণ, রমণীদের তোমরা দোষী করো না। তারা জগতের অলংকার। তাদেরকে আমি সুন্দর ও কমনীয় করে গড়েছি। রমণীরা এক কালে বন্য বা অসভ্য ছিল। কিন্তু তাদের সৌন্দর্যে আমি কোনো খাদ রাখিনি। বন্য এবং সভ্য,-উভয় রূপে তারা চিরকাল পুরুষের মন হরণ করেছে। অলংকার একাধারে নাজুক ও মনোহর হয়ে থাকে। ব্যবহার করার সময় বিবেচনা বজায় রাখা জরুরি। রমণীরা স্বাধীন। তারা বন্য রূপে স্বাধীন ছিল। সভ্য রূপে স্বাধীন থাকতে বাধা নেই। পুরুষরা অবশ্য নিজের বিচারবোধ তাদের উপর চাপিয়েছে। রমণীকে সেটা মানতে বাধ্য করছে। আমি বাধা দেইনি। তোমরা জানো মানুষের কোনোকিছুতে বাধা সৃষ্টি করা আমার অভিপ্রায় নয়। আমি দেখতে চাই তারা কতোদূর যেতে পারে। স্বাধীনতা, বিবেচনা ও বিচারকে কীভাবে প্রয়োগ করে। আমার পরিকল্পনার সঙ্গে সেটা মিলে কিনা! তোমরা ঠিক ধরেছো,-মানুষের কর্মই হচ্ছে তার নিয়তি। সুতরাং বাধা দেয়া নিরর্থক। করুক তার যা-খুশি। আমার সেখানে নির্বিকার থাকা উত্তম।
মানুষকে আমি নিচে নামিয়ে দিয়েছি। আশ্চর্য এই পৃথিবীতে একলা ছেড়ে দিয়েছি। নিজের ভালো-মন্দ তারা নিজে ঠিক করুক। তবে সায়েবটি আমায় আকর্ষণ করেছে। পেটের দায়ে বণিক হলেও তার মধ্যে পুরুষবুদ্ধি প্রবল নয়। জগতে পুরুষরা সম্ভোগ করতে জানলেও ভালোবাসতে জানে না। এদিক দিয়ে তারা খাটো। সায়েবটি সেখানে ভিন্ন। তার মধ্যে পুরুষবুদ্ধির চেয়ে রমণীবুদ্ধি প্রখর। সে রমণীর মন পড়তে জানে। রমণীকে মাতিয়ে তুলতে পারে। রমণীরা হলো আত্মপ্রেমী। নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসে না। তারা আসলে স্বর্ণ-স্বভাবী। তাদের স্বভাবকে আমি স্বর্ণের অনুরূপ করে গড়েছি। পচা মাটি গভীরে গিয়ে সোনার পিণ্ডে পরিণত হয়। মানুষ গভীর মাটি খনন করে সেই স্বর্ণপিণ্ড উদ্ধার করে। রকমারি অলংকার গড়ে। স্বর্ণ দিয়ে রমণীর মন ভুলায়। স্বর্ণকে আমি মূল্যবান করে গড়েছি। যদিও স্বর্ণ নিজের মূল্য সম্পর্কে সচেতন নয়। অন্যরা তাকে ব্যবহার করার পর নিজেকে মূল্যবান বলে বুঝতে পারে। রমণীরা হলো তদ্রূপ। নিজের স্বর্ণগুণ সম্পর্কে তারা সচেতন নয়। এটা আমি ইচ্ছে করে দেইনি। দেখি তারা সেটা বুঝতে পারে কি না! নিজের সম্পর্কে সচেতন হতে পারে কি না! আজ অব্দি সেটা ঘটেনি।
জগতে রমণীরা এখনো পুরুষ-নির্ভর। পুরুষের চোখ দিয়ে নিজেকে স্বর্ণ বলে বুঝতে পারে। বোঝার পর তার মধ্যে আত্মপ্রেম জাগ্রত হয়। তোমরা মনে করো সে পুরুষকে প্রেম করছে। বাইরে থেকে দেখলে সেটা মনে হবে। কিন্তু তোমাদের এই দেখা সঠিক নয়। পুরুষের প্রেমে পড়ার নামে রমণী আসলে নিজের প্রেমে পড়ে। পুরুষের আহবানে সাড়া দিয়ে নিজের আহবান সে চরিতার্থ করে। প্রমত্ত কোনো পুরুষের বাসনা মিটানোর নাম করে নিজের বাসনা পুরা করে। রমণী জানে না সে মনোহর। তার মাঝে স্বর্ণের সৌন্দর্য লুকিয়ে রয়েছে। পুরুষরা তার ভিতরে সেই সচেতনা জাগিয়ে তোলে। পুরুষের লালসা ও প্রবঞ্চনা তাকে নিজের মূল্য বুঝতে শেখায়। রমণীরা নিজের সৌন্দর্যকে পূজা করে। এর যত্ন করে। এটা দিয়ে পুরুষলোকের মন ভোলায়। পুরুষ যতো ভোলে সে ততো মুগ্ধ হয়। পুরুষের কাছে নিজেকে মনোহর করে তোলে। তাকে ছলনা ও প্রতারণা করে। যেচেপড়ে পুরুষের প্রতারণায় ধরা দেয়। মানুষকে নামিয়ে দেয়ার পর থেকে এটা চলছে। আগামীতেও চলবে।
একটা কথা মনে রেখো, রমণীর মধ্যে আমার গুণ বিরাজ করে। আমি তোমাদের সবাইকে ভালোবাসতে গিয়ে আমার নিজেকে বেশি করে ভালোবাসি। আমার ক্ষমতা ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। তোমাদের কাছে নিজেকে প্রচার করি। রমণীরা মর্ত্যে সেই কাজটি করে। পুরুষকে ভালোবাসতে যেয়ে নিজেকে অধিক ভালোবাসে। তাদের কাছে নিজের গুণপনা জাহির করে। যে-কারণে রমণীকে আমি বাধা দেই না। করুক না। দেখি কতোদূর গড়ায়। অন্যের সাহায্য ছাড়া রমণীরা যেদিন নিজের গুণকে আবিষ্কার করতে শিখবে, সেদিন আমাকে নতুন করে ভাবতে হবে। এর আগে অব্দি সবকিছু যেমন চলছে তেমনি চলুক।
ইংরেজ সায়েবকে তোমরা চমৎকার বর্ণনা করেছো। আমি একমত যে সায়েবটি মতিচ্ছন্ন ও পাগলাটে। তবে তার স্বভাবটি তোমরা ধরতে পারোনি। সায়েবের মধ্যে আমি নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। সে রূপের পূজারী। রূপ-সম্ভোগে নির্লজ্জ। বিবেচনা ও বিচার সম্পর্কে অজ্ঞ। স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারের ব্যবধান নিয়ে মাথা ঘামায় না। লঘু পায়ে শহরে ঘুরে বেড়ায়। পেটের দায়ে কারবারি হলেও তার মন কিন্তু কারবারে বাঁধা থাকে না। রমণীর সৌন্দর্য তাকে পাগলাটে করে। খ্যাপার মতো নেটিভ এক রমণীর জন্য লালায়িত হয়। আমি খবর নিয়েছি, ওই রমণী বিবাহিতা ছিল। সায়েব এখনো সেটা জানে না। জানার কোনো ইচ্ছে তার মধ্যে আমি দেখছি না। স্বভাবের দিক থেকে নেটিভ রমণীটি সায়েবের বিপরীত মেরুতে বাস করে। অথচ এ-নিয়ে তার মনে কোনো প্রশ্ন নেই। রমণীর খবর জানার কোনো চেষ্টা বা উদ্যোগ নেই। বিষয়টি কৌতুকজনক বটে!
সায়েব ধরে নিয়েছে রমণীটি স্বর্ণগুণের অধিকারী। সময় হলে আপনা-থেকে ধরা দেবে। তার এই কৌতুকময় ধারণা আমায় আকৃষ্ট করেছে। বিবেচনা ও বিচারবোধ বিসর্জনের ধরন দেখে খানিক চমকে উঠেছি। সে দৈবে বিশ্বাস করে না, অথচ তার প্রেমে পড়ার ধাঁচটি দৈব ও অলৌকিক। সায়েবটি এমনিতে যুক্তিশীল। কিন্তু প্রেম-লালসায় যুক্তির তোয়াক্কা করছে না। ফলে বিবেচনা ও বিচার আপনা-থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। মানুষকে চালনাকারী শক্তি দুটোকে সে যেভাবে নিষ্ক্রিয় করলো সেটা আমায় চমৎকৃত করেছে। তার এই মাতাল হয়ে পড়াটা আমি উপভোগ করছি। ইচ্ছে করলে এই মুহূর্তে ওর প্রাণ সংহার করতে পারি। কিন্তু সেটা আমি করবো না। আমি দেখতে চাই সে কতোটা মাতাল হতে পারে। তার লালসা কতোদূর ঘন হতে পারে। নিজের বিকারে সে কতোটা নগ্ন বা অকপট হতে পারে। বিবেচনাহীনভাবে সেটাকে প্রয়োগ করতে পারে। তার আগে অব্দি ওর প্রাণ-সংহার স্থগিত থাকবে।
প্রেমকে আমি বিকার রূপে মানুষের মধ্যে দিয়েছি। বিবেচনা ও বিচারের অবকাশ সেখানে রাখিনি। বিকার ঘন হলে প্রেম দুর্বার হবে। সায়েবের মধ্যে আমি দুর্বার হওয়ার লক্ষণ টের পাচ্ছি। নেটিভ রমণীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটানোর ব্যবস্থা আমি করবো। রমণী সায়েবকে আচমকা দেখা দিবে। আমি দেখতে চাই সে তখন কী করে। মানুষকে আমি স্বাধীনতার ছাড়পত্র দিয়েছি। এবার দেখি সায়েব সেটা কীভাবে প্রয়োগ করে। প্রেম সম্পর্কে আমার নিজস্ব ধারণার সাথে ওটা মিলে কি না! যদি মিলে যায় সায়েব ও নেটিভ রমণীকে আমি প্রেমে সুখী করবো। তোমাদের সাক্ষী রেখে এই প্রতিজ্ঞা আমি করছি।’