ওসমান সমাচার পর্ব ৯ । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ জুলাই ২০১৬, ৮:৫৫ পূর্বাহ্ণ, | ২৬৫৩ বার পঠিত

‘রাং রাজওয়া’ ইন্দ্রজাল : পিট সায়েব ও বাইজি-কন্যা সমাচার (১)
মেয়র সাহেবের বাগানে ফাটিয়ে চাঁদ উঠেছে। আমরা এখনো সেই বাগানে ঘুরছি। ভরা চাঁদের রাতে ওসমানের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছি। সার্জন সাহেবকে বলা হয়নি যে ওসমান তাকে নকলি করেছে। সার্জনের পোশাক পরে বাগানে ঘুরছে। সুঁই-ছুরি-কাঁচি হাতে মানুষ খুনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শহরের সম্মানিত চিকিৎসকের নকলি হয়ে তার এই ঘোরাফেরাটা একদম সহ্য হচ্ছে না। রাক্ষসটাকে শেষ করা প্রয়োজন। ডর-ভয় জয় করে মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। সকলে মিলে তাকে চেপে ধরা প্রয়োজন। কিন্তু চন্দ্রকিরণের প্রভাবে রাক্ষস নিধনে কারো মন নেই। সকলে নিজেকে উদযাপনে ব্যস্ত।
শহরে অনেক প্রবীণ লোক বাস করেন। প্রচুর বয়স হয়েছে তাদের। জীবনের অভিজ্ঞতায় পেকে ঝুনো নারিকেল হয়েছেন। আমরা মাঝেমধ্যে তাদের কাছে যাই। পুরোনো দিনের গল্প শুনি। শহরের আদি বাসিন্দাদের কাহিনী শ্রবণ করি। প্রবীণরা দক্ষ কথকঠাকুর। তাদের স্মৃতিশক্তি আমাদের আশ্চর্য করে। পুরোনো দিনের কথাগুলো তারা এখনো মনে রেখেছেন। অথচ আজকের কথা তাদের মনে থাকে না। নিয়মিত ওষুধ খেতে ভুলে যান। মানুষ দেখে চট করে চিনতে পারেন না। গতকাল কোনো ঘটনার সাক্ষী হলে আজকে সেটা ভুলে যান। অথচ দূর অতীতের অনেক ঘটনা গড়গড় করে বলে যেতে পারেন। প্রবীণদের আমরা মনে-মনে সমীহ করি। তারা হলেন সেতুবন্ধনী। ঝাপসা অতীতকে চলমান সময়ের সাথে সংযুক্ত করেন। মৃত অতীতকে আমাদের মধ্যে বারবার জাগিয়ে তোলেন।
প্রবীণরা এই শহরের কথকঠাকুর। বাসি ঘটনাকে কথার জাদু দিয়ে উজ্জীবিত করতে পারেন। মেয়র সাহেবের বাগানে তাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। ঘরের বাইরে তারা বড়ো একটা বের হন না। নিজেদের নির্জন কোঠায় অথবা হুইলচেয়ারে শুয়ে-বসে তাদের দিন কাটে। প্রবীণরা আসলে নিঃসঙ্গ। পরিবারের সদস্যদের কাছে ব্রাত্য ও অবহেলিত। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় কারো হয় না। ঘোলাটে চোখে তারা একালের শহরকে অবলোকন করেন। এর গতি ও ব্যস্ততা ঠাহর করার চেষ্টা করেন। তাদের বোধের জগতে শহরটিকে হেঁয়ালি বলে মনে হয়। তারা চোখ বন্ধ করে ঝিমাতে থাকেন। একালের শহরে বাস করে সেকালের শহরে ঢুকে পড়েন। সেখানে বিচরণ করতে থাকেন। নিজেকে এর অংশীদার করেন। পুরোনো দিনের গল্পগাছায় ডুবে নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখেন।
আমাদের কাছে প্রবীণরা তাই কথার জাদুকর। আমরা যেচেপড়ে তাদের সঙ্গে দেখা করি। দূর অতীতের গল্প শুনি। নিজেরা সেই কাহিনীর অংশ ও চরিত্রে বিচরণ করি। রোমাঞ্চ ও শিহরণে পুলকিত হই। রাক্ষস ওসমানের বহু কেচ্ছা প্রবীণদের কাছে শোনা। ওসমানের গল্প শেষ হলে তারা ঘোলাটে চোখ নেড়ে উদাস হয়ে পড়েন। বিড়বিড় করে কথা বলেন,-‘রাক্ষসকে হত্যা করা সহজ নয়। তাকে হত্যা করতে হলে তোমার নিজের মধ্যে ঘুমন্ত রাক্ষসটিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। ওসমানকে পাকড়াও করতে হলে তোমার ভিতরে তাকে জন্ম দিতে হবে। তার স্বভাব-চরিত্রে নিজেকে অভ্যস্ত করতে হবে। এছাড়া সে তোমার আশপাশে ঘুরলেও তুমি টের পাবে না।’
ওসমান প্রসঙ্গে প্রবীণরা ঘুরেফিরে কথাগুলো আমাদের বলেন। কেন বলেন সেটা আজো বুঝতে পারিনি। শুধু এটুক বুঝি আমাদের ভিতরে রাক্ষসের উপস্থিতি সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হতে পারছেন না। মেয়র সাহেবের বাগানে ওসমানের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে প্রবীণদের কথাগুলো আমরা স্মরণ করি। তাদের হেঁয়ালিভরা কথার অর্থ হুট করে পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা বুঝতে পারি আমাদের মধ্যে রাক্ষসের উপস্থিতি এখনো প্রবল হয়ে উঠেনি। শত্রুকে আমরা ভালো করে চিনি না। তাকে অনুভবের শক্তি রাখি না। যে-কারণে তার অদৃশ্য উপস্থিতি টের পেয়েও পাই না। বারবার বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি।
প্রবীণদের মতে রাক্ষস ছদ্মবেশ ধারণে পারঙ্গম। নিজেকে বিচিত্র রূপে হাজির করতে তার জুড়ি নেই। মানুষ ইচ্ছে করলে একটা গাছ হতে পারে না। রাক্ষস চাইলেই পারে। মানুষরা বাঘ-সিংহ-গণ্ডারের মুখোশ পরে ঘোরে। সাপ ও ভাল্লুকের পোশাক গায়ে চড়িয়ে অন্যকে উত্যক্ত বা বিনোদিত করে। রাক্ষসের ওসব করার প্রয়োজন হয় না। অনায়াসে যে কোনো প্রাণীর রূপ ও চরিত্র ধারণ করতে পারে। মানুষ অনেকভাবে নিজেকে আড়াল করে রাখে। অদৃশ্য ও রহস্যময় আচরণে অন্যকে বিব্রত করে। দ্বৈত সত্তা নিয়ে বন্ধু বা প্রিয়জনের মাঝে ঘুরেফিরে। প্রিয়জনকে প্রতারিত করে। প্রতারণা ধরা পড়লে তাকে আমরা জোচ্চুর ও প্রতারক বলে ডাকি। তার এই দ্বৈত সত্তা ধারণকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করি। রাক্ষস বলে তাকে গালি দেই। দ্বৈত সত্তাধারী মানুষের প্রতি আমাদের ক্ষোভ দেখে প্রবীণরা মুখ নিচু করে হাসেন। তাদের হাসতে দেখে আমরা কিছুটা অবাক হই। মনে সন্দেহ জাগে, তবে কি তারাও দ্বৈত সত্তা নিয়ে শহরে বসবাস করেন! অথবা দ্বৈত সত্তা ধারণ করে আমাদের বিভ্রান্ত করছেন! আমরা হতবিহ্বল হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। চোখে সন্দেহ ঘনায়। বুক ঢিপঢিপ করে। প্রবীণদের রাক্ষস বলে ভ্রম হতে থাকে।
এই শহরের প্রবীণকুল জীবনের অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক ও রসালো। আমাদের বিস্ময় ও সন্দেহ তারা চট করে ধরে ফেলেন। কাঁপা কণ্ঠে আমাদের বোঝান,-দ্বৈত সত্তা ধারণ করার পরেও রাক্ষস পালটায় না। সে যখন মানুষের রূপ ধরে তখনো রাক্ষস থাকে। ড্রাকুলা ও ভ্যাম্পায়ার যেমন মানুষের রূপ ধারণ করা সত্ত্বেও রক্তচোষা থেকে যায়। রক্তচোষাকে চেনার চোখ যার আছে তাকে সে ফাঁকি দিতে পারে না। এই ছদ্মবেশীর শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা থাকে। হাত দিলে মনে হয় মানুষের পরিবর্তে বরফখণ্ডে হাত দিচ্ছি। রাক্ষসরা সে নিয়মের বাইরে নয়। মানুষের বেশধারী রাক্ষসকে চেনার সহজ উপায় হচ্ছে তাকে স্পর্শ করা। এক্ষেত্রে নিয়ম অবশ্য উলটো। রাক্ষসের দেহ মানুষের চেয়ে উষ্ণ থাকে। স্পর্শ করলে হাত ছাঁৎ করে ওঠে। মনে হয় পুড়ে যাবে! এতোটাই উষ্ণতা সে রক্তে ধারণ করে!
সোজা কথা আসলি ও নকলি যে কোনো বেশে রাক্ষস নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। তার স্পর্শ তাকে চিনিয়ে দেয়। গায়ের গন্ধ ও চলাফেরার ধরন বুঝিয়ে দেয় সে হলো রাক্ষস। নিজের স্বভাব বেশিক্ষণ গোপন রাখতে পারে না। হুট করে সেটা বেরিয়ে পড়ে। যার দেখার চোখ আছে রাক্ষসকে সে ঠিক চিনে ফেলে। মানুষ কিন্তু অন্যরকম। সে ইচ্ছে করলে দ্বৈত বা একাধিক সত্তায় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে। ছদ্মবেশ ধারণের পর একটি মানুষ দুই বা ততোধিক মানুষে ভাগ হয়ে যায়। ফলে রাক্ষসকে চেনা গেলেও ছদ্মবেশী মানুষকে সহজে চেনা যায় না। প্রবীণরা বিশ্বাস করেন ছদ্ম মানুষের পক্ষে আসল রাক্ষসকে নিধন করা সম্ভব নয়। রাক্ষসকে মারতে হলে তোমাকে ছদ্ম মানুষের স্বভাব ছেড়ে রাক্ষসের স্বভাব রপ্ত করতে হবে। মানুষরা যে-নিয়মে ছদ্মবেশ ধারণ করে রাক্ষসের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম খাটে না। সুতরাং রাক্ষসের উৎপাত বন্ধ করতে হলে তোমাকে তার মতো সরল ও সোজাসপাটা হতে হবে। রাক্ষস নিধনের এটা হচ্ছে মূলমন্ত্র।
ভরা চাঁদের রাতে ওসমানের উপস্থিতি সম্পর্কে লোকজনকে নির্বিকার থাকতে দেখে প্রবীণদের কথাগুলো আমাদের মনের কোণায় যাওয়া-আসা করে। তাদের বলা গল্পগুলো স্মরণ করি। মন্তব্য ও উপদেশ ঝালাই করি। মেয়র সাহেবের আশ্চর্য বাগানে ওসমানের উপস্থিতি আমরা দিব্যি টের পাচ্ছি। অথচ অন্যরা পাচ্ছে না। তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য বাগানময় ছুটোছুটি করছে না। দিব্যি খোশগল্পে মেতে রয়েছে। যেন সবাই মিলে পিকনিক করতে এসেছে এখানে। তবে কি প্রবীণদের কথা সত্য! বাগানে যারা গুলতানি মারছে তারা আসলে রাক্ষসভাবিক নয়। তবে কি দ্বৈত বা অধিক বেশ ধারণ করে তারা এই বাগানে এসেছে? যে-কারণে তাদের চারপাশে রাক্ষসের চুপিসারে চলাফেরা টের পাচ্ছে না!
আমরা অবাক হই। যে কোনো মুহূর্তে ওসমানের ঝাঁপিয়ে পড়ার ভাবনাটি কাউকে বিচলিত করছে না কেন! তাকে আমরা সার্জনের পোশাকে বাগানময় ঘোরাফিরা করতে দেখছি। অথচ বাকিরা সেটা ধরতেই পারছে না! তাদের এই নির্বিকার থাকার ধরন প্রবীণদের কথার সঙ্গে মিলে যায়। প্রবীণরা বলেন বটে,-রাক্ষস মারতে হলে রাক্ষসের চরিত্র ধারণ করা জরুরি। নতুবা পিট সায়েবের অবস্থায় পড়তে হবে। লোকজন তোমায় শহরছাড়া করে ছাড়বে। পিট সায়েবের কাহিনী স্মরণ করে আমরা বিমনা হয়ে পড়ি। বহু পুরোনো গল্পটি নতুন করে মগজে হানা দেয়।
প্রবীণরা একদিন গল্পচ্ছলে ইংরেজ সায়েবের কাহিনী শুনিয়েছিলেন। কাহিনীটি আজব ও হেঁয়ালিভরা। তাদের মতে পিট সায়েবের কাহিনী থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। নিজেকে অনুপ্রাণিত করার রসদ রয়েছে। প্রবীণদের মুখে গল্পটি শোনার সময় আমাদের রক্ত ভালোবাসার আবেগে শিহরিত হয়। আমরা হিন্দিভাষী নেটিভ এক রমণীর প্রেমে চঞ্চল হই। সায়েব খেদানোর গানে উত্তেজিত হই। সবমিলিয়ে সেদিন আমরা নিজের মধ্যে ছিলাম না। প্রবীণরা আমাদের পুরোনো এক শহরে নামিয়ে দিয়েছিলেন। সেই শহরে ঢোকার পর আজকের শহরটিকে আমরা হারিয়ে ফেলি। রোমাঞ্চ, আবেগ ও শিহরণে আমাদের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। পিট সায়েবের বাতিক নিয়ে আমরা ঠাট্টা করি। তার উপর ক্ষুব্ধ হই। আবার তাকে শহর থেকে বিতাড়িত হতে দেখে দুঃখ লাগে। আমরা নিজের বশীভূত নই বুঝে প্রবীণরা মুখ নিচু করে হাসেন। আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বহুবার বলা কথাগুলো নতুন করে স্মরণ করেন।
প্রবীণরা সেদিন আমাদের মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন,-‘শোন, রাক্ষস যদি মারতে চাও তবে নিজেকে আগে রাক্ষস করে তুলতে হবে। তার সঙ্গে রণে নামার সময় ‘তুমি মানুষ’ এই কথাটা তোমায় ভুলতে হবে ভাই। রাক্ষস হিংস্র ও শক্তিশালী। তোমাকেও হিংস্র হতে হবে। রণে নেমে ভয় পেলে চলবে না। তোমার কোনো পিছুটান থাকবে না। ভয় পেয়ে পালানো যাবে না। সে হুংকার দিলে তোমাকে পালটা হুংকার ছুঁড়তে হবে। তেড়ে মারতে এলে তোমাকেও তেড়ে যেতে হবে। বেজি যেভাবে সাপের সঙ্গে লড়ে, তোমাকেও রাক্ষসের সঙ্গে সেভাবে লড়তে হবে। বিষধর সরীসৃপের সঙ্গে লড়বার সময় বেজি সাপের স্বভাব রপ্ত করে। বিষরাজের অস্ত্র দিয়ে বিষরাজকে ঘায়েল করে। সাপ সেটা পারে না বলে বেজির সঙ্গে বারবার হার মানে। ছোটখাটো প্রাণীটি অমন ভয়ংকর একটি প্রাণীর টুঁটি চেপে ধরে। রাক্ষসের ক্ষেত্রে কথাটি খুব খাটে।
একটা কথা মনে রেখো, রণে নেমে তোমাকে সতর্ক ও কৌশলী হতে হবে। এছাড়া রাক্ষস নিধন সম্ভব নয়। মনে রাখবে মানুষভাবিক হয়ে রাক্ষস মারা যায় না। তাকে ঘায়েল করতে হলে তোমাকেও রাক্ষসভাবিক হতে হবে। তার শক্তি ও পৌরুষ হরণ করে নিতে হবে। শহর থেকে পিট সায়েবকে বিতাড়নের সময় শহরবাসী এই কাণ্ডটি ঘটায়। আরেকটু হলে সায়েবদের পৌরুষ তারা কেড়ে নিয়েছিল। ইংরাজ সায়েবদের গায়ে এই প্রথম কম্প দিয়ে জ্বর আসে। শহরবাসীর এমনধারা আচরণ তারা আগে কখনো দেখেনি। ফ্লেচারের যুগে তো প্রশ্নই ওঠে না। পরে আরো সায়েব এসেছে। তারাও দেখেনি। কিন্তু পিট সায়েবের কপাল মন্দ। তাকে সেটা সইতে হলো!
সময়টা আসলে পিটের অনুকূলে ছিল না। সায়েব সেটা বুঝতে পারেনি। শহরের প্রতিটি অলিগলি সায়েব তাড়ানিয়া গানে মুখর ছিল। পিটের ঘটনা সেখানে আগুনে ঘি ঢালে। সে যাকগে, তোমরা যদি সত্যি রাক্ষস মারতে চাও তবে তাকে তাড়ানোর গান রপ্ত করতে হবে। তবেই জিতবে। এছাড়া ওসমানকে ঠেকাতে পারবে না। কোনো এক চাঁদরাতে সে ডেরা থেকে বেরিয়ে আসবে। পূর্ব-পুরুষরা তার উপর ভর করবে। ফুলখেকো রাক্ষস মানুষখেকো খোক্কস হয়ে সবাইকে গপ করে গিলে নেবে। তছনছ করবে গোটা শহর!’
প্রবীণদের কথার জাদুকরি টানে সেদিন আমরা অচেনা এক শহরে ঢুকে পড়েছিলাম। অচিন এক সময়ে পরিভ্রমণ করছিলাম। বিদায় নিয়ে রাস্তায় নামার পরেও ঘোর তাই কাটেনি। আমাদের বেসুরো কণ্ঠে সুর এসে ভর করেছিল। রাতের শহর চমকিত হচ্ছিলো গানে। শহরটি তখন ঘুমভার। আমাদের ফাটা গলার আওয়াজে অনেকে চমকে ওঠে। ঘুমচোখ কচলে জানালার পাশে দাঁড়ায়। জানালা খুলে রাস্তায় উঁকি মারে। তারা বোঝার চেষ্টা করে এতো রাতে কী ঘটছে সেখানে! আমরা তখন কাউকে পরোয়া করছি না। সঙ্গে টোকাইরা জুটেছে। রাতটি অন্যরকম ছিল। আজকের মতো আলোর এতো ঢল ছিল না। তবে চাঁদ ছিল আকাশে। কাস্তের মতো সরু চাঁদ উঠেছিল আকাশে। আমরা তখন নিজের মধ্যে নেই। কবেকার এক শহরে চলে গেছি! অচেনা এক নগরে ইন্দ্রজাল আমাদের নামিয়ে দিয়েছেন। ফ্লেচার সায়েবের শহরে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি। নেটিভ ও সায়েবসুবোয় ভরা পুরোনো নগরে পা ফেলে হাঁটছি। অনুসরণ করে চলেছি পিট সায়েবকে। আমাদের কণ্ঠে রণদামামা। আমরা এখন চারণকবি মুকুন্দ দাস হয়েছি। গলা খুলে গাইছি রাক্ষস তাড়ানিয়া গান!
ওটা ছিল স্বদেশীর যুগ। স্বরাজ ও সত্যাগ্রহ চলছে শহরে। ফ্লেচার সায়েব অনেক আগে মারা গেছে। তার জাতভাই পিটার উইলিয়ামস এখন শহরে বিচরণ করে। ফ্লেচারের মতো দাপুটে নয়। নিছক বণিক। ব্যবসার ধান্ধায় এখানে থিতু হয়েছে। সায়েবকে সকলে কমবেশি চেনে। শহরবাসী তাকে সংক্ষেপে পিটার নামে ডাকে। ফাজিল ছোকরার দল এককাঠি সরেস। সায়েবকে দেখলে পিট বলে হাঁক পাড়ে। তাদের যুক্তি হলো সায়েব দেখতে সুন্দর হলেও একটু টেরা টাইপের। কারো সঙ্গে কথা বলার সময় চোখ দুটো সারাক্ষণ পিট-পিট করে। মনে হয় চোখ মারছে।
দুরন্ত ফ্লেচারের তুলনায় পিটার আসলে নিরীহ মেষশাবক। দাপুটে ওই ইংরেজটির মতো ধুরন্ধর নয়। সে ফ্যাশনদুরস্ত ও শৌখিন। সায়েব হওয়ার সুবাদে ফ্লেচারের ন্যায় অত্যচার করে না। কারণে-অকারণে নেটিভদের উত্যক্ত করার বদ-অভ্যেস নেই। পিটারের একটাই মুদ্রাদোষ। সুন্দরী রমণী দেখলে আত্মহারা হয়ে পড়ে। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে প্রেম ও কামের চোরাটানে ভুগতে থাকে। পিটার এক সুদর্শন ইংরেজ। তার সৌন্দর্য রমণীকে পুলকিত করার হিম্মত রাখে।
পিট সায়েবের বচন কমনীয়। রমণীর সঙ্গে বাক্যালাপে খ্যাপাটে ও কাব্যিক। রূপ-সম্ভোগের বাই মাথায় চাপলে স্বদেশী ও নেটিভে তফাত ধরে না। মওকা বুঝে ঝাপটা মারে। রূপ-সম্ভোগের ক্ষণে সুদর্শন পিটার রোম্যান্টিক ও লম্পট বটে! শেলী ও বায়রন খুব ভালোবাসে। কিটস বা টেনিসন আওরে রুচিশীলা ইংরেজ রমণীকে প্রীত করে। শেকসপিয়ারের ডেসডিমোনার সঙ্গে কালিদাসের শকুন্তলার মিল-বেমিল নিয়ে গুরুতর কাব্য করতে জানে। রুচি ও নন্দনের প্রশ্নে সায়েব বনেদি। মনে কামবিকার ঘনালে বন্য ও অসংস্কৃত পাইরেট।
ফাজিল ছোকরার দল সায়েবকে পিট বলে ডাক পাড়ে। তাদের এই পিট নভেল পড়ে। রসিকজনের সঙ্গে ডিফো, ডিকেন্স ও সুইফট নিয়ে জমিয়ে আলাপ করতে জানে। নেটিভদের মাঝে সমঝদার শ্রোতা পেলে ডিফো’র মাহাত্ম্য বোঝায়। পিটের দুঃখ রবিনসন ক্রুশোকে নেটিভরা আজো বুঝতে পারে না। নির্জন দ্বীপে এক অসভ্য মানবকে সভ্য করে তোলার অর্থটি ধরতে পারে না। ক্রুশো কেবল রোমাঞ্চঠাসা নভেলের কাল্পনিক চরিত্র নয়। মানুষের সভ্যতা বিস্তারের ক্ষুধাকে সে প্রকাশ করে। জাহাজডুবির কারণে জনমানব-শূন্য এক দ্বীপে তার ঠাঁই হয়। দ্বীপে বসবাস করার সময় নরমাংসভোজীর হাত থেকে বন্য ও অসভ্য ফ্রাইডেকে সে উদ্ধার করে। তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে মানুষ করে তোলে। সভ্যতার নতুন ভাষা ও বচনে দীক্ষিত করে। ক্রুশোর মধ্য দিয়ে নেটিভ ও সায়েব এক যৌথ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। লেনদেনের উর্বর দিগন্তে দুজনে পা রাখে। ফ্রাইডের প্রভু হলেও ক্রুশো তাকে রাক্ষসের যুগ থেকে মানুষের যুগে অবতরণ করায়। পিটারের দুঃখ হয় ভেবে রাক্ষস থেকে মানুষে অবতরণের এই ইশারা অনেক ইংরেজ পাঠক ধরতে পারে না! নেটিভরা এর ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। ক্রুশোর মধ্যে সায়েবদের কলোনি স্থাপনের ফন্দিফিকির খুঁজে।
নেটিভদের বক্তব্যে পিটারের সায় নেই। নেটিভ রমণীর রূপে মুগ্ধ হলেও নেটিভ পাঠকের ডিফো-পঠন তাকে পীড়িত করে। ক্রুশো কোনো ছাপোষা কলোনি-মালিক ছিল না। ভাগ্যান্বেষী হলেও সে নিছক জলদস্যু নয়। ক্রুশো হচ্ছে সভ্যতার অগ্রদূত। নির্জন দ্বীপ ও ফ্রাইডেকে প্রাগৈতিহাসিক পচন থেকে রক্ষা করেছে। ফ্রাইডে তো পশু ছিল। বুনো ও অবাধ্য রাক্ষস ছিল। ক্রুশো তাকে পশু ও মানুষের পার্থক্য ধরতে শিখিয়েছে। রাক্ষস ও মানুষের তফাত বোঝাতে পেরেছে। বুনো ফ্রাইডেকে সে রুচিশীল ও বনেদি করেছে। বিনিময়ে যে সেবা ও আনুগত্য তার কাছে দাবি করেছে সেটা গুরুদক্ষিণার বেশি কিছু নয়। এই ভূ-বর্ষে গুরু তার শিষ্যকে হাতের আঙুল কেটে দক্ষিণা দিতে আদেশ করে। শিষ্য সেটা দিতে বাধ্য হয়। ফ্রাইডের কাছে ক্রুশো আঙুল দাবি করেনি। সে আশা করেছে খাটুনি ও আনুগত্য। শিষ্যের যেমন গুরুর প্রতি থাকতে হয়। মজুরকে অনুগত হতে হয় মালিকে।
পিট বিশ্বাস করে ফ্রাইডের এই আনুগত্যের ফলে নেটিভ ও সায়েব একটি সম্পর্কে প্রবেশ করতে পেরেছে। বুনো প্রকৃতি ও সভ্য মানুষের চুক্তিটি নতুন করে লেখা গেছে। পরস্পরের কাছে তারা এখন অপরিহার্য। নভেলে ক্রুশো ও ফ্রাইডে একে অন্যকে বিনিময়ে প্রীত করেছে। সভ্যতার চাকা বিনিময় ছাড়া ঘোরে না। এটা ছাড়া সমাজ টিকে থাকে না। সম্পর্ক নতুন গতিধারা লাভ করে না। বিনিময় ছাড়া মানুষ নরমাংসভোজী রাক্ষস থেকে যায়। মানুষ হতে পারে না। সায়েব মনে করে ডিফো’কে নেটিভদের ভালোভাবে পড়া উচিত। এই ইংরেজ লেখককে বোঝার চেষ্টা করা উচিত। নেটিভদের জীবনে সায়েবরা নতুন অবদান নিয়ে এসেছে। ক্রুশো ও ফ্রাইডের বিনিময় বুঝতে পারলে নেটিভ ও সায়েব যৌথ এক সম্পর্কে স্থিতু হতে পারবে। ভবিষ্যতের জন্য এটা দরকারি বটে!
শহরের রসিক শিক্ষিতজনের কাছে পিটার একজন ভালো বক্তা। রমণীকুলে কথার জাদুকর। তার বাচনভঙ্গি দৃঢ় ও কমনীয়। সুবেশী সায়েব যুক্তি দিয়ে কথা বলে। আবেগ ও কামনা বুকে পুরে ভালোবাসে। এখনো বিয়ে করেনি। সহসা করবে বলে মনে হয় না। স্বদেশী রমণীর পাণিগ্রহণ তার জন্য কঠিন কিছু নয়। রমণীরা পিটারকে বাসনা করে। নিজের দেশে এবং এই শহরে তার গুণমুগ্ধ ইংরেজ মেমের সংখ্যা নগণ্য নয়। সায়েব এক চঞ্চল ভ্রমর। ফুলে-ফুলে উড়ে বেড়ায়। মধু পান শেষে অন্য ফুলদলে উড়াল দেয়। ইংরেজ মেমদের বুঝতে বাকি থাকে না পিটার অতিশয় পাজি। প্রেমের জন্য লাগসই হলেও বিয়ের জন্য নয়।
পিটারের স্বভাব যারা বুঝে তারা লুকিয়েচুরিয়ে সায়েব-সঙ্গ করে। মেমকুলে পিটার হলো নিষিদ্ধ উত্তেজনা। রোমান্সের ঝুঁকি ও শিহরন। সায়েব হচ্ছে নিষিদ্ধ প্রেমের রাজা। মেমদের নিয়ে কাব্য করে ও কাব্য করায়। মাঝেমধ্যে অবশ্য রথ উলটো পথে চলে। গোপন অনুরাগের জোয়ারে ভাসতে সংকোচক্ষুব্ধ কোনো রমণীতে হৃদয় জখম হলে পিটার তাকে পটাতে বিলম্ব করে না। রূপ-সম্ভোগে সায়েবের কোনো ছুঁৎমার্গ নেই। কালেকটরের রূপবতী স্ত্রী ও সুশ্রী কন্যায় তফাত ধরে না। মা ও মেয়েকে কমনীয় বচনে বশীভূত করে। রূপবতীকে গোপনে কব্জা করে। সুশ্রীকে ছল করে অগোচরে। প্রেমের শর ছুঁড়ে কামবাসনার দুয়ার খোলে। সায়েব এক লঘুচিত্ত খেয়ালি। রূপ-সম্ভোগে নিষেধাজ্ঞা মানে না। বিকারের পরোয়া করে না।
কালেকটর সায়েবের বাটিতে সেদিন রাত্রে পার্টি ছিল। প্রশাসনের কর্তা সবাইকে নৈশভোজে ডেকেছে। মানিগুণীরা ভিড় করেছেন সেখানে। সায়েবরা আছে নিজগুণে। কতিপয় নেটিভ ডাক পেয়েছেন বনেদি ও বিশিষ্ট হওয়ার সুবাদে। পিটার কেউকেটা নয়। মান ও গুণের ভারে বিশিষ্ট নয়। সে লর্ড কিংবা আর্ল নয়। ইংলিশ অভিজাতদের বংশলতিকার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সায়েব দুঁদে আমলা বা রাজস্ব আদায়কারী নয়। রবার্ট লিন্ডসে হওয়ার ভাগ্য করে শহরে আসেনি। ওই কালেকটরের বড়ো দাপট ছিল শহরে। উৎপাত ঘটানো ছাড়া সায়েবটি অবশ্য নেটিভের কোনো কাজে আসেনি। তার আমলে নদী পর-পর দুইবার ভয়ংকরী হয়। ফসল ও ঘরদোর বানে ভাসে। বানভাসি নেটিভকে বাঁচাতে সায়েব কোনো উদ্যোগ নেয়নি। স্থানীয় লোকজনের স্বার্থের বিষয়ে উদাসীন হলেও রাজস্ব আদায়ে জবরদস্ত ছিল।
রবার্ট লিন্ডসে জীবনে অঢেল কামিয়েছে। অগাধ বিত্তের জোরে অভিজাত ইংলিশম্যানের সভায় ঢুকতে তাই অসুবিধা হয়নি। মুদ্রালোভী লিন্ডসের তুলনায় পিটার তুচ্ছ কীট মাত্র। জমিয়ে কাব্য করতে জানলেও লর্ড বায়রন হওয়ার ক্ষমতা রাখে না। প্রমত্ত এই কবি ও যোদ্ধার সঙ্গে তার সাদৃশ্য কাকতালীয়। বায়রনের অতুল কাব্য-প্রতিভা পিটারের নেই। গ্রিসের হয়ে অটোমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো বুকের পাটা নেই। তবে সে বায়রনের চাইতেও সুদর্শন। তার মতো ফ্যাশনদুরস্ত এক খ্যাপা রোম্যান্টিক।
পিটারের গুণ হচ্ছে সে সুন্দর। সৌন্দর্য ও বাচনভঙ্গি তাকে মানি-গুণীর ভিড়ে প্রাসঙ্গিক করে রাখে। মামুলি সায়েব থেকে অভিজাত ইংরেজ করে তোলে। শহরকে সে পোশাক ও সুগন্ধ দিয়ে সুবাসিত করছে। ভাগ্যান্বেষী সায়েবের ওটাই বাণিজ্য। ‘পিটার ক্লথস এন্ড জুয়েলারি’ শহরকে ফ্যাশনদুরস্ত থাকার রসদ যোগায়। ইংরাজ সায়েব ও মেমদের জন্য দোকানটি এক তীর্থস্থান। বনেদি নেটিভরা কৌতূহল মেটাতে বিলেতি কেতার দোকানে এক পাক ঘোরান দিয়ে আসে। শহরকে বিলেতি রাখার ক্ষেত্রে সায়েবের অবদান ইংরেজ মাত্র স্বীকার করে। প্রতিদানস্বরূপ সায়েবদের ভোজে বা উৎসবে পিটার আপনা-থেকে নিমন্ত্রিত থাকে এবং নিমন্ত্রিত হয়। বনেদি নেটিভরা ভোজে-পার্বণে তাকে আমন্ত্রণ জানাতে ভোলে না।
কালেকটরের নৈশভোজে পিটার থাকবে এটা স্বাভাবিক। ওই তো অতিথিকুলের মধ্যে লঘুপায়ে ঘুরছে। কমনীয় বচনে কালেকটরের সঙ্গে করমর্দন সারছে। কালেকটরের রূপবতী স্ত্রী নিজের শুভ্র আঙুল তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। রমণীর চোখে মদির কটাক্ষ। সুদর্শন পিটারকে দেখে রমণীর গোলাপি গণ্ডদেশ ঈষৎ রক্তিম হয়। অধরে গোপন প্রণয় রসিয়ে ওঠে,-‘ও! পিটার! কতোদিন পর তুমারে দেখিলাম! আমারে ভুলিয়া গিয়াছো মনে হয়!’ রমণীর চম্পক আঙুলে পিটার আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। সৌজন্যের পালা চুকিয়ে কালেকটর অন্যত্র সরে গেছে। অতিথিদের ছড়ানো-ছিটানো জটলার ভিড়ে দুজনে এখন একা। রূপবতীর চোখে সুদর্শনকে পান করার নেশা উথলে উঠছে, আর সুদর্শন সায়েবের ঠোঁটে জমেছে রূপবতীকে ঝাপটে ধরার উতলা পিপাসা!
তখন গ্রীষ্মকাল। কাঠফাটা গরমে অতিষ্ঠ হওয়ার দিন চলছে। মৌসুমী ফল রসালো ও পরিপক্ক হতে শুরু করেছে। অসহ্য তাপমাত্রার প্রভাবে ঘন-ঘন বজ্রপাত ও ঝড়-বৃষ্টির দিন শুরু হয়ে গেছে। বাতাসে এখন কাঁঠাল পাকার গন্ধ। রসবতি আম্রপালি ও রসরাজ আনারসের গন্ধ। কালেকটর সাহেব অতি বিচক্ষণ। দিন বুঝে নৈশভোজের আয়োজন করেছে। গত ক’দিনের টানা বজ্র-বৃষ্টির কারণে তাপমাত্রা খানিক নিচে নেমেছে। হালকা গরম অনুভূত হলেও মৃদু হাওয়া বইছে শহরে। হাওয়া বহন করছে আম্রপালির সুগন্ধ ও কাঁঠাল ফলের মাংসল ঘ্রাণ। ঘরের ভিতরে সুমিষ্ট আঙুর ফল ঝুলছে। আঙুর মাড়াই করে তৈরি মদিরার ঝাঁঝে অতিথিরা রসিয়ে উঠছেন। ঘর ভরে উঠেছে মদের কড়া ঘ্রাণে। রাতটি নেশাচ্ছন্ন। কালেকটর সাহেবে স্ত্রীর চোখে রূপ-সম্ভোগের নেশা লেগেছে। পিটার এখনো তার চাঁপারকলি আঙুলে অধর চেপে আছে। ওটা আর সৌজন্য চুম্বন হয়ে নেই। কামঘন বাসনার দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে। রমণীর চম্পক আঙুলে সায়েবের ঠোঁটের চাপ তীব্র হয়েছে।
পিটারের চুম্বনে রূপবতী খানিক বিব্রত হয়। সায়েবের বাসনাঘন চুম্বন তার দেহকোষে নিষিদ্ধ উত্তেজনার লহরী তোলে। অভিজাত রমণীর গণ্ডদেশ আরক্ত হয় সেই চুম্বনে। রক্তে বেসামাল হওয়ার আবেগ ভর করে। ঘরভর্তি জটলার ভিড়ে রমণী তার নিজেকে নিয়ে বিব্রত ও বেসামাল হয়ে পড়ে। আরক্ত গণ্ডদেশ ঘুরিয়ে আড়চোখে জটলার দিকে তাকায়। ভাগ্যিস, কেউ দেখেনি। পানীয় ও আলাপে সবাই এখন মশগুল। বিরাট ডিনার হলটি বলরুমে পরিণত হয়েছে। হলের মধ্যস্থলে অনেকে ওয়াল্টজ্ নাচে মগ্ন।
ওয়াল্টজ্ অন্তরঙ্গ ও যৌনাত্মক। চাইলে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস পড়া যায়। লোকে এটা দ্রুততালে নাচে। এই নাচে সঙ্গিনীর কোমর বেষ্টন করে সঙ্গী পুরুষ দ্রুততালে ঘোরে। পুরুষের বক্ষলগ্ন রমণী সেই তালে গোড়ালি ঘুরায়। তবে ইচ্ছে করলে গতি কমিয়ে ধীরলয়ে নাচা যায়। অনেকে ধীরে নাচে। কালেকটর সাহেবের হলরুমে ওয়াল্টজ্ এখন ধীরলয়ে বইছে। দেখে মনে হচ্ছে হালকা গরমের রাতে ওয়াল্টজে মগ্ন নাচিয়েরা পরস্পরের মাঝে অভিভূত হয়ে বইছে। গ্যাস ল্যাম্পের মৃদু আলোয় হলরুমকে অবাস্তব ও স্বপ্নিল মনে হয়!
কালেকটরের স্ত্রী ততোক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। তার চোখে বঙ্কিম কটাক্ষ,-‘ও! পিটার! তুমারে নিয়া পারি না! কালেকটর সাহেব টের পাইলে আস্ত রাখিবে না। দিনে-দিনে পাজি ও অসভ্য হইতেছো।’ রূপবতীর বিদ্যুৎবাণে পিটার মৃদু হাসে। সায়েব জানে এটা বাণ নয় প্রশ্রয়। নিষিদ্ধ অনুরাগের জোয়ার মেটানোর সময় এখন নয়। রমণী তাই সতর্ক। যদিও তার দেহের প্রতি কোষে পিপাসা উথলে উঠছে। উন্নত বুক জোড়া দলিত হওয়ার নেশায় ক্ষণে-ক্ষণে কম্পন তুলছে। রমণীকে আরেকটু চাপ দিলে বেসামাল হয়ে যাবে।
সায়েবের সুদর্শন চোখে নেশা ও কাব্য ঘনায়। চপলা রমণীকে আলিঙ্গনে পিষে ফেলতে ইচ্ছে করে। জোর করে সেই ইচ্ছায় লাগাম টেনে ধরে। কারণ তাদের দুজনকে ঘিরে ইংরেজ মেমদের ছোটখাটো এক জটলা জমে উঠেছে। কালেকটরের স্ত্রীর সঙ্গে পিটারকে কথা কইতে দেখে মেমরা তাকে ঘিরে ধরে। তাদের চোখে অনুরাগের মেঘ। অধরে অনুযোগের ফোয়ারা ছুটছে,-‘পিটার, তুমি সত্যি পাজি পিটার হইয়াছো। দোকানে গেলে সাক্ষাৎ মিলে না। হ্যারডস্ হইতে হবল আনাইয়া দিবার কথা ছিল, তার খবর নাই! তুমি না সত্যি পাজি হইয়াছো!’
রমণীকুলে পিটার চিরকালের স্বচ্ছন্দ। অনুযোগের মধ্যে অনুরাগকে পড়ে নিতে ভুল করে না। নিজে ফ্যাশনপ্রিয়। ইংরেজ মেমদের ফ্যাশনে প্রীত করতে ত্রুটি করে না। রানি ভিক্টোরিয়ার যুগ সেই কবে শেষ হয়েছে! ভিক্টোরিয় ছাদের পোশাকের কদর আগের মতো নেই। সায়েবসুবোদের পোশাকে পালাবদলের হাওয়া বইছে। ইংলিশ মেমরা রাজা এডওয়ার্ডের যুগে পা রেখেছেন। ফ্যাশন-বিলাসী রাজার যুগে নতুন রীতির পোশাক পরার ঢেউ উঠেছে। ইংরেজি বর্ণমালার ‘এস্’ অক্ষরটি এখন মেমদের মুখে-মুখে ফিরে। সেই অক্ষরের আদলে দর্জিরা এক নতুন পোশাক এনেছে বাজারে। হবল নাম ধারণ করে সে রমণী-হৃদয় কেড়ে নিয়েছে।
হবল রঙদার ও জমকালো স্বভাবের। মাটিতে লেছড়ে চলে। সাপের মতো শরীর বাঁকিয়ে রমণীর বক্ষ ও নিতম্ব কামড়ে ধরে। যুবতীরা যখন হবল পরে হাঁটে বক্ষকে তীক্ষ্ণ এবং নিতম্বকে গুরুভার লাগে। মনে হয় মেঘের সংকেত পেয়ে কামার্ত ময়ূর পেখম মেলছে। হবল তাই ময়ূরপঙ্খী। নতুন এই ময়ূরীর জন্য মেমরা মুখিয়ে আছেন। কিন্তু পাজি পিটারের আলস্য সেখানে বিঘ্ন হয়ে উঠেছে। ময়ূরপঙ্খী হওয়ার শখ মিটছে না। রমণীদের চোখে তাই অনুযোগের ছটা। স্ফুরিত অধরে কঠোর বাক্য ফুটে,-‘পিটার তুমি অলস হইয়াছো। আমাদের দিকে রুচি কমিয়াছে। মনে হয় নেটিভ রমণীর প্রেমে পড়িয়াছো। বিলেতি দোকানে নেটিভ সামগ্রী দেখিতে পাই। মনে হইলো উহারা সংখ্যায় বাড়িতেছে। তুমি আর ইংলিশ নহো পিটার। নেটিভে মন দিয়াছো। কেন?’

ÒA fashion plate showing the exterior of Harrod’s department store in Knightsbridge, 1909. The ladies’ silhouettes emphasize the vertical, with the waistline raised and the skirt width reduced. The lady in the foreground, who wears a cream military-style coat over her pinky-grey chiffon dress, holds a drawstring bag called a ‘Dorothy’. Handbags became essential accessories once narrowing skirts precluded the use of pockets. Applied decoration in the form of braid, tassels, beading and embroidery remained an essential feature of fashion.Ó
Ashelford, Jane. The Art of Dress; Clothes and Society, 1500-1914. London: The National Trust, 1996. p. 252, fig. 220.
সায়েবের পক্ষে এই অভিযোগের উত্তর করা মুশকিল। তার দোকানটি বিলেতি হলেও সেখানে নেটিভ সামগ্রী ঢুকছে। দিনশেষে বণিক লাভের অংক কষে। নেটিভের প্রভু হলেও শহরে ইংরেজরা সংখ্যালঘু। বিলেতি দোকান চালানোর ঝক্কি সামাল দিতে বণিককে বৈচিত্র্য ও আপস মেনে নিতে হচ্ছে। ব্যবসাদার পিটার এই অংকটা বুঝে বলে দোকান লাটে উঠেনি। হ্যারডস থেকে হবল নিশ্চয় আসবে, তার সঙ্গে চোলি-ঘাগড়াও চাই।
ভিক্টোরিয় যুগের প্রভাবে শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ ও শেমিজ পরার চল ঘটেছে। বড়ো ঘরের নেটিভ রমণীরা আজকাল ব্লাউজ পরে। সুতরাং ওটা রাখা চাই। কোম্পানির যুগে বিলেতি ও নেটিভে বনিবনা ছিল না। প্রভু হওয়ার সুবাদে কোম্পানির লোকজন নেটিভকে আচ্ছামতো দাবড়েছে। অথচ মেম ও নেটিভ রমণীর পোশাকে যথেষ্ট মিল ছিল তখন। নেটিভরা ইংরেজ মেমদের পোশাক থেকে নতুন কেতা ধার করতে দ্বিধা করেনি। নিজ দেশের পোশাকে সেটা যুক্ত করে পুরোনোকে নতুন করে গড়েছে। বিনিময়ের সেই চল এখন আর প্রবল নেই। শুধু টিকে থাকার ফন্দিফিকির আছে। নেটিভকে দাবড়ানির কূটনীতি আরো প্রবল হয়েছে। পিটার এর পক্ষে নয়।
সায়েব রাজ্য ও রাজনীতি কম বুঝে। সে ক্রুশোর ভক্ত। তার মতে নেটিভকে শুধু নেটিভ রেখে সায়েবি টেকানো যাবে না। তাকে আগে জাতে তুলতে হবে। তার রুচি ও আচারে নিজেরটা মিশিয়ে দিতে হবে। তোমারটা নেওয়ার জন্য তাকে লোভী করে তুলতে হবে। লোভী হলে সে পালটাবে। তার স্বকীয়তায় তখন ধস নামবে। সে এতে সায়েব হয়ে যাবে না, কিন্তু সায়েব খেদানোর গান কম গাইবে। ‘পিটার ক্লথস এন্ড জুয়েলারি’ সে কাজটি করছে এখানে। ক্রুশো যেমন ফ্রাইডের সঙ্গে করেছে। নিজের এই ফিলোসফি ইংরেজ মেমদের গিলানো মুশকিল বুঝে পিটার প্রসঙ্গ পালটায়,-‘তুমরা উতলা হও কেন! হ্যারডস-এ অর্ডার গিয়াছে। হবল অচিরে আসিবে। তবে চোলি ও ঘাগড়া কিন্তু কম রমণীয় নহে। ইংরেজ রমণীকে ইহারা উত্তেজক করে। এই পোশাকের মইদ্যে জিপসি রমণীর লঘু ছন্দ রহিয়াছে। প্রিয়তমের সান্নিধ্যে গম্ভীরা রমণী চপলা হইতে ভালোবাসে। চোলি ও ঘাগড়া তারে সেই সুখ প্রদান করিবে। তুমরা একবার পরিধান করিয়া দেখো। সুখ পাইবে।
আমি বলি কি, চোলি ও ঘাগড়া তুমরা বাহিরে নাই-বা পরিলে। প্রিয়তমের সম্মুখে উহা পরিতে পারো। ইংরেজ পুরুষ দিন-দিন একঘেয়ে হইয়া উঠিতেছে। তাহাদের প্রভাবে মেমরাও নিরস হইয়াছে। চোলি ও ঘাগড়া উহাদের সেই একেঘেয়েমি দূর করিবে। পুরষগণের মনে মৈথুন ও রমণের ক্ষুধা দুর্বার হইবে। তুমরা একবার পরিধান করিয়া দেখো। বাহিরে পরিবার দরকার নাই। ঘরের ভিতরে পরিয়া দেখো। নিজেরে হালকা ও চপলা লাগিবে। তুমাদের সৌন্দর্যে ঝর্ণার ছন্দ যোগ হইবে। পুরুষের মনে হইবে পাহাড়ি ঝোরা বন্য বেগে এইমাত্র নামিলো! উহারা বন্য আবেগে তুমাদের সন্তোষ যুগাইবে। শীতল ইংরেজ রমণীকে এই পোশাক অধিক উষ্ণ ও চঞ্চলা করিবে। চোলি ও ঘাগড়া কাম-ইচ্ছা জাগ্রত করায়। ইহারা উত্তেজক পানীয়। উত্তেজনা জাগ্রত করায়।’
পিটারের বাচন কমনীয়। অশ্লীল ইঙ্গিত অব্দি সে বাচনে লঘু হয়ে পড়ে। কোথায় যেন রসের বিস্তার ঘটে। মন রসিয়ে উঠে রঙ্গ ও প্রণয়ের ঝড়ে। সায়েব কথার জাল বিছাতে জানে। ভাবগম্ভীর ইংরেজকুলে পিটার এক বসন্ত হিল্লোল। গোমড়ামুখো অভিজাত সমাজে ছন্নছাড়া রোম্যান্টিক। রমণীরা এতেই মজে। নিজেরাও রঙ্গরসে ছলকে ওঠে,-‘হুম! সবাই তুমার মতো খ্যাপাটে হইলে ইংরেজকে আর চরিয়া খাইতে হইবে না। ইংরেজ রাজ লাটে উঠিবে। ভাগ্যিস তুমি কালেকটর কিংবা পুলিশ সুপার নহো। ইংরেজ মেমকে চোলি-ঘাগড়ায় দেখিয়া তুমি কামুক হইতে পারো, উহারা কিন্তু শীতল হইয়া পড়িবে। ক্রোধে ফুলিয়া উঠিবে। চোলি-ঘাগড়ার ভাবনা বাদ দাও। তুমি হবল আনিয়া দাও। আমরা তোমায় অধিক ভালোবাসিবো। ইংরেজ রমণী হবল দিয়া তোমারে জাদু করিবে।’
মেমরা হবলে কাবু দেখে সায়েব আর কথা বাড়ায় না। প্রসঙ্গ পালটায়। কালেকটরের রূপবতী স্ত্রীকে ইশারায় চোখ টিপে। মুখ করুণ করে বচন ঝাড়ে,-‘ভালোবাসার কথা বলিতেছো! সে আর পাই কোথা! তুমরা এই পিটারকে ভুলিয়াছো!’ সায়েব অভিনয় জানে। রমণীরা বুঝে এটা অভিনয়। তবু সে-অভিনয়ে রসিয়ে ওঠে। জটলায় মৃদু কলহাস্য জাগে। কালেকটরের স্ত্রী এই সুযোগে কিঞ্চিৎ মুখরা হয়,-‘ও! তোমার ভালোবাসার অভাব ঘটিয়াছে বুঝি! তা সে কেমন অভাব শুনি।’ পিটারের মুখে হালকা বিষাদ ঘনায়। রমণীর কৌতূহল তার মনের গভীর কন্দরে ঘাই মারে। সুদর্শন সায়েব হঠাৎ কোমল ও গম্ভীর হয়ে পড়ে। তার উপর কাব্যদেবী ভর করেন।
সায়েব এবার লঘু পায়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। সুন্দরী মেমকুল তাকে ঘিরে রেখেছে। তার আকস্মিক আচরণে ঘেরাও কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়। সায়েব চোখ মুদে শেলী’র কাব্য জপে। কমনীয় বচনে জন্ম রোম্যান্টিক এক কবিকে আওরায়,-‘ঝর্ণারা নদীতে মিশে,/নদীরা সাগরে;/স্বর্গীয় বায়ু চিরকাল মিশে থাকে/মিষ্টি আবেগে;/ভূমায় একা কেহ নহে;/বস্তুরা দিব্য আদেশে/অন্য অস্তিত্বরে আলিঙ্গনে বাঁধে-/আমি কেন থাকি না তবে তোমার অধীনে?’।
সকলে জানে পিটার ভালো কাব্য করে। কবিতা আওরানোর ক্ষণে তার চোখ দুটো কোমল হয়ে আসে। কণ্ঠে সুরঘন দ্যুতিরা চমকায়। ভালোবাসার জাদুতে তার কণ্ঠ তখন আর্দ্র ও বিষাদ-গভীর হয়। তাকে কবিতা আওরাতে দেখে সুন্দরী মেমকুলে নতুন সদস্য যোগ হয়। রমণীদের সঙ্গে পুরুষরাও জোটে। পিটার তখন নিজের মধ্যে নেই। রমণীকে তোষামোদের মধ্যে নেই। কালেকটরের রূপসী স্ত্রীকে আলিঙ্গনে পিষে মারার বন্য ক্ষুধায় আর ব্যাকুল নেই। তার মধ্যে অকালপ্রয়াত এক কবি ভালোবাসার শিহরন বিস্তার করেছে। রহস্যঘন আবেগে সায়েবের কণ্ঠ ডুবে আছে,-‘দেখো, পর্বতমালা সুউচ্চ স্বর্গকে চুমে,/শাখারা একে অন্যে আলিঙ্গনে বাঁধে;/সখাকে অবজ্ঞা করে সখীপুষ্প পায় না ক্ষমা/রবিকিরণ ভূমাকে আলিঙ্গনে বাঁধে,/আর চন্দ্রকিরণ সাগরকে চুম্বনে;-/কী-বা মূল্য বলো এসব চুম্বনে,/তারা যদি আমারে না চুমে?’
সেকালের কবি ভালোবাসায় বর্ণিল ছিল। নশ্বর দেহটি ঘিরে তার প্রণতি অবিনশ্বর রহস্যে বিলীন ও বিষাদঘন হতো। মৃত মাংসের মাঝে নবীন মাংসের স্ফিতি টের পেয়ে কবি চমকে যেতো। মৃত প্রেমিকার শরীরে নতুন প্রেমিকার উদগম ঘটছে বুঝে শিহরন জাগতো রক্তে। সেকালে কবি নশ্বরের মাঝে অবিনশ্বরের হ্রেষাধ্বনি শোনার বাসনায় উৎকর্ণ ছিল। শীতের দাপটে নিষ্প্রাণ এই জগতে বসন্তের কলরব অনুভব করে ইন্দ্রজালে ডুবে যেতো। নিরাশ কবিকে বসন্ত আশা যোগায়,-না, প্রেম এখনো মরেনি। মাংসের খিদে সত্য। মাংসের পচন মিথ্যে নয়। কিন্তু পচা মাংসে শেষ হয় না জীবনের কলরব। পচন শুষে নতুন কুঁড়ি আবার মাথা তোলে। বায়ুর হিল্লোলে তার আভাস পায় কবি,-‘The trumpet of a prophecy!/O Wind, If Winter comes, can Spring be far behind?’ শীত ঘনালে বসন্ত দেখা দেবেই। সে আর দূরে থাকে না। সে আসে শীতের পিছু-পিছু। সায়েব টের পায় তার ভিতরে বসন্ত জাগছে। এই বসন্ত কালেকটরের কামঘন স্ত্রীর জন্য নয়। সুন্দর ও সুস্বাদু মাংসে সাজানো রমণীর জন্য নয়। সায়েবের ভিতরে বসন্ত জাগিয়েছে এক নেটিভ রমণী।
একবার শুধু দুজনে সাক্ষাৎ ঘটেছে। তার দোকানে একদিন পা রাখে সেই রমণী। চপল পায়ে লঘু ছন্দ তোলে বিলেতি সামগ্রী পরখ করে। নেকাব উঠিয়ে সায়েবকে একবার দেখে নেয়। আয়ত নয়ন তুলে নেকলেসের দাম জিজ্ঞেস করে। সায়েব দেখে রমণীর মুখমণ্ডল বর্ষার ঘন মেঘে সজল। পদ্মপলাশ চক্ষু দুটি গভীর বিল। বিজলি চমকাচ্ছে ক্ষণে-ক্ষণে। রমণীর আঙুল খেজুরদানা। আর কণ্ঠে খৈনির ঘ্রাণ। সে যৎসামান্য পৃথুলা। কোমরের ভাঁজে চর্বির মৃদু আভাস গোপন নেই। তবে দেহের সুঠাম আয়তনের কারণে সেটা মানিয়ে গেছে। খৈনিকণ্ঠি রমণীর বক্ষ ও নিতম্বদেশ ভূ-বর্ষের মতো সুগম্ভীর। এতোকিছু সায়েব দেখে নেয় চোখের পলকে। রমণী তাকে কল্পতরু করে রাখে কিছুক্ষণ। সমস্ত উজাড় করে ঢেলে দিতে ইচ্ছে হয় সেই পদযুগলে।
সায়েবের সম্বরণ ফেরে খৈনি-বচনে,-‘গোরা সাহাব, আপ কাহা খো গায়ি! কুছ্ তো বলিয়ে। নেকলেস পসন্দ্ হুয়ি। আব্ বলো, কিতনা চাহিয়ে?’ সম্বিতরহিত কল্পতরু নিজেকে সুস্থির করে দাম বলে। দিনের শেষে অংক করতে গিয়ে টের পায় ভুল দাম বলেছে। কেনা দামে রমণীকে চমৎকার জুয়েলারি বেচে দিয়েছে। ব্যবসাদার সায়েবের এতে আফসোস হয় না। দাম মিটিয়ে রমণী তিল মাত্র দেরি করেনি। দ্রুত পায়ে দুয়ার ঠেলে ফিটনে উঠে। যাবার সময় সায়েবের দিকে চোখ ঠেরে উপদেশ বিলি করে,-‘তুমহারা ফেব্রিক্সকা কালেকশান বহুত্ আচ্ছি হ্যায়। মাগার ইন্ডিয়ান নেহি রাখা তুমে। কিউ? মানা হ্যায় কিয়া? হ্যারডস্ বিলেত মে হ্যায়। উস মে ইন্ডিয়া ভি মিলতা। তুম ভি রাখ সাকতে হো ইন্ডিয়ান ফেব্রিক্স। নেটিভ লোগ জরুর আয়েগি।’
সায়েবকে ঘোরে রেখে রমণী ফিটনে ওঠে। আর ফিরে না। নেটিভ-নন্দিনী তাকে দিয়ে চোলি ও ঘাগড়া কেনায়। বিলেতি স্যুট-টাইয়ের সঙ্গে কুর্তা পরায়। অথচ নিজে কেনে না। নিঠুরা রঙ্গিনী সায়েবের দোকানে উঁকি মারে না। সায়েবকে ঘায়েল করে সেই যে পালায়, আর ধরা দেয় না। তাকে সংযোগের কোনো সুযোগ রাখে না। সায়েবের জন্য রমণী-সাক্ষাতের দিনটি অভিশপ্ত প্রমাণ হবে পরে। আকস্মিক এক ঘটনায় সব তছনছ হবে। পরের কথা পরে। সায়েব এখন খৈনিকণ্ঠে আচ্ছন্ন। দিনের অর্ধেক রমণী তার মাথায় ঘোরে। ‘আপ কাহা খো গায়ি’ বাক্যটি অহর্নিশ মনে ঘাই তোলে। নিজেকে জোর করে সুস্থির রাখে সে। হিন্দি বচন সরিয়ে ইংরেজি বলে। রাতে ঘুমের মধ্যে রমণী তাকে চোখ ঠারে। আয়ত নয়ন তুলে জিজ্ঞেস করে,-‘কিতনা চাহিয়ে?’ ঘুমের ঘোরে সায়েব জবাব করে,-‘কুছ্ নেহি!’
এই ভূ-বর্ষে পা রাখার পর হিন্দি ও বাংলা বুঝতে সায়েবের গুরুতর অসুবিধে হয় না। ভাষা দুটি বোঝার অভ্যেস রপ্ত করে নিয়েছে। টুকিটাকি নিজে বলার চেষ্টা করে। হয় না, তবু চেষ্টা করে। ফাজিল ছোকরার দল রাস্তায় সায়েবের দেখা পেলে হাঁক পাড়ে,-‘হাই পিট্! কেমন আছো’। সায়েব উত্তর করে,-‘তুমরা যেমন রাখিয়াছো’। ছোকরাদের হাঁক পাড়ার অর্থ বুঝে বলে তাদের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে করে চোখ টেপে। পিট-পিট করে তাকায়। ছোকরারা হাসে,-‘আরে সায়েব, তুমি তো বাংলা শিখে গেছো!’ সায়েব আবারো চোখ টিপে,-‘এইসব তুমাদের কৃপা আর উনার ইচ্ছা!’
রঙ্গরসে সায়েব ও ছেলে-ছোকরাদের বাতচিত শেষ হয়। যে যার পথ ধরে। তবে ইদানীং ওসব রঙ্গরসের দিকে সায়েবের মন নেই। ‘কিতনা’ ও ‘কুছ নেহি’র মধ্যে খৈনিকণ্ঠি তাকে ঘুরিয়ে মারছে। রমণীর কোমর ও উদ্ধত নিতম্বের বাঁকে নিজেকে শহিদ অনুভব করে ঘন-ঘন বেসামাল হয়। কালেকটর সায়েবের নৈশভোজে যোগদান করেও রেহাই মিলছে না। চোখ মুদে শেলীতে নিমগ্ন হওয়ার ক্ষণে সায়েব টের পায় ইংরেজ রমণীর জন্য সে আর ক্ষুধার্ত হয়ে নেই। হালকা গরমের রাতে তার ভিতরে প্রেম ও বাসনার জোয়ার তুলছে এক নেটিভ রমণী!
পিট সায়েবের শেলীপাঠে মেমরা যথারীতি মুগ্ধ হয়। সুদর্শন গৈরিকের গণ্ডদেশ চুম্বনসিক্ত করার ক্ষুধা জাগে মনে। নিজেকে তারা সামলে নেয়। মৃদু করতালি ও কলহাস্যে সুদর্শন কবিকে সম্বর্ধিত করে। প্রবঞ্চনার অনুভূতি তাদেরকে কষ্ট দেয়। সুদর্শনের সঙ্গে নিজের মরদকে তুলনা করে রক্তে হাহাকার জাগে। মুদ্রা ও বাণিজ্যে কর্কশ মরদকুলের আলিঙ্গনকে অসভ্য লাগে। মেমদের কামঘন স্তন ও জঘন আচমকা আঘাতে কাঁপে। মনে হয় তাদের স্তন ও নিতম্বের খাঁজে কেউ মুদ্রা ঢালছে। পিঠে ও পাছায় রাক্ষুসে আঁচড়ের দাগ টের পেয়ে তারা শিউরে ওঠে। প্রমত্ত এক রাক্ষস চাবুকপেটা করছে মোমের মতো ত্বক। দাগ বসিয়ে দিচ্ছে বুকে-পিঠে ও পুরুষ্টু উরুদেশে। চাবুক তাদেরকে ঘরে ফিরে যেতে বলে। বিশ্বস্ত গৃহিণী ও আপন মরদের কামিনী হতে নির্দেশ করে।
রমণীরা এবার পিটারকে ছেড়ে আলগা হয়। ওয়াল্টজ্ নাচের জুটি বাঁধে। দ্রুত পায়ে গোড়ালি ঘোরায়। কালেকটরের রূপবতী স্ত্রী খণ্ড-খণ্ড জটলায় তার স্বামীকে খোঁজে। বিশ্বস্ত সেবিকারূপে স্বামীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কালেকটর সাহেবের হাতে পানপাত্র। অতিথিদের সঙ্গে গুরুগম্ভীর আলাপে ব্যস্ত। স্বামীকে আলাপে রেখে রমণী ধীর পায়ে ওয়াল্টজে ঢোকে। পরপুরুষের আলিঙ্গনে বন্য হতে ইচ্ছা করে তার।