ওসমান সমাচার পর্ব ৮ । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ জুলাই ২০১৬, ১২:৩৩ পূর্বাহ্ণ, | ২৫১৪ বার পঠিত
গিট্টুরঙ্গ : এমপি, আলেকজান্ডার ও সিন্ডি সমাচার (২)
ভরা চাঁদের রাতে মেয়র সাহেবের বাগানে ব্যংকের ম্যানেজার মুখ ভার করে বসে আছেন। তাকে দেখে জঙ্গলে যাওয়ার অনুভূতি তীব্র হচ্ছে। কিন্তু সব ইচ্ছে পূরণ হয় না। পূরণ করা যায় না। বীরাপ্পন বিদায় নেয়ার পর ম্যানেজারের মনে নির্বেদ জেগে উঠেছিল। মনে-মনে ঠিক করেছিলেন জঙ্গলে যাবেন। প্রিয় খেলাপিকে সেখানে খুঁজে নেবেন। তার মতো বানরকুলের ভাই হবেন। ভাল্লুকের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করবেন। মানুষ সেই কবে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সড়কে উঠেছে। বানরকুলের সঙ্গ ছেড়ে নতুন বসতি আবাদ করেছে। ইট-কাঠ ও কংক্রিটের জঙ্গলে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। এই জঙ্গলে বাস করতে গিয়ে ওই জঙ্গলে আর যাওয়া হয়নি। বানরকুলের সঙ্গে গাছের ডালে অথবা মাটিতে খেলাধুলা ও ঝগড়া-কলহে মেতে ওঠার দিনগুলো এখন ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’। কিন্তু ম্যানেজার সাহেবের জন্য সেটা ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’র বিষয় ছিল না। ইচ্ছা করলে তিনি ব্যতিক্রম হতে পারতেন। বীরাপ্পনের সঙ্গে টেপি বাঘ ও বানরকুলকে ধাওয়া করতে পারতেন। সেটা হয়নি। জঙ্গলে যাওয়ার পরিবর্তে চেম্বারে ফিরে গেছেন। লেঙ্গটের বদলে স্যুট-টাইয়ে নিজেকে শক্ত করে বেঁধেছেন। কাবুলি ড্রেস পরে কাবুলিওয়ালা হওয়ার শপথ পুরা করছেন। তার সামনে প্রমোশনের মূলো ঝুলছে। প্রমোশন-বিভোর ম্যানেজার সাহেব বীরাপ্পনকে ছেড়ে সিন্ডির সঙ্গে লটকে পড়েছেন!
ম্যানেজার সাহেব নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি। বীরাপ্পন তাকে ভাবুক করেছে, ফকির বা দার্শনিক করতে পারেনি। গ্রিক দেশের ভাবুকটির মতো জ্ঞানী করে তুলতে পারেনি। সম্রাট আলেকাজান্ডারের যুগ চলছে গ্রিসে। ম্যাসিডোনিয়া সে দেশের ছোট্ট এক নগর-রাজ্য। রাজ্য থেকে দিগ্বিজয়ী এক বীর ভূমিতে উঠে এসেছে। তার পায়ের তলায় রাজ্য ও রাজন্যরা লুটিয়ে পড়ছে। লোকে সেই বীরকে ‘ভিনি-ভিডি-ভিসি’ নামে ডাকে। নতুন কোনো দেশে তার আগমনের একটাই অর্থ তখন,-এলাম, দেখলাম এবং জয় করলাম। রাজ্য জয় করে ক্লান্ত বীর নিজের দেশে ফিরছে। ম্যাসিডোনিয়া যাওয়ার পথে ভাবুকের শহরটি পার হচ্ছে। সেকালে সম্রাটরা প্রচণ্ড খামখেয়ালি ছিল। আলেকজান্ডার খেয়ালি সম্রাট। এখন তার মাথায় ভাবুক দেখার খেয়াল চেপেছে। খেয়ালি সম্রাট ঘোড়া ছুটালো ভাবুক দেখবে বলে।
ভাবুকের ঘরবাড়ির ছিরিছাঁদ নেই। সাগরপারে থাকে। দিনের অর্ধেক বড়োসড়ো এক গামলায় শুয়ে-বসে পার করে। আরামসে রোদ পোহায়। দিগ্বিজয় শেষে ‘ভিনি-ভিডি-ভিসি’ ভাবুকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাবুক চোখ মুদে শুয়ে ছিল। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুলে তাকালো। সম্রাটকে দেখে তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটে না। চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,-‘তুমি কে ভাই? কী উদ্দেশ্যে এখানে আগমন?’
গামলাবুড়োর কথার ধরনে সম্রাটের সঙ্গী-সাথীর তো আক্কেলগুড়ুম। বলে কী বুড়োটা! দিগ্বিজয়ী সম্রাটকে চেনে না! ‘ভিনি-ভিডি-ভিসি’কে পরিচয় জিজ্ঞেস করে! ডানপিটে আলেকজান্ডারের বিদ্যাশিক্ষায় মতিগতি ছিল না। তবে গুরু এরিস্টোটলের পাল্লায় পড়ে ভাবুকদের স্বভাব-চরিত্র তার অজানা নেই। সম্রাট তাই মৃদু হেসে উত্তর করে,-‘আমি আলেকজান্ডার। এরিস্টোটলের শিষ্য হই বটে!’ উত্তর শুনে ভাবুকের কোনো ভাবান্তর ঘটে না। নির্বিকার মুখ করে শুধায়,-‘তো!’ প্রমত্ত সম্রাট জীবনে এরকম অস্বস্তির মধ্যে পড়েনি। এই ভাবুকটি তার গুরুর চেয়ে এককাঠি সরেস। আরো বেশি খ্যাপাটে। সম্রাট বিব্রত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে,-‘না মানে, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম আপনাকে দেখে যাই। অনেক নাম শুনেছি আপনার। আমি সম্রাট আলেকজান্ডার। বলুন আপনার কী উপকার করতে পারি?’
গামলাবুড়ো ঠোঁটকাটা স্বভাবের লোক। সম্রাটের উপর মনে-মনে বিরক্ত হয়ে উঠেছে। আহাম্মকটা সেই তখন থেকে রোদ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রতার খাতিরে বুড়ো কিছু বলেনি। এখন উপকারের কথা শুনে মওকা পাওয়া গেছে ভেবে খুশি হয়। নির্বিকার স্বরে উত্তর করে,-‘আপনি অনেকক্ষণ ধরে রোদ আটকে দাঁড়িয়ে আছেন। যদি একটু সরেন তো অধমের উপকার হয়। এরকম হালকা শীতের দিনে সাগরপারে রোদ পোহানো আমি উপভোগ করছি। আপনি সরে গেলে রোদটা উপভোগ করতে পারি। আপাতত এই উপকারটুকু করলেই যথেষ্ট।’
আলেকজান্ডার আর তিলেক দাঁড়ায় না। ভাবুক দেখার খেয়াল তার মিটে গেছে। হাতে রাজ্যের কাজ জমেছে। দেহটাও পরিশ্রান্ত। পাগলা ভাবুক নিয়ে পড়ে থাকার সময় কোথায়! উত্তম খানাপিনা ও নারীসঙ্গের টান জাগছে রক্তে। সম্রাট নিজের ঘোড়া ছুটায়। ভাবুককে গামলার মধ্যে রেখে ‘ভিনি-ভিডি-ভিসি’ ম্যাসিডোনিয়ার পথ ধরে।
আলেকজান্ডারের দীর্ঘায়ু পায়নি। পরাক্রমী শাসক সাকুল্যে তেত্রিশ বছর ধরায় বিচরণ করেছে। লোকে এখনো তাকে নিয়ে গল্প করে। তার অতুল বীরত্ব ও ঐশ্বর্যের কাহিনী শুনে রোমাঞ্চিত হয়। সম্রাটের আকস্মিক অস্তযাত্রা তাদের মনকে বিধুর করে ফেলে। নবীন শ্রোতাদের কাছে তার শেষ তিনটি ইচ্ছের গল্প শোনায়। সম্রাটের ইচ্ছেপূরণের কাহিনী শুনে শ্রোতার চোখেমুখে বিষাদ ঘনিয়ে আসে। গল্পটি সত্য অথবা মিথ্যে হতে পারে। ঠিক ও বেঠিক দুটোই হতে পারে। ইতিহাসবিদ এটা শুনে মাথা চুলকায়। পাঁজিপুঁথি খুলে সত্য-মিথ্যের হিসাব করে। আমজনতা ইতিহাসের ধার ধারে না। প্রবীণ ও নবীন শ্রোতারা ঐতিহাসিকের বচন শুনে রসিয়ে উঠে না। পাঁজিপুঁথির চেয়ে কথকঠাকুরে তারা অধিক সুখ বোধ করে। গল্পগাছার সুতো ছুঁয়ে নিজের পরিণামকে পড়ার চেষ্টা করে।
মহাবীর আলেকজান্ডোরের অস্ত যাবার দিন থেকে কথকঠাকুরের গল্পটি শুরু হয়। বেগতিক জ্বরের ঘোরে প্রমত্ত সমরনায়ক নিজের মধ্যে নেই। চিকিৎসকের নিদান সত্য হলে একটু পরে চিরঘুমের দেশে মাথা এলিয়ে দেবে। শোকস্তব্ধ মুখে প্রিয়জনরা শিয়রে বসে আছে। তাদের পেছনে মৃত্যুর দেবতা অকম্পিত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। জ্বরের ঘোরে সম্রাট প্রিয়জনের দিকে চোখ মেলে তাকায়। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। জ্বরতপ্ত কণ্ঠে সমরনায়ক নিজেকে শেষবার ঘোষণা করে,-‘শোন তোমরা, আমার হাতে সময় বেশি নেই। মৃত্যুর দেবতা শিয়রে দাঁড়িয়ে ক্ষণ গুনছে। একটু পরে সময় শেষ হবে। তোমাদের সঙ্গে এটা আমার শেষ সাক্ষাৎ। আমরা অনেকদিন একসাথে ছিলাম। সুখেদুখে নিবিড় থেকেছি। এবার বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় হয়েছে। আমি চলে যাবার পর তিনটি কাজ তোমরা আমার হয়ে করো। মৃত্যুর আগে এটাই আমার শেষ আদেশ। দেখো এর যেন অন্যথা না হয়।’
টানা কথা বলার ধকলে প্রমত্ত বীরবাহু হাঁপাচ্ছে। মৃত্যুর দেবতা জ্বরের ঘোর তীব্র করে এনেছে। সে তার দায়িত্ব পালনে একনিষ্ঠ। তরুণ সম্রাটের কথা বলতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। তবু কণ্ঠস্বর বজায় রাখে সে,-‘শোন, তোমরা কেউ আমার মরদেহ বহন করো না। আমি চাই রাজ্যের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকরা ওটা বহন করুক। রাজ্য-সেরা চিকিৎসকদল আমার শবযাত্রার ভারবাহী হবে। তারা আমায় বহন করে নিয়ে যাবার সময় সম্রাটের এ-যাবত অর্জিত সম্পদ রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিও। হীরে-মণি-মরকত কিচ্ছু রাখার প্রয়োজন নেই। সব রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিও। যার ইচ্ছে কুড়িয়ে নিতে পারে। আর, কফিনে শোয়ানোর পর আমার হাত দুটি যেন বাইরে ঝুলে থাকে। এই তিনটি কাজ আমি তোমাদের দিয়ে যাচ্ছি। দায়িত্ব মনে করো কাজগুলো করো। মনে রেখো, এটা আমার শেষ আদেশ। অতুল সম্রাটের শেষ ইচ্ছা! দয়া করে এতে বিঘ্ন ঘটিও না। তোমাদের কাছে এই হচ্ছে শেষ অনুরোধ।’
সম্রাট চিরকালের খেয়ালি। হত্যায় ও সম্ভোগে খেয়ালি। গুরুর সঙ্গে আচরণে খেয়ালি। অস্ত যাবার দিনেও খেয়ালি। তার অশ্ব একদিন এই ভূ-বর্ষে পা রেখেছিল। অঢেল সবুজের ছটা দিগ্বিজয়ীর চোখে ঘোর তৈরি করায়। জনপদের বৈচিত্র্য তাকে স্তব্ধ করে রাখে। সেনাপতিকে রণসজ্জার হুংকার দিতে দেখে ঘোর কাটে। তার কাঁধে হাত রেখে সম্রাট খেয়ালি হয়। কণ্ঠে বিস্ময় ফুটে বেরোয়,-‘ওহে সেলকুস্, বড়ো বিচিত্র এই দেশ!’ খেয়ালি সম্রাট তার অশ্বখুরের দাপটে ভূ-বর্ষের একাংশ জয় করে ফেলে। সে অবগাহন করে বিপাশায়। রমণীর কাজলকালো ভুরু তার চোখে নেশা ধরায়। কোমরের পাহাড়ি বাঁকে যৌবনের উত্তাল জোয়ার দেখে শিহরিত হয়। তাকে জয় করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
বিপাশা বড়ো ছলনাময়ী। হিমালয়ের ভাঁজে এঁকেবেঁকে চলে। এই সে চঞ্চলা। পর মুহূর্তে মেঘের মতো গম্ভীরা। রমণীর বিচিত্র সব বাঁকে দিগ্বিজয়ী ধোঁকা খায়। বিপাশাকে জয় করার জেদ চাপে মনে। অশ্ব ছোটায় রমণীর বিচিত্র বাঁকে ও ভাঁজে। পুরুষ বীরবাহু হলে রমণীরা হার না মেনে উপায় থাকে না। দিগ্বিজয়ীর অতুল বীরত্বের কাছে বিপাশা হার মানে। রমণীর ভাঁজে অবগাহন করে মহাবীর নিজের তৃষ্ণা মেটায়। সম্রাট বরাবরের খেয়ালি। হিমালয়কন্যার সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশিদিন টিকে না। এবার সাগর তাকে ডাকে। পারস্য ও ব্যাবিলন হাতছানি দেয়। দেশের মাটি দূর থেকে ইশারা করে। বিপাশার কাজলকালো ভুরুর মায়া ছেড়ে প্রমত্ত বীর অকস্মাৎ বেরিয়ে পড়ে। দেশের পানে ঘোড়া ছোটায়।
দিগ্বিজয়ীরা রমণীতে বেশি দিন আচ্ছন্ন থাকে না। তারা বীরত্বের পূজারী। ‘জয়ী’ হতে ভালোবাসে। এক রমণীকে ‘জয়’ করে নতুন রমণীর পানে ছোটে। তারা যাযাবর। কোথাও একদণ্ড স্থির থাকে না। বিপাশা ছেড়ে প্রমত্ত দিবাকর এখন ব্যাবিলনে পৌঁছে গেছে। বীরত্বের দুঃসহ চাপে তার দিন ফুরিয়ে আসছে। একটু পরে নিরুদ্দেশে অস্ত যাবে। অস্ত যাবার ক্ষণে কণ্ঠে হেঁয়ালি ভর করেছে। প্রিয়জনরা সম্রাটের সেই হেঁয়ালির একবর্ণ বুঝতে পারে না!
প্রিয়জনরা হতচকিত। খেয়ালি সম্রাটের হেঁয়ালি বুঝতে অক্ষম। সম্রাট সেটা টের পেয়েছে। জ্বরতপ্ত দেহে হেঁয়ালি ভাঙার উদ্যোগ করে। ধীরলয়ে নিজেকে বিস্তারিত করে,-‘হে আমার নিকটজন, আমি জানি আমার কথায় তোমরা আশ্চর্য হচ্ছো। সম্রাটের ইচ্ছেগুলোকে প্রহেলিকা বলে ভাবছো। ধাঁধার মতো লাগছে সবকিছু! কিন্তু না, কোনো ধাঁধা আমি করছি না। এই প্রথম হেঁয়ালি করে কথা বলার প্রয়োজন দেখছি না। আমার আদেশগুলো দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ। চিকিৎসকের কথা কেন বলছি জানো? আমি চাই শহরের লোকে দেখুক জগৎ-মাতানো সমরনায়কের সঙ্গে জগৎ-সেরা চিকিৎসকরা রয়েছে, তবু সমরনায়ককে সারিয়ে তুলতে তারা অক্ষম। মৃত্যু যখন আসে চিকিৎসা বিকল হয়ে পড়ে! চিকিৎসকের টোটকায় জীবন ফিরে না।
ধন-সম্পদ রাস্তায় ছড়িয়ে দিতে বলেছি। কারণ, আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে এসবের প্রয়োজন পড়বে না। অস্ত যাবার সময় সম্পদ ফেলে যেতে হয়, এটা হলো জগতের বিধান। এবং হ্যাঁ, কফিনের বাইরে হাত দুটো ঝুলিয়ে রাখা, তোমাদের প্রতি এটা আমার শেষ ইশারা। প্রথম দুটি যদি বুঝো এই ইশারা নিজেরাই বুঝতে পারবে। মনে রেখো, ‘আমি ভূমিষ্ট হয়েছি ম্যাসিডোনিয়ায়,-ন্যাংটা ও খালি হাতে। এখন আমি চলে যাচ্ছি অজানায়,-ন্যাংটা ও খালি হাতে। আমার জন্য তোমরা কেউ শোক করো না!’
চোখে মরণ ঘনিয়ে আসার পরে বিটকেল গামলাবুড়োকে সম্রাটের মনে পড়েছে। রাজ্য ও অতুল ঐশ্বর্য রেখে অস্তাচলে গমনের দিনে বুড়োর কথা তার মনে পড়েছে। মরণে শির ঝুঁকানোর দিনে মহাবীর বুঝতে পারছে গামলায় শুয়ে রোদ পোহানো কেন এতো সুখের ছিল! নিকষ অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার ক্ষণে পরাক্রমী সূর্য বুঝতে পেরেছে জগতের দিকে নির্বিকার থাকাই ভালো ছিল। আলেকজান্ডার বুঝেছে জ্ঞান পূর্ণ হয় জ্ঞানের বিসর্জনে। বিত্ত-বৈভবের সুখ মেলে সেটা ত্যাগ করতে পারলে। সে বুঝতে পেরেছে, আমরা কিছু সঙ্গে নিয়ে আসি না। চলার পথে যা-কিছু জড়ো করি অস্ত যাওয়ার ক্ষণে সব ছেড়ে যেতে হয়। এটা নিয়তি। ইন্দ্রজাল বিধান জারি করেছেন,-‘কুছ্ নেহি যায়েগা তুমহারি সাথ্। তুম আয়ে হো একেলা। তুমকো জানা ভি পড়েগা একেলা।’
বীরাপ্পনকে বিদায় বলার পর ম্যানেজার সাহেব ‘আসা-যাওয়ার’ নিয়মটি নিয়ে ভাবনা করলেও সেটা রপ্ত করতে পারেননি। ডাকুর একটি ফটো শুধু শোবার ঘরে বাঁধিয়ে রেখেছেন। প্রমত্ত সেই ডাকুর ফটো মাঝেমধ্যে তাকে উদাস করে তোলে। বীরাপ্পন এসে রক্তে ভর করে। গভীর জঙ্গলে বানরকুলের সাথে তাকে খেলা করতে দেখেন। ভাল্লুকের সাথে কুস্তি কিংবা টেপি বাঘের পেছনে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখেন। বীরাপ্পনকে অজগর বাগে পেয়ে চেপে ধরে। প্রমত্ত ডাকু সেই শক্ত বাঁধনে হা হা করে হাসে। সরীসৃপ তার বাঁধন আলগা করে। ম্যানেজার সাহেব বুঝতে পারেন ডাকুটিকে ভক্ষণের উদ্দেশ্য অজগরের একদম নেই। এটা নিছক খেলা। টারজান যেমন শিম্পাঞ্জী ও সিংহের সাথে খেলে, বীরাপ্পন ও অজগর পরস্পরের সঙ্গে খেলা করে।
ম্যানেজার সাহেবের কাছে বীরাপ্পন হচ্ছে এ যুগের টারজান। কারণ সে সামনে না গিয়ে পেছনে ফিরেছে। বিলীনপ্রায় অরণ্যে নিজের অস্তিত্ব মিশিয়ে দিতে পেরেছে। ভবিষ্যতে সুযোগটি থাকবে না। এই অনুভব ম্যানেজার সাহেবকে মাঝেমধ্যে বিকল করে ফেলে। সিন্ডি ও প্রমোশন তখন অর্থহীন লাগে। কিন্তু পরক্ষণে তাকে সেলফোনে ফেরত যেতে হয়। বড়ো কর্তা নতুন প্রপোজাল নিয়ে কথা বলতে চাইছেন। ম্যানেজার সাহেব আবার প্রপোজালের অরণ্যে হারিয়ে যান। তার নিম্নচাপ অব্যাহত থাকে। বহুমূত্রের আশংকায় চিতল মাছের মশলাদার কোফতা হিসেব করে প্লেটে তোলেন। জঙ্গলে যাওয়ার সময় তার হয় না। জংলী ফল ভক্ষণে রুচি জাগে না।
বীরাপ্পন বিদায় নেবার পর ম্যানেজার সাহেবের জীবনে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। ডাকুটি তাকে ভালোবাসার অর্থ শিখিয়ে গেছে। স্ত্রীর কথায় আগের মতো খেঁক করে উঠেন না। সরলা রমণীর সঙ্গে স্নেহের স্বরে কথা বলেন। ওটা হয়তো ভালোবাসা নয়। প্রেমিকরা স্নেহ দিয়ে কথা বলে না। প্রেমের অন্য এক ভাষা রয়েছে। প্রেমিকের হৃদয়ে ভালোবাসার পৃথক ইঙ্গিত ও বাচনভঙ্গি রয়েছে। ম্যানেজার সাহেবের কাছে সেটি আশা করা অন্যায়। খেলাপির পেছনে অষ্টপ্রহর দৌড়ঝাঁপ শেষে তার পক্ষে প্রেমিকের বাচনভঙ্গি রপ্ত করা মুশকিল। স্ত্রীকে দেখে খেঁক করে উঠছেন না, উলটো স্নেহমেদুর স্বরে কথা বলছেন,-তার স্ত্রীর জন্য এটাই অনেক। স্বামীর আচরণে সে সন্তুষ্ট। সরলা রমণীর উদ্বেগ খানিক কমেছে। তবে দিনশেষে এই সত্য লুকানোর উপায় নেই যে ম্যানেজার সাহেব পারেননি। তিনি ‘না’ বলতে গিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে ফেলেছেন। আরো বেশি সিন্ডিময় হয়ে উঠছেন।
সিন্ডি এক চৌকস পুরুষ। চপলা টেলারের হ্যান্ডসাম মানবফুল। সুদর্শন মানবফুলের সাথে দিন গুজরান করতে গিয়ে ম্যানেজার সাহেব খানিক সমকামভাবী হয়ে পড়েছেন। স্ত্রীর প্রতি স্নেহমেদুর হলেও রমণীসঙ্গ তাকে আর বিচলিত করে না। অন্য অনেক ম্যানেজারের মতো রমণীরা তাকে উতলা করে না। তিনি পুরুষভাবিক হয়ে সুখ পাচ্ছেন। তার ভাবুক মন কোনো রানির চাইতে রাজার দিকে অধিক সুখে ধাইছে। তার কাছে বীরাপ্পন এক আনসাং হিরো, আর সিন্ডি হলো সেলিব্রেটি।
বীরাপ্পন বন্য ও দুর্বিনীত। অসংস্কৃত ডাকুটি পরাজয়ে ডরে না। তার কাছে ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য/চিত্ত ভাবনাহীন’। বীরাপ্পন পরাভব মানে না। কারো কাছে পরাভূত হতে জানে না। অন্যদিকে সিন্ডি হলো মার্জিত। হিসেবি ও কেতাবি। চৌকস স্বরে কথা বলে। রমণী-ব্যাকুল ভঙ্গিতে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে। সুদর্শন এই মানবফুলের অন্তর্বাসের নিচে ঠাণ্ডা এক খুনি শুয়ে থাকে। সিন্ডি তাকে সোহাগ করে খাম্বু বলে ডাকে। সময় হলে খাম্বু গুহা থেকে বেরিয়ে আসে। শহরের আলো-বাতাসে নিজেকে উষ্ণ ও প্রমত্ত করে। নিজেকে সে শহরে উত্থিত করে। উত্থানের দিনে খাম্বুর প্রবল চাপ নিজের দেহের লাজুক ডেরায় সকলে টের পায়। পোশাকে ঢাকা গোপন গুহায় ওটা প্রবল হতে চলেছে। আমাদের পোশাক খসে পড়ে। গুহা আর গুহ্য থাকে না। আমরা টের পাই,-ওটা ঢুকছে! প্রবল চাপে খাম্বু গুহায় ঢুকছে। জুয়ার বাজারে গেলে চাপটি আরো প্রকট হয়। সিন্ডি আমাদের জুয়াড়ি করে তোলে। টাকশালের দিকে বিমোহিত করে। বাজির দান ফেলে ডাকসাইটে হওয়ার নেশা হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে। আমরা দলে-দলে জুয়ার আসরে ছুটি।
দরবেশবাবার শহরে জুয়াখেলার চল নেই, কখনো ছিল না। কিছু লোক অবশ্য লুকিয়ে-চুরিয়ে খেলেছে। এখনো খেলে। কিন্তু প্রকাশ্যে খেলতে সাহস করেনি। এই শহরে অনেক কিছু ‘নেই’র মাঝে জুয়া হলো একটি। সিন্ডি কিন্তু চৌকস পুরুষ। অসম্ভবকে সম্ভব করা তার কাজ। ‘নেই’কে ‘আছে’ করে তোলা স্বভাব। সে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। কানের মধ্যে গুনগুন করে মন্ত্র পড়েছে,-‘আরে ভাই, জুয়া নেই তো কী হয়েছে! ক্যাসিনো নেই দেখে কান্না করার কী আছে। জুয়া অনেকভাবে হয়। জুয়া অনেকভাবে খেলা যায়। মানুষের জীবনের কথা ভাবো। ওটা জুয়া ছাড়া কিছু নয়। জীবনজুয়ার আসরে আমরা বাজি ধরি। বাজিতে দান তুলি। জিতি কিংবা হারি। এভাবে যদি চিন্তা করো তবে একটা ক্যাসিনো না-থাকলে কিচ্ছু যায় আসে না। জুয়া অন্যভাবে খেলা যায়। খেলাটিকে শুধু চিনে নিলেই হলো। ব্যাস জুয়ার সুখ নিতে আর কোনো বাধা থাকে না।’
সিন্ডির কানমন্ত্রে আমরা মাথা চুলকাই। তার কথাগুলো মগজে ঢোকে না। ইশারাটি বোধগম্য হয় না। আমাদের বোকা মুখ দেখে সুদর্শন মানবফুল মুচকি হাসে। হাঁটুর উপর হাঁটু তুলে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে। ম্যানেজার সাহেব লাইটার এগিয়ে দেন। ধোঁয়ার শলাকা ফস করে জ্বলে ওঠে। আমরা এখন শহরের চপলা টেলার হয়েছি। সিন্ডির সিগারেট টানার কায়দায় বিমোহিত বোধ করছি। তার প্রতি মনে প্রেম জেগেছে।
সিন্ডি সিগারেটে ধোঁয়ার রিং তোলে। মুচকি হেসে আমাদের কানে মন্ত্র জপে,-‘কুছ্ পারোয়া নেহি। আরে ভাই, ক্যাসিনোর বাপ আছে এই শহরে। ফাটকার বাজার আছে এখানে। বাপ-দাদার আমল থেকে আছে। দরবেশবাবার নাকের ডগায় ওটা রয়েছে। তোমরা সেখানে যাও। দেখবে রুলেটের বদলে কি-বোর্ড ঘুরছে। মনিটর স্ক্রিনে কোম্পানির শেয়ার ভাসছে। দর বুঝে কেনাবেচা করো। দরের ওঠানামা বুঝে বাজি ধরো। বাজারে টাকা উড়ছে। আরে ভাই, জীবনে চান্স নিতে শেখো। বাজির দান তুলতে শেখো। যদি ধরতে পারো এক দানে লাল হয়ে যাবে। সিন্ডিকে তখন ভুলে যেও না। মনে রেখো বাজির খেলা সিন্ডি তোমাদের শেখালো!’
সিন্ডির কানপড়ায় আমাদের চোখে নেশা ঘনায়। সিন্ডি-বচনে মন্ত্রী ও মেয়র সাহেবের মনে ঘোর লাগে। আমরা বুঝতে পারি ওটা ঢুকছে। দুজনের লাজুক ডেরায় সে ঢুকে পড়েছে। খাম্বুর জাদুকরি চাপে তারা এখন নেশাতুর! সিন্ডির প্রমত্ত খাম্বু আমাদের লাজুক গুহায় দুর্বার বেগে হানা দেয়। প্রমত্ত সেই খাম্বুচাপে আমরা স্থান-কাল-পাত্র ভুলি। বাজির নেশায় নিজের নাম অব্দি ভুলে যাই। সকালে মৃদু খাম্বুচাপে ঘুম ভাঙে। দুপুর গড়ালে চাপের শিহরন মাত্রা ছাড়ায়। আমরা প্রবল হয়ে উঠি। পাগলের মতো কি-বোর্ড ঘুরিয়ে বাজি ধরি। হল্লা ও বেচাকেনায় নিজেকে সরগরম রাখি। রাতে ঘরে ফিরে ক্যালকুলেটারে খুটখাট আওয়াজ করি। লাভের অংক দেখে মুখে হাসি ফোটে। বউকে টকাস করে চুমু খেয়ে বলি,-‘এই জানো, বাজিতে আজ বড়ো দাও মেরেছি। এবার নিশ্চয় বাড়ি উঠবে। এতোদিনে তোমার শখ পূরণ হবে!’
বউ রাঙামুখে বিধুর হয়,-‘বাড়ি! এই, আর কী কী হবে গো! বলো না।’ আমরা আঙুল দিয়ে ক্যালকুলেটারে খুটখুট করি,-‘হুঃ! হবে, সব হবে! আরো কয়েকটা বাজি জিততে দাও না। দেখবে সব অটোমেটিক হয়ে গেছে!’ আমাদের অটোমেটিক আশ্বাস পেয়ে ঘরের বউ অটোমেটিক স্বপ্নে ভাসে,-‘আচ্ছা একটা গাড়ি হলে ভালো হয় না? বাবুটা রোজ রিকশার আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়ে স্কুল করে। ওর জন্য একটা গাড়ি কিনলে ভালো হতো!’ আমরা মুচকি হাসি। পুরুষের প্রবল আত্মবিশ্বাসে সিন্ডি হয়ে উঠি। তার মতো হাঁটুর উপর হাঁটু তুলে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করি। বউকে বলি,-‘লাইটার দাও তো। বউকে ম্যানেজার ভেবে মুখটা সামনে বাড়িয়ে ধরি। মনে ইচ্ছা রমণী লাইটার জ্বালিয়ে আমাদের ঠোঁটে অগ্নিসংযোগ করুক। এতে আমরা সিন্ডির মতো নিজেকে সুদর্শন ভাবতে পারবো। শহরে সিন্ডি এখন হিরো। হোম ম্যানেজারের দিকে মুখ বাড়িয়ে আমরা সিন্ডি হওয়ার স্বপ্ন দেখি।
ঘরের বউ অনেককিছু ম্যানেজ করে। তবু সে কখনো ম্যানেজার হয় না। অগ্নিসংযোগের পরিবর্তে ‘ছাইপাশ কী যে খাও!’ বলে লাইটার ছুঁড়ে মারে। কী আর করা! আমরা নিজে লাইটারে চাপ দেই। ফস করে আগুন জ্বালাই। বউয়ের গালে আস্তে টোকা মারি। রমণী সোহাগে গলে পড়ে। তার চোখে এখন স্বেচ্ছা-রমণের সম্মতি। অন্যদিনের মতো জোরাজুরির দরকার হবে না আজ রাতে। চাইলে কিছু দিতে বাকি রাখবে না। বউ হাত ধরে বিছানায় টানে,-‘এই আসো না। একটু বাড়ি-গাড়ি খেলি।’ আমরা মৃদু হেসে বউকে পাশ কাটাই। গভীর রাতে আমাদের লাজুক গুহায় সিন্ডির খাম্বুচাপ টের পাচ্ছি। বউকে নিরস্ত করি চুম্বনে,-‘আজ বাদ দাও না ডার্লিং! সারাদিন খাটনি গেছে। বড্ডো টায়ার্ড! বাজি শেষ হোক। এরপর চুটিয়ে হবে।’
বউ অভিমানী মুখে সরে যায়,-‘যাও বাজি খেলে-খেলে তুমি রোবট হয়ে গেছো। দেখো শেষমেষ বউকে না জুয়ার বাজারে বাজি ধরে বসো! পুরুষ লোককে বিশ্বাস নেই। তোমাদের আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি। সবক’টা মিনিমিনে শয়তান!’ বউয়ের বকুনি আমরা উপভোগ করি। তাকে অভিমানী রেখে পাশের ঘরে সরে পড়ার ধান্ধা খুঁজি। এই মুহূর্তে একটু আড়াল প্রয়োজন। খাম্বুচাপ ক্রমে প্রবল হচ্ছে। সুতরাং আড়াল প্রয়োজন। বউকে অদৃশ্য খাম্বুচাপের কথা কী করে বলি! এটা বলা সম্ভব নয়। সিন্ডির সঙ্গে পরকীয়া বউয়ের সহ্য হবে না। কুরুক্ষেত্র লাগবে ঘরে। সমকামভাবী বরকে রমণীরা কদাপি মেনে নিতে পারবে না। মনে-মনে সিন্ডির উপর অসন্তুষ্ট হই। বেটার কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু নেই। হাউজ এখন বন্ধ। রাত-গভীরে চাপ দেওয়ার কি দরকার তোর! নির্লজ্জ একটা!
বাজিখেলার নিয়মে শুরুতে আমরা লাভের অংকে ফুলেফেঁপে উঠি। কিন্তু ছক অচিরে পালটায়। আমরা বাজি হারতে শুরু করি। যতো হারি ততো মনে জেদ চাপে। পাগলের মতো কি-বোর্ডে দান তুলি। আমাদের হিসেব-নিকেশে গণ্ডগোল বাঁধে। বাজির দানের সঙ্গে বাজির অনুমান ভুল অংক করে। সকলে বাজি খেলে সর্বস্বান্ত হই। আমরা আর বাড়ি তুলতে পারি না। বাবুকে গাড়িতে করে স্কুলে পৌঁছে দিতে পারি না। বাবু এখন ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে স্কুল করে। বাবুর মা থমথমে মুখ করে থাকে। আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না লুকায়। আমরা আর আগের মতো উচ্ছ্বল হতে পারি না। সুপার-মানব বাবুটা ‘তবে রে রাক্ষস…’ বলে আমাদের তেড়ে মারতে আসে না। সে বুঝে গেছে বাবা একটা খারাপ লোক। তার কারণে পরিবারে দুর্দিন ঘনিয়েছে। পারিবারিক খুনসুটি বিষাদে ঢেকে গেছে। সে এখন বাবার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না।
আমরা অনুতাপ করি। দরবেশবাবার কথা মনে হয়। তাকে স্মরণ করে কাঁদি। তার মাজারে যাই। পুকুরঘাটে গজার মাছের নিশ্চিন্ত ছুটোছুটি দেখি। ইমাম সাহেব আমাদের ডেকে তিরস্কার করেন:-
‘আস্তাগফিরুল্লা! আফনারা মানুষ না ইবলিশ! আইজ বাদে কাইল গাতো গিয়া ঢুকবা। মুনকিন-নাকিরে জিগাইলে কী জওয়াব দিবা হেই চিন্তা নাই। জুয়ার বাজারে বড়োলোক অওয়ার খোয়াব দেখা শুরু করছইন। জুয়া খেলে ইবলিশে। আফনারা ইবলিশের ফান্দো ধরা দিলা! অই সিন্ডি একটা ইবলিশ। জলদি তওবা করইন। আল্লার কাছে মাফ চাইন। আর ইবলিশরে ঝাঁটা মারি বিদায় করইন শহর থাকি।’
ইমাম সাহেবের তিরস্কারে আমাদের মনের দুঃখ ঘোচে না। তওবা পড়ে মুমিন হওয়ার হিম্মত জাগে না ভিতরে। পাথরের মতো ভারী পা টেনে দরবেশবাবার মাজার থেকে সকলে বেরিয়ে আসি।
আমরা এখন শোকাহত। আমাদের মস্তিষ্ক বোধশূন্য। বাজির ঘোরপ্যাঁচ বুঝতে সে অক্ষম। মন্ত্রী ও মেয়র সাহেবের অবস্থা ভিন্ন নয়। বাজিখেলার গোলমেলে স্বভাবটি দুজনে ধরতে পারেননি। মন্ত্রী সাহেব রুদ্ধবাক হয়ে পড়েছেন। সিন্ডির খাম্বুচাপে শখ করে জুয়ায় ঢুকেছিলেন। এখন কৌপিণ পরে শরম ঢাকছেন। তাকে দেখে আমাদের মায়া হয়। বেচারা! ‘কী দিয়ে কী হয়ে গেলো’ সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। আমরা পাথর-পায়ে মিশনের মন্দিরটি অতিক্রম করি। পেছন থেকে পূর্ণেন্দু বাবু আমাদের ডাক দেন। সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ বিরসমুখে উপদেশ শুরু করে:-
‘জুয়া বড়ো সর্বনাশা। যুধিষ্ঠিরের লাখান ধার্মিক ও সত্যবাদি মানুষ বাজির নেশায় সর্বস্বান্ত অইছইন। পাণ্ডবকুলের নাম ডুবাইছইন। ভাই ও বউ নিয়া রাজ্য থাকি তারে নির্বাসিত অইতে অইছে। শকুনির কূটচালে তার মাথা নষ্ট অইলো। নিজের বউরে যুধিষ্ঠিরে বাজি ধরলা। ভরা সভায় সাধ্বি রমণীরে কুরুপক্ষ অফমানের একশেষ করি ছাড়লো। দ্রৌপদীর শাড়ি ধরি তারা টান দিলো। ঘটনা কিতা? বাজি হারার কারণে দ্রৌপদী আর পাণ্ডবদের কেউ নায়। কুরুপক্ষ তারে নিয়া যা-খুশি করতে পারে। ভগবান কৃষ্ণ রমণীর সহায় অইলা। মধুসূদন নিজে আবরু অইয়া দ্রৌপদীর মান রক্ষা করছইন।
সিন্ডি এই শহরে শকুনি অইয়া আইছে। ভগবানরে ডাক দিবার আগে আফনাদের কাপড় খুলি দিছে। কলির যুগে ভগবানরে পাওয়া মুশকিল। ভক্তির জোর কমি গেছে। ভগবানরে ডাক দিলে হুনইন না। আগের লাখান সাড়া দেইন না। দিবা কিলান, আফনারা কেউ ভগবানের মাঝে নাই। আছইন সিন্ডি আর শর্টকাটে। ভালামানুষ বাদ দিয়া বাটপারের লগে আফনাদের দোস্তি। দেখিয়া ভিতরে কষ্ট পাই।
এখন অতো কাপড় আমি কই পাই! আমি বামুন বেটার কী আর খ্যামতা। ভক্তির জোর নাই। ভগবানরে ডাকলে সহায় অইবা হেই ভরসা নাই। আফনারা আমার প্রতিবেশী লাগইন। ভাই-বন্ধু লাগইন। হারা জীবন আবরু বজায় রাখি চলছইন। আখতা এই শকুনির পাল্লাত্ কেনে পড়লা বুঝলাম না। এখন অতো কাপড় আমি পাই কই। ভগবান! তুমি সহায় অও। রক্ষা করো আমরারে।’
পূর্ণেন্দু বাবুর কথায় খেয়াল হয় আমরা এখনো নগ্ন। চৌকস এক পুরুষের কাছে ধর্ষিত। ভগবান-ভক্ত বামুনের সোজাসাপটা কথায় লজ্জিত মুখ করে দ্রুত পথ হাঁটি।
সিন্ডির হাতে নগ্ন হওয়ার পর আমরা বুঝতে পারি আমাদের গুহ্য আর স্বাভাবিক নেই। বিরতিহীন খাম্বুচাপে ওটা গুরুতর জখম হয়েছে। আমরা প্রবল ব্যথায় কাতরাই। দলে-দলে হাসপাতালে ছুটি। সার্জন সাহেব আমাদের দেখে খেপে উঠেন:-
‘আফনারা ক্রিমিনাল। সিন্ডি ঢুকতে চাইছে, আর আফনারা বলদের লাখান তারে ঢুকতে দিলা। এখন আমার কাছে কেনে আইছন। নিজের গুহ্য নিজে ঠিক করইন। দুর অইন আমার সামনে থাকি। যাইন্!’
ম্যানেজার সাহেবের সিন্ডি হচ্ছে এই! মানুষকে খুন করার সময় শোভনতা হারায় না। শিকারকে সহজ অভ্যাসে ব্যবহার করে। সময় হলে ছিবড়ে বানিয়ে ছুঁড়ে ফেলে। ছুঁড়ে ফেলার পর হাঁটুর উপর হাঁটু তুলতে ভোলে না। সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করতে এক সেকেন্ড দেরি করে না। সর্বনাশী এই শোভনতা হচ্ছে তার মারণাস্ত্র। সেই মারণাস্ত্র কতোটা অশ্লীল হতে পারে সেটা আমরা টের পেয়েছি বাজি খেলে। নিজের কাণ্ডজ্ঞানকে জুয়ার বাজারে কবর দিয়ে। তবে ম্যানেজার সাহেবের কাণ্ডজ্ঞান এখনো ফেরেনি। বীরাপ্পনকে ভুলে সিন্ডির সঙ্গে চেম্বারে লটকে আছেন। সিন্ডি তাকে কাবুলিওয়ালার ট্রেনিং দিচ্ছে। প্রমোশন আদায় করার কায়দা শেখাচ্ছে। কায়দাটি রপ্ত করে ম্যানেজার সাহেব উপরে উঠছেন। বড়ো কর্তা হলেও হতে পারেন। তার প্রস্তুতি এই কাবুলি ড্রেস। আফগানদের প্রিয় পোশাক। গজগামিনী রাতে কাবুলি পরেছেন। মেয়র সাহেবের বাগানে মুখ ভার করে বসে আছেন। তার গুহ্যদেশ সিন্ডির ঘোরপ্যাঁচে মগ্ন। মুখ ভার দাসত্বকে ‘না’ বলতে পারার অচেনা বিষাদে। এই দ্বৈততার কাছে রাক্ষস ওসমানের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। মেয়র সাহেবের বাগানে ওসমানের উপস্থিতি সম্পর্কে ম্যানেজার সাহেব এখনো উদাসীন!
(ক্রমশ)
সূত্রকাহন
এই কাহিনীতে ব্যবহৃত চিত্রকর্মগুলো অন্তর্জাল সূত্রে প্রাপ্ত। গামলাবুড়ো সিনিক দার্শনিক ডায়োজিনিস-এর চিত্রকর্মটি জাঁ লিও জেরোম ১৮৬০ সনে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। আলেকজান্ডারের সঙ্গে ডায়োজিনিসের সাক্ষাতের মুহূর্তটি ফরাসি চিত্রকর নিকোলাস আন্দ্রে’র আঁকা। ইঙ্গিত ও রঙের ব্যবহারে চমৎকার এই ছবিটি খুব সম্ভব ১৮১৮ সনে আঁকা শেষ হয়েছিল। প্রমত্ত দিবাকরের অস্ত যাবার ক্ষণটি সাদা-কালোর আবহে চিত্রায়িত করেন কার্ল ভন পিলোতি। জার্মান দেশী এই চিত্রকর ঐতিহাসিক চিত্রকর্মে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। আলেকজান্ডারের প্রয়াণ মুহূর্তগুলো নিয়ে আঁকা তার চিত্রকর্ম অব্যশ্য সমাপ্ত হতে পারেনি। ইতালিয় চিত্রকর ডোমেনিকো ইনডোনো’র ছবিটি দেখে মনে হবে চিকিৎসক আলেকজান্ডারকে দাওয়াই বাতলে দিচ্ছেন এবং সম্রাট মনোযোগ সহকারে তা শুনছেন। তাকে বেশ সুস্থ দেখাচ্ছে এখানে, যদিও সম্রাটের মনের ভিতরে অন্য সংলাপ চলছে তখন। প্রমত্ত দিবাকর বুঝে গেছে এবার ‘যাবার সময় হলো বিহঙ্গের’। ন্যাংটা ও হালি হাতে এসেছিলেন, এবার ফিরতে হচ্ছে অজানায়,- সেই ন্যাংটা ও খালি হাতে।