ওসমান সমাচার পর্ব ৭ । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : 16 July 2016, 9:32 am, | ২৫২৯ বার পঠিত

গিট্টুরঙ্গ : এমপি, আলেকজান্ডার ও সিন্ডি সমাচার (১)
ম্যানেজার সাহেব ‘না’ বলতে পারেননি। উলটো মেয়র সাহেবের বাগানে মুখ ভার করে বসে আছেন। গজগামিনী রাতে কাবুলি ড্রেস পড়েছেন। তার এই পোশাকটা উদ্দেশ্যমূলক। তিনি এখন বীরাপ্পনের চেয়ে বড়ো ডাকুর পাল্লায় পড়েছেন। লোকে এই ডাকুকে সিন্ডিকেট বলে জানে। অফিসের কলিগরা আদর করে সিন্ডি নামে ডাকে। সিন্ডিকেট বহুবাচনিক। রকমারি ফুল দিয়ে সাজানো এক তোড়া। প্রতিটি ফুলের রঙ, আকৃতি ও সুগন্ধ আলাদা। একটি তোড়ায় বাঁধা পড়ার কারণে ফুলদল নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে এক ও অভিন্ন হয়ে পড়েছে। স্বভাবে আলাদা হয়েও পরস্পরের মাঝে একীভূত হয়েছে। বহুবাচনিক মানবফুল একবাচনিক মানবফুলে নিজেকে প্রস্ফুটিত করছে। একগুচ্ছ মানবফুল একটি মানবফুলে বিলীন হয়েছে। মোদ্দা কথা বহুবাচনিক সিন্ডিকেট একবাচনিক সিন্ডি হয়ে উঠেছে।
ম্যানেজার সাহেবের কলিগরা সিন্ডিকেটকে সংক্ষেপে সিন্ডি নামে ডাকে। এই সংক্ষিপ্তকরণে ম্যানেজার সাহেবের সদয় সম্মতি ছিল। সিন্ডিকেটকে তিনিও সিন্ডি বলে ডাকেন। ঋণ, বিনিয়োগ ও মুনাফা নিয়ে তার সঙ্গে জমিয়ে আলাপ করেন। ম্যানেজার সাহেবের চেম্বারে সিন্ডির আগমন ঘটলে ছেঁড়া নোট গুনে ক্লান্ত টেলার খিল খিল করে হেসে ওঠে। চপলা রমণীর চোখে আবেশ ঘনায়। অধরে রোমাঞ্চ এসে জমে। পালিশ-করা জুতোয় মচমচ আওয়াজ তুলে সিন্ডি চেম্বারে ঢোকে। হাঁটুর উপর হাঁটু তুলে সিগারেট ধরায়। সিগারেট ধরানোর মুহূর্তটি চপলা রমণী দূর থেকে উপভোগ করে। তার আবেশঘন চোখ ক্যাশ কাউন্টার থেকে স্যারের চেম্বারপানে ধায়। রমণী দেখে স্যার সিন্ডিকে লাইটার এগিয়ে দিচ্ছেন। সিন্ডির ঠোঁটে সিগারেট ফস করে জ্বলে ওঠে। দৃশ্যটি পুরুষত্ববাচক। সুদর্শন ও যৌনাত্মক। সুন্দরী টেলারের অধর সিন্ডি-প্রেমে ছলকে ওঠে,-‘ওয়াও! কী হ্যান্ডসাম!’
সিন্ডি হ্যান্ডসাম বটে! চপলা টেলারের হৃদয় হরণ করার মতো পুরুষত্ব রাখে। ম্যানেজারের দিন কাটে সিন্ডি-সান্নিধ্যে। তার চেম্বার তামুকপাতার গন্ধে ভুরভুর করে। সিন্ডির প্রস্তাবে ধোঁয়া-ওঠা কফির কাপ নিজেকে সম্মানিত ও সম্মোহিত বোধ করে। ঝকঝকে চেম্বারটি তার পরিকল্পনা শুনে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বড়ো কর্তার কাছে সিন্ডিকে ই-মেইল করেন ম্যানেজার। তিনি এখন সিন্ডির বশীভূত হয়েছেন। বীরাপ্পনের সঙ্গে তার দেখা হয় না। দেখা হওয়ার সুযোগ থাকে না। ‘ম্যানেজার সাব, আমি আফনার বীরাপ্পন’,-এই বাক্যটির উপর ধূলির আস্তর পুরু হয়ে জমেছে। শহরে জলপাই নামে দেখে সব ছেঁড়েছুঁড়ে বীরাপ্পন জঙ্গলে পালায়। সে আর ফেরে না। কেউ তার দেখা পায় না। শহর থেকে সে চিরতরে উধাও হয়। তার ভাগ্যে কী ঘটে শহরবাসী আজ-অব্দি জানে না। হয়তো কোনোদিন জানবে না। বীরাপ্পন হাওয়া হয়ে গেছে। সে মিশে গেছে অথৈ নিরাকারে!
শহরে দিন পালটেছে। সাইরেন ও সার্চ লাইট ব্যারাকে ফিরে গেছে। মন্ত্রী ও এমপি সাহেব গোপন ডেরা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। মেয়র সাহেব আবারো তার বাগানে ফিরতে পেরেছেন। গন্ধরাজের পাশে হাস্নাহেনার ঝাড় লাগিয়েছেন শখ করে। ‘আত্মগোপনের দিনগুলি’ নামে আত্মজীবনী লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রোজ রাতে এক পাতা করে লেখেন। পিয়ারের চোখে ধুলো দিয়ে কী করে শহর থেকে পলায়ন করলেন তার রগরগে বর্ণনা আছে সেখানে। স্ত্রী ও ইয়ার-বন্ধুদের পড়ে শুনিয়েছেন। মেয়রের লেখনীশক্তির প্রশংসা করেছে তারা। পিয়ারের চোখের সামনে দিয়ে হিজড়া সেজে পালানোর বিবরণে আরো কিছু সাসপেন্স যোগ করার পরামর্শ দিয়েছে। মেয়র কৃতজ্ঞচিত্তে সেই পরামর্শ গ্রহণ করেছেন।
শহরে ফিরতে পেরে মেয়র সাহেব সুখী ও পরিতৃপ্ত। তার প্রতিপক্ষরা আল্লা মালুম এতোদিন কোথায় ছিল! সবাই একে-একে শহরে ফিরেছে। শহর কিলবিল করছে নেতা ও কলহে। গদি নিয়ে আবারো টানাটানি শুরু হয়ে গেছে। লালমুখো সায়েবদের কথা গদিনশীনরা কানেই তুলছে না। সায়েবরা ঘনঘন বার্তা দিচ্ছে,-‘ওহে গদিনশীন ও গদিহীন, তোমরা সিধা হও। একে অন্যকে ধরিয়া টানাটানি করিও না। ইহার ফল শুভ হইবে না। সুযোগ বুঝিয়া জলপাই ও জঙ্গি তোমাদের ধরিয়া টানিবে। উহাদের রুখিতে হইলে টানাটানি বন্ধ করো। নতুবা আমরা টানাটানি করিতে বাধ্য হইবো। সাধু হও। সাবধানে থাকো।’
সায়েবদের সতর্কবানীতে ফল হচ্ছে না। শহরে এক কালে ফ্লেচার সায়েবের রাজত্ব ছিল। সেই দিন অনেক আগে চুকেবুকে গেছে। সায়েবরা এখন বণিক ও পরামর্শক হয়ে এখানে সফর করে। তবু সায়েব আছে সায়েবের মতো! শহর ছেড়ে যাবার আগে টানাটানির তরিকা তারা শিখিয়ে দিয়ে গেছে। গদিহীন ও গদিনশীনরা সেই তরিকা একে অন্যের উপর প্রয়োগ করে। কিন্তু সুবিধা করতে পারে না। বিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতার অভাবে আনাড়ির মতো নিজেকে ধরে টানে। টানতে গিয়ে খালি গিট্টু পাকায়। সাত আসমানের উপরে এক ইন্দ্রজাল বিরাজ করেন। গিট্টু লাগানোর খেলাটি তাকে খুব হাসায়। মুচকি হেসে ওসমানকে তিনি ইশারা করেন। রাক্ষসটি তখন জোরসে তালিয়া বাজায়,-‘লাগ্ গিট্টু লাগ্। বন্ বন্ করি লাগ্।’ আমাদের শহর কিলবিল করে গদিলোভী নেতাদের গিট্টু লাগানোর রঙ্গ ও কলহে!
শহরটি বড়ো রঙ্গপ্রিয়। এখানে গদিহারা ও গতিহারা নেতারা থাকে। গদি নিয়ে কিচিরমিচিরে পারদর্শী টকিরা বসবাস করে। নেতারা গদির তালে ঘোরে আর টকিরা ঘোরে টেলিভিশনে। শহর জুড়ে তারা কিলবিল করে। মাছির মতো আমাদের চারিধারে ভন-ভন করে। তাদের মতো আমরাও কিলবিল করি বেবাট শহরে। সুযোগ পেলে একে অন্যকে ধরে টানি। ফ্লেচার সায়েবের মতো কায়দা করে টানি। কেন যেন হয় না ওটা! কেন যেন পারি না ওটা! টানতে গিয়ে খালি গিট্টু লাগে। আমাদের গিট্টু পাকানোর রঙ্গে ইন্দ্রজাল সাত আসমানে হেলান দিয়ে হাসেন। তার লাই পেয়ে ওসমান জোরে তালিয়া বাজায়,-‘আয় গিট্টু আয়। বেশি করি আয়। জলদি করি আয়। লাগ্ গিট্টু লাগ্। আরো জোরে লাগ্।’
গিট্টুকে দেখে আমাদের ভীষণ রাগ হয়। ওসমানের অসহ্য তালিয়া বাজানো শুনে মেজাজ সপ্তমে চড়ে। তবে দিনশেষে খারাপ ভাবটি কেটে যায়। আমরা বুঝতে পারি গিট্টু মিয়ার উপর গোস্বা করে লাভ নেই। সে হচ্ছে সার্কাসের ক্লাউন। শহরবাসীকে উত্যক্ত করে বিনোদিত করা তার কাজ। দিনের শেষে আমরা বুঝতে পারি গিট্টুর সুতো গিট্টু মিয়ার হাতে থাকে না। স্বয়ং ইন্দ্রজাল ওটা ধরে থাকেন। তার ইচ্ছে হলে সুতো ছাড়েন, আবার সময় বুঝে গুটিয়ে ফেলেন। গিট্টু নাচে ইন্দ্রজালের ইশারায়। সে এক মামুলি ক্লাউন। ইন্দ্রজালের ইশারায় নড়েচড়ে। শহরবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তোলে। ক্লাউনটির রকমারি রগড়ে আমরা বিনোদিত হই।
গিট্টু মিয়ার শহরটি এক আজব সার্কাস! সবকিছু এখানে এলোমেলো ও জট পাকিয়ে থাকে। জট হচ্ছে গিট্টুর অতি আদরের ছোটো বোন। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে বোনকে জিট্টু বলে ডাকে। তাকে খুব ভালোবাসে। বাপের মমতা ও মায়ের আদর দিয়ে বোনকে আগলায়। জিট্টুর হাত ধরে গান করে গিট্টু,-‘বাপের চোখের মণি নয়/মায়ের সোনার খনি নয়/ভাইয়ের আদরের ছোটো বোন/একটি বীণার তার/মোরা একটি সংসার/দুজনে কতো যে আপন!’ দুই ভাইবোন বড়ো আপন এই শহরে!
গিট্টুর বোন জিট্টু হলো এলোকেশী কালী। ছড়ানো কেশ দিয়ে নিজের নগ্নতা ঢাকে। সকাল হলে ভাইবোন রাস্তায় নেমে পড়ে। গভীর রাত্তিরে নিজের ডেরায় ফেরে। মোয়াজ্জিন ভোরের আজান দিলে আবারো রাস্তায় নামে। ভাই-বোন মিলে শহরের অলি-গলি ও রাজপথে রগড়ে মেতে ওঠে। গিট্টু দুই হাত দিয়ে দড়ি পাকায়। দড়িটি বোনের কোমরে শক্ত করে বাঁধে। হাতের মুঠোয় ওটা চেপে ধরে বোনকে ইশারা করে,-‘হেই, ছুট্ ছুট্ ছুট্।’ এলোকেশী জিট্টু ভাইয়ের ভীষণ অনুরক্ত। ইশারা পেয়ে নিমিষে ছুট লাগায়। জিট্টু যতো ছুটে গিট্টু ততো দড়ি ধরে টান মারে। সার্কাস জমে ওঠে শহরে।
এলোকেশী জিট্টু এক মহামায়া কালী। ওর মধ্যে আদ্যাশক্তি বিরাজ করে। দশমহাবিদ্যার অধিকারী শিবের পত্নী সতী বিচিত্ররূপিনী ছিল। দক্ষযজ্ঞ শেষে উমা-দুর্গা ও কালী রূপে ধরায় আবিভূর্ত হয়েছিল। জিট্টু হলো এ-যুগের সতী। ভাইয়ের ঘরে এলোকেশে রঙ্গ করে। সতী যেমন করে পতি শিবের ঘরে। বাউণ্ডুলে শিবের উপর তার শ্বশুর প্রজাপতি দক্ষ মহা খাপ্পা ছিল। খ্যাপাটে স্বভাবের ত্রিকাল-সংহারীকে সে দুই চোখে দেখতে পারে না। জামাই ও শ্বশুরে খিটিমিটি লেগেই থাকে। সতীর মিটমাটের চেষ্টায় কোনো লাভ হয়নি। শ্বশুর ঠিক করেছে মহাযজ্ঞ করবে। মেয়ে ও জামাই ছাড়া সবাইকে যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করেছে। দেবালোকে দক্ষযজ্ঞ নিয়ে মহা ধুমধাম পড়ে গেছে। মেয়ে সতী যজ্ঞের খবর পেয়ে বাপের বাড়ি যাবে বলে বায়না ধরেছে। বাপ কী করে মেয়ে-জামাইকে ভুলে যজ্ঞের আয়োজন করছে সেটা দেখে ছাড়বে। ত্রিকাল-সংহারী শিবকে ছাড়া যজ্ঞ কী করে হয়, বাপকে সেটা জিজ্ঞেস করবে। শিব যতো মানা করে সতীর জেদ ততো বাড়ে। মহাদেব তার জেদি বউকে বোঝায়,-‘দোহাই লাগে বহু, যেও না যজ্ঞে। বাপ তোমার বদরাগি। অপমানের একশেষ করে ছাড়বে। হ্যাংলা মেয়ের মতো সেধে পড়ে ওখানে যাওয়ার দরকার কী তোমার! তারচেয়ে দুজনে মিলে কামকেলি করি। মৈথুনের আনন্দে যজ্ঞের দুঃখ ভুলি।’
জেদি বউকে চিনতে শিবের তখনো অনেক বাকি! দক্ষ-নন্দিনী এবার স্বরূপে আবিভূর্ত হয়। নাকের পাটা ফুলিয়ে বরকে ধমক দিয়ে ওঠে,-‘রে মহাদেব, তুই আমায় এখনো চিনিস নাই। তোর কি জানা নেই আমি কে হই?’ এই শহরটি সতীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। দক্ষযজ্ঞ শেষে তার ছিন্নহস্ত এখানে এসে পড়েছিল। সে অন্য কাহিনী। আসল কথা হলো সতী এই শহরের মেয়ে। তার পতি হওয়ার সুবাদে মহাদেব শিব আমাদের জামাইবাবু লাগে। জামাইবাবুর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কে রঙ্গ-রস থাকবে না সেটা কি হয়? সুতরাং ত্রিকাল-সংহারী শিবকে দেখে শহরে কেউ ডরায় না। তাদের কাছে জামাইবাবু এক আত্মভোলা সাদাশিব। বাঘছাল পড়ে ঘুরে। শ্মশানে-মশানে পড়ে থাকে। গাঁজা-ভাং খুব টানে। নান্দী ও ভৃঙ্গী নামে দুই অপোগণ্ড সঙ্গে জুটেছে। দুটোকে সঙ্গে নিয়ে সারাদিন খ্যাপামি করে বেড়ায়।
আবারো প্রমাণিত হয় পুঁচকেরা বাঁধা হয়ে উঠে বলে আমরা চাইলেও একে অন্যকে সহজে ছাড়তে পারি না। সব ছেড়েছুঁড়ে জঙ্গলে নিরুদ্দেশ হতে পারি না। সকালে যাকে দেখে অসহ্য হই রাতে তার শরীরের ভাঁজে স্খলিত হই। ঝগড়া ও আপসে জীবনের মধু চাখি। আমাদের আর জঙ্গলে যাওয়া হয় না। সব ছেড়েছুঁড়ে জংলী হতে পারি না।
সতীর ধমক খেয়ে আত্মভোলা জামাইবাবু কী বলতে পারে সেটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। মহাদেব শিব মাথা চুলকে বউকে মিনতি করে,-‘লক্ষ্মী বহু আমার, যেও না বাপের বাড়ি। তুমি রাগ করলে সুন্দরী লাগে। তোমার ওই রোষ দেখে বড়ো কাম জেগেছে মনে। দুজনে মিলে রতিকেলি করি চলো।’
শহরের মেয়ে হওয়ার সুবাদে সতীকে আমরা ভালো করে চিনি। বোকা বরের মান-অপমান বোধের ঘাটতি আবিষ্কার করে তার মেজাজ তুঙ্গে উঠা স্বাভাবিক। শ্বশুরের অপমান যার গায়ে লাগে না সে কি পুরুষ! সতী মেয়ে হয়ে বাপের তাচ্ছিল্য সইতে পারছে না, আর গাঁজাখোর কিনা লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে রতিকেলির প্রস্তাব করছে! সে কবেকার কথা! অথচ এখনো সতীর গনগনে মুখটি আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই। বুঝতে পারি সাদাশিবের আজ খবর আছে!
শ্বশুর দক্ষ শিবের উপর মহা খাপ্পা ছিল। এবার কন্যা খেপে উঠেছে। এছাড়া এই অপদার্থকে লাইনে আনা মুশকিল। পতি শিবের উপর পত্নী সতী এবার করালবদনী হয়। মহামায়া দিয়ে রোধ করে জগতের চারটি কোণ। ঈশান ও নৈঋতকে রোধ করে মহাবিদ্যায়। মায়া বিস্তার করে চারিকোণে। সে এখন পতীভক্ত সতী নয়। এই সতী সংহারী করালবদনা! পতির উপরে খড়গহস্ত কালী। বেশরম শিবকে সংহার করতে তিলেক দ্বিধা করছে না। সতীর এই করালবদনী রূপ দেখে মহাদেবের বুকে কাঁপুনি লাগে। আহ্লাদী বউ রণচণ্ডী হলো দেখে বেচারা জামাইবাবু মনে-মনে প্রমাদ গুনে। ত্রিকাল-সংহারী নটরাজ ভয়ে পালাতে চাইছে। কিন্তু যাবে কোথায়! প্রথমে ভাবলো ঈশান কোণ দিয়ে ভাগা মারি। নাহ, দ্বার বন্ধ। নিরুপায় হয়ে নৈঋতকোণে পা বাড়ালো। হায়রে পোড়ার কপাল,-ওটাও বন্ধ! শিব যেদিকপানে ধায় করালবদনী লৌহমানবী তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সব দিকে এক ‘লৌহমানবী’র উপস্থিতিতে জামাইবাবু হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। তার এই দিশেহারা ছুটোছুটি দেখে করালবদনী অট্টহাস্য করে,-‘রে মূঢ়! তুই কোথা পালাবি! সতীর পদতলে আজ পিষে মরবি!’
ক্লান্ত ও হতশ্বাস মহাদেব লুটিয়ে পড়ে মহামায়ার পদতলে। করালবদনী এখন সৌম্য মহামায়া হয়েছে। দশমহাবিদ্যা দিয়ে রোধ করেছে নটরাজের গতি। তার পদতলে পড়ে আছে ওই ত্রিকাল-সংহারী। চোখ মুদে উপলব্ধি করছে প্রকৃতির জাগরণ। নারীর মধ্যে পুরুষের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের আলোড়ন। সৌম্য সতীকে দেখে শিবের ভয় কেটে যায়। কণ্ঠ সতী-বন্দনায় মুখর হয়। প্রমত্ত পুরুষ ভয়ংকরী প্রকৃতির স্তুতিভাষ্য করে,-‘মা, এবার চিনেছি তোমায়! তুমি আদ্যাশক্তি। জননী হও এ জগতের। নগ্নবসনা কালী তুমি। শক্তি প্রসব করো দিনে-রাতে। তুমি মহাকাল। অনাদিরূপে বিরাজ করো নিরাকারে। নারীরূপে কোমল হলে তোমাকে স্ত্রী ও ভগ্নি বলে বুঝি। আদ্যারূপে ভয়ংকরী হলে জননী-প্রকৃতি বলে চিনি। শিব কামুক হয় তুমি সতী রূপ নিলে। নটরাজ হয় মহামায়া হলে। মা তুমি মহামায়া। তুমি হলে জগৎ-জননী। স্ত্রী বা ভগ্নি রূপে নিছক চপলা রমণী!’
গিট্টুর বোন জিট্টুর কথা উঠলে সতীকে মনে পড়বেই। জিট্টু এই শহরের মেয়ে। সে হলো এ-যুগের সতী। তফাত শুধু এটুকু যে গিট্টু তার বর নয়,-মায়ের পেটের ভাই। এমন খ্যাপাটে মেয়র বর জোটানো ভারি মুশকিল। গিট্টু চেষ্টা কম করেনি। বোনের জন্য পাত্রের খোঁজ করে আর পাত্রপক্ষ এলে মনে-মনে বলে ‘বেটারা যেন জিট্টুর দস্যিপনা টের পেয়ে ভাগে।’ একমাত্র বোনের প্রতি গিট্টুর এই অগাধ টান দেখে ইন্দ্রজাল মুচকি হাসেন। জিট্টুকে সারাদিন এলোকেশী করে রাখেন। পাত্রপক্ষের সামনে আউলা-ঝাউলা মাতঙ্গিনী রূপ ধরে হাজির করান। বিয়ের কনে মাতঙ্গিনী রূপ ধরে আসে দেখে ভয়ে পাত্রপক্ষের গলা শুকায়। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করে। কনে দেখার শখ মিটে যায়। পাত্রপক্ষ পালায়। জিট্টুর বিয়ে ভাঙে। আদরের বোনটি হয়ে ভাইয়ের ঘরে দস্যিপনা করে বেড়ায়।
দড়ি খেলার জন্য ভাইবোন দুটিতে মিলে প্রতিদিন রাস্তায় নামে। সে খেলায় জিট্টু হয় দস্যি কালী। মেজাজ ফুরফুরে থাকলে ভদ্র ও রক্ষাকালী। রেগে গেলে চামুণ্ডা বা মহাকালী। মনে নির্বেদ এলে শ্মশানকালী। এবং, পরিশেষে আদুরে কালী। গিট্টু মিয়ার আদরের ছোট বোন। দড়ি ধরে ‘হেই ছুট্…’ বলা মাত্র দস্যি মেয়ে ভাইসুদ্ধ ছুট লাগায়। গিট্টু চালাক কম নয়। সে জানে তার বোন দস্যিকালী। সুতরাং দড়ি আলগা করে তাকে ছোটার সুযোগ করে দেয়। নিজে তার পেছনে দড়ি ধরে ছুটে। গলি থেকে রাজপথে ধায়। রাজপথ থেকে চৌরাস্তায় ছুটে। সেখান থেকে পুনরায় গলিপথে নামে। সুযোগ বুঝে গিট্টু দড়ি ধরে টানে। এতে করে মাতঙ্গিনীর ছোটার গতি খানিক মন্থর হয়। বোনকে মন্থর করতে পেরে গিট্টু জিরিয়ে নেয়। দড়ি-খেলা আবারো শুরু হয়। গিট্টু ইশারা করে,-‘হেই বোন, ছুট্ ছুট্ ছুট্।’ সংকেত পেয়ে দস্যি বাজারের দিকে ছুট দেয়। ঢুকে পড়ে অফিসে। ভাইকে টেনে তোলে ট্রাকে কিংবা বাসে। কখনো-বা পেছন থেকে পথচারীর শার্টের কলার চেপে ধরে। জিভ বের করে ভেংচি কাটে। দিন থেকে রাত অবধি শহরের অলি-গলি জুড়ে জিট্টুর বাঁদরামি চলে।
গিট্টুও কম রসিক নয়। বোনকে বাঁদরামি করতে দিয়ে নিজে বাঁদর হয়। রিকশা না-পেয়ে গাট্টাগোট্টা কোনো মহিলা হয়তো বিরক্ত। গিট্টু তার শপিং ব্যাগ ধরে টান দেবে। টেকো মাথার বীমার দালাল হনহন করে ছুটছে। মাথায় খদ্দের ধরার টার্গেট। আজকের মধ্যে টার্গেট পুরা করতে হবে। বসের ঝাড়ি থেকে বাঁচতে বেচারা প্রাণপণে ছুটছে। গিট্টু সেই বীমার পিছে ছোটে। তার টেকো মাথায় চাটি মারে।
এমপি সাহেবের জিপ রাস্তায় নেমেছে। রাজহংসীর মতো পাখা মেলে তিনি জনসভায় চলেছেন। এমপি’কে দেখে গিট্টু মহা খুশি হয়। বীমার দালাল ছেড়ে সাংসদের পিছু নেয়। দস্যি কালী জিপের বনেট টেনে ধরে। গিট্টু বোনের কোমরে বাঁধা দড়ি শক্ত করে টানে। ভাইবোনের টানাটানির চোটে এমপি সাহেবের জিপ রাস্তায় থেমে যায়। ড্রাইভার বিরসমুখে উক্তি করে,-‘স্যার, টায়ার পাংচার!’ মেয়র সাহেবের প্রতি এমপি’র মেজাজ পাংচার হয়। মনে-মনে ওর চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করেন। গিট্টুর ইশারায় দস্যি কালী জিপের বনেট ছেড়ে দিলে গাড়ি হুঁশ করে সামনে আগায়। আচমকা অটো রিকশায় ধাক্কা মারে। নিমিষে লোক জমে যায় সেখানে। সাংঘাতিক কোথা থেকে এসে জোটে আল্লা মালুম! ড্রাইভার বোকামুখে উক্তি করে,-‘স্যার, ব্রেক ফেল!’
পাংচার থেকে ব্রেক ফেল-এর আজগুবি ঘটনায় এমপি’র মেজাজ বিগড়ায়। ড্রাইভারের কান টেনে থাপ্পর দিতে ইচ্ছে করে। তাকে ধমকে উঠেন,-‘তুই বেটা ব্রেক ফেল। তোরে রাস্তায় কে পারমিট করে?’ ড্রাইভার কাচুমাচু মুখে উত্তর করে,-‘স্যার আপনি।’ গিট্টুর খপ্পরে পড়ে এমপি সাহেব ভুলে গেছেন তার গাড়ির কাগজপত্র কিছু ঠিক নেই। যদিও এই শহরে ড্রাইভার বাহিনীকে তিনি প্রতিদিন পারমিট করেন। সাংঘাতিক ফটো খিঁচে দেখে এমপি এবার নিজে ব্রেক ফেল করে বসেন। গাড়ি থেকে নেমে অপোগণ্ডটিকে ধাওয়া করেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে লাইসেন্সবিহীন রিভলবার বের করে আকাশে ঠুশ-ঠুশ গুলি ছোঁড়েন। লোকেরা ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়। রাগে অন্ধ এমপি প্রকাশ্যে রিভলবার হাতে সাংঘাতিক তাড়া করে চলেন। গিট্টু ও এলোকেশী এমপি’র পিছু-পিছু দৌড়ায়। সাংঘাতিকের পিছে এমপি’র দৌড়বাজি দেখে ভাই-বোন খুব মজা পাচ্ছে এখন।
এমপি পাগলা হয়েছে বুঝে সাংঘাতিক এঁকেবেঁকে ছুটে। এই কাজে তার তুলনা হয় না! এমপি’র চোখ ফাঁকি দিয়ে সরু গলি ধরে সটকে পড়ে। তার বুকে খুশির তুফান উথলে উঠছে। টিভি পর্দায় আজ লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। টেলিভিশন ফাটবে টকিদের গলার আওয়াজে। ওদিকে সাংঘাতিক খুঁজে হয়রান এমপি গলিমুখে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তার পা আর চলছে না। শরীর ঘামে জবজবে হয়ে গেছে। কাঁঠাল গাছের নিচে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন। গলিমুখে আজব কাঁঠাল গাছটি কোথা থেকে জোটে আল্লা জানে! গাছে থোকা-থোকা কাঁঠাল ধরেছে। মধুমাসের প্রভাবে রসে টসটস করছে। ব্রেক ফেল এমপি সাহেব আর নিজের মধ্যে নেই। মনে অপোগণ্ড সাংঘাতিককে খুন করার রোখ চেপেছে। তার হাতে উদ্যত রিভলবার। স্থান-কাল সব ভুলে আকাশ লক্ষ করে ঠুশ-ঠুশ গুলি ফাটান। তার মনে হয় এমপি’র ভয়ে মাটিতে টিকতে পারবে না বুঝে হতভাগা অলরেডি আকাশে উঠে গেছে। এবার তাকে ইন্দ্রজালের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা দরকার। সুতরাং আকাশ লক্ষ করে ট্রিগার চাপেন। দুম দুম করে গুলি ফুটতে থাকে আকাশে।
হাজার হোক এমপি সাহেব কোনো জাদরেল ব্রিগেডিয়ার না। নিতান্ত এক সিভিলিয়ান। গুলিবাজি করলেও পিয়ারের মতো লক্ষভেদ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এমপি সাহেবের এলোপাথাড়ি গুলি আকাশের পরিবর্তে আজব সেই কাঁঠাল গাছটিকে জখম করে। রসে টসটসে কাঁঠাল সবেগে তাকে লক্ষ করে ভূপতিত হয়। ফল হিসাবে কাঁঠাল অতি রসালো এবং অতি আঠালোও বটে! রস ও আঠা এমপি’র ব্রেকব্রাশ করা চুলে লেপটে যায়। মুখ বেয়ে শরীরের অলিগলি দিয়ে নামতে শুরু করে। কাঁঠালের কঠিন পিরিতে এমপি আঠালো হয়ে পড়েন। পিরিতি কাঁঠালের আঠা,-এই সারবাক্যের উদাহরণ হয়ে কাঁঠাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকেন। এমপি এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়! লোকজন তাকে ঘিরে ধরেছে। অসংখ্য ফটো-সাংঘাতিকে কাঁঠাল চত্বর ভরে উঠেছে। গিট্টু ও জিট্টুর কল্যাণে শহরে আজ টিভি চ্যানেলের দিন ফিরেছে। পাশের শহরের চ্যানেল ছেড়ে লোকে আজ হুমড়ি খাবে নিজের চ্যানেলে।
এদিকে তাড়া-খাওয়া সাংঘাতিক মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে কাঁঠাল গাছের চত্বরে হাজির হয়েছে। তার কপালে গুলিফুলি কিছু লাগেনি। তাড়া খাওয়ার সময় গুরুতর জখম হয়নি। তবু মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধেছে। এমপি’র আকস্মিক হামলার শিকার এই সংবাদকর্মীর প্রতি উপস্থিত জনতা বিগলিত হয়ে পড়ে। মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে সমবেদনা জানায়। অন্যের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজেকে সে খাবারে পরিণত করেছে। সহকর্মীরা তাকে ঘেরাও করে ফেলে। তার দিকে মাইক্রোফোন উঁচিয়ে ধরে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় এমপি’র সঙ্গে ব্যান্ডেজ সাংঘাতিক টিভি ক্যামেরা দখল করে ফেলে। করুণ মুখ করে ব্যান্ডেজ তার দুর্দশার কাহিনী শোনায়।
টিভি চ্যানেলে সুন্দরী সংবাদপাঠিকা লিড নিউজ পড়ছে। তার লাবণ্য-প্রাণ ঠোঁট দুটো ঈষৎ ভাঁজ হয়ে আছে। স্ফুরিত-অধরা দিনের প্রথম গরম খবর পাঠ করে। টিভি পর্দায় জমে যাওয়া দর্শককে স্বাগত জানিয়ে খবর পড়ে,-‘স্বাগতম ২৪ ঘণ্টার খবরে। আমি সুহাসিনী আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি দিনের গরম খাবারে। প্রথমেই শিরোনাম। জ্যোষ্ঠের কাঠফাটা রোদে নিরীহ সংবাদকর্মীকে রিভলবার নিয়ে তাড়া করলেন এমপি। খবরে প্রকাশ সংবাদকর্মীকে লক্ষ করে এলোপাথাড়ি গুলি ছোঁড়ার সময় ভূপতিত কাঁঠালফলে নাজেহাল হয়েছেন রোড পারমিটের ত্রাস নামে খ্যাত এই এমপি। তার কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণে মারাত্মক জখম হয়েছে শহরের জাতীয় ফল। জখম হয়েছে অনন্য এক স্থাপনা। দিনভর এমপি’র ত্রাস-সৃষ্টিকারী এই কাণ্ডের খুঁটিনাটি সহ ফিরছি বিজ্ঞাপন বিরতির পর। কোত্থাও যাবেন না। থাকুন ২৪ ঘণ্টার খাবারে। চোখ রাখুন কাঁঠালের রসে আঠালো এমপি’র খবরে…!
এমপি-রঙ্গে মত্ত শহরবাসীকে টিভির পর্দায় ব্যস্ত রেখে গিট্টু ও জিট্টু কালী মন্দিরের চাতালে বসে খানিক জিরিয়ে নেয়। একটু পরে আবার দড়ি-খেলায় নামবে দুজনে। ভাইবোনের চাপে সারাদিন ধরে আমরা অতিষ্ঠ ও বিনোদিত হই। তাদের দড়ি-খেলার চাপ রাস্তায় গিয়ে পড়ে। লাগে যানজট। দড়ি গুটলি পাকায় বাজারে। লাগে মূল্যজট। বাজারে ঢুকে আমাদের মাথা ঘোরে। হৃদযন্ত্র বিকল হওয়ার উপক্রম করে। বহুমূত্র হানা দেয় শরীরে। আমরা হাসপাতালে ভিড় করি। আমাদের ভিড়ের চোটে কেবিন ও ওয়ার্ডে লাগে চিকিৎসাজট। আমরা বাস করি এক জটের শহরে। হয়রান হই রকমারি জটে।
গিট্টু ও জিট্টুর কাছে পথচারী এবং মন্ত্রী সাহেবে কোনো ভেদাভেদ নেই। গিট্টু বোনকে ইশারা করে,-‘হেই বোন, ছুট্ ছুট্ ছুট্। ওই বেটার পিছে ছুট্।’ বোনকে মাতঙ্গিনী কালী করতে ক্লাউনটা মন্ত্র পড়ে,-‘এক্কা দোক্কা তিন টেক্কা। মন্ত্রী বেটা পাবে অক্কা।’ ব্যাস, দস্যি বোনকে আর পায় কে! বন্-বন্ করে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তিমায় ব্যস্ত মন্ত্রীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। তার চারপাশে লাটিম হয়ে ঘোরে। মন্ত্রীর বোঝার কথা নয় রক্ষাকালী এখন মাতঙ্গিনী চামুণ্ডা হয়েছে। শ্মশান ও ডুমুর গাছ ছেড়ে তার ঘাড়ে ভর করেছে। অনলবর্ষী বক্তা প্রতিপক্ষকে রাবিশ বলতে গিয়ে খবিশ বলে ফেলে। এটা নিয়ে বাঁধে গোল।
মোদ্দা কথা ভাইবোন সারাক্ষণ শহরে গোলমাল পাকায়। তাদের চক্করে আমরাও পড়ি গোলমালে। দিনের শেষে প্রচণ্ড মাথা ধরে। লিভারে চিন-চিনে ব্যথা টের পাই। ডাক্তার মুখ গম্ভীর করে বলে,-‘ওটা কিছু না। গেস্ট্রিক। পেটে গ্যাস হয়েছে। ওষুধ লিখে দিচ্ছি। খালি পেটে থাকবেন না। একটু পরপর একটা কিছু খাবেন।’ ওষুধ লিখতে গিয়ে ‘আউচ্’ বলে ডাক্তার সাহেব মুখ কুঁচকান। আমরা উদ্বিগ্ন হই,-‘কী হলো ডাক্তার সাহেব! কোনো অসুবিধা!’ ডাক্তার মুখ কুঁচকে উত্তর করেন,-‘না, তেমন কিছু না। গেস্ট্রিক। জ্বালিয়ে মারছে একেবারে!’ ডাক্তার সাহেবের প্রতি আমরা সহানুভূতি বোধ করি। বোকামুখে তাকে পরামর্শ দিই,-‘ও! আপনিও তাহলে গেস্ট্রিকের রোগী! খালি পেটে থাকবেন না। একটু পরপর একটা কিছু খাবেন। ঠিক সেরে যাবে।’
ডাক্তার সাহেবের পেটে গ্যাস জমা হয় ভেবে আমরা অবাক হই। ওষুধ কিনে ঘরে ফিরি। খালি পেটে ওষুধ গিলি। খাবারে রুচি আসে না। বায়ুর প্রকোপে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করি। মুখ গোমড়া করে মন্ত্রী ও এমপি সাহেবের রঙ্গ দেখতে টিভির রিমোট ঘুরাই। আমাদের মুখে হাসির ছটা ফিরে আসে। বউ ঝগড়া ভুলে খিল খিল করে হাসে। আমরাও গ্যাসের প্রকোপে ডাক্তার সাহেবের মতো ‘আউচ্’ বলে মুখ বাঁকিয়ে হাসি। এমপি-রঙ্গ শেষে গিট্টু আজকের মতো ক্ষান্তি দিয়েছে। বোনের কোমর থেকে দড়ি খুলে নিচ্ছে। বিছানায় শুয়ে আমরা টের পাই ভাইবোন নিজের ডেরায় ফিরছে। বোনের হাত ধরে গিট্টু এখন বোন-সঙ্গীত গাইছে। তার সঙ্গে আমরাও গলা মেলাই,-‘বাপের চোখের মণি নয়/মায়ের সোনার খনি নয়/ভাইয়ের আদরের ছোটো বোন…’। গানের প্রভাবে বায়ুর প্রকোপ কমে আসে। বউকে আমরা জড়িয়ে ধরি। মনে-মনে গিট্টু ও তার দস্যি বোনকে ধন্যবাদ জানিয়ে মৈথুনে লিপ্ত হই।
গিট্টু ও জিট্টুর শহরে ডাকু বীরাপ্পনকে কে আর মনে রাখে! তবে ম্যানেজার সাহেবের মনে রাখা উচিত ছিল। ডাকুর সঙ্গে সর্বশেষ সাক্ষাতের পর তার কৌপিন পরার কথা ছিল। স্যুট-টাইয়ের বদলে গাছের বাকলে তৈরি লেঙ্গট পরা উচিত ছিল। বীরাপ্পন তাকে জঙ্গলে ডাক দিয়েছিল। কপালগুণে শহরে একফালি জঙ্গল এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। তিনি চান্স নিতে পারতেন। দাসত্বকে ‘না’ বলে সোজা জঙ্গলে ঢুকে যেতে পারতেন। নিজেকে নতুন করে গড়ে নেওয়ার সুযোগ নিতে পারতেন। ব্যাংকের দাপুটে ম্যানেজার থেকে বনিআদম হওয়ার ইশারা বীরাপ্পন তাকে দিয়েছিল। দাসত্ব থেকে মুক্ত এক আরণ্যিক হওয়ার রাস্তা দেখিয়ে ছিল। বীরাপ্পনের সঙ্গী হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ ছিল সম্মুখে। ওর সঙ্গে সেই রাত্রে তার বেরিয়ে পড়া উচিত ছিল। ব্রিগেডিয়ার পিয়ারের সাইরেন ও সার্চ লাইট ফাঁকি দিয়ে তিনি জঙ্গলে পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু না, ম্যানেজার সাহেব পারেননি। দাসত্বকে তিনি ‘না’ বলতে পারেননি। ‘না’ বলার সাহস হয়নি। আফসোস!
মানুষ আসলে অনেক কিছু পারে না। ইচ্ছে থাকলেও পারে না। সকালে আমরা ঘুম থেকে উঠি। তখনো ঘুমন্ত স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করি,-‘ধুত্তেরি! এক মুখ আর কতোদিন দেখবো!’ আমরা বাথরুমে ঢুকি। বায়ুর প্রকোপ থেকে খালাস হয়ে বিরস মুখে দাঁত মাঝি। নাস্তার টেবিলে বসে পাউরুটি ও জেলি ভক্ষণ করি। স্ত্রী চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে মনে-মনে গজ-গজ করে,-‘ধেত্তেরি! আরামের ঘুমটা মাটি করে দিলো। এক কাপ চা নিজে বানাতে পারে না! বিয়ের পর থেকে জ্বালাতন করে মারছে। এটা চাই। ওটা চাই। এটা নেই কেন? ওটা হয়নি কেন? কী করো সারাদিন? বাপরে, কী ফুটানি! বিয়ে করে মাথা কিনে নিয়েছে! অপদার্থটার মুখ যে আর কতোদিন দেখতে হবে আল্লা জানে!’
আমরা আসলে এই জীবন নিয়ে ক্লান্ত। একে অন্যকে সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে ক্লান্ত। মেনে ও মানিয়ে নেয়ার খেলাটি খেলে ক্লান্ত। ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুঁড়ে ভাগি। কিন্তু দিনশেষে বউয়ের পাশে গিয়ে বসি। তার মেহদিরঙা চুলে মুখ ডুবিয়ে খুনসুটি করি। তাকে ঝাপটে ধরি। ঘামে-মেদুর কোমরে কাতুকুতু দেই। আমাদের ছেলেমানুষী হজম করতে না-পেরে বউ খিল খিল হাসে,-‘এই ছাড়ো তো! কী অসভ্যতা হচ্ছে। বাবু দেখবে।’ দুরন্ত ও ডানপিটে বাবুর নাম শুনে বউকে জোরে চেপে ধরি,-‘কেন বাবু কী করবে? তার মাকে চেপে ধরেছি দেখে কান্না করবে?’
আমরা জেদি বালক হয়েছি বুঝে বউ মুচকি হাসে,-‘হুঃ! কী করবে সেটা বাবুকে ডাক দিলে টের পাবে।’ আমাদের হাতের বাঁধনে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে বউ তার আদরের বাবুটিকে ডাকে,-‘বাবু দেখে যা, তোর বাবা রাক্ষস হয়েছে।’ অপোগণ্ডটা ফ্যান্টম ও সুপারম্যানের কমিকস নিয়ে মত্ত ছিল। হোমটাস্কের নাম করে সুপার-মানবে বিভোর ছিল। মা মুখোশ কিনে দিয়েছে সেই মানবের। এখন মুখোশ পরে সুপার-মানব হওয়ার ট্রায়াল দিচ্ছে। মাতৃদেবীর আহবানে ‘তবে রে রাক্ষস, আজ তোর একদিন কী আমার একদিন’ বলে উড়ে আসে। আমাদের হাতের চাপে নাজেহাল মাতৃদেবী বাবুকে দেখে মুখ করুণ করে তোলে,-‘বাবু, ওসমানের হাত থেকে তোর মাকে বাঁচা। জংলী রাক্ষসটা আমায় খেয়ে ফেলতে চাইছে। বাঁচা তোর মাকে।’
রমণীর ত্রাণকর্তাকে দেখে আমরা হো হো করে হেসে উঠি। তাকে আরো জোরে চেপে ধরি। ঘাড়ে মুখ নামিয়ে চুমুক লাগাই। আমরা এখন ড্রাকুলা হয়েছি। সুদূর বলকান থেকে এই শহরে উড়ে এসেছি। বাসিরক্ত পানের ক্ষুধা জেগেছে হৃদয়ে। মানবীকে ভ্যাম্পায়ার করার সাধ রক্তে উথলে উঠছে। আমাদের রক্তপানের খিদে ও আলিঙ্গনে রমণী হেসে গড়িয়ে পড়ে। ত্রাণকর্তা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়। মাতৃদেবীর আচরণ বুঝে উঠতে পারছে না। মাকে হাসতে দেখে তার মুখটি মেঘভার হয়ে উঠেছে। সুপার-মানবের মুখোশ সেই মেঘ লুকিয়ে রাখতে পারে না। ত্রাণকর্তাকে মেঘভার হতে দেখে রমণী পুনরায় জননী হয়ে ওঠে। কাতর মুখ করে বাবুকে সম্বোধন করে,-‘বাবু, তোর বাবা ওসমান হয়ে গেছে। আমাকে কামড় দিয়েছে। জাদু করে বশ করে ফেলেছে। রাক্ষসটাকে মার।’
জগতের সকল বাবুর কাছে মাতৃ-আজ্ঞা শিরোধার্য। মাতৃদেবীর আহবানে পুঁচকে ত্রাণকর্তার বিভ্রান্তি কাটে। সে এবার সত্যি-সত্যি সুপার-মানব হয়ে পড়ে। ‘তবে রে রাক্ষস, এই নে…’ বলে আমাদের পিঠে হাত চালায়। সর্বশক্তি দিয়ে পিঠে দমাদম ঘুষি মারে। পুঁচকেটা গায়ে শক্তি ধরে বটে! হতে পারে, জননী আক্রান্ত হলে জগতের পুঁচকেরা সুপার-মানব হয়ে ওঠে। ইন্দ্রজাল তাদের উপর ভর করেন। ওসমানকে শক্তি জোগাতে ইশারা করেন। পুঁচকের উপরে ওসমান এখন সত্যি ভর করেছে।
তার বিরামহীন আক্রমণ আমাদের নাজেহাল করে ফেলে। নিজেকে বাঁচাতে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। হাতের শক্ত বাঁধন আলগা করি। এই সুযোগে রমণী নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। সুপার-মানব ও মাতৃদেবী মিলে আমাদের উপর একসঙ্গে চড়াও হয়। কিল-ঘুষির বন্যা বহে পিঠে। ‘ধর ধর, রাক্ষসটাকে ধর। হাউ মাউ খাউ, রাক্ষসটাকে পাউ’ বলে ঘরময় আমাদের তাড়া করে। ব্যাপক এক হুল্লোড়ের মধ্যে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ঘরের সোফায় বসে হাঁপাই। আমাদের মধ্যে আবার সন্ধি স্থাপিত হয়। শান্তি নামে শহরে।
পুঁচকে সুপার-মানব ‘তবে রে রাক্ষস…’ বলে মারতে এলে জননী তাকে আটকায়,-‘আর মারে না সোনা। আমাদের মারের চোটে বাবা এখন ঠিক হয়ে গেছে। রাক্ষস থেকে আবার বাবা হয়েছে।’ পুঁচকের কাছে মায়ের আজ্ঞা শিরোধার্য গণ্য হয়। বেঁচে থাকার ক্লান্তি ভুলে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরি। ঘামভেজা শরীরে পুঁচকে মানবকে আলিঙ্গন ও আদর করি। আবারো প্রমাণিত হয় পুঁচকেরা বাঁধা হয়ে উঠে বলে আমরা চাইলেও একে অন্যকে সহজে ছাড়তে পারি না। সব ছেড়েছুঁড়ে জঙ্গলে নিরুদ্দেশ হতে পারি না। সকালে যাকে দেখে অসহ্য হই রাতে তার শরীরের ভাঁজে স্খলিত হই। ঝগড়া ও আপসে জীবনের মধু চাখি। আমাদের আর জঙ্গলে যাওয়া হয় না। সব ছেড়েছুঁড়ে জংলী হতে পারি না।