ওসমান সমাচার পর্ব ৬ । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জুলাই ২০১৬, ৯:১৮ পূর্বাহ্ণ, | ২২৪৫ বার পঠিত
ডাকু ও ক্যামেলিয়া : ফ্লেচার, খোক্কস ও বীরাপ্পন সমাচার (২)
চাঁদ এখন গজগামিনী। প্রসব ব্যথায় ধীরগামি। এমন গজগামিনী রাতে ওসমানকে সামাল দেয়া কঠিন হওয়ার কথা। অথচ সেটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। তরুণীযূথ থেকে খানিক দূরে ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেব মুখ ভার করে বসে আছেন। স্যুট-টাইয়ের পরিবর্তে কাবুলি ড্রেস পরেছেন। তাকে আমরা সায়েব-সুবোর পোশাকে দেখে অভ্যস্ত। হঠাৎ কেন কাবুলি পরলেন সেটা বোঝা যাচ্ছে না। হতে পারে খেলাপি ঋণ আদায়ের চাপ তাকে কাবুলি পরতে উৎসাহী করেছে। শহরের বিখ্যাত ঋণ খেলাপির পিছনে তার দৌড়ঝাঁপ ও বাক-বিতণ্ডার খবর কারো আজানা নেই। হেড অফিসের বড়ো কর্তার চাপে তার ব্লাড প্রেসার আজকাল নিয়ম মানে না। খেলাপি টাকা শোধ দেবে শুনলে রক্তচাপ দ্রুতগতিতে বেড়ে যায়। কবে কখন দেবে সেই খুশিতে সিস্টোলিক লাগাম ছেড়ে উপরে উঠে। আবার খেলাপি শোধ দিবে না শুনলে চাপ দ্রুত নিচে নামতে থাকে। খেলাপির হাত থেকে ইহ জীবনে নিস্তার নেই ভেবে ডায়াস্টোলিক ধাঁই ধাঁই করে নিচে নামে। সিস্টোল ও ডায়াস্টোলের এই ঘোরপ্যাঁচে ম্যানেজার সাহেবের মুখ সবসময় ভার থাকে। অফিসে কলিগদের সঙ্গে গোমড়া মুখে কথা বলেন। কারণে-অকারণে হম্বিতম্বি করেন। ঘরে বউ সোহাগ করে দুটো কথা বলতে গেলে খেঁক করে উঠেন। ম্যানেজার সাহেবের মাথায় শুধু খেলাপি ও হেড অফিস জেগে থাকে।
ম্যনেজার সাহেবের অভিধানে সবচেয়ে বড়ো ডাকুর নাম হচ্ছে খেলাপি। শহরের শীর্ষ ঋণ খেলাপিকে তার কলিগরা বীরাপ্পন বলে ডাকে। নামটি ক্রমে সারা শহরে রাষ্ট্র হয়ে গেছে। যদিও বীরাপ্পনের সঙ্গে বিখ্যাত এই ঋণ খেলাপির চেহারা ও আচরণে কোনো মিল নেই। তাকে বরং সোজা-সাপটা মানুষের মতো দেখায়। বীরাপ্পনের যুক্তি ও রসবোধ প্রবল। আসর জমিয়ে গপ্পো করতে জানে। এহেন মানুষটি শহরের ত্রাস সৃষ্টিকারী ঋণ খেলাপি! ম্যানেজার সাহেবের অভিধানে খেলাপির নাম যদি ডাকু বীরাপ্পন হয় তবে আতংকের নাম হলেন ব্যাংকের বড়ো কর্তা। এই কর্তার ভয়ে তাকে সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হয়। বড়ো কর্তা কখন তলব করে বসেন সেই আতংকে গভীর রাতে শরীর ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে বীরাপ্পন ও বড়ো কর্তা রাক্ষস হয়ে ম্যানেজার সাহেবের উপর চড়াও হয়। তাকে হেনস্থার একশেষ করে ছাড়ে।
এই তো কয়েক বছর আগের ঘটনা। খেলাপিকে নিয়ে বড়ো কর্তার ঝাড়ি খেয়ে ম্যানেজার সাহেব বেজারমুখে ঘরে ফিরেছেন। ডায়াস্টোলিক নিচে নামার সংকেত দিচ্ছে। ঝাড়ির চোটে মাথা ঘুরছে। বউ যত্ন করে চিতল মাছের কোফতা করেছিল। কোফতার উপরে সুন্দর করে বেরেস্তা ছিটিয়ে দিয়েছে। ভাঁজা পেঁয়াজকুঁচিকে খুব সুন্দর লাগছে দেখে। হাত-মুখ ধুয়ে ম্যানেজার সাহেব খেতে বসলেন। স্ত্রী আদর করে কোফতার বাঁটি সামনে এগিয়ে দিলো। বেরেস্তা দিয়ে সাজানো কোফতা দেখে ম্যানেজার সাহেব ভেউ করে কেঁদে ফেললেন। তার কেন জানি মনে হলো বড়ো কর্তা ও ঘরের বউয়ের মাঝে কোনো তফাত নেই। বউ চিতল মাছের মাংস পিষে কোফতা বানিয়েছে আর বড়ো কর্তা সেলফোনে তাকে কোফতা করে পিষছে। ম্যানেজার সাহেবের কোফতা খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে গেলো। বড়ো কর্তার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মুখ থমথমে। হৃৎপিণ্ডে ডায়াস্টোলিকের চাপ। ওটা নিচে নামছে। বিছানায় শুয়ে ম্যানেজার সাহেব ডাকু বীরাপ্পনের কথা ভাবতে লাগলেন।
মাস ছয়েক আগে বীরাপ্পনের মেয়ের শাদি হয়ে গেলো। বড়ো কর্তা সহ ব্যাংকের সবাই সেই শাদি মোবারকে হাজির ছিলেন। শহরের নামকরা বাবুর্চি বিয়ের খানা পাক করেছিল। বড়ো কর্তা বহুমূত্রের রোগী। অথচ বীরাপ্পনের চাপে কব্জি ডুবিয়ে খেলেন। খাওয়া শেষে পাহাড়ি শহরে একটা সাফারির প্রয়োজন নিয়ে দুজনে বকবক শুরু করলেন। শহরের কিনারায় একফালি জঙ্গল এখনো কী-করে জানি টিকে আছে। ওসমান নাকি মাঝেমধ্যে সেই জঙ্গলে হানা দেয়। জংলী ফুল ও বানরদের সাথে খেলাধুলা করে। বীরাপ্পন বন-জঙ্গল বিশেষজ্ঞ। শহরের একমাত্র জঙ্গলটি সম্পর্কে অনেক খবর রাখে। তার কথা শুনে বোঝা গেলো সুযোগ পেলে সে ওখানে ঘোরাঘুরি করে। পাখি শিকারের খুব শখ তার। হয়তো সেই টানে জঙ্গলে ঢোকে।
শহরের একমাত্র জঙ্গলটি সত্যি আকর্ষণীয়। ওখানে গেলে দুর্লভ প্রজাতির হনুমানের দেখা মিলে। টেপি বাঘ, বাগডাশ, খেঁকশিয়াল ও ছোট প্রজাতির বাদামি ভালুক জঙ্গলের গভীর গুহাদেশে এখনো টিকে আছে। অজগর ও বিচিত্র প্রজাতির সাপ তো রয়েছেই। বীরাপ্পন চায় সাফারির সঙ্গে এই জঙ্গলকে ঘিরে কমসে-কম একটা ইকো পার্ক গড়ে উঠুক। সাফারির ভিতর দিয়ে ছোট আকৃতির ট্রেন চলবে। লোকে সেই ট্রেনে চড়ে জঙ্গলের গভীরে ঢুকে যাবে। টেপি বাঘ ও ভালুক দেখে চমকে উঠবে। গাছের ডালে পণ্ডিতমুখো হনুমানের লম্পঝম্প দেখে নিজেরা লম্পঝম্পের দিনে ফিরে যাবে। অতিকায় গাছের ডালে আজগর গুটলি পাকিয়ে অলস রোদ পোহাচ্ছে,-এই দৃশ্যটি তাদেরকে নিশ্চয় শিহরিত করবে।
ট্রেন যেহেতু চলবে, ইচ্ছে করলে হাতি-গণ্ডারের মতো অতিকায় প্রাণীকে সে-বনে চরানো যাবে। হাতির প্রিয় খাদ্য কলাগাছের অভাব হবে না সেখানে। জঙ্গলে বুনো কলাগাছের সঙ্গে হাইব্রিড কলাগাছের চাষ করা কঠিন কিছু নয়। চিত্রা হরিণ তো থাকছেই। ওদের খাবারের অভাব নেই বনে। জঙ্গলের ভিতরে ছোট ছড়া ও বড়োসড়ো একটি খাল রয়েছে। সুতরাং পানির জন্য ভাবতে হচ্ছে না। ভরা বর্ষায় ছড়া ও খালের পানি বনের চারধারে উপচে পড়ে। পাখিরা ফল ঠুকরে মাটিতে বীজ ফেলে। গাছেরা আপনা থেকে বাড়ে সেখানে। চাইলে নতুন গাছ লাগানো যাবে। খালে মাছ ও কুমিরের চাষ করা যেতে পারে। এতে জঙ্গলের বৈচিত্র্য আরো বাড়বে। খালের পারে জ্বলজ্যান্ত কুমির রোদ পোহাচ্ছে,-এই দৃশ্য দেখার রোমাঞ্চই আলাদা। বনে পাখ-পাখালির অভাব নেই। পর্যাপ্ত খাবার নিশ্চিত করা গেলে আরো জোটানো যাবে। এবং এভাবে একদিন বাঘ মামাকে সেই বনে ছেড়ে দেয়া হবে। হরিণের পেছনে ধাবমান ডোরাকাটা দেখে দর্শক শিহরিত হবে।
ওটা আসলে প্রেম নয়, ওটা হচ্ছে ক্রোধ। অক্কা-পাওয়া ভূতেরা ক্রোধের আগুনে পুড়ছে। তাদের চোখে ম্যানেজারকে পুড়িয়ে মারার নেশা প্রবল হতে চলেছে। মুখে গালাগালির তুবড়ি ছুটছে। সারা ঘর জুড়ে ভূতনৃত্যের হল্লা শুরু হয়।
এখানেই শেষ নয়। ট্রেনের ধার ঘেঁষে হাতির পাল চলবে। প্রমত্ত গণ্ডার বুনো বিক্রমে মাটি কাঁপিয়ে ছুটবে। অনেকে হয়তো জানে না অতিকায় এই জীবটি আগুন নেভাতে ওস্তাদ। কোথাও আগুন জ্বলছে টের পেলে সে মাটি কাঁপিয়ে ছুটবে। পায়ের প্রমত্ত চাপে আগুন মাড়াই করবে। গণ্ডার আগুন জ্বালানো একদম পছন্দ করে না। একমাত্র দাবানল ছাড়া আগুন দেখে ডরে না। রোমাঞ্চ পিপাসুদের জন্য জঙ্গলের নিরাপদ অঞ্চলে ক্যাম্প ফেলার সুযোগ থাকবে। গণ্ডারের আগুন নেভানোর খেলা দেখার ব্যবস্থা থাকবে। ক্রমে সকল প্রজাতির পশু-পাখি ও কীট-পতঙ্গকে সেখানে ছেড়ে দেয়া হবে। সাফারিটি রকমারি প্রাণী ও উদ্ভিদের ভাণ্ডারে পরিণত হবে। ট্রেন ও হাতির পিঠে চড়ে মানুষ জঙ্গল ভ্রমণের রোমাঞ্চে আমোদিত হবে!
শহরের একমাত্র জঙ্গলকে ঘিরে ডাকু বীরাপ্পনের প্রকাণ্ড পরিকল্পনা শুনে বড়ো কর্তা ততোক্ষণে বাকহারা হয়ে পড়েছেন। তাকে আরো বাকহারা করতে ডাকুটি এবার নূহ নবির কাহিনী শোনায়। তার বিশ্বাস অপূর্ব এই আয়োজন দেখে লোকের তাক লেগে যাবে এবং ভবিষ্যতে এই সাফারিকে তারা নূহ নবির নৌকার সাথে তুলনা করবে। পৃথিবী ডুবিয়ে দেয়ার আগে আল্লা নূহ নবিকে ডেকে অতিকায় এক নৌকা তৈরির আদেশ করেন। সেই নৌকায় পৃথিবীর সমুদয় প্রাণীর একটি করে জোড়া রাখার নির্দেশ দেন। আল্লার কথামতো নূহ নবি একজোড়া করে প্রাণী নৌকায় উঠায়। পৃথিবী পানিতে ডুবে গেলো। অবিশ্বাসী জাতি ও দুষ্ট লোকেরা উত্তাল তরঙ্গ সহ্য করতে না পেরে ধ্বংস হলো। পানির অথৈ সায়রে নূহের নৌকাটি শুধু ভাসছে। উঁচু পাহাচূড়ায় সেটা আটকে যায়। অথৈ পানির সায়রে নূহ অবশেষে ডাঙ্গার দেখা পেলো! নৌকা থেকে সকল প্রাণীকে ডাঙ্গায় নামানো হয়। পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন থাকে আল্লার আদেশে।
বীরাপ্পনের ইচ্ছা অনেকটা সেরকম। শহরের একফালি জঙ্গলকে সকল জাতের প্রাণী ও উদ্ভিদের নৌকা করে গড়ে তোলা। এখন বড়ো কর্তা যদি সাহায্য করেন তাহলে বাকি কাজটা এগিয়ে যাবে। মন্ত্রী, এমপি ও মেয়র সাহেবের এতে আপত্তি নেই। মহতি এই পরিকল্পনায় উনারা খুশি মনে সম্মতি দিয়েছেন। জঙ্গলটি বীরাপ্পনকে লিজ দিতে কারো আপত্তি নেই। সাফারি ও ইকো পার্কের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে শর্ত-সাপেক্ষে অনুদান বরাদ্দ করা হবে। স্বচ্ছতা বজায় রাখতে সরকার নিজে এর অংশীদার থাকবেন। সংবাদ সম্মেলন করে প্রকল্পের সমস্ত খুঁটিনাটি শহরবাসীকে জানানো হবে। তবে আরো অর্থ প্রয়োজন। এখন বড়ো কর্তা উৎসাহী হলে কাজটা দুর্বার গতিতে আগানো সম্ভব।
বীরাপ্পনের অভিনব চিন্তা ও বাক্যজালে ব্যংকের বড়ো কর্তার চোখে ঘোর লেগেছে। তিনি আড়ষ্ট ও অভিভূত হয়ে পড়েছেন। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। একজন পেশাদার ব্যাংক কর্মকর্তার ভাব ধারণ করে কথা বলতে চাইলেও ডেলিভারী হচ্ছে না। ফলে মৌন ঋষি হয়ে চেয়ারে আটকে গেছেন। একে জমিয়ে খেয়েছেন, তার উপর বীরাপ্পনের সঙ্গে দীর্ঘ জঙ্গল সফরে বেরিয়ে চোখের সামনে হাতি-বাঘ-গণ্ডার ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। সিলিংয়ের ঝাড় বাতিকে মনে হচ্ছে শিরিষ গাছ। গাছের ডালে অজগর ঝুলছে। বীরাপ্পনকে ডোরাকাটা এক বাঘ মামা বলে ভ্রম হচ্ছে। বাঘটি তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে জঙ্গলে এনেছে। এখন হালুম করে ঝাঁপিয়ে পড়বে। নিজেকে বাঁচাতে ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে ‘না’ বলে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকেন।
বড়ো কর্তার এই ‘না’ ধ্বনিটি কেউ শুনতে পায় না। সবাই তখন ডাকু বীরাপ্পনের সঙ্গে সাফারির গভীরে ঢুকে পড়েছে। তাদের সমুখ দিয়ে হাতির পাল চলছে। অদূরে খালের ধারে অতিকায় কুমির বুনো এক মহিষের পায়ে কামড় বসিয়ে দিয়েছে। কুমিরের দাঁতে প্রচণ্ড শক্তি। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক কুমির কামড় দেবার সময় প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার পাউন্ড শক্তি প্রয়োগ করে। তার এই দানবীয় কামড়ে শক্ত হাড্ডি চুরমার হয়ে যায়। যদিও কামড়টা কুমির না বীরাপ্পন দিচ্ছে সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় না। বিয়ে খেতে আসা ব্যাংক কর্মচারীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বীরাপ্পনকে শ্রবণ করছে। টাকার বাণ্ডিল ও ছেঁড়া নোট গুনে ক্লান্ত সুন্দরী টেলার খিল খিল করে হাসছে। চপলা রমণীকে দেখে বোঝা যাচ্ছে ডাকু বীরাপ্পনের প্রেমে পড়তে ওর বেশি বাকি নেই।
ম্যানেজার সাহেবের অবস্থা সুবিধার নয়। চঞ্চলমতি টেলারের হাসি তাকে চাঙ্গা করতে পারছে না। বাচ্চা মেয়েটিকে ধমক দিয়ে থামানোর শক্তি দেহে অবশিষ্ট নেই। বড়ো কর্তা স্ট্যাচু হলেন দেখে নিজে কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। চির অভ্যস্ত ‘স্যার উঠুন’ শব্দটা মুখ দিয়ে বেরুতে চাইছে না। আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়েছেন। ডাকু বীরাপ্পন দুই আঙুলে চুটকি বাজিয়ে ম্যানেজার সাহেবকে কাছে বসতে ইশারা করে। ম্যানেজার তার পাশে গিয়ে বসেন। বীরাপ্পনের ডানে বড়ো কর্তা বসে রয়েছেন। সুখাদ্য ও সাফারি-ভ্রমণের আবেশে দুলছেন। বামে স্বয়ং ম্যানেজার সাহেব বসেছেন। মুখ ভার করে ডাকুটার খেলাপি-অংকের হিসাব করেন। সেলফোনের তিতকুনী ক্যালকুলেটারে ডিজিট কম থাকে। সুতরাং হিসাবে ভুলভাল হচ্ছে। ম্যানেজার সাহেব ডায়াস্টোলের নিম্নগতির আশংকায় কাতর হয়ে পড়েন।
ডাকু বীরাপ্পন দুই হাতের ডানা দিয়ে বড়ো কর্তা ও ম্যানেজার সাহেবকে আকর্ষণ করে। তার চওড়া হাতের আকর্ষণে দুজনে মাথা নিচু করেন। বীরাপ্পন নিজেও মাথা নিচু করে ফেলে। দেখলে মনে হবে তিন সাঙাত মিলে ব্যাংক ডাকাতির শলা-পরামর্শ করছে। বীরাপ্পনের গালের সঙ্গে বড়ো কর্তা ও ম্যানেজার সাহেবের গাল প্রায় লেগে রয়েছে। ডাকুর মুখে হাসির ছটা। চোখে বরাভয়। কানের পাশে নিচু স্বরে শিস বাজায়:-
‘ও স্যার, আপনারা ডরাই গেলা নি। এই ইনভেস্টে লাভ ডাবল। ইন্টারেস্ট দুই পার্সেন্ট বেশি ধরলে ক্ষতি নাই। যে লাভ অইবো আমার বাকিসিকি শোধ অই যাইবো। আমি বাঘের বাচ্চা। আপনারা বিলাই অইলে চলবো কেমনে!’
বীরাপ্পনের সাহসী-বচনে বড়ো কর্তার ঘোর কিছুটা কাটে। কাষ্ঠ হেসে মাথা ঝোঁকান। ডাকুর বলিষ্ট হাতের চাপ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মনমরা হয়ে পড়েন। বীরাপ্পনের অতীত কীর্তি-কাহিনী হয়তো মনে পড়ে যায়। ডাকুকে মলিন মুখে প্রপোজাল জমা দিতে বলেন। তার সঙ্গে করমর্দন সেরে গাড়িতে উঠেন। ম্যানেজার সাহেব স্যারের পিছু নেন। তার ডায়াস্টোল এখন নিম্নগামী। মাথাটা বন-বন করে ঘুরছে।
দুজনকে এগিয়ে দেয়ার সময় বীরাপ্পন ম্যানেজারের কান পাকড়াও করে। ফিসফিস করে কানে শিস বাজায়:-
‘ও ম্যানেজার সাব, বিলাইর লাখান মিউ-মিউ করিয়া লাভ কিতা। বাকিসিকি আমি শোধ দিতাম নায়। চাইলেও দিতে ফারতাম নায়। লস খাইছি। মেয়ের বিয়া দিছি। আত খালি। আফনে আমারে কিতা করবা? জেলে দিবা? জায়গা-সম্পত্তি ক্রোক করবা? ইতা আমি ডরাই না। ফকির থাকি আমির অইছি। আবার ফকির অইমু। অসুবিধা নাই। মাঝখান থাকি লস আফনার। উকিল বেটার পকেট ভারী করবা আর প্রমোশনের বদলা ডিমোশন খাইবা। আপনার তো লো প্রেশার হুনছি। ওইটা আরো লো করিয়া লাভ কিতা। ভাবীরে খামোখা কান্দাইবা। বড়ো স্যার আইজ আছইন কাইল নাই। ঝামেলা দেখা দিলে ভাগা মারবা। সব দায় চাপবো আফনার উফরে। আফনে তো চাইলেও ভাগা দিতে ফারতা নায়। আমারে সুযোগ দেইন। ব্যবসা অইছে বাজির ঘোড়া। বাজি খেলতে গেলে ঠিক ঘোড়া চিনা লাগে। ঘোড়ারে বিশ্বাস করা লাগে। আফনে মিয়া ঘোড়া চিনইন্ না। ইতার লাগি আফনার প্রমোশন আটকি থাকে। আমারে নিয়া খেলতে অইলে বাজি ধরা শিখতে অইবো। প্রপোজাল আমি দিমু। আফনে আগ্ বাড়ইন।’
বীরাপ্পনের ‘নূহের নৌকা’ নামের প্রপোজাল অবশ্য উপর মহলের অনুমতি পায়নি। উলটো তাকে দৌড়ানোর চাপ প্রবল করতে ম্যানেজারকে নির্দেশ দেয়া হয়। খেলাপিটা ভীষণ চালাক। এতো দৌড়ে কোনো লাভ হচ্ছে না। মাঝখান থেকে কোর্ট-কাছারির খরচ বাড়ছে! সব মিলিয়ে প্রচণ্ড এক চাপের মধ্যে বড়ো কর্তার এই ঝাড়ি ম্যানেজার সাহেবকে বিকল করে ফেলে। চিতল মাছের কোফতা কুৎসিত লাগে। বিছানায় শুয়ে ঘুম আসে না। বীরাপ্পনের উপর ভীষণ রাগ হয় তার। বিছানায় শুয়ে মিটিমিটে শয়তানটার গোষ্ঠী উদ্ধার করেন। সরলমনা স্ত্রী স্বামীকে বিড়বিড় করতে দেখে মনে-মনে চিন্তিত হয়ে পড়ে। এই জীবনে যতো সূরা-কলমা শিখেছে সেগুলো পড়ে স্বামীর বুকে ফুঁ দেয়। স্ত্রীর এই আদিখ্যেতায় ম্যানেজার সাহেবের মেজাজ আরো বিগড়ায়। শরীর ঘুরিয়ে ঘুমের ভান করেন। ইচ্ছে করে নাক ডাকান। ফুঁয়ে কাজ হয়েছে মনে করে স্ত্রী চোখ বন্ধ করে। স্বামীর মতিগিতি সুবিধের নয় বুঝে বাপের বাড়ি যাবার প্রসঙ্গ স্থগিত রেখে ঘুমের রাজ্যে ঢুকে পড়ে।
স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়লে ম্যানেজার সাহেব নিজেও ঘুমানোর চেষ্টা করেন। অমাবস্যার রাত ছিল সেটি। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জানলার ফাঁক গলে ঘরে অন্ধকার চুঁইয়ে পড়ছে। ঘুম ‘আসবো-আসবো’ করছে, হঠাৎ মনে হলো কে যেন জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে। হাতের ইশারায় তাকে ডাকছে। ম্যানেজারের মনে হলো চোখে ভুল দেখছেন। চোখ কচলে ভালো করে তাকালেন। না, ভুল নয়। জানালা দিয়ে সত্যি কেউ মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে। ম্যানেজার ভাবলেন ওটা হয়তো ওসমান হবে। রাক্ষসটি সম্ভবত শোবার ঘরের সঙ্গে রান্নাঘরকে গুলিয়ে ফেলেছে। চিতল মাছের কোফতাকে মাংস ভেবে তার ঘরে হানা দিয়েছে। অথবা ওটা বিড়াল হতে পারে। পাশের বাড়ির পেশকার সাহেব ভীষণ বিড়াল ভক্ত। তার বাড়িতে সারা বছর মাছ-মাংসের ধুম লেগে থাকে। জায়গা-জমির ঝুট-ঝামেলা ও কোর্ট-কাছারিতে বিরক্ত লোকজনের ভিড়ে বাড়িটি গমগম করে। তদবিরকারী লোকেরা থলে ভর্তি রুই-বোয়ালের পেটি নিয়ে আসে। গরু ও খাসির মাংসে ফি বছর ফ্রিজ বোঝাই থাকে। পেশকার সাহেব খাদ্য ও পশু প্রেমী। আট-দশটা বিড়াল পোষেন। এঁটোকাঁটা ওরাই সাবাড় করে। খাঁচায় ময়না পোষেন শখ করে। ময়নাটা ভারি বাচাল। পেশকার সাহেবকে দেখলে হাঁক দিয়ে ওঠে,-‘টেকা মাটি, মাটি টেকা। মিল-মহব্বত আসল কথা।’
পেশকার সাহেব পাখিপ্রেমী। ময়নার বাচালতায় মৃদু হাসেন। ওটাকে ছোলা ও লঙ্কা খাওয়ান। তিনি এই শহরের সুখী মানুষের একজন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। বিড়ালের খবরা-খবর করেন। ময়নার যত্ন নেন। আত্মীয় ও প্রতিবেশী অসুস্থ হলে তার বাড়িতে খাবার পাঠাতে ভুল করেন না। ম্যানেজার সাহেবকে টেনশন করতে মানা করেন। বীরাপ্পনকে নিয়ে তার দৌড়ঝাঁপ দেখে কানে-কানে পরামর্শ দেন:-
‘ম্যানেজার সাব, একটা কথা কই আফনারে, ওই ডাকুর পিছে পুলিশ-মামলা দিয়া লাভ নাই। তার জায়গা-জমি চৌদ্দ আনা ভেজাল। সম্পত্তি ক্রোক করতে গিয়া উলটা আফনারা ক্রোক অইবা। এক ভেজাল থাকি আরেক ভেজালে গিয়া ফরবা। আমি কই, আফনে তারে মহব্বত দিয়া বশ করইন। ডাকু কিন্তু ব্যবসা জানে। লস খাইলে লস পুরা করতে জানে। তারে একটু সময় দেইন। একটা কথা মনে রাখবা,- টাকা মাটি, মাটি টাকা। মিল-মহব্বত আসল কথা।’
ঘুটঘুটে আমাবস্যায় জানালার বাইরে রহস্যময় মুখ উঁকি মারার সময় পেশকার সাহেবের কথা ম্যানেজারের মনে পড়ে। এই বয়সে লোকটার রক্তচাপের ব্যামো নেই। বহুমূত্র নেই। কব্জি ডুবিয়ে খেতে পারে। কী সুখী ও নিশ্চিন্ত একটা মানুষ! নিশ্চয় নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। অথচ তার ঘুম আসছে না। উলটো জানালার বাইরে কে যেন উঁকি মারছে। তাকে হাত দিয়ে ডাকছে। আচমকা তার স্মরণ হয় বিড়ালের হাত থাকে না। মানুষ ও রাক্ষসের থাকে। ভূতের থাকতে পারে। তবে কী ভূত! ম্যানেজার সাহেবের বুক ভয়ে ঢিপঢিপ করে ওঠে। বিছানা থেকে আস্তে করে উঠে পড়েন। জানালার নিকটে গিয়ে দাঁড়ান। সাহস করে জানালাটি খুলে দেন। ফিসফিসে কণ্ঠে হাঁক দিয়ে উঠেন,-‘কে? কে ওখানে?’ পরিচিত কণ্ঠ তাকে এবার আশ্বস্ত করে,-‘ম্যানেজার সাব, আমি আফনার বীরাপ্পন।’
গভীর নিশীথে ডাকু বীরাপ্পনকে কথা বলতে শুনে ম্যানেজার সাহেবের কলজে শুকিয়ে আসে। ডাকুটা তার শোবার ঘরে পৌঁছে গেছে দেখে হতবাক হয়ে পড়েন। এটা কী করে সম্ভব! আঙুলের নখ দিয়ে হাতে চিমটি কাটেন। চোখ কচলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। সাদা কাপড়ে মুখ-ঢাকা লোকটি আসলে বীরাপ্পন কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কাঁপা হাতে তার মুখের কাপড় তুলে ধরেন। ম্যানেজার সাহেবকে অবাক করে বীরাপ্পন মৃদু হাসে। ডাকুটি রাত-বিরেতে উৎপাত করছে দেখে ম্যানেজার সাহেবের মনে প্রচণ্ড বিস্ময় ও বিরক্তি জাগে। স্ত্রী এখন গভীর ঘুমে। কিছু টের পাওয়ার অবস্থায় নেই। নিজেকে তিনি সামলে নেন। গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করেন:-
‘আফনে! এতো রাতে আমার জানালার বাইরে কিতা করইন? মাথা খারাপ অইছে নি আফনার?’ বীরাপ্পন হাত দিয়ে ম্যানেজার সাহেবের মুখ চেপে ধরে,-‘আস্তে। আফনে দেখি ভাবীরে ঘুম থাকি তুলি দিবা।’ ম্যানেজার সাহেবের বিরক্তি ও বিস্ময় কাটতে চাইছে না। উত্তেজিত কণ্ঠে আবার ফিসফিস করে উঠেন,-‘ভাবীর কথা বাদ দেইন। ঘুমের ওষুধ খাইছন। ঘরে ডাকাইত ফরলেও টের পাইতা নায়। কিন্তু আফনে ইখানো কেনে? আমার বাড়ির ভিতরে এতো রাইত কিতা করইন? আজব তো!’
ম্যানেজার সাহেবের বিস্ময়ে বীরাপ্পন বিচলিত হয় না। উলটো তার হাতটি নিজের মুঠিতে চেপে ধরে। হাতে ভারী একটা ব্যাগ ধরিয়ে দেয়। ব্যাগটি কাগজপত্রে ঠাসা। ম্যানেজার সাহেব বোকার মতো ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। অমাবস্যার রাতে এমন উদ্ভট কাণ্ডে তার মাথা শূন্য হয়ে পড়েছে। বীরাপ্পন গলার স্বর আরেকটু নিচু করে:-
‘ম্যানেজার সাব, মাথা ঠাণ্ডা করি হুনইন, শহরে আর্মি নামছে। ব্রিগেডিয়ার পিয়ার মোহাম্মদে আমার বাড়ি রেইড দিছে। আমি এখন ভাগা দিরাম। যাইবার আগে মনে অইলো আফনার লগে দেখা করি যাই। ম্যানেজার সাব, আমি জানি আফনে আমার উফরে বিরক্ত। আফনারে অনেক ত্যক্ত করছি। হাছা কথা কইলে আমি মানুষটা খারাপ না। ব্যাগে জায়গা-জমির কিছু দলিল আছে। ভেজালি জায়গা নায়। ‘নূহের নৌকা’র লাগি নিজের হাতে বায়না করছি। উকিল দিয়া ব্যাংকের নামে মুসাবিদা করাইছি। এখন আফনারে দিয়া যাইরাম। এই জায়গার দামে ব্যাংকের টেকা উসুল অই যাইবো। বড়ো স্যাররে আমার সালাম দিবা। যদি বাঁচি, আবার দেখা অইবো।’
ম্যানেজার সাহেবের ডায়াস্টোল আবার নিচে নামছে। গলার স্বর খাদে নেমে গেছে। ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বীরাপ্পনকে জিজ্ঞেস করেন,-‘আফনে কই যাইরা?’ বাইরে তখন সাইরেন বাজছে। শহরে হঠাৎ জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। আর্মি কনভয় ও সাজোয়া ট্যাংক ছাড়া রাস্তায় কোনো জনপ্রাণী নেই। সার্চ লাইটের আলো চারধারে ঘুরছে। যে কোনো মুহূর্তে এই আলো ম্যানেজার সাহেবের একতলা বাড়ির জানালা বা ছাদে এসে পড়তে পারে। বীরাপ্পন সেটা অনুমান করে দ্রুত উত্তর করে:-
‘ম্যানেজার সাব, জীবনে আমি বহুত্ ম্যানেজারের চেম্বারে বইছি। বহু ম্যানেজার আমার পিছে লাইন দিছে। তারারে আমি নাকো দড়ি দিয়া ঘুরাইছি। তারা ধান্ধাল। তারার লগে আমিও ধান্ধা করছি। কিন্তু আফনারে দেখিয়া মায়া লাগে। আফনে মানুষ ভালা। আমার থাকি সুবিধা নিতে ফারতা। কিন্তু নিছইন না। উলটা নিজে পেরেশান অইছইন। আফনারে বিপদে রাখিয়া গেলে দিলে শান্তি মিলতো নায়। তাই জানের ঝুঁকি নিয়া দেখা করছি।’
বীরাপ্পনের চোখে তখন অশ্রু জমেছে। ডাকুটি কাঁদছে দেখে ম্যানেজার নিজে আবেগ বোধ করেন। ওর জন্য মায়া হয়। সার্চ লাইটের আলো ক্রমে পেশকার সাহেবের বাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ম্যানেজার সাহেবের বাড়ির প্রায় নিকটে ওটা পৌঁছে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে জানালায় আছড়ে পড়তে পারে। সেই ঝুঁকি মাথায় নিয়ে বীরাপ্পনের হাত চেপে ধরেন,-‘আফনে কই যাইরা কইয়া যাইতে অইবো। এতো রাইত যাইবা কই? আর্মি আফনারে এরেস্ট করবো। আমি পাকঘরের দরজা খুলি দিরাম। আফনে পেছনের দরজা দিয়া পাকঘরে ঢুকি যাইন। পরে সময় বুঝি হরি যাইবা।’
ম্যানেজারের আশ্বাসবাক্যে বীরাপ্পন হাসে:-
‘না ম্যানেজার সাব। ভাবীরে ত্যক্ত করি লাভ নাই। আমি জানি আফনারা আমারে ডাকু বীরাপ্পন কইয়া ডাকইন। এক কালে আমি ডাকু আছ্লাম। মুক্তির সময় লোকের ঘরবাড়ি লুট করছি। ব্যাংক লুট করছি। আমারে ধরার সাহস কুনু বেটার অয় নাই। সাদা পাঞ্জাবি পরি। দাড়ি লম্বা করছি। আফনাদের সাথে মাতকথার ভাও খিকছি। আমারে কেমনে ধরবা! কিন্তু এক জায়গাত্ আমি ধরা। কেউ না জানুক, আমি জানি আমি কিতা। আমি যে ডাকু এই কথা আমি ভুলছি না। আইজ আবার ডাকু অওয়ার টাইম অইছে। মানুষের ঘরবাড়ি ডাকাতির লোভ আমার নাই। পিয়ারে নিতে চায় নিবো। ডাকু কই থাকে আফনে জানইন। আমি অখন জঙ্গলে যাইরাম। এই জঙ্গলের গাছপালা আমি চিনি। পশু ও পাখ-পাখালিরে হাতের তালুর লাখান চিনি। মুক্তির সময় জঙ্গলে থাকার ট্রেনিং নিছি। পিয়ারের বাফোর ক্ষমতা নাই আমারে জঙ্গল থাকি খুঁজিয়া বাইর করে।
ম্যানেজার সাব, ওসমানরে আফনারা ধরতা ফারইন না। আমারেও ফারতা নায়। আমি নূহের নৌকায় যাইরাম। আল্লায় আমার মরণ অউ নৌকাত্ লেখছইন। বাঁচিয়া থাকলে আবার দেখা অইবো। আর যদি মরি যাই, জঙ্গলের ভিত্রে যে গুহা আছে হেই গুহায় আমারে পাইবা। এই গুহা অইছে আমার কবর। আমার মায়ে কইতা,-‘বাজান, মায়ের পেটের গুহা থাকি মানুষ বাইর অয়। মরলে পরে কবরে গিয়া হুতে। আল্লায় এক পেট থাকি বার করি আরেক পেটে ঢুকাইন। আমার অখন ঢোকার টাইম অইছে। দুনিয়ায় কিচ্ছু টিকে না ম্যানেজার সাব। ডাকু বীরাপ্পন টিকতো নায়। আমার মাইয়ারে কিছু কওয়ার দরকার নাই। খালি সময় করি তার খোঁজখবর নিলে মনে শান্তি পাইমু। মা নাই। বাফোর মায়া পাইতো নায়। কিতা আর করা! কপালের লেখা আমি খণ্ডাইবার কেউ নায়। জীবনের ঢং-তামাশা বহুত্ দেখছি। অখন জঙ্গলে গিয়া শেষ ঘুম দিমু। যাই ম্যানেজার সাব।’
ম্যানেজারকে হতবিহ্বল রেখে ডাকু বীরাপ্পন ঘুটঘুটে অন্ধকারে মিশে যায়। আর্মি কনভয় থেকে সার্চ লাইটের আলো ছাদে এসে পড়ে। সেখান থেকে টেরচাভাবে জানালার নিচ দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। শহর এখন জলপাই ট্যাংক ও কনভয়ের দখলে। জরুরি অবস্থার অধীনে। আর্মি নামছে টের পেয়ে মন্ত্রী সাহেব গা ঢাকা দিয়েছেন। এমপি ও মেয়র সাহেবের খোঁজ মিলছে না। মেয়রের প্রতিপক্ষরা কেউ বাসায় নেই। চেম্বার সভাপতি দিনে একবারের জন্য হলেও ঘরের বাইরে বের হননি। গ্রোসারি মার্চেন্টরা আর্মি নামছে শুনে আগেভাগে দোকানপাট গুটিয়ে নিয়েছে। গত কিছুদিন ধরে শহরে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। ক্ষমতার মসনদ নিয়ে পক্ষ ও প্রতিপক্ষে আবার কামড়া-কামড়ি লেগেছে। শহরে গুজব ছিল আর্মি নামছে। গুজব সত্যি হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে জলপাইরা ট্যাংক নিয়ে বের হয়েছে। বাড়ি ফেরার সময় শহরের এই থমথমে পরিস্থিতি ম্যানেজার সাহেবের চোখে পড়েছে বৈকি। বড়ো কর্তার ঝাড়ি ও বীরাপ্পনকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় মন আচ্ছন্ন থাকায় আমলে নেননি। এখন নিতে বাধ্য হলেন।
শহরে জলপাইদের হুটহাট নেমে পড়া নতুন ঘটনা নয়। এর আগে বহুবার এভাবে নেমেছে। আবার ব্যারাকে ফিরেও গেছে। সুতরাং ম্যানেজার সাহেব আর্মি কনভয়ের চেয়ে বীরাপ্পনকে নিয়ে অধিক চিন্তিত ছিলেন। দুশ্চিন্তার চোটে মুখ ভার করে বাড়ি ফিরেছিলেন। তার দুশ্চিন্তার অবসান ঘটেছে। বীরাপ্পন তাকে খেলাপির পিছনে অবিরাম দৌড়ঝাঁপ থেকে রেহাই দিয়েছে। খেলাপি বীরাপ্পন এখন ডাকু বীরাপ্পন হয়ে অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে। ব্রিগেডিয়ার পিয়ার মোহাম্মদের কনভয় তাকে খুঁজছে। পিয়ারের সামরিক হাঁটু তার দায়িত্ব পালনে নেমেছে। কান পেতে পক্ষ ও প্রতিপক্ষ নেতাদের পায়ের গতিবিধি আন্দাজের চেষ্টা করছে। নাগালে পেলে হাজতে ভরবে। গুলিও ছুঁড়তে পারে। শহরে সবাই জানে গুলি চালানোর সময় শত্রুর মুখের দিকে সে তাকায় না। তার চোখ পায়ের দিকে তাক করা থাকে। মনে হবে গুলিটা পায়ে ছুঁড়বে। হ্যাঁ, ছুঁড়তে পারে। কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে। ইতিহাস বলে, পিয়ারের চোখ শত্রুর পায়ে স্থির থাকলেও বুলেট বুক অথবা পিঠ ভেদ করে ঢোকে। বীরাপ্পনের পায়ের আওয়াজ সে এখনো টের পায়নি। পেলে ওই ডাকুর পিছু নেবে। তাকে হয়তো হাজতে ভরবে। পায়ে চোখ রেখে বুকে বুলেট ভরে দেবে। খেলাপি ডাকুর দিন শেষ হবে কোর্ট মার্শালে!
বীরাপ্পনের কথা ভেবে ম্যানেজার সাহেব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। জীবনে প্রথম কোনো ডাকুর জন্য তিনি এতোটা উদ্বেগ বোধ করছেন। ওর কথা ভেবে উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে আসছে। ডাকুটির জন্য মন ভার হয়ে আছে। সে কি পিয়ারের চোখ ফাঁকি দিতে পারবে? জাদরেল মিলিটারির শ্বাপদ-তীক্ষ্ণ কানটিকে ফাঁকি দিতে পারবে? সে কি পারবে নিজেকে শহরের বাইরে নিয়ে যেতে? শহুরে সভ্যতার কঠিন শিকল গলে জঙ্গলে ফেরত যেতে? বীরাপ্পন কি পারবে গহীন অরণ্যে নিজের ঠাঁই করে নিতে? সেখানে সমাধিস্থ হতে?
ম্যানেজার সাহেবের মনে প্রশ্নের ঝড় উঠেছে। ওদিকে মিলিটারি সাইরেনের দাপটে বাড়িঘর কাঁপছে। ওটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার হৃৎপিণ্ড দ্রিম-দ্রিম করে কাঁপে। আজানা শঙ্কায় মন ভার হয়। এই প্রথম কোনো ডাকু তাকে এতোটা বিচলিত করে তুলেছে। ঘুটঘুটে অমাবস্যায় জানালার সামনে দাঁড়া করিয়ে রেখেছে। নিরেট অন্ধকার ভেদ করে বীরাপ্পনের অন্ধকার তার উপর ঢলে পড়ছে। ম্যানেজার সাহেবের মনে হচ্ছে নিজের দোষে মানুষ ডাকু ও খেলাপি হয় না, তাকে ডাকু ও খেলাপি করে ঋণের চক্র। ঋণদাতার সুভাষিত প্রলোভনে মজে মানুষ উচ্চাকাক্ষী ও নিঃস্ব হয়। ঋণ এক সর্বনাশা প্রলোভন এবং বীরাপ্পন সেই প্রলোভনের শিকার। ঋণচক্রের ফাঁদে পড়ে মানুষ প্রলোভনের দেবতার কাছে মাথা ঠুকে মরে। সুদে-আসলে দেবতার রাক্ষুসে ক্ষুধার মূল্য চোকায়!
ম্যানেজার সাহেব জীবনে প্রথম নিজেকে রাক্ষস বলে চিনতে পারছেন। বুকের ভিতর রাক্ষসের অট্টহাসি শুনে শিউরে উঠছেন। অসংখ্য বীরাপ্পনকে ডাকু বানানোর ক্ষুধা সেখানে প্রবল হয়েছে। ঋণচক্রের ফাঁদে ফেলে কড়মড় করে চিবানোর সাধ জাগছে। অযুত বীরাপ্পন ম্যানেজার সাহেবের চারপাশে ভিড় জমিয়েছে। ঘোর অমাবস্যায় তাকে ঘিরে ফেলেছে। তারা আর ডাকু নেই। সিঁধেল চোর বনে গেছে। ডাকাবুকো হতে গিয়ে নিঃস্ব ও ছিঁচকে হয়েছে। ডাকু হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ঋণচক্রের প্রলোভনে ধরা দিয়েছিল। এখন ঋণের চক্রে ফকির হয়ে অক্কা পাচ্ছে!
অক্কা-পাওয়া ডাকুর দল ম্যানেজার সাহেবকে ঘিরে ফেলে। ঘোর অমাবস্যায় তাকে ঘিরে ভূতের মাতন শুরু হয়। ভূতেরা সমবেত কণ্ঠে গান ধরে,-‘একবার দাঁড়াও বন্ধু বহুদিনে পাইছি তোমার লাগ/দাঁড়াও নইলে প্রেমাগুনে করে দিমু খাক।’ ম্যানেজার সাহেবকে নাগালে পেয়ে ভূতের সমাবেশে প্রেমের আগুন ধিকি-ধিকি জ্বলছে। ওটা আসলে প্রেম নয়, ওটা হচ্ছে ক্রোধ। অক্কা-পাওয়া ভূতেরা ক্রোধের আগুনে পুড়ছে। তাদের চোখে ম্যানেজারকে পুড়িয়ে মারার নেশা প্রবল হতে চলেছে। মুখে গালাগালির তুবড়ি ছুটছে। সারা ঘর জুড়ে ভূতনৃত্যের হল্লা শুরু হয়।
ম্যানেজার সাহেব এখন একা। অসংখ্য বীরাপ্পনে তার ঘর ভরে উঠেছে। বাইরে পিয়ারের পাগলা সাইরেন বাজে। ঘরের ভিতরে বীরাপ্পনরা ম্যানেজারকে ঘিরে রাখে। তার দিকে আঙুল তুলে চিৎকার ছোঁড়ে,-‘তুই রাক্ষস।’ ঘরের বাইরে পিয়ারের পাগলা সাইরেন আরো জোরালো হয়। ভিতরে বীরাপ্পনদের চিৎকার আর্তনাদে গড়ায়। এটা আর্তনাদ নয়, এটা হলো প্রেতের হাহাকার। আমির থেকে ফকির হওয়ার হাহাকার। নিজের হৃদয় শূন্য ও রিক্ত হওয়ার হাহাকার।
সার্চ লাইটের আলো সবেগে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকতে চাইছে। ম্যানেজার সাহেবের আর সহ্য হয় না। তিনি ত্বরিত জানালা বন্ধ করেন। শ্লথ পায়ে বিছানায় উঠেন। ঔষধের প্রভাবে স্ত্রী এখন গভীর ঘুমে। পিয়ারের পাগলা সাইরেন ও সার্চ লাইট তাকে জাগাতে পারেনি। সরলা রমণী ঘুমের রাজ্যে ডুবে আছে। সার্চ লাইটে তার কিছু হয় না। পিয়ার ও বীরাপ্পনে থোড়াই কেয়ার করে। অযুত বীরাপ্পনের পেছনে ম্যানেজার সাহেবের দৌড়বাজি তাকে এতোটুক চিন্তিত করে না। স্বামীর রক্তচাপ নিম্নগামী হলে সে চিন্তিত হয়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে তার সারল্যমাখা দেহটি খেলাপি ঋণের ক্রীতদাসকে তড়িৎস্পৃষ্ট করে। ঘুমে নিমজ্জিত স্ত্রী লোকটি তাকে প্রভাবিত করে। স্ত্রীর বাহুতে হাত রেখে ম্যানেজার সাহেবের মনে হয় নিজের দাসত্বকে এবার ‘না’ বলবার সময় হয়েছে।