ওসমান সমাচার পর্ব ৫ । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ জুলাই ২০১৬, ১:০৩ পূর্বাহ্ণ, | ২৪৩০ বার পঠিত
ডাকু ও ক্যামেলিয়া : ফ্লেচার, খোক্কস ও বীরাপ্পন সমাচার (১)
নদীতীর থেকে আমরা আবার জংধরা মামুলি শহরে ফেরত এসেছি। মেয়র সাহেবের বাগানে নিজেকে বিচরণ করতে দেখছি। রাক্ষস ওসমানের খোঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে ছিলাম। বিলের ধারে তাকে পাইনি। শহরের অলি-গলি চষে হদিস মেলেনি। অবশেষে মেয়র সাহেবের বাগানে পৌঁছে গেছি। সেখানে ঢোকার পর থেকে ওসমানের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। সার্জন সাহেবের গালের কাটা দাগে তাকে আমরা ছায়া ফেলতে দেখেছি। ওসমান এখন বিলে নেই। বিলের বদলে বাগানে ঢুকেছে। সুঁই-ছুরি-কাঁচি নিয়ে সমানে আমাদের তাড়া করছে। এক জটলা থেকে আরেক জটলায় ঘুরে লুকোচুরি খেলছে। খুনিটার হাত থেকে বাঁচার জন্য সকলে মেয়র সাহেবের নিকটে চলে এসেছি। ফাদার রোজারিও, পূর্ণেন্দু বাবু ও জামে মসজিদের পেশ ইমাম সাহেবকে গল্প করতে দেখছি। উনারা মন খুলে বাতচিত করছেন। ওসমানকে নিয়ে তাদের মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না।
ওদিকে স্থাপনা সচিব ও ঠিকাদারের লেনদেন এখনো শেষ হয়নি। হিসাব-নিকাশের উত্তেজনায় শখের ধূমপায়ী স্থাপনা সচিব পরপর সিগারেট ফুঁকছেন। তার আঙুলের ফাঁকে সিগারেট জ্বলছে। আরেকটি এইমাত্র ধরালেন! সিগারেটখোর চেম্বার সভাপতির প্রভাবে মেয়র সাহেবও সিগারেটের ফাঁদে পড়েছেন। সরল মনে বিষ পান করছেন। তার স্ত্রী আশপাশে নেই। থাকলে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতেন। ধূমপানে হৃদযন্ত্র বিকল হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। স্ত্রীর চোখ ফাঁকি দিয়ে মেয়র সাহেব বিনে পয়সায় ধূমপানের সুখ করে নিচ্ছেন। উনি রাজনীতি করেন। রাজনীতি করতে হলে মাগনা খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করা জরুরি। মেয়র সাহেব সেটা ভালোই রপ্ত করেছেন। চেম্বার সভাপতি ব্যবসায়ী মানুষ। তার নীতি অন্যরকম। সভাপতি বিশ্বাস করেন মাগনায় পয়সা ডাবল। তিনি ইংরেজ-ভক্ত। ফুরসত পেলে ইংরেজরা কী করে শহরে চা পানের প্রচলন ঘটিয়েছে সেই গল্পটি করেন। তাকে দেখে গল্পটি মনে পড়ে যাচ্ছে।
এই শহরে লোকজন নাকি চা পান করতো না। চা গাছের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। পাহাড়ি এলাকায় গাছটি দ্রুত বাড়ে। ঢালু জমি পেলে লকলক করে বাড়তে থাকে। এমনকি চা গাছের আরেক নাম ক্যামেলিয়া,-শহরের লোকজন কোনোদিন সেটা জানার আগ্রহ বোধ করেনি। ক্যামেলিয়া কী-করে শহরে বাড়তে শুরু করে সেটি তাদের কখনো ভাবিয়ে তোলেনি। ক্যামেলিয়া কি চীন থেকে এখানে এসেছিল? য়ূয়ান্ চোয়াঙ্ বা হিউয়েন সাং কি শহর ঘুরতে এসেছিলেন? ইবনে বতুতা তার সফরনামায় দরবেশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন। পরিব্রাজকদের মধ্যে কেউ কি ক্যামেলিয়াকে সঙ্গে করে এই শহরে এসেছিলেন? দস্যি মেয়েকে টিলার ঢালু জমিতে রোপন করেছিলেন? নাকি এই ভূ-বর্ষ তার মাতৃভূমি ছিল? এইসব প্রশ্নে ইতিহাসবিদের আগ্রহ থাকতে পারে, কিন্তু শহরের লোকজন ইতিহাসে বরাবর কাঁচা। নিজের নাম পর্যন্ত কষ্ট করে মনে রাখে। দস্যি ক্যামেলিয়ার কথা ভাবার সময় কোথায়!
ক্যামেলিয়ার জন্য বিষয়টি অবশ্য সুখের ছিল। বুনো মেয়ে এই সুযোগে দুদ্দাড় করে বেড়ে উঠতে পেরেছে। জগতে অনেক বৃক্ষ আছে যারা রাক্ষস স্বভাবের। টনকে-টন পানি সাবাড় করে তাদের তৃষ্ণা মেটে না। ক্যামেলিয়া সেদিক থেকে চুজি। তার গোড়ায় পানি জমলে দস্যি মেয়ে কাহিল বোধ করে। সে হলো মডেলকন্যা। বিড়াল-ছন্দে হাঁটার আগে শক্ত ডায়েটিং করে। রাক্ষস প্রজাতির গাছের সঙ্গে তার তাই তুলনা চলে না। গাছের গোড়ায় পানি জমিয়ে চো-চো করে খাবার অসভ্যতা সে করবে না। পানির প্রবাহ তার ঢালু পাদদেশ দিয়ে ঝর্ণার মতো গড়িয়ে পড়ে। ক্যামেলিয়া আজলা-ভরে সেই ঝর্ণাধারা পান করে। যে-কারণে ঢালু জমি তাকে খুশি রাখে। টিলার উপর গেড়ে বসার সুযোগ পেলে গায়ে-গতরে ধিঙ্গি হয়ে ওঠে। আশপাশের লম্বা গাছের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মডেলকন্যার মতো লম্বুনী হওয়ার নেশায় মাতে। লম্বা ডাল হেলিয়ে-দুলিয়ে বিড়ালছন্দে দোলে। মডেলকন্যার দুলুনি দেখে অন্য গাছেরা আমোদ বোধ করে। সুন্দরী ক্যামেলিয়ার জন্য মনে-মনে কাতর হয়। আকারে-ইঙ্গিতে প্রেমের ইশারা জানায়। শাখা দুলিয়ে তালিয়া বাজায়।
অন্য গাছের সঙ্গে ক্যামেলিয়ার এই ফস্টিনস্টি নিয়ে শহরের লোকজনের সমস্যা ছিল না। মেয়েটা বাড়তে চাইছে তো বাড়ুক না। এতে অসুবিধার কী আছে! দস্যি মেয়েকে কেটেছেঁটে রাখলে কী ফল হয় সেটা তাদের জানার কথা নয়। জানবার প্রয়োজন পড়েনি। তবে ইংরাজ সায়েবরা সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছে। তাদের স্বভাব-চরিত্র অন্যরকম। কারণে-অকারণে সবকিছু নিয়ে টানাটানি করে। সায়েবদের এই বদ-খাসলতে শহরের লোকেরা বহুদিন থেকে অতিষ্ঠ হয়ে আছে। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। বলতে গেলে বিড়ম্বনা বাড়ে।লোকের কাছে সায়েবরা এক মুসিবত বটে! মুসিবতদের কৌতূহল অসীম। সবকিছু টেনেটুনে দেখার খাসলত তাদেরকে দুর্গম এই শহরে টেনে এনেছে। আসার পর থেকে আর যাওয়ার নামটি করে না! দিব্যি ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। লোকজনকে দিয়ে ধানের বদলে নীল চাষ করিয়েছে। অতিকায় রেললাইন বসিয়েছে শহরে। বড়ো-বড়ো দালান তুলছে। কোর্ট-কাছারি অব্দি দখল করে ফেলেছে। শহরে এখন সায়েবদের রাজত্ব চলছে।
বিলেতি সায়েবরা আজব বচনে কথা বলে। সেই বচন শিখানোর জন্য ইদানীং শহরের ছেলেপুলেদের নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে। তাদের অজুহাতের অভাব হয় না। বুদ্ধি খাটিয়ে একটা বের করে ফেলে। তাদের সঙ্গে আসলে পেরে ওঠার জো নেই। শহরে লোকজন অতো বুদ্ধিশুদ্ধি রাখে না। সকলে তাই সায়েবদের এক প্রকার মেনে নিয়েছে। তাদের টানাটানির বাতিকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ক্যামেলিয়াকে নিয়ে টানাটানি করছে দেখে লোকে তাই অবাক হয় না। তারা দেখে টিলাগুলো সাফ-সুতরো করার এন্তেজাম চলছে। মিশমিশে কালো রঙের মানবদল রেলগাড়ি ভরে শহরে ঢোকে। তারা স্থানীয় নয়। বিরাট ভূ-বর্ষের অন্য প্রান্তে দিন গুজরান করছিল। ওখানে টিকতে না পেরে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছে। সায়েবরা তাদের কুলি নামে ডাকে। কুলিরা টিলাগুলো সাফ-সুতরো করে। টিলার একপাশে শেড বসানোর কাজ শুরু হয়। সেখানে নাকি বীজতলা তৈরি হবে। সেই বীজতলায় ক্যামেলিয়ার চারা বুনবে এই কুলিরা।
দস্যি ক্যামেলিয়ার ধারণা ছিল না তাকে নিয়ে কী হতে যাচ্ছে! সে শুধু অবাক হয়ে দেখে বিলেতি সায়েবরা এবার তাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে। আর কুলি নামের কালো-কালো মানুষগুলো পরম আদরে তার ঝাঁকড়া চুল ছেঁটে দিচ্ছে। ক্যামেলিয়ার খুব কষ্ট হয়। চোখ দিয়ে টুপটুপ করে জল গড়িয়ে পড়ে। তার কষ্টে সায়েবের কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। আজব ভাষায় কুলিদের বকুনি দিয়ে চলে। হাতের লাঠি ঘুরিয়ে অং-বং ইশারা করে। ওর কাণ্ড দেখে ক্যামেলিয়ার খুব রাগ হয়। রাগের মাথায় ঝাঁকড়া ডাল নামিয়ে বিলেতির ঘাড়ে রদ্দি বসায়। বুনো ক্যামেলিয়ার আচমকা আঘাতে সায়েবের ঘাড়ের শিরা ফুলে ওঠে। সে রেগে যায়। কুলিদের হাত থেকে ধারালো কাঁচি ছিনিয়ে নিয়ে সপাং করে ক্যামেলিয়ার ঝাঁকড়া ডালে কোপাকোপি শুরু করে। পাষাণটার দিলে কেনো মায়া-দয়া নেই। কুলিরা ভয়ে মাথা নত করে ফেলে। কাঁচিটা তাদের হাত ফেরত দিয়ে সায়েব এবার নির্দেশ করে,-‘তুমরা দুই ঘণ্টা সময় পাইবে। এর মইদ্যে সব সাফ করিতে হইবে। দুই ঘণ্টার মইদ্যে কাজ শেষ না-করিলে রেশন বন্ধ থাকিবে।’
রেশন বন্ধ থাকার আতংকে কুলিরা এবার দ্রুত হাত চালায়। লম্বুনী ক্যামেলিয়া বেঁটেখাটো মেয়েতে রূপ নিতে থাকে। সায়েব আসে ঠিক দুই ঘণ্টা পরে। টিলা তখন দিনের মতো ফকফকা। সায়েব খুশিতে চিৎকার দিয়ে ওঠে,-‘সুনডর হইয়াছে। আজি হইতে এই বাগানে ক্যামেলিয়া রহিবে না। বুনো মেয়েরে আর ডাঙ্গর হইতে দিবো না। ওরে চা গাছে রূপ দিবো। বুনো হইতে সভ্য করিবো। এখন হইতে এই টিলায় চা গাছের আবাদ হইবে। তুমরা শেড তৈয়ার করো। বীজ ফেলিতে হইবে। আজি হইতে এই টিলারে লোকে ফ্লেচার সায়েবের বাগান কহিয়া ডাকিবে। তুমরা এই বাগানের যত্ন করিবে। এইখানে ঘরবাড়ি তুলিয়া থাকিবে। শহরের লোকজনের সহিত মিলামিশার প্রয়োজন দেখি না। উহারা বজ্জাত। তুমরা এই বাগানের ভিতরে থাকিবে। ক্যামেলিয়ারে চা গাছ হইয়া উঠিতে সাহায্য করিবে। বিনিময়ে রেশন পাইবে। সপ্তাহে একদিন তনখা দিবো। যাও শেড তৈয়ার করো।’
ইংরেজ সায়েবের দৌলতে দস্যি ক্যামেলিয়া এভাবে চা গাছে পালটে যায়। লম্বুনী মডেলকন্যা থেকে বামন-সুন্দরী হয়ে পড়ে। তার মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। খোঁপায় কচি পাতার কুঁড়ি গোঁজা। শহরের লোকজন দেখে টিলাগুলো আর জংলী নেই। সায়েবের টানাটানির সুবাদে বাগান হয়ে উঠেছে। ঘনীভূত এক সবুজে শৃঙ্খলিত হয়েছে। তাদের মনে পড়ে ইংরেজরা শৃঙ্খলার পূজারী হয় বটে! ঘন সবুজের শৃঙ্খলাটি দেখতে ভালোই লাগছে। সায়েব এখন নিয়ম করে টিলায় টহল মারে। কুলিরা ছোট-ছোট শেডে চা গাছের বীজ বুনেছিল। চারাগুলো পল্লবিত হয়ে বাতাসে দোলে। শেড থেকে কচি চারা উঠিয়ে টিলার ঢালু জমিতে তারা রোপন শুরু করে। বছরভর পানি ও সার দেয়। পোকা মারার ঔষধ ছিটায়। কাঁচি দিয়ে বাড়তি ডালপালা ছাঁটাই করে। দস্যি ক্যামেলিয়া বামন-সুন্দরী হয়ে লোকের মনোহরণ করে।
ক্যামেলিয়া এখন বামুন-সুন্দরী হয়ে গেছে। তার খোঁপায় কচি পাতার কুঁড়ি ফুটেছে। কুলি রমণীরা দুই আঙুলের আলতো চাপে কুঁড়ি ছিঁড়ে ঝুড়িতে ভরে। বাগানের ভিতরে বিরাট আকৃতির যন্ত্র বসানো হয়েছে। সায়েবরা বলে এটা নাকি ফ্যাক্টরি। কচি পাতারা সেই ফ্যাক্টরিতে পিষে গুঁড়ো হয়। চা নামের পানীয় হয়ে ওঠে। কুলিরা চায়ের গুঁড়ো প্যাকেট ও বাক্সবন্দি করে। রেলগাড়ি করে চায়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ে সারা ভূ-বর্ষে। জাহাজে করে প্রমত্ত নদী ও সাগর পাড়ি দেয়। সায়েবদের সবকিছু ভীষণ সুশৃঙ্খল। নিয়ম দিয়ে সাজানো। এটাকে তারা সভ্যতা বলে ডাকে। শহরের লোকজন তাদের সভ্য কাজ-কারবার দেখে চমৎকৃত হয়।
চেম্বার সভাপতির সক্রিয়তা দেখে বোঝা যায় ‘মাগনায় পয়সা ডাবলের’ নীতি প্রয়োগ করে কিছু একটা ঘটাবেন। তিনি কামিল লোক। তার থলে থেকে কখন কী বের হয় কে জানে!
চমৎকৃত হলেও লোকজন চা পানে আগ্রহ বোধ করে না। তবে সায়েবরা যেখানে আপদ বাড়ে সেখানে। তারা এবার উৎপাত শুরু করে। এইবেলা তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। লোকজনকে তারা বোঝাতে চাইছে বামন-সুন্দরীর পাতা থেকে চমৎকার এক পানীয় হয়। পানীয়টি অত্যন্ত সুস্বাদু। স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এটা টনিকের কাজ দেয়। এর লিকার পান করলে মন প্রফুল্ল ও সতেজ থাকে। কাজকর্মে উৎসাহ দ্বি-গুণ হয়। শহরের লোকজন তবু চা পানে উৎসাহিত হয় না। আজব এই পানীয় নিয়ে তাদের মনের ভয় ও সংশয় ঘোচে না। তারা ভাবে এটা হয়তো সায়েবদের নতুন কোনো চাল। শহরবাসীকে বশে রাখতে চায়ের নেশা ধরাতে চাইছে। শহরবাসী নীরবে অসহযোগ গড়ে তোলে। সায়েবদের শত প্রলোভনে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে রাজি হয় না। পেয়ালা বাড়িয়ে দিলে আলগোছে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যেন চা নয়, ক্যাস্টর অয়েল পান করতে বলা হচ্ছে তাদের!
সায়েবদের এভাবে নিরাশ করতে পেরে শহরবাসীর মনে খুশির অন্ত থাকে না। এই প্রথম নিজেকে তারা চালাক ভাবতে পারছে। সায়েবরা কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। তারা টেটন প্রকৃতির লোক। নিজেকে সায়েব ও শহরবাসীকে নেটিভ বলে ডাকে। নেটিভকে বশ করার একশো কায়দা জানে। সুতরাং নেটিভের নেংটি ধরে টানাটানি না-করে অন্য পথ ধরে। বিরাট প্যান্ডেল বাঁধে শহরে। প্যান্ডেল দেখে শহরবাসী সেখানে জড়ো হয়। তারা অবাক হয়ে দেখে প্যান্ডেলের ভিতরে মানি-গুণী লোকেরা ঘোরাফিরা করছেন। রায় ও খান বাহাদুর আগেই চলে এসেছেন। ডেপুটি মেজিস্ট্রেট থেকে শুরু করে দারোগা সাহেব অব্দি প্যান্ডেলে ভিড় করেছেন। এমনকি ভটচাজ পুরোহিত ও জামে মসজিদের ইমাম সাহেব চলে এসেছেন। শহরের মানগণ্য লোকজনকে প্যান্ডেলে জড়ো হতে দেখে শহরবাসীর চমক লাগে। মনে আশঙ্কা ঘনায়। তাহলে কি সায়েবরা মানি-গুণী লোকজনকে বশ করে ফেলেছে! তাদের মনে চা পানের নেশা ধরিয়ে দিয়েছে! শহরবাসী চিন্তা করে কুল পায় না। তারা কানাকানি করে। রায় ও খান বাহাদুরের উপর মনঃক্ষুণ্ন হয়। গোস্বা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্যান্ডেলের বাইরে।
এদিকে দারোগা সাহেব হাফ প্যান্ট পরে প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে দেখে শহরবাসী সতর্ক হয়ে পড়ে। দারোগা সাহেবের খাসলত ভালো নয়। হাফ প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ায়। সায়েবসুবোর সংস্পর্শে এসে মাথাটা বিগড়ে গেছে। নিজে নেটিভ, অথচ নেটিভ দেখলেই টানাটানি শুরু করে। যদিও আজ তাকে অন্যরকম লাগছে। শহরবাসী বুঝতে পারে দারোগা সাহেবকে আজ চা পানের নেশায় পেয়েছে। তাকে প্যান্ডেলে ঘোরাঘুরি করতে দেখে এক ইংরাজ সায়েব উল্লাস বোধ করে। হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকে। দারোগা সুড়সুড় করে সায়েবের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তাকে লম্বা স্যালুট টোকে।
শহরবাসী দেখে বড়ো সাইজের পাত্রে পানি জ্বাল দেয়া হচ্ছে। আগুনের আঁচ পেয়ে পানি টগবগ করে ফুটে। ফুটন্ত পানির মধ্যে চা পাতার গুঁড়ো ঢেলে দেয়া হয়েছে। পাত্রের পানি মনোহর এক রঙ ও সুগন্ধে পালটে যেতে থাকে। ফুটন্ত চায়ের লিকারে সারা প্যান্ডেল মউ-মউ করছে। চায়ের এই সুগন্ধ উৎপাদনের ক্ষমতা সম্পর্কে শহরবাসীর ধারণা ছিল না। চা পাতাকে গুঁড়ো করলে এমন চমৎকার সুগন্ধ হয় এটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয় সবকিছু ধরে টানাটানি করার কারণে সায়েবরা এতো বুদ্ধিমান হতে পেরেছে। আশ্চর্য এক নেশা ছড়িয়ে দিয়েছে প্যান্ডেলে! মনের ভিতর চা পানের ক্ষুধা জাগছে বটে!
ইংরেজ সায়েব দারোগার কাঁধে হাত রাখে। তার হাতে গ্লাসভর্তি আশ্চর্য পানীয়। মৃদু ধোঁয়া উঠছে সেখান থেকে। দারোগার হাতে গ্লাসটি ধরিয়ে দেয়। তাকে জিজ্ঞেস করে,-‘ডারাগো, তুমি কখনো চা পান করিয়াছো?’ বিগলিত হেসে দারোগা উত্তর করে,-‘না হুজুর! তবে আপনি অনুমতি দিলে পান করিতে ইচ্ছা করি।’ সায়েব অট্টহাস্য করে,-‘অনুমতি! ওইটার প্রয়োজন নাই। তুমার যতো ইচ্ছা পান করিতে পারো। এইটা পান করিলে মন প্রফুল্ল হইবে। তুমি আরো ভালোভাবে লোকের কুঁচা ধরিয়া টানিতে পারিবে।’
সায়েবের অট্টহাস্যে দারোগা মনে-মনে লজ্জা বোধ করে। আড়ষ্ঠ হেসে চায়ের গ্লাস হাতে নেয়। তার ঠোঁট আশ্চর্য পানীয়ে চুমুক বসায়। দারোগাকে চা পান করতে দেখে মান্যগণ্য লোকেরা হেসে উঠেন। রায় ও খান বাহাদুর চায়ের গ্লাস হাতে নেন। মৃদু চুমুকে চা পান করে চলেন। ভটচায বামুন মা দুর্গার নাম স্মরণ করে গ্লাসে কপাল ঠেকান। আশ্চর্য তরলে চুমুক দিয়ে গ্লাসটি নামিয়ে রাখেন। ঈষৎ কুঁচকানো মুখে সায়েবকে লক্ষ করে মন্তব্য করেন,-‘বড্ডো তেতো সায়েব। মনে হইলো চিরতার রস পান করিতেছি! দুগগা, দুগগা!’
বামুনের চা পানের প্রতিক্রিয়া শুনে সায়েব হাসে। তার হাতে চিনির কৌটা। বামুনের গ্লাসে এক চামচ চিনি ঢেলে ভালো করে নাড়ে। তারপর গ্লাসটা ধরিয়ে দেয়,-‘বামুন তুমি চিনি ছাড়া চা পান করিয়াছো। লিকার কড়া হইলে তিতা লাগিতে পারে। চিনি মিশাইলে স্বাদ বাড়িবে। নাও এইবার পান করিয়া দেখো।’ বামুন প্রমাদ গুনেন। শহরে কী দিন এলো! ম্লেচ্ছ যবনের হাতে তাকে চা পান করতে হচ্ছে। মনে-মনে সায়েবের শাপ-শাপান্ত করে চায়ের গ্লাসে ঠোঁট রাখেন। এখন বেশ স্বাদ লাগছে। যদিও ম্লেচ্ছটার কারণে তাকে ঘরে ফিরে আরেকবার স্নান করতে হবে। উপবাস দিতে হবে। কী বিড়ম্বনা!
পেশ ইমাম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চোখ বুজে ফেলেন। সায়েবকে লক্ষ করে আওয়াজ করেন,-‘বহুত খুব। মাশাআল্লা। আল্লার কী কুদরত! তিনি চাইলে কী না পারেন। বহুত খুব!’ ইমাম সাহেবের কুদরতি বচন শুনে সায়েব মৃদু হাসে,-‘মাওলানা, তুমি ইচ্ছা করিলে গডের নিয়ামত নিয়মিত পান করিতে পারো। আমি তোমায় চায়ের প্যাকেট বিনা মূল্যে পাঠাইয়া দিবো।’
বামুন ও ইমাম সাহেব চা পান করলেন দেখে শহরবাসী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। চায়ের নেশা তাদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। কিন্তু সায়েবের মুখে ‘দাম’-এর কথা শুনে সকলে দমে যায়। ও! তাহলে পয়সা দিয়ে খেতে হবে! সায়েব বিচক্ষণ লোক। নেটিভের মতিগতি বুঝতে তার সময় লাগে না। হাতে গ্লাস ভর্তি চা নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হয়:-
‘তোমরা ভীত হইও না। এই চা পান করিবার জন্য গাঁটের একটি পয়সাও খরচা করিতে হইবে না। যার যতো ইচ্ছা পান করিতে পারো। ব্রিটিশরাজ তুমাদের মঙ্গল চাহে। তুমরা কী করিয়া ভালো থাকো সেইটা নিয়া আমরা ভাবনা করি। ইংলন্ডে রানি তুমাদের নিয়া ভাবনা করেন। এই প্যান্ডেল আরো কিছুদিন থাকিবে। আমরা চাই তুমরা আশ্চর্য এই পানীয় পান করো। ইহা পান করিয়া প্রফুল্ল ও সতেজ থাকো। ভয় করিও না। কুনু দাম লইবো না। যার ইচ্ছা প্যান্ডেলে আসিয়া পান করিতে পারো। ইচ্ছা করিলে পরিবার নিয়া আসিতে পারো। কেউ দাম চাহিবে না। যদি ভালো লাগে, যদি বাড়িতে ইহা তৈয়ার করিতে ইচ্ছা করো তা-হইলে প্যাকেট কিনিতে পারিবে। বাড়িতে চা পানের স্বাদ নিতে পারিবে। আমরা অধিক মূল্য ধরিবো না।’
সায়েবের সুবচনে আশ্বস্ত হয়ে শহরবাসী দলে-দলে মাগনা চা পান করতে থাকে। প্রতিদিন সকালে কৌতূহলী লোকজনে প্যান্ডেল ভরে ওঠে। বিকাল পর্যন্ত লোকের ভিড় থাকে সেখানে। চা পান শহরের দ্রষ্টব্য ঘটনায় পরিণত হয়। দস্যি ক্যামেলিয়ার কথা লোকের আর মনে থাকে না। কুলিরা ক্রমে শহরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। বুনো ক্যামেলিয়া বামন-সুন্দরী চা পাতা হয়ে লোকের উপর ভর করে। লোকেরা প্রথমে সুন্দরীর প্রেমে পড়ে। তারপর নেশা ধরে। পরিশেষে সুন্দরী একটা অভ্যেস হয়ে তাদের ঘাড়ে চাপে। তাকে ঘরে পাওয়ার জন্য পয়সা খরচা করতে কারো আপত্তি থাকে না।
এক শীতের সকালে শহরবাসীর খুব চায়ের নেশা চাপে। তারা দলবেঁধে প্যান্ডেলে ভিড় জমায় এবং অবাক হয়ে দেখে প্যান্ডেলটি নেই। তার জায়গায় একটি চমৎকার চায়ের দোকান শোভা পাচ্ছে। বাইরে বড়ো অক্ষরে সাইনবোর্ড ঝুলছে,-‘ফ্লেচার টি-শপ’। নিচে ছোট করে কয়েক লাইনের বাক্য,-‘যদি সতেজ হইতে চাও ফ্লেচারে আসো। যদি ক্রয় করিতে ইচ্ছা হয় ফ্লেচার তুমারে স্বাগত করিবে। আমরা তুমারে তাজা রাখি বাজারের সেরা চা পাতায়। আর চা সরবরাহ করি অতি অল্প মূল্যে। ফ্লেচারে আসো, চাঙ্গা রাখো নিজেকে।’
শহরে চা প্রচলনের পুরোনো গল্পটি স্মরণ করে আমরা হাসি। চেম্বার সভাপতির মাঝে কবেকার এক ইংরাজ সায়েবের ছায়া ফুটে উঠেছে। মেয়র সাহেবের প্রতি তার এই বদান্যতার পেছনে নিশ্চয় কারণ রয়েছে। যদিও আমরা সেটা অনুমান করতে ব্যর্থ হই। চেম্বার সভাপতি পাকা মাথার ব্যবসায়ী। লোহা-লক্কর থেকে শুরু করে নানা কিসিমের ব্যবসা করেন। ইদানীং ডেভোলাপারের খাতায় নাম উঠিয়েছেন। শহরে লোকজনের আবাসন সমস্যা নিয়ে টক-শো’য় বক্তৃতার ফুলঝুরি ছোটান। বোঝা যায় এটি নিয়ে তিনি বিশেষ চিন্তিত। মেয়র সাহেব নিজে লোকজনের যত্রতত্র দোকানপাট ও বাড়িঘর তোলার বিরোধী। সরকারি জায়গা দখল করে লোকেরা ঘরবাড়ি ও দোকানপাট তুলছে। পরিদর্শনে গেলে নির্বিকার মুখ করে থাকে। যেন এটা সরকারি জায়গা নয়, তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি। উচ্ছেদ করতে গেলে ঝামেলা পাকায়। মেয়রের প্রতিপক্ষরা তখন ঝটপট ব্যানার টাঙ্গিয়ে রাস্তায় বসে পড়ে। প্রেসের লোকজন ডেকে ফটো-পোজ দেয়। মেয়রের নামে অভিযোগের ফুলকি ছোটে। তোলপাড় শুরু হয় শহরে।
প্রতিপক্ষের অভিযোগ, মেয়র নাকি জনগণের ভিটেমাটি দখলের ষড়যন্ত্র করছেন! শান্তিপ্রিয় শহরবাসীর পেটে লাথি মারার নীলনকশায় নিজেকে শামিল করেছেন। বুদ্ধিসেবীরা এককাঠি সরেস। মেয়র ও চেম্বার সভাপতির মাখামাখি নিয়ে আকারে-ইঙ্গিতে গপ্পো ফাঁদে। মেয়রকে কী করে জনগণের হতে হয় সেটা বোঝানো শুরু করে। এইসব হট্টগোলের মধ্যে জায়গা দখলকারি শান্তিপ্রিয় নগরবাসী আবালমুখ করে বসে থাকে। তাদের ভাব দেখে মনে হয় ইহজীবনে ওই কর্মটি তারা করেনি। মেয়র সাহেবের নামে উলটো নালিশ ঠোকে। ভোটের আগে মেয়র তাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন জনগণ সকল সম্পদের মালিক। সমুদয় সম্পদের মালিক জনগণ হলে মালিকানার নিয়মে সরকারি জায়গা জনগণের হওয়ার কথা। সুতরাং নিজেদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট নিয়ে তারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। মেয়র সাহেবের এখানে বলবার কিছু নাই। তিনি জনগণের সেবক মাত্র। ভোটে পাশ করার পর তার এই উলটাসিধা আচরণের রহস্য নিয়ে জনগণ তাই প্রশ্ন তোলে। সংবাদকর্মীরা সাড়ম্বরে সেটা টিভি ও পত্রিকায় প্রচার করে। টিভি রিপোর্টার জনগণের হয়ে মেয়রের দিকে প্রশ্নটি ছুঁড়ে দেয়। শহর জুড়ে হইচই শুরু হয়।
শান্তিপ্রিয় জনগণকে এহেন আচরণ করতে দেখে মেয়র অবশ্য গুম হয়ে বসে থাকেন। ভোটের সময় কী-না-কী উলটাসিধা বলেছেন, এখন সেটাকে ইস্যু করা হচ্ছে দেখে তার দুঃখের সীমা থাকে না। দখলদার উচ্ছেদের ইতি ঘটে। তবে ডেভোলাপারের খাতায় চেম্বার সভাপতির নাম উঠবার পর থেকে বাতাস অন্যখাতে বইছে। সরকারি জায়গা থেকে দখলদার উচ্ছেদ ও পরিকল্পিত আবাসন নিয়ে সভাপতি খুব তৎপর। সরকারি জমি কী করে পুনরুদ্ধার করা যায় সেটা নিয়ে তার বক্তব্য বহুবার ‘টক অব দ্য টাউন’ হয়েছে। শহরবাসীকে কম খরচে পরিকল্পিত আবাসনের আওতায় আনার ব্যাপারে তিনি ভীষণ সক্রিয়। চেম্বার সভাপতির সক্রিয়তা দেখে বোঝা যায় ‘মাগনায় পয়সা ডাবলের’ নীতি প্রয়োগ করে কিছু একটা ঘটাবেন। তিনি কামিল লোক। তার থলে থেকে কখন কী বের হয় কে জানে!
মেয়র সাহেবের বাগানে ভরপুর চাঁদ উঠেছে। ব্রিগেডিয়ার পিয়ার মোহাম্মদ সেই তখন থেকে গলা ফাটিয়ে হাসছেন। তার মিলিটারি হাঁটুতে চাঁদের আলো খেলা করে। রাক্ষস ওসমানের তাড়া খেয়ে আমরা ব্রিগেডিয়ারের পেছনে চলে এসেছি। চেয়ার টেনে তার নিকটে বসে পড়েছি। পিয়ার মোহাম্মদ সাহসী লোক। কমপ্লিট মিলিটারি ম্যান। পায়ের আওয়াজ বুঝে শত্রুকে ঘায়েল করায় তার জুড়ি নেই। রাক্ষসকে পরাস্ত করতে হলে তাকে লাগবে। যদিও ওসমান সম্পর্কে তিনি এখন-পর্যন্ত নির্বিকার। ওর পায়ের আওয়াজ টের পাচ্ছেন বলে মনে হয় না। চন্দ্রকিরণের মদির প্রভাবে হাঁটু নাচিয়ে হেসেই চলেছেন। তার সঙ্গে তাল দিয়ে আমরাও হাসি। চোরাচোখে পিয়ারের সুন্দরী স্ত্রীকে তালাশ করি। ওই তো কোমল পানীয়ের গ্লাস হাতে মেয়র সাহেবের স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। চাঁদের আলো তার চুলের ফাঁকে লুটিয়ে পড়ছে। মানুষ হওয়ার বদলে চাঁদ হতে না-পারার দুঃখে আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এই সুন্দরের দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। কিছুক্ষণ তাকানোর পর মনে হয় ওটা অসহ্য সুন্দর। আমাদের নোলায় সইবে না। আমরা দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে নেই।
আলোর রেণু চারধারে গলে পড়ছে। খানিক দূরে অল্প বয়সী তরুণীরা জটলা পাকিয়ে গল্প করছে। তাদের চোখে-মুখে আলোর ঢল নেমেছে। মেয়র সাহেবের বাগানকে আজ অপার্থিব লাগছে। তার বাগানে প্রস্ফুটিত তরুণীদের অপার্থিব ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যাচ্ছে না। ঈশ্বরের বাগান থেকে তারা এইমাত্র মেয়রের বাগানে নেমেছে। বেদেনির মতো কোমর বাঁকিয়ে চন্দ্রকিরণের সুখ নিচ্ছে। তাদের দেখে বেদেনি-বহুল দিনগুলোর স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে।
বেশি দিন আগের কথা নয়, আমাদের শহরটি সাপ ও বেদেনিতে বোঝাই ছিল। শীতের কুয়াশা ঘন হলে বিলের পানি নিচে নেমে যায় আর সেই বিল ঠেলে বেদেনিরা উঠে আসতো। তাদের হাতে সাপের ঝাঁপি। মাথায় চুড়ি ও নাকফুল। কোমরে বিছে হার। উদ্যত সর্পিনী গলিপথ ধরে হাঁটছে। তার দেহে যুবতী হাওয়া। কণ্ঠে সর্বনাশের মদিরা,-‘হেই সাপের বিষ ঝাড়ি। দাঁতের পোকা বার করি। সাপের খেলা দেখাই। হেই সাপের খেলা!’
শহরের রমণী ও শিশুরা বাকপটু বেদেনিকে দেখে কৌতূহল বোধ করে। যুবকরা তার সর্পিল কোমরের বাঁকে সম্মোহিত হয়। জিপসী রমণীর নাচুনে কটাক্ষ সবাইকে অবশ করে ফেলেছে। বেদেনি এবার নাগিনী হয়েছে। তার ঝাঁপি থেকে বেরিয়ে আসছে দুধরাজ। আমরা বশীভূত সেই দুধরাজে। শহরের বখিল লোকটি বশীভূত বেদেনির নাগিনীরঙ্গে,-‘ওরে আমার দুধরাজ, ফণা তুইল্যা যা। খা তুই খা, ওই বখখিলারে খা।’
বেদেনির রঙ্গে বখিল আঁতকে ওঠে। হাসির রোল পড়ে শহরে। রঙ্গ শেষ। নাগিনীছন্দে বশীভূত দুধরাজ ঝাঁপিতে ঢোকে। আমরা অকালপক্ক কিশোর বেদেনির পিছু নেই। কোমরে প্রমত্ত জোয়ার তুলে রমণী বিলে নেমে যাচ্ছে। তার পাথুরে নিতম্ব আমাদের কাবু করে রাখে। নিতম্বে বন্য ঢেউ তুলে জিপসী রমণী বিলের জলে বিলীন হয়। আমাদের রক্তে বুনো বাসনা ডানা ঝাপটায়। বুকের খাঁচা বন্য কামের জোয়ারে ছটফট করে। শহরকে জোয়ারে ভাসিয়ে বেদেনি বিলে নামে। বিলীন হয় অথই গভীরে!
মেয়র সাহেবের বাগানে জটলা পাকানো তরুণীরা এখন বেদেনি হয়েছে। তাদের চোখের কোণায় লাস্য। অধরে চন্দ্রকিরণের ছটা ঝলমল করে। কোমরের বাঁকে উদ্দাম হাওয়া খেলে। ভ্রূ-পল্লব তুলে তারা ডাক দিচ্ছে চন্দনের বনে। তরুণীরা এখন মাদি হরিণী। ঝলমলে পোশাকে কামঘন। এই রাত তাদেরকে নিয়ে বনে যাওয়ার রাত। ঘন জঙ্গলে নিরুদ্দেশ হওয়ার রাত। বন্য ও অশ্লীল হওয়ার রাত। আমরা অশ্লীল হতে চাইছি। প্রমত্ত কামফেনায় লাগামহীন হতে চাইছি। তরুণীদের আমরা বনে নিতে চাই। চন্দনের সুগন্ধে মাতাল ও মাংসাশী হতে চাই। অথচ সেটা পারছি না। ওসমান বাগাড়া দিচ্ছে সেখানে। তরুণীযূথে তার চতুর সঞ্চালন আমরা টের পেয়েছি। গুড়ি মেরে আগাচ্ছে সে। কামঘন বেদেনিরা সেটা ধরতে পারছে না। মদির চোখ তুলে চন্দনের বন খুঁজছে। তারা বুঝতে পারছে না ওসমান তাদের ঘাড়ের নিকটে নিঃশ্বাস ফেলছে। তার গায়ে সার্জনের পোশাক। হাতে সুঁই-ছুরি-কাঁচি। চোখে মানুষ খুনের নেশা। রাক্ষসটি আজ ফুলের নেশায় ডেরা থেকে বের হয়নি। তার চোখে মাংস ভক্ষণের খিদে জ্বলজ্বল করছে!
গজগামিনী রাতে ওসমানের উপর তার বাপ-দাদারা ভর করে। ফুলখেকো রাক্ষস মাংসখেকো খোক্কসে পরিণত হয়। রাক্ষস ও খোক্কসে ব্যবধান রয়েছে। আকার-আকৃতির দিক থেকে খোক্কসরা হচ্ছে অতিকায় রাক্ষস। গাছের চেয়ে লম্বা। এক গ্রাসে বিশ-পঁচিশটা মানুষ মুখে পুরে। রাক্ষসরা শিকারকে কড়মড় করে চিবিয়ে খায়। খোক্কসের ওসব বালাই নেই। কোঁত করে গিলে ফেলে। রাক্ষস ফুল ও রমণী ভালোবাসে। রাজকন্যায় কাতর হয়। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে নিজে বিপন্ন হয়। খোক্কস ভিন্ন প্রকৃতির। ফুল ও রমণীর সে পরোয়া করে না। খিদের বাই উঠলে ভেড়া বা রাজকন্যায় তফাত ধরে না। সারাক্ষণ ক্ষুধার্ত থাকে। খোক্কসের একটাই মন্ত্র,-শিকার পেলে গিলে ফেলো।
রাক্ষস ও খোক্কসে আরও প্রভেদ আছে। রাক্ষসরা রসিক প্রকৃতির হয়। খোক্কস ঘোর বেরসিক। উদরপূর্তি ছাড়া কিছু বোঝে না। রাক্ষস প্রজাতির মধ্যে খোক্কস এক আলাদা প্রজাতি। সম্পর্কে রাক্ষসের বড়ো ভাই হয়। গায়ের জোরে তাদের রাজা হয়ে বসে। রাক্ষসদের কাজ হয় পেটুক রাজাকে খাবার যোগানো। রাক্ষসকুলে খোক্কসরা মাথামোটা নামে বিখ্যাত। তারা বন্য ও পেটুক স্বভাবের। খোক্কসের তুলনায় রাক্ষস শান্ত-স্বভাবী। তবে গজগামিনী রাতে রাক্ষস ও খোক্কসে প্রভেদ ঘুচে যায়। ভরা চাঁদের জোয়ারে প্রেমভাবী রাক্ষসের মধ্যে বড়ো ভাই খোক্কস জেগে ওঠে। সে বেরিয়ে পড়ে সব তছনছ করবে বলে। ওসমান আজ সব তছনছ করতে বেরিয়েছে। তার চোখে মানুষ খুনের নেশা জেগেছে!
ক্রমশ