ওসমান সমাচার পর্ব ৪ । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জুন ২০১৬, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ, | ২৭৬৬ বার পঠিত
ইন্দ্রজালের ফিকিরি : ফকির ও নদীতীর সমাচার
মেয়র সাহেবের বাগানে আজ ভরা পূর্ণিমা। সুডৌল চাঁদ শ্লথগামী রমণী হয়েছে। গর্ভের ভারে ধীরলয়ে মাটিতে পা ফেলছে। সে এখন ভরা পোয়াতি। বিয়োবার বেশি দেরি নেই। আসন্ন প্রসবা রমণী নিজেকে নিয়ে বিব্রত। শিহরিত নয়ন তুলে মেয়র সাহেবকে দেখছে। পোয়াতি রমণীকে দূর থেকে সুন্দর লাগছে দেখে। রমণী চলেছে দুলকিচালে। তার দ্যুতির আবেশে বাগানের প্রতিটি ফুলকে গর্ভবতী মনে হচ্ছে। গাছের ফাঁকে আলাপচারিতায় মগ্ন লোকজনকে সে ভাসিয়ে নিচ্ছে। গজগামিনী চলেছে ধীর পায়ে। এমন গজগামিনী রাতে রাক্ষসরা জেগে ওঠে। তাদের খিদে পায়। তারা গুহা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। হস্তিযূথের মতো সারবেঁধে লোকালয়ে নামে। তছনছ করে লোকালয়। শিকার পেলে গপ করে মুখে পুরে। হস্তিযূথ ভারী পা ফেলে হাঁটে। দল বেঁধে ফসলের জমিতে হানা দেয়। ছড়িয়ে পড়ে যেদিকে খুশি। শিকার করে যাকে খুশি। মেয়র সাহেবের বাগানে তারা এখনো নামেনি। তবে নামতে কতোক্ষণ! দেয়াল ফুঁড়ে সহসা বাগানে ঢুকে পড়তে পারে। মেয়র সাহেবকে গপ করে গিলে নিতে পারে। যাকে ইচ্ছা তাকে দু’আঙুলে ধরে মুখে পুরতে পারে। ভারী পা ফেলে তারা এগুচ্ছে। তাদের সুগম্ভীর পায়ের আঘাতে মাটি এখন কাঁপছে। যদিও বাকিরা সেটা টের পাচ্ছে না। আশ্চর্য বৈকি!
মেয়র সাহেব খোশগল্পে মত্ত। কিছু বুঝতে পারছেন না। স্থাপনা সচিব পেয়ারা ঠিকাদারের কাঁধে হাত রেখে দুখ-সুখের গল্পে মগ্ন। কিছু টের পাচ্ছেন না। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনার শহরে সন্ত্রাস বেড়ে যাওয়া নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। অপরাধ-বিশেষজ্ঞের স্বরে দুজনে কথা বলছেন। অন্য কিছু অনুভব করার মেজাজে নেই। প্রধান প্রকৌশলী ওয়ার্ড কমিশনারদের সাথে পাবলিক টয়লেটের জায়গা বাছাই করা নিয়ে ব্যস্ত। হস্তিযূথের আগমন সম্পর্কে তিনিও নির্বিকার। চন্দ্র-কিরণের মদির প্রভাব তাকে পাবলিক টয়লেট থেকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। গজগামিনী নিয়ে কাব্যে মাতার চাইতে গণ শৌচাগার স্থাপনের সিদ্ধান্তে পৌঁছানো তার জন্য খুব দরকারি। পাবলিক টয়লেট স্থাপনে প্রধান প্রকৌশলীর এতোটা উতলা হওয়া শহরে মুখরোচক ঘটনার একটি। লোকে সুযোগ পেলে তার এই টয়লেট প্রীতি নিয়ে আলাপ করে। এর উৎপত্তির কথা ভেবে হো হো করে হাসে। প্রধান প্রকৌশলীর টয়লেট প্রীতি অবশ্য হুট করে শুরু হয় না। এর একটা পরম্পরা থাকে। এক গল্পের লেজ ধরে আরেক গল্পে ঢুকে পড়ার মতো আমরা তাকে পাবলিক টয়লেটে লেগে পড়তে দেখি। সংবাদকর্মীরা তাকে খবর করায় তিনি ‘টক অব দ্য টাউন’ হয়ে উঠেন। প্রকৌশলীর পাবলিক টয়লেটে লেগে পড়ার গল্পটি কারো আর আজানা থাকে না।
অস্তিত্বের শুরু মায়ের জরায়ুতে। এর পুনর্জন্ম সেই জরায়ুতে। এর শুরু এক ‘আমি’কে দিয়ে। তিরোভাব ও পুনর্জন্ম আবারো সেই ‘আমি’র মধ্যে।
আমাদের এই শহরে অনেক কিছু নেই। পাবলিক টয়লেট তার একটি। এখানে পরিবার নিয়ে বেড়ানোর মনোরম উদ্যান নেই। হকারদের দাপটে ফুটপাতে পা ফেলে হাঁটার সুযোগ নেই। পিঁপড়ে-সারির মতো বিপণি বিতান থাকলেও কোনো সিনেপ্লেক্স নেই। শহরের রাস্তাগুলো সরু ও হিলহিলে। অতিশয় কদাকার। টিলা-টক্কর কেটে বহুতল দালান উঠছে। কোনো এক কালে শহরটি ঘন সবুজে আচ্ছাদিত ছিল। বুনো সবুজের মাঝে এক চিলতে বসতি নিয়ে নিরালা ও প্রান্তিক ছিল। সে-দিন আর নেই। কালের নিয়মে বসতি বেড়েছে। বুনো সবুজ হটিয়ে ইট-কাঠ-কংক্রিটের ব্যাপক আবাদ ঘটছে। দর-দালান আবাদের খরচা দূরদেশ থেকে আসে। আমাদের স্বজনরা সেই খরচা পাঠায়। সাত সমুদ্র ও তেরো নদীর পারে এক শহর রয়েছে। তারা সেই শহরে থাকে। আমাদের বাপ-দাদারা কোনো এক কালে সারেং ও খালাসি ছিল। জাহাজে করে উত্তাল নদী ও সাগর পাড়ি দিতে ভয় করেনি। তারা ভাগ্যান্বেষী ছিল। অভিযানপ্রিয় ও দুঃসাহসী ছিল। শহরের মায়াজাল ছিন্ন করে দূরদেশে তরী ভিড়িয়েছে। থিতু হয়েছে অচেনা শহরে।
অচেনা সেই শহরটি অন্যরকম। মেঘ ও রৌদ্রে সুগম্ভীর নয়। সবুজের ঘ্রাণে মদির নয়। লোকজন সেখানে চকোলেট ও আইসক্রিম ভালোবাসে। শখ করে ঝাল মাংসের কারি খেতে পছন্দ করে। শহরটি স্যাঁতসেঁতে। শীতের দাপট তাকে কাবু রাখে। এর গাছপালা ও ঘরবাড়ি অন্যরকম। ফুলের গন্ধ অন্যরকম। রাস্তাঘাট ও দরদালান অন্যরকম। বিচিত্র রঙের মানুষ সেখানে ভিড় জমায়। বিচিত্র কাজে ব্যস্ত রাখে নিজেকে। অনেকে বিরসমুখে চলেফিরে। ডাট মেরে কথা বলে। অনেকে আবার সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে। তারা কী চায় নিজেও জানে না। শহরটি ব্যস্ত ও সুশৃঙ্খল। গোছানো ও বনেদি। জগতের কাছে নিজের আভিজাত্য জাহির করতে ভালোবাসে। সাদা-কালো-বাদামি আর দো-আঁশলার অঢেল সমাগমে সারাক্ষণ গমগম করে।
আমাদের বাপ-দাদারা একদিন জাহাজে করে বর্ণিল সেই শহরে পা রাখে। শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীটি দেখে তারা অবাক হয়। পেছনে ফেলে আসা নদীর সঙ্গে মিল খুঁজে পায়। এই সাদৃশ্য তাদেরকে স্মৃতিকাতর করে তোলে। ভিনদেশী নদীটিকে তারা ভালোবেসে ফেলে। সারেং ও খালাসিগিরি ছেড়ে এখানে কামলা খাটতে শুরু করে। ঝাল মাংসের কারি দিয়ে শহরবাসীর মন ভোলায়। রসুইকারি হিসাবে ভালো নাম কামায় সেখানে। রান্নার জাদু দিয়ে পরদেশকে নিজের করে নেয়। আমাদের বাপ-দাদারা এবার পেশা বদলায়। জাহাজের সারেং থেকে তান্দুরিওয়ালা হয়ে ওঠে। খালাসি থেকে শেফ বনে যায়। সাত সমুদ্র তোরো নদীর পারে তারা স্থায়ী ডেরা পাতে। শহরের একাংশ ঘিরে মৌচাক গড়ে তোলে। অন্য অংশেও ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। পেছনে ফেলে-আসা শহরটিকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে এখানে। একসঙ্গে দুই শহরে যাপনের যুগ শুরু হয়।
আমাদের বাপ-দাদারা হরহামেশা দুই নদীতে তরী ভিড়ায়। নদী দুটির মধ্যে সাত সমুদ্র ও তেরো নদীর দূরত্ব রয়েছে। তারা সেই দূরত্ব ভেঙে ফেলেছে। তাদের কারণে আমরা এখন দুটি শহরকে একসঙ্গে যাপন করি। দুই নদীতে সমানে অবগাহন করি। আমাদের শহরকে ভিনদেশী শহরের আদলে জল্পনা করে সুখ পাই। নিজেকে একাকার করি বিলেতি সেই শহরে। একাকার হলেও দুই শহরের দূরত্ব ঘোচে না। আমাদের শহরটি প্রাচীন হলেও বর্ণিল নয়। বহু-মানবের প্রণয় তীর্থ নয়। তার উৎপত্তি মহাদেব শিবের দক্ষযজ্ঞের দিনে। দক্ষযজ্ঞে মহাদেবের অপমান সইতে না-পেরে স্বেচ্ছামরণ বেছে নিয়েছে প্রিয় পত্নী সতী। শোকাকুল শিবের দুই হাতে পত্নীর শবদেহ। রুদ্র পশুপতির মাতন তাণ্ডবে সতী-অঙ্গ খণ্ড-খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভূমায়। শ্রী-অঙ্গের একটি অঙ্গ কামাখ্যায় ঠাঁই করে নিলো। সতী দেবীর ছিন্নহস্ত ছিটকে পড়ে নিরালা এই নগরে। লোকে বলে সতীর শ্রী-অঙ্গ ধারণ করে কালে-কালে নগরীটি শ্রীভূমি ও তিলোত্তমা হয়েছে। ডাকিনী-যোগিনী ও তান্ত্রিকের সঙ্গে তার উঠবস দক্ষযজ্ঞের দিন থেকে চলছে। কোনো এক কালে সে নাকি হারিকেলে ঢুকে পড়েছিল। বিস্তার লাভ করেছিল লাউড়, গৌড় ও জৈন্তার পাদদেশে। বদল ও বিস্তারের এই খেলায় যবনিকা ঘটে দরবেশের আগমনে। জংধরা নগরী নিজের আয়তনে সুস্থির হয়।
লোকে বলে দরবেশ আসেন জায়নামাজে চড়ে। তাকে ঠেকানোর জন্য রাজা জাদুবিস্তার করে। তার গতি রোধ করতে সম্মুখে একখণ্ড পাথর ঠেলে দেয়। পাথরটি এখনো সতীর ছিন্ন হস্তের দাগ ধরে রেখেছে। দরবেশের দিকে পাথরটি ঠেলে দিয়ে রাজা তাকে নগরীর অতীত ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলেন। বুঝিয়ে দিতে চাইলেন কেন এই নগরী তিলোত্তমা বলে সুনাম কিনেছে। কেনই-বা শ্রী-ভূমি নামে লোকজন এর প্রশংসা করে। দরবেশ তখন মৌন। তার চিত্ত পাথর দেখে এতোটুকু বিচলিত হয় না। তিনি মরুভূমির মানুষ। উটের পিঠে চড়ে যাত্রা শুরু করেছেন। মরুঝঞ্ঝা ঠেলে শ্যামল ভূ-বর্ষে পৌঁছে গেছেন। নৌকায় করে পাড়ি দিয়েছেন প্রতিকূল নদীপথ। টিলা ও বন-জঙ্গলে ঘেরা প্রাচীন জাদুপিঠে পা রেখেছেন। তার পক্ষে উলটোযাত্রা সম্ভব নয়। যে-করে হোক এই নগরীটি তাকে জয় করতে হবে। এখানে স্থাপন করতে হবে মানব-বসতির নতুন ইতিহাস। এটা তার গুরুর আদেশ। তার মনে হলো নগরীটি নতুন আকার নিতে চাইছে। অস্তিত্বের নবীন অর্থ ও প্রাসঙ্গিকতায় নিজেকে ব্যক্ত করতে চাইছে। পাথরকে তাই মৃদু কণ্ঠে ধমক দিলেন দরবেশ, —‘হেই হট্ যা।’ তার ধমকে প্রচণ্ডতা ছিল। হাতের আঙুলে অলৌকিক প্রতাপ ছিল। পাথর নড়ে উঠে দরবেশকে পথ করে দিতে বাধ্য হয়। কামাখ্যায় দরবেশের দিন শুরু হলো।
রাজা সেই কবে ভূমায় বিলীন হয়েছে! দরবেশ লুপ্ত হয়েছেন টিলায়! শহরটি লুপ্ত হয়নি। এখনো সে বিচরণ করে অতীতে এবং বিদ্যমান থাকে বর্তমানে। তার সঙ্গে আমরাও বিচরণ করি অতীতে এবং ফিরে আসি বর্তমানে। জংধরা শহরের সঙ্গে সাগরপারের শহরকে করতলে ধারণ করি। নিজের ভবিষ্যৎ পরখ করি ভিন্ন দুটি শহরে। সাগরপারের শহরটি পুরোনো হলেও সেকেলে নয়। একালের সঙ্গে সন্ধি করে টিকে আছে। সে গতিশীল। শ্বাসরোধী শৃঙ্খলায় বন্দি ও নিরাকার। আমাদের স্বজনরা সেই নিরাকারে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। জংধরা শহরের প্রতি তাদের টান আগের মতো গভীর নয়। কালের গতিতে সেখানে ভাটা পড়ছে। ফেলে আসা শহরকে তারা ভুলতে শুরু করেছে। আমাদের স্বজনরা এখন আর স্মৃতিকাতর নয়। বহুমানবে তরঙ্গিত এক শহরে তারা সুস্থির হতে ইচ্ছুক। এদিকে আমরা এখনো সেকেলে শহরে পড়ে আছি। সতীর ছিন্নহস্তে শক্ত করে নিজেকে ধরে রেখেছি। জংধরা শহর ছেড়ে ঝা-চকচকে শহরে পাড়ি জমাতে পারিনি। আমরা যাপন করছি এর হট্টগোল। নিজেকে সুস্থির রেখেছি এর আলসেমিভরা কলরবে। কালের বিচারে আমাদের শহরটি মামুলি হয়ে গেছে। তবু তাকে ছেড়ে যেতে মন চায় না। গাব গাছের আঠার মতো সেঁটে থাকি। শহরের প্রতিটি খিলান ও গম্বুজকে আমরা ভালোবাসি। নিজেকে অভ্যস্ত করেছি নিদারুণ এই অপচয়ে!
প্রধান প্রকৌশলী এরকম এক ‘নিদারুণ’ শহরের লোক। এর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। শহরে অনেক কিছু ‘না থাকা’ তাকে বিচলিত করে না। তিনি মেনে নিয়েছেন জংধরা শহরে কোনো ফুলের দোকান থাকবে না। রাস্তার দু’পাশে সারিবাঁধা বৃক্ষ থাকবে না। প্রতিটি চৌরাস্তায় ফোয়ারা ও ভাস্কর্যের বাহার থাকবে না। শখের থিয়েটার ও ফ্রেস্কোয় শহরকে নান্দনিক করা হবে না। কবি-চিত্রকর ও গায়করা এখানে ছাপোষা গেরস্থ হয়ে দিন কাটাবে। বাজারি শিল্পকলায় জাবর কাটবে। জংধরা শহরটি সাগরপারের শহরটির মতো বর্ণিল নয়। এখানে অনেক কিছু থাকতে নেই। এই না থাকায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। প্রকৌশলী এটা দেখে অভ্যস্ত যে আবর্জনা ফেলার ঝুড়ি সঠিক জায়গায় নেই। ময়লা পরিশোধনের ব্যবস্থা নেই। নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছড়াগুলো অতীতের মতো নাব্য নেই। এবং, এই শহরে আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কানামাছি খেলার সুখ নেই। ডাংগুলি ও মার্বেল খেলার উঠোন নেই। পুকুরপারে বড়শি ডুবিয়ে ধ্যানী বক হওয়ার সুযোগ নেই। ডোবা ও খানাখন্দ ছাড়া সর্পিল কোনো হ্রদ নেই। কাকচক্ষু জলে নিবিড় দিঘি বা জলাধার নেই। তারা ইন্দ্রজাল ছিল। ইন্দ্রজালের নিয়মে একদিন শহরে আবিভূর্ত হয়েছিল! সেই নিয়ম মেনে মহাশূন্যে বিলীন হয়েছে!
লোকে বলে একদা এই শহরে ইন্দ্রজাল বিরাজ করতেন। তার জাদুকরি ইশারায় বিল ও নদীতে নয়া পানির ঢল নামতো। পুবালী বাতাস বইতো শহরে। ইন্দ্রজাল বজরা নৌকার ডাক দিতেন। নৌকারা ভিড় করতো নদীতীরে। শহরে একদিন নববধূর আঁচল পুবালী বাতাসে খসে যেতো। বাপ-ভাইয়ের বিরহে তার মন পুড়তো। বধূ উদাসী হতো নাইওরী যাবে বলে। বধূ নাইওর যাবে বাপের বাড়ি, ফিরবে দুই মাস পরে! সুন্দরী বধূর জন্য বরের মন তাই আনচান করে। রাতে ঘুম আসে না। রানারকে দিয়ে পত্র পাঠায়,-‘আর কতোদিন? বাপের বাড়ি যাইবার সুখে আমারে ভুলিয়া গেলে!’
বরের পত্র পেয়ে বধূর মুখে মুচকি হাসি ফোটে। মনের মধ্যে পুরুষকে বিরহী করার সুখ ঘনায়,-‘এতো উতলা হও কেন? মাত্র তো আসিলাম। তুমি না-আসিলে যাই কি করিয়া! এক দিনের জন্য কি আসিবার ইচ্ছা করো না?’ বর পারলে উড়াল দেয়। কিন্তু হাত বাঁধা নিয়মে। অগত্যা ডাকঘরে চিঠি ফেলে,-‘আসিতে খুব ইচ্ছা করে। এদিকে বড়ো কাজের চাপ পড়িয়াছে। তুমি বলিয়া দাও আমার অসুখ করিয়াছে। উনারা মানা করিবে না। আমার কিন্তু সত্যি জ্বর আসিয়াছিল গতকাল রাত্রে। আর কতো দিন থাকিবে বল তো! আমি কিন্তু তোমায় আর পাঠাইবো না! বাপের বাড়ি গিয়া আমারে ভুলিয়াছো! কী নিঠুর তুমি!’
বরের আবেগে বধূর মুখে মুচকি হাসি। মনে রঙ্গ ও প্রণয়ের ঝড়। দেহের কোষে কীসের যেন টান। বধূর এখন মন খারাপ,-‘তোমারে নিয়া আর পারি না। আমি সত্বর আসিবো। বাবাকে বলিয়াছি তোমার অসুখ করিয়াছে। সামনের সপ্তাহে ফিরিবো। নিজের যত্ন নিও।’ বধূ এখন ইন্দ্রজালের বশীভূত। পাল তোলা বজরায় চড়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরছে। বাপ-মা’কে ছেড়ে যাবার দুঃখে তার চিত্ত বিকল হয়ে আছে। দেহের কোষে নিজের পুরুষকে কাছে পাওয়ার সুখ তরঙ্গ তুলছে,-‘কতো গল্প যে জমিয়াছে। ঘরে আসিলে বলিবো। সব শুনিতে হইবে কিন্তু!’ কাঁচা বয়সের আবেগ দেখে ইন্দ্রজাল হাসছেন। পুবালী বাতাস গুটিয়ে নিতে আদেশ করেন। আসছে বছর আবারো কোনো বধূর আঁচল খসানোর জন্য ডাক দেবেন সময় হলে।
শহরে এখন নাইওরী নেই। পুবালী বাতাস চিরতরে উবে গেছে। নৌকারা ডুবেছে পচা পানির গভীরে। মেয়েরা এখন বিরসমুখে বাপের বাড়ি যায়। তারা বাপের বাড়ি যায় গাড়িতে করে। ইঞ্জিনের ভটভট ও খানাখন্দের ঠোক্কর সয়ে। সেলফোনে বরের খবর করে,-‘এই, আমার হাত খালি। টাকা পাঠিও তো।’ বর বিরসমুখে উত্তর করে,-‘তুমি কি আসবা না? সেই যে গেলা, আর খবর নাই! আমার তো ইচ্ছা করে…!’ বরের ইচ্ছায় বউ মুচকি হাসে,-‘এতো খাইখাই করো কেন? মাত্র তো এলাম। ম্যানেজ করে নাও ক’টা দিন। খেয়েছো?’ বরের মনোবেদনা চাগা দিয়ে ওঠে,-‘আর খাওয়া! তুমি তো বাপের বাড়ি জমিয়ে খাচ্ছো। এদিকে আমি! বুয়ার রান্না! কী আর বলবো? ওই বেটিকে রান্না শেখাতে পারো না। ঝালের চোটে মুখ জ্বলছে।।’ বউ হাসে,-‘বাপরে, কী আবদার! রেঁধে খাওয়াও। বুয়াকে রান্না শেখাও। তোমায় রেঁধেবেড়ে খাওয়ানোর জন্য কি আমায় পটিয়েছিলে? বুয়ার দরকার কি? তুমি নিজে রেঁধে খাও না কেন? একটা ডিম তো ভাজি করতে পারো অন্তত। আচ্ছা যাও, বুয়াকে বলো দেবো যেন ঝাল কম দেয়। বেশি অসুবিধা হলে হোটলে খেয়ে নিও। মাত্র ক’টা দিন। তুমি না…।’ একালের নাইওরী সংক্ষিপ্ত। নতুন বউ বিরসমুখে বরের কাছে ফেরে,-ইঞ্জিনের ভটভট ও খানাখন্দের ঠোক্কর সয়ে!
একদিন শহরে ইন্দ্রজাল থাকতেন। তার ইশারায় নির্জন টিলায় ঘর বেঁধেছে এক ফকির। ভাই-বন্ধু-পরিজন ছেড়ে জংলী টিলায় একা দিন পার করে। জংলী ফুল ও ঝোঁপঝাড়ে ঠাসা টিলায় গাছগাছালির রাজত্ব। সাপ-বেজি ও কীটপতঙ্গ ছাড়া জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই কোথাও। মানুষের অনুপস্থিতি ফকিরকে ভাবিত করে না। অল্প আহারে তার পেট ভরে। পেটের ক্ষুধা মেটাতে টিলার রকমারি গাছাগাছালি যথেষ্ট। ফকির ঘরে একা থাকে। ঘরের দাওয়ায় একা বসে ভাবে। বিষধর সাপ তার পায়ের পাশ দিয়ে চলে যায়। বেজির পাল সাপকে তাড়া করে। বেজি ও সাপের হল্লা টিলার নির্জনতায় তরঙ্গ তুলে মিলিয়ে যায়। মৃত সাপকে মুখে নিয়ে বেজির দল উল্লাসে ছুটোছুটি করে। দৃশ্যটি ফকিরকে বিচলিত করে না। উদাসমুখে বসে শুধু ভাবে!
ফকিরের তাপ্পিমারা আলখাল্লার পকেটে মস্ত বড়ো ফুটো। ফুটো দিয়ে মেঠো ইঁদুর ঢুকে পড়ে। ইতিউতি চোখ মেলে চায়। পকেট গলে সুড়ুত করে মাটিতে নেমে পালায়। ফকিরের পায়ের সামনে পোষা খরগোশ ঝিকিমিকি চোখ মেলে চায়। লাফ দিয়ে তার কোলে ওঠে। সেখানে থেকে ডাইভ দিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। খরগোশদের এই লম্পঝম্প অকারণে নয়। ওরা চাইছে সে তাদের দিকে মনোযোগ দিক। তাদের নৈপুণ্যে হাততালি দিয়ে উঠুক। অন্যসময় খরগোশদের লম্পঝম্প ফকির উপভোগ করে। হাত দিয়ে তালিয়া বাজায়। মুখে শিস দেয়,-‘সাবাশ বেটারা। আওর জোরে। লাগ্ ভেলকি লাগ্। আওর জোরে!’ খরগোশ মনের আনন্দে ফকিরের কোল থেকে মাটিতে ডাইভ দেয়। একে অন্যের সঙ্গে গোত্তা খেয়ে পায়ের পাশে গড়িয়ে পড়ে। ফকির হেসে তাদের কোলে তুলে নেয়। খরগোশের শুভ্র কোমলতায় আঙুল চালায়,-‘কামাল কিয়া বেটারা! বহুত হো গায়া। আব বাস্ কর।’
খরগোশদের দুষ্টুমিতে ইদানীং মন নেই ফকিরের। ঘরের দাওয়ায় ঠায় বসে থাকে। বসে-বসে নিজেকে নিয়ে ভাবে। নির্জনবাসের কারণ তালাশ করে। ফকিরের এই ফকিরি নিছক অকারণে নয়। সে জনপদে ছিল। সেখানে দীর্ঘ দিন থেকেছে। এখনো মাঝেমধ্যে জনপদে একচক্কর ঘোরান দিয়ে আসে। তবে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। সাপ ও বেজির দঙ্গলে ফিরে আসে। গর্জন গাছের নিচে চুপচাপ বসে থাকে। নিজেকে নিয়ে ভাবে। অচেনা এক আগন্তুককে মনে-মনে তালাশ করে। তাকে খোঁজে ঘরে, জঙ্গলে ও জনপদে। আগন্তুকের নাম নেই। ঠিকানা ও পরিচয় অস্পষ্ট। ফকির তবু তাকেই খুঁজে মরে।
ফকিরের জীবনে আগন্তুকের প্রবেশ হঠাৎ করে ঘটে। ধানখেতের পাশে মাটিতে হেলান দিয়ে শুয়ে ছিল সে। বর্ষা তখন সমাগত। আকাশে মেঘ করেছে। ধানের খেতে ব্যাংয়ের পাল টানা-স্বরে মেঘকে ডাকছে। ব্যাংয়ের ঘ্যানঘ্যানিতে বিরক্ত মেঘরাজ দলা পাকিয়েছে আকাশে। মেঘে-মেঘে টক্কর লাগার বেশি দেরি নেই। কড়াৎ গর্জনে মেঘের ছিপি খুলবে একটু পর। মেঘরাজের সঙ্গে ব্যাংয়ের যুদ্ধ এই থামলো বলে। ধূমল বৃষ্টিতে সকল কলরব থমকে যাবার খুব বেশি দেরি নেই। ঠিক সেই মুহূর্তে ব্যাংয়ের কলরব ছাপিয়ে কে যেন ফকিরের কানে আওয়াজ করে! আওয়াজটি সুরেলা ও কুহকী ছিল। এর কম্পাঙ্ক মৃদু ঢেউয়ের মতো তার কানে গিয়ে ঢোকে। হতচকিত ফকির ভয়ে কান চেপে ধরে। ধানখেত থেকে তীরের বেগে ঘরে ঢোকে। আওয়াজ থামার আশায় ঘরের দরোজা বন্ধ করে খাটে শুয়ে থাকে। এটা দুঃস্বপ্ন এবং সহসা থেমে যাবে, এই আশায় ফকির কানে বালিশ চাপা দেয়। চোখ মুদে নির্বিকার শুয়ে থাকে।
নিজের অজান্তে আমরা আবার হারানো মায়ের নিকটে ফিরে আসি। প্রিয় রমণীর স্ফিতকায় অবয়বে তাকে দেখতে পাই। বুঝতে পারি মা কখনো হারায় না। আমরা জন্ম নিয়েছি মাতৃগর্ভে। আমরা ফিরে এসেছি জন্ম দিতে,-ওই মাতৃগর্ভে!
ফকির তখন নিরেট গৃহস্থ। চাষবাস করে খায়। বাজার-সদাই করে। বউ ও ছেলেপুলে নিয়ে ভরা সংসার তার। মনের মধ্যে আরেকবার ‘কবুল’ বলার শখ জেগেছে। ঘটক পাঠিয়েছে দূর গ্রামে। এমন সময় কুহকী আওয়াজের পাল্লায় পড়ে। সব মাটি হতে বসে ফকিরের। কাজে মন লাগে না। বাজার-সদাই করতে ইচ্ছে করে না। টাউনে গিয়ে ম্যাটিনি শো দেখতে ইচ্ছে করে না। কুহকী আওয়াজ সারাক্ষণ তার কানে তরঙ্গ তোলে। সুরেলা লাস্যে তাকে বেরিয়ে পড়তে ইশারা করে।
ফকির শহরে যায়। লোকের ভিড়ে ঘুরে। নদীর পারে চুপচাপ বসে থাকে। বিলের ধারে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ে। বোয়াল মাছ ঘাই দিচ্ছে বিলে। বোয়ালকে ঘাই তুলতে দেখে ফকিরের ঘাই তোলার শখ জাগে। সে বিলে নামে। বিলের কালো জলে হাত-পা ছড়িয়ে সাঁতরায়। শ্যাওলা ও কচুরিপনা তাকে ঘিরে ফেলে। নির্বিষ ঢোঁড়া সাপ কানের পাশ দিয়ে সাঁতার কাটে। শান্ত বিলে মৃদু তরঙ্গ উঠছে। কচুরিপনার ফুলের উপর বসা বুনো প্রজাপতি অকারণে উড়াল দিয়ে তার কানে গিয়ে বসে। ফকির জলে গা ছড়িয়ে ভাসে।
জলে-ভাসা ফকির এক পদ্মফুল। বিলটি পদ্মপাতা। থালার মতো পদ্মপাতায় সে চোখ বুজে শুয়ে আছে। ফকির এখন ব্রহ্মা। তার নাই-কুণ্ডুলিতে ঢোঁড়া সাপ গুটলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। কানে সুরেলা-ছন্দে কুহকীরা আওয়াজ তুলতে শুরু করেছে। খিল খিল হাসির তরঙ্গে ফকির পদ্মপাতায় দুলছে। হাসির তরঙ্গ সইতে না-পেরে ঢোঁড়া সাপ তার নাভি থেকে জলে নেমে পড়ে। প্রজাপতিরা হিজল গাছের ডালে গিয়ে বসে। সেখান থেকে উড়ে-উড়ে বিলের উপর পাক খায়। ফকিরের আর সহ্য হয় না। সে বিল থেকে উঠে আসে। পাগলের মতো মাথা নাড়িয়ে কান ঝাড়ে। তার কানের চারপাশে কুহকীরা ডেকেই চলেছে। ঝাঁকড়া হিজল গাছ তরঙ্গিত হয় সেই কলস্বরে। মৃদু ঢেউ জাগে থালার মতো বিলে।
কুহকীর কারণে ফকিরের আহার-নিদ্রা মাটি হতে বসে। কাজে শৈথিল্য ঘনায়। পরিবার ও পাড়া-পড়শী তাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। ডাক্তার-কবিরাজ দেখায়। হুজুরের শরণাপন্ন হয়। ফকিরের তবু অসুখ সারে না। কানের ভিতরে সারাক্ষণ কীসের যেন কানাকানি চলছে। সে ক্রমে ঘোরে ঢুকে পড়ে। ঘোর থেকে বেঘোরে নির্বাসিত হয়। খ্যাপাটে হয়ে ওঠে। ‘লাগ ভেলকি’ বলে ঘরের উঠানে চক্কর খায়। ফকির এখন উদোম নটরাজ। তার প্রমত্ত লিঙ্গে এমোনিয়ার ঝাঁঝ। সে উঠে গেছে আম গাছের ডালে। সহসা নামবে বলে মনে হচ্ছে না। ফকির এখন বানরকুলের ভাই। গাছের ডালে বসে পা দোলায়। নির্বিকার মুখ করে এমোনিয়া ত্যাগ করে। এমোনিয়ার ফেনা মাটিতে মিশে যাচ্ছে। ঝাঁঝালো গন্ধে ভরে উঠেছে চারপাশ। বউ নাকে আঁচল চাপা দেয়। বানরকে নামানোর কসরত চলে উঠানে। ফকির সেই কসরতে ধরা দেয়ার বান্দা নয়। বহু যুগ পর ডালে বসার সুযোগ পেয়েছে। গাছের ডালে বসে বাঁদরামির সাধ নিচ্ছে। সে এখন মানব নয়,-বাঁদর। সে এখন বানরকুলের ভাই।
ফকিরের এই তামাশা দেখে ইন্দ্রজাল হাসছেন। তার পিছনে কুহকী লেলিয়ে দিয়েছেন। ফকির ঘরের চালে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে। সেখান থেকে ‘হাক্ মাওলা’ বলে নিচে নামে। তাকে ধরার চেষ্টা চলছে। প্রমত্ত নটরাজকে ছেলেপিলেরা ঘিরে ধরে। পাড়া-পড়শীরা হাত দিয়ে ঘেরাও করে। ফকিরের মুখে পাগলা হাসির তরঙ্গ উঠেছে। তার গায়ে রাক্ষস ভর করেছে। রাক্ষসের চরকিনাচে ঘেরাও টিকছে না। উদোম ফকির মুক্তির আনন্দে ছুটতে শুরু করে। ইন্দ্রজাল মুচকি হেসে কুহকীকে ইশারা করেন। ধানখেতের আইল ধরে ফকির বেদম ছুটছে। কুহকীরা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে নিরুদ্দেশে।
পরিবারের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে ফকির পালায়। পাখি বাঁধন কেটে উড়াল দেয় অজানায়। সে এখন শহরে। ভিড়ের মাঝে হাঁটছে। শহরের গলিপথে বাঁক নিচ্ছে। গলির মোড়ে ক্যাসেটে গান বাজে। গানটি তার ভালো লেগেছে। কণ্ঠে ক্যাসেটের গান এসে ভর করে। গলা খুলে গাইতে থাকে,-‘পিঞ্জর খুলে দিয়েছি/যা কিছু কথা ছিল ভুলে গিয়েছি/যা রে, যাবি যদি যা।…/যা রে পাখি তুই উড়ে যা/যা রে বাঁধন কেটে যা।’ ইন্দ্রজাল ফকিরের গান শুনছেন। জাদু-বিস্তার করছেন তার হৃদয়ে। ফকির এক শান্ত বৈরাগী। কুহকীতালে জনপদ থেকে জনপদে ঘুরে। জীবনের ব্যস্ত কলরবের মাঝে অচিন আগন্তুকের তালাশ করে। গানের নেশায় আতুর হয়। তার চিত্তে পাখির জন্য বিষাদ ঘনায়। পিঞ্জর খুলে পাখিকে সে ছেড়ে দিয়েছে। শুয়াচান পাখি ফুড়ুত করে উড়ে গেছে নিরুদ্দেশে। ফকির তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। শুয়াচান পাখিকে ফেরত না পাওয়ার বিলাপে কণ্ঠ মেদুর হয়ে আসে,-‘সোনার পিঞ্জিরা আমার কইরা গেলায় খালি রে/হায় রে আমার যতনের পাখি/সোনা বন্ধুরে, কাটারি খাইয়া আজ মরি।’
ফকিরের বিলাপ শুনে ইন্দ্রজাল মুচকি হেসে ইশারা করেন। কুহকীরা তাকে জনপদ থেকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে। কণ্ঠে গানের তরঙ্গ ভরে জনপদ থেকে সে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাঁক নিচ্ছে নির্জনের দিকে। ফকির জনপদ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পেরিয়ে যাচ্ছে সাধুসঙ্গ। এই তো কিছুক্ষণ আগে কাওয়ালির ঘোরে ছিল। ফকিরি জিকিরে মশুগুল ছিল। তার হৃদয় প্রেমরসে ভরে উঠেছিল। পায়ে ঘূর্ণি তুলে কাওয়ালি ধরেছিল,-‘তেরি ইশক্ নাচায়া, থাইয়া থাইয়া থাইয়া।’
ইশকের পেয়ালা কুহকীরা কেড়ে নিয়েছে। মৌন ফকিরকে নামিয়ে দিয়েছে বৃষ্টিভেজা পিচ্ছিল পথে। চড়াই-উৎরাই ভেঙে সে পৌঁছে গেছে আশ্চর্য এই টিলায়। ঘর বেঁধেছে নির্জনে। ইন্দ্রজালের ইশারায় কুহকীরা তার কানে মন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে। কুহকী-মন্ত্রণায় বধির ফকির ভাবে নির্জনে গেলে নিশ্চয় আগন্তুকের দেখা পাবে। সে হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে ভালোবাসে। তার সাক্ষাৎ পাওয়ার আশায় টিলায় চলে এসেছে। গাছগাছালির হরিৎ অরণ্যে ঘর তুলেছে। টিলাটি অতি নির্জন। পাতা ঝরার শব্দে আশপাশ চমকে ওঠে। যদিও নির্জনে এসে লাভ হয়নি। আগন্তুকের দেখা এখনো মেলেনি। নাম-পরিচয় অস্পষ্টই রয়ে গেছে। অনামা আগন্তুককে ফকির তাই সাঁই বলে ডাকে। টিলার নির্জনে সাঁইয়ের তালাশ করে!
রাতে বাঁকা চাঁদ উঠে আকাশে। তারাগুলো মিটিমিটি করে জ্বলে। ঘরের দাওয়ায় বসে ফকির চাঁন-তারা দেখে। হালকা বাতাস তুফানে জমাট হয়ে বৃষ্টির আভাস আনে। টিলার গাছগাছালি বৃষ্টিধারায় সিক্ত হওয়ার লোভে কাঁপে। ফকির তার নিজের ভিতরে কম্পন টের পায়। তার হাতের একতারা টুনটুন করে ওঠে। উদাস ফকির একতারায় সঙ্গত করে,-‘কবে হবে সজল বরষা/আমি চেয়ে আছি ওই ভরসায়/আমার এই আধলা দশা মিটবে কতদিন পরে/এবার যদি না পাই চরণ আবার কী করি ফ্যারে/আমায় রাখিলেন সাঁই কূপজল করে আধলা পুকুরে।’
ইন্দ্রজালের ইশারায় ঘর ছেড়ে ফকিরের লাভ হয়নি। জনপদ ছেড়ে নির্জনতায় ডুব দিয়ে ‘অদেখা’র দেখা মেলেনি। তার কানের পাশে কুহকীরা আগের মতো আওয়াজ করে না। আওয়াজ থামানোর জন্য নিজের কান তাকে আর চেপে ধরতে হয় না। এখন চাইলে সে ঘরে ফিরতে পারে। কিন্তু ফকির ফেরে না। ঘরে ফেরার ক্ষুধা তাকে আর তাড়িত করে না। সে এখন বটবৃক্ষের নিচে ছায়া পাওয়ার জন্য বসে। কিন্তু ছায়ারা তার থেকে দূরে সরে যায়। কে যেন বলেছে শহরের প্রান্তদেশে এক নদী আছে। নদীর ওপারে এক দেশ রয়েছে। সেখানে যেতে পারলে আগন্তুকের দেখা মিলবে। ফকিরের বিশ্বাস হয় না। তবু টিলা পেরিয়ে সে ওই নদীর কাছে ধায়। তাকে দেখে নৌকা দূরে সরে যায়। বিফল মনোরথে ফকির আবার টিলায় ফেরত আসে। ঘরের দাওয়ায় বসে থাকে। তার দেহ অবসন্ন। মন অস্থির। ফকিরের ফিকিরি দেখে ইন্দ্রজাল হাসেন। সে এক ‘আজব আওয়াজের’ প্রেমে পড়েছে। কুহকীরা একদিন তার কানে আওয়াজটি করেছিল। ইন্দ্রজালের ইশারায় লোকান্তর থেকে লোকের কানে তারা আওয়াজটি করেছিল। এই আওয়াজ মানুষকে ফকির করে। তার বেশ-ভূষণ খসে পড়ে। সম্পর্কের সকল বন্ধন ছিঁড়ে যায়। মানুষ ফকির হয় আওয়াজের ফিকিরে।
ইন্দ্রজাল দেখেন ফকিরের চুল উস্কুখুস্কু। চোখের তারায় উদভ্রান্তি জমেছে। তার পায়ের গোড়ালিতে পথ পাড়ি দেয়ার ক্লান্তি। তাকে দেখে ইন্দ্রজালের মায়া হচ্ছে। তন্দ্রার জাল বিছিয়ে দিয়েছেন টিলায়। দুপুরের রৌদ্র প্রখর হয়ে থাকে। গর্জন গাছের ডালে টিট্টিভ পাখি সুর তুলে ডাকছে। ফকিরের ঘরের পাশে পেয়ারা গাছ। গাছের পাশ দিয়ে ঢালু পথ নিচে নেমে গেছে। ঢালুর ধারে সরু নালি। বৃষ্টির পানি সেই নালি দিয়ে সমানে বইছে। পানির মৃদু স্বরধ্বনি ও টিট্টিভ পাখির টি-টি ছাড়া টিলায় কোনো শব্দ নেই। ফকিরের চোখ ঘুমে ভারী হয়ে আসে। ইন্দ্রজাল এবার ঘুমন্ত ফকিরকে উঠাতে ইশারা করেন।
ফকিরের দেহ শূন্যে ভাসে। সে উঠে যাচ্ছে উপরে। গর্জন গাছের উঁচু ডালে টিট্টিভ পাখি বসে রয়েছে। ফকিরের দেহ পাখির পাশে গিয়ে স্থির হয়। গর্জন পাতার ঘন কষ টুপ করে তার ঠোঁটে এসে পড়ে। তেতো কষের প্রভাবে ঘুম টুঁটে যায়। ধড়মড় করে উঠার কারণে গর্জন গাছের ডাল থেকে নিচে ফসকে যেতে থাকে। ফকিরের দেহ নিচে পড়ছে। ইন্দ্রজাল তাকে পলকা তুলোর মতো মাটিতে নামিয়ে আনেন। ফকিরের ঘুম কেটে গেছে। মাটি থেকে শূন্যে আরোহন ও পুনরায় মাটিতে অবতরণের ঘটনাটি স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন সেটা নিশ্চিত হতে পারছে না। তার মুখ ঘর্মাক্ত। গা বেয়ে দরদর করে ঘামের স্রোত বইছে। এই প্রথম নিজেকে শূন্য লাগছে। লোকালয় ও নির্জনতা দুটোকেই সমান অর্থহীন মনে হচ্ছে। শুধু নিজেকে অর্থপূর্ণ লাগছে!
ফকির টিলা বেয়ে নিচে নামে। বৃষ্টিতে পিচ্ছিল পথ ধরে নদীর দিকে হাঁটা দেয়। সে এখন নদীপারে চলে এসেছে। নদীর তীরে বিরাট বট গাছ। ফকির সেই গাছের নিচে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। পাকা ফলে বট গাছটি বোঝাই হয়ে আছে। পাখিরা বটফলে সমানে ঠোকর দিচ্ছে। বটফলের বীজ মাটির ভিতরে ঢুকে নতুন চারাকে পল্লবিত করে। ফকির ভাবে এবার তার ঘরে ফেরা প্রয়োজন। কিন্তু ইন্দ্রজালের ইচ্ছা বট গাছের নিচে তাকে বসিয়ে রাখবেন। ফকির উঠতে চাইলেও উঠতে পারে না। তার হৃদযন্ত্রে কুহকীরা আবার ঢুকে পড়েছে। হৃদযন্ত্র-ভরে তারা ফিসফিস শব্দ করছে। ফকিরের কানে তারা নামতা পড়ে,-‘দুনিয়াটা মিছে, ফকিরিটা সত্য।’ তাদের কথা শুনে ফকির মাথা নাড়ে। সে বলতে চায় দুটোই ঘোর মিছে। শুধু জন্মটা সত্য। বেঁচে থাকা ও মরে যাওয়াটা সত্য। কিন্তু বলতে পারে না। তার ঠোঁট বেয়ে বটফলের তেতো কষ গড়িয়ে পড়ে।
অচিন পাখি ফকিরকে ঠোকর দিচ্ছে। ফকির এখন মিশে যাচ্ছে মাটিতে। সমাধিস্থ হচ্ছে বট গাছের নিচে। সব দেখে ইন্দ্রজাল হাসছেন। ফকিরের দেহকোষ আলগা হতে শুরু করেছে। দেহকোষে ভাঙনের ক্ষণে মানুষ দিব্যজ্যোতি লাভ করে থাকে। ফকিরকে দেখে মনে হচ্ছে সাদা দেবদূত মর্ত্যে নেমেছে। তার মৃতদেহ থেকে দ্যুতি ঠিকরে বেরোয়। ওর এই দিব্যজ্যোতি ধারণের খেলাটি দেখে ইন্দ্রজাল লোকালয়কে ইশারা করেন। ফকিরের শরীরে জাদু-বিস্তার করেন। তার মৃতদেহ ঘিরে লোকজন ভক্তিভরে জড়ো হতে থাকে। বটের পাতা শান্ত বাতাসে মৃদু দুলছে। ইন্দ্রজাল সেই পাতার ফাঁক দিয়ে ফকিরকে দেখছেন। লোকালয়কে তিনি কবর খুঁড়তে ইশারা করেন।
বট গাছের পাশে লোকজন কবর খুঁড়ছে। কবরের উপর লালসালু টানানো হয়। বাতাসে ওটা পতপত করে দোলে। আসছে বছর এই কবর মাজারে পরিণত হবে। পরের বছর লোকে এখানে শিন্নি দেবে। ফকিরের পরিবারকে ইন্দ্রজাল খবর করেছেন। ফকির বাবার দোয়া নিতে তারাও আসছে। এদিকে কবরে শুয়ে ফকিরের বুক দুঃখে ফেটে যায়। তার কানের পাশে কুহকীরা জীবনবৃত্তান্ত পড়ে শুনাচ্ছে। তাদের গলার স্বর অতীতের মতো মধুর ও সুরেলা নয়। প্রলুব্ধকারী নয়। কেমন যেন খটখটে! নিজের জীবনবৃত্তান্ত শুনতে ফকিরের ইচ্ছে করে না। সে কিছুটা বিরক্ত হয়। তর্ক করার রোখ চাপে মনে। ফকির বোঝাতে চায় মাটির উপরে থাকা ও মাটির নিচে থাকা দুটোই এক মস্ত তামাশা। কুহকীরা তার কথায় কর্ণপাত করে না।
মাটির নিচে শুয়ে থাকতে ফকিরের ভালো লাগছে না। সে উঠে পড়তে চাইছে। কুহকীরা ঘাড় ধরে তাকে শুইয়ে রাখে। জীবনবৃত্তান্ত পাঠ এখনো শেষ হয়নি। ওটা চলছে। কবরের উপরে আখনির গন্ধে বাতাস ভারী হয়। আজ ফকিরের ওরস হবে। মাজারের চারপাশ জুড়ে ‘হাক মাওলা’র হল্লা উঠছে। গায়করা সেখানে সমবেত হয়। নিজেকে বিলাপে বিদীর্ণ করে,-‘কী সাপে দংশিল আমারে/ও সাপুড়িয়া রে/জ্বলিয়া-পুড়িয়া মইলাম বিষে/বিষ উইঠাছে বিষনালে/রক্তের সনে মিশে/ও সাপুড়িয়া রে/জ্বলিয়া-পুড়িয়া মইলাম বিষে…’।
বাতাস ভারী হয়ে আছে আখনির সুঘ্রাণে। গায়কের বিচ্ছেদী বিলাপ ভেদ করে আখনির সুঘ্রাণ ভাসে। ‘বিচ্ছেদ ও হাক মাওলা’র তালে ইন্দ্রজাল মুচকি হাসেন। জাদু-বিস্তার করেন আখনি পাকানেওয়ালার হাতে। কুহকীদের ইশারা করেন সরে যেতে। ফকিরকে ছেড়ে তারা সরে যাচ্ছে। তার এখন একটু ঘুমের প্রয়োজন,-তিন হাত মাটির কবরে!
সেকালে এই শহরে ফকিররা বসবাস করতো। শহরের প্রতিটি কোণে একজন করে ধ্যানী পীর বসে থাকতেন। তারা ছিলেন ফকিরদের দীক্ষাগুরু। তাদের প্রাণের মুর্শীদ। পীর আমরা দেখিনি। আমাদের উপস্থিতি টের পেলে তারা উবে যেতেন। ফকিরের ঘোরমত্ত কণ্ঠ সাদা আলখাল্লায় ঢাকা পীরের গল্প বলে যেতো। আমরা তন্ময় হয়ে সে গল্প শুনতাম। পীর ও আমাদের মাঝখানে ফকিররা ছিল সংযোগ সেতু। ফকিরি ঢংয়ে ধ্যানী বকপাখির গল্প শুনাতো। মনে হতো এই কিছুক্ষণ আগে পীরেরা এখানে ছিলেন। ধ্যানী বকের মতো মাথা ঝুঁকিয়ে জিকিরে মশুগুল ছিলেন। তাদের সাদা আলখাল্লার সঞ্চালন অনুভব করে আমরা চঞ্চল হয়ে উঠতাম। গা শিউরে উঠতো অজানা রোমাঞ্চে!
পীরদের স্মৃতি বিজড়িত পিঠস্থান দেখে আমাদের মনে অপার সমীহ জাগতো। তাদের স্মৃতি ও অস্তিত্বকে সমাধিগুলো ধারণ করে আছে। এগুলোকে ধ্যানী পীরের সমাধি অনুভব করে আমরা সুখ পেতাম। সমাধির পরিচর্যা করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। রাতে ঘুমের দেশে তলিয়ে যাওয়ার সময় সমাধিরা জেগে উঠতো। পীরেরা জিকিরে মশগুল হতেন। সেকালে শহর অনেক নির্জন ছিল। রাত গভীর হলে জিকির-গুঞ্জনে নগরী গুঞ্জরিত হতো। জিকিরের আবেশে আমাদের চোখ ঘুমে ভারী হয়ে এলে ধ্যানী বকপাখিরা দফ্ বাজিয়ে সামা গানে মেতে উঠতেন। পীরদের সমাধি এখন মাজার নামে পরিচিত। আমরা মাজারে জিয়ারত করি। নিয়ম করে মিলাদ পড়ি ও শিন্নি দেই। দূর দূরান্ত থেকে লোকজন আসে। মাজার প্রাঙ্গণ ভরিয়ে তোলে। কিন্তু দফ্ ও সামার আওয়াজ আর পাই না। ফকিরদের সঙ্গে তারাও শহর থেকে বিদায় নিয়েছে।
লোকে বলে শহরে একদা ইন্দ্রজাল বিচরণ করতেন। তার ইশারায় শহরটি ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়তো। কুয়াশা ঘন হয়েছে দেখে গায়করা দলে-দলে শহরে নেমে আসতো। অলি-গলি ধরে ছড়িয়ে পড়তো। শহরটি ফকির ও গায়কের দখলে ছিল। সুদূর ভাটিদেশ থেকে গায়করা আসতো। হাওর-বাওর পেরিয়ে, নৌকায় ও লঞ্চে চড়ে তারা আসতো। দুর্গম কাদামাটির আল ঠেলে, অনেকট পথ পায়ে হেঁটে শহরে ঢুকে যেতো। লক্কর-ঝক্কর বাসে চেপে বাবরিচুলের গায়করা আবির্ভূত হতো এই শহরে। বেহালার আচমকা আর্তনাদে আমরা চমকে উঠতাম। আমাদের ঘুম ভেঙে যেতো। বিষমাখা প্রেমের শেলে বিদ্ধ হওয়ার শিহরণে লোমকূপে কাঁপুনী জাগতো।
ইন্দ্রজাল গায়ককে ইশারা করছেন। অচিন গায়ক বেহলার ছড়ে বিষ মাখিয়ে নশ্বর শহরকে ধরাশায়ী করছে। সে হরণ করে নিচ্ছে আমাদের প্রাণ। প্রেমশেলে বিদ্ধ হওয়ার যাতনায় আমরা গায়কের পিছু নিতে বাধ্য হয়েছি। গায়ক এখন বেহালায় ছড় টেনে গলিপথ পার হচ্ছে। তার কণ্ঠ কুহকী-বন্দনায় গমগম করছে। প্রেমের জিকিরে গলিপথ ভরে উঠেছে। গায়কের জিকির শুনে আমাদের পায়ের শব্দ থমকে যায়। গায়ক এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। আমরা সম্মোহিত ইঁদুর। বাঁশিওয়ালা আমাদের নদীতীরে টেনে এনেছে। কাদামাখা তটে বসিয়ে রেখেছে। তাকে ঘিরে আমরা গোল হয়ে বসে পড়েছি। গায়কের চোখ-মুখ বিষাদে কাতর হয়। আজ গান হবে! গায়ক সমাধিস্থ হবে বেহালার বিষমাখা ছড়ে।
শীতের কুয়াশায় নদী এখন অদৃশ্য প্রায়। ঘন কুয়াশায় দু’একটা পণ্যবাহী নৌকা ছাড়া কিছু ঠাহর হয় না। তীরে-বাঁধা নৌকায় টিম-টিম করে প্রদীপ জ্বলছে। মাঝিরা নৌকা থেকে গায়ককে দেখতে পেয়েছে। সেদ্ধ চালের গন্ধ নদীতীরে উথলে উঠেছে। মাঝিরা চুলোয় ভাত চাপায়। গায়কের সাক্ষাৎ পেয়ে নৌকা থেকে হাঁক ছাড়ে,-‘কিতা বা, গান-টান অইবোনি?’ গায়ক বেহালায় ছড় টেনে উত্তর করে,-‘অইবো। মুর্শীদে কান্ডারি অইলে গান অইবো।’
গায়কের উত্তর শুনে ইন্দ্রজাল হাসেন। মাঝির নৌকায় জাদু বিস্তার করেন। নৌকা থেকে আওয়াজ ওঠে,-‘মুর্শীদের দোআই দিয়া পার পাইতায় না। বহুত্ দিন বাদে তোমার লাগ পাইছি। মুর্শীদ আইজ ভর করছইন নদীর পারো। এলাহী ভর করছইন আমরার উফ্রে। এলাহীর নাম নিয়া শুরু করো মিঞা।’
মাঝিদের যুক্তি শুনে ইন্দ্রজাল কুহকীদের ইশরা করেন। গায়কের বেহালায় তারা ভর করে। অনামা এলাহীকে লক্ষ করে গায়ক বেহালায় ছড় টানে,-‘তোমার নাম-স্মরণে ঘোর নিদানে/আমি চরণ-ভিক্ষা চাই ওগো এলাহী/তোমার মতো দরদী আর নাই/ওগো এলাহী/মাতা-পিতা রমণফলে/মাতৃগর্ভে পাঠাইলে/জরায়ুতে দিয়াছিলে ঠাঁই/তোমার কী আজব ঘটনা/মাতা-পিতায় টের পাইলা না/আলিমুল গায়েবে আল্লা সাঁই গো এলাহী/তোমার মতো দরদী আর নাই।…’
নদীতীরে গায়কের স্বর প্রলম্বিত হয়। কুয়াশা পায়ের গোড়ালি দখলে নিতে থাকে। শীতের তীব্রতায় রোমকূপে শিহরন জাগে। এই নদীতীর এখন মাতৃজরায়ু। আমরা তার বশীভূত বালক। মাতৃত্বের প্রথম প্রহরে ফিরে গেছি। মায়ের গর্ভে নিজেকে গুটলি পাকাতে দেখছি। মা আমাদের এখানে প্রসব করেছে। আমরা ভূমিষ্ট হয়েছি নদীতীরে। নিরাকার থেকে রূপ নিচ্ছি আকারে। আবিভূর্ত হচ্ছি দৃশ্যের জাদুকরি জগতে। ভাষা দিচ্ছি নিজেকে। মা আমাদের ছেড়ে গেছে। এলাহী নিরাকারে অদৃশ্য হয়েছেন। মা ও এলাহীর আকস্মিক অন্তর্ধানে আমরা অসহায় বোধ করি। নিজেকে বুঝতে পারি না। শুধু নদীতীর ধরে হাঁটি। পরিপূর্ণ হই পরিপার্শ্বে। আবিল হই জগৎপ্লাবি দৃশ্যস্রোতে।
নদীতীর লোকালয়ে ভরে উঠেছে। আমরা লোকালয়ে ঢুকে পড়েছি। জনতার অফুরন্ত মিছিলে বেড়ে উঠছি। সম্পর্কের ভিড়ে কলরব করছি। মা ও এলাহীর অন্তর্ধানে আমরা আর বিচলিত নই। নিজের বেড়ে উঠা নিয়ে নিজেই মুগ্ধ। আমরা পুরুষ হওয়ার আবেশ যাপন করছি। নারী ও শিশুর প্রেমে কাতর হওয়ার সুখ উদ্যাপন করছি। প্রিয় রমণীকে নিয়ে নদীতীরে একলা হয়েছি। তার গর্ভে কচি ভ্রূণ ঠেসে দিচ্ছি। টের পাচ্ছি কাঁচা মাংসপিণ্ডের কম্পন। রমণীগর্ভে ওটা নড়ছে। নিজের অজান্তে আমরা আবার হারানো মায়ের নিকটে ফিরে আসি। প্রিয় রমণীর স্ফিতকায় অবয়বে তাকে দেখতে পাই। বুঝতে পারি মা কখনো হারায় না। আমরা জন্ম নিয়েছি মাতৃগর্ভে। আমরা ফিরে এসেছি জন্ম দিতে,-ওই মাতৃগর্ভে!
নদীতীর এখন নির্জন। লোকালয় নির্জনতায় অদৃশ্য হয়েছে। মা ছাড়া বিস্তীর্ণ নদীতটে কেউ নেই। দূর থেকে আমরা দেখছি মা নদীতে নেমে যাচ্ছে। নদী সঙ্কুচিত হয় উত্তাল জরায়ুতে। ইন্দ্রজাল তার জাদুর ঝাঁপিটি খুলে দিয়েছেন। নিজেকে আমরা জরায়ুর পিচ্ছিল জলাশয়ে সমাধিস্থ হতে দেখি। রূপ নেই বিচিত্র আকারে। বিলুপ্ত হতে থাকি নিরাকারে। সঙ্গীত আমাদের চেতনাকে অবশ করে দিয়েছে। গায়ক ও মাঝির সঙ্গে নিজেদের কোনো ভিন্নতা টের পাচ্ছি না। সবাই মিলে সঙ্গীতে লীন হয়েছি। বেহালার বিষমাখা ছড়ে অভিভূত হয়ে আশ্চর্য এই অস্তিত্বকে বন্দনা করছি। এই অস্তিত্বের শুরু মায়ের জরায়ুতে। এর পুনর্জন্ম সেই জরায়ুতে। এর শুরু এক ‘আমি’কে দিয়ে। তিরোভাব ও পুনর্জন্ম আবারো সেই ‘আমি’র মধ্যে। বন্দনাগানে নদীতীর ভরে উঠেছে। আমরা নিজেকে বন্দনা করছি। গলা খুলে গাইছি,-‘রূপ দেখিলাম নয়নে/আপনার রূপ/দেখিলাম রে/আমার মাঝত্ বাহির হইয়া/দেখা দিল আমারে/রূপ দেখিলাম রে।/সোনার-ও বদনখনি/যেন কাঞ্চা সোনা/দেখিয়া আপনার-ও রূপ/আপনি যে ফানা/রূপ দেখিলাম রে।’
রূপ-দর্শনের খেলা দেখে ইন্দ্রজাল এতোক্ষণ মুচকি হাসছিলেন। আমাদের তাড়িয়ে দিতে কুহকীকে ইশারা করেন। রূপ-দর্শন করিয়ে তিনি এখন ক্লান্ত। হয়তো বিশ্রামে যাবেন। ইন্দ্রজালের ইশারায় কুহকীরা ঘন কুয়াশার জাল বিস্তার করে নদীতীরে। কুয়াশাজাল ঠেলে আমরা হাঁটতে থাকি। গায়ক বিষমাখা বেহালার ছড়ে পাগলের মতো টান দিচ্ছে। তার ঝাঁকড়া চুল আর নিজের বশে নেই। সম্মোহিত চরণ ফেলে নদীতীর থেকে রাস্তায় নেমে পড়েছে। আমরা তাকে অনুসরণ করি। গায়কের সঙ্গে নিজেরাও নিওনবাতির মৃদু আলোয় ঢুকে পড়ি। একটি ছুটন্ত ইঞ্জিন হুঁশ করে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। রাত গভীর হলেও চৌরাস্তা পুরোপুরি নির্জন নয়। খুচরো দোকানী তার ঝাঁপি এখনো বন্ধ করেনি। শীত তাড়াতে ক্যাসেটে গান চাপিয়েছে। রাতের নির্জনতা খুন করে গায়ক গাইছে,-‘আমি কষ্ট পেতে ভালবাসি/তাই তোমার কাছে ছুটে আসি।’
দোকানী চোখ মুদে গায়ককে শুনছে। প্রেমিক গায়কের কষ্টে নিজে কষ্ট পাচ্ছে বোঝা যায়। হতে পারে গায়কের মতো দোকানীও দাগা খেয়ে কষ্টের গান বাজাচ্ছে এতো রাতে। রাস্তার নিওনবাতিকে দেখে মনে হলো সে বেচারা দোকানীর কষ্টে খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমরা ঘোরে ছিলাম। দোকানীর কষ্ট-সঙ্গীতে ঘোর কেটে যায়। বাবরি চুলের গায়ক তার বেহালার ছড় থামিয়ে কাষ্ঠ হাসি হাসে,-‘কী ঠাণ্ডারে বাবা! একটা পান খাইলে মন্দ অয় না। কিতা কইন আপনারা?’ তার কথায় সায় দিয়ে আমরা মৃদু হাসি। রক্তে সিগারেটের তৃষ্ণা টের পাই। সিগারেটে সুখটান দিয়ে বুঝতে পারি আমরা আর নদীতীরে নেই। কোনো জরায়ুতে নেই। অন্তত এই মুহূর্তে কোনো মাতৃগর্ভে নেই। মা আমাদের প্রসব করেছে এই শহরে। আমরা বেড়ে উঠেছি বর্তমানে। নদীতীর থেকে এইমাত্র জংধরা মামুলি শহরে ফিরছি!