আলোর আঘ্রাণ- এর পাঠপর্যায় কথাসূত্র । ধীমান সৈকত
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুন ২০১৬, ২:৩৫ অপরাহ্ণ, | ২১০৪ বার পঠিত
বাংলা কবিতার আদিপাঠ আর পূর্বাপর পাঠে সম্পূর্ণতা নেই, নেই কোনো সম্পৃক্ততা কবির সাথে কবির— কবিতার। তবু কখনও কখনও মিল এসে যায় বা সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় অগ্রজের সাথে অনুজের কবিতার। আমার পঠিত কবি এহসান হায়দার এর ‘আলোর আঘ্রাণ‘ কবিতার বই। কবির নিঃশব্দ যাত্রা যেন বইয়ের এক একটি কবিতা। এহসান দীর্ঘ দিন ধরে লিখছেন, কিন্তু কোনো চাতুর্য নেই মিডিয়ার কল্যানে তার নামে।
সাধারনত আমরা দেখে থাকি এহসান তার কবিতার যাপনে যেন একাকি হেঁটে চলেছেন। বাংলা কবিতায় আশি পরবর্তী সময়ে নতুন ভাবনায় কোনো কবিকে দেখা যায় না। মধ্য আশিতে কবিদের আলোর ঝলকানির আভার দেখা মিললেও শেষাব্দি তা আর পূর্নতা পায়নি। বরং নব্বই বা শূন্য দশকে কেবল দশকবাজীর ব্যতিক্রম ঘটেনি। দশকের পর দশক ধরে দলবাজী ও পিঠচাপড়ানী সাহিত্য চর্চা অব্যাহত রয়েছে। এহসান হায়দার এই সময়েরই কবি। গলাবাজী, দলবাজী, চালবাজী স্ট্যানবাজী এসবেই এ সময়ের কবিরা নিমজ্জিত। প্রতিটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা বা সাময়িকী ঘিরে একেকটা গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে এদেশের সাহিত্য পরিমণ্ডলে। কেউ কাউকে জায়গা দিতে চায় না সামান্যতম। সেখানে প্রান্তিক জনপদের কোনো লেখক কবি উঠে আসবেন তার ভালো লেখার গুনে এটা প্রত্যাশাও যেন ‘আকাশকুসুম কল্পনা‘ মাত্র। আর ওর লেখা বই যে কেউ পাঠ করে কেউ খুব লিখবে তাও আশা করা বোকার স্বর্গে বসবাসের মতো। একটা সময় ছিল যখন কবিতা, গল্প–উপন্যাস এসব যারা লিখতো তারা সমাজের মানুষের কাছে বড্ড মহান ছিলো– একালে একেবারে ঠিক তার উল্টোটাই চোখে পড়ে। এখন যুগ পাল্টেছে হয়তো কবিরা এখন সেই ইতিহাসের ফকির বিদ্রোহের মতোন কলম খাতা হাতে নিয়ে কবিতা চর্চাতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে পারছেন না বা চান না। তা না হলে তো– বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশ্লীল ভাবে এক কবি আরেক কবিকে গাল দিতো না। তার মানে কবিতার দিন বদলেছে। শহুরে আধুনিক মানুষেরা এখন যদিও কবিতা পড়ে না কিন্তু ফেসবুকের কল্যাণে মানুষ এখন নিজেদের রাতারাতি বড় কবি বানিয়ে ফেলেন।
কবি মানেই তাকে ফেসবুক, টুইটারে ফলোয়ার— লাইকারের সংখ্যা বাড়ানো। সাম্প্রতিককালের কবিরা আরও একটি কাজ মহৎ নীতি নিয়ে করে থাকেন তা হলো— আগে রাজা বাদশাহরা কবিকে তোয়াজ করতেন, তাদের ভয় পেতেন আর এখন কবিরাই রাজা–বাদশাহদের ভয় পায়, তোয়াজ করে।
আলোর আঘ্রাণ— নিয়ে কথা বলতেই আমার এতো কথা। কথার পিঠে কথা বললেই তো কথা বাড়তে থাকে। এহসান হায়দার এর ‘আলোর আঘ্রাণ‘— এ সবমিলিয়ে পঁয়ত্রিশ টি কবিতা রয়েছে। আকারে খুব দীর্ঘ মাত্র ৫–৬টি কবিতা যার পঙক্তি সংখ্যাও ২২ সর্বোচ্চ। আর বাকি কবিতার শরীর মাঝারি সর্বোচ্চ ১০ পঙক্তিতে সীমাবদ্ধ। বইয়ের প্রথম কবিতা ‘আলোসন্দেহ দিন‘ এ ঠাসা এক ধরনের উপমায় চিত্রন করা হয়েছে। কবির এই আলোসন্দেহ কী, কেন তা রহস্যঘন হতে থাকে শুরু থেকে। কখনও মনে হয় কবি তাঁর প্রমিকাকে বলছেন— কখনও মনে হয় প্রেমিকার গুন,রূপ বর্ননা করছেন—
একরাশ মেঘ ঘুরে ঘুরে ত্রিকোণ হয়
আলো দিনগুলোর চেয়েও দ্রুত মনের দৃষ্টি
সূর্য শুষে নেয় রাত ও নীরব সন্দেহ
সব রোদ হয়ে ওঠে নীল।
যে তোমায় খুঁজে যায়— আলোর তলদেশে
তুমি দৃশ্যের ভেতর অন্য দৃশ্য;
এক জগৎ সে,
যেন ঝলমলে।
(আলোসন্দেহ দিন # পৃষ্ঠা ১৩)
আবার—
তুমি অরূপের ভেতরে কেবলই এক রূপ
কোনো ভিন্নতা নেই
সুরে ঝরে পড়ে আকাঙ্ক্ষা—
যেন হাওয়া আর একটা বেতফল ছুটে আসে
বহমান নদী।
(আলোসন্দেহ দিন # পৃষ্ঠা ১৩)
দু–জায়গাতেই মনে হয় এক অসাধারন প্রেমের কারুকাজ। কিন্তু কার জন্য এ উপমা এ বন্দনা—
তা কী পাঠক মাত্রেরই বোধগম্য হবে?
কবিতাটি সুখপাঠ্য অর্থবোধ সম্পন্ন। কিন্তু সাধারন পাঠক খুব ধন্দে পড়বেন এহসান এর এ রকমের নানা গাঁথুনীতে।
তিন পঙক্তির কবিতা এটা—
ধুসর পাথর তোমার নীরবতা,
আমার ব্যথাবিহঙ্গ
দীর্ঘ অভিমানের শীত কবে শেষ হবে
(গতদিনের # পৃষ্ঠা ১৫)
কবিতাটি পড়ে মনে হলো ষাটের কবি— ভাস্কর চক্রবর্তী‘র কথা। তিনি লিখেছিলেন, ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা‘। গতদিনের শিরোনামের কবিতাটিকে এমনই আবেদনের মনে হয়েছে। পাঠক একে কীভাবে দেখবেন তা পাঠকের নিজস্ব বিষয়ভাবনা। প্রেমিকার ‘নীরবতা‘র রং ‘ধুসর‘ হয়, কবির ‘ব্যথা বিহঙ্গ‘ পাখীর মতো উড়ে উড়ে যায়, কবি যেন প্রেমিকার কষ্টও নেন আবার নিজের কষ্টও নেন— তখনই উচ্চারন করেন, প্রশ্ন করেন— কবে শেষ হবে এই ‘অভিমানের শীত?’
শহুরে দিনে দেখি মন পুড়ছে কবির। কারন কবিও একজন শিল্পী, কবিতার শিল্পী। কিন্তু এ শহরজুড়ে শিল্পগেলার ধান্দায় থাকা মানুষও যেন আরও শিল্প গিলতে চায়। গিলে গিলে নগর আর শিল্পকে ক্ষত–বিক্ষত করে; কবি এদের ‘শিল্পশকুন‘ বলেন।
কবিতার বিচার বিশ্লেষণ আর সমালোচনা করার কাজ আমার না। কেবল পাঠ মন্তব্য করাই আমার উদ্দেশ্য। এহসান হায়দার এর ‘আলোর আঘ্রাণ‘ বইয়ে গদ্যপথে হেঁটে যাওয়া কবিতার একটা সুপরিচিত অধ্যায়। ছন্দের বন্ধনে কোনো কবিতা তৈরির চেষ্টা দেখা যায় না বইটিতে। হয়তো কবি চেয়েছেন ছন্দ এড়িয়ে লিখতে— তবে কী কবি তার শুরুটা ছন্দের দোলায় নিতে চান নি? অথবা পরে কী তার কোনো ভিন্ন গ্রন্থে সে পরিচয় দিতে চান— সে অপেক্ষা করতে হবে বই কী? পাঠ সূচীর দিকে কবিতার নাম–বিষয়বস্তুর ভেতরবাহির একটা সম্যক ধারনা পাওয়া যায়।
নিজস্বতার একটা সূক্ষ্ম ছাপ রাখার প্রয়াস এই বইয়ে এহসান রেখেছেন। ব্যাক্তিগত ভাবে এহসান সম্পর্কে জানার সুযোগ থাকায় ওর চিন্তা–কবিতা লেখার সরল—সমান্তরাল গতি আবিষ্কার করা সহজ হয়ে উঠেছে অনেক খানি।
চুম্বনফুল, পরিবিষয়ী, গতদিনের, আলোসন্দেহ দিন, আলোর আঘ্রাণ, কবিতাত্রয়, মৃত্যু ডায়েরী ব্যাতিক্রমী মনে হয়েছে। আর পুরো বই জুড়ে একটা কাব্যিক জার্নির আভাস পাওয়া যায়— যাহ সাধারনত অনেকের বেলায় ঘটে নাহ। তাই এ কথাটি বলতে পারি প্রথম কবিতার বই এহসান ‘আলোর আঘ্রাণ‘ প্রকাশ করে যে নতুন সুর বাজাতে চেয়েছেন তা পরবর্তী কাজে খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশা করছি। পরিশেষে কবিতার যাত্রার পথ শুভ হোক কবি এহসান হায়দার এর যে পথে হেঁটে হেঁটে বয়ে গেছে আলোর যাত্রার পরিবিষয়ী কবিতার নিজস্ব স্বর— এ পথে চলুন আজন্ম।