ওসমান সমাচার পর্ব ৩ । আহমদ মিনহাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জুন ২০১৬, ৬:৩৪ অপরাহ্ণ, | ২৫৬৪ বার পঠিত
গজগামিনী চাঁদ, ফুট-ফেটিশ পিয়ার ও রাক্ষস সমাচার (২)
জীবনের পড়ন্ত বেলায় হাঁটুর বয়সী মেয়েকে পিয়ার কী করে জোটালেন সেটা নিয়ে অনেক গল্প চালু আছে শহরে। সবচেয়ে বিশ্বস্ত গল্পটি বলে দাঙ্গার বছরে ঈশ্বর তার কপালে এই তরুণীটি বরাদ্দ করেন। দাঙ্গায় শহরবাসীর কপাল পুড়লেও পিয়ারের কপালে জোটে অনিন্দ্য এক রাজকন্যা। দাঙ্গা বাঁধার কারণটি ভারি অদ্ভুত ছিল। এরকম দাঙ্গা শহরটি আগে কখনো দেখেনি। এটি এমন এক দাঙ্গা যেখানে পূর্ণেন্দু বাবু, ফাদার রোজারিও এবং জামে মসজিদের পেশ ইমাম সাহেবের কিছু করার থাকে না। কারণ দাঙ্গাটি ছিল অন্যরকম। এই প্রথম মেয়র সাহেব ও জেলা প্রশাসকের প্রতি আমরা ক্ষুব্ধ হই। খাকি ও জলপাইয়ে অনাস্থা জ্ঞাপন করি। এবং, এই প্রথম ও শেষবার সিভিল ও মিলিটারি পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ি। একে অন্যকে আক্রমণ করি। শহর ভরে উঠে গোলা-বারুদ ও টিয়ার গ্যাসে। ব্যস্ত সড়কে সাজোয়া ট্যাঙ্ক ও জলকামান নামে। শহরের অলি-গলি ইটের টুকরোয় বোঝাই হতে থাকে। ছুরি ও চাপাতি ঝিলিক দেয় রাত-বিরাতে। শহরে অন্ধকার নামে। আমরা কার্ফিউ ও ব্ল্যাকআউট উপেক্ষা করে দলে-দলে রাস্তায় নেমে পড়ি।
দাঙ্গাটি অদ্ভুত ছিল। গলি রাস্তায় স্যান্ডেলকে তাড়া করে বুট জুতো। আচমকা ছুটোছুটি ও গোলাগুলির মধ্যে ককটেল যখন-তখন ফাটে। ভারী ট্যাঙ্কের গর্জনে রমণীরা গর্ভপাত ঘটায়। হাসপাতালের ফ্লোর রক্ত ও জখমে সয়লাব হয়। মর্গে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বেড়ে চলে। লাশের মিছিল দেখে ডোমরা ত্যক্তবিরক্ত হয়। এই প্রথম ডেটল ও ফিনাইলের গন্ধে আমাদের বমি আসে। সার্জন সাহেব দেবদূত হয়ে উঠেন। আমরা তাকে ঘনঘন দেবদূত বলে সম্বোধন করতে থাকি। ওসমানকে আমরা কখনো দেখিনি। ঈশ্বরকে দেখার অভিজ্ঞতাও কারো নেই। যদিও উভয়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের মনে দ্বিধা নেই। সার্জন সাহেবের গালের কাটা দাগে আমরা ঈশ্বরকে আবিষ্কার করি। সকলে মিলে প্রণত হই সেবিকা ও চিকিৎসকের পায়ে।
দাঙ্গার দিনগুলোয় আমরা উপাসনালয় গুলিয়ে ফেলতে থাকি। মন্দিরে ঢুকতে গিয়ে মসজিদে ঢুকে পড়ি। মসজিদে ঢুকে দেখি গির্জা ও মন্দিরে বসে আছি। এই প্রথম পূর্ণেন্দু বাবু, ফাদার রোজারিও ও পেশ ইমামকে একসঙ্গে জানু পেতে কান্না করতে দেখি। এবং, এই প্রথম পিয়ার মোহাম্মদের মধ্যে ওসমানকে টের পাই। তার চোখ আমাদের পায়ের দিকে তাক্ করা। সেই চোখে রক্ত পানের খিদে। আমরা পিয়ার মোহাম্মদের মুখোমুখি হই। তার পদযুগল-প্রীতি নিয়ে কটাক্ষ করি। তাকে ফুট-ফেটিশ বলে খোঁচাই। পিয়ারের রকমারি ব্যঙ্গচিত্রে শহরের দেয়াল ভরিয়ে তুলি। আমাদের যুবতীরা গোড়ালি উঁচিয়ে তার ট্যাঙ্ক ঘেরাও করে। পেশাদার নর্তকীর মতো হাতে হাত রেখে পিয়ারকে সমরে আহবান জানায়।
দাঙ্গাটি সত্যি অদ্ভুত ছিল। এর কারণ ও পরিণামে নাটকীয়তার খামতি ছিল না। আমরা কেউ নিজের মধ্যে ছিলাম না। আমাদের শিশু ও যুবকরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। রমণীরা মাত্রাজ্ঞান হারায়। অদ্ভুত এই দাঙ্গায় খাকি ও জলপাই নিজেকে বশে রাখতে ব্যর্থ হয়। আমরা পাগলা কুকুর হয়ে উঠি। আমাদের দেখাদেখি তারাও পাগল হয়ে ওঠে। দাঙ্গার প্রথম দিন আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমরা রাস্তায় নামি। মিছিল ও শ্লোগানে শহর প্রকম্পিত হয়। প্রতিটি রাস্তার মোড়ে ব্যারিকেড ওঠে। আমরা অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দিই। এই প্রথম তদন্ত ও দোষীদের সমুচিত শাস্তির আপ্তবাক্যে আমাদের ঘৃণা জাগে। মেয়র ও পিয়ারকে রূঢ়বাক্যে ফিরিয়ে দিই। আকস্মিক ক্ষোভে সবকিছু টগবগ করে ফুটে।
পিয়ারের বউকে নিয়ে আমরা বৃষ্টিতে ভিজি। মেঘবরণ কন্যার কুঁচবরণ কেশ বৃষ্টির তোড়ে খুলে-খুলে পড়ে। আমরা দুই হাত দিয়ে সেই কেশ ধরি। কেশবতি কন্যাকে বুকের খাঁচায় ধরে রাখি। পিয়ারের রূপবতী বউকে অবিশ্রান্ত বৃষ্টিফোঁটায় সিক্ত করে চলি।
দাঙ্গার নিয়মে শহর জুড়ে ভাঙচুর শুরু হয়। আমরা বিপণিবিতানে আগুন লাগাই। খাকি ও জলপাইকে ইটের টুকরো ছুঁড়ে জখম করি। ট্রাফিক সার্জেন্টের ঘুষখোর পায়ে সপাটে হকিস্টিক ঘুরাই। মাত্র গতকাল তার পকেট মুদ্রা দিয়ে ভরেছি। আজ টেংরি ভেঙে ঘুষের শোধ তুলি। হঠাৎ কী হয়, আমরা ঢুকে পড়ি সরকারি দর-দালানে। কেরানি ও আমলাদের কান ধরে রাস্তায় টেনে আনি। শামিল করি মিছিলে। কেরানি ও আমলারা সরীসৃপ-স্বভাবী। তারা ঋতু বুঝে খোলস ছাড়ে, অবস্থা বুঝে ভোল পালটায়। সরীসৃপকে শামিল করতে পারায় মিছিলে তাই উল্লাস জাগে। আমাদের অবাক করে সরীসৃপরা মন্ত্রীর বাসভবনে হামলা করে বসে। বেতন না-বাড়ানোর ক্ষোভ এই ফাঁকে মিটিয়ে নেয়। আমরা অন্য পেশাজীবীদের মিছিলে শরিক করাই। ভীতচিত্তে তারা মিছিলে যোগ দেয়। দাঙ্গা শুরুর দিনে শহরে আমরা দুর্বার হয়ে উঠি।
দাঙ্গার প্রথম দুই দিন এভাবে কাটে। তৃতীয় দিনে ছক পালটায়। পিয়ারের বন্দুক ও কামান খুনি হয়ে ওঠে। খাকিরা ঘরে-ঘরে তল্লাশি শুরু করে। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে কেরানি, আমলা ও শিক্ষকরা রাস্তা থেকে নিমিষে উবে যায়। নিজেকে আবার ঘিনঘিনে সরীসৃপে পরিণত করে। অন্যদিকে যুবকরা দলে-দলে গ্রেপ্তার হতে থাকে। বেয়নেটের খোঁচা খেয়ে গলি-রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে। পিয়ারের ট্যাঙ্ক ঘেরাওকারী যুবতীরা জলপাই জিপে উঠতে বাধ্য হয়। আমরা সাময়িক পিছু হটি। যুবতী বোনদের পরিণাম ভেবে চিন্তিত হই। আমাদের ক্ষোভ তীব্র হয়। আমরা অতীত স্মরণ করি। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ইতিহাস মনে করার চেষ্টা করি। একজোট হয়ে লড়াই করার দিনগুলো নিয়ে আলাপ করি। সংকল্পে দৃঢ়চেতা হই। মনে-মনে দুর্বার হয়ে উঠি।
চতুর্থ দিন শেষে আবার আমরা খাকি ও জলপাইকে ঘেরাও করি। আমাদের রমণীরা এখনো জিপে। তারা বন্দি পিয়ারের কনভয়ে। সৈন্য শিবির ও সেনা-ছাউনিতে। যুবতী বোনদের সম্ভ্রম হারানোর উৎকণ্ঠা আমাদের পাগল করে তোলে। আমরা জীবন বাজি রেখে পিয়ারের ট্যাঙ্ক ও কনভয়ের পিছু নেই। খালি হাতে সেনা-ছাউনি ঘিরে ফেলি। আমাদের চোখ টিয়ার গ্যাসে ঝাঁঝরা হয়। হাঁটু থেকে পিচকারি দিয়ে রক্তের ফোয়ারা ছুটে। আমরা রাস্তায় লুটিয়ে পড়ি। খাকি ও জলপাই আমাদের মুখে লাথি মারে। সেনা-ছাউনি থেকে আমরা ড্রেনে গড়িয়ে পড়ি। গড়াগড়ি খাই পাড়ার রাস্তায়। কাতরাই শহরের প্রধান সড়কে। তবু হাল ছাড়ি না। পিয়ারের সঙ্গে আমাদের লড়াই রক্ত, জখম ও কলজে-কাঁপানো শিৎকারের মধ্যে বহাল থাকে।
জেলা প্রশাসক ও মেয়র সাহেব বোঝাতে অক্ষম হন যে আইন নিজের হাতে নিয়ে আমরা ভুল করছি। মেয়রকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। তার ফুলের বাগানে ঢুকে সাজানো কেয়ারি তছনছ করি। নিজের মধ্যে ওসমানকে টের পাই। প্রথম ও শেষবার তাকে আপন বলে ভাবি। ফুলখেকো রাক্ষস শহরে ভর করে। দাঙ্গায় যোগ দেয়। ফুট-ফেটিশ পিয়ারের উপর তাকে ভর করতে দেখি। নিজের ভিতর তার নড়াচড়া টের পাই। দাঙ্গার পঞ্চম দিন শেষে শহরের আনাচে-কানাচে আমরা ছড়িয়ে পড়ি। রক্তচাখার ক্ষুধায় উন্মত্ত হই। ত্বরিত হানা দেই খাকি-ডেরায়। আগুন ধরাই জেলা-প্রশাসকের কক্ষে। স্থাপনা সচিব ও ঠিকাদার বাধা দিতে এলে তাদের কান ধরে চৌরাস্তায় উঠবস করাই। চেম্বার সভাপতিকে পেয়ে হাতে আকাশের চাঁদ পাই। বিদেশী ব্রান্ডের বদলে তার মুখে বিড়ির বাণ্ডিল ঠেসে ধরি। শখের গাড়ি লুট করে হানা দেই সেনা-ছাউনিতে।
আমরা আর দুর্বল নই। সুযোগসন্ধানীরা আমাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ধরিয়ে দিয়েছে। মেয়রের প্রতিপক্ষরা এখন মিত্র হয়েছে। জলপাই তাঁবুর দিকে সকলে আগ্নেয়াস্ত্র তাক্ করি। লাশ ফেলি ও নিজেরা লাশ হই। অখিল বাবু আমাদের বোঝাতে এসে ব্যর্থ হয়। আমরা তাকে জজের টিলায় দৌড় করাই। জজ সাহেবকে নিয়ে প্রকাশ্যে মশকরা করি। শহরের বিশিষ্ট বুদ্ধিসেবীদের দেখে ভেংচি কাটি। জিপার খুলে তাদেরকে কলা দেখাই। আমাদের কেন জানি মনে হয় বুদ্ধিসেবীরা মানবদেহের এই অঙ্গটি দেখার জন্য শহরে জন্ম নিয়েছে। এই প্রথম আমরা স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুখ উদযাপন করি। ওসমানের মতো যততত্র হানা দেয়ার রাক্ষুসে আমোদে মেতে উঠি। বন্য ও অসভ্য হতে পেরেছি ভেবে যারপরনাই খুশি হই। এবং, এই প্রথম পিয়ারের শক্ত হাঁটুতে আমরা কম্পন টের পাই। ওটা এখন কাঁপছে। ফুট-ফেটিশের ট্যাঙ্ক ও কনভয় ভেদ করে অট্টহাসির রোল উঠেছে। তার প্রয়াত স্ত্রী গোড়ালি তুলে তাকে ডাকছে,-‘পিয়ার চলে আয়, এখনো সময় আছে, ঝাঁপ দে মরণে।’
প্রতিটি ঘটনার শুরু ও সমাপ্তি থাকে। ঘটনা সমাপ্ত হয় ঘটনার আবর্ত অনুসারে। প্রতিটি তাণ্ডব শুরু হয় স্বেচ্ছাচারে। পরিশেষ ঘটে সকরুণ বিষাদে। তাণ্ডবের শুরু ও শেষের মাঝখানে যেসব ঘটনা ঘটে তারা কালের গর্ভে বিলীন হয়। তাণ্ডব শেষ হলে শহর পুরোনো সুস্থিরতায় ফিরে। লোকালয় সুগ্রন্থিত হয়। নদীর আরামে সবকিছু বয়ে চলে। শহরে তাণ্ডবের সূত্রপাত ঘটে অপোগণ্ড এক ধূমপায়ীর দোষে। মন্থর বিকেলে সেনা চেকপোস্ট পার হওয়ার সময় সেটি দানা বাঁধে শহরে। চলন্ত বাসযাত্রীরা ছিল সেই তাণ্ডবের হোতা। চেকপোস্টের অফিসার ও সাঙ্গোপাঙ্গরা প্রতিপক্ষের ভূমিকা গ্রহণ করে, আর অগ্নিদগ্ধ বিড়ির টুকরো হয়ে ওঠে উস্কানিদাতা। আমরা এবার পুরো ঘটনাটি স্মরণ করি।
বিড়িখোর এক যাত্রী ধূমপান শেষে আঙুলের মৃদু টোকায় বিড়িটি বাসের বাইরে চালান করেছিল। ওটার আয়ু তখনো ফুরায়নি। টিম-টিম করে জ্বলছে। বাতাসে গোত্তা-খাওয়া বিড়ি ঘুরতে-ঘুরতে জলপাই অফিসারে ঝাঁপ দিয়ে মরবে বলে ঠিক করে। বুলেটের মতো ছুটে যায় অফিসারের শরীর লক্ষ্য করে। জলপাই-রঙ পোশাকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অফিসারের মনে হয় তার শরীরে আগুনের সুঁই ঢুকছে। সে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। অপোগণ্ড বিড়িখোরকে দেখার অভিলাষ জাগে মনে। তাণ্ডব শুরু হয় বিশ্বাসঘাতক এক বিড়ির আচরণে। ওটা তীব্র হয় জলপাইয়ের অপোগণ্ডকে দেখে নেয়ার অভিলাষ থেকে!
এতোকিছু ঘটার পরেও পিয়ারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে প্রতিরোধ জেগে থাকে। দিনশেষে আমরা টের পাই পিয়ার ও আমাদের মাঝখানে বিষধর এক সাপ শুয়ে আছে। আমরা তার নাম রেখেছি ওসমান!
জলপাই ও বিড়িখোর পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে। না দাঁড়ালে ভালো ছিল। কিন্তু ইন্দ্রজালের ইচ্ছা তিনি মজা দেখবেন। সিভিল ও মিলিটারিকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ করবেন। দুজনের বাক্যালাপ বিবাদে গড়ায়। সেখান থেকে ঘটনাটি বিড়িখোরের কান ধরে উঠবস করানোর মিলিটারি প্রথায় পৌঁছায়। শহরে তাণ্ডব দানা বাঁধে বিড়িখোরের দোষে। কিন্তু সেটা গতি পায় জলপাই অফিসারের ভুলে। সিভিলরা নির্বিষ ঢোঁড়া সাপ। তবে রেগে গেলে রাক্ষস হয়ে পড়ে। ইন্দ্রজালের ইচ্ছা সিভিলকে তিনি রাক্ষস করবেন। সাত আসমান থেকে ওসমানকে তাই ইশারা করেন। ওসমান তখন মনা রায়ের টিলায় জংলী ফুলের বাহারে বুঁদ হয়ে ছিল। ইন্দ্রজালের ইশারা পেয়ে মুহূর্তে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। দাঙ্গার সূত্র বলতে এইটুকু। বাকিটা সিভিল ও মিলিটারির স্বেচ্ছাচার।
ওসমান এক মায়াবী দানব। নিজেকে অদৃশ্য ও বায়বীয় রাখতে তার জুড়ি নেই। বায়বীয় ওসমান এবার বাসের ভিতরে ভর করে। বাসযাত্রীরা রক্তের ভিতরে রাক্ষসের উপস্থিতি টের পায়। জলপাই তখন বিড়িখোরকে চড়-চাপড় মারছে। কান ধরে উঠবস করাচ্ছে। রাগের মাথায় লাথিও মেরেছে। তার এই আচরণে যাত্রীরা সংযম হারিয়ে ফেলে। জলপাইকে ঘেরাও করে পিটুনি শুরু হয়। সিভিলের পিটুনি কোনো জলপাইয়ের সহ্য হওয়ার কথা নয়। এটা নিয়মের মধ্যে পড়ে না। রাষ্ট্রের বিধানে ঘোর ব্লাসফেমি। এই পিটুনিকে প্রশ্রয় দেয়ার অর্থ হলো প্রধানমন্ত্রীর লুজ মোশন। আর মেয়র সাহেবের চিরস্থায়ী টয়লেট-বাস। সুতরাং ব্যারাক থেকে প্লাটুনকে প্লাটুন সৈন্য বেরিয়ে আসে। সৈন্য ঠেকানোর ক্ষমতা ইন্দ্রজালের ছিল। কিন্তু তিনি তখন হাসছেন। সিভিলে ও জলপাইয়ে মারামারি দেখার শখ মেটাচ্ছেন। বাসশুদ্ধ যাত্রীরা গ্রেফতার ও ব্যারাক-বন্দি হয়। বাকি ঘটনা সহজেই অনুমেয়।
গুণীজনরা বলে দাঙ্গা বা তাণ্ডবে সিভিলের কপালে দুর্ভোগ ছাড়া কিছু জোটে না, তবে সুযোগসন্ধানীর কপাল খুলে যায়। আকস্মিক এই ঘটনা পিয়ারের জন্য সৌভাগ্য হয়ে আসে। সুযোগসন্ধানী দুবৃত্তরা ফাও পেয়ে লাভবান হয়। আর অশেষ উপকৃত হয় সংবাদকর্মী। খবরের কাগজ খইয়ের মতো বিকোতে থাকে শহরে। মিলিটারি ও সিভিলের তাণ্ডব শুরু করে এক বিড়িখোর। এটা তীব্র হয় সংবাদকর্মীর কলমের দোষে। এতে ইন্ধন যোগায় মেয়র সাহেবের প্রতিপক্ষরা। আর দাঙ্গাটিকে আমরা যুবকের দল বেগবান করে তুলি। তাণ্ডবের শুরুতে আমরা হিরো ছিলাম, শেষের দিকে এসে ভিলেনে পরিণত হই। আমাদের কপালে পুরস্কারের পরিবর্তে তিরস্কার জুটতে থাকে। দাঙ্গার সপ্তম দিনে সকলে দম হারাই। আমাদের চোখ ক্লান্তিতে ভার হয়ে ওঠে। ওসমান রক্ত থেকে নামতে শুরু করে। রাক্ষস পালায় চুপিসারে।
তাণ্ডব শেষে আমরা বুঝতে পারি পিয়ারের দিন ফিরেছে। সৈনিকের হাঁটু তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। পিয়ার এখন মুচকি হেসে আমাদের মাপছে। তার কান আমাদের পায়ের গতিবিধির দিকে উৎকর্ণ হয়ে আছে। আমরা ধরা পড়তে ও ধরা দিতে থাকি। না-দিয়ে উপায় থাকে না। আমাদের নিয়ে শহর জুড়ে ধিক্কার উঠে। সুস্থিরতা জারি রাখার আওয়াজ প্রবল হয়। জনক-জননীরা আমাদের আচরণে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন। মুরব্বিরা যৌবনের অযথা অপচয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন। প্রিয় মুখের উদ্বেগ ও কান্না আমাদের দুর্বল করে ফেলে। শিশু ও প্রেমিকারা মনকে কাতর করে রাখে। বোনকে বুকে জড়িয়ে আমরা কান্না করি। মুখ লুকাই জননীর অবুঝ করতলে।
আমরা ভেঙে পড়ি। নতজানু হই নদীতীরে। মেয়র ও পিয়ার মোহাম্মদের পদতলে আগ্নেয়াস্ত্র সমর্পণ করি। মেয়র আমাদের ভালোবেসে আলিঙ্গন করেন। পুত্র ও ভাই বলে মুখচুম্বন সারেন। আমরা বুঝতে পারি মেয়রের এই ভালোবাসা অন্য সময়ের মতো নিছক অভিনয় নয়। এর মাঝে লুকিয়ে রয়েছে স্বস্তি। এ-যাত্রা টিকে থাকার স্বস্তি। জলপাইয়ের রোষ থেকে পার পাওয়ার স্বস্তি। ঘন-ঘন টয়লেট-যাত্রার হাত থেকে নিস্তার লাভের স্বস্তি। মেয়রের চোখে সুস্থিরতার অশ্রু বহে। আমরা বুঝতে পারি আজ রাতে তার গাঢ় ঘুম হবে।
আবেগ এক সর্বনাশা পুরুষ। মেয়র এক সর্বনাশা আবেগ। তার আলিঙ্গনে আমরা উতলা বোধ করি। নগরপিতাকে নির্ঘুম রাখার লজ্জা মনকে গ্রাস করে। পিয়ার মোহাম্মদের হাঁটুতে কম্পন জাগানোর জন্য মনে-মনে লজ্জিত হই। নিরীহ শহরবাসীকে উৎকণ্ঠিত রাখার জন্য নিজেকে অপরাধী বলে ভাবি। মেয়র সাহেবের আলিঙ্গনে আমরা অশ্রুসিক্ত হই। যদিও তাকে বুঝাতে পারি না এই তাণ্ডব শুধু অপোগণ্ড বিড়িখোরের কারণে ঘটে না। আমরা তাণ্ডবে মত্ত হই ওসমানের প্রভাবে। তাকে চিরতরে শেষ করার বাসনা বুকে নিয়ে।
শহরে তাণ্ডব ঘটে আমাদের অক্ষমতার দোষে। আমরা হাঁটু শক্ত করে কখনো দাঁড়াতে পারি না। হাঁটুশক্তির সাক্ষাৎকারে আমাদের পা নিজেকে বারবার অযোগ্য প্রমাণ করে। আমাদের অক্ষমতা টের পেয়ে প্রিয়তম মুখ দূরে সরে যায়। আমরা তাকে উচ্ছ্বল হতে দেখি হাঁটুশক্ত নাগরিকের ঘরে। আমাদের দেখে জনক চোখ বোজেন। চোরের মতো সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকতে হয়। মেয়র সাহেবকে বলা হয় না এই মাতলামি আমাদের অযোগ্যতার দোষে ঘটে। কারণ আমরা ট্রাফিক সার্জেন্টের পকেট মুদ্রা দিয়ে ভরিয়ে তোলার মতো শক্ত হাঁটুর মালিক নই। স্থাপনা সচিবকে যোগ্যভাবে তোষামোদ করার শক্তি রাখি না। রেস্তোরাঁর ওয়েটারকে বখশিশ দিয়ে সুখী করার মুরোদ আমাদের নেই। খেলনার লোভে কাতর শিশু ও প্রিয়তমাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নেয়ার জাগলিং,—এতোটা শক্তি ও পৌরুষ আমাদের নেই। মেয়র সাহেবকে আমরা বুঝাতে পারি না শহরে তাণ্ডব ঘটিয়ে নিজের হাঁটুর শক্তি আমরা ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। পরখ করতে চেয়েছিলাম মানুষ হিসাবে আমাদের সক্ষমতা।
নদীতীরে দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারি ওর মতো সুখী কেউ নেই এ-জগতে। নদীর ঘোলা জলে চোখ রেখে বুঝতে পারি পিয়ার মোহাম্মদের হাঁটুর যোগ্য আমরা নই। পায়ের গতি বুঝে বন্দুকের নিশানা ঠিক করা আজো শিখিনি। পিয়ারের জলপাই হাঁটুর কাছে আমরা বালক মাত্র। মেয়রের স্বস্তিভরা আলিঙ্গন আমাদের বুঝিয়ে দেয় রাক্ষসকে ধারণ করার শক্তি আমরা এখনো অর্জন করিনি। ওসমানকে অস্তিত্ব থেকে মুছে দিতে পারিনি। আমরা হচ্ছি মামুলি যুবক। পিয়ারের বউকে দেখে দুষ্টুমি করতে পারি। চেম্বার সভাপতির আদুরে দুলালীকে অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ দিতে পারি। নিজেকে বিধ্বস্ত করতে পারি হাতের অনুশীলনে। পিয়ারের বউ ও সভাপতির আদুরে দুলালীর কথা ভেবে জাহির করতে পারি পৌরুষ। তাদের নিয়ে জল্পনায় তরী ভাসাতে পারি। বড়োজোর গণিকা-মৈথুনের সুখ নিতে পারি। দিনের শেষে পিয়ারের বউ পিয়ারের থেকে যাবে। চেম্বার সভাপতির দুলালী অন্য কোনো চেম্বার সভাপতির হাভেলিতে উঠবে।
মেয়রের কাছে অস্ত্র-সমপর্নের ক্ষণে আমরা বুঝতে পারি ওসমান নিছক রাক্ষস নয়। ঈশ্বরের মতো সর্বত্রগামী হলেও নিষ্কাম নয়। নির্লিপ্ত বা উদাসীন নয়। ওসমান শ্রেণি বুঝে। শ্রেণি ও মানুষ ভেদে নিজেকে পালটাতে জানে। বসতি ও লোকালয় বুঝে বিচিত্র সাজে সে হাজির হয়। আমরা তাকে রোগাপটকা রাক্ষস বলে ভাবি। চেম্বার সভাপতির কক্ষে সে চালাক দানবের বেশে হাজির হয়। মন্ত্রী ও এমপির ঘরে সর্বস্ব সাবাড়কারী পেটুকের বেশে ঢুকে। রাক্ষসের গৎবাঁধা অবয়বে সে সুস্থির নয়। বহু রূপে ও বেশবাসে তার লীলা চলে শহরে। আমরা সেই বহুরূপী ওসমানের করতলে নতজানু হই। মেয়রের আবেগী আলিঙ্গনে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ি। তার ক্ষমা ও ভালোবাসায় মুগ্ধ হতে থাকি। আসছে বছর তাকে ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করি না।
আমরা পুনরায় মেয়র সাহেবে সুস্থির হই। তার সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে। সকলে মিলে দলবেঁধে দরবেশবাবার মাজারে যাই। জানু পেতে ভুল স্বীকার করি। তার উছিলা ধরে পরম এক নিরাকারের কাছে ক্ষমা চাই। মাজারের নিকটে শান-বাঁধানো পুকুর রয়েছে। অতিকায় গজার মাছ সেখানে লাফঝাঁপ দেয়। লোকে বলে এই মাছেরা নাকি দরবেশের সমান বয়সী। তার অলৌকিক কীর্তির স্মারক। শহরে পা রাখার পর জাদুকরকে পরাস্ত করেন দরবেশ। তার পা স্থির হয় নাতিউচ্চ টিলার পাদদেশে। টিলার ভিতরে গুহার মতো ছোট সুড়ঙ্গ। সঙ্গীসাথী নিয়ে দরবেশ সেই সুড়ঙ্গে ঢোকেন। সঙ্গীরা মশাল জ্বালে। হাতের ইশারা বুঝে মশালটি নিভিয়ে দেয়। সূর্যের ক্ষীণ রেখা তখন গুহামুখে ঢুকছে। সুড়ঙ্গের ভিতরে দরবেশ কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। একঝাঁক পায়রার ডানা ঝাপটানোর শব্দে তার সেই নীরবতা ভঙ্গ হয়। তিনি চোখ তোলেন উড্ডিন পায়রার দিকে।
পায়রার ঝাঁক সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে বাইরে উড়াল দিতে থাকে। মুক্ত আকাশে এক পাক ঘোরান দিয়ে আবার সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ে। দরবেশের সরু কাঁধে বসে তারা ডানা ঝাপটায়। দরবেশ মৃদুকণ্ঠে আওয়াজ করেন,-‘হেই কবুতর! তোরা কি জাদু? না আল্লা পাঠালেন তোদের?’ কবুতরের দল ডানা ঝাপটে উত্তর করে,-‘ওহে দরবেশ, আমরা জাদু নই। কোনো জাদুকর আমাদের পাঠায়নি। আমরা এই প্রকৃতি-মায়ের কোলে জন্ম নিয়েছি। উড়াল শিখেছি মায়ের হাত ধরে। এই টিলা আমাদের অন্ন যোগায়। দিনে দানা খুটে খাই আর রাত ঘনালে সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ি। আমরা কোনো জাদু নই। আমরা হচ্ছি সৃষ্টি। এখানে জন্মাই। এখানেই বংশবৃদ্ধি করি। আল্লার আদেশে এই গুহায় চোখ বুজি। ওহে দরবেশ, লোকে বলে আমরা নাকি তুমি আসবে জেনে এখানে এসেছি। না, তোমার জন্য আমরা এখানে আসিনি। আমরা এসেছি আল্লার নিরাকার আরশ থেকে। সময় হলে সেই নিরাকারে বিলীন হবো।’
কবুতরের সঙ্গে রহস্যময় বাতচিত শেষে দরবেশ প্রসন্ন মনে সঙ্গীদের দিকে মুখ ফেরান,-‘শোন তোমরা, এখন থেকে এই টিলা ও গুহা হবে আমার ঘরবাড়ি। কবুতরের দল হবে সঙ্গী। তোমাদের আমি ধরে রাখবো না। ইচ্ছে হলে থাকতে পারো। মন চাইলে চলে যেতে পারো। আমি চাই প্রাচীন এই নগরের আনাচে-কানাচে তোমরা ছড়িয়ে পড়ো। গৃহে ও সংসারে তরঙ্গিত হও। তবে আল্লাকে স্মরণে রেখো। মনে রেখো কবুতরের বচন,-‘আমরা নিরাকার থেকে আসি। অন্তিমে নিরাকারে সমাধিস্থ হই।’ কবুতরের কাছে আমি শিখতে চাই গুহা-যাপনের উদ্দেশ্য। বুঝতে চাই ওইসব গাছগাছালির সুস্থির থাকার রহস্য। কী সেই রহস্য যার জোরে তারা টিলার গভীরে শিকড় ছাড়ে। বীজ রেখে ধসে যায়। বন্দি হয় মাটির গভীর থাকে।
আজ থেকে এই মাটিকে আমি বেছে নিয়েছি। আমার সমাধি নামে একে আলিঙ্গন করছি। এই মাটি খেয়ে আমার জন্ম হয়েছিল। আমি প্রবিষ্ট হচ্ছি এর গভীরে। মাটি এখন আমায় খাবে। এই গুহা আমার মাতৃগর্ভ। আমি আবার ফিরে এসেছি মাতৃগর্ভে। জাদুকরের সঙ্গে লড়াই করার প্রয়োজন দেখি না। সকল জাদুর রাজা হচ্ছে মাতৃগর্ভ। আর মাতৃগর্ভের রাজা হলেন নিরাকার। আমি কিছুদিন মাতৃগর্ভে যাপন করতে চাই। তারপর সমাধি নেবো অন্ধকার এই গুহায়।’
দরবেশকে একলা রেখে সঙ্গীসাথীরা প্রস্থান করে। শহরের অলি-গলিতে তারা ছড়িয়ে পড়ে। দরবেশ তার পায়রা নিয়ে নিরিবিলি দিন কাটান। সঙ্গীরা সময় করে তার সঙ্গে দেখা করে। কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে যায়। কারণ দরবেশ দিন-দিন মৌন হয়ে পড়ছেন। গাছগাছালির ছায়ায় বসে তার দিন কাটে। পুকরপারে বসে নিরাকারের ধ্যানে বুঁদ হয়ে থাকেন। সঙ্গীদের দিয়ে পুকুরটি কাটানোর পর মাছের পোণা ছেড়েছেন। ছোট পোণা অতিকায় গজার মাছে রূপ নিতে শুরু করেছে। পোণারা গজার মাছে পরিণত হওয়ার দিনে দরবেশ চির প্রস্থানের দেশে গমন করেন। নাতিউচ্চ টিলায় তাকে সমাহিত করা হয়। দরবেশ সমাহিত হলেও গজার মাছেরা এখনো পুকুরে সাঁতার কাটে। তাদের গায়ে শ্যাওলার আস্তরণ পুরু হয়ে উঠেছে। অতিকায় শরীরের পরতে-পরতে দরবেশ-যাপনের স্মৃতি লেপ্টে রয়েছে।
আমরা শান-বাঁধানো পুকুরঘাটে বসি। গজার মাছকে খাবার ছুঁড়ে দেই। পুকুরের পানি তোলপাড় করে তাদের ছুটোছুটি উপভোগ করি। মন হালকা হয়ে আসে। নিজেকে ভারমুক্ত লাগে। পুকুরঘাটে বসে আমরা বুঝতে পারি শহরে তাণ্ডব ঘটিয়ে কারো কোনো উপকার হয়নি। ওটাকে হাঁটুশক্তির উত্থান ভেবে আমরা ভুল করেছি। রমণী ও শিশুরা আমাদের কারণে বিপন্ন হয়েছে। এই তাণ্ডবে সুযোগসন্ধানী ও সংবাদকর্মী ছাড়া কেউ সুখী হয়নি। পিয়ার মোহাম্মদ ছাড়া কারো ভাগ্যে কিছু জোটেনি। এই প্রথম আমরা বুঝতে পারি তাণ্ডব ও বিপ্লব এক নয়। বিপ্লব হলে ওসমান পালায়। সে ফিরে আসে বিপ্লবের শেষভাগে। পুনরায় হানা দেয় ঘরে ও কর্মস্থলে।
পুকুরঘাটে গজার মাছের রঙ্গক্রীড়া দেখে আমাদের বোধোদয় ঘটে। আমরা বুঝতে পারি জীবন একটা তামাশা ছাড়া কিছু নয়। দরবেশকে ভিতরে টের পাই। তিনি তখন নীরবে হাসছেন। মৃদুকণ্ঠে আমাদের ডাক দিচ্ছেন টিলার পাদদেশে। তাকে অনুসরণ করে আমরা ছোট এক ঘরে পৌঁছাই। খোল-করতাল ও গায়কের হল্লা কানে আসে। দরবেশ ঘরে ঢুকতে ইশারা করেন। তার মুখে রহস্যময় হাসির ছটা লেগে আছে। সাদা আলখাল্লা ক্রমে নিরাকারে মুছে যাচ্ছে। দরবেশকে আর দেখা যাচ্ছে না!
অপরিসর এক কক্ষে আমরা ঢুকে পড়ি। সেখানে ফকিরদের তাণ্ডবনৃত্য চলছে। গেরুয়া পড়া ফকিররা ঘোরমত্ত আওয়াজে কক্ষ গুলজার করে রেখেছে। তারা মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে যায়। পরক্ষণে মাটিতে নেমে আসে। তাদের ঘূর্ণি আমাদের চোখে ঘোর তৈরি করায়। আকার ও নিরাকার একতালে রক্তের মধ্যে নাচে। আমরা ‘হাক্ মাওলা’ বলে মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠতে চেষ্টা করি। সেটা সম্ভব নয় বুঝে ‘হায় মাওলা’ বলে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ি। আমাদের কাণ্ড দেখে ফকিররা হাসে। নেশামত্ত ফকিরদের ঘোরলাগা হাসির দাপটে কক্ষটি গমগম করতে থাকে। তাদের হাসির তরঙ্গ আমাদের ভঙ্গুর হাঁটুতে গিয়ে আঘাত করে। হাসির ধাক্কা সইতে না পেরে নীরবে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসি।
মাজার প্রাঙ্গণ এখন শান্ত ও সুস্থির। মোয়াজ্জিন এইমাত্র আজান দিয়েছেন। আমরা ওজু করি। সারবেঁধে নামাজে দাঁড়াই। রুকু ও সেজদা করি। ঘাড় ঘুরিয়ে নিরাকারকে সালাম জানাই। এবং, আচমকা আবিষ্কার করি আকারে ও নিরাকারে প্রকাণ্ড ব্যবধান শেষে কোনো ব্যবধান থাকে না। আকার অবিরাম নিরাকারে ধসে যায়। আর নিরাকার ক্রমে আকারে রূপ নিতে থাকে। নিজের ভিতর আমরা দরবেশকে দেখতে পাই। মুখ নিচু করে বসে রয়েছেন। মুখের রেখায় মৃদু কষ্টের ছাপ লেগে আছে। ওটা বলছে জাদুকরকে পরাস্ত করে কোনো লাভ হয়নি। কারণ জাদুকর ও দরবেশে প্রভেদ থাকলেও পরিশেষে কোনো প্রভেদ থাকে না। দিন শেষে জাদুকর অলৌকিক বলে গণ্য হয় আর অলৌকিক দরবেশে পালটে যায়।
দরবেশকে অন্ধ গুহায় রেখে আমরা মাজার থেকে বেরিয়ে আসি। আমাদের বক্ষে লক্ষ কবুতর ডানা ঝাপটায়। ওরা কবুতর নয় ‘কৈতর’। লোকে বলে জালালী কৈতর। কবুতর ও কৈতরে শব্দের প্রভেদ থাকলেও আসলে কোনো ভেদাভেদ নেই। লক্ষ জালালী কৈতরের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শুনে আমরা বধির হয়ে পড়ি। নৈঃশব্দ্য আমাদের চেতনা দখল করে রাখে। বধিরতা ও নৈঃশব্দ্যের ডুব দিয়ে আমরা বুঝতে পারি তাণ্ডব ও বিপ্লবে পার্থক্য ঘটলেও পরিশেষে কোনো পার্থক্য থাকে না। সকল তাণ্ডব সমপর্ণে নিঃস্ব হয়। মেয়র সাহেবের স্বস্তি-বচনে বিরাম খুঁজে। বিপ্লব শেষ হয় আলোচনার বিখ্যাত টেবিলে। সুস্থিরতা-লোভী বুদ্ধিসেবীর প্রলাপ বচনে।
আমরা সোজাসাপ্টা বুঝে ফেলি তাণ্ডব ও বিপ্লবে শহর তছনছ করা যায়, কিন্তু দিনশেষে শিকল ছিঁড়ে না। তছনছ শেষ করে বিপ্লবী তার ঘরে ফেরে। ছ্যাতা পড়া ঘিনঘিনে দিনে নিজেকে সুস্থির রাখে। তাণ্ডব শেষে আমরা শহরে ফিরে আসি। মায়ের প্রসন্ন আদরে মাথা রাখি। বোনের সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠি। টেংরি-ভাঙা সার্জেন্টের ইশারায় আমাদের বাইক আবারো চৌরাস্তায় থেমে পড়ে। সার্জেন্টের পকেট আমরা মুদ্রায় ভরিয়ে তুলি এবং সবাই মিলে যোগ দেই ব্রিগেডিয়ার পিয়ারের বিবাহ উৎসবে।
পিয়ারের বিয়েতে আমরা খুব খাটি। ডেকোরেটার ঠিকঠাক করি। ভুঁড়িভোজের এন্তেজাম সারি। শহরের মানি লোকজনের কাছে বিয়ের দাওয়াত পৌঁছাই। আমাদের রমণীরা সেই বিবাহে শরিক হয়। তারা গোল হয়ে পানদান সাজায়। কোমর ঝুঁকিয়ে ধামাইল গান ধরে। পিয়ারকে আমরা বরের বেশ পরাই। রমণীরা কনেকে বিয়ের সাজে রূপবতী করে। আমরা কাজী ডাকি। বর ও কনেকে কবুল পড়াই। দাঙ্গায় কুড়িয়ে পাওয়া রাজকন্যা দেখে আমাদের মন হু হু করে ওঠে। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। পিয়ারের সৌভাগ্য বুকে খচ করে বিঁধে। বিধাতার রসিকতা ও অপচয়ে হতাশ হই। বিয়ের হুল্লোড় শেষে সবকিছু শান্ত হয়ে পড়ে। গরিলা হাতের থাবায় রূপবতী কনেকে বগলদাবা করে পিয়ার গাড়িতে ওঠে। আজ তার ফুলশয্যার দিন। রাজকন্যাকে নিয়ে রাক্ষস হওয়ার দিন। কন্যার রক্তকমল পদযুগল চুম্বনে সিক্ত করার দিন!
পিয়ারকে ফুলশয্যায় পাঠিয়ে আমরা দাঙ্গার দিনগুলোয় ফিরে যাই। তেতলা বাড়ির ছাদে এক রাজকন্যাকে আবিষ্কার করি। কুঁচবরণ কেশ ও তেঁতুল বরণ ঠোঁটের কন্যাকে দেখে বিমোহিত হই। মেঘবরণ কন্যা রে তার কুঁচবরণ কেশ, চিরল দাঁতের হাসি দিয়া কন্যা পাগল করে দেশ। কন্যার চিরলবরণ সৌন্দর্য আমাদের বধির করে ফেলে। সেইসঙ্গে অবাক হয়ে দেখি দাঙ্গাবাজরা কন্যাকে ঘেরাও করে ফেলেছে। বাড়ির প্রবেশমুখে দাঙ্গাবাজির প্রমাণ পেয়ে আমরা শিউরে উঠি। কন্যার আপনজনরা উঠানে লাশ হয়ে পড়ে আছে। দাঙ্গা কুঁচবরণ কন্যাকে ছাদে নিয়ে তুলেছে। আমরা দেখি রাজকন্যার বসন খসে পড়ার উপক্রম করছে। তার নগ্ন ত্বকে রাক্ষসের অট্টহাসি ঠিকরে পড়ে। আঙুরফল চোখে দানবে পিষ্ট হওয়ার ভয় এসে জমেছে।
কন্যার সুঠাম উরুদেশ রাক্ষসের আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়। রাক্ষসরা তাকে ঘিরে ফেলে। কন্যা তার গোড়ালি তুলে সেই রক্ষণব্যুহ ভেদ করার সুযোগ খোঁজে। তার স্তন ও শ্রোণিদেশ রাক্ষস-আতংকে তিরতির করে কাঁপে। মেঘবরণ কন্যার মধ্যে সৌন্দর্য ও আতংকের যুগলবন্দি দেখে আমরা বিকল হয়ে পড়ি। দুটোকে একত্রে দেখার ধকল সইতে না-পেরে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকি। অবোধ চোখ তুলে রাক্ষসব্যুহে কন্যার গোড়ালি সঞ্চালন দেখি। ছুটোছুটি অর্থহীন জেনেও কন্যা এটা করছে দেখে মনে-মনে ক্ষুব্ধ হই। সেইসঙ্গে আবিষ্কার করি আমাদের কারণে রাজকন্যা ও রাক্ষসব্যুহে কোনো ভাবান্তর ঘটেনি। আমাদের কাছে রাজকন্যার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। রাক্ষসদের কাছে আমরা হচ্ছি অবান্তর। আমরা টের পাই ভয়ে আমাদের হাঁটু কাঁপছে।
নিজের কম্পিত পদ নিয়ে সকলে বিব্রত হয়ে পড়ি। এমন সময় ছাদের সিঁড়িতে জুতোর খটখট আওয়াজ উঠে। শব্দটি অতি পরিচিত। রাক্ষসব্যুহে আলোড়ন শুরু হয়। সবাই বুঝে ফেলে পিয়ার তার ব্যাটালিয়ান নিয়ে ছাদে উঠছে। তার আগমন টের পেয়ে রাক্ষসরা চোখের পলকে ছাদ বেয়ে নিচে নেমে যায়। অলি-গলি দিয়ে পালায়। রাজকন্যা স্থানুর মতো ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে। সে এখন কলঙ্কিনী সীতা। তার স্তন থেকে ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত ঝরছে। শ্রোনিদেশ রাক্ষসের কামড়ে জখম হয়েছে। যোনিদেশ দিয়ে রক্তের স্রোত বইছে। রাজকন্যার এই নগ্নতা আমাদের লজ্জিত করে। তাকে ছুঁতে সাহস হয় না। পোশাকে আবৃত করতে ভয় লাগে। কন্যাকে দেখে আমাদের হাঁটুর কম্পন চলতেই থাকে। আমরা হাঁটু গেড়ে ছাদে বসে পড়ি।
আমরা বসে থাকি, কিন্তু আমাদের সমুখ দিয়ে পিয়ার মোহাম্মদ ছাদে উঠে আসে। তার জলপাই চোখ দুঃখ ও বিষাদে চকচক করছে। পিয়ার তার ঊর্দি দিয়ে রাজকন্যার লজ্জা ঢাকে। কন্যা এই মুহূর্তটির অপেক্ষায় ছিল। সব শেষ জেনেও বীর এক রাজপুত্রের অপেক্ষায় ছিল সে। পিয়ারের আগমনে তার সেই অপেক্ষার পালা ফুরায়। কুলহারা কলঙ্কিনী রাজপুত্রের বুকে ঢলে পড়ে। কন্যা ঢলে পড়লো দেখে পিয়ারের চোখ অশ্রুসজল হয়। পাথুরে মুখ নরোম বিষাদে রাজকন্যার মুখের নিকটে ঝুঁকে থাকে। প্রমত্ত জলপাইয়ের শক্ত হাতের আবেষ্টনে কন্যা এখন নির্ভয়া। পিয়ার তাকে কোলে করে গরিলার বিক্রমে নিচে নামে। তাকে অনুসরণ করে আমরাও নিচে নামি,-মাথা হেঁট করে!
পিয়ার আবারো আমাদের হারিয়ে দেয়। তার শক্ত হাঁটুর নিকটে আমরা পরাস্ত হই। অদম্য এক ব্রিগেডিয়ারের পায়ে মাথা নত করি। আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না ব্রিগেডিয়ার কেন পাখির ছানার মতো রাজকন্যাকে আগলে রাখে। রাজকন্যাই-বা কেন এতো অনুগত থাকে ওই সমর-মানবে! আমরা স্বীকার করি কুঁচবরণ কন্যা পিয়ারকে সত্যি ভালোবাসে। রমণী-হৃদয়ের মমতা দিয়ে বয়স্ক মিলিটারিকে সে ঘিরে রাখে। তার পাগলামো সহ্য করে। মসৃণ গোড়ালি ও পদযুগল দিয়ে জলপাইকে প্রীত করে। পিয়ারের প্রতি রমণীর এই ভালোবাসা আমাদের কেন জানি সহ্য হয় না। আমরা হিংসায় ফেটে পড়ি। স্মৃতি থেকে পিয়ারকে মুছে ফেলতে তৎপর হই।
ইচ্ছে করলেই সবকিছু মুছে ফেলা যায় না। পিয়ারকেও আমরা স্মৃতি থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারি না। আমরা ক্ষুব্ধ হই। নিজের উপর ক্ষোভ জাগে। কারণ এটা আমাদের অক্ষমতা যে রাজকন্যাকে আমরা অভয় দিতে পারিনি। আমরা আয়নার সামনে দাঁড়াই। রক্তের ত্রুটি অনুভব করে বিমর্ষ হয়ে পড়ি। অবাক হই এটা দেখে যে রাজকন্যাকে নিয়ে জল্পনায় ডুবে থাকার শখ আমাদের এখনো যায়নি। পিয়ারকে ফুট-ফেটিশ বলে গাল পাড়ার সময় আমরা ভুলে গেছি যে আমরা নিজেও কম ফেটিশ নই। আমাদের সামনে বীর হওয়ার সুযোগ ছিল। আমরা সেটা নিতে পারিনি। বীর না হতে পারার আফসোস আমাদের উতলা করে। নিজের উপর ক্ষোভ ঝাড়তে গিয়ে পিয়ারের উপর ক্ষোভ ঝাড়ি।
দৃপ্ত এক মিলিটারিম্যানের সাফল্যে আমরা হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরি। সহজ মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার জন্য নিজেকে দায়ী করার নামে পিয়ারকে দায়ী করি। নিজেকে প্রতিপক্ষ না করে তাকে প্রতিপক্ষ করি। তার স্ত্রীকে জোর করে নিজের বলে বুঝাই। তাকে নিয়ে জল্পনার জগতে বিহার করি। আমাদের ভিতরে রাক্ষস মাথা তোলে। অন্যের বউকে নিজের বউ ভাবার বিভ্রম থেকে বের হতে পারি না। ইচ্ছে করে সেই বিভ্রমে বিচরণ করি। বায়বীয় থাকার সুখ উদযাপন করে চলি। আমরা বায়বীয়কে বাস্তব ও বাস্তবকে বায়বীয় করি। একসঙ্গে যাপন করি যৌথ এক অস্তিত্ব।
বাস্তবতার এই রূপান্তর আমাদের সুস্থির রাখে। ‘বউ পাগলা পিয়ার’কে অপদস্থ করে সুখ পাই। নিজেকে ডেকে বলি,-‘শুনেছো, পিয়ারের বন্দুকে জং ধরেছে। আজ সারাদিন ঘর থেকে বের হয়নি। বউকে দিয়ে জং ধরা বন্দুক পালিশ করিয়েছে।’ পিয়ারের বন্দুকে জং ধরার খবর শুনে রাক্ষস হা হা করে হাসে। বাইরে তখন তোড়ে বৃষ্টি নেমেছে। আমরা ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজি। পিয়ারের বউকে নিয়ে ভিজি। দুর্গম গুহা থেকে রাজকন্যাকে মুক্ত করার খুশিতে নিজেকে সিক্ত করি।
পিয়ারের বউকে নিয়ে আমরা বৃষ্টিতে ভিজি। মেঘবরণ কন্যার কুঁচবরণ কেশ বৃষ্টির তোড়ে খুলে-খুলে পড়ে। আমরা দুই হাত দিয়ে সেই কেশ ধরি। কেশবতি কন্যাকে বুকের খাঁচায় ধরে রাখি। পিয়ারের রূপবতী বউকে অবিশ্রান্ত বৃষ্টিফোঁটায় সিক্ত করে চলি। বৃষ্টিস্নান শেষ হলে সকলে ঘরে ফিরে যাই। শুকনো জামা-কাপড় বের করে পরি। গরম চায়ের কাপ হাতে জানালার সমানে গিয়ে দাঁড়াই। টিনের চালে বৃষ্টিফোঁটার গর্জন চলছে। গলি-রাস্তা ও দোকানপাটে বৃষ্টি সমানে ঝরছে। আমাদের হৃদয়ের গহীনে অবিরাম বৃষ্টি ঝরে। ব্রিগেডিয়ার সাহেবের বাড়ির ছাদে ওটা ঝরে। আমরা দেখি বয়স্ক ব্রিগেডিয়ার তার স্ত্রীকে নিয়ে ছাদে উঠেছে। রূপবতী স্ত্রীর হাত ধরে বৃষ্টিধারায় সিক্ত হচ্ছে দুজনে!
ব্রিগেডিয়ার পিয়ার মোহাম্মদকে আমরা এভাবে আমাদের অস্তিত্বে ধরে রাখি। আমরা নাছোড়বান্দা সাংবাদিক। জাদরেল জলপাইকে নীরবে অনুসরণ করি। সামনে পড়ে গেলে সমীহে মাথা ঝুঁকাই। আড়াল হলে পিছু লাগি। তাকে নিয়ে কানাকানি করি। মুখরোচক চাটনির মতো সারাদিন তাকে চাটি। এতোকিছু ঘটার পরেও পিয়ারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে প্রতিরোধ জেগে থাকে। দিনশেষে আমরা টের পাই পিয়ার ও আমাদের মাঝখানে বিষধর এক সাপ শুয়ে আছে। আমরা তার নাম রেখেছি ওসমান!
(ক্রমশ)