কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়- ঋদ্ধ এই অনুভব অতুলনীয় । কালের লিখন
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ মে ২০১৬, ১১:০৭ অপরাহ্ণ, | ১৯৩৩ বার পঠিত
পৃথিবী দৃশ্যময়, যা অদৃশ্য তাই অসার। সারবস্তুর খোঁজে প্রতিটি মানুষ জীবন নামের ট্রেনে পরিভ্রমণে রত। এই পরিভ্রমণে সকল দৃশ্য চোখের সীমা আর বোধের চৌহদ্দি পেরিয়ে, মনের অভ্যন্তরে গিয়ে চেতনার কার্নিশে দোল দিতে পারে না। কিছু দৃশ্য নিজস্বতার ছাঁপ রাখতেই প্রিয় হয়ে ওঠে, মানুষ মূলত সেই সব প্রিয়তার কাছেই বারবার নতজানু হয়। বিজ্ঞান একে হয়তো স্মৃতি বলবে, দর্শনশাস্ত্র বলবে স্মৃতিকাতরতা। প্রিয় সব দৃশ্যের আড়ালে বা ফাঁকফোঁকরেও কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয় থেকে যায়। কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের দ্বাদশ কবিতার বই- ‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়’। মননশীল পাঠক মাত্রই জানেন, কবি তার সময়কে ধারণ করেন, অনাচার অবিচার মিথ্যে আর কলুষতাকে বারণ করেন। বোধের রোদ পোহানো, অসংখ্য মানবিক মানুষের অনুভব হরণ করেন। দীর্ঘ আট বছর পর- কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের যাপিত সময় পরিভ্রমণের ইতিবৃত্ত শব্দের আলো-ছায়ায়, ভাবের ব্যঞ্জনায় আর প্রকাশের দ্যোতনায় অপরূপ কিছু দৃশ্যকল্পে উপস্থাপিত হয়েছে এই কবিতাগ্রন্থে। কবি যাকে বলছেন- ‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়’। ৫৩টি কবিতার সারমর্ম জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠে বইয়ের প্রচ্ছদে চোখ রাখলেই। নান্দনিক প্রচ্ছদশিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর এর প্রলুব্ধ চেতনায় আঁকা, উপলব্ধহীন অকারণ একটা দৃশ্য, ব্যাকরণ বিভোর চোখকেও বিশ্বাস করতে বাধ্য করে- কিছু দৃশ্য সত্যিই অকারণে প্রিয় হয়ে উঠে। কিছু দৃশ্য সময়ের রুপালী নৌকোয় বাঁধা থাকে স্রোতহীন অশ্রুত বেদনার ঘাটে। বইয়ের প্রথম কবিতার ডাকনাম- ‘শব্দ’। চলুন নিঃশব্দে পাঠ করি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান এই কবির কবিতাটি—
‘কবির বেহালা শব্দ, শব্দই কবির বেহালা
ঢেউ-ঢেউ নদী তার ধ্বনি
শব্দকে বাজালে নদী কথা বলে; রূপসী রাত্রিরা খোলে মুখ
শব্দকে কাঁদালে কাঁদে ডাকাতিয়া বিলের ডাহুকশব্দই কবির প্রেম; সে ঢোকে নিঃশব্দ পায়ে মনে
শব্দের ডুবুরি কবি; শব্দে বাঁচে ডুব-সন্তরণে’
দাড়িহীন কবিতাটি যেন মহাকালের ব্যাপ্তি ছুঁয়েছে। কানে বাজে কবির শাব্দিক বেহালা, সময়ের রুপকে মোড়া ‘নদী’ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই শাব্দিক বেহালার ধ্বনি, কবি বলছেন- শব্দকে বাজালে নদী কথা বলে। আমরা সত্যি সেই সময় নামক নদীর কথা শুনতে পাই। শব্দকে বাজালেই রূপসী রাত মুখ খোলে, আবার ডাকাতিয়া বিলের ডাহুক কেঁদে উঠে, যদি শব্দের বেহালা কাঁদে। শব্দই কবির প্রেম, কবি শব্দের ডুবুরি, ভাবের জলে এবার শুনতে পাই শব্দের ডুব-সন্তরণ। শব্দ আর কবির এই যুগল মিলন, সত্যদ্রষ্টা কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের উপলব্ধিজাত অনুপম অনন্য উচ্চারণ।
দ্বিতীয় কবিতা ‘মেদেনীদুপুর’। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের সাবলীল সাক্ষর এই কবিতার শরীর জুড়ে, কিছু অকারণ প্রিয় দৃশ্য তো আছেই, চলুন একটু দোল খেয়ে আসি- শাহরিয়ারের অন্তমিলের দোলনায়—
‘বাঁচি তো এবার শীতে বৃন্দাবনে যাব
পারসোনাল ট্যুর
আমাকে ডেকেছে রাঙামাটির শহরে
মেদেনীদুপুর
আগেও গিয়েছি ঐ কাব্যজনপদে
কবিদের দেশ
কে এক কুমোর কবি আমাকে দিয়েছে
মাটির গণেশতোমার অনেক কথা রোজই আমি শুনি
গণেশের মুখে
কপালে সুরেলা হাত অনুভব করি
অসুখেবিসুখেসে-হাত যেখানে থাক, পুনর্বার গেলে
টেনে নেব কাছে
কোকিলও আগাম এসে বেহালা বাজাবে
রাধাচূড়াগাছে’
ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যকল্পের স্বল্প আলোয়, আবু হাসান শাহরিয়ার একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন আর জনপদের তত্ত্বতালাশ দেন আমাদের। কুমোর কবির মাটির গণেশ হস্তান্তর আর কবিদের দেশ সেই কাব্যজনপদে আর একবার গিয়ে সেই সুরেলা হাত কাছে টেনে নেবার আকুতি মনের ভিতর আর একটা মনের উপস্থিতি দাঁড় করিয়ে দেয়, যেন একটা দৃশ্যের মধ্যে আর একটা দৃশ্য, একটা গল্পের মধ্যে আর একটা গল্প, একটা জীবনের মধ্যে আরও অজস্র জীবন, একটা দুপুরের মধ্যে আর একটা মেদিনীদুপুর। কবির খণ্ড খণ্ড শব্দপ্রলয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হাপুরহুপুর।
‘এক চাবিতে দুজন আমি’ কবিতায় আমরা আর একজন শাহরিয়ার এর সন্ধান পাই—
‘বসো শাহরিয়ার, চা বানিয়ে আনছি’- নিজেকে বসিয়ে রেখে চা বানাতে যাই। ‘দরজাটা লাগাও শাহরিয়ার’ বলে বাইরে বেরই। চাবি একটাই দুজন আমি। আমার আমিদের নিয়ে আজকাল আমি খুব দুশ্চিন্তায় আছি। কেউ কারও কথা শুনতে চায় না। ফলত প্রতিদিন কিছু না কিছু ভুল হয়ে যায়। গতকাল আয়নাকে দরজা ভেবে অতিথিকে ঘরে ঢুকিয়ে দুই কাপ চা বানিয়ে এনে দেখি, ঘরে কোনও অতিথিই নেই। এসময় অন্য শাহরিয়ার বাড়িতে ছিল না। কাল রাতে সে আর বাড়িই ফেরেনি। আমার উৎকণ্ঠা এখন ওকে নিয়ে। যাই, থানায় একটা অভিযোগ লিপিবদ্ধ ক’রে আসি। বেরুনোর সময় দরজাটা যে কাকে লাগাতে বলব, সেটাই ভাবছি।
ভাবনা বিলাসী পরম চেতনায় নিজেকে নিজের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দেওয়ার সাহস শুধুমাত্র আত্মঅন্বেষু পরমনিষ্ঠ স্বভাব কবির-ই থাকে, যে কবি মুহূর্তে মুহূর্তে অকারণে কিছু প্রিয় দৃশ্য আঁকে। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার এক চাবি হাতে নিয়ে দুইজন আমি’র স্বরে হাঁকে। এভাবেই কত মানুষ প্রত্যহ তলিয়ে যায় ভাবনার পাঁকে। শুধু শব্দের বেহালা যার হাতে, সেই-ই সময় নদীর কূলে ডুব-সন্তরণে একার সন্ন্যাসে মগ্ন থাকে।
সাহিত্যের সবচেয়ে কঠিন শাখা নিঃসন্দেহে কবিতা। সুগঠিত একটা কবিতার দুটি লাইনের ব্যাখ্যা দিয়ে অনায়াসে দুই হাজার শব্দের প্রবন্ধ লেখা যায়। অবাক বিস্ময়ে ভাবতে ইচ্ছে করে- কবিতার এক একটি শব্দ উচ্চকিত ঢেউয়ের মতো, মুহূর্তে প্লাবিত করে দিতে পারে ভাবসমুদ্রের এপার ওপার, চেতনার এধার ওধার। কবিতার এক একটা লাইনের ভার অনেক ব্যাপক। কথাসাহিত্য যেখানে ভাবকে ক্রমাগত বহির্মুখী করে বিভিন্নভাবে তার প্রকাশ আর ভাবোন্মোচন করতে থাকে, কবিতা ঠিক তার উল্টো পথে ধাবমান, সে ভাবের মাঝেও মহাভাবের জন্ম দেয়। মূলকের প্রলয় ভেদ করে আঁকতে বসে রুপকের রুপ-শ্রী। চলুন পড়ি, আবু হাসান শাহরিয়ারের দুই লাইনের একটি কবিতা, কবিতার ডাকনাম- ‘পরাবাস্তবতা’
মানুষের অ্যাকুয়ারিয়াম- নগর
মাছের নগর- অ্যাকুয়ারিয়াম
লাইন দুটো পাঠ মাত্রই মুহূর্তে মনে হয়, আমিও এক অ্যাকুয়ারিয়াম নগরের বাসিন্দা। যে নগরের আছে আবার হাজার হাজার গল্প। ছোট পরিসরে কবি পরাবাস্তবতা কবিতায় এঁকে দিলেন যাপিত কালের এক নিষ্ঠুর মনোকল্প।
একরকম আরও একটি কবিতা- ‘ব্যঞ্জনা’
১.
সাঁকো গড়ো মনে ও মননে শব্দই ব্রহ্ম তাকে ব্যঞ্জনায় বাঁধো২.
বাজালে পাথরও বাজে; কঠিন পাহাড়ই সব সুরস্রোতা নদীর জননী
এ যেন সীমার মাঝে অসীমের গান, চেতনার ভাঁজে ভাঁজে নতুন ভাব, ভাবনা আর দ্যোতনার বিচ্ছুরণ।
সর্বশ্রেষ্ঠ আলোচনার নাম আত্মসমালোচনা। অথচ আমরা অধিকাংশ মানুষই এই কাজে বোধকানা। চলুন পাঠ করি, কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘আত্মসমালোচনা’ কবিতাটি—
‘পাতায় জলের ফোঁটাঃ পাতাটা কচুর
পলকে গড়িয়ে যাওয়া ফোঁটাটা জীবনঅস্থায়ী খুঁটিই যার নড়বড়ে
স্থায়ী ঠিকানার লোভে তারও কত ভিটা-ভিটা সাধ
মানুষের মতো লোভী প্রাণী
পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই
অথচ নিজেকে নিজে ‘শ্রেষ্ঠ’ দাবি করে
নদীর আয়নায় আমি কুৎসিতদর্শন সেই প্রাণীটিকে দেখিআমার মানুষ-মুখ কতটা কদর্য, আমি জানি’
এই যে একজন কবির পরমসিদ্ধ উপলব্ধি আর প্রজ্ঞার অনুরণনে নির্মোহ উচ্চারণ- ‘আমার মানুষ-মুখ কতটা কদর্য, আমি জানি’ এই সত্যপ্রিয় স্বমুখদর্শিত কবির অনন্য কাব্যিক আয়োজন ‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়’।
সদ্য প্রয়াত কবি রফিক আজাদকে পাই- ‘গ্র্যান্ডমাস্টার রফিক আজাদ’ কবিতায়—
‘সব বাদ অস্ত গেলে থাকে মৃত্যু বাদ
মৃত্যুর এপারে ব’সে
গ্র্যান্ডমাস্টারের চালে দাবা খেলে রফিক আজাদ’
কিম্বা ‘জীবনানন্দ দাশ সমকালেই বুদ্ধদেব বসুর বোধগম্য ছিলেন’ কবিতার সেই চিরন্তন উচ্চারণ—
‘নদীসব নৃত্যপটিয়সী
কবিতাও নৃত্যপ্রিয়; কবিতারও নদীর স্বভাব
শব্দগুলো ঢেউগাছপাকা কথা এইঃ সকলেই কবি নয়; কবি কেউ-কেউ’
মানুষের ডাকনাম চিত্রায়ন করতে গিয়ে কবি ‘আশ্বাসঘাতক’ কবিতায় লিখলেন—
‘আবারও আসবে ব’লে সূর্যের রোজই অস্ত যাওয়া। সূর্য কথা রাখে। ঢেউ-ঢেউ নদী কথা রাখে। ‘ফের দেখা হবে’ বলে কোকিলও বসন্তে ফিরে আসে। একবার চ’লে গেলে মানুষ ফেরে না। কথা দিয়ে কথা সে রাখে না। মানুষের ডাকনাম- আশ্বাসঘাতক’।
মানুষের প্রথাসিদ্ধ ডাকনামে, মুহূর্তের জন্য আশ্বাসপ্রিয় মন নিরাশায় দোলে উঠে। কোথাও কোথাও বেদনার ফুল শঙ্কার মতো ফুঁটে।
সত্যম কাব্যম সুন্দরম কবিতায় পাই কবি-ধর্মের চিত্রায়ন। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার যখন বলেন—
‘নিজের মাথায় ছাতা নিজেকেই মেলে ধরতে হয়। ছত্রধর বিপদসঙ্কুল। একাই হাঁটতে হয় জীবনের কিলো-কিলো পথ। গাড়ি-ঘোড়া অনিবার্য নয়। সত্যের দর্শনে লাগে কৃপাবিমুখতা। একই দাবি সুন্দরেরও।
কবির শাশ্বত ধর্ম- কৃপাবিমুখতা।’
তখন বোধের কম্পন জাগে কবি স্বত্বার নির্মোহ জীবনাচার আর অন্তর্নিহিত ভাব-প্রাচুর্যের বিন্যাস দেখে।
আবু হাসান শাহরিয়ার শুধুই সময়ের কবি নন, তিঁনি মুহূর্তকে ছেনে কবিতা নির্মাণ করেন, ছোট ছোট মুহূর্তের শাব্দিক চিত্রায়নে নির্মাণ করেন মহাকালের ছবি। ‘সোনামুখি সুঁই’ কবিতাটি এরকম একটি মুহূর্তগামী কবিতা, কিন্তু তার বিচরণ সময়ের প্রবাহমানতায়—
কেবলই অস্থির হয়- ভাঙে, জোড়া লাগে
মানুষের মন
নতুনও প্রাচীনপন্থী, মাটি খুঁড়ে তোলে
লুপ্ত প্রকরণদশকেই সঙ্ঘ ভাঙে, শঙ্খদার কথা
ঠিকই তো; আবার
পরাবাস্তবতা হাতে ফেসবুকও এক
যৌথ পরিবারএখন যন্ত্রের যুগ, যান্ত্রিকতা ছাড়া
মেলে না কিছুই
সেফটিফিন আছে বটে, হারিয়ে ফেলেছি
সোনামুখি সুঁইস্মার্টক্যামেরায় তোলা ছবিতে কত কী
দৃশ্য আসে যায়
আসে না বালিকা আর কাঁপনও লাগে না
ঝুলবারান্দায়
আবু হাসান শাহরিয়ারের শব্দেরা আপন দ্যোতিতে প্রীতিময়, ভাবনারা বৃক্ষের মতো ছায়াময়। বক্তব্য বস্তুনিষ্ঠতার কূল ঘেঁষে সত্যনিষ্ঠ। তাঁর কবিতায় আশ্রয় আছে, আছে নিরীক্ষার মাঝেও চেতনার চুলচেরা স্ফুরণ।
একটা কবিতার সামান্য অংশ পাঠে সম্পূর্ণতার স্বাদ পাওয়া যায়না, যদিও কবিতা সর্বকালের জন্য এক অসম্পূর্ণ যাত্রা। আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘তারা মিঞা’ কবিতাটি উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না—
‘পাঁচতারকা হোটেলের সভাকক্ষে একজন চারতারকা জেনারেল যেদিন জাতিকে গণতন্ত্র বোঝাচ্ছিলেন, সেদিন আমি হাওড়ের দেশে। জানো তো, কবির সাম্রাজ্য ঐ খাল বিল হাওড় নদীরা। রাতের শ্যালোনৌকায় আমি আর মাঝি যখন ধনু নদীকে নিয়ে গল্প করছি, তখন আকাশের সব তারকাই ছিল আমার আর মাঝির। কী আশ্চর্য, মাঝিটির নামও ছিল- তারা তারা মিঞা। ঐ রাতেই তারা মিঞাকে আমি আমার সাম্রাজ্যের প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দেই। কবির সাম্রাজ্যে সেনাপতিরা অযুত নক্ষত্রখচিত।’
অযুত নক্ষত্রখচিত সেনাপতির হাতে কালের বৈঠা, সামনে ধনু নদী। এরকম বোধ অনাদির আদি। আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতারা হঠাৎ করে কবিতা হয়ে উঠে, পুনঃপাঠে ধরা পড়ে আসলে কবিতার প্রতিটি শব্দ সুচিন্তিত, কোথাও বিন্দুমাত্র ফাঁকফোঁকর নেই। কোথাও জোর করে শব্দের
শরীরে শব্দ চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপার নেই। যেন পূর্ব-নির্ধারিত কোন ছবি এঁকে যাচ্ছে একজন কলমসৈনিক, তাতে উঠে আসছে যাপিত জীবনের সমূদয় ভাবনা, যা নিত্য নৈমত্তিক।
আট আর দশ মাত্রার মধ্য বিভাজনে চমৎকার ব্যঞ্জনা নিয়ে গড়ে উঠেছে- ‘ভাঙা চাঁদই পরাবাস্তবতা’ কবিতার শরীর। কবিতার প্রথমাংশ—
‘বুড়িগঙ্গা ঘাটে বাঁধা/ বনলতা বরিশালে গেছে
হাতিশালে হাতি নেই/ বাড়ি তোলে এলিফ্যান্ট রোড
মুছে যাচ্ছে জলাশয়/ মেগাসিটি ঝেড়ে কথা বলে
মাঠে নামে পুরাতত্ত্ব/ ঘাস কাটে শপিং কমপ্লেক্স
মেশিনের পায়ে আঁঠা/ যানজটে থেমে আছে প্রেম
স্মৃতিরা অ্যালার্ম ঘড়ি/ গলা সাধে মোরগের ভোর
উঠোনে হাজার বেলি/ পালকে মেঘের ডানা বাজে
চাতালে টিনের চালা/ পালতোলা রিকশা ডেকে আনো’
পড়তে পড়তে পাঠক মনে ভেসে উঠে অসংখ্য ছোট ছোট দৃশ্য, আরও একটু ভাবলে প্রতিটি খণ্ড দৃশ্যের পিছনেই আর একটা বৃহৎ পরিসরের মস্ত গল্প। এইসব ছোট ছোট শব্দে আঁকা দৃশ্য অকারণেই প্রিয় হয়ে ওঠে পাঠকের মনে। ভাঙা চাঁদই পরাবাস্তবতা কবিতার শেষ দুটি লাইন—
‘প্রয়োজনই শেষ নয়; কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়
নোনা-পচা গল্পদেরও কবিতায় শয্যা পেতে দিও’
এরপর আর বলার কিছু থাকে না। সত্যি তো- প্রয়োজনই শেষ কথা নয়, এর বাইরেও অপ্রয়োজনীয় অনেক দৃশ্যই অকারণে আমাদের প্রিয় হয়ে উঠে। আর সেসব ছোট ছোট দৃশ্যের যোগফল আমাদের সমগ্র মানবজীবন। একজন কবিতাপ্রেমী পাঠকের কাছে এই বইয়ের পাঠ উন্মোচন সময়ের দাবি। এই ছোট্ট পরিসরে অজস্র বৃহৎ ভাবনা পরিবেষ্টিত কাব্যগুচ্ছের- আলোচনা কিম্বা অকারণে প্রিয় অজস্র দৃশ্যের মর্মভেদ, সমালোচনা বা পাঠ আলোচনা কোনটাই করার সুযোগ নেই। একজন নিমগ্ন পাঠক হিসেবে এই উপলব্ধিটুকুই পরম সত্য- কবি আবু হাসান
শাহরিয়ার সত্যিকারের একজন শব্দের ডুবুরি। সময় নদীতে ডুব দিয়ে ভাবের ধ্বনি প্রকাশে উপযুক্ত শব্দ তোলে আনতে তাঁর জুড়িমেলা ভার। তাঁর কবিতা স্বাতন্ত্র মেজাজে ভীষণ ক্ষুরধার।