ভোগ বিষয়ক হেত্বভাষ । কেতু মন্ডল
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ মে ২০১৬, ১২:২৭ পূর্বাহ্ণ, | ২২৪৮ বার পঠিত
মানব সমাজের যে কোনো অবস্থায় ভোগ অপরিহার্য। ভোগ শ্রম-শক্তির বিকাশ ঘটিয়েছে এবং অর্থনীতির কেন্দ্রীয় চলক হিসেবে ক্রিয়াশীল। মোট কার্যকর চাহিদার সাথে মোট কার্যকর সরবরাহের একটি কাম্য অবস্থা তৈরি করে ভোগ প্রবণতা এবং এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে বাজার নামক এক মিথ ভাবনা। বাজারকে মিথ বলা হলো এই কারণে যে এটি চোখে দেখা যায় না, তবে ভোগ এই মিথকে উপস্থাপন করে ‘বাজার অর্থনীতির’ মোড়কে। এ আলোচনা গভীর বিতর্কের দিকে নিয়ে যাবে, তবুও ভোগ প্রবণতা তার নিজস্ব মহিমা নিয়ে বিরাজ করবে এবং ভোগ ব্যয় হ্রাস পেলে সুদ হার হ্রাস পায়, ভোগ ব্যয় হ্রাসের ফলে বর্ধিত সঞ্চয় ব্যাংকে তারল্য বৃদ্ধি করে যা সুদ হারে প্রভাব ফেলে।
নিম্ন সুদ হার বাজারে নগদ অর্থের প্রবাহ বাড়িয়ে দেয়, আবার যখন বলা হয় ভোগ ব্যয় হ্রাসের কারণে সঞ্চয় বৃদ্ধি সুদ হারে প্রভাব রাখে অর্থাৎ সুদ হার হ্রাস পায়, এক্ষেত্রে নগদ অর্থের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ভোগ ব্যয়ের বৃদ্ধি ঘটে। বাজারে নগদ অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে তা লগ্নি অভিমুখে ধাবিত হতে পারে। প্রশ্ন করা যেতে পারে, আসলে ভোগব্যয় হ্রাসের কারণে সঞ্চয় বৃদ্ধি সুদ হার কমিয়ে দেয়, না-কী ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি ঘটে সুদ হার হ্রাসের কারণে। এখানে আমরা দেখতে পাই, ভোগ ব্যয় হ্রাস সুদ হার হ্রাস; ভোগব্যয় বৃদ্ধি সুদ হার হ্রাস। এই বক্তব্য দু’টি এক সাথে গ্রহণ করলে ধাঁধাঁর অস্তিত্ব অনুধাবন করা য়ায়। এরভিন শ্রয়েডিংগার-এর ক্যাটস প্যারাডক্সের মত হেত্বভাষ অবস্থা বিরাজ করে, যেখানে শ্রয়েডিংগার-এর পর্যবেক্ষকদ্বয় যতক্ষণ পর্যন্ত এ্যাকুরিয়ামের বিড়াল সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন না করে ততক্ষণ পর্যন্ত বিড়ালটি জীবিত এবং মৃত উভয় ভাবে পর্যবেক্ষকদ্বয়ের কাছে উপস্থিত থাকে। আমরা ভোগকে এ্যাকুরিয়ামের ভেতর বিড়াল পর্যবেক্ষণে দেখবো, কিন্তু তা কখনো এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করবে না যে ভোগব্যয় সুদ হার-কে ঋণাত্মক না-কি ধনাত্মকভাবে প্রভাবিত করে যদি না আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করি। ফলে এ-ভাবে বলা যায় যে, ভোগব্যয় হ্রাস পেলে সঞ্চয় বৃদ্ধি পায় যা ব্যাংকে নগদ অর্থ জমা হতে ভূমিকা রাখে এবং উৎপাদন হ্রাসের কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠানের নগদ অর্থের চাহিদাও কমে যায়, ফলে নিম্ন সুদ হারে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। সঞ্চয় এবং এই ঋণের প্রবণতা থাকে অধিক মুনাফার প্রত্যাশায় ফটকামূখী হওয়ার, এ-ধরনের অবস্থায় শেয়ার বাজারে বুদবুদ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক।
সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি অথবা শাসকগোষ্ঠী যদি জনগণের মৌলিক অধিকার স্থগিত করে, যদি সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করে, সেক্ষেত্রে ভোগ কমিয়ে নগদ টাকা হাতে ধরে রাখার ইচ্ছা দেখা দিতে পারে। এ-অবস্থায় সুদ হার হ্রাস পাবে। কেইনস্ বলছেন- It is the “price” which equilibrates the desire to hold wealth in the form of cash with the available quantity of cash, which implies that if the rate of interest were lower, i.e, if the reward for parting with cash were diminished, the aggregate amount of cash which the public would wish to hold would exceed the available supply, and that if the rate of interest were raised, there would be a surplus of cash which no one would be willing to hold. হাতে থাকা নগদ সঞ্চিত অর্থ অধিক মুনাফা অর্জনের প্রত্যাশা বহন করে। সুদ হার হ্রাসের কারণে জনগণ হাতে ধরে রাখা নগদ অর্থ ব্যাংকে জমা না রেখে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। সুদের হার নির্ধারণে কাঁচা টাকার প্রতি অনুরাগ একটি আংশিক প্রভাবক হিসেবে ক্রিয়াশীল। যখন ভোগ প্রবণতা সংকুচিত হতে থাকে, অপরদিকে তখন নগদ টাকার প্রতি অনুরাগ বাড়তে থাকে। কেইনস্ আরো বলছেন, But an increase (or decrease) in the rate of interest will have to carry with it an increase (decrease) in the rate of consumption. নগদ অর্থ সঞ্চয়রূপে জমা হতে থাকে ভোগ হ্রাসের মধ্য দিয়ে।
মার্কস বলেছেন, পুঁজিবাদের অধীনে, পুঁজি ও তার বৃদ্ধিই মনে হয় সূচনা বিন্দু আর শেষ গন্তব্য, উৎপাদন হলো শুধু পুঁজির জন্য উৎপাদন। উৎপাদিত পণ্য সম্ভার ভোগে ব্যবহার না হলে উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়বে। এ রকম অবস্থা হতে লক্ষ করা যায়, ভোগ হ্রাস পেলে সঞ্চয় বাড়বে যা উৎপাদন অভিমুখে না যেয়ে ফটকা কারবারের দিকে ধাবিত হবে, যেহেতু এ প্রবাহ তাৎক্ষণিক বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে শেয়ার বাজার ক্রমে স্ফীত হতে থাকে।
মার্কিন অর্থনীতির চাঙ্গাভাব নির্ভর করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ভোগের উপর। ভোগব্যয়ের ইনডেক্স অর্থনীতির পরিমাপক। ভোগ বৃদ্ধি পেলে বেকারত্ব হ্রাস পায়। বাজারে ঋণের সহজ প্রাপ্যতা ভোগব্যয় বৃদ্ধির ইন্ধনে কাজ করে। সহজলভ্য ঋণের উৎস হিসেবে ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃক বিপুল মুদ্রা পণ্য বাজারে সরবরাহ লক্ষণীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার অর্থনীতি বিকাশের ঐতিহাসিক ফলাফল হলো সামরিকতন্ত্র এবং কর্পোরেট পুঁজির দৌরাত্ম্য। কর্পোরেট পুঁজির প্রধান যোগানদাতা ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, এ-সব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রবাহিত পুঁজি ফিন্যান্স পুঁজি নামে সম্বোধিত হয়ে থাকে। কর্পোরেটগুলো অধিক মুনাফার প্রত্যাশায় যুদ্ধ বাধাতেও দ্বিধা করে না, সাম্প্রতিক ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনার সমাহার দেখা যাবে। বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি চাঙ্গা না থাকলে কর্পোরেট পুঁজির অধিক মুনাফা প্রত্যাশা পূরণ হয় না। ফলে চাঙ্গাভাব ধরে রাখার জন্যে স্বল্প মূল্যের শ্রম বাজারের উদ্ভব ঘটে। অনুন্নত দেশসমূহের অব্যবহৃত বিপুল শ্রমশক্তি বিশ্ববাজারে রপ্তানি হয়ে থাকে। এই সব শ্রমশক্তি দ্বারা অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশীয় বাজারে বিক্রি করে কয়েক গুণ বেশি পরিমাণের স্থানিক মুদ্রা পেয়ে থাকে যা ভোগ বৃদ্ধির অনুঘটক হয়ে কাজ করে। সকল ধরনের ভোগ্যপণ্যের বিশেষ করে বিলাস সামগ্রী এবং ইলেকট্রনিক পণ্যসমূহের চাহিদা বেড়ে যায়। বর্ধিত চাহিদা মেটানোর জন্যে বহুজাতিক কর্পোরেট হাউসগুলো বাজার উদ্দীপনায় অধিক উৎপাদনে উৎসাহিত হয়। এ-ভাবে বিশ্বব্যাপী ভোগচক্র টিকে থাকে। এ-দিকে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে যে পরিমাণ স্থানিক মুদ্রা পাওয়া যায় তার আনুপাতিক ভোগ ব্যয় কম হয় এবং সঞ্চয় গড়ে ওঠে। সঞ্চয় আকাঙ্খার মাঝে লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যতে অধিক ভোগের প্রত্যাশা, নিদেনপক্ষে বর্তমান ভোগ অবস্থা যাতে বজায় থাকে। তাই বর্তমান ভোগকে সঞ্চয়ের ইচ্ছার কাছে উৎসর্গ করা হয়। এ ধরনের সঞ্চয়ের প্রবণতা থাকে অধিক মুনাফার আশায় ফটকা কারবারে নিয়োজিত হওয়া, এ-জন্যে উচ্চ ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয় অর্থাৎ সঞ্চয় বিনিয়োগ হয়ে ঝুঁকির সাথে জুয়া খেলায় লিপ্ত হয়। মূলত সঞ্চয় হলো চিরকালীন বর্তমানের জন্যে ভবিষ্যৎ ক্রয় করার আকাঙ্খা।
মার্কস বলেছেন, পুঁজিবাদের অধীনে, পুঁজি ও তার বৃদ্ধিই মনে হয় সূচনা বিন্দু আর শেষ গন্তব্য, উৎপাদন হলো শুধু পুঁজির জন্য উৎপাদন। উৎপাদিত পণ্য সম্ভার ভোগে ব্যবহার না হলে উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়বে। এ রকম অবস্থা হতে লক্ষ করা যায়, ভোগ হ্রাস পেলে সঞ্চয় বাড়বে যা উৎপাদন অভিমুখে না যেয়ে ফটকা কারবারের দিকে ধাবিত হবে, যেহেতু এ প্রবাহ তাৎক্ষণিক বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে শেয়ার বাজার ক্রমে স্ফীত হতে থাকে।
সঞ্চয় প্রাথমিক পর্যায়ে উচ্চ সুদ হারে আকর্ষিত হয়ে ব্যাংক ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয় এবং ব্যাংকের আমানত বৃদ্ধি পেতে থাকে, কিন্তু উৎপাদন ক্ষেত্রে তহবিলের চাহিদা তীব্র না থাকায় সুদহার হ্রাস পায় এবং ঋণ প্রবাহ বাড়তে থাকে, ব্যাংকে গচ্ছিত আমানত সঞ্চয়কারীদের হাতে নগদ অর্থে ফিরে আসে। ফলে অতিরিক্ত তারল্যভাব ফটকা কারবারের লোভনীয় খাতে স্থানান্তরিত হতে থাকে।
মার্কস দেখিয়েছেন শ্রমশক্তি উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে। ভোগ উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাতের সুযোগ করে দেয়। ভোগের জন্যে বাজারের প্রয়োজন হয়। জেবি সে বলেছেন সরবরাহ চাহিদার সৃষ্টি করে। নতুন বাজার সৃষ্টির জন্যে নতুন পণ্যের প্রয়োজন হয়। প্রযুক্তির উদ্ভাবন নতুন অভাবের জন্ম দেয়, আবার অন্যভাবে বলা যায়, প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে নতুন পণ্যের আবির্ভাব ঘটে যা নতুন ভোক্তা শ্রেণীর উদ্ভব ঘটায়। ফলে যদি কোন কারণে ভোগ হ্রাস পায় তবে অতি উৎপাদন দোষে শিল্পে সংকট দেখা দেয়। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় ভোগ বৃদ্ধি।
ভোগ বৈচিত্র মানুষের নতুন আবিষ্কারের পথ খুলে দিয়েছে। অভাব অসীম সম্পদ সসীম, এ বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলা যায় সীমাহীন সম্পদের মাঝে মানবজাতি হাবুডুবু খাচ্ছে। আন্তঃনক্ষত্রীয় বসতি গড়ার আকাঙ্খা তৈরি করেছে বিজ্ঞান প্রযুক্তি। এখানে দেখা যাচ্ছে প্রযুক্তির এ-অগ্রগতির আগে মানুষের এ আকাঙ্খার বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করে নি, যদিও কল্পনার জগতে মানুষ অনেক আগেই চাঁদে বসতি গড়েছে, স্বপ্নও মানুষের ভোগকে উসকে দেয়। ভোগ আকাঙ্খা পূরণের তাড়নায় আজকের বর্তমানে বসবাস আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। চাঁদে বসতি গড়ার কল্পনা অলীক জগতে নিয়ে গেছে আমাদের। অর্থনীতির কোনো তত্ত্ব কাজ করবে না যেখানে ভোগের কোনো অস্তিত্ব নেই অথবা এমন এক অবস্থা যেখানে সকল ধরনের ভোগের সামগ্রী সকলের জন্যে লভ্য এবং পর্যাপ্তভাবে উপস্থিত। অর্থনীতির সকল তত্ত্বের মূলে রয়েছে ভোগ। ভোগ উৎস হয়ে অর্থনীতির তত্ত্ব সমূহের উদ্ভব ঘটায়, যেখানে ভোগের কোনো বাধা নেই সেখানে অর্থনীতির প্রয়োজন থাকবে না কারণ এ ধরণের অবস্থায় অর্থনীতির তত্ত্ব কার্যকর থাকার কোনো শর্ত বিরাজ করবে না। যেমন অনন্যতা-য় পদার্থ বিজ্ঞানের কোনো সূত্র কাজ করে না, এ অভিজ্ঞতা মানুষ এখনো অর্জন করতে পারে নি, তবে মানুষ ঐ পরিবেশ তৈরি করতে পারে যেখানে অর্থনীতির কোনো সূত্রের প্রয়োজন হবে না। এটা এক অযৌক্তিক প্রপঞ্চ মনে হবে, কারণ বিরাজমান পরিবেশে যে যুক্তি গঠন হয় সেখানে এটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই যে ভোগ্য সামগ্রী সবার জন্যে লভ্য এবং পর্যাপ্তভাবে উপস্থিত থাকতে পারে। যুক্তি কাঠামো তথা এপিস্টমলজি অর্থাৎ প্যারাডাইম গঠন হয় উৎপাদন সম্পর্ক এবং উৎপাদনের উপকরণসমূহের বিকাশের ধরন দ্বারা। মানুষ কখনো ভাবতে পারে নি যে ‘মা’-কে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন দেখা দেবে, কারণ এটা ছিল চিরকালীন শ্বাশত, কিন্তু প্রযুক্তি আজকে মানুষকে সেই প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে, মা বলতে কাকে নির্দিষ্ট করতে হবে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে একাধিক দাবিদারের উদ্ভব, ‘সরোগেট মাদার’ প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। সুতরাং একথা বলে এ-লেখার আপাত সমাপ্তি টানা যেতে পারে, কারণ এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা আরো রয়েছে, তাই শেষ করবো এ বলে যে, মানুষের জন্যে ক্লেশহীন ভোগ সম্ভব হলে মানুষ একদিন মহাজাগতিক অভিযাত্রিক হয়ে ব্রহ্মান্ডে টিকে থাকবে।