পথ গেছে দূরে, কুয়াশা ছাড়িয়ে । মোস্তাক আহমাদ দীন
প্রকাশিত হয়েছে : 13 May 2016, 8:15 am, | ২৭৩৭ বার পঠিত

যোগ্যতার বিচারে খোন্দকার আশরাফ হোসেন আশির দশকের সবচেয়ে কম আলোচিত লেখক, অথচ সৃজন-মনন উভয় ক্ষেত্রে তিনি সবসময় ছিলেন তৎপর ও নিরলস : কবিতা রচনার পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদনার মতো কঠিন কাজ (অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ-কাজটিও এখন শুধু সংকলন ও গ্রন্থনার পর্যায়ভুক্ত), কবিতা, পুরাণ ও সাহিত্যতত্ত্বের তরজমা এবং পূর্ববর্তী-পরবর্তী ও সমবর্তী কবিতার আলোচনা-পর্যালোচনায় ছিলেন মনোযোগী ও সতর্ক। যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ লেখকের তাঁর সমকালে আশানুরূপ আলোচিত না-হওয়াটা তাঁর সময়ের সমাজ-মানুষের সৃজন-মননের দৈন্যেরই পরিচয় তুলে ধরে,১ এ-ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। অবশ্য খোন্দকারের ক্ষেত্রে একটি বাড়তি কারণও আছে, তা হলো তাঁর ক্ষুরধার জিহ্বা ও কলম, যা সাহিত্যিক বিষয়ের সঙ্গে-সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষয়ের আলোচনায় সবসময় ছিল সচল। বাড়তি কারণটি অবশ্য সবসময় একতরফা ছিল না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা ছিল প্রতিবাদ ও আত্ম/নৈরাত্ম-রক্ষারই জের/প্রতিক্রিয়া—এতে সমস্যা ছিল একটাই, তাতে ব্যক্তিগত আক্রমণ মাঝে-মাঝে যুক্তি-শৃঙ্খলাকে পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে ফেলত। তারপরও একথা বলা যায়, খোন্দকার তাঁর এই প্রবণতাকে আত্মপ্রচারের কাজে লাগাননি কখনো, এ-প্রসঙ্গে তাঁর কবিতা-বিষয়ে দুটি ঘটনার উল্লেখ করলে এর সত্যতা মিলবে।
২০০৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার বাংলা দ্বিতীয় পত্রের উত্তরপত্র দেখতে গিয়ে একদিন এক পরীক্ষার্থীর খাতায় খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ‘মানুষ’ কবিতার নিম্নোক্ত পঙ্ক্তি কটি আবিষ্কার করি:
মানুষ আত্মভেদী, আত্মনাশী নীল পতঙ্গ
একদিন সে পাঁজরের হাড় দিয়ে গড়েছিল এ পৃথিবী
একদিন মানুষই ধ্বংস করবে তাকে।
না ঈশ্বর না দেবতা না পাষাণ মৃদঙ্গ না প্রভাত না
মধ্যরাতে নিমগ্ন বালিশ না ফোয়ারা না যোনি না
কবন্ধ রাত্রির ঘুম কোনো কিছু না।
‘আবিষ্কার’ এজন্যই বলছি, আমি নিজে সেই কবিতাকে দেড় যুগ ধরে স্পষ্টভাবে ঈশ্বরকে মুখোমুখি করে মানুষের জয়গানের কারণে বাকাবিল্লার২ চূড়ান্ত রূপ বলেই ভেবে এসেছি, কোনো শিক্ষার্থী একে ‘পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার’ শীর্ষক রচনার সহায়রূপে উদ্ধৃত করবে এমনটি কল্পনাও করিনি কখনো। আমি এ-তথ্যটি সঙ্গে-সঙ্গে খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে জানাই, তা শুনে কবি বেশ মজা পেয়েছিলেন, বুঝতে পারি পরীক্ষার্থী যে-অর্থেই ব্যবহার করুক, তিনি এতে আনন্দিতও হয়েছিলেন; তা সত্ত্বেও আমি যখন আমার পত্রিকার জন্য এ-কবিতার (জন্ম)মুহূর্ত নিয়ে লিখবার অনুরোধ করি তখন তিনি তা লিখেও পাঠান, কিন্তু প্রাসঙ্গিক নয় বলেই হয়তো লেখার কোথাও সে-তথ্যের উল্লেখ করেননি।
এরও আগে, কলকাতা থেকে প্রকাশিত দীপংকর রায় সম্পাদিত এবং কথা পত্রিকায় ‘প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত’ বলে একজনের নামে তার ‘রিঙ মাস্টার’ কবিতাটি মুদ্রিত হতে দেখে বিস্মিত হই;৩ পরে সে-সংবাদ তাঁকে জানালে মুদ্রিত কবিতার একটি ফটোকপি আমাকে পাঠাতে বলেন; একসময় এ-কবিতাটি নিয়েও আমি তাঁকে লিখতে বলি, কিন্তু এ-নিয়ে কোথাও লিখেছেন বলে জানি না।
এখানে ঘটনা দুটি উল্লেখ করার কারণ তাঁর প্রতিবাদের আক্রমণাত্মক ধরনের প্রতি আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সেই প্রবণতাকে যে আত্মপ্রচারকার্যে লাগাননি তার পরিচয় তুলে ধরা, দ্বিতীয় কারণ, ভিন্ন-ভিন্ন ব্যাপারে কবিতা দুটি পাঠকের মনে স্থান করে নিলেও সেগুলো যে-বইয়ের অন্তর্ভুক্ত সে-বইটি কেন যে আজও আশানুরূপ সমাদৃত হলো না সে-বিষয়ে খানিকটা বিস্ময় প্রকাশ করা। অথচ জীবনের সমান চুমুক বইটি স্ব-উদ্যোগে একবিংশ প্রকাশন থেকে মুদ্রিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে, এরপর আর পুনর্মুদ্রণের দরকার পড়েনি, এরপর ২০০৫ সালে বইটি কবিতাসংগ্রহ-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, ২৩২ পৃষ্ঠার এই বইয়ের মূল্য মাত্র ১২৫ টাকা, আশ্চের্যের বিষয় ‘শিখা প্রকাশনী’ মুদ্রিত সংগ্রহটি এখনো বাজারে সুলভ। নানাবিধ গুরুত্ব বিবেচনায় এই বইটিই আজ আমাদের আলোচ্য।
২
বইটি শুধু আমার নিজের প্রিয় নয়, কবি নিজেও বলেছেন ‘আমার নিজেরও প্রিয়তম কাব্যগ্রন্থ জীবনের সমান চুমুক।’ তার কারণও আছে, এ-বইয়ের কয়েকটি কবিতা নানা তাৎপর্যে সচেতন পাঠককে অপঠিতপূর্ব অভিজ্ঞতায় মুখোমুখি করে। ‘মানুষ’ কবিতাটির কথাই যদি ধরি, যে-কবিতাকে শুরুতে কবি নিজে তাঁর কাব্যগ্রন্থে স্থান দিতে চাননি,৪ সে- কবিতাটি আপাতদৃষ্টিতে মানুষের স্বক্ষমতার জয়গানের কথা বললেও সুফিবাদের তুরীয় অবস্থারই নজির। বাংলা কবিতায় এমন প্রবণতা নজরুলের কিছু কবিতায় আছে, কিন্তু সেগুলির সঙ্গেও রয়েছে এ-কবিতার চেতনাগত পার্থক্য : নজরুলে রয়েছে অক্ষমতাজাত ক্ষোভ আর এখানে তার বিপরীত স্বক্ষমতার ব্যঞ্জনা, এছাড়াও বাড়তি গুণ হিসেবে এখানে আধুনিক মানুষের বেদনার সুরটিও যেন কোথাও বেজে উঠছে:
আমি সেই ভঙ্গুর ভঙ্গপ্রিয় ত্রিভঙ্গ মুরারির জন্যে
আমার কবিতা রেখে যাই।
আর কেউ নয়, আর কারো জন্যে আমার
দীর্ঘশ্বাস নেই, না গ্রন্থ না সুহৃদ না পলাতক
ভ্রমর গুঞ্জন না নারী না নিশ্চল বসন্ত বাহার …
আমি মানুষকে ভালবাসি কেননা সে একদিন
নিজহাতে নিজেকে পোড়াবে।
এ-কবিতাটিকে হয়তো বিভিন্নমুখ বিষয় ও চরিত্রের তালিকানির্ভর বিবরণের জন্য বইয়ে স্থান দিতে চাননি, কারণ এ-আমি একই চেতনা নিয়ে ভিন্ন রূপে এসেছে বইয়ের আরও একাধিক কবিতায়। ‘আমার ঘাতক’ কবিতায় যে ঘাতককে আহ্বান করে জানিয়েছেন ‘তবে আয়/আয় তোর ক্রুদ্ধ নুনের ছুরি মোহাবিষ্ট চকিত চাকুর/শাণিত ফলার নাচ বল্লমের মুগ্ধ জিভ আয়’, এই ঘাতক যে নিজেরই অন্য সত্তা, তার প্রমাণ কবিতার শেষ পঙ্ক্তি: ‘তবে আয় দেখা হোক মুখোমুখি ঘাতক সুন্দর’, এখানে ঘাতক ও সুন্দর শব্দ দুটি একে অন্যের বিশেষণ বা ব্যাখ্যা নয়, শব্দ দুটি মুখোমুখি/বিপ্রতীপ, দুই সত্তা এবং একে অন্যের পরিপূরক। ‘হনন’ কবিতাটিতেও রয়েছে সেই পরিচয় (এ-ছাড়াও কোনোভাবেই এটি কোনো সাধারণ কবিতা নয়, এতে আছে রবীন্দ্রনাথপ্রসঙ্গে এমন এক বিপজ্জনক স্তবক, কবিতা সচরাচর মনোযোগে পড়া হয় না বলেই কবি শুদ্ধতাপন্থীদের সমালোচনা থেকে বেঁচে গেছেন)। প্রথম পঙ্ক্তিতেই রয়েছে, শেষপর্যন্ত তিনি আয়নাটা ভেঙে ফেলেছেন আর পরে দেখছেন-শুনছেন অনেক কিছুই : গোলাপের বুকে তীর, ছিন্নভিন্ন চাঁদ, কারও পেচ্ছাবের জলস্রাবে-ভাসানো প্রান্তর, জ্বলন্ত আঙুর, এই সবকিছুই ঠিক আছে, কিন্তু এই বর্ণনার মাঝামাঝি হঠাৎ নিজেকে এমনভাবে হাজির করছেন কেন কবি? ‘এখন আমার নেই অতীত কিংবা ভবিষ্যত/আমি গালের চামড়া চিরে ত্রিফলা ছুরির টানে/আঁকতে পারি আঁকাবাঁকা বাঘের টোটেম/পর্বতের চূড়া থেকে লাফিয়ে পড়তে পারি/জীবনের ঘাড়ে/সুখের পাছায় কষে তিন লাথি বলতে পারি ভাগ্ শালা’, আর শেষ স্তবকে বলছেন, ভাঙা কাচে শতচক্ষু কোকিলের বাক্যালাপ শুনে তার ছুরির নাসারন্ধ ঘামতে থাকে, তাই ঘাড় এগিয়ে তীব্র বেগে চাকু ঢুকিয়ে দেন, আর রক্তপাতের আওয়াজকে কামার্ত নারীর শীৎকারের মতো মনে হয়। এই ভাবে নিজেকে তীব্রভাবে হাজির করে কবি আসলে মানুষের সেই অবস্থানকে তুলে ধরেন যা মরমি অর্থে যুগপৎ আত্মজাগরণ ও আত্মলুপ্তি উভয়/দ্বন্দ্ব-এরই শিল্পরূপ। কয়েকটি কবিতায় এই প্রবণতা থাকা সত্ত্বেও একথা মনে করার কোনো কারণ নেই, ‘আমি’র এমন অবস্থার সম্প্রসারণই তাঁর কবিসত্তার, বা এই বইয়ের, একমাত্র প্রবণতা।
অন্যত্র, তাঁর এই কবিসত্তাকেও দেখেছি অসহায়রূপে—অবশ্য একেও ঠিক অসহায়ত্ব বলা যাবে না হয়তো, মনে হয় রোমান্টিক চেতনার কারণে বৈদেহ-অনুভব থেকে এই অসহায়ত্ব বা আপাতপরাজয়ের বয়ান—বলছি তাঁর সাবলীল কবিতা ‘কোকিলস্বভাবা’র কথা; সাবলীল বললেও, কবিতাটি প্রতীকী কারণে সহজ নয়:
তুমি কোকিলের বুক চিরে তুলে নিতে চেয়েছিলে গান
আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
প্রস্তুত না থাকলেও, কবির কথা অনুযায়ী তাঁর হাতের অস্ত্র ছিল পাথরে শাণিত, চোখে ছিল সাত আসমান-পোড়ানো ক্রোধ আর তিন হাজার ষাঁড় বাগে-আনার-মতো ক্ষমতা, কিন্তু কবির উদ্দিষ্টা তাকে শুধু একটি ফুল পেড়ে আনার কথা বলল, আর কালো কোকিলের কলজে দিয়ে তৈরি করতে চাইল সুরুয়া, কারণ শিল্পকে সে খাদ্য আর পানীয়ের অধিক কিছু ভাবে না। এ-পর্যন্ত পড়লে বোঝা যায়, এখানে কোকিল এসেছে শিল্পের প্রতীক হিসেবে আর তাই শিল্পের এ-অবস্থা দেখে তিনি বলেন, এর জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না, প্রস্তুত ছিলেন আরও বড় যুদ্ধের জন্য এবং আরও অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার আকাক্সক্ষা ছিল তার; কিন্তু এরপরও বাধা আছে :
তুমি এগিয়ে দিলে পা ও উরু
ছুঁড়ে দিয়ে হাতের পাশা হেসে উঠলে ‘জিতেছি জিতেছি’।
সমুদ্রের অগাধ নীল জলের ভেতর
আমি তিমি হন্তারক তীর হারপুন ফেলে দিয়ে
হাঁটুজলের চপল সফরীর পশ্চাদ্ধাবন করলাম,
তুমি হেসে উঠে বললে,
‘পরাজিত মানুষকে আমি ভালবাসি না’
বুঝতে বাকি থাকে না এখানে নারী এসেছে সাবেকী প্রচল্ মুদ্রায়, তার ছলাকলাসহ :
তোমার আবদ্ধ উরুর মধ্যে ধরে রাখো স্পন্দমান প্রজাপতি
অথচ কোকিলকে দাও বনছাড়ার খোলা ছাড়পত্র
শেষপর্যন্ত সেই তুমি/নারী হাততালি দিয়ে যখন কোকিলের সহগামী হয়, তখন কোকিলকে শিল্পের প্রতীক রূপে ভাবাও আর সংগতিপূর্ণ মনে হয় না, সৌন্দর্যের প্রতীক বলেও মনে হয় না, এখানেই কবিতার অসহজতা আর রহস্য; তবে এটুকু স্পষ্টই বোঝা যায় যে, কবিসত্তা এখানে আর শক্তিমানের রূপে নয়, শত প্রস্তুতি সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত পরাজয়েরই প্রতিভূ। এমনকি ‘রিঙ মাস্টার’ কবিতাটিও যে তাঁর শ্রেষ্ঠতম একটি কবিতা, সেখানেও আছে এমনই এক অসহায়ত্ব—পরাজয়ের বিবরণ। এ-কবিতায় কবি জীবনকে সার্কাসের অর্ধশিক্ষিত বাঘ বলে ঠাউরেছেন :
জীবন একটি অর্ধশিক্ষিত বাঘের নাম
সে শুধু শিখেছে কি করে গরজাতে হয়,
গলার ভেতরে ওর ফাটা বাঁশি,
ওর হলকুমে ভ্রষ্ট বেহালার ছেঁড়া তার।
‘হলকুম’ শব্দের ব্যবহারটা এখানে চমৎকার, আর উপমাও নিঃসন্দেহে অভিনব, বাঘটিকে কবি দড়ির খেলা শিখিয়েছেন, দু-পায়ে ঘুঙুর বেঁধে কীভাবে সারা রিঙজুড়ে নাচতে শিখিয়েছেন, তাকে নন্দনতত্ত্বের সূত্র শিখিয়েছেন, জিহ্বায় কাঁটা বেঁধা সত্ত্বেও কীভাবে বেদনার ধ্রুপদ গাইতে হয়, তা শিখিয়েছেন, শিখিয়েছেন কথাকলির চৌষট্টি মুদ্রাও, তবু সে/জীবন ‘এখনো দিতে চায় শিল্পহীন লাফ’ সে শ্রীমতীর কাঁখের কলসকে পিপাসার জল হিসেবেই দেখতে চায়, দোলায়িত নিতম্বকে ভাবে একপ্রহরের আমিষের জোগান—এই কারণে কবির এই আক্ষেপ :
কানুর পিরীতি ওকে শেখানো গেলো না কোনোভাবে,
একদিন আমি জানি ও আমাকে খাবে ॥
নানা কাজে ও ঘটনায় মানুষেরা এমন চিন্তার মুখোমুখি হয়, জীবন নিয়ে ভাবে, ভাবতে বাধ্য হয়, মানুষ হিসেবে এটি যদি মানুষের কোনো রকমের পরাজয়ও হয়, তবু এর থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন—এই কারণেই কবিতাটি আধুনিক মানুষের আত্মজীবনী এবং এখানেই তার সফলতা। অন্যত্র, ‘হায় পার্থ’ কবিতায় কবি যে জীবনকে ‘পাখির জ্বলন্ত ঠোঁটে একদানা সরিষা’র সঙ্গে তুলনা করেছেন, সেখানেও এই চিন্তা, কবি পার্থকে বলছেন, তুমি আকাশের দিকেই বৃথাই তীর ছুঁড়ছ, মানবরক্ত তোমার শরীরে, তুমি তোমার চোখের মণিতে উড়ালপাখির ছায়া গেঁথে নিতে পারো তবু তোমার শায়ক ঈশ্বরের ঠিকানা খুঁজে পাবে না, আর, ‘জীবন মৃত্যুর মাঝখানে কম্পমান দ্রৌপদীর/সাতমহলার সিঁড়ি।/পিছল এবং অন্ধকার’, আর অমরতা যে-টুকু, তাও নিমেষের জন্য, ‘এর বেশী অনশ্বর, হায় পার্থ, নেই কোনো ছবি’। এমনকি বইয়ের নামকবিতায়ও তো রয়েছে সেই ব্যঞ্জনা, যেখানে জীবনসমান আলোর বাটিতে বারবার আকুতি জানালেও শতাব্দীর হাহাকার তাঁর হাতের নাগাল থেকে বাটি কেড়ে নেয়, প্রশ্বাস কেড়ে নেয় এবং তিনি বিষণ্ণ পাখির কণ্ঠে শোনেন শেষকথা : ‘তুই মৃত্যুর স্বাধীনতা পাবি, মুক্তি পাবি না।’ এই সবকিছুর মূলে রয়েছে এক চিরন্তন সত্যের প্রতি (কখনো বাধ্যতা, কখনো-বা অবাধ্যতাবশত) অনুগতি, ফলে তাঁর বুক চিরে বের হয় হতাশা ও ক্লান্ত বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস। তাঁর এই প্রবণতা বোঝার জন্য বইয়ের ‘চাকা’ কবিতার বিষয়ই যথেষ্ট, যেখানে কবি বলেন ঘুরতে ঘুরতে পুনরায় চাকার ভেতরেই যেতে হয়, চাকার সঙ্গে বিবাহ, চাকাকে হৃদয়ে গেঁথে হেঁটে যাওয়া, তার হৃদয়ে মিশে-যাওয়া, কিন্তু তা তো কবির অভিপ্রায় নয় কোনোভাবেই, কেননা এই চাকা বিনয়ের চাকার মতো আকাক্সিক্ষত চাকা নয়, কিন্তু এই সত্য-বাস্তবতা মেনে নিতে হয় তাঁকে, কারণ এ-ছাড়া গত্যন্তর নেই কারও।
চিরসত্যের প্রকাশ ছাড়াও কিছু কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে সমাজ-পরিবেশের অসংগতি, এতে কোনো-কোনো জায়গায় গলাও একটু চড়া, কিন্তু রূপ-প্রতীকের তাৎপর্য ও ছন্দ-ধ্বনিগত কারণে সেগুলো শিল্প-শর্ত পালন করেছে। প্রতীক হিসেবে সাধারণত এসেছে ছুরি, বল্লম, আলো, অন্ধকার, কসাই, কুকুর, বাঘ, কুমির, ফুল ও প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ, তবে এগুলো সব কবিতায় একই অর্থে আসেনি সবসময়, স্থানে-স্থানে এদের ওপর ভিন্ন ভিন্ন অর্থ আরোপ করা হয়েছে। এ-প্রসঙ্গে ‘কসাই’ কবিতাটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য:
দ্যাখ কসাইয়ের চোখের পাতায়
নাচছে প্রজাপতি
কাল সে ছিল মনমোহিনীর
হাতের নীচে জবাই
কাল সে ছিল গরীব নেওয়াজ
পাঞ্জেগানা প্রেমের—
কাল সে ছিল গোপন প্রেমের একক তরী বাওয়া
নাচছে ছুরি হায় ভগবান!
নাচছে ছুরি নিপাট আলোয় তিনশ’ তিরিশ
ওয়াটে
জ্বালছে আগুন শিরার ভেতর
সীমার নামের কবি
স্পষ্ট না হলেও বোঝা যায় এ-কবিতায় রয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্র-বাস্তবতার পরোক্ষ পরিচয়—এই বাস্তবতা জীবনের সমান চুমুক-এর আরও কিছু কবিতায় আছে। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় দেশের দুই কীর্তিমানকে নিবেদিত দুটি কবিতার কথা, একটি এসএম সুলতানকে আর অন্যটি নিবেদিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য করে—দুটি কবিতাতেই, বিশেষত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখিত কবিতায় রয়েছে সমাজপরিবেশের পরোক্ষ পরিচয়। সুলতানকে নিয়ে লেখা কবিতাটি অনেকটাই প্রথাগত, ব্যক্তিশিল্পী ও শিল্পকৃতির কথা কিছু আছে; কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতাটি ইঙ্গিতপূর্ণ, এতে আবেগ আছে—তা তো আরও অনেকের কবিতায়ই আছে—এখানে সংবেদনা প্রকাশের পাশাপাশি রয়েছে সমালোচনাও, যা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখিত অন্যদের কবিতায় অনুপস্থিত; সমালোচেনার পাশাপাশি এসেছে তাঁর সাফল্য, স্বপ্ন এবং মৃত্যুর কথাও :
তোমার মৃত্যু দিয়ে যাবে শুধু স্বপ্নের চোরাবালি
তোমার পায়ের পাতায় বিঁধেছে গোলাপের ভুল কাঁটা
তোমার জন্যে শুন্য বাটিতে জমা হবে লাল ক্রোধ
খঞ্জ পথিক উধাও চরের শ্রান্তিতে দিশাহারা
তোমার কাফনে কর্দম মাখা পায়ের স্বপ্ন মোছে
তুমি যাবে দূরে যাবে দূরে যাবে দূরে
৩
খোন্দকার তাঁর কবিতা-সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমার শুরুতে আমি ছিলাম আশিরচটিকা রোমান্টিক; চোখে ছিল উলুকভুলুক দৃষ্টি; শিরায় শোণিতে অনিকেত সংক্ষোভ’, জীবনের সমান চুমুক বইটি তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ হলেও তার কিছু কবিতায় এই প্রমাণ রয়েছে। বইয়ের ‘আত্মঘোষণা’ ও ‘সমাজ-পরিপার্শ¦’চেতন কবিতার পাশাপাশি এতে স্থান পেয়েছে ‘ঝাপুই খেলা’ এবং ‘শ্রাবণযাপন’-এর মতো কবিতাও। অবশ্য এখানেও স্রেফ আনন্দ-উদ্যাপনের আহ্বান নয়, চলে এসেছে খোয়াজ খিজিরের ধারালো তলোয়ার, হাঙরের খাবলামো, আকাশের ভেঙে-যাওয়া খিল নিয়ে ইঁদুরের পলায়ন এবং মানসীর হৃদয় ছেঁড়ার কথা। অর্থাৎ কবি যেখানে রোমান্টিক, সেখানেও তাঁর ফাঁকে-ফোকরে ঢুকে পড়েছে সময়-সমাজের ক্রুর-বক্র ছায়া। এর জন্য তিনি অনায়াসে ক্লাসিক কবিদের মতো নিজের দেশকাল-এর বিবেচনা বজায় রেখে নিয়ে এসেছেন দেশ-বিদেশের পুরাণ ও পুরাণচরিত্রের প্রসঙ্গ। কিন্তু কবি, তিনি ক্লাসিক হোন আর রোমান্টিকই হোন, তাঁর ভাব প্রকাশের জন্য দরকার পড়ে নিজের চেতনার রঙে রঞ্জিত শব্দ ও শব্দবন্ধ এবং তার অর্থ-দর্শন বিষয়ে কবির যথার্থ ধারণা, তা যে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ছিল তার পরিচয় নানা বইয়ে তো আছেই, এ-বইয়েও রয়েছে তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। বাংলা, ইংরেজি ও তৎসম শব্দ নিয়ে খেলেছেন খোন্দকার, কিন্তু তা তো আরো অনেকেই খেলেছেন, এখানে বরং আলোচনা হতে পারে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার বিষয়ে।
একসময় তামাদ্দুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার শুরু হয়েছিল, নজরুল অবশ্য বিষয়-পরিপ্রেক্ষিতকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য বহু শব্দের যথার্থ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু খোন্দকারে শব্দ-ব্যবহারে রয়েছে সম্পূর্ণ নিজস্বতা, ‘নিজস্বতা’র পরিবর্তে খোদ কবি-ব্যবহৃত শব্দ মনোনয়ন করেই বলি, ছিল ‘আশরাফিতা’। (উপরিউদ্ধৃত) ‘কসাই’ কবিতার একটি স্তবকে রয়েছে ‘কাল সে ছিল গরীব নেওয়াজ/পাঞ্জেগানা প্রেমের—/কাল সে ছিল গোপন নারীর একক তরী বাওয়া’, এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, ফারসি শব্দ ‘গরীব-ই-নেওয়াজ’ মানে গরিবের সহায়/আশ্রয়, এমনিতে খাজা মইনুদ্দিন চিশতির বিশেষণসূচক উপাধি, আর ফারসি শব্দ ‘পাঞ্জেগানা’ শব্দের অর্থ পাঁচবার, যেটি ফারসি ‘নমাজ’, আরবি ‘মাসজিদ’-এর আগে বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়, যেমন : পাঞ্জেগানা নমাজ, পাঞ্জেগানা মাসজিদ ইত্যাদি, কিন্তু এ-কবিতায় পাঞ্জেগানা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে প্রেমের আগে। এই কবিতায় ‘গজল’ শব্দের ব্যবহারও হয়েছে অভিনব : ‘রক্তপাতের ঝিনিকঝিনি ছয় লাইনের গজল’। ‘কোকিলস্বভাবা’ কবিতায় একই বাক্যে ব্যবহৃত হয়েছে দুটি বিদেশি শব্দ : ‘আর কালো কোকিলটার কলিজায় বানাতে চাইলে সুরুয়া’, কলিজা শব্দটি উর্দু ‘কলীজহ্’ আর ‘সুরুয়া’ আরবি ‘শুরুবা’ থেকে আগত—এখানে অবশ্য ভিন্ন চেতনায় ব্যবহৃত হয়নি, তবে এই শব্দ দুটির কারণেই বাক্যটি হয়েছে যথার্থ ও শ্র“তিসুখকর। ‘কৌন হ্যায়’ কবিতায় পুথির ভাষা কর্জ করে ভিন্ন চেতনার রূপ দেওয়ার জন্য সৃষ্টি হয়েছে একটি সুন্দর স্তবক :
দূরের দরক্ত থেকে চিড়িয়ার গান ভেসে আসে
কলাপাতা বউ নয়, অন্ধকারে শ্বাপদের মুখ
হয়ে যায় বদবক্ত মানুষেরা—ভেতরে সিঁদেল
চোর খিদে শাবল শানায়—বেহুঁশ বান্দারা
দরক্ত ফাটিয়া পড়ে চেয়ে দেখে মানুষের লোহু
‘বেহুঁশ’, ‘বান্দা’, ‘লোহু’ —এগুলো অপ্রচলিত নয়, ‘বদবক্ত’ও আগে ব্যবহৃত হতে পারে, কিন্তু ‘দরক্ত’, যেটি ফারসি ‘দরখ্ত’ থেকে আগত, যার অর্থ গাছ, সেটি আধুনিক কবিতায় এমন সার্থকভাবে আগে কোথাও ব্যবহৃত হয়েছে বলে জানি না। পুর্বোল্লিখিত ‘রিঙ মাস্টার’ কবিতায় ‘হলকুম’ শব্দের ব্যবহারের কথা আগেই উল্লেখ করেছি, যে-স্থানে বাঘের গরজানোর আওয়াজ বোঝাতে ফাটা বাঁশি আর ভ্রষ্ট বেহালার তারের আওয়াজের কথা উঠেছে সে-স্থানের নাম হিসেবে সম অর্থের ‘গলা’ বা ‘কণ্ঠনালী’ ব্যবহারের চেয়ে আরবি ‘হুলকুম’ থেকে আগত ‘হলকুম’ ব্যবহারটাই ধ্বনিগত দিক থেকে যথাযথ। একই কবিতায় ফারসি শব্দ ‘গর্দান’-সহযোগে লিখিত হয়েছে আরও একটি চমৎকার বাক্য : ‘দুচোখে মেলাতে চায়/শ্বদন্ত ও গর্দানের জ্যামিতি’। খোন্দকারের একটি প্রিয় শব্দ ‘আলখাল্লা’, এটি তাঁর বহু কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে, শব্দটি তুর্কি, মূলে হতে পারে আরবি শব্দ ‘আল্খলক’। এছাড়াও ব্যবহৃত হয়েছে আরবি শব্দ মুশায়রা, একাধিক কবিতায় ফারসি শব্দ ‘খোয়াব’। এত এত বিদেশি শব্দের ব্যবহার যে করেছেন খোন্দকার, তাতে তাঁর কবিতা কোথাও কৃত্রিমতা-দোষে দুষ্ট হয়েছে বলে মনে হয় না, বরং এ-কারণেই তাঁর কবিতা সহজেই হতে পেরেছে চিত্রল ও সংগীতময়। এমনিতে তাঁর কবিতার (মুদ্রা-)দোষ খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে মাত্রাধিক বিশেষণ, সংযোজক অব্যয়ের ব্যবহার, বিষয় বিবেচনা না করেই সব কবিতায় নিটোলতা আর সংগীতগুণ দানের চেষ্টা এবং কিছু কবিতায় পূর্ববর্তী কবিদের বিষয়-অনুষঙ্গের প্রভাব। অবশ্য পরবর্তীকালে তাঁর ভাষা ও বিষয় উভয়ই পালটেছে, সেই পরিবর্তন কমবেশি আদৃতও হয়েছে, কিন্তু আমাদের কাছে এ-বইটিই নানা বিচারে শ্রেষ্ঠ এবং এতে তাঁর কাব্যচিন্তার মূল স্বর/সুর-টি ধরা পড়েছে বলে মনে করি। উল্লেখ্য যে, তাঁর পরবর্তী বইযের নাম সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর, কিন্তু ‘ঘৃণার ঘুঙুর’ ব্যবহৃত হয়েছে জীবনের সমান চুমুক-এর শেষ কবিতা ‘আমার সময়, আমি’তে; আগের বইয়ের নাম পার্থ তোমার তীব্র তীর, তবু পার্থ-এর তীর ছোঁড়ার প্রসঙ্গ তাৎপর্যের সঙ্গে এসেছে এ-বইয়ের ‘হায় পার্থ’ কবিতায়—এমন উদাহরণের মাধ্যমে খোন্দকারের এতগুলো কাব্যগ্রন্থের মধ্যে এটিই কেন তাঁর কাছে ‘প্রিয়তম কাব্যগ্রন্থ’-এর মর্যাদা পায়, তা আন্দাজ করা যাবে।
টীকা
১. খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতা নিয়ে একদমই যে আলোচনা হয়নি তা নয়, মনে পড়ছে একবিংশ (ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫)-এ তুষার গায়েনের ‘স্বদেশের মর্ম থেকে উঠে আসা কবি’ শীর্ষক আলোচনার কথা, যেখানে তুষার খোন্দকারের প্রধান প্রবণতাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন;
২. ‘বাকাবিল্লা’ হচ্ছে স্রষ্টার অস্তিত্বে স্থিতি লাভের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির (স্রষ্টার) ক্ষমতা অর্জন, অর্থাৎ স্রষ্টার রঙে নিজেকে রঞ্জিত করা, তাঁর গুণ আপনার মধ্যে ধারণ করা—স্রষ্টার ক্ষমতা তো এর মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয়, এই কথা মনে রেখে (ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হলেও, ফ্রিডম-এর পরিভাষারূপে অমর্ত্য সেন-সমর্থিত) ‘স্বক্ষমতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। এ-ব্যাখ্যার অপর নির্ভরতা হলো মৎ-সম্পাদিত মুনাজেরা (আগস্ট, ২০০৯) দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘মানুষ’ কবিতা-বিষয়ে কবির মন্তব্য : ‘কোনো কোনো অপরিণতমনস্ক পাঠক এর ভিন্নরকম পাঠের চেষ্টাও করেন শুনেছি। ঈশ্বরের আলখাল্লাও মানুষকে ধারণ করতে পারে না—এ উচ্চারণ বিব্রতকর ঠেকে তাদের কাছে যারা মরমিয়া তত্ত্বের আস্বাদ কখনো পায়নি, জানে না স্রষ্টাও এক অর্থে সৃষ্টির উপর নির্ভরশীল—কারণ সৃষ্টিই তাকে সংজ্ঞায়িত করে। তবে সুফিতত্ত্ব আমজনতার জন্য নয়’;
৩. কবিতাটি এবং কথার এপ্রিল, ২০০৩ সংখ্যায় মুদ্রিত। এতে কিছু সংযোজন-বিয়োজন ঘটেছে {(মনে হয় যেন কোনো পক্ককেশ সম্পাদক গোঁফ না-ওঠা কোনো নবীন কবির কবিতা সংশোধন করে তার পত্রিকায় ছাপিয়েছেন); জালকবি প্রসেনজিতের রুচির তারিফ করতে হয় এই কারণে যে, সংযোজন-বিয়োজন সেরে, কিছু বানান শুদ্ধ করে, পঙক্তিবিন্যাস বদলে দিয়ে, ধ্বনিগত পরিবর্তন ঘটিয়ে তিনি কবিতাকে যে-অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছেন তাতে, কোনো-কোনো অংশ খোন্দকারের অংশের চেয়েও সুন্দর ও সাবলীল হয়েছে; এখানে নারীর ভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতা বিষয়ে বর্ণনা থাকার কারণে তৃতীয় স্তবকটি—নারীবাদীদের ভয়ে হোক বা দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণেই হোক— বর্জনের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। তার এই রুচি ও কারুদক্ষতা পর-ক্ষেত্রে অপচয় না করে, স্ব-ক্ষেত্রে কাজে লাগালে বাংলা কবিতার পাঠক উপকৃত হবে!}। এখানে মূল কবিতা ‘রিঙ মাস্টার’ এবং জালকবিতা ‘রিং মাস্টার’ দুটোই উপস্থাপিত হলো :
রিঙ মাস্টার । খোন্দকার আশরাফ হোসেন
জীবন একটি অর্ধশিক্ষিত বাঘের নাম
সে শুধু শিখেছে কি করে গরজাতে হয়,
গলার ভেতরে ওর ফাটা বাঁশি,
ওর হলকুমে ভ্রষ্ট বেহালার ছেঁড়া তার।
ওকে শেখালাম দড়ির সকল খেলা,
দু’পায়ে ঘুঙুর বেঁধে কি করে আসতে হয় নেচে
সারা রিঙ জুড়ে,
জীবন একটি অর্ধশিক্ষিত বাঘের নাম,
ও এখনো নখরের মৌমাছিকে
নিজের থাবার মধ্যে নিয়ে বসে থাকে।
ও এখনো রক্তপিপাসাকে শিল্প বলে চালাতে পারে না
(যেমন রমণীকুল নিজের ভ্রষ্টতাকে
অজ্ঞতার খামে মুড়ে বাজারে বিকোয় বেমালুম।)
ওকে শেখালাম নন্দনতত্ত্বের মূলসূত্র,
জিহ্বায় বিঁধিয়ে কাঁটা কি করে গাইতে হয়
বেদনার অমল ধ্রুপদ, সখি
নিশিদিনো হায় এসে চলে যায়, কে…
বাঘ তবু গরজায়, আর তার গলার ভেতরে
ফাটা বাঁশে আটকানো পিপাসার মাছি।
জীবন একটি অর্ধশিক্ষিত বাঘের নাম
মানুষের হৃৎপিণ্ড চিরে সে এখনো তুলে নিতে চায়
স্বপ্নের সুগন্ধ তুলোবীজ, ছুরির হিংস্রতাকে
বিকোতে পারে না শল্যচিকিৎসা বলে।
ওকে শেখালাম কথাকলির চৌষট্টি মুদ্রা,
নিপাট চোখের মধ্যে করুণার বিম্বপাত,
হাসির জোব্বার নীচে দাঁত শানানোর কলা
তবু ও এখনো দিতে চায় শিল্পহীন লাফ,
দুচোখে মেলাতে চায়
শ্বদন্ত ও গর্দানের আদিম জ্য্যামিতি
শ্রীমতির কাঁখের কলসী ওর চোখে শুধু পিপাসার জল,
দোলায়িত নিতম্বকে সে শিল্প ভাবে না,
ভাবে মাংস এক প্রহরের আমিষের
সম্ভাব্য যোগান—
কানুর পিরীতি ওকে শেখানো গেলো না কোনোভাবে,
একদিন আমি জানি ও আমাকে খাবে ॥
রিং মাস্টার । প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
জীবন একটি অর্ধশিক্ষিত বাঘের নাম
সে শুধু শিখেছে কি করে গরজাতে হয়,
গলার ভেতরে ওর ফাটা বাঁশি
ওর হলকুমে ভ্রষ্ট বেহালার ছেঁড়া তার
ওকে শেখালাম দড়ির সকল খেলা,
দু’পায়ে ঘুঙুর বেঁধে কি করে নেচে নেচে আসতে হয়—সারা রিঙ জুড়ে,
তবু সে নখের মৌমাছিকে থাবার মধ্যে নিয়ে বসে থাকে।
ওকে শেখালাম, নন্দনতত্ত্বের মূলসূত্র,
জিভে কাঁটা বিঁধিয়ে কি করে গাইতে হয়
অমল ধ্র“পদ, তবু সে গরজায়,
আর তার গলার ভেতরে ফাটা বাঁশে আটকে থাকে পিপাসার মাছি।
জীবন একটি অর্ধশিক্ষিত বাঘের নাম
মানুষের হৃৎপিণ্ড চিরে সে এখনো তুলে নিতে চায়
স্বপ্নের সুগন্ধী তুলাবীজ,
বোকা বাঘকে শেখালাম কথাকলির চৌষট্টি মুদ্রা
নিপাট চোখের ভাঁজে করুণার বিম্বপাত,
হাসির নিচে দাঁত শানানোর কলা
তবু সে এখনো মাঝে মধ্যে শিল্পহীন লাফ দিতে চায়
দুচোখে মেলাতে চায় শ্বাদন্ত ও গর্দানের আদিম জ্যামিতি
শ্রীমতীর দোলায়িত নিতম্বকে সে শিল্প ভাবে না, ভাবে
এক প্রহরের আমিষের সম্ভাব্য জোগান—
শুধু একটাই আপশোষ
কানুর পিরিতি ওকে শেখানো গেলো না কোনোকিছুতেই,
আমি জানি , একদিন ও আমাকেই খাবে।
৪. মুনাজেরা (আগস্ট, ২০০৯) দ্বিতীয় সংখ্যায় খোন্দকার আশরাফ হোসেন লিখেছেন : ‘জীবনের সমান চুমুক-এর পাণ্ডুলিপি সাজাচ্ছিলাম যখন, কবিতাটি তাতে দেব কি দেব না এ নিয়ে দ্বিধা ছিল। পাশে বসা ছিলেন তখনকার তরুণ কবি, একবিংশ-এর প্রথম সহকারী সম্পাদক বদরুল হায়দার। তিনি বললেন, ‘মানুষ’ কবিতাটি শুধু গ্রন্থভুক্ত করবেন তা নয়, ওটিকে দিতে হবে প্রথমে। আমি তার কথা মেনে নিই’।