লী মারাক্যাল-এর কবিতা । ভাবানুবাদ : শাহানা আকতার মহুয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ মে ২০১৬, ৮:৩২ পূর্বাহ্ণ, | ১৮৪১ বার পঠিত
লী মারাক্যাল ১৯৫০ সালে কানাডার বৃটিশ কলাম্বিয়া প্রভিন্সের নর্থ ভ্যাঙ্কুভারে জন্মগ্রহণ করেন ঐতিহ্যবাহী Salish and Metis গোত্রে। কানাডার আদিবাসী শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট স্কুলের বাইরে যে-কয়জন শিশু প্রথম কোনো সাধারণ স্কুলে পড়ার অনুমতি পেয়েছিলেন, লী ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। নয় বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা লেখেন। মূলত স্বশিক্ষিত লী একজন প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক, কবি এবং ঔপন্যাসিক। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘I am Woman: A Native Perspective on Sociology and Feminism’; তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : Bobbi Lee: Indian Rebel (1990), Sojourner’s Truth and Other Stories (1990); Oratory: Coming to Theory(1990), Sun Dogs (1991), Raven song (1993)। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘Bent Box’ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে।
মিস্টার ম্যান্ডেলা
আমাকে ক্ষমা করবেন মিস্টার ম্যান্ডেলা
গত পঁচিশটি বছর ধরে চেষ্টা করেছি
আপনার বন্দী জীবনের নিখুঁত ছবিটি আঁকতে,
কিন্তু পারিনি …
কোনো-এক অদৃশ্য হাত বারবার সজোরে টিপে ধরেছে
আমার কণ্ঠনালী
এই মাটিকে আমি জানি
তবে নির্মম সত্য হচ্ছে
নিজের ভূমিতেই বেড়ে উঠেছি এক
বদ্ধ ঘরে, আমার শৈশবে
যে-ঘরে সবসময় আটকে থাকত ইঁদুর আর ভয়ঙ্কর শব্দ!
অন্তহীন এক শূন্যতা আজো কুঁরে কুঁরে খায় আমাকে …
রুদ্ধ হয়ে আসে কণ্ঠস্বর
সেইসব ভয়াল দিনের কথা আর
মনেও আনতে চাই না …
অন্ধকারে, জোর-করে-টিপে-বন্ধ-করে-রাখা চোখে
তবুও সেইসব অভূক্ত দিনেরা এসে হামলা করে।
ওইসব অপূর্ণতা পূরণ করতে চাই, ভরিয়ে দিতে যাই
যেভাবে আপনি বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
ধবধবে সাদা দেয়াল আর লোহার শিকের ফাঁকে
উঁকি-দেওয়া আপনার কালো মুখটি
শতশত আলোর বিচ্ছুরণ নিয়ে আসে।
আমার জন্য যেন রেখে যায় সহস্রধারায় বৃষ্টিভেজা
দিনের প্রশান্তি …
মিস্টার ম্যান্ডেলা, যখন আপনাকে দেখি অবরুদ্ধ, কারাবন্দী —
সমুদ্রমাতার সেই শক্তিময়তা আমি আর অনুভব করি না
আমাদের সবুজ পাহাড়ে পাহাড়ে যেন জেগে ওঠে বাতাসের হাহাকার
জোরালো সেই বাতাস ঠেকানোর জন্য
গোপনে শক্তিমান ঈগলকে প্রশস্তি করি
যেন সে আগলে রাখে আপনাকে আর লিওনার্দোকে
তার শক্তিশালী পাখায়।
আপনাকে ভালো থাকতে হবে, মিস্টার ম্যান্ডেলা —
আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন গ্রহণ করুন …
অভিনয়
সত্যের মতো এমন নিখুঁতভাবে ভুঁরি ভুঁরি মিথ্যে বলার জন্য
নিশ্চয়ই অস্কার পাওয়া উচিত আমার।
এই যে এতবার এত রকম মুখোশ পরি, ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করি —
তার জন্য একটা অস্কার অবশ্যপ্রাপ্য।
কিন্তু আদিবাসী ইন্ডিয়ান কোনো নারীকে তারা
অস্কার দেয় না
পুরস্কার দেয় না ভোগ ম্যাগাজিনের পাতায় ছাপা ছবির মতো
ও-রকম খোলামেলা পোশাকের জন্যও
কেবল মধুঝরা বুলির মধ্যে চুবিয়ে রাখে
আচ্ছা … অমন ভাঙাভাঙা ইংরেজি তো আমিও বলতে পারি।
যদিও এখন
বাকরুদ্ধ …
নারী
আমেরিকা আর ইসরায়েলের বোমা বিস্ফোরণের তালে তালে
প্যালেস্টাইনের নারীরা শিশুদের দোলনা দোলায়
সে-বিস্ফোরণে কেঁপে-ওঠা মরুভূমির বাতাস
তাঁবুকে ছিন্নভিন্ন করে;
জলবাহকদের মুখে ছিটকে আসে বালুকারাশি।
কানাডা-আমেরিকায় মায়েরা হাতির দাঁতের তৈরি সামগ্রী ব্যবহার করে
এবং এখানে, ‘হাগিস’-এর মূল্যবৃদ্ধি আমাদের জন্য এক গুরুতর সমস্যাই বটে!
রাস্তায় রাস্তায় মরিচের গুঁড়োর মতো ধুলো ওড়ে
প্রতিরোধের তরঙ্গ এসে কশাঘাত করে রাজধানীর নগরদুর্গে।
কানাডা-আমেরিকার রাস্তা প্লাবিত হয় শুধুমাত্র ক্রেতাদের
ব্যতিব্যস্ত কেনাকাটার ধাক্কায় … সওদা করা … খরিদ করা আর খরিদ করা …
যখন গোপন কারখানায় রাতের অন্ধকারে
নারীরা কোমল হাতে অস্ত্র বানায় প্যালেস্টাইনের জন্য —
কান-আমেরিকার নারীরা তখন
লোভাতুরভাবে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায় ইসরায়েলি কমলার কোয়া
প্যালেস্টাইনী শিশুরা যা কোনোদিন চোখেও দেখেনি।
উষ্ণ, সর্বংসহা নারীদের দৃঢ়
নরম, নিশ্চিত পদক্ষেপ
সংগ্রামের মরুদ্যানে ছাপ এঁকে যায়;
নারীসুলভ প্রতিরোধ দিয়ে তারা মরুদ্যানকে জলপুষ্ট করে।
পরিবর্তনের উষ্ণ হাওয়া জানান দিয়ে যায়
আর বিজয়ের বিশুদ্ধ ঘ্রাণ ভাসে
এই ধ্বংসস্তূপে।
রাজেল্ বেরি
হাজার হাজার সুক্ষ্ম কাঁটা
আমার শরীরে গেঁথে যায়
সূর্যের তীব্র তাপ ফোসকা এঁকে দেয়
কালো পিঠে।
কেবল আকাঙ্ক্ষার মতো সামনে ঝুলে আছে
লাল টুকটুকে, থোকা থোকা অগণিত বেরি।
বিছুটির যন্ত্রণা
থকথকে কাদা, মশাদের ভনভনানি, গরুর গায়ে সেঁটে-থাকা
এঁটুলিপোকা আর ডাঁশমাছি …।
একটি ভারী বালতি যেন আমার গলায় টানা দিয়ে রাখে
উর্ধ্বমুখী টনটনে বাহু, তির্যক চক্ষুযুগল
কেন জানি না টাইপরাইটারে খটখট করে অক্ষরকে অঙ্কুরিত করার চাইতে
রাজেল্ বেরি তুলতেই আমার ভালো লাগে।