বাংলা চলচ্চিত্রের দিন বদলের এক শক্তিশালী মাইলফলক ‘মুসাফির’ । মোঃ অনিকউজ্জামান
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ এপ্রিল ২০১৬, ১০:১৭ অপরাহ্ণ, | ২৫৯৪ বার পঠিত
আজ মুক্তি পেয়েছে ২০১৬ সালের ঢালিউডের অন্যতম বহুল প্রতিক্ষীত মুভি ‘মুসাফির – টেল অফ অ্যাসাসিনস’। ‘আশিকুর রহমান’ পরিচালিত এ মুভিতে অভিনয় করেছে ‘আরেফিন শুভ’, নবাগতা ‘মারজান জেনিফা’, ‘মিশা সওদাগর’, ‘টাইগার রবি’, ‘শিমুল খান’, ‘সিন্ডি রোলিং’, ‘জাদু আজাদ’ এবং ‘ইলিয়াস কোবরা’। অতঃপর দেখে এলাম ‘মুসাফির’ এর আজকের ফার্স্ট দিনের ফার্স্ট শো। চলুন দেখে নেয়া যাক, কেমন ছিল ‘মুসাফির’ এর জার্নি…
‘কিস্তিমাত’ ও ‘গ্যাংস্টার রিটার্ন্স’ মুভি দুটি রিলিজের পর তরুন পরিচালক ‘আশিকুর রহমান’ এখন বেশ আলোচনায়। এরপর তিনি ঘোষনা দিলেন ‘আরেফিন শুভ’কে নিয়ে তৈরী করবেন অ্যাসাসিন মুভি ‘মুসাফির’, তারপর যখন এ মুভির টিজার ট্রেলার রিলিজ হলো তখন সকলকে একটু নড়েচড়ে বসতেই হলো, কারণ এমন স্টাইলিশ প্রমিসিং মুভির ট্রেলার এর আগে কখনো দেখা যায়নি। আবার আরেক দল মুখ বাঁকা করে বললো, এখন বাংলা মুভির ট্রেলার যতটা প্রমিসিং হয়, মুভিটা হয় তার তুলনায় যথেস্ট হতাশাজনক, যার রেকর্ড ‘চোরাবালি’, ‘কিস্তিমাত’, ‘তারকাঁটা’, ‘গ্যাংস্টার রিটার্ন্স’, ‘রানআউট’ সহ অতিতে নানান মুভির ছিল। তবে, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এবার ‘মুসাফির’ এর বেলায় হয়নি। ‘মুসাফির’ এর গল্পটা সাধারণ কিন্তু অনেক বিশ্বমানের ও নানান রকম টুইস্টে ভরপুর। ট্রেলারে দেখে গল্প যা আন্দাজ করা যায়, নায়ক একজন কিলার যাকে একটি অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় মুভির নায়িকা একজন সিক্রেট এজেন্টকে খুঁজে বের করে তাকে কিডন্যাপ করে সিক্রেট সার্ভিসের হাতে হ্যান্ডওভার করে দিতে। এদিকে সেই নায়িকার পিছনে লেগেছে আরেক গ্যাং বাহিনী এবং একদল কনট্রাক্ট কিলার। এদের সবার হাত থেকে নায়িকাকে বাঁচিয়ে সিক্রেট সার্ভিসের হাতে তাকে তুলে দিতে নায়কের পুরাই মাথা নষ্ট অবস্থা। নায়িকাকে নিয়ে নায়কের শুরু হয় এক বিপজ্জনক যাত্রা, যার পদে পদে হানা দিতে থাকে একের পর এক কুখ্যাত কনট্রাক্ট কিলার। কিন্তু এদের সকলের উদ্দেশ্য কি ? কেন সিক্রেট সার্ভিস তাকে ফিরে পেতে চায় ? কেন এক অচেনা গ্যাং বাহিনী তাকে মেরে ফেলতে চায় ? কেন তাকে মারতে একের পর এক কনট্রাক্ট কিলার পাঠানো হয় ? এদিকে সিক্রেট সার্ভিসের ভিতরেই বসে কেউ বেইমানী করে নায়ক নায়িকার তথ্য বাহিরে পাচার করতে থাকে, কে সেই বেইমান ? আর মুভির যে মূল নায়ক, কে এই ‘মুসাফির’ ? কি তার পরিচয়, উদ্দেশ্য ? কেন তার অতিত তাকে তাড়া করে ফেরে ? কি আছে তার অতিতে ? নায়িকার সাথে কি তার অতিতের কোন লিঙ্ক আছে ? কেন সে নায়িকাকে বাঁচাতে এত মরিয়া যাকে সে কখনো চেনেই না ? সব মিলিয়ে গোটা মুভিটি সিক্রেট সার্ভিস, ইন্টেলিজেন্স, এসপিওনাজ ও অ্যাসাসিনসদের বিশাল জগতের রহস্যের এক চাঁদরে মোড়ানো, যার একেকটি পরতে পরতে রহস্য উন্মেচন করা হয়েছে অভাবনীয় সব টুইস্টের মাধ্যমে। এই মুভির শুরুটাই হয়েছে এমন এক দৃশ্য ও টুইস্ট দ্বারা যা দর্শককে শুরুতেই সিটের সাথে বেধে ফেলবে এবং কনফিউজড করে দিবে। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এভাবে কখনো কোন মুভি শুরু হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। তারপর যতই মুভি এগিয়ে যাবে, দর্শক ব্যাকুল হয়ে যাবে রহস্য জানার জন্য, কিন্তু মুভির শেষ দৃশ্য না দেখলে দর্শকেরা কল্পনাই করতে পারবে না যে তারা গল্পে এতক্ষণ যা দেখে ও বুঝে এসেছে, তার গোটাটাই ছিল এক বিশাল ধাঁধা। ‘মুসাফির’ সাধারণ গল্প হলেও অত্যান্ত আনপ্রেডিক্টেবল একটি স্টোরী যার শেষ দৃশ্য না দেখলে কখনই এই মুভির টুইস্ট ধরা সম্ভব নয়, আর শেষ দৃশ্য পর্যন্ত দর্শককে সিটে বসিয়ে রাখার জন্য এমন প্রচুর টুইস্ট রয়েছে গোটা মুভিতে। অনেকেই ভাবছেন, এটি জাস্ট একটি রোড জার্নি মুভি। তাদের এই ধারনা ভুল। জার্নি হচ্ছে মুভির গল্পের একটি অংশ মাত্র, জার্নি ছাড়াও মুভির গল্পে আরো অনেক উপাদান ও টুইস্ট আছে।
‘মুসাফির’ মুভির প্রধাণ শক্তি হচ্ছে এই মুভির ডায়লগ। এ মুভির প্রতিটি চরিত্র তা ছোট হোক বা বড় হোক, তাদেরকে দিয়ে যে ডায়লগ গুলো বলানো হয়েছে তা ছিল অত্যান্ত পাওয়ারফুল ও এঞ্জয়বল। গোটা মুভির কমেডি থেকে শুরু করে সিরিয়াস সকল ডায়লগ ছিল অসাধারণ সব পাঞ্চ লাইনে ভরপুর যা হলের প্রতিটি দর্শক এঞ্জয় করেছে প্রচুর। কমেডি ডায়লগে সবাই মন খুলে হেসেছে ও সিরিয়াস ডায়লগে তুমুল হাততালি চলেছে। এর আগে কখনো কোন বাংলা মুভিতে গোটা মুভি জুড়ে এত পাওয়ারপ্যাকড ডায়লগ থ্রোয়িং দেখানো হয়নি। ‘আরেফিন শুভ’ এর সাইডকিক হিসেবে ‘বান্টি’ চরিত্রটি গোটা মুভির কমেডি সিন গুলো একাই টেনে নিয়ে গেছে, তাকে পর্দায় দেখা মাত্রই দর্শক সব সময় আনন্দে হাততালি দিয়েছে। তার সাথে ‘শুভ’র কমেডি টাইমিং ছিল অসাধারণ, যাকে বলে পারফেক্ট গুরু ও শিষ্য। ‘মারজান জেনিফা’র সাথে ‘শুভ’র কমেডি ও রোমান্টিক টাইমিং এবং ডায়লগ গুলোও ছিল অত্যান্ত উপভোগ্য। তাদের রোমান্টিক সিন গুলো এতটাই মজার ছিল একদম মন ছুঁয়ে যাবার মত। আর ‘মিশা সওদাগর’ এবং ‘আরেফিন শুভ’র যে কনভারসেশন তা ছিল যাকে বলে পুরাই আগুন ঝরানো। সব মিলিয়ে, এই মুভির স্ক্রিপ্ট ও ডায়লগ যে লিখেছে, তাকে চোখ বন্ধ করে মুভির অর্ধেকের বেশী ক্রেডিট দিয়ে দেয়া উচিত। মুভিতে ছিল ৪টি গান যা অত্যান্ত সুন্দর, আকর্ষনীয় এবং গল্পের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কোন গান দেখে মনে হয়নি যে এটি অযথা বা অপ্রয়োজনীয়। ‘মুসাফির’ এ প্রথমবারের মত অন্তরীক্ষে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট ও সিক্রেট সার্ভিসে তার ব্যবহার দেখানো হয়েছে এবং এই কনসেপ্টটি সত্যিই অনেক প্রশংসার দাবীদার। মুভির ব্যাকগ্রাইন্ড মিউজিক ছিল পুরাই রক্ত গরম করে দেবার মত, বিশেষ করে ‘মুসাফির’ গানটি ও তার মিউজিকের ব্যবহার। ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ ও ‘কৃষ্ণপক্ষ’ এর পর কোন বাংলা মুভির ব্যাকগ্রাইন্ড মিউজিক এভাবে মন ছুঁয়ে যেতে পারলো।
‘মুসাফির’ মুভিতে এমন সব ভায়োলেন্ট ও ঝুকিপুর্ণ অ্যাকশন দৃশ্য রয়েছে যা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এর আগে কখনো কোন মুভিতে দেখানো হয়নি, এমনকি ‘অগ্নি’, ‘কিস্তিমাত’ মুভি গুলোতেও নয়। এ মুভিতে ‘শুভ’র সাথে ভিলেনদের হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট গুলোর স্টাইল ও অ্যাকশন গুলো আপনাকে মনে করিয়ে দিবে ‘কোয়ান্টাম অফ সোলেস’ ও ‘জেসন বর্ন’ সিরিজ গুলোর অ্যাকশনের কথা। আশা করি বুঝতে পারছেন, কি টাইপের কমব্যাট স্কিলিং দেখানো হয়েছে এ মুভিতে। এ ছাড়াও এ মুভিতে বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম বারের মত দেখানো হয়েছে এক ধরণের মার্শাল আর্ট রানিং চেজ সিন যাকে বলে ‘পার্কার’ যা আমরা ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ এ দেখেছি। ট্রেনের কেবিনের ভিতরে দুর্দান্ত এক অ্যাকশন দৃশ্য ছিল যাও বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম। কতটা যত্ন নিয়ে এ মুভির অ্যাকশন গুলো সাজানো হয়েছে ও ‘আরেফিন শুভ’ যে কতটা ডেডিকেটেড ছিল মুভির প্রতিটি অ্যাকশন দৃশ্যে এমনটা ঢালিউডের আর কোন মুভিতে বা কোন নায়ককে কখনো করতে দেখা যায়নি। মুভির আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় ছিল মুভির কালার গ্রেডিং ও গ্রাফিক্স। গোটা মুভিটি ছিল অত্যন্ত কালারফুল ও কালার কম্বিনেশনের এত অসাধারণ ব্যবহার এর আগে কোন বাংলা মুভিতে করা হয়নি। ‘কিস্তিমাত’ মুভিটিও ছিল কালারফুল ও গ্রাফিক্সে ভরপুর তবে সেটি ছিল মাত্রাতিরিক্ত ও বিরক্তিকর। ‘আশিকুর রহমান’ সেই ভুল দ্বিতীয় বার করেননি। তিনি এ মুভিতে গ্রাফিক্স ও কালারের ব্যবহার অনেক সীমিত ভাবে করেছেন যেন তা দেখতে দৃষ্টিকটু না লাগে। কয়েকটি সীমিত বিস্ফোরণ দৃশ্য গ্রাফিক্স দ্বারা করা হয়েছে তবে সেগুলো ‘অনন্ত জলীল’ এর মুভি বা ‘কিস্তিমাত’ এর মত হাস্যকর, বিরক্তিকর ও কার্টুন টাইপের ছিল না। তবে মুভিতে একটি দৃশ্য ছিল চলন্ত ট্রেনের উপর অ্যাকশন, যা আমরা সচারচর দেখি বলিউড ও হলিউড মুভিতে। এটি খুবই সাহসী একটি কনসেপ্ট ছিল চলন্ত ট্রেনের উপর অ্যাকশন দেখানো কারণ এর আগে বাংলা চলচ্চিত্রে এমন কনসেপ্ট কখনো দেখানো হয়নি, তাই এ ব্যাপারে ‘আশিকুর রহমান’কে বাহবা দেয়াই যায়, তবে আসলে ঐ দৃশ্যটির কোন দরকার ছিল না কারণ ঢালিউড এখনো টেকনোলজির দিক থেকে এতটা অগ্রসর হয়নি যে চলন্ত ট্রেনের উপর একটি বাস্তব সম্মত অ্যাকশন দৃশ্য তৈরী করা সম্ভব হবে। দৃশ্যটি দেখে বোঝাই যাচ্ছিল যে এটি সম্পুর্ণ গ্রাফিক্সে তৈরী, এছাড়াও চলন্ত ট্রেনের উপর লড়াই রত অবস্থায় নায়ক ও ভিলেনের যে ঝুকিপুর্ণ অ্যাটিচুড দেখানো হয় তা ছিল এখানে মিসিং কারণ দৃশ্যটি তো স্টুডিওতে আলাদা ভাবে করা হয়েছে এবং পরে তা গ্রাফিক্স করে চলন্ত ট্রেনের উপর জুড়ে দেয়া হয়েছে যা ছিল বেশ দৃষ্টিকটু। এই একটি দৃশ্য ছাড়া গোটা মুভিতে গ্রাফিক্সের ও অ্যাকশনের কোন গুরুতর সমস্যা ছিল না।
‘মুসাফির’ মুভিতে ছিল একগাদা ভিলেন। এত গুলো ভিলেনকে সমান ভাবে গুরুত্ব দেয়া ও তাদের নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ করে দেয়া খুবই কঠিন একটি কাজ। মুভির ৩টি ছোট কনট্রাক্ট কিলার চরিত্রে ‘জাদু আজাদ’, ‘সিন্ডি রোলিং’ ও ‘শিমুল খান’ ছিল নিজ নিজে অবস্থানে বেশ শক্তিশালী তবে আফসোস, ‘সিন্ডি রোলিং’ ও বিশেষ করে ‘শিমুল খান’ এর চরিত্রকে আরো বেশী সময় দেয়া উচিত ছিল নিজেদের মেলে ধরার জন্য। ‘শিমুল খান’ তার অল্প উপস্থিতিতে যে অভিনয় করেছে, তাকে যদি আরো বেশী সময় দেয়া হত, তবে সে একাই গোটা মুভি কাঁপাতে পারতো। ভবিষ্যতে সে যে ‘মিশা সওদাগর’ এর মতই একজন শক্তিমান ভিলেন হতে যাচ্ছে, সেটা তার এই মুভির এক্সপ্রেশন দেখেই বোঝা যায়। কি ভয়ানক সাইকো টাইপের এক্সপ্রেশন ছিল তার, পুরাই গায়ে কাঁটা দেয়ার মত। এর পরেই আসা যাক ‘টাইগার রবি’র কাছে। এই মুভিতে ‘টাইগার রবি’র মেক-আপ, গেট-আপ, এক্সপ্রেশন, স্টাইল, ডায়লগ ছিল পুরাই মারদাঙ্গা এক ভিলেনের মত। তার ‘শুভ’র সাথে কিছু কিছু দৃশ্য ছিল এতটাই মজাদার যে দর্শক মন খুলে হেসেছে সেখানে। তবে, ‘টাইগার রবি’র সাথে ‘অনন্ত জলীল’ এর একটা মিল আছে আর তা হল তাদের দুজনেরই প্রধান সমস্যা হচ্ছে তাদের গলার ভয়েজ। ‘টাইগার রবি’র ভয়েজ শুনলে মনে হয় একটি শুকনা কাঠের সাথে আরেকটি শুকনা কাঠ ঘষা খাচ্ছে, যাকে বলে ফ্যাসফ্যাসে টাইপের গলা আর এই কারণেই সে যতই ভাল এক্সপ্রেশন দিক না কেন, ভাল ডায়লগ থ্রোয়িং করুক না কেন, শুনলে মনে হয় হুদাই খালি চিল্লাচ্ছে যা অত্যান্ত বাজে লাগে শুনতে এবং অনেক ডায়লগ বোঝাই যায় না ঠিক মত। ‘টাইগার রবি’র উচিত নিজের ভয়েজকে উন্নত করা নয়তো অন্য কাউকে দিয়ে নিজের ডাবিং করানো। মুভিতে সম্পুর্ণ নতুন চেহারা ছিল ‘মারজার জেনিফা’। ‘মারজান জেনিফা’ অত্যান্ত গ্ল্যামারাস ও কিউট এবং ইনোসেন্ট চেহারার অধিকারী। নতুন নায়িকা হিসেবে এ মুভিতে তার অভিনয়, এক্সপ্রেশন মোটামুটি সন্তোষজনক ছিল এবং এসব কিছুতে তাকে পুরোপুরি পাস মার্ক দিয়ে দেয়া যায়। ‘শুভ’ ও ‘জেনিফা’র জুটিটি ছিল অসাধারণ যা ‘কিস্তিমাত’ এর ‘শুভ’ ও ‘আঁচল’ জুটির থেকে হাজার গূণে ভাল। তবে ‘জেনিফা’র একটি দিকে সমস্যা ছিল, তা হল মুভির ইমোশোনাল ও কান্নার দৃশ্য গুলোতে সে এতটাই বাজে অভিনয় করেছে যে সেই গম্ভীর দৃশ্যেও দর্শক মজা পেয়ে হেসেছে। তবে ‘ফিরে আয়’ গানটিতে তার অভিনয় ও ইমোশোনাল এক্সপ্রেশন গুলো সুন্দর ছিল। ‘মারজান জেনিফা’কে ইমোশোনাল দৃশ্যগুলোর এক্সপ্রেশন ও ডায়লগ থ্রোয়িং এর প্রতি যথেস্ট মনোযোগ দিতে হবে এ ছাড়া তার বাকি সব কিছু ঠিক আছে আর একটি বিষয় হচ্ছে তার স্থুলকায় ফিগার। মুভির ‘রঙ’ ও আলতো ছোঁয়াতে’ গানটি ও কিছু কিছু দৃশ্যে তাকে যথেস্ট দৃষ্টিকটু লেগেছে তার ফিগারের জন্য। এখন এই মর্ডান সময়ে ‘মাহি’, ‘মিম’ দের মত স্লিম ও ট্যালেন্টেড নায়িকাদের ভিড়ে এমন ‘ময়ুরী’দের মত স্থুলকায় নায়িকা মোটেও মেনে নেয়া যায় না। ঢালিউডে টিকে থাকতে হলে, ‘মারজান জেনিফা’কে অবশ্যই নিজের ফিগার মেইনটেইন করতে হবে। ‘দেবাষীষ বিশ্বাস’কে একটি ছোট অতিথী চরিত্রে বেশ ভাল লেগেছে তবে, মুভির সব থেকে দারুণ ও শক্তিশালী একটি রহস্যময় অতিথী চরিত্র ছিল ‘ইলিয়াস কোবরা’র যা দর্শককে গল্পের টুইস্ট সম্পর্কে কনফিউসড করে দিবে। ‘ইলিয়াস কোবরা’ জাস্ট কাঁপিয়ে দিয়েছে তার সেই ছোট্ট চরিত্রে। তাকে কোন বড় চরিত্র দেয়া হয়নি, এটিও আরো একটি বড় আফসোস।
‘মুসাফির’ মুভির সব থেকে রহস্যময়, কনফিউসিং ও মাস্টার মাইন্ড ক্যারেক্টার ছিল ‘মিশা সওদাগর’ এর হেড অফ দ্য সিক্রেট সার্ভিস ‘কর্নেল আসাদ’ চরিত্রটি। ‘কর্নেল আসাদ’ কি ভাল নাকি মন্দ ? ভিলেন নাকি বন্ধু তা নিয়ে দর্শক গোটা মুভিতে থাকবে কনফিউশনে। মাঝে মাঝে ‘মিশা সওদাগর’কে দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল ‘মাসুদ রানা’ বইয়ের ‘মেজর রাহাত খান’ ও ‘জেমস বন্ড’ এর ‘স্পেক্ট্রা’ মুভির ‘এম’ এর কথা। এ যেন তাদেরই বাংলা সংস্করন। যতক্ষণ সে পর্দায় ছিল জাস্ট ফাটিয়ে দিয়েছে বিশেষ করে তার অতিতের এক ইমোশোনাল দৃশ্যে এবং মুভির শেষে সে যে টুইস্ট দেখিয়েছে তা দর্শকের মুভির গল্প সম্পর্কে সকল প্রেডিকশনকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিবে সেই সাথে ‘কর্নেল আসাদ’ এর যে অতিত দেখানো হয়েছে, তাতে সব কিছুর পরেও তার প্রতি দর্শকের মায়া জাগতেই বাধ্য। অবশেষে, যার কথা না বললেই নয় সে হল ‘আরেফিন শুভ’। এই নায়ক যে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ‘শাকিব খান’ এর সব থেকে বড় প্রতিদ্বন্দী হিসেবে আবির্ভূত হবে তা ‘মুসাফির’ দেখলেই বোঝা যায়। আমি ‘শুভ’র অভিনয় দেখলে খুব ভয়ে থাকি, কারণ তার এক্সপ্রেশনে বেশ ত্রুটি ও ন্যাকামি আছে। ‘শুভ’ যে কোন লেভেলের অভিনেতা সেটা সে ‘তারকাঁটা’ মুভিতে দেখিয়েই তার জাত চিনিয়ে দিয়েছে কিন্তু ‘কিস্তিমাত’ এ এসে ‘গাব্বার শিং’ এর ‘পবন কল্যান’কে নকল করতে গিয়ে সে যে পরিমাণ বাজে এক্সপ্রেশন দিয়েছে ও ন্যাকামি করেছে, আমি বিরক্ত হয়ে ‘কিস্তিমাত’ শেষই করতে পারিনি। এরপর সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ এ এসে আবার বাজিমাত এবং এখন ‘মুসাফির’। আস্তে আস্তে সে তার সব ত্রুটি ও ন্যাকামি গুলো ঠিক করে একজন পরিপুর্ণ নায়কে পরিণত হচ্ছে। ‘কিস্তিমাত’ এর সাথে ‘মুসাফির’ এর তুলনা করলেই বোঝা যায় ‘শুভ’ অভিনয় ও এক্সপ্রেশনে কতটা ডেভেলপ করেছে। ‘মুসাফির’ এর তার কোনই ন্যাকামি ছিল না, একদম গম্ভীর এক কিলার ও পারফেক্ট নায়কসুলভ অভিনয় করেছে সে। সেই সাথে ‘শুভ’ যেভাবে অসাধারণ ভাবে ফিগার মেইনটেইন করে তা ঢালিউডের আর কোন নায়ককে করতে দেখা যায় না। ‘মুসাফির’ এর ‘শুভ’র ফিগারের সাথে ঢালিউডের আর কোন নায়কের তুলনা হবে না। ‘শুভ’র এত অল্প সময়ে জনপ্রিয়তা ও উন্নতির সব থেকে বড় কারণ হচ্ছে মুভি সিলেকশনে তার রূচিশীলতা ও বিচক্ষণতা। এর আগে টিভি থেকে ‘ইমন’, ‘নিরব’ সহ অনেকেই মুভিতে এসেছে, কিন্তু তারা এসেই যেভাবে বস্তাপঁচা বানিজ্যিক মুভির জোয়ারে গা ভাসিয়েছে যার ফলে এখন তারা সবাই বিলুপ্ত আর এই দিকে ‘শুভ’ পুরোপুরি রূচিশীলতার পরিচয় দিয়ে ‘ইফতেখার চৌধুরী’, ‘মোস্তফা কামাল রাজ়’, ‘শিহাব শাহীন’, আশিকুর রহমান’ দের মত তরুন ও ট্যালেন্টেড নির্মাতাদের সাথে কাজ করে বিচক্ষণতার সাথে অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের খ্যাতিকে প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে। আমার আফসোস, যে ‘শিহাব শাহীন’, ‘আশিকুর রহমান’ ‘শুভ’কে জিরো থেকে হিরো বানিয়েছে, তাদের মত তরূন নির্মাতাদের সাথে যদি ঢালিউডের নাম্বার ওয়ান নায়ক ‘শাকিব খান’ কাজ করতো তবে, ‘শাকিব খান’ এর অবস্থান ও খ্যাতি যে কোথায় গিয়ে ঠেকতো তা কল্পনার বাহিরে।
‘মুসাফির’ মুভি যে একদম ত্রুটিমুক্ত মুভি তা বলা যাবে না। এ মুভিতেও অনেক জায়গায় অনেক ত্রুটি আছে। যেমন, ‘শুভ’ বার বার ডান হাতে ও শরীরের নানা অংশে জখম হয়েছে কিন্তু কিছু দৃশ্যের পরেই জখমের দাগ ও ব্যান্ডেজ গায়েব যা বেশ দৃষ্টিকটু ছিল এ ছাড়াও মুভির শেষ অ্যাকশন সিন যেমন মারদাঙ্গা হবার কথা ছিল তেমনটা হয়নি, মনে হয়েছে জোর করে শেষ করে দেয়া হল মুভিটি। ইন্টারভেলের পর মুভি একটু স্লো মনে হয়েছে, কারণ ইন্টারভেলের পর ৩টি গান দেখানো হয়েছে তবে সব মিলিয়ে খারাপ লাগেনি। আসলে চাইলে যে কোন মুভি থেকেই জোর করে হলেও হাজারো ভুল বের করা সম্ভব কিন্তু ‘মুসাফির’ এমন একটি মুভি যার ভুল বের করা উচিত হবে বলে আমি আমি মনে করি না, কারণ এত অসাধারণ, স্টাইলিশ ও বিশ্বমানের বাংলা মুভি এর আগে কখনো ঢালিউডে তৈরী হয়নি এমনকি ‘অনন্ত জলীল’ এর মুভিগুলোরও ক্ষমতা নেই ‘মুসাফির’ এর ধারে কাছে যাওয়ার। এই মুভিকে আপনি চাইলে অনায়াসেই বলিউডের সাথে তুলনা করতে পারেন কারণ বলিউডের সব ম্যাটেরিয়াল ও অ্যাকশন ‘মুসাফির’ এ আছে এবং এই মুভি যদি কলকাতায় রিলিজ হত তবে এর কাছে ‘দেব’, ‘জিৎ’ এর মুভিও ভাত পেত না, কারণ এই ধরণের গল্প, অ্যাকশন, মেকিং ও ক্যামেরার কাজ এ যাবতকালে শুধু ঢালিউডই নয় কখনো কলকাতার মুভিতেও ব্যবহার করা হয়নি। তাই আমাদের সবার উচিত এই মুভিটিকে যতটা সম্ভব এপ্রিসিয়েট করা। সব শেষে একটি কথা, মুভির কিন্তু গল্প অসমাপ্ত, কারণ আসছে সিক্যুয়াল ‘মুসাফির টু – টু টেলস অফ অ্যাসেসিনস’, যার ইঙ্গিত দিয়ে দেয়া হয়েছে মুভির শেষ দৃশ্যে। সুতরাং রেডী থাকুন, অদূর ভবিষ্যতে আরেকটি ‘মুসাফির’ এর শ্বাসরুদ্ধকর জার্নির জন্য… !!!