একগুচ্ছ কালের চিঠি । কালের লিখন
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ এপ্রিল ২০১৬, ৮:২৪ পূর্বাহ্ণ, | ৩০৭৭ বার পঠিত
প্রিয় বারান্দা
অনেকদিন বসা হয়না তোমার বুকে পাতা দোলচেয়ারে। দেখা হয়না চারপাশের ছায়াচিত্র। সকালের প্রথমরোদ, দুপুরের নিস্তব্ধ ক্লান্তি আর বিকেলের নীল আকাশ, কেমন দূরের মনে হয় আজ। মনে আছে তোমার? প্রথম দু’টো কাঁটাওয়ালা ক্যাকটাস আনলাম, তোমার বুকের এককোণে রাখবো বলে। একদিন বেখেয়ালে খোঁচা লেগে রক্তারক্তি কাণ্ড, ভিজে একাকার তোমার সাদা বুক। তারপর বারোমাস ছিলো আকাশ জুড়ে রক্ত ঝরার শোক।
দীর্ঘদিন পর মাটির টবে এলো টকটকে গোলাপ, ছিটেফোঁটা রোদ্দুরে কেমন চকচকে হয়ে উঠতো একান্ত সময়গুলো। অনেক সময় বসে বসে ঝেড়ে দিয়েছি তোমার বুকের অস্থায়ী ধুলো। চোখের মাঝেও আর একটা গভীর দৃষ্টি আছে এই কথা ভাবতে ভাবতে কতদিন হারিয়ে গেছি জানলার গ্রিল ছুঁয়ে অনন্ত আকাশে। তখনো তুমিই ছিলে এক চিলতে অবসর, স্থিতিশীল আমায় ভালোবেসে।
আমি আজ পথের পথিক, হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হওয়াই কাজ। তবুও মাঝে মাঝে উঁচু উঁচু বাড়ির দিকে তাকালেই চোখে পড়ে তোমার মতোই কোনো বারান্দা, বিশাল পৃথিবীর বুকে সামান্য আশ্রয়, এক জোড়া দর্শনপ্রিয় চোখ। হঠাৎ করেই মন খারাপ হয়, ভুলতে পারিনা প্রিয় বারান্দা, তোমার আকাশ হবার শোক।
প্রিয় বুনোফুল
শেষ দেখা হয়েছিল যখন আমি সমুদ্রে নেয়ে, আকাশের সাথে কথা বলতে বলতে পাহাড়ের দিকে যাচ্ছিলাম। তুমি ফুঁটে ছিলে উঁচু নিচু পাহাড়ি পথের ঢালে। তোমার সৌন্দর্যে রীতিমত কেঁপে উঠেছিলাম, যেন সদ্য যৌবনা কারও মৌবনের ঘ্রাণ মাতাল অবস্থা। চোখে চোখ পড়তেই তুমি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠলে, ততক্ষণে ভাবুক মনের বাতাস ধরেছে উল্টো স্রোত। প্রকৃতি কি অনুপম, কি মায়াময় অদ্ভুত। কেউ দেখুক না দেখুক, ঘ্রাণ নিক না নিক, তুমি ফোটে আছো আপন মনে।
জানো মুহূর্তে সেদিন কি মনে হয়েছিল? দুঃখু মিয়ার সেই নির্মোহ উক্তি- ‘আমি বনের পাখি, গান গাওয়াই স্বভাব, কেউ শুনলেও গাই, না শুনলেও গাই।’ সেই থেকে প্রতিদিন মনে মনে ভাবি- মানুষ বড়ই প্রশংসার অভাবী। তোমার আপন সৌন্দর্যে ফুঁটে উঠার জন্য কোন প্রেষণা প্রণোদনা প্রয়োজন হয়নি, দরকারের খাতায় ছিলো না আলোকচিত্রির ছবি তোলার অভিপ্রায়। তোমার ঘ্রাণ বিভোর চেতনায় ছিলো না সেদিন- কোন কবি কাব্য করুক তোমাকে নিয়ে। তবুও একান্ত মনের দায়ে, ভালোবাসার মধু ঘায়ে, আমি লিখছি তোমায় সাময়িক স্মরণপত্র।
প্রিয় বুনোফুল, এখনো অবাক দখল করে আছো তুমি- দৃষ্টিমগ্ন কবির সৃষ্টিলগ্ন নেত্র।
প্রিয় আকাশ
জানি প্রতিদিন অজস্র চিঠির ভারে ন্যুব্জ তোমার মেঘ পিওনের ডাকবাক্স। আমার সামান্য চিঠি, তোমার সীমাহীন বিশালতার কিছুই স্পর্শ করতে পারবে না। তাতে কিছুই যায় আসে না, আমি জলচক্রে বিশ্বাসী। তাই বিন্দু বিন্দু চোখের জলে তোমাকেই লিখছি। একথা তো সত্য- জলেরা বাষ্প হয়ে তোমার কাছেই ছুটে যায় আবারও জমাট বাঁধার প্রত্যাশা নিয়ে।
অনেক কথার ভিড়ে হারিয়ে যাবার আগে তোমার প্রতি প্রথম প্রেমের গল্পটা বলে নেই- সেদিন স্কুল বন্ধ ছিল, শুক্রবারের কোন অলস বিকেল, গত দুই দিন তুমুল বৃষ্টি। মায়ের হাতের চিঁড়ার মোয়া খেতে খেতে অবোধ বালক আমি পলকে তাকালাম আমগাছের ফাঁকে একখণ্ড আকাশে, সদ্য বৃষ্টি থামা তোমার গায়ে তখন অপূর্ব সব রঙের রেখা। আরও বড় হয়ে জেনেছি সেটা রঙধনু। বারবার রঙ বদলের খেলা খেললেও সেই থেকে আমি তোমাকে আর ভুলতে পারিনি।
এখনো মায়ের মুখ মনে পড়লেই আমি তোমাকে দেখি। বিশালতার উপমায় তুমি এসে হাজির হও ঔদার্য নিয়ে, বিষাদের রঙে কাব্য বিনির্মাণেও তোমার সাহায্য চাই। তোমাকে আমি চোখ বন্ধ করে, বন্ধ ঘরে কৃত্তিম ছাদের নিচে বসেও পাই। তুমি সীমার মাঝে অসীমের গুঞ্জরন তুলে, ভুল ভুলে ভাসিয়ে নিয়ে যাও আমাকে মেঘের ডানায়। তোমাকে পাই আমি লেখায়- আঁকায়। প্রিয় আকাশ- তুমি সবটা জুড়ে আছো অনুভবের ফাঁকায়।
প্রিয় নদী
ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছি-“সময় আর নদীর স্রোত, কারও জন্য অপেক্ষা করে না” সেই থেকে তোমার নাম শুনলেই মনে হত তুমি প্রচণ্ড ধাবমান জলাধার। মনে হতো সবকিছু ভাসিয়ে নেওয়াই তোমার কাজ। বারবার পড়তাম- ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে।’ জানো? প্রথম কবে দেখলাম তোমাকে? – আমার দু’গ্রাম পাশেই নানী বাড়ি। নানী বাড়ি যেতে যেতে নৌকোয় পার হতাম এক নদীর এপার ওপার। দুই ধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। ঘাটে ঘাটে অজস্র নৌকো বাঁধা। সমতলে পা ফেলে বেড়ে উঠা আমি, তোমার জলের অথৈ দেখে, সম্মোহনী গভীরতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, জলের তুড়ে নৌকোয় দোলে উঠেছিলো আমার সমস্ত পৃথিবী।
সেই থেকে নদী মানেই আমার প্রচণ্ড অস্থিরতার নাম। নদী মানেই আমার গহনে জলের ছলাৎ ছলাৎ। ধীরে ধীরে বড় হতে হতে জেনেছি -নদী মানেই এপার ওপার ভেঙ্গে-চুড়ে যাওয়া হুলস্থূল এক রমণীর নাম। যদিও- নদী মানেই আজকাল মরা চর, নদী মানেই আজকাল সরু খাল, দিকে দিকে দখলে নিয়েছে তোমায় পঙ্গপাল।
তবুও হে প্রিয় নদী, তুমি আমার প্রবাহমান জলজ বিশ্বাস, জলমগ্ন অনন্ত মহাকাল। তুমি আমার মরুতৃষ্ণ বুকে মায়াময় জলের ঢেউ, আমি ভালোবাসি জল, ভালোবাসি তোমাকেও।
প্রিয় চাঁদ
জানি তোমাকে নিয়ে হয়েছে বিস্তর কথার আবাদ। তোমার সৌন্দর্য প্রশ্নাতীত এই জগতব্যাপী। আমি সামান্য মাটির মানুষ, কি করে তোমার পরিসর মাপি? অনন্তকালের প্রেমপিয়াসী অন্তরে তুমি ঢেলেছ জোসনা সুধা। তুমি দিনের ক্লান্তি মুছে দিয়ে রাত এলেই আলোকিত করেছ ঘুমমগ্ন বসুধা। কতজন প্রাণপণ তোমাকে দেখেছে মিশিয়ে মনের মাধুরী। তুমি কত-শত বছরের পুরনো প্রেমবস্তু, আমি তো করছি সেদিনের বাহাদুরি।
তবুও হে চাঁদ- একটুও মিথ্যে নয় আমার প্রেমময় ভালোবাসার শাব্দিক বিবাদ। আমি আকণ্ঠ পান করেছি তোমার চন্দ্রসুধা, এখনো তৃষ্ণার্ত আমি, মিটে নাই জোসনা বিলাসের ক্ষুধা। জানি- আমার মতো অজস্রজন করেছে তোমার বন্দনা, আরও শতাব্দীর পর শতাব্দী আসবে যাবে কতজন, কারো অনুভবেই তুমি মন্দ না। কবি লিখবে কবিতা, শিল্পী আঁকবে ছবি। গিলে খাবে আস্ত চাঁদ যারা সরল অভাবী। কেউ তোমায় প্রিয়া ভাববে, কেউ ভাববে বুড়ি নানী, এসবে কিছুই হবে না তোমার, তুমি তো ভাবের রাজধানী। শুধু একটা কথাই এই চিঠিতে বলবো তোমায় চাঁদ, তোমার কাছেই জেনেছি প্রথম- ‘ভালোবাসা একটা ফাঁদ।’ অসহ্য আলোয় তুমি এই বার্তাই দাও, জীবন ক্ষণস্থায়ী, একে লুটেপুটে নাও।
প্রিয় হাসনাহেনা
সেদিন মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো, আমার তখন কুড়ি। শরীরে মনে চনমনে প্রকৃতি সকাল বিকাল দোল দিয়ে যায়। গাছফুল, লতাপাতা অকারণে আকর্ষণ করে এবেলা ওবেলা। কবরের পাশে ফুলের গাছ লাগানো, তখনো মৃতের প্রতি পবিত্র অর্ঘ্য নিবেদনের পর্যায়ে। পাশের বাড়ির বুড়িটা অনেকদিন বিছানায় গড়িয়ে মরে গেছে, হঠাৎ করে বুঝতে পারি- বুড়ির কবর থেকে মাতাল এক ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। কেমন ভয় পেয়ে গেলাম, আকাশে তখন চকচকে থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ। অসহ্য সুন্দর আলোয় অদম্য আকর্ষিত ফুলের ঘ্রাণ, মুহূর্তে আমি গন্ধ মাতাল, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম কবরের দিকে। সেদিন কতক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে নেই। ভোর হতেই- দু একজন নামাজি কবর জিয়ারত করতে এসে বলেছে- হাসনাহেনার গায়ে সাপ থাকে। আমি মুহূর্তে বোঝে নিয়েছিলাম- তোমার বিষাক্ত ঘ্রাণের তেলেসমাতি। আমি প্রথম উপলব্ধি করেছি- কাকে বলে মাতাল ঘ্রানানুভুতি। প্রিয় হাসনাহেনা, এখনো আমি তোমার গন্ধে মাতাল, যদিও এই শব্দগুচ্ছে মিটবে না সেই দেনা।
প্রিয় বিষাদ
সুখের অববাহিকায় সবাই নাইতে চায়। অথচ আমি তোমাকেই ভালোবাসি। পরিপূর্ণ প্রশান্তিতে মগ্ন হয়েও আমি, তোমাকে কাছে পেলেই হাসি। মুহূর্তে মুহূর্তে বোধের রোদে আমি তোমাকেই খোঁজে পাই। কাব্যে নাব্য হয়ে নিত্য নতুন বিষাদ পুড়াই। তুমি গালফোলা সকাল, মরে যাওয়া দুপুর আর আক্রান্ত সন্ধ্যায় ঠাঁয় বসে থাকো আমার ভাবনার আঙিনায়। আমি তোমাকেই দেখি কেবল একমাত্র সহায়।
তোমাকে দেখি আমি করুন ভিখারির চোখে, ঘুরে বেড়াও তুমি আর্ত-পীড়িতের মরা মুখে মুখে। তোমার ছায়া নিয়ে শিল্পী আঁকে ছবি, তোমাকে ছেনে দুঃখ এনে কবিতা সাজায় কবি। তোমাকে পাই অনুভবে, অসংখ্য না পাওয়ায়, তুমি উড়ে বেড়াও নষ্ট সভ্যতার ভ্রষ্ট হাওয়ায়।
প্রিয় বিষাদ, আমাকে ছেড়ে যেও না, যেখানেই থাকি, কুঁড়েঘর কিম্বা রাজপ্রাসাদ।