‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’ এর সফল অ্যাডাপ্টেশন ‘আরশিনগর’ । মোঃ অনিকউজ্জামান
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ এপ্রিল ২০১৬, ৯:২১ অপরাহ্ণ, | ২৯৬৫ বার পঠিত
বাড়ীর পাশে আরশিনগর, সেথায় একখান পড়শী বশত করে। আমি একদিনও না দেখিলাম তারে… ‘লালন’ এর এই গানের সাথে কোথায় যেন ‘শেক্সপিয়ার’ এর ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’ এর মিল আছে। পাশাপাশি দুই পরিবার যারা একে অপরের জাত শত্রু। প্রতিবেশী হবার পরেও সেই পরিবারের ছেলে ও মেয়ে কেউ কাউকে কখনো দেখেনি, আর যখন দেখা হয়েই গেল তখন তারা মন উজাড় করে ভালবাসলো একে অপরকে যার কারণে তাদের সম্মুক্ষীণ হতে হল এক করুণ পরিণতির। ইতিহাসের সব থেকে সাড়া জাগানো এই প্রেম কাহিনী নিয়ে মুভি নাটক কম হয়নি। হলিউডে আছে বিখ্যাত ‘লিউনার্দো ডিক্যাপ্রিয়ো’ ও ‘ক্লেয়ার ডেনস’ অভিনীত ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’। বলিউডে আছে ‘রনবীর শিং’ ও ‘দিপিকা পাডুকোন’ অভিনীত ‘রাম-লীলা’। দুটি মুভি থেকেই আমরা এই ঐতিহাসিক গল্পের দুই রকম স্বাদ পেয়েছি। এবার আসা যাক ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’ এর বাংলা ভার্সনে…
‘ইতি মৃণালিনী’ ও ‘গয়নার বাক্স’ খ্যাত ‘অপর্না সেন’ টলিউডের একটি বিখ্যাত অভিনেত্রী ও পরিচালকের নাম। তিনি যখন ঘোষনা দিলেন যে তিনি ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’ এর বাংলা ভার্সন নির্মাণ করবেন, তখন তো সেই প্রজেক্ট নিয়ে প্রত্যাশা কাজ করাটাই স্বাভাবিক। নায়ক হিসেবে নেয়া হল টলিউড সুপারস্টার ‘দেব’কে, অবশ্যই তার স্টার পাওয়ারের কারণে আর এতদিনে ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘বুনো হাঁস’ করে ‘দেব’ মোটামুটি ভিন্ন ধারার নির্মাতাদের দৃষ্টি কাঁড়তে সক্ষম হয়েছে। নায়িকা হিসেবে নেয়া হল ‘১০০% লাভ’ মুভিতে অভিনয় করা ‘জিত’ এর উপর ক্রাশ খাওয়া সেই পিচ্চি মেয়ে ও ‘বরবাদ’ মুভির নায়িকা ‘ঋতিকা সেন’কে। এবং মুভির ভিলেন চরিত্রে নেয়া হল মোস্ট ট্যালেন্টেড ‘যীশু সেনগুপ্ত’কে। শুরু হল ‘আরশিনগর’ নির্মাণ।
মুভির গল্প ‘আরশিনগর’ নামক এক কাল্পনিক বস্তিকে কেন্দ্র করে যার দখল নিতে মরিয়া দুই জাত শত্রু ‘মিত্র’ ও ‘খান’ পরিবার। এদিকে এই ‘মিত্র’ বাড়ীর ছেলে ‘রনজয় মিত্র’ ও ‘খান’ বাড়ীর মেয়ে ‘জুলেখা খান জুলি’ একে অপরকে ভালবাসে। এরা দুজন যখন নিজেদের ভালবাসা ও গানের জগতে ডুবে ছিল, সেই সময় ‘রনজয়’ এর বন্ধু ‘মিত্র’ সাহেবের ডান হাত ‘মন্টি’ ও ‘খান’ বাড়ীর আরেক ছেলে ‘জুলি’র কাজিন ‘তায়েব’ পরস্বপর ‘আরশিনগর’ এর দখল নিয়ে গ্যাং ওয়ারে জড়িয়ে পড়ে আর উপর থেকে মিনিস্টারের চত্র ছায়ায় কলকাঠি নাড়তে থাকে জনাব ‘খান’ ও ‘মিত্র’ এবং এসবের ফলে এক নির্মম পরিণতি নেমে আসে ‘আরশিনগর’ এর নিরপরাধ মানুষের উপর। ‘আরশিনগর’ ভাংতে ষড়যন্ত্র করে লাগিয়ে দেয়া হয় হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। বোকা মানুষ গুলো যারা এতদিন ভাই ভাই হয়ে মিলে মিশে বসবাস করছিল তারাই একে অপরকে মারতে ও কাটতে উঠে পড়ে লেগে যায় ও উপর থেকে ‘খান’ ও ‘মিত্র’ সময় গুণতে থাকে কখন সবাই মরে ‘আরশিনগর’ সাফ হয়ে যাবে। কিন্তু উপরওয়ালার কি অদ্ভুদ খেলা, নিজেদের স্বার্থের জন্য ‘খান’ ও ‘মিত্র’ যে দাঙ্গা লাগিয়ে দিল, শেষ পর্যন্ত সেই দাঙ্গাই কেড়ে নিলো তাদের পরিবারের দুই নিষ্পাপ প্রাণ ও শেষ করে দিল কিছু স্বপ্ন ও এক অবুঝ ভালবাসাকে।
‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’ এর গল্প জানে না এমন মানুষ প্রায় নেই বললেই চলে। একেক দেশে এই গল্পকে একেক ভাবে উপস্থাপন করা হয়ে হয়েছে যেমন ‘রাম-লীলা’তে গুজরাট এর সংস্কৃতী ও সেখানকার প্রেক্ষাপটে মানুষের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত দেখানো হয়েছে, তেমনি ‘আরশিনগর’ এ বাংগালী পটভূমীর হিন্দু-মুসলমান প্রেম ও সাম্প্রদায়িকতা দেখানো হয়েছে সেই সাথে উঠে এসেছে নোংরা রাজনীতী। ‘অপর্না সেন’ এর তারিফ করতে হয় উনি এমন কিছু স্পর্শকাতর বিষয়কে তার মুভির সোর্স মেটেরিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’ এর বিখ্যাত কিছু দৃশ্য যেমন ‘রোমিও’র লুকিয়ে প্রথম ‘জুলিয়েট’ এর বাড়ীতে যাওয়া, তাদের প্রথম দেখার নাটকীয়তা, ‘রোমিও’র বারান্দার ব্যালকনিতে উঠে ‘জুলিয়েট’ এর সাথে কথা বলা, এক সাথে পালানোর প্ল্যান করা সব কিছুই উঠে এসেছে ‘আরশিনগর’ এ তবে অবশ্যই বাংগালী পটভুমীতে ও এখনকার সময় ও আধুনিকতা সাপেক্ষে। আর শেষ ফিনিশিং এ অবশ্যই ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’ ও ‘রাম-লীলা’ থেকে ভিন্নতা রয়েছে যদিও পরিণতি একই। মুভির সিনেম্যাটোগ্রাফী অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুভির সেট, ডিজাইন ও ক্যামেরার কাজ দেখে আপনার কাছে মনে হবে আপনি মঞ্চ নাটক দেখছেন কিন্তু তাই বলে এগুলো মুভির শৈল্পিক সৌন্দর্যকে মোটেও নষ্ট করেনি, বরং শত গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘আরশিনগর’ মূলত মিউজিক্যাল ড্রামা। এই মুভির ‘জান কবুল’ গানটি সত্যিই জান কেড়ে নেবার মত, ‘মওলা মেরে মওলা’ নামক কাওয়ালী গানটি আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক দুনিয়ায়, ‘জান যদি যায় যাক’ গানটি আপনার মনকে করবে বিদ্রোহী আর ‘ছোট্ট একটা কামরা’ গানটি আপনার মনকে করবে ফ্রেশ সেই সাথে আছে ‘বাড়ীর পাশে আরশিনগর’ গানটিও তবে চেনাজানার বাহিরে একটু ভিন্ন সুরে।
অভিনয়ের কথা বলতে গেলে প্রথমে বলি ‘ঋতিকা সেন’ এর কথা। ‘জুলিয়েট’ এর মত এমন একটি শক্ত চরিত্রে এই বাচ্চা মেয়েকে নেয়াটা মোটেও যুক্তিযুক্ত হয়নি। গোটা মুভিতে এই মেয়েটা কিউটনেস ছড়িয়ে গেলেও এক্সপ্রেশনে ছিল পুরাই কাঠ। শুধু মাত্র ‘জুলিয়েট’ এর কারণে গোটা মুভিটা ঝুলে গেছে, এই চরিত্রে ‘কোয়েল’, ‘শ্রাবন্তী’ বা টিভি নাটকের কোন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নতুন মুখকে আনলেও মুভিটা অনেক জমজমাট হত। তবে ‘ঋতিকা’ মেয়েটা চেষ্টা করেছে যা দেখেই বোঝা যায় আর ‘অপর্না সেন’ও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে মেয়েটার মধ্য থেকে তার সেরাটা বের করে আনতে। আসলে অভিজ্ঞতা কম হলে যা হয় আরকি, তাই হয়েছে ‘ঋতিকা’র বেলার। সব মিলিয়ে খুব একটা খা্রাপ ছিল না আর ‘দেব’ এর সাথে তাকে মানিয়েছেও বেশ। তবে গোটা মুভিতে অভিনয়ে যে আগুন ঝরিয়েছে সে হল ওয়ান এন্ড অনলি ‘যীশু সেনগুপ্ত’। ‘তায়েব’ চরিত্রে তার যে ভিলেন লুক আর এক্সপ্রেশন, পুরাই মার কাট অবস্থা। এত দিন কোথায় ছিলে গুরু ? ‘অপর্না সেন’ একেবারে হিরে খুঁজে বের করেছে ‘যীশু’র মধ্য থেকে। ‘মন্টি’ চরিত্রে ‘অনির্বান ভট্টাচারিয়া’ ছিল অনেক উজ্জ্বল। এই ছেলেটা ভবিষ্যতে অনেক ভাল করবে বোঝা যাচ্ছে। এবার আসা যাক ‘রোমিও’ সাহেবের বেলায়। রকস্টার ‘রনজয়’ চরিত্রে ‘দেব’ ছিল বেশ। তার নতুন রকস্টার লুকটাও ছিল একদম তরুণীদের মন কেড়ে নেবার মত। কার কাছে কেমন লাগবে জানি না, তবে আমার কাছে ‘দেব’ ছিল অ্যাভারেজ। খুব বেশীও না, আবার খুব কমও না। এ মুভিতে ‘দেব’ ছিল অনেক পুরুষালী। পুর্বের ‘পাগলু’ টাইপের ন্যাকামী গুলো ছিল একেবারে অনুপস্থিত। আর এ মুভিতে ‘দেব’ তার ক্যারিয়ারের প্রথম অন স্ক্রিন লিপ কিস করেছে ‘ঋতিকা’র সাথে, একবার নয় বেশ কয়েকবার ! তবে, ‘রোমিও’ চরিত্রে তার কাছে আরো বেশী প্রত্যাশা ছিল। কেন জানি মন ভরেনি ‘দেব’ এর অভিনয়ে। সব সময় মনে হয়েছে আর একটু বেশী ইমোশন, এক্সপ্রেশন দরকার ছিল। তবুও ‘দেব’কে সাধুবাদ জানাই তার প্রচেষ্টার জন্য। ইদানিং ‘দেব’ যেভাবে মুভি ও চরিত্র নির্বাচনে রূচিশীলতার পরিচয় দেখাচ্ছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার আর তার চরিত্রের সাথে সাথে তার অভিনয়েরও পারদর্শীতা বাড়ছে। যেখানে টলিউডের সব থেকে বড় সুপারস্টার ‘জিত’ এখনো ‘বেশ করেছি প্রেম করেছি’, ‘পাওয়ার’ এর মত নিম্ন মানের রিমেক মুভি নিয়ে পড়ে আছে সেখানে এক সময়কার ট্রল কিং ‘দেব’ এর ঝুলিতে আছে ‘বুনোহাঁস’, ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘শুধু তোমারই জন্য’, ও ‘আরশিনগর’ এর মত অসাধারণ কিছু মুভি সেই সাথে ‘দেব’ এর হাতে আছে এখন ‘শ্রীজিত মুখার্জী’র ‘জুলফিকার’ (‘প্রসেনজিত’, ‘যীশু’, ‘পরমব্রত’, ‘অংকুশ’, ‘পাওলি’), ‘কৌশিক গাংগুলী’র ‘ধুমকেতু’, ‘কমলেশ্বর মুখার্জী’র ‘চাঁদের পাহাড় টু’, এবং ‘বিরসা দাসগুপ্ত’ এর নাম ঠিক না হওয়া মুভি। পরিচালকদের নাম দেখেই বোঝা যায় আগামী কয়েক বছরে ‘দেব’ এর অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকবে।
‘আরশিনগর’ মুভিটি সবার কাছে ভাল নাও লাগতে পারে। মুভিটি একটু ডার্ক টোনে বানানো আর যেহেতু জানা গল্প ও সেই সাথে যদি মাথায় ‘রাম-লীলা’ ঘুরতে থাকে তবে এই মুভিকে যে কেউ অনায়াসে বাতিলের খাতায় তুলে দিতে পারে তাই, খুব সিরিয়াস হয়ে ও ব্যাপক প্রত্যাশা নিয়ে ‘আরশিনগর’ দেখার দরকার নেই। তবে একটি বিষয় আমি গ্যারান্টী দিয়ে বলতে পারি, কারো কাছে যদি গোটা মুভির কোন কিছুই ভাল না লাগে তবুও একটি জিনিস তার ভাল লাগতেই বাধ্য আর তা হল মুভির ডায়লগ। কারণ এই মুভিতে সাধারণ কোন ডায়লগ ব্যবহার করা হয়নি। ‘আরশিনগর’ এর প্রত্যেকটি ডায়লগ কবিতার ছন্দে তৈরী সেটা প্রেমালাপ হোক, ভিলেনের সাথে রাগারাগি হোক, পিতা-পুত্রের ঝগড়া হোক বা রাজনীতীর ষড়যন্ত্র হোক প্রত্যেকটি ডায়লগ এমন ভাবে ছন্দের বাঁধনে বাঁধা, এ যেন কোন মুভি নয় বরং এক মহাকাব্য। এই একটি বিষয়ই দর্শককে পর্দায় আটকে রাখবে এবং এটিই ‘আরশিনগর’ সব থেকে বড় পাওয়া। ‘অপর্না সেন’ কতটা যত্ন নিয়ে মুভিটি বানিয়েছেন তা এ মুভির ডায়লগ থেকেই প্রমাণ হয়। আর সেই সাথে মুভির শেষ দৃশ্যটি চোখে লেগে থাকবে অনেক্ষণ ও দর্শকের মন খারাপ করে দিতে বাধ্য। অবশেষে, আমার ব্যক্তিগত মতামত থেকে বলছি, ভুল ত্রুটি সব মুভিতেই আছে ও থাকবে। ‘আরশিনগর’ এও অনেক ভুল আছে, সমস্যা আছে এবং চাইলে এই মুভির সমালোচনা করে একে একদম মাটিয়ে মিশিয়েও দেয়া যাবে কিন্তু টলিউডের সীমিত বাজার এবং অল্প বাজেট ও সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করলে সত্যিই বাংলায় ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’ এর অ্যাডাপ্টেশন এর থেকে ভাল আর হতেই পারে না। হ্যাটস অফ ‘অপর্না সেন’, সেই ‘গয়নার বাক্স’ এর পর আবার একবার মুগ্ধ হলাম আপনার কাজ দেখে… !!!
Arshinagar (2015)
Arshinagar poster Rating: 6.0/10 (12 votes)
Director: Aparna Sen
Writer: Aparna Sen, William Shakespeare (original story)
Stars: Dev, Rittika Sen, Jishu Sengupta, Rupa Ganguly
Runtime: 134 min
Rated: N/A
Genre: Drama, Musical, Romance
Released: 25 Dec 2015
Plot: Arshinagar is a Bengali musical romance drama film directed by Aparna Sen. The screenplay is an adaptation of Shakespeare’s Romeo and Juliet.