আধখানা চাঁদ, চূর্ণসূর্য, পূর্ণ কবিতাবই । তোজাম্মেল তালুকদার তোতা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ এপ্রিল ২০১৬, ৭:৪৬ পূর্বাহ্ণ, | ২৩১০ বার পঠিত
নিমেষেই গলাধঃকরণ না-করে ব্যাপারটা তারিয়ে তারিয়ে চেখে দেখবার, ‘ক্রমশ রস নিয়ে’ চেখে চেখে তৃপ্ত হবার-‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যে যেমন বলেছিলেন বিনয় মজুমদার — যে-কোনো মগ্নচৈতন্য কবির কাজকর্মের সামনে এসে এহেন বোধ জন্মায় পাঠকের ভিতরে। এবং উপরন্তু যদি হয় একজন কবির অভিষেকলগ্নিত কবিতাপুস্তক সেইটা, তাহলে তো অধিকন্তু মজুমদারেরই লিখিত পঙক্তিনিহিত মর্মসত্যের জয় হয়;-সেই রসধারায় ‘তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে’ — এবং, রসোত্তীর্ণ কবিতা আস্বাদনের প্রসঙ্গ তো ওঠে ঢের পরে, যে-কোনো কবিতার/কবিতাবইয়ের সমীপবর্তী হয়ে আমরা পাঠক হিশেবে চাই ‘বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন / সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।’
এহেন মস্ত গৌরচন্দ্রিকার আগে, একদম গোড়াতেই, একবার বলে নেয়া আমাদের কর্তব্য ছিল যে এই নিবন্ধটি সম্প্রতি-বেরোনো এক ছোট্ট-কলেবর কবিতাপুস্তকের সংবাদ প্রতিবেদিত করার লক্ষ্যেই লিখিত হতে চলেছে। এই ক্ষীণতনু পুস্তক/পুস্তিকার নাম ‘হাফ চক্লেট’, পুস্তকপ্রণেতা আনকোরা না-হলেও নবীন, কবি দ্বিতীয়-দশকে-লেখা-শুরু-করা আলফ্রেড আমিন।
কবিতাপুস্তক বলাটাও হয়তো মর্মত ঠিক হচ্ছে না, আন্দাজ করছি কবিরই অলিখিত অভিপ্রায় থেকে, কবিতাপাণ্ডুলিপি বলাটাই বোধহয় অধিকতর সংগত। বইটা, বা পাণ্ডুলিপিটা, আধখানা ম্যানাস্ক্রিপ্ট, ‘জাঙ্গাল’ নামে একটা কাগজে ছাপা হয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সনে। এবং ওই কাগজেরই সূচিপত্রে দেখতে পাচ্ছি ‘অর্ধেক পাণ্ডুলিপি’ ফলকের তলায় একে রাখা হয়েছে। এর মানে, ম্যানাস্ক্রিপ্টের কবি-অভিপ্রেত পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থকায়া আমরা পাই নাই। কিন্তু যতটা পাচ্ছি, যেটুকু তবুও সুলভ বর্তমান পত্রিকাপাতে-পাওয়া পাণ্ডুলিপিরূপে, তাতেই ঈপ্সিত কবির ও উল্লেখযোগ্য কবিতার দেখা আমরা পাবো। কাজেই, গ্রন্থ পেলে বেহতর হয় নিশ্চয়, কবিতা ‘আবিষ্কারে’ এবং ‘প্রেমে’ গ্রন্থ অনিবার্য জরুরি কিছু নয়।
একটানা আদ্যোপান্ত পঁচিশটি ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামের কবিতা একসঙ্গে এঁটে ছাপানো কবিতাপুস্তক। পত্রিকাসাধ্যির টানাপোড়েনের কারণেই হয়তো কতকটা গাদাগাদি দশায় প্রায়-নিঃশ্বাসফাঁক-না-রেখে কবিতাগুলো প্রকাশিত। পড়তে তেমন-একটা পাঠকবৈরী কিছু মনে হবে না ব্যাপারটা। তারপরও, বলা প্রাসঙ্গিক হবে হয়তো, কবিতা থেকে কবিতান্তরে যাবার পথে স্পেস্ থাকলে একটু অধিকতর নন্দনোত্তীর্ণ হতো গোটা ছাপনপ্রয়াসটুকু। তবে এইটা তো অত বড় কোনো গলতি নয়। ‘হাফ চক্লেট’ গলাধঃকরণের আনন্দাভিজ্ঞতা তাতে হেরফের হয় না।
আচ্ছা, ‘হাফ চক্লেট’ কেন? পুরো চক্লেট নয়? মানে, ঠিক নামকরণের সার্থকতা প্রতিপন্নকরণের মামলা নিষ্পত্তিতে যেতে চাইছি না, তারপরও মনে হয়, কেন ‘চক্লেট’ নয়? এর কবিপ্রদত্ত/সম্পাদকব্যক্ত কোনো উত্তর সন্নিবেশ করা নাই পত্রিকার কোথাও, হবার কথাও না। তারপরও মনে হয় ‘আধাপাণ্ডুলিপি’ ছাপার সঙ্গেই রিলেটেড নামকরণসূত্র। যদি তা না-ও হয়, তাতেও অসুবিধা নাই। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থাবদ্ধ রূপ প্রকাশকালে যেন কবি নতুন নামের তালাশে নেমে বৃথা গলদঘর্ম না হন, বলি তাই, কবিতাগ্রন্থের নাম হিশেবে ‘হাফ চক্লেট’ যথেষ্ট সমর্থ ও সুন্দর। ওই বিনয়ের প্রোক্ত কবিতাটিতেই আছে, ‘আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট’; কবিতাগুলোর পৃথক মলাটে বড়-কলেবর গ্রন্থরূপ প্রকাশকালে একই শিরোনাম বহাল থাকলে পরে এ-সমস্ত পরক্ষোল্লেখগুলো পাঠকের মনে আসবে। এই মনে-আসাটা কাব্যসংগত। অঞ্জন দত্তের সমনামী সেই গানটাও চকিতে উঁকি দিয়া যাবে পাঠকমনে। এছাড়া আধখানার ধারণাটাই তো অতুলনীয় রোম্যান্টিকতাঋদ্ধ। অশোকবিজয় রাহা-র সেই মিষ্টি লিরিকের লাবণ্যলতিত,-‘একটি সন্ধ্যা’-‘মাথার উপর ডাকল পেঁচা, চমকে উঠি-আরে! / আধখানা চাঁদ আটকে আছে টেলিগ্রাফের তারে!’ … কিংবা ‘আধেক’ শব্দধারণাটুকু শক্তির কবিতায় কী বিস্ময়বিভা চারিয়ে রেখেছে দেখি না? ‘আধেক লীন হৃদয় দূরগামী / ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি’ … ইত্যাদি শক্তিসিদ্ধি বাংলা আবহমান কবিতায়। আধখানা মানেই তো অপেক্ষায় আছে কোথাও অন্য অর্ধেক। দোঁহে একদিন মিলিবে কোথাও জগজ্জটিলা ভ্রান্তিদীর্ণ ভুবনরণাঙ্গনে। এহেন কবিতাশ্বাস, এইটা ভাবতেও তো অদ্ভুত ভালো লাগে, না?
আরম্ভপৃষ্ঠায় আছেন ‘সুরমা’, কবির জন্মাঞ্চলের নদী, যেখানে মেলে এহেন উচ্চারণ : ‘সফোক্লেস, শুনতে পাও তুমি / সুরমার ঢেউগুলি বেহুলার বিরহনিঃশ্বাস’; এরপর একে একে একটানা আরও চব্বিশটা গানের ঘোর। কয়েকগুচ্ছ ঘোর দৈবচয়িত পরিবেশন করা যাচ্ছে এইখানে : ‘উন্মাদ সমুদ্রবক্ষে দুলে ওঠে চাঁদ / মৃত নক্ষত্রের পাশে কেঁদে ওঠে বেদনার ভ্রূণ’ … ‘মাটি খুঁড়ে বের হলো যে-ছায়া তার মুখ গত সন্ধ্যার / মাটি খুঁড়ে বের হলো যে-ছায়া তার মুখ আগত সন্ধ্যার’ … ‘সেগুনগাছের মতো / অতন্দ্র পাহারা নিয়ে দূরাগত স্মৃতি / জেগে আছে দূরে’ … ‘সবুজ ডাবের মতো একজোড়া চোখ / আমার গৃহস্থালি ঘরে অনিবার্য আগুন জ্বেলেছিল … তুমি কি জেনেছো তাকে, কী করে সে পেয়ে গেছে ভুবনের ঘুম / মাটির গভীরে গিয়ে আকাশের দুরন্ত উড়াল?’-ইত্যাদি, এইসব, বিজুরিবিথার।
শুধুই তারিফি আলোচনায় শেষ হবে এই নিবন্ধপ্রতিবেদন? যথোচিত ফোকরগুলো গোচরে আনা হবে না? না, খারিজি আলোচনা অন্তত অভিষেকলগ্নে করতে নেই। ডেব্যু অ্যালবামে একজন কলাকারের খুঁত ধরা যায় না তা নয়, আসলে ডেব্যুমুহূর্তে প্লেয়ারের স্ট্রোকগুলো অপূর্বদৃষ্ট হবার কারণেই বিস্ময়নন্দিত হয়ে থাকে। এরপরও সংক্ষেপে এইটুকু কথা আমরা আগ বাড়িয়ে বলে ফেলব ঝুঁকি সত্ত্বেও যে, এই কবির সঙ্কেতনির্মাণের প্রণালি একটা স্বাভাবিক স্ফূর্তিসম্পন্ন। ঘোর তৈয়ারের যে-কথাটা আগে একপ্যারায় হিন্টস্ আকারে বলে এসেছি, হিন্টস্ সদর্থ-নঞর্থ দুইদিকেই প্রযোজ্য। কবিতার জন্য ঘোর যেমন জরুরি, তেমনি ঘোর কবিতার জন্য খাঁড়াও বটে। একজন কবির হাতে এই ঘোর তৈরির মতো ঘোর থেকে বেরোনোর কৃৎকৌশলও থাকা চাই। নিশ্চয় কিমিয়াটা আলফ্রেড আমিনের আয়ত্ত রয়েছে। এছাড়াও সঙ্কেত সৃজনকালে এই কবির কিছু শব্দপ্রয়োগ লক্ষ করা গেল, ভবিষ্যতেও অনুরূপ শব্দপ্রয়োগপদ্ধতি অনুসৃত হলেই বিপদের আশঙ্কা। আমরা একটামাত্র উদাহরণে এইবেলা ক্ষান্ত হব; পঙক্তি তোলা যায় ‘মেটামর্ফোসিস্’ কবিতা থেকে, ‘তুমি-যে ছবির মতো কোনো-এক শূন্য দেয়ালে / দাঁড়িয়ে দেখছো নীল, রেলগাড়ি, সেলাইমেশিন’-এইখানে, এই যে, ‘সেলাইমেশিন’ প্রযুক্ত হবার সঙ্গে-সঙ্গেই বিপদটা ঘটে যেতে পারে; এমন নয় যে এক কবির কয়েনেজ্ অন্য কবি নিতে পারবেন না; না, আমরা তা বলছি না, আমরা বলছি শব্দ বসানোর পদ্ধতি নিয়ে; এক ও অভিন্ন শব্দ নিয়েই বিভিন্ন কবি একসঙ্গে কাজ করেন, সমকালেই, প্রয়োগপ্রণালিগত স্বকীয়তার কারণেই ভিন্ন হয়ে ওঠে একের সনে অন্যের শব্দপ্রযুক্তি। শুধু এই ‘সেলাইমেশিন’ শব্দটাই উৎপলের প্রায় টিপছাপ থাকা সত্ত্বেও শব্দটা ভাস্করের কবিতায় এসেছে একেবারেই ভিন্ন প্রয়োগযোগে, এসেছে ব্রত চক্রবর্তী কি নির্মল হালদারের কবিতাতেও। শুধু প্রয়োগভিন্নতায় এদের কারোটাই কারোর ছবি রিপ্রোডিউস্/রিপ্রিন্ট করে না। কাজেই, শব্দ নয়, অ্যাপ্লিক্যাশনপ্রক্রিয়াটাই নিরীক্ষণীয় কবিতায়। আলফ্রেড আমিনের কবিতায় এই দিকগুলো ভবিষ্যতে আমরা আরও অভিনিবেশে লক্ষ করব, বলা বাহুল্য, নতুনতর উদ্ভাসনেরই দেখা পেতে।
এই কবির একটা আস্ত কবিতা পড়তে পড়তে আমরা আজকের বইসংবাদ শেষ করব। কবিতাটা পড়ার সময়, আসলে পাঠোত্তর, এবং পুনঃপুনরাবর্তিত পাঠের সময় লক্ষ করব যে এর মিলবিন্যাস কত অনায়াস অথচ অধরা প্রায়! আমিনের এহেন অনায়াসলব্ধ ঘোর, প্রায়শ চারণকবির গানের ন্যায় আচ্ছন্ন ও অত্যাসক্ত ঔদাস্য, ভবিষ্যতের বাংলা কবিতায় বিনিয়োগ হোক সুস্থায়ী শস্যের আশ্বাস নিয়ে। এবং রচিত হোক বাংলাদেশের সুরচিত্রঋদ্ধ কবিতা আলফ্রেড আমিনের হাতে। এইবার কবিতাটা, ‘আমার সমস্ত ধ্যান’, আস্তে আস্তে পড়ি এবং তারপর যার যার জায়গা থেকে এই কবি এবং এই পঁচিশটুকরো কবিতার খোঁজতালাশ চালাই।
বাঁ-দিকে ঘুরালে মুখ পাখিদের গান শুনতে পাই
ডানদিকে তুমি হাঁটো, ঘুঙুরের শব্দ ঝরে পড়ে
এখন কি দিন বলো রাত্রি বলো কোনদিকে যাই
আমার সমস্ত ধ্যান ধবল জ্যোৎস্নার মতো ঝরে।
কে যেন নিঃশব্দে ডাকে, ভাবি তুমি, তবু বনবোধে
আমার অপেক্ষা, ভ্রম, উড়ে যায় দিগন্তের দোরে
যেখানে পাথরকাল, পর্বতেরা গলে যায় রোদে
মেরুদ্রাঘিমার রেখা দূরাগত আগুনের ভোরে।
তুমি তা বোঝো না শুধু কী-এক আনন্দ সারাদিন
ধনুকের মতো নদী, বাঁকা নদী, কার গান গায়
ভেতরে বিষের পলি, ভেতরে করুণ ভায়োলিন্
বাতাসে পালক ঝরে, পালকে বাতাস ঝরে যায়।
‘হাফ চক্লেট’ পড়া যাবে ফেব্রুয়ারি-২০১৬ সংখ্যা ‘জাঙ্গাল’ পত্রিকায়। এর প্রকাশক, যুগপৎ পত্রিকা ও পাণ্ডুলিপির, শামস শামীম। অলঙ্করণকারী বিমান তালুকদার। হিরণ মিত্র অঙ্কনগুচ্ছ অবলম্বনে পাণ্ডুলিপিপ্রচ্ছদ করেছেন লৌকিক। ‘হাফ চক্লেট’ তথা ‘জাঙ্গাল’ পেতে চাইলে, কাছের বইদোকানির উঁচা উঁচা তাকিয়ায় না-পেলে, এর সম্পাদক-প্রকাশক বরাবরে যোগাযোগ করা যেতে পারে। সংযোগতথ্য : পৌরবিপণী (দ্বিতীয় তলা) সুনামগঞ্জ; shamsshamim1@gmail.com; +৮৮ ০১৭১২ ৩২৯ ৯৯৭; মূল্য ধরা আছে : দেশের ভেতরে ৬০ টাকা, বাইরে ৩ পাউন্ড।