পুরনো পথের নির্মম অভিমানে অধিক আক্রান্ত কবি! আমেনা তাওসিরাত
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ৮:২৬ অপরাহ্ণ, | ২৭৩৩ বার পঠিত
লেখক, সাংবাদিক এবং শহুরে বাউল হিশেবে খ্যাত সেজুল হোসেন এর চতুর্থ এবং মূলত কথন প্রধান বই ‘ও জীবন ও মায়া’, চৈতন্য প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে এছরের অমর একুশে বই মেলায়। শঙ্খ ঘোষের প্ররোচনাই হোক বা জীবনের বিবিধ উৎসবের উস্কানিতেই হোক, সেজুল আয়ু লিখতে চান। আর আয়ু লিখতে লিখতে তিনি যেন শব্দ মত্ত এক ঘোরের ফেরি করে যান। তাঁর সেই ছবিময় জীবনের সংক্ষিপ্ত আত্মপ্রকাশ এই বইটি। এখানে চলন্ত বাস-ট্রেনে পাওয়া দৃশ্যও যেভাবে জায়গা নিয়েছে, বিভাবিত নাগরিক বেদনা আর মথিত নদী জীবনও সেভাবেই এসছে। আর এই সব ছবিময় গল্পের ভিতরে, না ঠিক পরিপূর্ণ গল্প নয়, গল্পের ইঙ্গিতের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি সেজুলও এসছেন।
‘গানে, কবিতায়, প্রেমে, কামে, হাতে রাখা হাতে, গভীর চুম্বনে আমি তো আয়ুই রচনা করতে চাই। নিঃশব্দের শব্দ দিয়ে রচনা করতে চাই অলৌকিক কোন কোলাহল। একান্ত রাজ-উৎসব।’ — এ কবির নিজস্ব স্বীকারোক্তি।
নাগরিকতার রিহার্সেলে, বস্তুর আর ব্যক্তির মধ্যকার যে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট তার কথা বলতে বলতেই সেজুল তাঁর বই শেষ করে দেন। আর বলে যান— ‘আমি পেয়ে যাব আবারও বাঁশি, আবারও নদী, কোন মুদ্রায় না বিকনো, আমার রাখাল জীবন।’
চারটি পৃথক পাঠে তিনি বইটিকে সাজিয়েছেন। যার প্রথমটি হচ্ছে,‘হাসিতে ধরা পড়ে না সুখের আপাদমস্তক’। সেজুল মূলত একটি বাঁশি আর তার সুরের বিদীর্ণতাকে শব্দে অনুবাদ করতে গিয়ে যে লেখকসত্তার টানা-পোড়েন এ পুড়েন তারই পোস্ট অপারেটিভ যন্ত্রণা এই অধ্যায়ের বিষয়বস্তু। শঙ্খ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ফরাসি কবি পল ভালেরিও তাঁকে জীবনভিত্তিক দর্শন শিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। আবার কখনো তিনি ম্যাজিক রিয়েলিজমের স্রষ্টা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মত সংকট তাড়িত সময়ের একাকী হাঁসফাঁস হয়ে ওঠেন। তিনি সাহিত্যের ব্যাপ্তিকে, ভিন্নতার চর্চাকে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা করেন আর সেখানে নিজেকে তুচ্ছ ভাবেন। এখানেই তিনি আলাদা, তাঁর শব্দের প্রগলভতাকে তিনি চর্চিত ভুল অভিজ্ঞান ছাড়া আর কিছুই ভাবেন না। আর এভাবেই, সামান্য পিঁপড়া, বিষণ্ণ মৃত্যু পৃষ্ঠা, শহরের বাড়ন্ত বাস্তবতাকে পাঠ করতে করতে সেজুল, শক্তির চট্টোপাধ্যায় এর কবিতায় গিয়ে ধার করেন দুটো হাহাকার। কারণ— তাঁর বালক বয়স হারিয়ে গ্যাছে, নদীর তীব্র ডুবে সবটা স্মৃতি নিয়ে। কারণ মাতৃগর্ভ তাঁকে ফেরত নেবে না আর কোনকালে। তাই তাঁর আপাদমস্তক লোকজ সত্তায় বাউল গানের ক্ষুরধার বিলাপ,
‘আমার নাও যে গাঙে ডোবে না, ও মাঝি খবরদার’ —
শহরের দম্ভকে যেন এক ঝটকায় থামিয়ে দিতে চান তিনি। পশ্চিমা বিশ্বের দ্রুত বৃদ্ধি বিড়ম্বনার ঠিক পাশে সেজুলের ভাঙা নাও— ভীষণ বিপরীতধর্মী এই টেনশনটা নিতে পাঠকের দারুণ লাগবে। কিংবা অসুখকালীন সাইকোলজিটা কীভাবে যেন তাসের ছবির মত পাল্টে গিয়ে সাইকোলজিকে অসুখ দিয়ে দিলো । এভাবে সেজুল লিখার ক্যারেক্টারকে দক্ষভাবে বদলে দিতে পারেন। ‘ভাবনাটা থিতু হয় কাওরান বাজারে, ফুটপাথে, আইল্যান্ডে। যেখানে অলিখিত গোল বেত ঝুড়িকে বিছানা বানিয়ে, শরীরকে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করে, সেই টুকরি বাড়িতে যারা ঘুমায়, তাদের ঘুমে কি স্বপ্নেরা আসে?’ —এই বিহ্বলতা পাঠকের জিজ্ঞাসা হতে বাধ্য।
আবার লেখক আচমকা প্রেমিক হয়ে যান। আর তখনই সেজুলের জার্নাল ঘুরে যায়। পাঠককে কৌতূহলী করে তিনি ঘোষণা করে বসেন তাঁর ভালোবাসা। তবে তাঁর শব্দের রহস্যময়তা আসলে কোন বাস্তব চরিত্রের সাথে হৃদঘটিত যোগাযোগের ধারণা দিচ্ছে না কী, অবাস্তব কোন আচ্ছন্নতার কথা বোঝাচ্ছে, তা ব্যক্তি সেজুলই জানেন। কারণ তাঁর পূর্ববর্তী লিখাগুলোতেও তিনি বিবিধ বর্ণনায় প্রেম চেয়েছেন। বিনয়ের চাকার সন্ধান করেছেন। আর চকিতে দেখা দৃশ্যের ভেতরের আনুপাতিক চলচ্চিত্র দেখতে সেজুল কত দক্ষ তা তাঁর পাঠক ভক্ত মাত্র জানেন। সেজুল ‘সেই একজন’ এর ভাবনার গিঁট খুলতে গিয়ে আবার লিখতে না পারার নিদারুণ অভাবে বসেন। ‘বাড়ির ছাদে হাল্কা বাতাসে স্কুল বালিকার ফ্রক উড়ছে। দেখি বালিকার মা তার ভেজা শাড়ি রোদে দিয়ে খুব অহংকারী পায়ে ছাদ থেকে নেমে জাচ্ছে। এই সব রোদ, বাতাস, ফ্রক, আর ভেজা শাড়ির গল্পও লিখতে ইচ্ছে করে। পারি না।…’
এরকম আরও স্মৃতিকথা বা ব্যথা থেকে না লিখে লিখেও সেজুল সবই লিখে যাচ্ছেন।
‘তবে একদিন আমি ঠিক ঠিক লিখে দেবো স্মৃতির গাঙচিল, অভিমানী দূরের নদী, নৌকাতে রাত, ডুবে যাওয়া গান, উড়ে যাওয়া ঘুড়ি, বাঁশি আর বুকে ভাঙচুর… বলে দেবো দ্যাখো শৈশব, আমি এখনও মাটির ছেলে, সুদিন আনতে গিয়ে কবিতা ভুলিনি।’
প্রেমকে আবিষ্কার করার সহজাত জিজ্ঞাশা থেকে তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় অংশের জন্ম। এখানে পথে দেখা টুকরো মুহূর্ত, ফেলে আসা নিজস্ব যাতনা আর কবি ধর্মের অযুত দর্শনে তিনি প্রেমকে বিভাজিত করেছেন। ‘ঘর পালানো মেয়েগুলোর জন্য খুব মায়া হয়। কী এক অর্বাচীন ঘোরের প্যাঁচে পড়ে এরা ঘর ছাড়া হয়। এই ঘোরের নাম বুঝি প্রেম?’ এই অংশে সেজুল শব্দ বা ঘটনার যে মনস্তাত্ত্বিক ধাঁধা নির্মাণ করেছেন তাতে, ধারাবাহিক জীবনী লিখা লেখকের বাইরেও যে তাঁর কলম কতটা ক্ল্যাসিকেল ইলুশন সৃষ্টি করতে পারে তার একটা উপযুক্ত উদাহরণ। এটা পাঠক নিজে থেকে পড়ে দেখবেন তাই কোন লাইন উদ্ধৃত করছি না এখানে। তবে সেজুল তাঁর প্রেমিক সত্তাকে কিছুটা অস্পষ্ট করে রেখেছেন, এ তাঁর ব্যর্থতা না কী ঐচ্ছিক অবস্থান? প্রেম তাঁর কল্পনা এবং বাস্তবে প্রাপ্ত ঘটনার সম্মিলিত গল্প সংগ্রহ। পুরনো সম্পর্কের যোগাযোগ বহুল পথ আর অভ্যস্থতার আমূল পরিবর্তিত দৃশ্যে পাওয়া প্রেমঘটিত ব্যথায় তিনি এখনও কাতর। তাই পরবর্তী লাইনগুলোতে তিনি দ্বিধায় ফেলে দেন। কারণ তাঁর স্বপ্নের ডাকপিয়ন আর তাঁর স্বপ্নের বাহুল্যতায় কবি অধিক আমোদিত না কী পুরনো পথের নির্মম অভিমানে অধিক আক্রান্ত? পাঠক তা ভাবতে বসবেন। ‘আবিষ্কারের শেষ বিন্দু তুমি…’ —
এভাবেই কবির হাহাকার আবারও শব্দবর্তী হতে চায়। প্রেম আর প্রেমিকাকে নিয়ে তাঁর যে মুখরতা তা তিনি শব্দে লিখে দিতে চান। আর পাওয়া না পাওয়ার এই মিশ্র দিনগুলোর শেষে তিনি তাঁর গেরস্থালি ঘুম নিয়ে তাঁর কাছেই ফিরতে চান। এ শুধু দরজায় দাঁড়ানো কোন মানবীর দিকে সেজুলের স্বস্তিকর যাত্রা নয়, হতে পারে এটা সংকট বহুল আহত জীবনের পরে খোঁজা প্রত্যেকটা মানুষের আকীর্ণ আশ্রয়। ছোট দুটি অধ্যায়ের একটি হচ্ছে, কবির ভাত প্রিয়তার ব্যাখ্যা যাকে আমাদের আদি বাঙালিসত্তার আয়না কথাও বলতে পারি। কবি মুহম্মদ ইমদাদের একটি অমোঘ ঘটনার ভবিষ্যৎ ছবিতে শুধু লজ্জা নয়, মৃত্যুবোধও ওঠে আসে। আর কবিতার এই অংশ নিয়ে লিখতে বসে সেজুল তাঁর গ্রাম্য কথন, জন্মক্ষণ, সংখ্যার গরমিলে পাওয়া জীবনকে সাজিয়ে তোলেন। আর যে জীবন সেজুল হোসেনকে প্রতিনিধিত্ব করছে, তা তো অন্য কাউকে বা অসংখ্য সম্ভাবনাকে ও প্রতিনিধিত্ব করতে পারতো। তাঁর এই বর্ণনাগুলো অসাধারণ। ‘বৃষ্টিমুখর সেই দিনে আমি না এলেও বাৎসরিক ফসল হিশেবে আমার জায়গায় অন্য কেউ আসতো।’ আবেগ, গ্রাম, ছোট সেজুলের ছুট ছুট বাচ্চা রসায়নে সমৃদ্ধ এই অংশগুলো বৃষ্টির মত পড়া যায়। ‘কৈশোরে গ্রামের মাঠে শতাধিক গরুর রাখাল ছিলাম আমিও। এক হাতে থাকতো ঘুড়ি আর অন্য হাতে লাঠি। পকেটে বাঁশিও থাকতো।বাজাতে জানতাম না, তবুও বাঁশি ছিল। এখন যেমন মনের মধ্যে একটা বাঁশি আছে।’ সেজুল স্মৃতি বলতে বলতে জায়গা বা সময় হারিয়ে ফেলেন। শৈশবে দেখা জুয়াড়িদের মত এখানে নগরেও মানুষগুলো স্বপ্ন নিয়ে বাজির খেলায় বসে। নানা পথে, নানা উপলক্ষে এরা কবির মুখোমুখি হয় আর ভাবনা তাড়িত শব্দ দিয়ে যায়। ‘সবাই হারে, সবাই জিতে। প্রকৃত প্রস্তাবে কেউ ঠকে না। প্রকৃত প্রস্তাবে কেউ হারেও না।’
আবারও গ্রামবাসী হতে চাওয়া, নায়ে বসে ভাত খাওয়া আর ভীষণ আকুলতায়, সব আর্তনাদের পরে তাঁর প্রিয় মা’কে কাছে চাওয়ার গল্পেরা এখানে জড়ো হয়েছে। শেষ অংশে সেজুল লিখেছেন মানুষের মুখোশধারী জীবনের ভুল বিজ্ঞাপনের কথা। এখানে মাসুদ খান তাঁর প্রারম্ভিক প্রেরণা। স্বর্ণজ্বরে ভোগা রোগামতো একটি মানুষ হয়ে নানাবিধ জটিল হিশেব নিয়ে বিভ্রান্ত সময় এখানে ওঠে এসছে। প্রকাশিত অভিব্যক্তি আর আচরণের পেছনে থাকা গোপন পৃষ্ঠা, অযাচিত কষ্ট, কিছু ব্যর্থতার কথা সেজুল এখানে বলছেন। ‘পকেট থেকে মানিব্যাগ খুলে রাখার সময় ইচ্ছেটাকেও খুলে রাখি টেবিলে।’
নাগরিকতার রিহার্সেলে, বস্তুর আর ব্যক্তির মধ্যকার যে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট তার কথা বলতে বলতেই সেজুল তাঁর বই শেষ করে দেন। আর বলে যান— ‘আমি পেয়ে যাব আবারও বাঁশি, আবারও নদী, কোন মুদ্রায় না বিকনো, আমার রাখাল জীবন।’
সেজুল হোসেন এক আবিষ্ট ডায়েরি লিখেছেন সন্দেহ নেই কিন্তু এটি হতে পারতো একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা, গল্পের স্বরুপ বা বক্তব্যধর্মী উপন্যাস। তিনি আরও বৃহৎ আকারেও লিখতে পারতেন যা বিক্ষিপ্ত ঘটনা বা ভাবনাগুলোকে আরও সুনির্দিষ্ট করতে পারতো।
আগামীতে আরও ব্যাপক পরিসরে তাঁর লিখা পড়তে চাই, যেখানে সামাজিক জরা বা ব্যাধিগ্রস্থ চরিত্রগুলো উঠে আসবে ভুল কাঠামোগত জীবনের বিরুদ্ধে কথা বলতে। তবে এক জীবনের মায়ায় ছড়িয়ে থাকা দৃশ্যগুলোকে, তিনি যেভাবে কবিতার সূত্র ধরে, গল্প বলার নিজস্ব ভঙ্গিতে এক্সপোজ করেছেন তার জন্যে এই জার্নালটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে নিঃসন্দেহে। আর নামের যথার্থতাও ছিল পুরো বইয়ে। সর্বোপরি কবিকে অনেক অভিনন্দন এবং সাথে ‘ও জীবন ও মায়া’ কেও।