শহীদুল জহির পাঠ: জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা । ফাহিমা আল ফারাবী
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ৩:১৭ অপরাহ্ণ, | ২৮০৮ বার পঠিত
শহীদুল জহির—বাংলা সাহিত্যের এই জাদুকরের নাম আমার কাছে নবতম প্রেমের সমার্থক হয়ে ওঠে যেদিন ই-বই এ, কম্পিউটারের পর্দায় ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র প্রথম বাক্যটি দৃষ্টিগোচর হয়—‘উনিশ শ পঁচাশি সনে একদিন লক্ষ্মীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যাণ্ডেল পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিঁড়ে যায়’। এই লাইনটির মধ্যে প্রথমেই যা নজরে পড়ে, বা বলা যায় এক ধাক্কায় যে ভঙ্গিমাটি এটি তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়, তা একটি নির্দিষ্ট গদ্যরীতি, যার সাথে প্রবন্ধের বাক্যগঠনের আমরা একটি সম্পৃক্ততা দেখতে পাই। মনে হয় লেখক যেন এই জগতের, যে জগতটি তিনি বুনে চলেছেন, তার দূরতর কোন দ্রষ্টা, যেন অন্য কোথাও পড়া কিছু গল্পের আখ্যান তিনি লিখে চলেন, যে গল্পগুলো সম্পর্কে তার নিজস্ব বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। কেন আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায় তার সন্ধান করতে উৎসুক পাঠক এগোলে জানতে পায়, ‘আসলে বস্তুর প্রাণতত্ত্ব যদি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে হয়তো বলা যেত যে, তার ডান পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতে বস্তুর ব্যর্থতার জন্য নয়, বরং প্রাণের অন্তর্গত সেই কারণে ছিন্ন হয়, যে কারণে এর একটু পর আবদুল মজিদের অস্তিত্ব পুনর্বার ভেঙে পড়তে চায়’। দ্বিতীয় লাইনে এসে শহীদুলের বিজ্ঞানমনস্কতার সাথে আমরা পরিচিত হই, যেখানে তিনি মানুষের মানসিক বাস্তবতার সাথে বস্তুজগতের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে নিজের আস্থায় আলোকপাত করেন।
‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ শহীদুল জহিরের প্রথম উপন্যাস, দ্বিতীয় প্রকাশিত গ্রন্থ। এটি লিখবার আগে লেখক প্রথম জাদুবাস্তবতার ঘরানার সাথে পরিচিত হন, তার ভাষ্যমতে তার প্রথম পড়া ম্যাজিক রিয়েলিজম ভিত্তিক উপন্যাস ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ এর পাঠের মাধ্যমে। শহীদুল জহিরকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের জাদুবাস্তবতার পুরোধার, যদিও তিনি নিজে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর লেখায় এর আলামত আগে দেখতে পান বলে ব্যক্ত করেন। প্রথম উপন্যাসেই তিনি এই গল্পশৈলি এমন সাফল্যের সাথে প্রয়োগ করেন যে আমরা রয়ে যাই হতবিহ্বল। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে সাহিত্যচর্চা করে আসা শহীদুল জহিরের পক্ষে হয়ত এ অতিবাস্তব কিছু মোটেই না।
আমাদের দেশের রাজনীতিকদের ধারণা ছিল, এবং এখনো আছে— ‘রাজনীতিতে চিরদিনের বন্ধু অথবা চিরদিনের শত্রু বলে কিছু নেই। কাজেই অতীত ভুলে যাওয়া ছাড়া কি-ই বা করার থাকে মানুষের’…
শহীদুলের প্রথম বই, একটি ছোটগল্পের সংকলন ‘পারাপার’ এর সাথে যদি আমরা পরিচিত থাকি তবে বুঝতে পারা যায় এই ‘লম্ফের’ দূরত্ব। ‘পারাপার’, লেখকের নিজের বয়ানেই একটি নির্দিষ্ট ভাবাদর্শের চেতনা-প্রসূত গ্রন্থ। মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে অল্প-বিস্তর হাতেখড়ি হওয়া শহীদুল তখনো বিশ্বাস করতেন মানুষের ও জীবনের জয়ে, গল্পশৈলীতেও তাই তখন রয়ে যায় যথোপযুক্ত বাস্তবতার প্রভাব, চরিত্রগুলো বেশিরভাগ হয় নিম্ন-বিত্ত খেটে-খাওয়া শ্রেণীভুক্ত মানুষেরা। ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’য়, যা কি না ১৯৭১/ ১৯৮৫ সনের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লিখিত, এই পরিচিত চিন্তাধারা থেকে শহীদুল সরে আসেন। ক্ষণজন্মা এই লেখকের হাতে রচিত হয় ‘পরাজয়ের’ এমন এক আখ্যান যার জন্ম একমাত্র বাংলাদেশ নামের এই ভূখন্ডেই সম্ভব হয়।
গল্পটা আবদুল মজিদ ও বদরুদ্দিন মওলানাদের। গল্পটা এক ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’র যার সমাপ্তি ঘটে গল্পের গন্ডিতে করুণ পরিণতির ভেতর। ১৯৮৫ এর লক্ষ্মীবাজারের পটভূমিতে এই কাহিনীর শুরু যখন বদরুদ্দিন মওলানার ছেলে, রাজাকার-পুত্র, আবুল খায়েরের উচ্চকিত কন্ঠ লাউডস্পিকারে ধ্বনিত হলে আবদুল মজিদের স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়, যা তার হৃদয়ের তন্তু বিচ্ছিন্ন হবারই সমার্থক। পৃষ্ঠা না উল্টাতেই আমরা প্রবিষ্ট হই ১৯৭১ সালের লক্ষ্মীবাজারে, যখন বদরুদ্দিন মওলানারা আনন্দের সহিত কাটা মাংসের টুকরা আকাশে ছিটিয়ে কাকদের সাদরে আমন্ত্রণ জানাত, যে কাকেরা এখন তার পুত্রের আলখাল্লা থেকে দলে দলে বের হয় বলে মজিদের কাছে প্রতিভাত হয়।
বদরুদ্দিন মওলানাদের নৃশংসতার কাহিনী আমরা জানি নানাভাবেই, কিন্তু শহীদুল জহির ভাষা ও শৈলীর অভিনব প্রয়োগে যে বাস্তবতা রচনা করেন তা যে কোন জাদুবাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যায়, নাটকীয় হয়েও এড়িয়ে যায় অতি-নাটকিয়তা অদ্ভুত কৌশলে। অবশ্য ’৭১ এর প্রেক্ষাপটে রচিত কোন গল্পই যথেষ্ট নাটকীয় হতে পারে না। যে পুনর্কথনের মাধ্যমে শহীদুল দুই সময়ের (মোটা দাগে) এবং বিভিন্ন ঘটনাগুলোর মধ্যকার সময়কালের সম্পর্ক ও পারস্পরিক ব্যঞ্জনা দক্ষতার সাথে রক্ষা করেন, তা কথন-শৈলী হিসেবে বোধ করি একান্তই তার নিজস্ব। এই শৈলীতে সাযুজ্য রক্ষা করতে অনিবার্যভাবে কিছু রেফারেন্স পয়েন্টের প্রয়োজন হয়— আবদুল মজিদের জুতা ছেঁড়া, তার বোন মোমেনার পরিণতি, বদু মওলানা ও পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের সম্পর্ক, আজিজ পাঠান— এরকমই কয়েকটি ঘটনা/চরিত্র যেগুলো গল্প বলায় ক্রমে ঘুরে ঘুরে আসে এবং ধীরে ধীরে একটি নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়, যার আভাস আমরা উপন্যাসের শুরু থেকেই পেয়ে আসি।
শহীদুল জহিরের লেখনীর যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য তা হল গল্পকথনের এক সম্পূর্ণ নতুন ভঙ্গিমা, যাকে আমরা বর্ণনা করতে পারি এক ‘যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি’ হিসেবে। কথনশৈলীর এই রূপে মহল্লার মানুষ, গ্রামের লোকেরা সমষ্টিগতভাবে হয়ে ওঠে মূল/গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তাদের মুখ থেকে খসে পড়া কান-কথা/গুজবকে লেখক সাগ্রহে গ্রহণ করেন, এবং তাদের যুগপৎ বয়ানে সত্য ও মিথ্যার ভেদাভেদগুলো ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আলোচ্য উপন্যাসে মহল্লার লোকেরা শুধু এককভাবে মতামত পোষণ ও ব্যক্তই করে না, তাদের ক্রিয়াকর্মও হয়ে ওঠে অভিন্ন। পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে নিহত ব্যক্তিদের তারা একসাথে দাফন করে, একসাথে গোপনে শোক-পালন করে। তারাই একসাথে যুদ্ধ শেষে কবরস্থান থেকে ছিন্ন মস্তকসমূহ উদ্ধার করে এবং তারাই ত একত্রে প্রিয় স্ত্রী-কন্যাদের মুরগীর মত উর্ধ্বশ্বাস ছোটাছুটি দেখে ‘বলাৎকারের’ অর্থ অনুধাবন করে। তারা একত্রে আজিজ পাঠানের যুদ্ধে গমন, বাড়িতে লুটপাট, ও তার ফিরে আসা অবলোকন করে। তারাই স্বাধীনতার দু’ বছরের মধ্যে বদু মওলানাদের ফিরে আসার সাক্ষী থাকে এবং তাদের কেউ কেউ, আবদুল মজিদ সহ, একদিন কাকদের মানুষের মাংস খিলানো বদু মওলানাকে লাউডস্পিকারে ভাষণরত অবস্থায় দেখার সৌভাগ্যও অর্জন করে!
হ্যাঁ, বদু মওলানারা মরল না। কারণ, শহীদুলের ভাষ্যমতে একাত্তরের পর স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বিভিন্নভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলেও ‘সত্যিকার অর্থে ছত্রভঙ্গ হল না তারা যারা যুদ্ধের বিরোধিতা করল’। কারণ আমাদের দেশের রাজনীতিকদের ধারণা ছিল, এবং এখনো আছে— ‘রাজনীতিতে চিরদিনের বন্ধু অথবা চিরদিনের শত্রু বলে কিছু নেই। কাজেই অতীত ভুলে যাওয়া ছাড়া কি-ই বা করার থাকে মানুষের’। এই বইটি যে সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা তখন স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, এর বিভিন্ন প্রবাহের সাথে তখন এসে মিশেছিল তারাও যারা এই দেশটারই অস্তিত্বের বিরোধিতা করেছিল। পুনর্বাসিত এই সব প্রেতদের দেখে ঘৃণায় কুকড়ে উঠেছিল আবদুল মজিদের মত যুদ্ধ-পর্যুদস্ত মানুষেরা, এবং এই ঘৃণাই হয়ে উঠেছিল তাদের কাল।
মুক্তিযুদ্ধ শহীদুল জহিরের লেখায় বারং বার ফিরে আসে। কখনো সশরীরে যুদ্ধে না যাওয়া শহীদুল কি চাপা অপরাধবোধে ভুগতেন? যদিও তিনি সে সম্ভাবনা প্রকাশ্যেই নাকচ করে দেন, আমরা দেখি মুক্তিযুদ্ধ বার-বার আসে জ্বলন্ত ভাবে, আর জিঞ্জিরায় লেখকের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতাও একাধিক বার আমরা তার লেখায় উঠে আসতে দেখি। আজ অকাল-প্রয়াত এই লেখক বেঁচে থাকলে রাজাকারদের ফাঁসি দেখে নিশ্চিত খুশি হতেন একাধারে। প্রশ্ন জাগে, অন্যদিকে অভিজিৎ রায়-অনন্ত বিজয় দাশের মতন তরুণ প্রাণদের একই আততায়ীদের হাতে ঝরে যেতে দেখলে তিনি কি বলতেন? হয়ত তখন তার হাত দিয়ে বেরিয়ে আসত আর কোন অজর আখ্যান, যার শেষ আপাতদৃষ্টে গোচর হয় না।