ফের্নান্দ পেসোয়ার কবিতা । আবু তাহের তারেক
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১:৪২ অপরাহ্ণ, | ২৮৫৫ বার পঠিত
পেসোয়ার নাম প্রথম শুনি এক আন্টিক শপের বৃদ্ধ মহিলার কাছে। পরের দিনই বুকশপে যাই। আর আমার নজরে পইড়া যায় সেই অবধারিত লাইন: শূন্যে অবশিষ্ট থাকে শূন্য। আমরা কিছুই না।
এই লাইন পইড়া, আমি ধন্ধে পইড়া গেলাম। আর মনে হইল, এই কবিতা বাংলায় অনুবাদ কইরা পড়লে কেমন হয়। কইরা ও ফেললাম। এই কবিতা, উনার আরো লিখা পড়তে উত্সাহিত করলো। দেখলাম, ভালো লাগে। এগুলোকে বাংলায় পড়তে ইচ্ছে হইল। কয়েকটা অনুবাদ করলাম। তখন মনে হইলো, আরো কিছু করলে তো বইও করা যায়। মালেক ভাইয়ের সাথে শেয়ার করলাম বিষয়টা। তো, উনি বললেন, আমার বই বের করবেন। এই শুরু।
আমি ভাবিনি পর্তুগিজ থিকা অনুবাদ করার কথা। পর্তুগালে তিন বছর ধরে আছি হিসেবে টুকটাক জানি পর্তুগিজ। কিন্তু পেসোয়া নিজে আমারে উত্সাহ দিছেন। উনার কবিতার মাধ্যমে। এত অর্গানিক তাঁর কবিতা। অপ্রয়োজনীয় শব্দ থাকেই না। কাটা তরমুজের মতো, টকটকে লাল দেহ খানি থাকে কেবল। আর, তার কবিতা ফরফরাইয়া চলে। ভাষার লালিত্য/গাম্ভীর্য কম। এক চলমান মুগ্ধতা টেনে নেয় শেষ পর্যন্ত। অন্যদিকে, আমার হাতে ছিল রিচার্ড জেনিথের দ্বিভাষী পর্তুগিজ-ইংলিশ সংস্করণ। ফলে ইংলিশের সাথে মিলাইতে পারছি আমি। এ জন্য আমার এই অনুবাদ পর্তুগিজ থিকাও যেমন, ইংলিশ থিকাও তেমন। তবে শুধু ইংলিশ থিকা করলে, অনুবাদগুলো হয়তো অন্যরকমই হইত। কারণ কুমার চক্রবর্তীও এবার পেসোয়া অনুবাদ করছেন। ইংলিশ থিকা। আমি তার অনুবাদের পাশে আমার কয়েকটা অনুবাদ রেখে, এমন অনুমান করলাম।
সে যাক, ফের্নান্দ পেসোয়া(১৩জুন ১৮৮০-৩০নভেম্বর ১৯৩৫) বিংশ শতাব্দীর কবি। পর্তুগালে ব্যাপক পঠিত। এমনকি ইউরোপেও। অন্যসব ইউরোপীয় আধুনিক কবির মত প্রতীকবাদ, সুররিয়ালিসম সহ বিভিন্ন ইজমের প্রভাব তাঁর কবিতায়ও আছে। তাঁর প্রাতিস্বিকতা কবিতার স্বচ্ছন্দতায়। সাহিত্যের প্রচলিত ইসথেটিকসরে তিনি থোড়াই কেয়ার করছেন।
অল্প বয়সে দক্ষিন আফ্রিকায় যাওয়া, বাবা ও ভাইয়ের মৃত্যু—এসবের প্রভাব আছে তাঁর ব্যক্তিজীবনে। লেখায়। দেশত্যাগ তাঁর ভেতরে তৈরী করছে বোহেমিয়ানা। শেকড়চ্যুতি তাঁর দেখার চোখরে পাল্টাইয়া দিছে। তাঁর একটি কবিতা: সফর। দেশের পর দেশ হারানো হামেশা অন্য কেউ শেকড়হীন আত্মা নিয়ে কেবল দেখতে দেখতে বাঁচা…
তো, জীবনের অন্য অনেক ঘটনার সাথে, এইসব পাঠ, অভিজ্ঞতা তাঁর মধ্যে একধরনের প্লুরালিজম তৈরী করছে। এগুলোর চর্চাও তিনি করছেন, কবিতায়: আমাদের মধ্যে বসত করে অগনিত প্রাণ যখন ভাবি বা অনুভব করি জানিনা কে ভাবে আর অনুভব করে…
পেসোয়া’র মরমিপনাও দেখার মতো: মৃত্যু হইল রাস্তায় বাঁক মরা কেবল অদৃশ্য হওয়া… কেউ কাউকে হারায়নি কখনো সকলই সত্য আর রাস্তা… এ সবের শেষে, অনুবাদ গুলি আমারই কবিতা আসলে। পেসোয়াকে পাওয়া না পাওয়ার ঊর্ধে রাইখা, কবিতা গুলো যদি পড়তে ভাল্লাগে আপনার, যদি টানে—তখন হয়ত অনুবাদ নিয়া, পেসোয়া নিয়া; আমরা বিস্তর ভাবতে পারবো।
পর্তুগালে, শব্দের শেষে ও থাকলে, এরে উ-কার আর ও-কার এর দরমিয়ানে উচ্চারণ করা হয়। তাই আমি ফের্নান্দু বা ফের্নান্দো না লিখে, ফের্নান্দ লিখা প্রিফার করছি।
অনুবাদ করতে আমাকে উত্সাহিত করছেন আহমদ জুনায়েদ । মুহম্মদ ইমদাদ। এমদাদ রহমান। আলফ্রেড আমেন। সুহেল আহমদ। কৃতজ্ঞতা জফির সেতু, মোস্তাক আহমাদ দীন ও আবিদ ফয়সালকে।
পর্তুগালে, কাউনসিলর ও রাষ্ট্রীয় ট্রান্সলেইটর রানা তসলিম উদ্দিন ভাই ও এখানকার বাংলাদেশ এম্বাসির প্রতি কৃতজ্ঞতা। নাগরী প্রকাশের মালেক ভাই আর সুফী সুফিয়ান আমার বন্ধু, স্বজন। তাদেরকে কষ্ট দেওয়ার হক আমার আছে। নাগরী প্রকাশের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ুক।
ভূমিকা ও অনুবাদ : আবু তাহের তারেক
লিসবুয়া, পর্তুগালকারেকশন: পর্তুগালে, শব্দের শেষে ‘o’ থাকলে,
‘ও’নয়। ‘o’ হবে। থ্যান্কস ।
দ্যুতিময় বিড়াল: ভেতরের এই রাত্রি কখন দূর হবে, মহাবিশ্ব
আমি, আমার আত্মা, আমার আসবে দিন
কখন জাগব আমি, এই জেগে থাকা থেকে
জানিনা। ওই উঁচুতে কিরণ দেয় সূর্য
উদাস তারা মিটমিট করে
বেশুমার তারা
হৃদয় স্পন্দিত হয় একান্তে
যায় না শোনা
কবে অবসান হবে থিয়েটারহীন এই নাটকের
নাটকবিহীন থিয়েটার
যেতে পারব ঘরে
কোথায়। কখন। কিভাবে
চেতনার চোখ নিয়ে তাকাইতেছে বিড়াল। গভীরে উঁকি দেয় কে
সে। সে
যীহোশূয়’র মতো সূর্যকে থামতে বলবে সে। আর জাগব আমি
তারপর হবে দিন
স্মিতহাস, নিদ্রিত আত্মা আমার
মৃদুহাসো। ভোর হবে
গান
দিগন্তের বাঁক তোমাকে অতিক্রম করে
তোমার দৃষ্টিকে, স্বত্তা বা প্রাণকে নয়
জীবন থেকে আত্মা উইড়া গেলে
তোমরা মৃত বইলো না তারে। বইলো :
হারিয়ে গেছে দূর সমুদ্রে
সমুদ্র, সমস্ত প্রাণের প্রতীক
অনড়, অনিশ্চিত, দৃষ্টির অতল
মৃত্যুর সফর আর পৃথিবীর ঘূর্ণন শেষে
আবার ফিরে আসবে আত্মা আর নাও
আত্মমনঃজীবনী
কবি হইলো অনুকারক
সে তার ব্যাথারেও নকল করে
সত্যিকারের ব্যথা
তার পাঠক
বেদনার কথা পইড়া আনন্দ পায়
এই দুই বেদনার বাইরে
পায় অন্য কোনো বিষাদ
এভাবেই, ঘুরে ঘুরে
বোধিতে ধুকে পড়ে
এমন ট্রেইনের লাইন
যার নাম হৃদয়
পোর্তো রীতিতে গড়া : ফের্নান্দ পেসোয়া
আমি জানতে শুরু করছি আমারে
আমি নাই
আমি যা হইতে চাই আর লোকে আমারে যা বানাইছে
আমি তার দরমিয়ান
দরমিয়ানেরও অর্ধেক। কারণ, আছে জীবন
আমি ইহাই। শেষতক
আলো নিভিয়ে দাও। দরোজা বন্ধ করো
করিডোরে চটির আওয়াজ চলুক
আমারে থাকতে দাও ঘরে, শান্তিমতে
মহাবিশ্ব বড় সস্তা
নাতাল/বড়দিন
ভগবান জন্মাইলো। অন্যরা হইলো গত। সত্য
না আইলো, না গেলো। মিথ্যা বদলাইলো কেবল
এখন অন্য শাশ্বত আমাদের
ভালো ছিল আগের আমল
অন্ধ বিজ্ঞান চষে বন্ধ্যা পৃথিবী
পাগলা বিশ্বাস তার দিবাস্বপ্নে
নয়া ভগবান একটা শব্দ কেবল—
খুঁইজো না। কইরো না বিশ্বাস। সকলই নিগূঢ়
অগ্রন্থিত কবিতা
প্রতিটি চুমুই যেন
বিদায়ের চুমু
ক্লৌ সোনা, চলো ভালোবেসে, চুমু খাই
হয়ত কাঁধে জড়ানো এ হাত
নিয়তির বারকি’রে ডাকতেছে
সে আমাদেরকে একই আঁটিতে বাইন্ধা
একীভূত করবে
জীবনের দেশহীন সার্বজনীন সমগ্রতার সঙ্গে
তামুকখানা কবিতার অংশবিশেষ
চকলেট খা মেয়ে
চকলেট খা
চকলেটের লাহান অধিবিদ্যা দুনিয়ায় নাই
কোনো দীন’ই ক্যান্ডির দোকানের লাহান তালেব দিব না তরে
খা অস্পৃশ্য মেয়ে
তর লাহান মতি নিয়া খাইতাম যদি …
আমি ভাইব্যা ভাইব্যা, তিনের তবক লইয়া
সবকিছু মাটিতে আছাড় মারি
যেমন আছাড় মারছি এই জীবন রে …
অন্তত এই তিত্তায়, আর কখনো হব না
হিজিবিজি কবিতা হইল
অসম্ভবের ভাঙ্গা দুয়ারে
অন্তত ঘিন্নাইতে পারলাম আমারে, না লেলাইয়া
হাবা ভাব লইয়া কিছুটা মহৎ হইলাম
ভাগাড়ের লিস্টি ছাড়া ময়লা ত্যানা আমি
ল্যাংটা হইয়া রই ঘরে …