গল্পটি পাণ্ডুলিপি থেকে নেয়া । আবু রাশেদ পলাশ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ৮:০২ অপরাহ্ণ, | ২০৩১ বার পঠিত
জয়তুন
সকালে ঘুম থেকে ওঠে বউকে খুঁজে পায়না মজিদ। ধলপ্রহরে ওর ঘরের দরজা খোলা দেখে বিস্মিত হয় সে। তারপরপাড়ায় খবর চাউর হলে ছেলেরা খুঁজতে বের হয় জয়তুনকে। বর্ষাকালে কালীধরা নদীর পানি থৈ থৈ করে ।চণ্ডীবর্দি গ্রামে বন্যা হয় এ সময়। জেলেপাড়ার উত্তরে দরগাতলা, তার কূলঘেঁষে প্রকাণ্ড বটগাছ। স্রোতজলের ধারা এসে গোড়ায় পাক খায় তখন। পড়ন্ত বেলায় খবর আসে।
—মজিদ ভাই হে, আহ।
অতিউৎসাহী মজিদ হন্তদন্ত হয়ে দরগাতলায় গেলে সত্য প্রকাশিত হয় । বটগাছের গোড়া থেকে একটা শাড়ির আঁচল ভাসে পানিতে ।
বুড়ো ইলিমুদ্দির মৃত্যুর পর সংসারের ভার এসে পড়ে মজিদের উপর। ঘরে তখন নিদারুণ অভাব ওদের। মৃত্যুকালে কি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে পড়েছিল বাপ, রোগ নির্ণয় করতে পারেনি পাড়ার আরজু ডাক্তারও। বাড়ীর পাশের সামান্য আবাদি জমিটুকু বিক্রি করে ইলিমুদ্দির চিকিৎসা করেছে মজিদ। সেই ইলিমুদ্দি মারা গেল অবশেষে। মানুষ মারা গেলে ভবলীলা সাঙ্গ হয়। কিন্তু ভবপারে পড়ে থাকা অন্যমানুষ গুলো? উত্তরাধিকার সূত্রে বসতভিটা ছাড়া ইলিমুদ্দির কাছে আর কিছু পায়নি মজিদ। এখন পেট বাঁচাতে পাড়ার অন্যদের সাথে দিনমজুরীর কাজ করে সে। কিন্তু তাতে ফায়দা কি? একেতো মজুরীর পরিমাণ সামান্য তার উপর কাজ থাকেনা প্রায়ই। বেকার থাকলে একরকম উপোষ দিনাতিপাত করতে হয় মজিদদের। সে সময় সস্তাদরে মোড়লের বাঁশঝাড় থেকে কিনে আনা কঞ্চি দিয়ে খাঁচা বানায় মজিদ। তাতেও সংসারের অভাব মিটেনা তার। ফলে দারিদ্র্য ওর চিরকালের ।
হাতে যখন একেবারেই কোন কাজ না থাকে মজিদ তখন বড়শিতে মাছ ধরে কালীধরা নদীতে। চণ্ডীবর্দি গ্রামে মজিদের বাড়ীটা এ নদীর কূলঘেঁষে। পার্শ্ববর্তী গোঁড়াকান্দার নওশের আলীও জালে মাছ ধরতে গেলে চোখাচোখি হয় দুজনের। নওশের বলে—
—একখান বিড়ি দিবানি মতি পানিত ফুঁক দেই?
পরমুহূর্তে কোমরে গুঁজে রাখা প্যাকেট হতে একটা বিড়ি বের করে নওশেরের হাতে দিলে আগুন ধরায় সে। খোশমেজাজি নওশের বিড়ি ফোঁকে সময় ধরে। তারপর মজিদের সাথে খোশগল্পে মাতে অনেকক্ষণ।
—আজ কামে যাওনাই মালুম অয়? মজিদ বলে—
—কাম নাইগো মিয়া ভাই। নসু মাতবর মানা করছে কাইল।
চৈত্র মাসে কাজ থাকেনা মজিদ মিয়ার। এ দৃশ্য চণ্ডীবর্দির ঘরে ঘরে। যাদের সামান্য আবাদি জমি আছে তারা বাহারি ফসল ফলায়। যাদের সে সুযোগ নেই তারা ঋণ করে কারও কাছে। এর মধ্যে একদিন অসুখে পড়ে হরবলা বিবি। মা অসুস্থ হলে মনে মনে চিন্তিত হয় মজিদ। আরজু ডাক্তার গঞ্জে নেওয়ার পরামর্শ দেয় তাকে। অর্থের বন্দোবস্ত না হলে নসু মাতব্বরের কাছে ঋণ নিতে যেতে হয় মজিদকে। এ পাড়ায় নসু মাতব্বর পুরনো গেরস্থ। হালে বলদ আর পাড়ায় আবাদি জমি দুটোই আছে তার। গরীব মানুষ বিপদে পড়লে সুদে ঋণ দেয় সে। মজিদ মিয়া তাদেরই একজন। মাতব্বর বলে—
—মজিদনি, টাহা চাও মুনে কয়?
—হ ভাই, মায়নি ব্যারামে পড়ছে কাইল।
—শোধনি দিবা হাঁচা?
—নিয্যস। টাহানি মারুম মালুম অয়?
শেষমেশ নসু মাতব্বরের কাছে দ্বিফসলী ঋণ পায় মজিদ। শর্ত অনুযায়ী আগামী বোরো মৌসুমে গতর খেটে সুদ সমেত ঋণ শোধ দিতে হবে তাকে। তারপর একদিন হরবলা বিবিকে দেখা যায় উপজেলা সদর হাসপাতালে। মায়ের চিকিৎসা করায় মজিদ। কিন্তু তাতেও সহসা রোগ ছাড়েনা হরবলা বিবির। অসুস্থতা আরও বাড়লে বিছানা নেয় সে ।
বৈশাখের গোড়ার দিকে আবার দিনমজুরীর কাজে ব্যস্ত হয় মজিদ। কালীধরা নদীর পশ্চিমে পুরনো নৌকা মেরামতের অপেক্ষায় থাকে। আসছে বর্ষাকে কেন্দ্র করে নতুন নৌকা তৈরির চিন্তা করে নসু মাতব্বর। জেলেপাড়ার নবীশেখের সহযোগিতায় মাতব্বরের নৌকা মেরামতের কাজ পায় সে। এ পাড়ায় অন্য কাজের তুলনায় নৌকা মেরামতে মজুরী বেশী, তবে পরিশ্রম করতে হয় অত্যধিক। মজিদের দুঃখ নেই তাতে। পাড়ায় যথেষ্ট সামর্থ্যবান সে। রাতে বাড়ী ফেরার পথে চণ্ডীবর্দি মসজিদের বড় হুযুরের কাছ থেকে পানিপড়া নিয়ে আসে মজিদ। তারপর বাড়ী ফিরে রোগ সারানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে সে। হরবলা বিবি বলে—
—ব্যারামনি, এইডা ছাড়বার নয়গো বাপ।
ভাদ্রমাসে বিয়ের ধূম পড়ে চণ্ডীবর্দি গ্রামে। বর্ষায় জেলে নৌকায় কাজ করে মোটা টাকার মালিক হয় অনেকেই। উড়নচণ্ডী ছেলে গুলোর মধ্যে বিয়ের বাসনা জন্মে তখন। রাতে বিছানায় শোয়ে মেয়ে মানুষের অভাববোধ করে তারা। এবার বর্ষার পুরো সময়টা নসু মাতব্বরের নৌকায় কাটিয়েছে মজিদ। সে সুবাদে যৎসামান্য টাকা এসেছে তার হাতে। এরইমধ্যে একদিন পাশের বাড়ীর হাস্না পান খেতে এসে খোশগল্প করে হরবলাবিবির সাথে।
—মজিদ ভাইনি কাঁচা টাহা পাইছে হুনি?
—হাঁচা মালুম অয়। সত্যিনি কয় পুত?
—এইবার ঘরে বউ আন চাচি।
সেদিন হাস্নার বলা কথাটা মনে ধরে হরবলা বিবির। মজিদের জন্য ঘরে বউ আনার সাধ হয় তার। বুড়ো মানুষটা অসুস্থ হলে খাওয়া দাওয়ার অসুবিধা হয় ছেলের। বউ এলে এ সমস্যার সমাধান হবে অন্তত। তাছাড়া অসুস্থ হরবলা বিবিও কথা বলার মানুষ পাবে একজন। তারপর একদিন ছেলে বাড়ী ফিরলে মনোবাসনা খোলে বলে হরবলা।
—একখান কতা কমু, গোস্যানি অয় বাপ? মজিদ বলে—
—গোস্যা কিয়ের, কও হুনি?
—একখান বিয়া কর শিগগির, বয়সনি বইয়্যা থাহে?
হরবলা বিবির বলা কথা মিছে নয়। দেখতে দেখতে যথেষ্ট বয়স হয়েছে মজিদের। সমবয়সী সবাই বিয়ে করেছে ইতোমধ্যে। এখন ঘরে বউ দরকার তারও। মজিদ বলে—
—বিয়ানি, মাইয়া দেহ তাইলে।
উত্তরপাড়ার হারু ঘটক বিয়ের কাজে পাকা লোক। মুখে আধপাকা দাঁড়ি আছে তার। হরবলা বিবি খবর দিলে একদিন মজিদের বাড়ীতে দেখা যায় তাকে। হরবলা বলে—
—পুলার বউনি খুঁজ্যা দিবা মিয়া ভাই? হারু বলে—
—দিলে ভরসা থও ভাবী, সরেস পাত্রী দিমু নিয্যস।
তারপর পাড়ায় পাড়ায় কনের সন্ধান করে হারু ঘটক। কিন্তু সহসা কনের খোঁজ মিলেনা কোথাও। পুনশ্চ, মজিদের কাছ থেকে মোটা টাকা হাতিয়ে নেয় সে। অবশেষে আশ্বিনের গোড়ার দিকে ভাল পাত্রীর সন্ধান মিলে পার্শ্ববর্তী মজুপুর গ্রামে। কনে আফাজুদ্দির মেয়ে জয়তুন। দেখতে ভাল, স্বভাব চরিত্রও। হারু বলে—
—সরেস মাইয়্যাগো ভাবী, পুলার কপাল কই।
মজুপুর গ্রামে আফাজুদ্দির বাড়ীটা শহরমুখী কাঁচা রস্তার কূলঘেঁষে। ঘরে স্ত্রী ছাড়াও দুই কন্যা আছে তার। পেশায় ফেরিওয়ালা সে। পাড়ায় বাহারি পণ্য ফেরি করে দিনাতিপাত করতে হয় তাকে। ফলে সংসারে অভাব মেটানোর সামর্থ্যের অভাব তার। এ অবস্থায় জয়তুনের বিয়ে ঠিক হলে চিন্তিত হয় সে। পাত্রপক্ষের দাবিও যৎসামান্য নয়। হারু বলে—
—পুলা সরেসগো মিয়া ভাই, দিলে ভরসা লও।
অবশেষে নিজের নামের বসতভিটার কাছের সামান্য জমিটুকুই বেচে দেয় আফাজুদ্দিন। তারপর একদিন নিয়ম মেনে বিয়ে হয়ে যায় মজিদ আর জয়তুনের। নতুন সংসারে কদিন আত্মীয়ের আনাগোনা থাকে খুব। অতিউৎসাহীরা বউ দেখতে এসে ধন্য ধন্য করে। তারপর ওরাও বিদায় নিলে সংসারধর্মে ব্রতী হয় দুজনই। আফাজুদ্দির কাছ থেকে পাওয়া মোটা টাকায় বাড়ীতে টিনের দুচালা ঘর তুলে মজিদ। বাকি টাকায় একটা নতুন রিকশা কিনে সে। ঘরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খরচ বৃদ্ধি পায়। পাড়ায় দিন মজুরীর কাজ করে দুবেলা অন্ন জোগাড় করার সামর্থ্য নেই মজিদের। সেক্ষেত্রে প্রায়ই বেকার থাকতে হয় তাকে। অথচ নিজের একটা রিকশা থাকলে সে সম্ভাবনা নেই তার। তাছাড়া স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারবে সে। মজিদের প্রস্তাবে বাঁধা দেয়না জয়তুন। স্বামীর সাথে দিনকে দিন সংসারে সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখে সেও।
বিয়ের পর মজিদের সুখের সংসার দৃষ্টি এড়াইনা গেঁয়োদের। এ পাড়ার অনেকেই কানাকানি করে ওদের নিয়ে। উত্তরপাড়ার আজিবরের বউ ময়না আর কলিমুদ্দির বউ হবিরন পান খাওয়ার উছিলায় মজিদের বাড়ীতে এসে খোশগল্প করে। জয়তুন বড়ঘরের বারান্দায় বসে কাঁথা সেলায় দিনমান। হবিরন বলে—
—কি সুখের সংসারগো বু তোমার! ময়না বলে—
—হাঁচা চাচি । বউ দেহ চাঁনরূপ।
তারপর এক এক করে দিন যায়। একদিন হরবলা বিবি অসুস্থ হয় আবারও। মা অসুস্থ হলে মজিদ জমানো টাকা খরচ করে। কিন্তু অসুস্থতা ছাড়েনা সহসা। ফলশ্রুতিতে আবারও বিছানায় পড়ে হরবলা বিবি।
আজকাল দিনের বেলা দেখা পাওয়া যায়না মজিদের। সুজাতপুর রিকশা চালাতে যায় সে,ফিরে রাত করে। ও এলে অজুর পানি এগিয়ে দেয় জয়তুন। রাতে একই বিছানায় শোয়ে খোশগল্প করে দুজন। অভাবের সংসারেও চোখে স্বপ্ন জ্বলজ্বল করে দুজনের।
দিনে মজিদ বাড়ী না থাকলে একাকী সময় কাটায় জয়তুন। স্বামীর অবর্তমানে শাশুড়ির শুশ্রূষার দায়িত্ব পালন করতে হয়। হরবলা বিবি অসুস্থতার ধরুন বিছানায় পড়লে সেবার জন্য কাতর হয়। জয়তুনও কখনও অবহেলা করেনা তাকে। শাশুড়ি বলে—
—হামাক দেইক্যগো মা, তোমারে মোর বেটি থুই।
তারপর মাস দুই পর হয়তো জয়তুনের কারণেই যমের দোয়ার থেকে ফিরে আসে হরবলা বিবি। ও সুস্থ হলে পাড়ার মেয়েরা ধন্য ধন্য করে জয়তুনের। অসুস্থতার সময় কি না করেছে মেয়েটা? শাশুড়ির জন্য রাতের ঘুমও হারাম করেছে সে। কিন্তু কেন যেন কৃতজ্ঞতার বশবর্তী হয়েও সত্যটা মানতে পারেনা হরবলা বিবি। পাশের বাড়ীর হবিরন জয়তুনকে নিয়ে কথা বললে হরবলা বিবির সহজ জবাব—
—মাইনসের বেটিগো বু মাইনসের বেটি। আপননি অয় হে? পাশে থেকে প্রতিবাদ করে হাস্না—
—মিছা কওকে চাচি, অমুন বউনি আছে গাঁয়?
তবুও সহসা সত্যিটা স্বীকার করেনা হরবলা বিবি। সম্ভব হলে পাড়ার অন্য মেয়েদের সাথে বিদ্রোহ করে সে।
এর কদিন পরের ঘটনা। একদিন মজিদের বাড়ীতে মেয়েমানুষের কান্নার আওয়াজ শুনা যায়। সহসা কান্নার কারণ খোঁজতে ব্যর্থ হয় অন্যরা। পরমুহূর্তে জয়তুনের মুখেই সত্য প্রকাশিত হয় । আজ সকালে রিকশা নিয়ে গঞ্জে গেছিল মজিদ। সারাদিন রিকশা চালিয়েছে সে। বিকেলে রাস্তা আটকে কে বা কারা রিকশাটা কেড়ে নিছে ওর। কাউকে চিনতে পারেনি মজিদ। বুড়ি হরবলা বিবি বড়ঘরের বারান্দায় বসে সন্ধ্যার শেষ অবধি আহাজারি করে—
—আয়গো খোদা, হামাক কি সব্বনাশ অইলগো। হরবলা বিবি আহাজারি করলে ধমক দেয় মতি—
—চুপ র মাগীর ছাও, দিলে সবুর দেস কই।
শহরে রিকশা হারিয়ে চিন্তিত হয় মজিদও। একমাত্র উপার্জনের বাহন হারানোর অর্থ আগামীতে উপোষ থাকতে হবে সবাইকে। নসু মাতব্বর লোক মারফৎ রিকশাটা খোঁজার চেষ্টা করে সুজাতপুর। সহসা সন্ধান দিতে পারেনা কেউ। নিরুপায় হলে কদিন ধার করে সংসার চালাতে হয় মজিদকে। দিন দশেক পর সে সুযোগও থাকেনা তার।
এরইমধ্যে একদিন মজিদকে ডেকে পাঠায় নসু মাতব্বর। অতিউৎসাহী মজিদ মিয়া দেখা করতে গেলে পাওনা টাকার তাগিদ দেয় সে। মজিদ বলে—
—টাহানি কাহা? হাতত খালী সুময় দেন। মাতব্বর বলে—
—ইতা কেমুন কতা অইল মজিদ। অভাবনি একলা তোমার?
অবশেষে নসু মাতব্বরের কাছ থেকে কদিন সময় নেয় মজিদ। তারপর বাড়ীতে এসে ভাবনায় পড়ে সে। অভাবের সংসারে যেখানে তার দুমুঠো ভাত জোগানোর সামর্থ্য নেই, সেখানে নসু মাতব্বরের ঋণ শোধের সাধ্য কোথায়? কিন্তু যথা সময়ে দেনা পরিশোধ করতে না পারলে বিপদ হবে তার। নসু মাতব্বর কি আর যেসে লোক? এ গাঁয়ের মোড়ল সে। হয়তো যেকোন উপায়ে পাওনা আদায় করে নিবে সে। তারপর কি ভেবে একদিন নিতান্ত অপরাধীর মত জয়তুনের সামনে এসে দাঁড়ায় মজিদ। সে বলে—
—একখান কতা কমু, গোস্যানি অয় বউ? জয়তুন বলে—
—গোস্যা কিয়ের, হাঁচা কও হুনি?
—বাপের বাড়ী যাবানি, কয়ডা টাহানি আনবার পাও?
মজিদের এমন প্রস্তাবে ভাবনায় পড়ে জয়তুন। অভাবের সংসারে আফাজুদ্দির সামর্থ্য যে মজিদের চেয়ে কোন অংশেই ভাল নয়, এটা জয়তুনের চেয়ে ভাল কে জানে। জয়তুন বলে—
—টাহানি, বাজাননি পাব দিতে?
জয়তুনের কথার সহসা জবাব দেয়না মজিদ। তারপর সত্যি একদিন টাকা চাইতে বাপের বাড়ী যেতে হয় মেয়েকে। দীর্ঘকাল পর মেয়ের আগমনে পুলকিত হয় সে বাড়ীর সবাই। পরমুহূর্তে আসার কারণ প্রকাশিত হলে রীতিমত ভাবনায় পড়ে আফাজুদ্দিন। ফেরার সময় মান অভিমানের এক পালা গান হয় বাপ বেটিতে। আফাজুদ্দিন বলে—
—হামাক মাপ দিস, সাধ্যনি আছে মোর?
অবশেষে শুন্য হাতেই ফিরে আসতে হয় জয়তুনকে। শ্বশুরবাড়ীর অপারগতায় বিমর্ষ হয় মজিদও। সংসারে নিদারুণ দুঃসময়ে শ্বশুরবাড়ীকে একমাত্র ভরসা ভেবেছিল সে। জয়তুন ফিরে এলে শ্রাব্য অশ্রাব্য কথার তুবড়ি ছুটে হরবলার মুখে।
—কেমুন বাপ, ফকিরনি? মুখে ঝাঁটা থুই।
হরবলা বিবি অভিসম্পাত করলে সহসা জবাব দেয়না জয়তুন। নিজের ঘরে বসে অশ্রু বিসর্জন দেয় সে। তারপর একদিন পাওনা টাকা আদায় করতে এসে মজিদের পালের বলদটা নিয়ে যায় মাতব্বরের ছেলেরা। এ বাড়ীর কেউ বাঁধা দেয়না তাতে।
শ্রাবণ মাসে বন্যা হয় চণ্ডীবর্দি। তখন পানিবন্দী হয়ে পড়ে এ পাড়ার সবাই। একদিন হারু ঘটক কনের সন্ধান দিলে ছেলেকে দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চায় হরবলা বিবি। মজিদ বলে—
—নিকানি, বড় বউয়ের গোস্যানি অয়?
জয়তুনের প্রশ্নে কর্ণপাত করেনা হরবলা বিবি। সে বলে—
—গোস্যা ছাড়ান দে। পেটের ভাত দিব কেডা?
শেষমেশ পাকা কথা দিতে হয় মজিদকে। জয়তুনের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনা কেউ। জয়তুনও যেচে বাঁধা দিতে আসেনা কখনও। ভালবাসাপাগল যে মেয়েটি শত দুর্দশাতেও মজিদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছে আজন্মকাল। আজ অস্তিত্বের সংগ্রামে কেন যেন কোন আগ্রহ নেই তার। কে জানি, ও হয়তো যেনে গেছে জোর করে যায় হোক অস্তিত্বে আসন হয়না কখনও।
এরপর একদিন আবার সব নিয়ম মেনে দ্বিতীয় বিয়ের পিঁড়িতে বসে মজিদ। কনে আলফাডাঙার মুহুর আলীর বেটি হালিমা। গায়ের রং কালো— তাতে কি, মেয়ে কাল বলেই হয়তো পণের অংকটাও বড়। মেয়ের বিয়েতে মুহুর আলী নগদ টাকা দিয়েছে মজিদকে। সাথে নতুন রিকশা। মজিদের দ্বিতীয় বিয়ে চাউর হলে কানাকানি করে গেঁয়োরা।
—ইতা কিতা অইল বু, মজিদেরনি পাষাণ পরাণ?
নতুন বউ বাড়ী এলে বরণ করতে হয় জয়তুনকেই। যে বিছানায় একদিন নিজেকে সঁপে দিয়েছিল সে, সেখানে আসন ছাড়তে হয় তার। পরদিন সকালে আর খুঁজে পাওয়া যায়না তাকে। কে জানে, শেষকালে কি দুঃখ ছিল জয়তুনের। এরপর অনেক বছর পরও দরগাতলায় দেখা যায় মজিদকে। বটগাছের গোড়ায় বসে উত্তাল নদীর স্রোত জলে দৃষ্টি আওড়ায়। লোকে বলে এখনও নদীতে শাড়ির আচল ভাসে। সবাই দেখেনা, তবে কেউ কেউ দেখে-আচলে জরানো সেই নিথর দেহ।