পাণ্ডুলিপি থেকে নেয়া কবিতা । ইশরাত তানিয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ৭:১৪ অপরাহ্ণ, | ৩০৩৩ বার পঠিত
ধূসর প্রকোষ্ঠে আত্মজীবনী লেখে কেউ। দেয়ালে দেয়ালে, বই, ঘড়ি, পানির বোতলে। খোলা জানালা দিয়ে সময় ঢোকে বেরোয়। কেউ আসে ঝড় জলের রাতে লণ্ঠন হয়ে। কখনো সন্ধ্যার জ্বরের ঘোর নিয়ে।
আলমারিতে গুছিয়ে রাখা তীব্র বনজ ঘ্রাণ। বেলা শেষের তৃপ্ত স্নান। মেলে দেয়া ভেজা কাপড় থেকে টুপটাপ ঝরে জলের ফোঁটা। রোদ পোহায় স্যাঁতসেঁতে মুগ ডাল। রেশমিচুড়ি খুলে কেউ মরে যায়। কেউ বেঁচে থাকে। অভয়ারণ্যে। বিলুপ্ত ম্যামথ খোঁজে মাহুতের সাথে।
ইশরাত তানিয়ার কবিতা অন্যমনস্ক। পথে হঠাৎ চমকে ওঠে। পরক্ষণে ভালোবাসার কুয়াশাভাপে আচ্ছন্ন। বোধের ধোঁয়াশা বৃষ্টি আসে সেখানে। গোধুলির হাত ধরে। কিংবা বাতাসের বাবুইদুপুরে। আর ইচ্ছেরা? নেমে আসে ঝরা পাতার মতো। নিরিবিলি, নৈশব্দে। তানিয়ার ধুলোটে রশ্মির রাজ্যে।
দাগশূন্যপুর
পাছে দাগ লেগে যায়—
মন ভরে জামভর্তা খেতে পারিনি
প্রেমিকের হাত ধরতে পারিনি দাগের জন্যই—
রোদ বাঁচিয়ে হেঁটে গেছি, চাঁদমুখে যেন দাগ না লাগে।
সপাটে চড় খেয়ে মনে হয়েছিল— গালে দাগ বসে গেল!
বিছানা থেকে উঠেই দেখে নিয়েছি দাগ লাগেনি তো—
হলুদ মাখা হাত দেখে শঙ্কিত চোখ আঁচল খুঁজেছে
আনমনে হাত মুছে ফেলেছি নাকি—
তুলি হাতে আমি সাবধানী
ক্যানভাস টপকে অবাধ্য রঙয়ের ফোঁটা
ভাড়াবাড়ির দেয়ালে না লাগে।
আমার সমস্ত জীবন, সত্যি, দাগশূন্যই রয়ে গেল
এতটা শুভ্রতা কি আমি চেয়েছিলাম?
প্রাগৈতিহাসিক
এক সে দেশ, এক নিবিড় বনবাসী গাছ
যেন সুন্দরী রমনী থমকে দাঁড়িয়েছে
সদ্য পুরুষোচিত হাওয়ার চুমকুড়ি,
পাতায় পাতায় আনন্দ আশ্রয়।
যে গাছের বেঁচে থাকা আছে,
স্পর্শ কাতরতা আছে, মরে যাওয়া আছে,
তার একটি মন আছে নিশ্চয়ই—
অর্জুন কি অর্কিড, গাছের মন কথা বলে।
আর আমার মন
পৃথিবীর বাইরে মহাপৃথিবীর কিনারায়
উড়িয়ে নিয়ে যা নেবার— তারপর
গাছের বাকলে ঢুকে মাধবীবাতাস, সে পারে
বাকলের অপরূপ কারুকার্যে ঢুকতে বেরুতে
যখন যেমন ইচ্ছে— এপাশ ওপাশ।
আর আমার মন
এইসব গাছ দেখেশুনে,
ভালোবাসার আস্তর পাতে ঐরাবতে—
আদি বৃক্ষের অভয়ারণ্যে, কী আশ্চর্য ভবঘুরে,
মাহুতের সাথে করে বিলুপ্ত ম্যামথের তত্ত্বতলাশ।
যে আসে কেন আসে
চলে যাবে বলে যে আসে
পৃথিবীর সমবয়সী ছায়া ছাপ
রেখে যায় ঘরের মেঝেতে—
নিয়ে এলে ঝড়ের রাতে
হাত ধরে, লণ্ঠনের মতো।
যে আসে চলে যাবে বলে
কেন তাকে আসতেই হয়
যেভাবে সন্ধ্যায় জ্বর আসে।
সে যাবে বলে চলে আসে—
কাঁপা কাঁপা লণ্ঠনের আলোয়
নির্বিকার দুটো হাত
জ্বর জ্বর পড়ে থাকে।
পূর্বাপর
ভালবাসবার আগে কী করছিলাম আমি?
জলপাই কুড়াই ঠাণ্ডা আলোয়
আশ্চর্য মেঘগুলো জমা রাখি বোদলেয়ারের কাছে
পায়ের নিচে মাছ চুম্বনরত।
ভালবাসবার পর কী করেছিলাম?
কুয়াশায় মুছে ফেলি
আমসত্বের আলগা নুন-মরিচের গুঁড়ো
লেগে থাকে যা মুখের এখানে সেখানে,
জল আর রোদ ঘর-বার করে।
খড়কুটো রোদ্দুর
শহুরে জানালা গলে ঢুকে পড়ে পাখির ঠোঁটের খড়কুটো
মন থেকে মেঘ উঠে যায় আকাশে; একটি কিংবা দুটো
রোদ্দুর চোখ থেকে চিবুক পেরিয়ে খসে পড়ে বুকে, ভিজে
ঘামে, চর্ম-অস্থি-রক্ত কণিকা ভেদ করে ঢুকে অন্য কোথাও,
সাঁতার কাটে মনের শ্যাওলা জমা ভেতরের আরেক মনে।
বেফাঁস শব্দেরা কবিতার তাঁত বোনে বেলা অবেলায়—
চলমান জীবনের টানা ও পোড়েনে, এসো, ইতস্তত খড়কুটো
রোদ্দুর-ধোঁয়া ওড়া সিগারেট ঠোঁটে স্থির শহুরে বারান্দায়।
কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কবে থেকে সে কারো প্রতীক্ষায়।