ইশরাত তানিয়া’র একগুচ্ছ কবিতা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুলাই ২০১৫, ৫:৪৮ অপরাহ্ণ, | ৩০৫৯ বার পঠিত
বিপর্যয়
অসময়ে কল বেল বাজে
আগন্তুকের সময় জ্ঞানের বড় অভাব—
ঘর ঝাড়ু-মোছা, টবের গাছে পানি,
ধুলো ঝাড়পোঁছ, ঝুল ঝাড়া,
রোদে আচার, কবেকার স্যাঁতস্যাঁতে মুগ ডাল,
ফর্শা কুশন-পর্দা, টান টান বিছানা,
কাচা কাপড় দড়িতে মেলা,
সাবানের গন্ধ ভরা পানি ঝরে টুপটাপ।
‘কে? কে?’
আটা মাখা, রুটি গড়া-সেঁকা, সবজি কোটা,
ফুটন্ত ভাতের পাতিলে উপচানো ফেনা,
এক সিঙ্ক এঁটো হাঁড়ি-খুন্তি, এক চুমুক চা,
হাওয়ায় ঝলক ঝলক ডাল ফোঁড়নের ঘ্রাণ—
অবশেষে গরম তেল মশলায় একটু পানি, ছ্যাঁত!
‘কে আপনি? আপনার নাম কী?’
হাতের চুড়ির সাথে থালা বাটির মৃদু টুং টাং,
গনগনে তাপ, ধোঁয়া, লালচে মুখ, ঝাঁঝে জ্বলা চোখ,
এই যাহ্! হাত পুড়েছে অনন্ত আগুনে—
সেভলন-বার্নল থার্মোমিটারের সাথে গেছে পাড়া বেড়াতে,
বরফ ঘষলে হয়।
তেলের বোতল উল্টে পড়ে, ভবিতব্য!
আলু-পেঁয়াজ গড়িয়ে কলতলার সীমানা পেরুলো
ঘর সংসার চৌপাট, লণ্ডভণ্ড চারিদিক—
বাঁ হাতে নাক চুলকায়, হীরার নাকফুলে আঙুলের ছায়া পড়ে,
দুচোখ এদিক ওদিক খোঁজে, ওড়নাটা কোথায় রাখলাম—
‘একটু দাঁড়ান, আসছি!’
সে কেউ
মেঘের ঝোপে মুখ লুকিয়ে বলে
শ্রাবন ভেজা বাউলনদীর ঢেউ
আড়বাঁশিতে অনেক দূরের চাবি—
রোদ উজিয়ে আগুন জ্বালায় জলে।
বাঁশের বনে চন্দনা আর কোয়েল
উল্টে দিয়ে আলতা-রঙ্গা তরল
চমকে তাকায় পথ-ভোলা সে কেউ—
জলটুঙিতে বৃষ্টিপাখি ওড়ে।
শিশির ধোয়া একটি তারা নামায়
সুঁই সুতাতে গাঁথে তারার বোতাম
পাতার ঘরে মেলে দেয়া জামায়—
কাঁকন বাজে আঁজলা পানির হাতে।
এখন তোমার আউশ-পাকা মাঠে
মিঠে নীলের মাছরাঙাদের বসত
দাঁড়িয়ে থাকে ঘর-হারা সে কেউ—
ধুপছায়া রঙ বুলিয়ে তার বুকে।
একটি আলমারি
ক্যাপাচিনোয় চুমুক দিয়ে ধীরগতিতে দেখছিলাম মাঘের দুপুর
মন-কেমন-করা পড়ন্ত বিকেলে রূপান্তরিত হয়ে যায়
ধুপের ধোঁয়া আর ফানুস-জ্বলা সন্ধ্যা বুঝিয়ে দিল বিকেলও ফুরায়—
বাড়ি ফিরে সেই দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যাকে ভাঁজ করে তুলে রেখেছি, আলমারিতে।
মালার ছিঁড়ে যাওয়া লহর থেকে ছিটকে পড়া লাল-নীল পুঁতি কুড়িয়ে
এক ফালি লেবুর মত আধেক চাঁদ আর কিছু তারার মিহি গুঁড়োর সাথে
কাচের শিশিতে পুরে আলমারির খাঁজে রেখেছি।
এক ভাগে জোছনায় পাহাড়ের কাব্য গুছিয়েছি
আরেক ভাগে জল জঙ্গলের ডাক—কিছু ঘুঘুর গান,
বুনো পাখিদের কোলাহল, মনে আছে?
ফরফুরে নরম পালকে স্বরলিপি ফেলে ওরা উড়ে গিয়েছিল
একবারও আমাদের দিকে ফিরে না তাকিয়ে!
ঝর্ণার জলে গা ডুবিয়ে ভেবেছিলাম—পায়ের কাছে বসে আছে সময়
লেজ ফোলানো আদুরে ‘মিনি’র মত অথচ অবগাহনের কাল পেরিয়ে
এসেছি বহু আগে, সেই কবেকার বেলা শেষের তৃপ্ত স্নান
বাক্সে ভরে রেখেছি আলমারিটার দখিন-পশ্চিম কোণে।
একদিকে লাল সোনালি ফিতেয় জড়িয়ে রেখেছি বসন্তের উদাস চিঠির গুচ্ছ-
নীল খাম নয়, বাদামি রঙের, যেন বা শুকনো ঝরা পাতা—
ই-মেইল দেখার অবসরে মাঝে মধ্যেই, অজান্তে হাতড়াই
বার্তাবহ সনাতনী কাগজগুলো আবছা আঁধারে আলমারির ভিতর।
অন্যদিকে রেখেছি বর্ষার মেঘ উপচানো আকাশের পটভূমিতে
সবুজ গাছদের আভা, হেমন্তের তীব্র বনজ গন্ধ,
দারুণ উষ্ণ বেলার কাল-বোশেখির ধুলো ধুলো হাওয়া।
এ সবকিছুই ভাগে ভাগে সাজিয়ে রেখেছি আমি।
কথা ছিল, তোমার সাথে একটি একটি করে তাকের পুনর্বিন্যাস করব
ভাঁজগুলো খুলে উল্টে-পাল্টে দিব, শুকনো নিমপাতা ছড়াব
আলমারিতে বিছানো পুরনো খবরের কাগজের উপর।
ন্যাপথলিনের সাদা বল গড়িয়ে দিব আনাচে-কানাচে
যেখানে বেগুনি-জাফরানি রঙ ফুটে ওঠা আকাশ রেখেছিলাম
আর মনে করে কিছু চালতা ফুলও—
হোঁচট খাওয়া উঁচু নিচু রাস্তা, ইতস্তত উড়ে বেড়ানো কাগজের টুকরো,
ক্রমাগত পাক খাওয়া নাগরিক শব্দময় তরঙ্গ, আগুন গরম ভাপা-চিতই,
ধুলোমাখা মুখরোচক ঝাল ফুচকা, আদাকুচি দেয়া চা,
লেকের তিরতিরে জল, জলের কোলে নৌকা,
কংক্রিটের বুকে কৃষ্ণচুড়ার উৎসব, কালো পিচের উপর সোনাঝুরি পাতা,
অসংখ্য অর্ধপঠিত বই, আংশিক লিখিত কবিতার চরণ,
তোমার ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হাসি, বশীকরণের মন্ত্র তন্ত্র চাহনি,
স্পর্শের একেকটি জ্বলে ওঠা অমৃত নক্ষত্র…
খোলা আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে আছি—
যাবার সময় হয়ে এলো, এক বুক পকেটে আমি কেমন করে এত কিছু নিব!
আকাশময়ী
আলো-এসে-থেমে-যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে
মনে হলো এখনই বিচ্ছেদক্ষণ,
অসময়ে এতো আলো সাঁতার কাটে চোখের গাঙে—
ডুবে মরি।
দেহহীন অবয়বে আলো-সঞ্চিত-মুখ খুঁজি
সেখানে আদৌ যাওয়া হয়নি কখনো,
যদি যেতে পারি মায়াবী ঘাটে মাঝিহীন দুপুরে।
এখনই নিঃসঙ্গক্ষণ
বেঁচে থাকি।
যে মুখে আকাশ থেমে গেছে—
সে মুখ নত হলে
আকাশ ঝুঁকে থাকে আমার মুখের ওপরে।
দিকভ্রান্ত মধ্যরাত
এমন হবার কথা নয়, তবু হল,
মধ্যরাতে ঘুম ভাঙার পর বুঝলাম
স্বপ্নে যার আসার কথা নয় সে-ই চোখ জুড়ে থাকল
স্বপ্নে স্বপ্নে এই মধ্যরাতে—
যে-রাত্রির আকাশ মেঘের সাজ ধরে বসে আছে
তার কাছে আমার চাইবার কিছু নেই
আমি নিজেই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি সূর্যোদয়ের বহু আগে
এখন কেমন করে আকাশকে আঁকড়ে ধরি!
ছন্নছাড়া মন বারণ শুনে না
মধ্যরাতে লণ্ঠন হাতে দিকভোলা হয়ে পথে নেমে যায়
পিছনে লু হাওয়ার হলকা, সামনে শীতল বাতাসের মৃদু স্পর্শ—
মৃত্যু ভাবে আর কোনও দিন ফিরে যাবে না।
কুঠারে টুকরো টুকরো উদাস মন ছিটকে পড়ে
অবহেলায় বনভূমির সবুজ সুষমায়
বিষাদগ্রস্ত ওষ্ঠধর ধারণ করে বিপন্ন যৌবন।
ঘোর দাবানলে পঙ্খিরাজের পাখা আগুন নিয়ে উড়ে যায়
চাঁদের কাছে জোছনার প্রলেপ মাখাতে এই মধ্যরাতে—
এসো না, এসো না, তুমি, ফিরে যাও বিষণ্ণ নদী—
দীর্ঘশ্বাসের বাষ্প ঘোলা দৃষ্টি নিয়ে
স্মৃতির উপত্যকায় নিরুদ্দেশ ঘোরাফেরা—
একদিন এই আমি কারও প্রেমিকা ছিলাম!
চূর্ণ– বিচূর্ণ ১
এভাবে আর লিখব না—
চড়ুইভাতির মাটির উনুন
নিভিয়ে দিয়ে
লিখতে গেলেই
খুলে পড়ে
সোনার নোলক
ঝলক ঝলক
হলুদ রোদে।
অমন কথা বলব না—
অগোছালো হাওয়ায় ঘেরা গিরিপথে
বলতে গেলেই
আবার উতল
মনের বাউল
পারুল জারুল
বনের ঘাটে।
তোমায় আমি ভাবব না—
নেভা উনুন ছাই উড়িয়ে
ধিকি ধিকি
ভাবতে গেলেই
মাথার ভেতর
নোলক ঝলক
জারুল বনে
হাওয়া-রোদের
অতর্কিতে মাতামাতি
চড়ুইভাতি
শেষ হলো না।
দাগশূন্যপুর
পাছে দাগ লেগে যায়—
মন ভরে জামভর্তা খেতে পারিনি
প্রেমিকের হাত ধরতে পারিনি দাগের জন্যই—
রোদ বাঁচিয়ে হেঁটে গেছি, চাঁদমুখে যেন দাগ না লাগে।
সপাটে চড় খেয়ে মনে হয়েছিল- গালে দাগ বসে গেল!
বিছানা থেকে উঠেই দেখে নিয়েছি দাগ লাগেনি তো—
হলুদ মাখা হাত দেখে শঙ্কিত চোখ আঁচল খুঁজেছে
আনমনে হাত মুছে ফেলেছি নাকি—
তুলি হাতে আমি সাবধানী
ক্যানভাস টপকে অবাধ্য রঙয়ের ফোঁটা
ভাড়াবাড়ির দেয়ালে না লাগে।
আমার সমস্ত জীবন, সত্যি, দাগশূন্যই রয়ে গেল
এতটা শুভ্রতা কি আমি চেয়েছিলাম?
দরজা–জানালা
দরজাটা আমি খুলছি না
ধুসর প্রকোষ্ঠে লিখে রাখি আত্মজীবনী
দেয়ালে দেয়ালে, বই, ঘড়ি, পানির বোতলে।
ভ্রমণরত প্রাগৈতিহাসিক সময়
খোলা জানালা দিয়ে ঢুকছে এবং বেরুচ্ছে।
রচিত জীবন
প্রজাপতির পায়ে আলতা দেখিনি
ডানায় রঙের খেলা দেখি ঝিকমিক
এক ফোঁটা দাম্পত্য মিশে কবিতায়—
শুষ্ক ত্বক ছুঁয়ে চলে যায় ছোট বড় গল্পরা
বাগানে উপন্যাসের ফসিল শুকায়
ছাইয়ের স্তুপে প্রহসনের দীর্ঘশ্বাস শুনি;
যা কিছু তাৎপর্যপূর্ণ হঠাৎ অর্থহীন
সুপারির শুকনো মর্বিড খোসা।
গাছের ডালে খানিক পাতা ওড়ে,
বাতাস ফিরে গেলে গাছেই ঘুমায়
স্বেচ্ছায় জন্মাইনি, মৃত্যুও অজ্ঞাত-
মাঝখানে রচিত আমি
দারুচিনি আর মেছো গন্ধে, কুহু আর কলহে।
বিগত কঙ্কাবতী
বুকের মধ্যে একলা পাখি ডাকে
কান পেতে শুনি শুকপাখির কথা,
বুঝি না কিছুই, কবে ভুলে গেছি রূপকথার ভাষা,
নীল কমল আর লাল কমল, সুয়ো-দুয়ো রানি
অরুণ-বরুণ-কিরণমালা সবাই ছেড়ে গেছে
কেমন আছো ডালিম কুমার, কুচবরণ রাজকন্যা?
গজমোতির মালা ছিঁড়ে খুলে গেছে কোন পথে—
কিংবা আমি ফেলে দিয়েছি অজ্ঞাত অবহেলায়।
সময়ের স্রোতে পাল তুলে মন পবনের নাও
তলিয়ে গেছে হিরামন পাখি, রাজা-রানির গল্প,
আমার মাথায় কেউ ছুঁয়ে দাও সোনার কাঠি
দুলে উঠুক সোনার পালঙ্ক, দাসি এনে দে হলুদ বাটা,
কপিলা গাইয়ের দুধে শুদ্ধ স্নান, সাতনরি হার,
কানে ঝুমকো লতা, চোখে নীলকান্ত মনি চূর্ণের প্রলেপ,
হিরার পদ্ম পাপড়ি মেলে সুরভিত করুক আমার জাগরণ।
‘এ্যালেন, এ্যালেন’ দূরে কারো ডাক শুনি
কে যে ডাকে কাকে, নিশির ডাক
এ মরণ ঘুমে আমিও ডাকছি বহুকাল—
হারিয়ে যাওয়া, প্রায় ফুরিয়ে যাওয়া
প্রিয় কবিতারা কে কোথায় চলে গেছে!
বৈকালিক
নিন্মলিখিত বিকেলগুলো আমি স্বীকার করে নিচ্ছি—
১
যে-বিকেলে ক্লান্ত টিপ বেসিনের আয়নায় রেখে মুখে এক আঁজলা পানির ঝাপটা দিয়েছিলাম।
২
যে-বিকেলে বাদামি রঙের একটি শুকনো বটপাতা রোদে পিছলে আমার ঘরে চলে এসেছিল।
৩
যে-বিকেলে তামার ঘণ্টায় হাতুড়ি পড়েছিল আর আমি ছুটির আনন্দে ভগ্নাংশ-উৎপাদকে বিশ্লেষণ ভুলে উড়ে উড়ে নিজেকে সোজা পাখির বাসায় পেয়েছিলাম; এখন এই বয়সেও।
৪
যে-বিকেলে হৃৎপিণ্ডকে বারণ করেছিলাম- এত রক্ত ঝরিও না, পৃথিবী ভেসে যাবে; তা সে কবে কার কথা শুনেছে!
৫
যে-বিকেলে একটি মহাকাব্য রচিত হতে দেখেছিলাম কোথাও, সে-মহাকাব্যের অবারিত নিঃশ্বাস ঝিকিমিকি পড়ন্ত বেলায় মিশে গিয়েছিল মৃদু সোনালি আলো হয়ে।
৬
যে-বিকেলে রিকশার উদ্দেশ্যহীন চাকার সাথে আমি আর মুন্নী স্তব্ধতার মুখে খুদকুঁড়ো দিয়ে পোষ মানিয়েছিলাম তারপর মৌনতাকে পাশে রেখে দু’জনে একসাথে একে অন্যকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- ‘কিছু বললে?’
৭
যে-বিকেলে আঁচলে আগুন লেগেছিল এবং সে আগুন আমার লেখার হাত পুড়িয়েছিল এমনকি লিখিত কবিতা গুলোও।
# #