ওয়ারসান শার এবং তাঁর কবিতা । মঈনুস সুলতান
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ জানুয়ারি ২০১৬, ৬:২৪ অপরাহ্ণ, | ২৫৮২ বার পঠিত
কবি পরিচিতি : জাতিসত্তার দিক থেকে সোমালি হলেও কবি ওয়ারসান শার-এর জন্ম ১৯৮৮ সালে পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়ায়। পরবর্তীকালে তিনি যুক্তরাজ্যে অভিবাসী হিসাবে বসবাস শুরু করেন। ‘আর্টস্ ইন ক্রিয়েটিভ রাইটিং’-এ ডিগ্রিপ্রাপ্ত ওয়ারসান শার কবিতা লিখতে শুরু করেন মূলত সোমালি ঐতিহ্যের সাথে যোগসূত্র রক্ষার তাগিদে। বলা চলে—পূর্ব আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সোমালিয়ায় শিকড়ের অনুসন্ধান তাঁর কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য। ‘ফর ওয়োম্যান ডিফিকাল্ট টু ল্যভ’ শিরোনামের একটি দীর্ঘ কবিতা লিখে তিনি প্রথম কাব্যামোদিদের নজরে আসেন। ২০১১ সালে তিনি ‘টিচিং মাই মাদার হাউ টু গিভ বার্থ’ নামে একটি কবিতার প্যাম্ফলেট রচনা করেন। পরপর প্রকাশিত হয় তাঁর আরো দুটি কবিতাপুস্তিকা—যেগুলোর শিরোনাম হচ্ছে যথাক্রমে : ‘আওয়ার ম্যান ডু নট বিলং টু আস্’, ও ‘গ্রিফ হ্যাজ ইটস্ ব্লু হ্যান্ডস্ ইন মাই হেয়ার’। অল্পবয়স্ক এ-কবির কবিতা আজ অব্দি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত না-হলেও তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ইতালি প্রভৃতি দেশে কবিতা পাঠ করে আলোচিত হয়েছেন। তাঁর কবিতাদি প্রকাশিত হয়েছে ‘পোয়েট্রি রিভিউ’ ও ‘নিউ ওয়েভ’ প্রভৃতি মর্যাদাবান জার্নালে। তাঁর কিছু কবিতা ইতালিয়ান, সুইডিশ, ইসতেনিয়ান ইত্যাদি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ২০১৩ সালে ব্রুনেল ইউনিভারসিটি থেকে তিনি ‘আফ্রিকান পোয়েট্রি প্রাইজ’ পান। একই সালে লন্ডনে ‘ইয়াং পোয়েট লারিয়েট’ হিসাবে নির্বাচিত হন। কবি নানা দেশে কবিতা বিষয়ে কর্মশালা পরিচালনা করে থাকেন।
যেসব নারীদের ভালোবাসা দুরূহ তাদের জন্য
তুমি যেন দুরন্ত অশ্ব এক—ছুটছো একাকী,
পোষ মানানোর চেষ্টা করছে সে তোমাকে—
এত সহজে তা হয় কী?
তুলনা করে কখনো সে অগম্য রাজপথের সাথে
অগ্নিদগ্ধ গৃহ হয়ে দাঁড়ায় তোমার উপমা পরদিন প্রভাতে।
অন্ধ করে দিচ্ছো তাকে—করে এমনও অনুযোগ,
কখনো ছেড়ে যেতে পারবে না তোমাকে, ভুলে যাওয়াও অসম্ভব
তুমি ছাড়া অসাধ্য তার জীবনের সব উপভোগ।
তুমি ছাড়া অন্য কিছু কাম্য নয় তার,
মতিচ্ছন্ন করে দিচ্ছো তুমি তাকে, তোমাকে সহন করা খুবই দুরূহ
বইতে পারছে না সে তোমার গুরুভার।
তোমার আগে যেসব নারীরা এসেছে তার জীবনে,
কিংবা তোমার সাথে সম্পর্ক টুটে যাওয়ার পর
যাদের সাথে হবে তার প্রণয়—
তোমার নামের তোড়ে ভেসে যায় সবকিছু বেনোজলে
শুধু তুমি জুড়ে থাকো তার হৃদয়।
তোমার ভাবনায় লালাসিক্ত হয় তার মুখগহ্বর,
সংবেদনশীল হয় দাঁত—যখন মনে পড়ে তোমার শরীর—
তার দেহ দিঘল ছায়া হয়ে তোমাতে খোঁজে তৃষ্ণার নীর।
তার দৃষ্টিতে তুমি সর্বদা তীব্র, ছড়াও দাপট প্রবল,
যে-রকম লজ্জাহীনভাবে তাকে চাও, কামনা করো তার অর্ঘ্য
আতঙ্কগ্রস্ত হয় সে—হারায় উদ্দীপনা, হয়ে পড়ে হীনবল।
বলে—কোনো পুরুষই পাল্লা দিতে পারবে না তার সঙ্গে
যে বসবাস করে তোমার মস্তিষ্কের কন্দরে,
চাওনি কী? তুলতে তো চেয়েছো তাকে নিজের ঘরে।
তোমার মুখ করে তুলেছো চন্দ্রচন্দনে কমনীয়…আবেদনে বিহ্বল,
চঞ্চলতাকে পরিহার করে থেকেছো স্বপ্নঘোরে তন্দ্রাচ্ছন্ন
শরীরে ছড়িয়েছো নরোম রূপসুষমায় মোহনীয় ছল।
কিন্তু এমনকি গভীর ঘুমেও অনুভব করেছো
চলে যাচ্ছে সে আপন স্বপ্নে অনেক দূরে,
তার করোটি দু-ভাগ করে খুলে দেখতে চাও কী?
ধরে রাখতে তো পারোনি তাকে তোমার অন্তঃপুরে।
মানবসন্তানদের নিয়ে তুমি পারবে না বাঁধতে ঘর,
কারো তোমাকে বিষয়টি আগেই বুঝিয়ে বলা উচিত ছিলো—
কাছে আসার ভান করে তারা থেকে যায় পর।
আর সে যদি তোমাকে ছেড়ে যেতে চায়—যেতে দাও তাকে
তুমি ভয়ংকর—ব্যতিক্রমী ও সুন্দর,
বেঁধে রাখতে যেও না রকমারি ছলে,
কীভাবে ভালোবাসতে হয় তা তো জানে না সকলে।
তোমাকে হাসতে দেখে
কাছে এসো—আমাকে দেখাও তোমার বুকের জখম,
আর বলো নিরিবিলি—
যেসব নারীকে ভালোবেসেছো তাদের কথা,
তোমার মনে যারা ছিলো অনুপম।
বলতে পারো আদ্যোপান্ত—করেছো যেসব মিথ্যাচার,
যা তোমাকে জাগিয়ে রেখেছে রাতের পর রাত দহনে অনিবার,
বলো তাদের কথা—যাদের মুখে করেছো চপেটাঘাত—
তোমার হৃদয়ে ঝরেছে যখন রক্তের প্রপাত,
শুনতে চাই তাদের কথা—
যাদের সাথে তৈরি হয়েছে তোমার গাঢ় শত্রুতা,
যারা ভাঙতে চেয়েছে তোমার ঘর,
যেসব পরিবারকে তুমি পরিয়েছো কাফন—দিয়েছো কবর।
করতে হয়েছে তোমাকে যেসব নোংরা কাজ
পুড়েছে কণ্ঠনালী, দমবন্ধ হয়ে এসেছে
নাসারন্দ্রে মদের তীব্র ঝাঁঝ,
জেগে উঠেছো প্রতিটি প্রভাতে শূণ্যতায় রিক্ত
অনুশোচনায় মনস্তাপে ম্রিয়মাণ,
কেউ বলেনি দুটি কথা সহানুভূতির
চিত্ত পায়নি পরিত্রাণ।
কাছে এসো—আমাকে বলো সমস্ত কিছু
তোমার হৃদয় হোক আজ নির্ভার,
শুনতে চাই তোমার দিনযাপনের খুঁটিনাটি
আমাকে করো তোমার হর্ষ-বিষাদের অংশীদার।
তারা গতকাল যা করেছে
তারা আমার কাকিমার ঘরে লাগিয়ে দিয়েছে আগুন। কেঁদে উঠেছি আমি প্রবলভাবে—যে-রকম দুর্যোগে দগ্ধ নারীরা রোদন করে টিভিস্ক্রিনে। যে-ছেলেটি একসময় ভালোবাসতো আমাকে, হাতছানি দিয়ে ডেকেছি তাকে। কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে বলেছি ‘হ্যালো।’ চমকে ওঠে সে জবাব দিয়েছে, ‘ওয়ারসান, সমস্যাটি কি, কি হয়েছে তোমার?’
অনেক বছর ধরে আমি প্রার্থনা করছি—হে প্রিয় ঈশ্বর, এই কী আমার প্রার্থনার জবাব! যে-দুটি দেশে ছড়ানো আমার নিবাস—তার একটি তৃষ্ণার্ত, অন্যটি দগ্ধ হচ্ছে আগুনে। দু-জায়গায় প্রয়োজন জলের।
ওইদিন রাতে আমি মেলে ধরি একটি মানচিত্র। আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি সমস্ত বিশ্ব। আর ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘বলো, আঘাতটা কোথায়?’ জবাব আসে, ‘সর্বত্র।’
তোমার ভাবনায়
আমি যেন খাচ্ছি ফলের সুস্বাদু শাঁস,
জিহ্বাকে ঠেলে পৌঁছে দিচ্ছি পেঁপের কালো পাকস্থলির ভেতরে,
বুক ভরে নিচ্ছি তোমার সুবাস।
দাঁত দিয়ে খোসা ছড়াচ্ছি লিচুর,
কামড়ে দিচ্ছি পাকা নাসপাতি, চুষে খাচ্ছি আম
মনে খেলছে চেনা গানের সুর।
এসব ঘটে যাচ্ছে বেসিনের কাছে রান্নাঘরে,
শীত ঋতুর মাঝামাঝি—খালিপায়ে মোজা না পরে।
আঁটালো হাতে মুখ থেকে ঠেলে সরিয়ে চুলের গুচ্ছ গুচ্ছ অমানিশা,
সমস্তক্ষণ জপি তোমার নাম, ঝঙ্কৃত হয় হৃদয়, জুড়ায় তৃষা।
উত্তরাধিকার
কোথায় পেয়েছো ডাগর চোখ দুটি
যার অশ্রুতে হারায় নীহারিকা,
পূর্ণ ঠোঁটের লালিমায় জ্বলে পিদিমের শিখা?
জবাবে বললে—মা আমার।
আর পেয়েছো কার কাছ থেকে নিঃসঙ্গতা?
তোমার হৃদয় বুঝি নির্জন বালুচর,
গভীর গোপনে জমেছে কিছু অনুক্ত স্বর,
‘জননী’, উত্তরে বললে আবার।
এবার জানতে চাই—কে দিয়েছে নিরাসক্তি
ধমনীতে তোমার বয়ে যাচ্ছে দায়িত্বহীনতা আজতক,
জবাব দিলে তুমি—‘আমার জনক।’
প্রেমে অপারগতার অজুহাত
নিঃসঙ্গ আমি—থাকি নিজের মতো একাকী। তোমাকে ভালোবাসা যুদ্ধে যাওয়ার মতো দুরূহ মনে হয়। জড়ালে একবার প্রেমের মিহি ঊর্ণাজালে, ছিড়ে তন্তুনিচয় ফিরে আসতে পারি না সহজে আগের অবস্থায়।
নারীদের ঘৃণা করো তুমি, যেমন করেছে তোমার পিতা ও পিতামহ; এ-বিষয়টা বাহিত হচ্ছে তোমার রক্তধারায়। আমি তোমার হৃদয়ের প’ড়ো কারপার্কে ছন্নের মতো ঘুরছি—যদি-বা ভাগ্যক্রমে তোমার কাছ থেকে পেয়ে যাই বাড়ি ফেরার লিফ্ট। আমি বিরান পার্কিংলটে দাঁড়িয়ে থাকি, অপেক্ষায় অশান্ত হই দারুণ; কারণ—তুমি হচ্ছো একটি স্বপ্নের প্রারম্ভ যা আমি স্মরণ করতে চাই আগামী দিনে।
যেসব মেয়েদের নিজস্ব কোনো মতামত নেই, যারা আদতে কণ্ঠস্বরহীন, তাদের ভালোবাসো বলে আমি তাকে কাছে ডাকিনি। সে মিথাচারে নিমগ্ন হতে চায়—এ-ধারণাও সঠিক নয়। তবে ঘটনা হচ্ছে—অবহিত নয় সে সত্যের স্বরূপ সম্পর্কে।
আমি তোমাকে ভালোবাসতে অপারগ—কারণ, আমার কাছে তুমি ছোটখাটো যুদ্ধ বিশেষ। আমরা হারানোর বেদনা ঢাকি কৌতুকের চাদরে। আমি আমার মা-বাবার মতো ভালোবাসায় ব্যর্থ হতে চাইনি। আমার ভেতরমহলে বাস করে যে ভবঘুরে তাকে তুমি শিখিয়েছো ঘরনির্মাণের কলাকৌশল। থিতু হয়েছে সে তোমার জন্য।
কিন্তু আমি গৃহপালিত কোনো কুকুর নই। তবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করছি যে—আমাদের রক্তপ্রবাহ ভ্রান্তিময়। তারপরও আমি নিঃসঙ্গ ছিলাম ভীষণ; তাই চেষ্টা করেছি একাকী মানুষের মতো চলতে নির্জন সরণীতে।
হ্যাঁ, অবশ্যই আমি ভুগছি অনিরাপত্তায়; এবং এ-রকম পরিস্থিতিতে দিন কাটিয়ে গেছেন আমার জননী ও মাতামহী। না, সে আমাকে ঠিক ভালোবাসে না তবে কাঁদায় প্রচুর। সে জানে আমার সকল বিষয়আশয়—তারপরও চুমো খেতে চায়।
তুমি এত নির্মম ছিলে যে—দীর্ঘ সময় ধরে ভালোবাসা যায় না তোমাকে। এভাবে চালানো যাচ্ছিলো না স্রেফ। একদিন অপরাহ্ণে আমার বাবা সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে গিয়েছিলেন, তিনি আর ফিরেননি কখনো ঘরে। তারপর থেকে আমি ঘুমাতে পারি না; কারণ—তার সৌরভ যে লেগে আছে আমার অন্তরে।
আমার সবচেয়ে প্রিয় উদ্ভিদ ছিলেন তিনি। আমি তার শিকড় কেটে দিয়েছি। বৃক্ষটি এখন পচছে ডালপালা সহ রোদবৃষ্টিতে। তাতে বেজায় ঝুরঝুরে হয়েছে আমার সংসারের গোড়া। আমার পরিবারে নারীদের মৃত্যু হয় অপেক্ষায়। কিন্তু আমি মরে যেতে চাইনি, বেঁচে থেকেছি তুমুল কষ্টে কেবল তোমার অপেক্ষায়।
তাকে ছেড়ে আসতে হয়েছে। আমি ভীষণ একাকি বোধ করছি। মনে পড়ছে—সে যখন জড়িয়ে ধরেছিলো আমাকে। তুমি হচ্ছো বহুবার শোনা সে-গান, যা আমি বারবার রিওয়াইন্ড করেছি—যতক্ষণ-না লিরিকের কথাগুলো মুখস্থ হয়ে যায়, আর আমি শুনতে শুনতে জপতে জপতে অসুস্থবোধ করি।
সে আমাকে একটি টেক্সট্ পাঠিয়েছে—যাতে লেখা ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি এমন তীব্রভাবে।’ তার হাসি যতটা মনমোহন ছিলো তেমন সুন্দর ছিলো না তার হৃদয়। আবেগের ছলনায় আমরা পরষ্পরের সাথে খেলেছি—যতক্ষণ-না মনে হয়েছে আমাদের আচরণই ভালোবাসা। ক্ষমা করো, আমি নিঃসঙ্গ ছিলাম বলেই তোমাকে চেয়েছিলাম। আমি এমন এক প্রেমিকা যার আদতে নেই কোনো প্রেমাষ্পদ।…অনুরাগে সুষমাময় আমি কিন্তু নিঃসঙ্গ। আমার সত্তাকে খুঁজে পাই শুধু নিজের কাছে।