জেনি জেনি! গাম্পের ভিতর হারাইছো তুমি । হাসান শাহরিয়ার
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ জানুয়ারি ২০১৬, ৫:০৪ অপরাহ্ণ, | ২৩৭১ বার পঠিত
জেনির কথা মনে পড়তেছে। তার নিঃসঙ্গ দুইটা চোখের ভিতর বিস্ময় ছিল। আর ছিল ভয়। বিস্ময় আর ভয়ের অনুনাদ। সন্ধ্যা হইলে সে উইড়া যাইতে চাইত। পাখি হইয়া। অনেক অনেক দূরে। তার প্রার্থনা খোদা কোনদিন শুনে নাই।
১৯৮৬সালে ইয়াঙ্কি রাইটার উইনস্টন গ্রুমের একটা উপন্যাস বাইর হয় ‘ফরেস্ট গাম্প’ নামে। গ্রুম আমেরিকান রিডারদের রুচি মোতাবেক এত বেশি শক্তিশালী লেখক ছিলেন না। ফলে বইটা নিয়া তেমন আর আলোচনা হয় নাই। গ্রুমের লগেও আর পরিচয় হয় নাই। কিন্তু ১৯৯৪সালের পরে গ্রুমরে আর এড়াইয়া থাকা গেল না। রবার্ট জেমেকিস যখন গাম্পরে সিনেমার ফিতায় আটকাইয়া ফেলেন। সিনেমা যেমন পাবলিকের পুরা মনোযোগ পাইল তেমন গ্রুমও মিলিয়ন মিলিয়ন গাম্প বিক্রি করতে পারলো। ফরেস্ট গাম্প হিসাবে টম হ্যাঙ্কস ওয়াজ আউট অব দ্য ওয়ার্ল্ড। সাথে অন্যরাও। কিন্তু আজকে আমি শুধু জেনিরে মনে করতেছি। জেনি; আবছা গভীর দ্বন্দ্ব; যেইটা ভর কইরা ছিল কোন এক মানুষীর কাঁধে; আর শেষে যেইটা পাখি হইয়া উইড়া যাইতে পারে নাই অনেক অনেক দূরে।
তোমারে নিয়া এইবার আমি একটা নদীর ধারে যাইতে চাই। একটা খুকির মত নদী। হল্লামাতাল। প্রাণ আছে যার। আমার আর তোমার মত মরা মানুষেরা মাঝেমইধ্যে এইরকম একটা নদী খুঁইজা লইতে পারে। তারপর তোমার কাছে আমি জেনির গল্প শুরু করতে পারি।
আমি ঠিক নিশ্চিত না, গ্রুমের মনের মধ্যে আসলে কী ছিল। অথবা জেমেকিসের। গাম্পের রিটার্ড এক্সপ্রেশনটারে হয়ত আরো বেশি প্রাণবন্ত অথবা বাস্তব করার লাইগাই কেবল জেনি ছিল; এজ আ নেসেসারি ম্যাটেরিয়াল। যুদ্ধের ময়দানে অথবা সবকিছুতে আনঅর্থোডক্সভাবে সফল হইয়া যাওয়া গাম্পের নিঃসঙ্গতা-ই হয়ত জেনি। যারে, যখন রাত নামে আর সবকিছু ঘুমাইতে যায় নিজের নিজের ঘরে; তখন মনে পড়ে। আকাশের নিচে, নক্ষত্রদের আলোয় যখন খালি শূন্যতা থাকে; তখন। হয়ত এইসবও কিছু না। গ্রুমের মনে একটা ভালো আর মিষ্টি মেয়ে ছিল যার বাবা মেয়েটারে শারীরিকভাবে নির্যাতন করত। যার শৈশব ছিশ নোংরা। ভীতির। মাতৃভালোবাসা শূন্য। আর এইগুলার প্রভাবে যে একসময় উচ্ছৃঙ্খল হইয়া যায়। খারাপ হইয়া যায়। গাম্পের আনঅর্থোডক্স প্লেইন মাইন্ড যেইটা কোন লজিক ছাড়াই পাগলের মত গ্রহণ করে। অথবা জেমেকিসও এইরকমই ভাইবা থাকবে যেমন জেনিই তবে গাম্পগল্পের শেষ ম্যাজিকটা থাইকা যাবে। একদিন আচমকা গাম্পের কাছে সে আসবে। তারা একসাথে ঘুম দিবে। মিলবে। আর সকালে গাম্প দেখবে, জেনি আবারও নাই। আর মইরা যাবার আগে গাম্পরে জানাইয়া যাবে, তার পেটে সে জুনিয়র গাম্পরে ধরছিল।
আমি এইসব চিন্তা বাদ দিতে চাই। এইগুলা বাদ দিয়া জেনিরে দেখতে চাই। আর কোনখানে জেনি আছে! জেনিরে এইভাবে মনে পড়তেছে আমার।
ধর, এইরকম কি কখনো হইছে তোমার যেমন আমি যা বলতেছি, তুমি তা শুনতেছ আর আমি যেইটা বলতেছি না, সেইটাই তুমি দেখতেছ? আর তা দেখতে দেখতে আমারেই তুমি বলতেছ, যেইখানে আমি শব্দহীন; আমার সবটা সেইখানে তড়পাইতেছে। এইভাবেই এইরকম জায়গাতেই কি মানুষ মানুষরে পায়?
সিনেমা অথবা কবিতা; আর্টের যে কোন জায়গার ভাষাটাই বোধ এইরকম। বাস্তব ঘটনাটা এইখানে একটা ডিস্ট্রাকশন; একটা প্রিমেডিটেইটেড ভ্রান্তি। আর ম্যাজিকটা যেইখানে ঘটতেছে ঠিক সেইখানেই ঘটনার কজ এন্ড ইফেক্ট।
যেমন জেনিরে দেখা যায়, ভিয়েতনাম যুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকার মাতাল প্রজন্মের সাথে কোন ভাবনা ছাড়াই মিইশা যাইতেছে। ব্যান্ড করতে চায় সে। এইটার জন্য সবকিছু করতেছে সে। মাতালদের সাথে ঘুরতেছে, শুইতেছে। যেইটাতে তার কোন ফেইথ নাই, তার পিছেও ছুটতেছে। ড্রাগ নিতেছে। তার বয়ফ্রেন্ড মারতেছে তারে; এইটাও মাইনা নিতেছে সে। গান গাইবার সুযোগ পাইছে; কাজেই বারের স্টেজে ন্যাংটা হইয়া গিটার বাজাইতেছে সে। তার গান শুইনা খদ্দেররা লম্পটেরা হাসতেছে। তারে গিটার সরাইয়া যোনী দেখাইতে বলতেছে। জেনি এইগুলাও ডিল করতেছে একা একা। এরমধ্যে ঘটনাক্রমে গাম্পের সাথে তার দেখা হইতেছে এইখানে সেইখানে। গাম্পের বিত্তবৈভব আর সাফল্যে চমকাইয়া যাইতেছে সে। আর গাম্পের একের পর এক অসহায় নিরেট গভীর ভালবাসার প্রস্তাবরে ফিরাইয়া দিতেছে; অনায়াসে। তারপর আবার হারাইয়া যাইতেছে জেনি। মিইশা যাইতেছে উচ্ছৃঙ্খল জীবনে; ড্রাগস আর প্রত্যাখান যেইখানে না চাইলেও পাইতেছিল সে; বারবার।
পুরা ছবিতে গাম্পের বিশাল অতিকায় অস্তিত্বটারে ঠেলতে ঠেলতে সরাইতে সরাইতে আমি ভাবতে থাকি, কী অস্বাভাবিকতা আছে এইসব ঘটনার মধ্যে। জেনির এই পলাইয়া থাকার ভিতর? দূরে সইরা থাকার ভিতর? গাম্পরে বারবার প্রত্যাখানের ভিতর? গাম্প সেই তরুন যারে লোকাল মাস্তানরা তাড়া করলে যে পাল্টা আঘাত করতে পারত না। গাম্প শুধু দৌড়াইত। শুধু দৌড়াইত। আর মাস্তানদের ক্লান্ত কইরা দিতো। জেনি ছিল এই ইদুঁরবিড়াল দৌড়ের সবচেয়ে কাছের দর্শক। বাপের বিকৃত যৌনতা থেইকা রক্ষা পাইতে প্রায় রাতে জেনি গাম্পের ঘরে লুকাইয়া চইলা আসতো। গাম্পের পাশে ঘুমাইয়া পড়তো।
গাম্প এইভাবে জেনির বাপের পুরাতন বাড়িটার মত এমন এক অতীত যেইখানে সে ছিল ভীত। অসহায়। অস্তিত্বহীন। যেইখান থেইকা সে বরাবর পলাইয়া যাইতে চাইত। পাখি হইয়া অনেক অনেক দূরে উইড়া যাইতে চাইত। গাম্প জেনির সেই অতীতের এমনি এক দৃশ্যমান ছায়া যেইটা তারে নিয়ত তাড়া কইরা বেড়াইত; আততায়ীর মত। কাজেই গাম্পের অস্তিত্ব গাম্পের প্রেম গাম্পের নির্দোষ আসক্তি জেনিরে টানতে পারে না। কিছুতেই। এমন কি গাম্প যখন আর সেই পুরান ল্যাংড়াটা নাই, রিটার্ডও না। এমনকি গাম্প যখন একজন ওয়ার হিরো, পিংপং চ্যাম্পিয়ন, সফল ব্যবসায়ী, জাতীয় নায়ক। এমন কি গাম্প যখন অঢেল বৈভবের মালিক। তখনও না। জেনি তারে কিছুতেই চায় না।
ক্লান্ত হইলে জেনি গাম্পের কাছে আসে। থাকে। কথা বলে। ফের চইলা যায়। ফের হারাইয়া যায় কোথাও। বারবার বিপদে গাম্পের ত্রাতা হইয়া আসাটারেও জেনি মাইনা নিতে পারে না। এমনকি গাম্পের সাথে যেইদিন শুইতে আসে জেনি, গাম্পের অবিশ্বাসটারে খুবই শুকনা কন্ঠে টোকা দেয় জেনি। আই লাভ ইউ, ফরেস্ট। করুণা ছাড়া এই কন্ঠে আর কিছুই ছিল না জেনির।
যাই হোক, নিজের এই কুত্সিত অতীত থেইকা জেনি কতটা বাইর হইয়া আসতে পারছিল, নিজের অস্তিত্বটারে কতটা শরীর দিতে পারছিল, জায়গা দিতে পারছিল এইরকম খুবই আনফ্রেন্ডলি পৃথিবীতে; এইটা নিয়া তুমি আর আমি কয়েক রাত তর্ক করতে পারি। রং চা খাইতে খাইতে। কিন্তু তোমার কাছে আমার জিজ্ঞাসা হইলো, গ্রুম অথবা জেমেকিসের তৈরী করা অতিকায় গাম্পের ভিতর অস্তিত্বের লাইগা জেনির লড়াইটারে তুমি দেখতে পাইছো কি না? জেনি পাখি হইতে চাইছিল। সে উইড়া যাইতে পারে নাই। জেনি ব্যান্ড করতে চাইছিল। সে শিল্পী হইতে পারে নাই। জেনি আত্মহত্যা করতে চাইছিল। সে মইরা যাইতে পারে নাই। শেষে সে একজন ওয়েট্রেস হইতে পারছিল বড়জোর। ছোটখাটো একটা রেস্টুরেন্টের। রোগতাপে মইরা যাবার আগে সে বাচঁতে চাইছিল। তার অস্তিত্বের লাইগা একটা জায়গা করতে চাইছিল। জেনি জেনির মত থাকতে চাইছিল। হয়ত কিছুটা পারছিলও বোধ হয়। কিছুটা জেনি; জুনিয়র গাম্পের ভিতর।