‘জেমস বন্ড’ সিরিজ – পর্ব ০১ । মোঃ অনিকউজ্জামান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫, ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ, | ২৬৯৯ বার পঠিত
‘জেমস বন্ড’ সিরিজের এ পর্যন্ত ৬ জন অভিনেতাকে নিয়ে ২৫ টি (আনঅফিসিয়াল ‘Never Say Never Again’ সহ) মুভি নির্মাণ করা হয়েছে। এখন এই মুভিগুলোর মধ্যে যদি বিভাজন করা হয় তবে ২১টি মুভি যাবে একদিকে আর বাকি ৪টি মুভি যাবে আরেকদিকে। এই ৪টি মুভি যথাক্রমে ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’, ‘কোয়ান্টাম অফ সোলেস’, ‘স্কাইফল’ এবং ‘স্পেক্ট্রা’। এই ৪টি মুভির একটি বিশেষত্ব আছে আর তা হল, এই ৪টি মুভির গল্প একই সুত্রে গাঁথা যা এর আগের ২১টি মুভিতে কখনো দেখা যায়নি। গত ২১টি মুভিতে ‘শন কনারি’, ‘রজার মুর’, ‘জর্জ লেজেনবি’, ‘টিমথি ডাল্টন’ ও ‘পিয়ার্স ব্রসনান’ অভিনীত ‘জেমস বন্ড’ চরিত্রটি ছিল প্রায় একই রকম। তাদের অভিনীত বন্ড কখনো হারতে জানে না, কাঁদতে জানে না, কষ্ট কি জিনিস তা জানে না, মেয়েদের শরীর ছাড়া কিছু বোঝে না, অপ্রতিরোধ্য, অভঙ্গুর ও অনেকটা সুপারহিরোর কাছাকাছি পর্যায়ের এক চরিত্র, ঠিক যেমনটি ‘জেমস বন্ড’ এর লেখক ‘ইয়ান ফ্লেমিং’ তার বইয়ে বর্ণনা করেছেন।
অতঃপর ২০০৬ সালে সিরিজের সব থেকে বিতর্কিত নায়ক ‘ডেনিয়েল ক্রেগ’কে নিয়ে গোটা ‘জেমস বন্ড’ সিরিজটি রিবুট করা হয় এবং তার জন্য বেছে নেয়া হয় সিরিজের সর্ব প্রথম ও সব থেকে দুর্বল গল্প এবং সিরিজের একমাত্র গল্প যেখানে কোন অ্যাকশন নেই। এদিকে ‘পিয়ার্স ব্রসনান’ এর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার পর হঠাৎ করে তাকে বাদ দিয়ে ভাঙ্গাচোরা ও বিদঘুটে চেহারার, খাটো, ছোট চুলের ‘ডেনিয়েল ক্রেগ’কে ‘জেমস বন্ড’ নির্বাচন করায় ভক্ত সমাজ ক্ষেপে গিয়ে ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ বর্জনের হুমকি দেয়। অবশেষে, সেই ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ যে মুভি নিয়ে রিলিজের আগে বিতর্কের শেষ ছিল না, রিলিজের পরে সেই সময় সিরিজের সব থেকে ব্যবস্যাসফল মুভিতে পরিণত হয় এবং সিরিজের সব থেকে বিতর্কিত বন্ড ‘ডেনিয়েল ক্রেগ’ পরিণত হয় সিরিজের সব থেকে সেরা বন্ড এ। সমালোচকেরাও তার অভিনয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু কি ছিল সেই মুভিতে যার কারণে সেই মুভি বদলে দিয়েছিল সিরিজের সকল হিসাব-নিকাশ?
প্রথমবারের মত আমরা ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ এ ‘জেমস বন্ড’কে দেখি আগের পর্ব গুলোর মত কোন সুপারহিরো নয় বরং একজন মানুষ হিসেবে যে কিনা আর দশটা সাধারন মানুষের মতই ভালবাসে, ভালবাসার মানুষকে হারিয়ে কষ্টে কাঁদে, ভুল করে, প্রতিপক্ষকে হারাতে প্রাণপন চেষ্টা করে, প্রতিপক্ষের আঘাতে ভেঙ্গে পড়ে, আবার উঠে দাঁড়িয়ে পালটা আঘাত করে। এই প্রথম আমরা ‘জেমস বন্ড’কে কাঁদতে দেখি, কষ্ট পেতে দেখি। মোটকথা, বন্ডকে এর আগে এমনটা মানবীয় ভাবে কোন মুভিতেই দেখানো হয়নি (‘অন হার ম্যাজেষ্টিস সিক্রেট সার্ভিস’ ব্যতিক্রম) এমনকি ‘ইয়ান ফ্লেমিং’ এর লেখাতেও না। অতঃপর পরবর্তী ৩টি মুভিতেও আমরা ‘জেমস বন্ড’কে দেখি একই মানবীয় গুণাবলিতে। ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ এ আমরা দেখি ‘জেমস বন্ড’ এর একদম গোড়ার দিকের কাহিনী যেহেতু এটি সিরিজের প্রথম গল্প ছিল। এই মুভিতে দেখানো হয় কিভাবে ‘জেমস বন্ড’ ’00’ (ডাবল 0 – মানুষ হত্যার লাইসেন্স) পজিশন লাভ করে, কিভাবে তার জীবনে ‘ভেসপার লিন্ড’ নামক এক ভালবাসার মানুষ আসে, কিভাবে সেই ভালবাসার মানুষকে হারিয়ে বন্ডের জীবনটা পালটে যায়, কিভাবে সে এত নিষ্ঠুর ও নির্মম হয়ে ওঠে।
মুলত এখান থেকেই ‘ইয়ান ফ্লেমিং’ তার পরবর্তী গল্প গুলোতে ‘জেমস বন্ড’কে এতটা অনুভুতী শুণ্য, নিষ্ঠুর করে তৈরী করেছেন কারণ বন্ড সব সময় একটি অজানা কষ্ট বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কখনো কাউকে তার জীবনে আপন করে নিতে চায় না কারণ সে তার সকল আপনজনকে হারিয়ে এ পৃথিবীতে সম্পুর্ণ একা আর প্রিয়জন হারানোর থেকে বড় কষ্ট এ পৃথিবীতে আর নেই। ঠিক সেই থিমটাই অনুসরন করা হয়েছে ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ এ…পরের পর্ব ‘কোয়ান্টাম অফ সোলেস’ এ আমরা বন্ডকে দেখি এক জখম হওয়া বাঘের ভূমিকায় যে তার প্রেমিকা হারানোর কষ্টে এতটাই জর্জরীত যে প্রতিশোধের নেশায় সে দুনিয়ার কাউকে, কোন বিধি নিয়মকে পরোয়া করে না। অনেকেই বলেন যে ‘কোয়ান্টাম অফ সোলেস’ ‘ডেনিয়েল ক্রেগ’ এর বন্ড সিরিজের সব থেকে দুর্বল মুভি যা আগাগোড়া শুধু অ্যাকশনে মোড়ানো এবং কোন গল্প নেই এই মুভিতে। এটা ঠিক যে ‘কোয়ান্টাম অফ সোলেস’ এ কোন গল্প নেই, হতে পারে এটি সব থেকে দুর্বল মুভি, কিন্তু আপনি যদি একজন পরিচালকের দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখেন তবে বুঝতে পারবেন যে সে আপনাকে কি গল্প শোনাতে চাচ্ছে। ‘কোয়ান্টাম অফ সোলেস’ শুরু হয়েছে একদম ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ এর পরে থেকেই। এই মুভিকে ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ এর পরিণতি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে যেখানে বন্ড এর এক অন্য রকম সাইকোলজি দেখানো হয়েছে যা কেউ দেখেনি এর আগে। বন্ডকে এতটা হিংস্র, নিষ্ঠুর ও প্রতিশোধপরায়ণ রুপে আর কোন মুভিতেই প্রকাশ করা হয়নি। প্রতিশোধের নেশা যে মানুষকে কতটা নিচে নিয়ে যেতে পারে এবং এর জন্য মানুষ যে কি না করতে পারে তার একটা বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে ‘কোয়ান্টাম অফ সোলেস’।
একবার নিজেকে বন্ড এর জায়গায় কল্পনা করে দেখুন, প্রিয়জন হারানোর প্রতিশোধের নেশা আপনার মাথায় থাকলে আপনি কি করতেন, তখন আর আপনার কাছে এই মুভি যুক্তিহীন, অনুভূতী শুণ্য বলে মনে হবে না। আমার কাছে এই মুভিটিই সিরিজের সব থেকে মানবীয় মুভি, যেখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বন্ডকে তীব্র কষ্ট বুকে নিয়ে চলতে হয়েছে এবং মুভির শেষ দৃশ্যে যখন বন্ড ‘ভেসপার’ এর ধোঁকাবাজ বয়ফ্রেন্ডের মুখোমুখি হয়, যার কারণে ‘ভেসপার’ এর জীবন ধবংস হয়ে গেছে তখন বন্ড তাকে মেরে প্রতিশোধ না নিয়ে তাকে জীবিত রেখেই চলে আসে আর এখানেই গল্পের সব থেকে বড় সাইকোলজি দেখিয়েছেন পরিচালক আর তা হল শুধু মাত্র শত্রু হত্যা করে প্রতিশোধ নিয়ে নিলেই মনের কষ্ট লাঘব হয় না। শত্রুকে পরাজিত করে ক্ষমা করে দেয়াটাই মহত্বের কাজ, আর এর ফলেই একমাত্র মনের মাঝে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। যে যাই বলুক না কেন, আমার মতে গোটা ‘জেমস বন্ড’ সিরিজে এমন একটি রিভেঞ্জ সাইকোলজির মুভি দরকার ছিল। আর এটা তো জানা কথা যে বন্ড যতটা হিংস্র হবে তার অ্যাকশনও হবে ততটাই ভয়ংকর আর তাই তো ‘কোয়ান্টাম অফ সোলেস’ গোটা ২৫টি বন্ড মুভির মাঝে সব থেকে ঝুকিপুর্ণ ও ভয়ংকর অ্যাকশন ধর্মী মুভি।
পরের পর্ব ‘স্কাইফল’ এ আমরা দেখি ‘জেমস বন্ড’ তার অতীতকে ভুলে সম্পুর্ণ কাজে মন দিয়েছে এবং একটি অপারেশনে ব্যর্থ হয়ে যখন সে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায় ও তাকে যখন অফিসিয়ালী মৃত ঘোষনা করা হয়, তখন সেও চায় এই অস্থির ও অনিশ্চিত জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে একটু শান্তিপুর্ণ জীবনের ছোঁয়া নিতে। এমনটাই স্বাভাবিক কারণ একবার যে এই জীবনে প্রবেশ করে সে অফিসিয়ালী ডেড না হওয়া পর্যন্ত এই জীবন থেকে মুক্তি পায় না। কিন্তু কর্তব্য যখন পথের মাঝেখানে এসে দাঁড়ায় তখন কর্তব্যকে পাশ কাটিয়ে পথ চলা খুব কঠিন হয়ে পড়ে, তাই বন্ডকে আবার ফিরে যেতে হয় সেই অন্ধকার দুনিয়ায় কারণ সে তার দেশ ও সংগঠনকে ভালবাসে। তবে এই মুভিতে বিচক্ষণ পরিচালক ‘স্যাম মেন্ডেজ’ অনেক ক্রিটিক্যাল একটি খেলা খেলেছেন যা সচারচর কোন স্পাই মুভিতে দেখানো হয় না। আমরা পুর্বের ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ ও ‘কোয়ান্টাম অফ সোলেস’ এ দেখেছি ভালবাসার জন্য বন্ডকে সব কিছু করতে, এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। ভালবাসা যে কারো জীবনে আসতেই পারে। আমরা ‘ডাই হার্ড’ ও ডাই হার্ড ফোর’ মুভিতে দেখেছি ‘জন মেক্লেইন’ কে তার স্ত্রী ও মেয়েকে বাঁচাতে, ‘টেকেন’ সিরিজে দেখেছি ‘ব্রায়ান মিলস’ কে তার স্ত্রী ও মেয়েকে বাঁচাতে, ‘মিশন ইম্পসিবল থ্রি’ তে দেখেছি ‘ইথান হান্ট’কে তার স্ত্রী কে বাঁচাতে, এভাবে খুঁজলে অনেক স্পাই মুভির রেফারেন্স পাওয়া যাবে। কিন্তু কোন মুভিতে আমরা খুঁজে পাব না যে কোন এজেন্টকে তার বসকে বাঁচাতে বিশেষ করে সেই বস যদি হয় তার মায়ের বয়সী এক মহিলা। এখানেই হচ্ছে আসল সাইকোলজিক্যাল গেম। ‘জেমস বন্ড’ একজন এতিম যে কিনা তার জীবনে স্নেহ, মায়া, মমতা খুব কম পেয়েছে এবং কষ্ট পেয়েছে বেশী।
তাকে যদি ‘ব্রুস ওয়েইন’ এর সাথে তুলনা করা হয় তবে বলা যায় যে তারা দুজনে একই পথের পথিক। কর্মক্ষেত্রে বন্ড কাজ করেছে ‘অলিভিয়া ম্যান্সফিল্ড’ ওরফে ‘এম’ নামক একজন বয়স্ক মহিলার আন্ডারে যে কিনা বন্ডকে তার ভুল ও অনিয়মে একাধারে শাসন করেছে আবার অনেক বড় বিপদ ও ক্রিটিক্যাল মুহুর্তে ছায়ার মত তার পাশে থেকে তাকে রক্ষা করেছে। সব মিলিয়ে তাদের দুজনের সম্পর্কটা কোন অংশে একজন মা ও ছেলের থেকে কম না যদিও তারা সব সময় একে অন্যের প্রতি ফিলিংস গুলো অপ্রকাশিত রেখেছে বস ও কর্মচারী এই দুই সম্পর্কের বেঁড়াজালে। আর যখন এই ‘এম’ এর জীবন সংকটে পড়ে তখন বন্ড তাকে বাঁচাতে নিজের জীবনের সর্বোচ্চ ঝুকি নিয়েছে, ফিরে গিয়েছে তার অতীতের স্মৃতিময় বাসভবন ‘স্কাইফল’ এ যা সে জীবন দিয়ে ঘৃনা করতো। কিন্তু তার পরেও সে তার ‘এম’কে বাঁচাতে পারেনি। আমরা একবার দেখেছি ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ এ বন্ডকে কাঁদতে যেখানে বন্ডের কোলের উপর ছিল তার ভালবাসার মানুষের মৃতদেহ, আবার আমরা ঠিক একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তী দেখি ‘স্কাইফল’ এ যেখানে বন্ডের কোলের উপর ছিল তার এ পৃথিবীর শেষ আপনজন যে কিনা থাকে শাসন ও স্নেহ দিয়ে সব সময় আগলে রাখতো ও যাকে বন্ড নিজের অজান্তেই ভালবাসতো অনেক। যে কষ্টের সমাপ্তী ঘটেছিল ‘কোয়ান্টাম অফ সোলেস’ এর শেষে, ঠিক সেই কষ্টই আবার ‘স্কাইফল’ এর শেষে তাড়া করে ফিরে আসলো বন্ডের জীবনে।
‘জেমস বন্ড’ এর সারা জীবনে তাড়া করে বেড়ানো এই কষ্টের পিছনে কার হাত আছে ? বন্ডের অজান্তেই বন্ডের জীবনের কলকাঠি নাড়ছে কে ? তার সাথে বন্ডের কিসের সম্পর্ক ? কিসের শত্রুতা ? বন্ড তার অতীতের কিছু একটা লুকাচ্ছে, কি তার সেই অতীতের রহস্য ? বন্ডের জীবন থেকে একে একে তার ভালবাসার মানুষ ও আপনজনদের সরিয়ে দিচ্ছে কে ? এই সব প্রশ্নের উত্তরে শুধুমাত্র একটি নামই পাওয়া যায়, আর তা হল ‘স্পেক্ট্রা’… !!!