পাতার পাহাড়, রক্তবর্ণ হিম আর উষ্ণবয়সী ব্ল্যাকবোর্ড । পাপড়ি রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ আগস্ট ২০১৫, ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ, | ৩৩৮৩ বার পঠিত
পাতার পাহাড়
টিলার উপর থেকে রাবার বাগানটাকে একেবারে পাতার পাহাড়ের মতো দেখায়। রাবার প্ল্যান্টগুলোর পাতাই কেবল দৃশ্যমান হয় বলে প্রাথমিকভাবে আমাকে এই বিভ্রমের ভেতর পড়তে হয়েছিল। অবশ্য এই বিভ্রমের ভেতর নাস্তানাবুদ হওয়ার পূর্বে আমি ঝুক্কুর-ঝুক্কুরের দুর্দান্ত স্বাদ পেয়েছিলাম। আদতে ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে যেনতেন প্রকারের স্বাধীনতা নয়। দীর্ঘকাল ফাটকবাসের পর এক্কেবারে গ্যাসবেলুনের মতো উড্ডিন হতে পারা। উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে আকাশ ছুঁয়ে ফেলার মতো ঘটনাই ছিল সেটা। আমার আতঙ্কবাদী বাবা ওই প্রথমবার আমাকে ঘরের বাইরে দুই পা ফেলতে দিলেন। আর আমার এই-রকম গ্যাসবেলুন হয়ে ওড়ার সুযোগ ঘটল রাজা কাক্কার কল্যাণে। রাজা কাক্কা মানে বাবার ফুপাতো ভাই। তদুপরি তিনি ফরেস্টার বা আরও উর্ধ্বতন কোনো পদে কর্মরত। বাবা তাকে মোটামুটি দেবতা জ্ঞান করেন। রাজা কাক্কার মেয়ে বিউটি আপা আমার চাইতে পাঁচ ক্লাস উঁচু। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে যে কিনা আমারই ইশকুলে ভর্তি হলো। আর বিউটি আপার সাথে আমার খাতির জমলো দুধে-ভেজানো চিতইয়ের মতো। যাতে কেবল চিৎ হয়ে ভেসে থাকা। উপুড় হওয়ার মতো কোনো ঘটনাই ঘটল না কোনোদিন! রাজা কাক্কা আর বিউটি আপার ব্যাপক টানাহেঁচড়ায় আমার আতঙ্কবাদী বাবার দিল্ সামান্য নরম হলো। কিন্তু বন্দুকটা রইলো আমার দিকে তাক করা। এই আরেক বিভ্রম! ভয় আর ভালোবাসা। দোস্তি আর ঘৃণা। আমি জানি তাক-করে-রাখা বন্দুকের নলটি অন্যত্র সরিয়ে নিলে বাবা একেবারে অন্য মানুষ। সদ্য-জন্মানো শিশুর গায়ের পেলবতা সেই মানুষের মনে সেঁটে থাকে। অচেনা রূপ-গন্ধ-আশ্রয়। অথচ অহেতুক এই বন্দুক তাক করে রাখা — বাবাকে একেবারে আতঙ্কবাদীতে পর্যবসিত করেছে।
নেমে দেখি ফরেস্টের জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। জিপে ওঠার পর চলন্ত জিপের পেছনের খোলা অংশে তাকিয়ে দেখি, কোথায় সেই পাহাড়ের সারি? কোথায়ই-বা রেললাইন? সব হাওয়া হয়ে বিস্তীর্ণ সবুজ আমাদের ঘিরে রেখেছে! গাছেদের-পাতাদের এতটাই মেশামেশি যে কোনটা-যে কি গাছ তা-ও আলাদা করা দুরূহ। সেই নিবিড় বনরাজি, গাঢ় সবুজ গাছপালা আর পাখিদের বিচিত্র ডাক শুনতে শুনতে দেখি সেগুনের প্রায়-গোলাকার ঢাউস পাতারা আকাশচারি হয়ে আছে। ত্রিপল-ঢাকা জিপের ভেতর সবুজ গন্ধ ভরে উঠলে আমি মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠি — একটা গাছ আমি অন্তত চিনতে পেরেছি — সেগুন!
যখন আমার অপু-দুর্গার মতো গ্রামময় এক ছেলেবেলা ছিল, তখন আমি সেগুনকে বেশ ভালোই দেখভাল করতাম। কেউ তো আর জানে না — বোশেখের ঝড়-বৃষ্টির পর সেই গাছের নিচে পড়ে-থাকা ছিন্নপত্র ও গোটা-গোটা ফল দেখার লোভে কতদিন আমি ছুটে গেছি! সেগুনের পাতা ডলে দুইহাত রাঙিয়ে তুলেছি! ওইসব খবর কেই-বা রাখে? ওই অপু-দুর্গার জীবনে কেই-বা আমার গতিবিধির উপর কড়া নজরদারি করবে?
আমার আতঙ্কবাদী বাবার খপ্পরে পড়ার আগে গ্রামময়, বৃক্ষময়, বৃষ্টিময় — স্বাধীন এক ছোটকাল আমাকে মারাত্মক সুখী করে ছিল!
আমার সেই ছোটকালেই সেগুন আমার সঙ্গী হয়েছিল। সেগুনের ফুল ছিল হাল্কা ঘিয়ে রঙের। আকাশের তারার আকৃতির। সেই ফুল নাকের পাতায় বসালেই পড়ে যেত। আমি ফের বসাতাম।
এভাবেই দিনমান ফুলের উত্থান-পতন খেলায় মেতে থাকতাম। সেগুনের অনতিদূরে বাতাবিনেবুর গাছ। তাতে যখন ফুল ঝেঁপে আসত — আহা, কী যে তাদের রূপ আর সুগন্ধ! আমাদের ছুটন্ত জিপের কোনো ধারেই বাতাবিনেবুর একটা গাছও নজরে এল না!
শুধু গাছের গন্ধভরা, পাতার গন্ধভরা সবুজ হাওয়া কেটে কেটে আমাদের জিপ এগিয়ে চলল।
জিপ থামল বেশ উঁচু একটা টিলার নিচে। নেমে দেখলাম সুদীর্ঘ সিঁড়ি টিলাটাকে দুইহাতে পেঁচিয়ে ম্যালাদূর উঠে গেছে। আমরাও আমাদের তল্পিতল্পা সহ উঠতে লাগলাম। যতই উপরে উঠতে লাগলাম চারপাশে সন্নিবিষ্ট সবুজ পাতা ছাড়া আর কোনো দৃশ্য নাই! ওই প্রত্যন্ত পাহাড়িয়া অঞ্চলে বৃক্ষ আর আকাশ ছাড়া আর যেন কিছ্ইু নেই!
সিঁড়ি আর শেষ হয় না। উঠতে উঠতে হাঁপ ধরে যায়। জলতেষ্টায় কণ্ঠ কাঠ-কাঠ হয়ে উঠলে — রাজা কাক্কার সুবিশাল বাংলো।
টিলার উপরের ওই বাংলো থেকে চারপাশে তাকালে দুই-চারটা চূড়া দেখতে পাওয়া যায়। ওইসব পাহাড়ি ছড়া বা ঝর্ণার জলে রোদ্দুর পড়ে রূপালি রঙের নহর বইয়ে দিচ্ছে।এই যে একেবারে ছবির মতো সাজানো পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্যাবলি — যা দেখে মনে হয় স্বর্গ কোনোভাবেই এর চাইতে উত্তম হতে পারে না। তবে সবচাইতে আনন্দের বিষয় এইখানে আমার আতঙ্কবাদী বাবা নাই। তার কড়া শাসন আর প্রচণ্ড মারধরের উপদ্রব নাই।
আহা! স্বাধীনতা! স্বাধীনতা সব সময়ই জীবনকে আনন্দময় করে দেয়। আমাকে যদি আর ফিরতে না হতো ওই মারধরের সংসারে! যেখানে এক নিষ্প্রভ বুদ্ধির মা তার তৈজসপত্রের মতো নিজের মেয়েটিকেও এককোণে ফেলে রাখে — অযত্নে-অবহেলায়!পরদিন ঘুম ভাঙতেই দেখি রোদ্দুর বাংলোটিকে স্পর্শ করে হেসে আছে! যেদিকে তাকাই সবুজের নানারূপে একেবারে ব্যারাছ্যারা অবস্থায় পৌঁছে যাই। আদতে এইসব হলো সিদ্ধান্তহীনতার ঘোর। কোন সবুজ যে আমার নয়ন জুড়িয়ে দেবে আর আমি সেদিকেই নির্ণিমেষ তাকিয়ে থাকব!
বাংলো থেকে নিচে তাকালে পা শিরশির করে। বিস্তর সবুজের ভেতর আমার ঘূর্ণায়মান আঁখি হঠাৎ করে খুব কাছে এক রূপার নহরের সন্ধান পেয়ে যায়। সবুজ বনানীর মাঝখানটা চিরে যেন গলিত রূপার ধারা বইছে। আর ওই রূপালি স্রোত বহু নিম্নে সমতলভূমির ওপর সর্পিল গতিতে বয়ে চলেছে।
বাংলোতে দাঁড়িয়ে আমি ওই ঝর্ণার কল্লোল শুনছি। আহা! কে জানে, মরণের পর স্বর্গ কেমন? কেউ তো ফিরে এসে বলে নাই স্বর্গের রূপ আসলেই কেমন?
কিন্তু আমি জানি, এই বন-বনানীর সবুজ আর নমিত ঝর্ণাধারার চাইতে স্বর্গ কিছুতেই উত্তম হতে পারে না।
.
রক্তবর্ণ হিম
লোকালয় পেরিয়ে বহুদূরে বরমচালের রাবার বাগানটিতে যে সবুজরাজ্য গড়ে উঠেছে — তাতে হিমও যেন নামে একেবারে আপোসহীনভাবে। কারণ সূর্যের আলো ওই অরণ্যে বা বনানীতে ছিটকি পাতার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রবেশ করে। রাতভর উশ্ পড়ে পাতার উপর আর ওই উশ্ বৃষ্টির ফোঁটার মতো টপটপিয়ে ঝরতেই থাকে। ভোরে ঘুম ভাঙলেই দেখি অপরূপ দৃশ্যাবলি। দূর্বাঘাসের উপর অজস্র ছোট ছোট হীরে যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে।ঘুম ভাঙার পর ঝর্ণার থেকে তোলা জলে মুখ-হাত ধুয়ে নাস্তা খেতে হয়। প্রতিদিনের নাস্তার মেন্যু ঘরে-তৈরি কাঁচা ছানা। হাতে-বেলা রুটি। ছোলার হালুয়া। কোনো কোনো দিন গরম ভাত, ভর্তা। বাসী তরকারী। বাংলোতে কোনো পানি-সাপ্লাইয়ের বন্দোবস্ত নাই। পানি আনতে হয় অনেক নিচুতে গিয়ে ঝর্ণা থেকে। সেই পানি রোদের বুকে ফেলে গরম করা হয়। এবং ওতেই চলে স্নান।প্রায় বিকেলেই আমি আর বিউটি আপা হাঁটতে বেরোই। হাঁটবার জন্য আমাদের সুদীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয়। আমরা হাঁটি রাবার বাগানের ডানা ঘেঁষে। কখনো-বা রাবার বাগানের ভেতর। গাছেদের আর পাতাদের ঝাঁঝালো সবুজ গন্ধে আমাদের বুক ভরে ওঠে। তখনো হয়তো সূর্যাস্তের ঢের দেরি। কিন্তু চারপাশে কি-রকম সবুজাভ অন্ধকার। বিউটি আপা বেশ ভারি ধরনের কার্ডিগান গায়ে চাপিয়ে হাঁটে। আমার সে-রকম উষ্ণ কোনো শীতের কাপড় নেই। আমাকে পরতে হয় আমার আতঙ্কবাদী বাবার খামখেয়ালিতে-বানানো কোট স্টাইলের একটা জামা। সামান্য ভারী কাপড়টা — কিন্তু ভেতরে কোনো নাইলনের বালাই নেই। ফলে যত শীত সবটাই ওতে হুড়হুড়িয়ে ঢুকে পড়তে পারে। এবং ঢুকে পড়েও। আমি শীতের বিষাক্ত কামড়ে মরণাপন্ন হয়ে উঠলেও কাউকে কিছু বলি না। আমার কোনো দীনতাই অন্যকে বলতে লজ্জা লাগে।হাঁটতে হাঁটতে বিউটি আপা বাঁ-হাতের বুড়া আঙুল যখন-তখন পুরে চুষতে থাকে। এটা তার প্রিয়তর অভ্যাস। যখন আশেপাশে কেউ না-থাকে বিউটি আপা তার এই অভ্যাস বজায় রাখে।এদিকে আমি বয়সে ছোট ও বিউটি আপার প্রিয় বলে এই কাজটি সে আমার সামনে হরহামেশাই করে। ওই-রকম সবুজাভ অন্ধকারের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে বিউটি আপা একদিন বলে ওঠে —
—গণ্ডারের গন্ধ পাচ্ছি।
—কী! মানে কি?
—গণ্ডার নেমেছে পাহাড় থেকে। রয়েছে আমাদের কাছ থেকে সামান্য দূরেই।
—কী?
—হ্যাঁ, আমি গণ্ডারের গন্ধ চিনি।শুনে ভয়ে আমার গায়ের লোম জারিয়ে যায়।বন্য জীবজন্তুও তাহলে রয়েছে এই অরণ্যে? ঘন জঙ্গল কেটে রাবার চাষ করা হয়েছে — মানুষের কিছু ঘরবাড়িও রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কিন্তু তা প্রায় না-থাকার মতোই। তবুও একেবারে জনমনিষ্যি নাই এমন তো নয়! এর মাঝে গণ্ডার কীভাবে আসে?চিন্তা যত দ্রুতই করি না কেন — ওই সূর্যের আলোহীন সবুজাভ বিকেলে কোনোকিছুকেই প্রতিরোধ হিশাবে দাঁড় করাতে পারি না। হয়তো আমার মতো বিউটি আপাও পারে না। আমরা জানি, সূর্য জঙ্গলের আড়ালে হারিয়ে গেলে চারপাশ কত দ্রুত ঘন অন্ধকারে পূর্ণ হয়ে ওঠে। আর সিঁড়ি বেয়ে ওঠা কতটাই-না ঝুঁকির। ভাবতে ভাবতেই শীত যেন হঠাৎ আমাদের আরো আচ্ছন্ন করে ফেলে। আমরা জানি না — শীতের তীব্রতায় না গণ্ডারের ভয়ে আমাদের দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠক শব্দ তুলতে থাকে। যদিও খুব মৃদু সে-ধ্বনি। কিন্তু বিউটি আপা বা আমি দুজনেই সে-ধ্বনি থামাতে পারি না। প্রায় দৌড়ে বাগান থেকে বেরিয়ে আসি। বিউটি আপা সাধ্যমতো চেষ্টা করে আমার সঙ্গ ধরতে। কিন্তু আমি এত জোরে দৌড়াই যে মুহূর্তে রাবার বাগানের দীর্ঘকায় গাছগুলো দূর ছবির মতো অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিউটি আপা হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে দৌড়ের গতি বাড়ায়। আমরা যখন টিলার উপরে উঠি তখন ওই সবুজাভ অন্ধকার ঘন কালোতে রূপ নিয়েছে।আমাদের ঘেমে-নেয়ে-ওঠা শরীর গরমকাপড়ের আড়ালেই থাকে। ঝর্ণার তোলাজলে মুখ-হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে প্রবল কাশির চোটে আমি একেবারে কাস্তের মতো বেঁকেচুরে যাই।আমার মনে হয় প্রচণ্ড এক হিমখণ্ড আমার বুকের ভেতর ঢুকে পড়েছে। ফলে বেদম কাশিতে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।বিউটি আপার আম্মা রসুন থেঁতো করে সর্ষের তেলে গরম করে আমার বুকে-পিঠে জোর মালিশ দেন। কিন্তু আমার কাশির উপশম হয় না।
বিউটি আপা তার ঢাউস ট্রেঞ্জিস্টারের নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গান বাজায়। একেবারে লো ভলিয়্যুমে। আমি বলি —
— আরেকটু জোরে বাজান
— না, না আর জোরে না।
— কেন?
— মানুষ শুনলে মন্দ বলবে।
গান বাজালে মানুষ মন্দ বলবে? আমি এই রহস্যের কোনো কূল-কিনারা পাই না। বিউটি আপাকে দেখি ট্রেঞ্জিস্টারের সাথে কান লাগিয়ে গান শোনে। ফলে আমাকেও কান লাগিয়ে গান শুনতে হয়। আমার কান ব্যথা করতে থাকে আর কাশিও বাড়তে থাকে।
এদিকে চাচিমা আমাকে প্রতিদিনই গোসল করতে বলেন। বলেন, —
— গোসল কর, গোসল কর নইলে কফ বুকে শুকাইয়া যাইব।
আমি সূর্যের নিচে ফেলে-রাখা কুসুমগরম পানিতে হররোজ গোসল করি।
বিকাল হলেই রাবার বাগানের ধারে বা ভেতরে বা ঘাসময় দীর্ঘ জমির উপর হাঁটতে থাকি। সঙ্গে বিউটি আপা। আমার পরনে আমার আতঙ্কবাদী বাবার খামখেয়ালিতে বানানো সেই কোট। ভেতরে নাইলন ছাড়া। ফলে পাহাড়-টিলা-অরণ্য-ঝর্ণার যত হিম সব আমার শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। আমার কাশির বেগ বাড়ে। ঝর্ণার খুঁসখুঁসে জ্বরে আমি অবসন্ন হয়ে পড়তে থাকি।
ওই পাহাড়-অরণ্য-ঝর্ণা আর বিশুদ্ধ বাতাস, তাজা ছানা-হালুয়া-রুটি কিছুই আমার জ্বর কমাতে পারে না। এমনকি আমার কাশিও কমে না।
জ্বর-কাশি নিয়েই আমি রাবার বানানোর প্রক্রিয়া দেখি। কিভাবে রাবারের বৃক্ষ কাটা হয়, কিভাবে তাতে টিনের পাত্র পেতে দেয়া হয়, কিভাবে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিয়ে সেই রাবারের মণ্ড তৈরি করা হয়।
এদিকে চাচীমার গরম সর্ষের তেল আর রসুনের মালিশে আমি বিব্রত হতে থাকি। কারণ আমি দেখি আমার সমতল বুকে পক্ষীশাবকের নরম রোঁয়া উঠেছে। ডিমের কুসুমের মতো কুঁড়িস্তন আমাকে সংকুচিত করে তুলছে!
ধুর! চাচিমা খামাখাই এত কষ্ট করছে। আমার কাশি তো কিছুতেই কমছে না!
এদিকে অরণ্য বা পাহাড়ের কোনো পরিবর্তন নাই। এমনকি ঝর্ণাধারারও। বাংলোর উপর থেকে তার জলপতনের শব্দ আমি শুনতে পাই। চাচিমার আর্দালি-বেয়ারারা ওই জল টিনের পাত্রে ভরে উপরে উঠিয়ে নিয়ে আসে।
আহ্! একেবারে বিশুদ্ধ জল!
এই পাহাড়ের হাওয়া বিশুদ্ধ। গাছতলা-বৃক্ষরাজি তাদেরও উদ্ভাসিত তারুণ্য।
আর আছে বান্দরের মেলা! প্রায়ই গাছ থেকে নেমে এসে তারা চাচিমার নানানকিছু নিয়ে পালিয়ে যায়! তাদেরে ধরার সাধ্য কারো নাই।
আর আছে পাখিদের বিচরণ। কত বর্ণ-গোত্রের পাখি! কত বিচিত্র তাদের কথাবার্তা! বিশাল-বিশাল রক্তচোষা! ভয়ে আমি একা কোথাও যাই না।
রক্তচোষা যদি আমার সব রক্ত চুষে নেয় এই ভয়েই কিনা কে জানে আমার শরীরের রক্তকণারা জোট বাঁধে। অবশ্য আমি তা আদৌ বুঝতে পারি না।
আমি পুনরায় ত্রিপলঢাকা জিপগাড়িতে চেপে বসি। বিউটি আপা সজল চোখে তাকিয়ে থাকে। চাচিমা বলেন,—
—ফের আইসো বাপ! ইশকুল ছুটি হইলেই আইসো।
আমার আতঙ্কবাদী বাবা আমাকে নিতে এসেছে। ফের সেই ভয়াবহ কারাগার! ফের বন্দিজীবন! ফের বৃক্ষহীন নগর। বিষাক্ত হাওয়া। ট্রেন আমাকে হাওয়ার টানে উড়িয়ে নিতে থাকে। বরমচালের অরণ্যে আমি কত-যে কাঠবিড়ালী দেখেছি! কত পাখি! আর তাদের গান!
কেন-যে আমি মানুষ!
কাঠবেড়াল হলেও তো লুকিয়ে থাকতে পারতাম গাছের কোটরে।
দুইপাশের লালমাটির পাহাড় ফেলে ট্রেন কি ভীষণ জোরে ছুটে চলেছে!
পাতাদের সবুজ ঘ্রাণ হাওয়া থেকে ক্রমে হারিয়ে যেতে থাকে।আমি কি তাকালেই দেখতে পাবো ওই নিবিড় স্নেহচ্ছায়াময় সবুজ বনভূমি?
জানি — পাবো না।ফেলে-আসা কোনোকছিুই মানুষ কোনোদিন অক্ষত ফেরত পায় না!.
.
উষ্ণবয়সী ব্ল্যাকবোর্ড
আমাদের বাগানের ঘাসগুলা কি অতটাই সবুজ?বিউটি আপার সাথে যে-ঘাসে আমি হেঁটেছিলাম তাদের মতো?আমি তাকিয়ে তাকিয়ে ঘাসেদের সবুজ হওয়া দেখি, কিন্তু কিছুতেই ওই সবুজের সাথে মেলাতে পারি না। আমাদের বাসার ভেতরে অরণ্যের ঘ্রাণ নেই — কেরোসিন তেলের ঘ্রাণ থইথই করে। মা ওই তেলে স্টোভ জ্বালিয়ে রান্নাবান্না করে। এদিকে তরল কাশির দমকে আমার শরীর আরো অনেক বেশি বেঁকেকুকে যায় — আমি কাশতে কাশতে দম নিতে পারি না।আমাদের শাদাগোলাপ গাছে বিস্তর কুঁড়ি এসেছে। কয়দিন পরই ফুল ফুটিয়ে গাছটিকে এরা ঢেকে দেবে। নানারঙের জিনিয়া আর গোলাপি-শাদা দোপাটিফুলের সারি দেখতে দেখতে আমার পাহাড়ের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। গণ্ডারের গন্ধভরা বিকেল। আমাদের ত্রাস আর দৌড়ানো শুরু করা। ওই গভীর নির্জন অরণ্যে — ওই সবুজাভ সন্ধ্যাবেলায় আমাদের ত্রাণকর্তারূপী কেউ ছিল না। ফলে আমাদের দৌড়াতে হয়েছে। বেদম দৌড় যাকে বলে।
আমি আমাদের বাগানের ঘাসেদের রকমসকম দেখতে দেখতে প্রচণ্ড কাশিতে ফের বাঁকাকুকা হয়ে যাই।
তরল লবণাক্ত কফ ফেলতে ফেলতে হঠাৎ চমকে উঠি। দেখি রক্তের মতো কি-যেন ঘাসের ভেতর গড়িয়ে যাচ্ছে।
রক্ত!
সত্যিই রক্ত নাকি?
ফের কাশি ওঠে। ফেলতে ফেলতে ফের চমকাই।
রক্ত!
আহা! সেই-যে হিমের বিকেল — পাহাড়ের সেই প্রচণ্ড হিম কি রক্তবর্ণ ধারণ করে আমার ফুসফুসের ভেতরবাসা বেঁধেছে!
তৃতীয়বারের কাশিতে ঘনরক্ত উঠে আসে।
আর বাগানের ঘাসে সেই রক্ত লাল ফড়িংয়ের মতো ঝুলে থাকে।
আমি আমার আতঙ্কবাদী বাবাকে ডাকি।
— বাবা কাশির সাথে রক্ত যাচ্ছে!
— কি বলিস! কই, দেখি?
— বাগানের ঘাসে।
বাবাকে বলা হয় না ঘাসের উপর বসে-থাকা লাল ফড়িংদের পিছু পিছু আমি কত সাবধানে পা ফেলেছি। দুইহাতে ডানা দুটো যেই ধরতে যাব — হঠাৎ সে উড়ে গেছে! আর আমি সে-দুঃখে প্রায়ই কেঁদে ফেলেছি।
আজ সেই লাল ফড়িঙের দল আমাদের বাগানের ঘাসের উপর স্থির বসে আছে। ভারি অদ্ভুত কাণ্ড তো!
বাগানের ঘাসে রক্তচিহ্ন দেখে বাবা ভয়ানক গম্ভীর হয়ে যায়!
আমাকে আর কিছুই বলে না।
এরপর থেকে আমার ইশকুল কামাই হতে লাগল। বিকেলের খেলার সাথীরা আমাদের বাসায় আসা ছেড়ে দিলো।
আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ক্রমাগত কাশতে লাগলাম। রক্ত ঝরে ঝরে আমার ফুসফুস প্রায় শূন্য হয়ে গেল। অবস্থা দেখে বাবা প্রায় উন্মাদগ্রস্ত হয়ে উঠলেন। এ-ডাক্তার, সে-ডাক্তার — ছোট-বড় সব ডাক্তার জড়ো করে ফেললেন। ওষুধ-পথ্য-এক্সরে-জ্বর-চাদর এইসবের মাঝে আমার জীবন কী অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে গেল!
আমি রাতভর কাশতাম। আমার বিছানার পাশে ছাইভরতি বাসন দিয়েছে মা। যাতে বাতাসে জীবানু না ছড়ায়। ভোর হতে হতে রক্তে ভিজে সব ছাই দলা পাকিয়ে যেত!
আমিও অবাক হতাম — আমার এতটুকুন শরীরে কি করে এত রক্ত এল?
এই-যে অবিশ্রাম কাশছি — কাশির সাথে টকটকে তাজা রক্ত উঠে আসছে — তবুও কেন রক্ত নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে না আমার শরীর থেকে?
সকালে ঘুম ভাঙতেই আমার মনে পড়ে যেত ইশকুলের কথা। ক্লাসটিচার রাবেয়া খাতুন ব্ল্যাকবোর্ডে চকখড়ি দিয়ে তারিখ লিখছেন। তাঁর দুধশাদা আঙুলে চকখড়ি ধরে-রাখা। সরু সরু চমৎকার আঙুলগুলো চকের গুঁড়োতে মাখামাখি! রাবেয়া খাতুন, আমার খাতায় প্রায়ই লিখে দেন ‘ভালরাখা’।
‘ভাল রাখা’ মানে কি?
একদিন লিখলেন ‘রাখা’।
আমি বুঝলাম ‘ভালরাখা’ মানে গুড ধরনের কিছু হবে। আপার নাম আসলে রাখা — রাবেয়া খাতুন। রক্তের সমুদ্দুরে ভাসতে ভাসতে আমার শুধু ইশকুলের কথাই মনে পড়ে। খরস্রোতা নদী পেরিয়ে আমার ইশকুল — আমার ক্লাসরুম আর সহপাঠিরা। এদিকে মাকে দেখি আমার খাবারের গ্লাস-প্লেট সব আলাদা করে দিয়েছে। আমার প্লেটে সে কাউকে খেতে দেয় না। অন্যদের প্লেট-গ্লাসে আমাকেও। এটা সে এতটাই চাতুরির সাথে করছে যে আমার আতঙ্কবাদী বাবা টেরও পায় না।
আমার কি ভয়ঙ্কর কোনো অসুখ করেছে?
নইলে মায়ের এত সাবধানতা কেন?
আমি একদিন খেতে বসে কেঁদে ফেলি!
বাবা চোখ লাল করে জানতে চায় —
— কি হইছে কান্দস কেন?
আমি বলি —
— আমার খাওয়ার প্লেট-গ্লাস মা আলাদা করে দিয়েছে।
— কোনটা তোর?
আমি আঙুল তুলে একটা লাল বর্ডারের প্লেট দেখিয়ে দিলে বাবা ওতে খেতে বসে যায়।
বাবার মুখ দেখি থমথম করে। দেখি বাবাও কাঁদছে।
আমার মনে হয় — আমার শরীরটা পাখির মতো হাল্কা হয়ে গেছে! এখন আমি যেন ইচ্ছে করলেই উড়ে যেতে পারি। উড়ে উড়ে বরমচালের রাবার বাগানে পৌঁছে যেতে পারি। ওইখানে যে-ঝর্ণা বইছে, সে-ঝর্ণা পান করে ফিরে আসতে পারি। অথবা ওই সবুজ বনভূমির প্রতিটি বৃক্ষের পাতায় পাতায় দোল খেতে পারি। ঠোঁট দিয়ে খুঁটে দিতে পারি পাতাদের শিরা-উপশিরা।
অথবা উড়তে উড়তে ওই অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলতে পারি। হয়তো তখন অন্ধকার ঘনায়মান। বানরের দল গাছের ডালে চুপটি করে বসে বসে অপেক্ষা করছে রাত্তিরের।
অন্ধকারের ভয়ে আমার পাখিশরীরটা নিমিষে লুকিয়ে ফেলতে পারি পাতাদের আড়ালে, যাতে কেউ আমাকে আর খুঁজে না পায়। আমি অরণ্যের গন্ধের ভেতর, বিশুদ্ধ হাওয়ার ভেতর, ঝর্ণার জলের ভেতর একাকার হতে হতে ভুলে যেতে পারি সংসারকারাগার। যেখানে বাড়াবাড়ি শাসন, কড়া পড়ার চাপ, প্রচণ্ড মারধরে আমার ছোট্ট শরীরটা প্রায়ই নীলাভ হয়ে থাকে। সেই জখমচিহ্নের দিকে তাকিয়ে আমি সারারাত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি। একটা জখম না-সারতেই আরেকটা জখমের চিহ্ন তীব্রভাবে শরীরে বসে যায়।
অবিরাম কাশি, রক্তপাত, ওষুধ, পথ্য, চাদর, বালিশ, বিছানার সঙ্গে আমার আতঙ্কবাদী বাবা সেঁটে থাকে। আমার ভয়ানক অসুস্থ শরীরটাকে সারিয়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু আমি তো সেরে উঠতে চাই না। সেরে উঠলেই আমার শরীরটা আর পাখি থাকবে না। ভারী শরীর নিয়ে আমি কি আর উড়তে পারব? কিন্তু আমাকে-যে উড়তেই হবে!
উড়ে উড়ে যেতে হবে ওই পাহাড়ে। ওই অরণ্যে। ওই অরণ্যে আমি ফের যেতে চাই — যে অরণ্যের হিম আমার ফুসফুস ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। আমার এই অসুস্থতা, প্রবল রক্তপাতময় শরীরটাকে আমি ওই অরণ্য ছাড়া আর কোথায়ই-বা রাখতে পারব?
ওই অরণ্যের দিনগুলোতেই তো আমার সমতল বুকে ডিমের কুসুমের মতো কুঁড়িস্তন জেগে উঠেছে। ওই অরণ্যই আমাকে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছে।
এখন এই ভাঙাচোরা, মৃতবৎ, ক্ষয়িষ্ণু শরীরটাকে নিয়ে আমি কোথায় আশ্রয় পাবো?
আমি জানি মানুষ ফিরিয়ে দিলেও অরণ্য কিছুতেই ফেরাবে না। ফেরাতে পারবে না। অরণ্যের ঠাঁই মানুষের জন্য চিরকালের।
. # # #