চড়ুই পাখি ও জ্যৈষ্ঠকথন । আবু রাশেদ পলাশ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ আগস্ট ২০১৫, ৫:১৪ পূর্বাহ্ণ, | ৩০২৪ বার পঠিত
অবশেষে মৃদুলের কাছে দোলার চিঠি আসে শেষবার। হলুদ খামে মোড়ানো নীলরঙা চিঠি। চিরকুট সদৃশ, তাতে লেখা — ‘আমি অপেক্ষায় আছি মৃদুল, এসে নিয়ে যাও শিগগির। সম্পর্কে দীর্ঘবিচ্ছেদ মানুষে মানুষে দূরত্ব সৃষ্টি করে ক্রমাগত। আজ অনেকদিন দোলার বিশেষ খোঁজ জানেনা মৃদুল। ও যেদিন অভিমান করে ঘর ছেড়েছিল, তারপর কতবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে মান ভাঙেনি দোলার। বারংবার বিভিন্ন অজুহাতে এড়িয়ে গেছে তাকে। এক এক করে দিন গেছে। পথিমধ্যে চশমাবিহীন খোলা চোখে চশমা এঁটেছে একজন। দোলা কি জানে, বিচ্ছেদের দীর্ঘসূত্রিতায় মৃদুলের জীবনে পরিবর্তন কতটুকু?
.
—অপেক্ষা করো মৃদুল, বাইরে যাব দুজন।আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো আপাদমস্তক পাতাঝরা বৃক্ষের ন্যায়। বিশেষ কোন সৌন্দর্য নেই এদের। দৃষ্টি গেলে কেমন হাহাকারবোধ হয় নিজের মধ্যেই। আমাদের মৃদুল আগাগোড়া মধ্যবিত্তের প্রতিচ্ছবি। কর্মজীবনে উপজেলা শিক্ষা অফিসে স্বল্প বেতনে চাকরি শুরু করেছিল সে। সম্প্রতি সেখানে পদোন্নতি হয়েছে তার কিন্তু বেশভূষায় পরিবর্তন ঘটেনি তেমন। উঁচুদরে কেনা কাপড়গুলো আলনাতে সাজানো থাকে তদ্রূপ। মাঝেমাঝে শখে পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে কেমন বেমানান ঠেকে তার। মৃদুল এমনই।ধনুয়া গ্রামে উসমান সাহেবের বাড়িটা হাটখোলা বাজারের কূলঘেঁষে। লোকে বলে তালুকদার বাড়ি। মেয়ে দোলা মৃদুলের সংসার থেকে ফেরার পর বাবার বাড়ি এসে থাকে। স্থানীয় একটা স্কুলে বাচ্চাদের পড়ায় সে। দুরন্ত শিশুগুলো চোখের সামনে আনাগোনা করলে মাতৃত্বের সাধ জাগে নিজের মধ্যে। অভিমানের বিষবাষ্পে পুড়ে যে মৃদুলকে একদিন ত্যাগ করেছিল সে, আজকাল তারই অভাববোধ হয় খুব। পিদিমনেভা রাতে একাকি বিছানায় শুয়ে থাকলে ওর স্পর্শ অনুভব করে সে। যাকে নিজের দেহ মন সঁপে দিয়েছে দোলা তাকে কি ভুলা যায়? বারংবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে সে। পরদিন আতিয়া বানু কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে দেয় ——মৃদুলরে আসতে বলছি মা। ও এলে ফিরে যাব কিন্তু?আতিয়া বানু আপত্তি করেনা তাতে। মেয়ের সুবুদ্ধিতে বরং খুশি হয় সে।বিশ্বনাথপুর সরকারি কলেজে পড়ার সময় বড়বাজারের কাছে একটা মেসে থাকতো মৃদুল। পনের—বিশ জন উড়নচণ্ডী ছেলেদের অগোছালো জীবন ছিল ওটা। মৃদুলদের সংসারে অভাব ছিল তখন। নিজের খরচ জোগাতে টিউশনি করত সে। স্নাতকোত্তর পড়ার সময় একই কলেজের দিনার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল মৃদুলের। সাদা-কালো জীবনে ঐ একজনের সাথেই মিশেছে সে। তখন কত সুখময় মুহূর্ত ছিল ওদের! দিনাদের সচ্ছল পরিবার ছিল। ওর ছোটভাই শিহাব অংক পড়তো মৃদুলের কাছে। সুযোগ পেলে শহরের রাস্তা ধরে হাঁটত দুজন। এ নিয়ে বন্ধুদের কাছে একবার বিপাকে পরতে হয়েছিল মৃদুলকে। শরতের কোন এক বিকেলে গাঁয়ের পথ ধরে হেঁটেছিল দুজন। শহরমুখি যে সড়কটা ধনুয়া গ্রামের দিকে চলে গেছে সে সড়কের পাড় ধরে হেঁটেছিল ওরা। ঘটনাচক্রে মেসের ছেলেদের সামনে পড়েছিল মৃদুল। সন্ধ্যায় মেসে ফিরলে শত সহস্র প্রশ্ন শুনতে হয়েছিল তাকে ——মেয়েটা কেরে মৃদুল?
—কেউনা, পরিচিত।
—পরিচিত? তাই বল।
সেদিন সবাই হেসেছিল ওদের নিয়ে। তারপর নানা অজুহাতে দিনাকে নিয়ে ক্ষেপাত সবাই। মৃদুলের অস্বস্তি হত মাঝেমাঝে। দিনাকে ভাল সে বাসেনি কখনই। অথবা ওকে ভালবাসা সম্ভবও ছিলনা তার। মৃদুল খুব ভাল করেই জানত অন্তরঙ্গতা ওদের যতই হোক দূরত্ব ওদের আকাশচুম্বী। কিন্তু মন? তাকে বাঁধার সাধ্য কার? স্নাতকোত্তর পাশ করার পর মৃদুল বুঝেছিল দিনাকে হয়তো ভালবাসে সে । ততদিনে দিনা সংসার পেতেছে অন্যকোথাও।
স্নাতকোত্তর শেষ করে বেকার বসে থাকার উপায় ছিলনা মৃদুলের। ওদের সংসারে তখন নিদারুণ অভাব। সেবার বিশ্বনাথপুর উপজেলা শিক্ষা অফিসে চাকরিটা দিনার তদবিরে পেয়েছিল সে। সে সূত্রে দিনার প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই তার। চাকরি পাওয়ার পর মৃদুলের মধ্যে পরিবর্তন আসে সামান্য। ওদের সংসারে সচ্ছলতা আসে ধীরে ধীরে। মাস শেষে বাড়ি গেলে বিয়ের তাগিদ দেয় মা। ছেলেকে সংসারী দেখার ইচ্ছে তার। মা বলে —
—চাকরি অইচে অহন একখান বিয়া কর বাপ।
—বিয়ানি? দিলে সবুর দেও কয়দিন।
—উসমান সাবরে কইয়ে থুইচি, মাইয়া দেখ শিগগির।
আক্তিয়ারা বেগম পীড়াপীড়ি করলে পাকা কথা দিতে হয় মৃদুলকে। দোলা মেয়ে ভাল, দেখতেও বেশ। ওর সাথে বিয়ে হলে অসুখী হবেনা মৃদুল। তারপর একদিন স্বাভাবিক নিয়ম মেনে বিয়ে হয়ে যায় দুজনের। উঠতি যৌবনে দিনার প্রতি ভালোলাগা হয়তো দিনকে দিন নিজের মধ্যে পোষে রাখে মৃদুল। কিন্তু সংসার ধর্মের মোহে পরলে সত্য অব্যক্তই থেকে যায় দোলার কাছে।
বিয়ের পর দোলাকে নিয়ে একটা ভাড়া বাসায় উঠে মৃদুল। একটা ছোট সংসার হয় ওদের। সংসারে সচ্ছলতা সামান্যই, কিন্তু সুখবোধ ষোল আনা। সেখানে দোলার কৈশোরিক চপলতা গুলো বর্তমান। মাঝেমাঝে ছোট ছোট ব্যাপার নিয়ে খুনসুটি হয় ওদের। তারপর অকারণ কেঁদে চোখ ভাসায় কিশোরী। ও অভিমান করলে সহসা কাছে আসার সাহস করেনা মৃদুল। তবুও একসময় ভয়ে ভয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় সে । তারপর বলে—
—অভিমান ভুলো পাখি, খিদে পাইছে যে।
তাৎক্ষনিক কথা বলেনা দোলা। ও কথা না বললে উল্টো রেগে যায় মৃদুল। তারপর মান অভিমানের একপালা গান হয় দুজনের মধ্যে। অবশেষে বশ্যতা স্বীকার করে দোলা। তারপর বলে—
—খেতে আস আমারও খিদে পাইছে খুব।
অবসরে দোলাকে নিয়ে পাড়া ঘুরে মৃদুল। বিশ্বনাথপুর ছোট থানা শহর। দুরন্ত যৌবনের বেশিরভাগ সময় এখানে কেটেছে তার। এ শহরের প্রতিটা গলি মুখস্থ ওর। দোলা আবদার করলে গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে হাটে দুজন। সুবিস্তৃত ধানক্ষেতের আইল ধরে হাটে ওরা। দূর্বাঘাসে তখন কিশোরীর নরম পায়ের চিহ্ন পরে। সময় ধরে ওর নিগুঢ় মুগ্ধতায় মেতে থাকে মৃদুল। কথা বলেনা সহসা।
দোলা বলে —
—কি দেখ অমন করে?
মৃদুল বলে—কিছুনা, চল যাই।
সেদিন একটু দেরি করে বাড়ি ফিরে ওরা।
মৃদুলের সংসারে মানুষ ওরা দুজন। সুযোগ পেলে আক্তিয়ারা বেগম এসে ঘুরে যায় এখান থেকে। দোলার ব্যস্ততা বাড়ে তখন। অগোছালো সংসারে স্থিরতা আসে দুজনের মধ্যে। আক্তিয়ারা বেগম মেজাজি মানুষ। কড়া করে কথা বলেন তিনি। দোলার খারাপ লাগেনা। একাকি সংসারে কথা বলার মানুষ পেলে খুশি হয় সে। সপ্তাহ খানেক থেকে বিদায় নেন আক্তিয়ারা বেগম। যাওয়ার আগে দোলাকে নিভৃতে ডেকে বলে যায় —
—আর কতদিন একলা থাকবাগো নাতির মুখ দেখাও শিগগির।
দোলা কথা বলেনা সহসা। আক্তিয়ারা বেগম বিদায় নিলে অদ্ভুত ভাবনায় পরে সে। মৃদুল এলে শিহরণ হয় নিজের মধ্যে। চড়ুই পাখি সদৃশ যে চপলমতি কিশোরী অল্পপরিচিত একজনের হাত ধরে এখানে এসে সংসার পেতেছে, সে যে ইতোমধ্যেই পাকাপোক্ত গৃহিণী হয়ে উঠেছে দোলাকে দেখে সহজেই তা অনুমান করা যায়। মৃদুলের ভালবাসাপূর্ণ দায়িত্বশীলতা মুগ্ধ করে তাকে। তারপর রাতে একই বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন বুনে দুজন। ভাঙা ভাঙা অগোছালো স্বপ্ন, রূপকথার ন্যায় যেখানে না বলা কত কথা ভাষা পায় ।
চৈত্র মাসের গোঁড়ার দিকে ব্যস্ততা বাড়ে মৃদুলের। চাকরির অজুহাতে রাত করে ঘরে ফিরতে হয় তাকে। একাকি সময়ে ঘরে বিড়াল পোষে দোলা। ওর পোষা বিড়ালটা চারপাশে আনাগোনা করে সারাদিন। উঠানে লাগানো ফুলগাছগুলো পরিচর্যা করে সময় ধরে। রাতে ক্লান্ত মৃদুল বাড়ি ফিরলে আহ্লাদিত হয় সে। নিজের কৈশোরিক চপলতাগুলো প্রকাশ করতে গেলে ধমক দেয় মৃদুল। আবার মনক্ষুন্ন হয় দোলা। তবে অভিমান ওদের দীর্ঘস্থায়ী হয়না কখনই।
আশ্বিনে ভরা পূর্ণিমা হয়। চাঁদের এলো এসে মৃদুলের বাড়ির উঠানে আশ্রয় নেয়। মৃদুল আর দোলা উঠানে বসতি গড়ে তখন। ঝি ঝি পোকার আওয়াজগুলো ক্রমশ ম্লান হতে হতে থেমে যায় একসময়। দুজনের ঘোর কাটেনা সহসা। ওরা জেগে থাকে রাতের শেষ অবধি।
মৃদুল আর দোলার সংসার হয়তো সারাজীবন এমনই হতে পারতো যদি ওদের জীবনে অযাচিতের মত দিনার আগমন না হত। একদিন ভালবেসে যে মানুষটার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল দিনা সম্প্রতি তার সাথেই সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটেছে তার। জীবনের এ কঠিন সময়ে নিজের বাবা-মার কাছেও উপেক্ষিত সে। শিহাবটাও কেমন পরিবর্তন হয়ে গেছে এখন। অবশেষে নিরুপায় দিনা মৃদুলের সংসারে এসে উঠে। দোলা আপত্তি করেনা তাতে। শহুরে জীবনে দিনা নামে মৃদুলের বন্ধু ছিল কেউ এটা দোলা শুনেছে ওর কাছেই।
আপনজনের কাছে বিতাড়িত দিনা মৃদুলের সংসারে আশ্রয় পেলে স্বস্তি আসে ওর। মৃদুলের বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা ভেতরে ভেতরে বাঁচার প্রেরণা দেয় তাকে। সবুজের কথা মনে হলে দুঃখ পায় সে। মৃদুল বলে —
—আবার সংসারে ফিরে যা দিনা।
দিনা বলে-সাধ্য কই, জোর করে ঘর হয় কি?
এরপর দিনে দিনে পরিবর্তন হয় মৃদুল স্বয়ং। দিনার আগমনের পর কাজে মনোযোগ কমে ওর। সুযোগ পেলে দিনাকে সময় দেয় সে। দিনার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তার। দুঃসময়ে দিনা কি না করেছে ওর জন্য! বিশ্বনাথপুর শহরের কূলঘেঁষে যে নদীটা অজানার উদ্দেশ্যে বহমান তার পাড় ধরে হাটে ওরা। পরিচিত কেউ দৃষ্টিগোচর হলে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে দুজনই। তারপর ফেরার পথে হয়তো রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরে দুজন। চপলমতি দোলা মৃদুলের জন্য অপেক্ষা করে বাড়িতে। নিশীথের অন্ধকার ঘনতর হলে তাড়া দেয় —
—খেতে এসো মৃদুল।
মৃদুল বলে —খেয়ে আসছি চড়ুই পাখি। খেয়ে নাও তুমি।
আজকাল মৃদুলের কথায় সহজেই মন খারাপ হয় দোলার। এটা নতুন নয়। ওদের সম্পর্ক হাটখোলার আচারের ন্যায়, টক-ঝাল। সেখানে অভিমান কতবারইতো হয়েছে। তবে দোলার আজকের এ মন খারাপ অন্যকারণে। মৃদুলের পরিবর্তনটা সহজেই বুঝতে পারে সে। অথচ এমন সে কখনই ছিলনা। রাতে একই বিছানায় শুয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয় দোলা, মৃদুলের কাছে সেটা অজানায় থেকে যায় দিনের পর দিন। এরপর মৃদুলের কাছে নিজেকে কেমন অস্তিত্বহীন ঠেকে দোলার। সম্পর্কে হয়তো সন্দেহ ডুকে তখনই।
পালপাড়ার অবিনাশ মৃদুলের বাল্যবন্ধু। দোলাদের পাশের গ্রামে থাকে সে। দোলার সাথে পরিচিত বিয়ের আগে থেকেই। এখন নিউমার্কেটে কাপড়ের ব্যবসা করে সে। এরমধ্যে একদিন কোন কাজে বাইরে গেলে দোলার সাথে দেখা হয় অবিনাশের । অবিনাশ জোরাজোরি করলে একটা কফি হাউজে গিয়ে বসে দুজন। অবিনাশ বলে —
—মৃদুলরে দেখলাম সেদিন দিনার সাথে।
দোলা বলে-ওর বন্ধু, তোমারো বোধয়?
—না, আমার না।
একই কলেজে পড়ার সুবাদে দিনা পরিচিত অবিনাশের কাছে। তবে ওদের বন্ধুত্ব হয়নি কোনকালেই। প্রোক্ষণে দোলা ফিরতে আগ্রহী হলে অবিনাশ বলে —
—সংসারে বারোমাস জ্যৈষ্ঠমাস। সামাল দিস দোলা।
অবিনাশের কথার অর্থ বুঝেনা চপলা। বাড়ি ফিরলে অজানা আশংকায় ভেতরে বিনাভাষী আর্তনাদ হয় তার। তারপর একদিন মৃদুলের দৃষ্টির অগোচরে ওর পুরনো বইপত্র ঘাঁটতে গেলে সত্যি আবিষ্কৃত হয়। কোনকালে দিনার প্রতি ভালোলাগা ছিল মৃদুলের। এ সত্য আজও দোলার কাছে প্রকাশ করেনি মৃদুল। এরপর সম্পর্কে বিষ ডুকে দুজনের। মৃদুলকে সহসা বিশ্বাস করতে পারেনা দোলা, কেমন নপুংসক মনে হয় যেন!
এর কিছুদিন পর একরাতে ঘুম ভেঙে যায় দোলার। মৃদুল তখন নিজ শয্যায় অনুপস্থিত। সন্ধানী চক্ষুযুগল কৌতূহলী হলে দিনার ঘরে মৃদুলের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে সে। ওরা কি যেন ব্যাপার নিয়ে কথা বলে সময় ধরে। মৃদুল আর দিনার কথাগুলো স্পষ্ট বোঝা যায়না দোলার ঘর থেকে। সত্য সন্ধানে অপারগ দোলা ভেতরে ভেতরে অশ্রু বিসর্জন দেয়। মৃদুল ঘরে ফিরলে সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হয় দুজনের মধ্যে। দোলা বলে —
—আসলা যে, পুরনো প্রেম তাইনা?
তারপর এক-দুই কথায় কলহ করে দুজন। সকালে মৃদুল ঘুম থেকে উঠে দেখে ঘরে নেই দোলা। ধলপ্রহরে বাপের বাড়ি গিয়ে উঠে সে।
এরপর বেশ কয়েকবার দোলাকে ফেরানোর চেষ্টা করেছে মৃদুল। রাজি হয়নি মেয়েটা, রীতিমত অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে তাকে। এরপর আশাহত মৃদুল আর কোনদিন আনতে যায়নি দোলাকে। মাঝখানে কেটে গেছে দুটো বছর।
প্রথম জীবনে দোলার অনুপস্থিতি বিধ্বস্ত করেছিল মৃদুলকে। আশাহত দিনগুলোতে দিনার ভালবাসাপূর্ণ হাতের স্পর্শ ছিল ওর উপর। সে দিন গুলোতে দিনা কি না করেছে ওর জন্য! ওর অগোছালো সংসারকে বাঁচিয়েছে সে। দিনে দিনে দিনার প্রতি নির্ভরতা বেড়েছে মৃদুলের। এরপর কখন যে বিবাহ বহির্ভূত একটা নিষিদ্ধ সম্পর্কে জরিয়েছে দুজন জানা হয়নি আজও। সে সম্পর্ক শয্যা অবধি আসতে সময় নেয়নি বেশিদিন। এখন ওরা আত্মার আত্মীয়। সম্পর্ক ওদের দেহ-মন মিলেই। কি এক উদ্ভট বিশ্বাসে বেঁচে আছে দুজন! যেখানে দুজনের মনের মিল সেখানে বিয়ের গুরুত্ব কি?
দোলা যে এতদিন পর ফিরতে চাবে মৃদুলের জীবনে ভাবেনি মৃদুল। আচমকা ভাবনার দোলাচলে পরলে পিষ্ট হয় সে। যেন করাত কাঁটার মত করে নিজেকে ফালাফালা করে কেউ। দিনার কাছে সত্যি অপ্রকাশিত। এখন সম্পর্কে দুজন স্ত্রী তার। একজন ধর্মমতে অন্যজন মৌনসম্মতিতে। আজকাল মৃদুল অন্যমনস্ক থাকলে দৃষ্টি এড়াইনা দিনার। একদিন যেচে জানতে চায় সে—
—তুমি কেমন বদলে গেছ,কিছু হয়েছে কি?
দিনার কথার সদুত্তর দেয়না মৃদুল। এরপর একদিন ধনুয়া গ্রামে দেখা যায় তাকে। ও এলে আহ্লাদিত হয় দোলা। তারপর বড় পুকুরের পাড়ে বসে গল্পের ঝাঁপি খোলে সে।—চোখে চশমা নিছ কতদিন হল?
—অনেকদিন।
—হাতের কবজটা ফেলে দিছ তাইনা?
—হুম, বিশ্বাস নেই আমার।
—আমার যে আছে। বিড়ালটা এখনও আছে, আমার ফুলগাছগুলো?
সহসা জবাব দেয়না মৃদুল। দোলার ছেলে মানুষীতে নিজেকে বেমানান ঠেকে তার। সে বলে—
—কিছু বলব আজ, ভুল বুঝোনা পাখি।
অবশেষে সত্যি প্রকাশিত হয় দোলার কাছে। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে দিনাকে নিয়ে সুখী হতে চায় মৃদুল। এ জীবনে মৃদুল ব্যতিত দোলার হয়তো সব আছে। কিন্তু দিনার জীবনে মৃদুল ছাড়া কেউ নেই আর। মনের অগোচরে যে মানুষকে নিজের সহচর ভেবেছে দিনা, অকস্মাৎ তার প্রস্থান হয়তো মৃত্যুর কারণ হবে ওর। মৃদুলের বলা সহজ সত্যিগুলো বাকরুদ্ধ করে দোলাকে। উসমান সাহেবের কাছে সত্য উন্মোচিত হলে হুংকার করে সে। তাতে বাঁধ সাধে দোলা। সে বলে —
—ওরে যেতে দেও বাবা, আমি ভাল থাকব নিশ্চয়।
মৃদুল বেড়িয়ে এলে বাঁশের দেউরির পাশে এসে দাঁড়ায় দোলা। প্রিয়তমের প্রস্থান দৃশ্যে অশ্রু বিসর্জন দেয় সে। দোলাদের বড়ঘরের কোণায় চড়ুই পাখি বাসা করেছে সম্প্রতি। একদিন ওদের দিকে দৃষ্টি গেলে নিজের কথা মনে হয় দোলার। মৃদুলের চড়ুই পাখি বাপের বাড়িই আশ্রিতা। ওর চোখের পানি চোখে শুঁকিয়েছে কবেই, এখন সেখানে শুধুই জ্যৈষ্ঠের খরা।
# # #