গাদলা । আফরোজা সোমা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জুন ২০১৫, ২:০৩ অপরাহ্ণ, | ২৬১০ বার পঠিত
এই অবিশ্রাম, অক্লান্ত, অবিরল বর্ষণকে আমাদের এলাকায় ময়-মুরুব্বিরা ‘গাদলা’ বলে ডাকে। আষাঢ়ের প্রথমভাগের বর্ষণে পুকুরগুলো একটু একটু ভরতে শুরু করে জলে। ধীরে-ধীরে সেই জল বাড়তে-বাড়তে পুকুর কানায়-কানায় এমনি পূর্ণ হয় যে, আর এক ফোটা পানিও বুঝি ধরার জায়গা নেই। কিন্তু গাদলা বলে কথা! গাদলায় পুকুরগুলো উপছে যায়। জল উপচে উঠে যায় পাশের ক্ষেতে, আল উপছে ক্ষেত আর পুকুর একাকার হয়ে যায়।নয়া পানিতে পুকুর কী সুন্দর! পানি ঝলমল-ঝলমল টলমল-টলমল করে। সেই পানিতে কলার গাছ দিয়ে ‘পুলাপান’ ভেলা বানায়। ভেলাকে আমরা ‘বুরা’ বলে ডাকি। বর্ষায় বুরায় করে পারি দিতাম পুকরের এপাড়-ওপাড়। ঘুরে বেড়াই নরসুন্দার এদিক-ওদিক।
গাদলায় নরসুন্দায় নয়া পানি আসে। অবিরাম বর্ষনে নরসুন্দার মতনই ভরে উঠে পাড়ার নিচু জমি, মাঠ, ডোবা ও ড্রেন। সেইসব পানিতে মাছ হয়। ছোটো-ছোটো মাছ। নয়াপানির মাছ।
বহুকাল হলো, গাদলা হলেই কুবের-এর কথা মনে পড়ে। কুবের এক গরীব ধীবর। তার কথা লিখেছিলেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। মানিকের সেই উপন্যাসটা পড়ার পর থেকে প্রতি গাদলায় কুবের-এর কথা আমার মনে পড়ে। তার দীনহীন সংসার, তার স্ত্রী-এর বাচ্চা প্রসব-এর কথা মনে পড়ে। আর মনে পড়ে আমার শৈশবের পাড়াটাকে।
আশির দশকের শেষদিকে আমি বেড়ে উঠেছি এক মফস্বলের পাড়ায়। সেই পাড়ায় একটা কামার বাড়ি, একটা কোলু বাড়ি ছিল। ছিল ঢুলি বাড়ি, গরুগাড়িওয়ালার বাড়ি, বাক্কারের বাড়ি, মিডুদাদার বাড়ি, টুইন্যা বেডার বাড়ি, জলের বাড়ি, হাজেরা আপাদের বাড়ি, মাইয়াদের বাড়ি, মাস্টরের বাড়ি, লুদুনিরার বাড়ি, নাজিরের বাড়ি, কন্ডেগদার-এর বাড়ি এবং একটু দূরে ছিল দীনালির বাড়ি। আর ছিল আমাদের বাড়ি, যে বাড়িকে কেউ ডাকতো ‘সুমারার বাড়ি’, কেউ ডাকতো ‘সিদ্দু বেডার বাড়ি’।
আশির দশকের শেষদিকে আমার পাড়াটা এমনি ছিল। ছিল এই কয়েকটা ঘর। নব্বইয়ের শুরুর দিকেই পাড়াটার বদল শুরু। দূর-দূরান্তের নানান এলাকা থেকে অন্যান্য থানার লোকেরা এসে শহরে, আমার পাড়ায়, জায়গা কিনে ‘বাসা’ করে বাসিন্দা হয়েছে। আমার পাড়া বদলেছে। পাড়ার মানুষ পাল্টেছে। পাল্টেছে পাড়ার ভূগোল। তবুও বর্ষার দিনগুলোতে, বিশেষত গাদলায়, পাড়াটার সেই আদি রূপ, আমার শৈশবে দেখা, আমার হঠাত-হঠাতই মনে পড়ে। ‘মনে পড়ে ঘরটি আলো, মায়ের হাসিমুখ/ মনে পড়ে মেঘের ডাকে গুরুগুরু বুক।’
বর্ষায়, গাদলায়, ব্যাঙ ডাকে: ম্যাগ অ, ম্যাগ অ, ম্যাগ অ।
ব্যাঙের সাথে-সাথে আমরা ছোটোরাও সুর করে বলি: ম্যাগ অ, ম্যাগ অ, ম্যাগ অ।
ব্যাঙের ডাককে বইয়ের ভাষায় যতই শিখি, ‘ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ’, আমার কানে সেই ডাক চিরকালই ‘ম্যাগ অ ম্যাগ অ’ বলে ধরা দেয়।
ম্যাগ অ মানে মেঘ হ। কিশোরগঞ্জের মানুষ বৃষ্টিকেও মেঘ বলে। তাই ব্যাঙের এই ম্যাগ অ মানে বৃষ্টি হ। মানে আরো বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের প্রার্থনা।
৫/৬ দিন চলে যাবার পরেও বৃষ্টি যদি না থামে তাহলে গাদলায় মানুষ অতিষ্ঠ হয়। রোদ নেই। অনেকেরই রান্না করার শুকনো লাকড়ি প্রায় শেষ। কাপড়-চোপড় শুকানোর কোনো উপায় নেই। যে বাড়িতে ছোটো শিশু আছে সেই বাড়িতে তো আরো ঝামেলা। ‘ভিজা ক্ষেতা’ শুকানোর কোনো উপায় নেই। ফলে, এমন গাদলায় ব্যাঙ যদি ম্যাগ অ ম্যাগ অ করে তাহলে মুরুব্বিরা বিরক্ত হয়। বলে: ‘এই যে দেহ, ব্যাঙ্গে আরো ডাকতাছে। আরো ম্যাঘ অইবো।’
এই রকম বৃষ্টির মধ্যে কোনো দুষ্টু ছেলে-মেয়ে যদি খোলা ছাতা খোলা অবস্থায় চরকির মতন ঘোরায়, তাহলে ময়-মুরুব্বিরা দেখলে বলবে: এমনিই ম্যাগ খুরে না (থামে না)। তুই আরো ছাতি ঘুরাস! আরো তো ম্যাগ অইবো।’
ঢাকা শহরের ‘বরিষণ মুখরিত’ দিনে বসে আমার বাড়ির কথা মনে পড়ে, পাড়ার কথা মনে পড়ে, কুবেরের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, কুবেরকে তার কর্মসঙ্গী গণেশ জিজ্ঞেস করেছিল: ‘যে যারে ভালোবাসে সে তারে পায় না কেন, কুবের?’ উত্তরে কুবের কী বলেছিল মনে নেই। প্রশ্নটাই মনে আছে শুধু। গাদলায় কোনো এক অবসরে অযাচিতেই এই প্রশ্ন মনে আসে।
মনে আছে, একবার এক গাদলায় মানুষের সে-কী কষ্ট। সাত দিন পাড় হয়ে গেছে। তবু, রোদ উঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। দিনের কোনো এক ফাঁকে কোনো ভুলেও যদি সূর্যের টিকিটারও আভাস পাওয়া যায় সঙ্গে-সঙ্গেই পাড়ার ময়-মুরুব্বিরা ছোটো-ছোটো ছেলে বাচ্চাদের বলে: ‘এই এই সুরুজরে ফুটকি দেহা, ফুটকি দেহা।’
ময়-মুরুব্বিদের বিশ্বাস এমনি ছিল যে, ছোটো ছেলে বাচ্চারা যদি পাছার কাপড় খুলে উপুর হয়ে সূর্যকে তাদের ‘পুটকি’ দেখায় তাহলে সূর্য ওঠবে।
কিন্ত সেবারের সেই বর্ষায়, বৃষ্টির তোড়ে সকলেরই ত্রাহি-ত্রাহি দশা। তবুও থামে না ‘আষাঢ় মাইস্যা ঢল’। এরই মধ্যে সেবার শুনতে পেলাম যে, এবারের গাদলা না-কি ১৭ না ১৮ দিন আগে থামবে না। কেন? কী কারণ? গাদলা কেন থামবে না? জানা গেলো, শহরে কথা ছড়িয়েছে যে, হাসপাতালে কোন এক ছেলে বাচ্চা না-কি জন্মেছে। তার চুল-ভ্রু কিচ্ছু নাই। সেই বাচ্চা না-কি খুব বুজুর্গ। সে না-কি কথাও বলতে পারে। সে না-কি বলেছে, তার চুল-ভ্রু না থাকার কারণ। আর সেই না-কি বলেছে যে, এই গাদলা ১৭ না ১৮ দিন আগে থামবে না।
সেই গাদলায় আমার মা বলে: আষাইর্যা ঢল আর কত ভালা লাগে! মাডিত্তে (মাটি থেকে) পঁচা গন্ধ বাইর অইতাছে। রইদ কবে উঠবো।
নগরে বসে আমি আমার পাড়ার বৃষ্টির কথা ভাবি। আমার নানুবাড়ির পুকুরে উপচে উঠা জলের কথা ভাবি। নানুবাড়ির গ্রামে ফসলের মাঠে বৃষ্টির মায়াজাল নেমে আসার কথা ভাবি। বৃষ্টির দিনে আমার মা চাল ভেজে দিত, সিমের বিচি বা কাঁঠালের বিচি বা বাদাম ভেজে দিত। চাল ভেজে বেশি করে পেঁয়াজ কাঁচামরিচ আর সরিষার তেল দিয়ে মেখে বাটিতে দিয়ে সঙ্গে একটা চামচ দিয়ে দিত। আমি বারান্দায় হয় চেয়ারে, নয় টুলে, নয় পিড়িতে বসে নয় বেড়ার মধ্যে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে অথবা বারান্দার টিনের চাল থেকে নেমে আসা পানির ধারায় হাত ভেজাতে- ভেজাতে বৃষ্টি দেখতাম। দেখতে-দেখতে কখনো ভাবতাম: ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এলো বান’। আবার কখনো ভাবতাম: ‘বৃষ্টি এলো কাশবনে, জাগলো সাড়া ঘাসবনে’।
বাংলাদেশের বৃষ্টির কথা মনে পড়েছে জার্মানিতে বসে। সেখানে ডরমের রুমে কবীর সুমন গেয়েছে: ‘আজি বরিষণ মুখরিত শ্রাবণ রাতি’। আর আমি কাঁচের জানালার ওপাড়ে তাকিয়ে দেখেছি, আমার দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা নাম না জানা বড় একটা গাছে এক জোড়া ঘুঘু দিনভর ভিজছে। রাইন নদীর পাড় ধরে হাঁটতে-হাঁটতে ভেবেছি, ধানমণ্ডি লেকে বাড়তে থাকা জলের কথা। ভেবেছি, বর্ষায় ধানমণ্ডি লেকের ভেজা বাতাস, ভেজা পাতা আর ভেজা কদমের কথা। একটা আষাঢ়-শাওন রাইন নদীর তীরে কাটিয়ে এসে মনে হলো: আহা! কতোদিন আমি ব্যাঙের ডাক শুনি না! কত দিন শুনি না: ম্যাগ অ ম্যাগ অ। আর মনে হলো, বহুদিন হলো কদমের গন্ধ পাই না।
বর্ষায় আমি ব্যাঙের ডাক ও কদমের গন্ধ ‘মিস করেছি’। এই কথা শুনে আমার এক ছোটো ভাই বলেছে: হুমমম. . . তুমি এখনো অনেক প্রিমিটিভ। তুমি এরকমই থেকো। পাল্টে যেও না।
কে কখন পাল্টে যায়, কার জীবনে কখন কোন পরিবর্তন আসে সেটা কি কেউ জানে? চৈত্রের খড়ায় যে মাঠ ফেঁটে চৌচির হয়েছে, বৃষ্টি না থাকায় ফসল মার খাচ্ছে ভেবে যে বৃষ্টির জন্য কৃষকেরা দলে-দলে করেছে প্রার্থনা, সেই বৃষ্টিই কি-না না চাইতেই ঝরছে! সকাল-বিকেল সারাদিন সারাসপ্তাহ ঝরছে।
অনাবৃষ্টিতে নানুবাড়িতে দেখেছি কৃষকদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ। আবার অতিবৃষ্টিতে, শ্রাবণের গাদলায়, ফসল জলে ডুবে যাচ্ছে বলেও নানাদের কতো দুশ্চিন্তা। এই যে বদল, একই মাঠে একই বৃষ্টির কারণে এই যে এতো পরিবতর্ন, বৃষ্টি কি তা জানে? না-কি জানে আষাঢ়-শ্রাবণ?
বাড়ির ঘাটে যখন আসে নয়া পানির ঢেউ, যখন জল টলমলটল করে, যখন আসে নতুন পোনার ঝাঁক, তখন সেই পানি থেকে উঠে ঘরের কোণায় কুণ্ডুলি পাকিয়ে যদি বসে থাকে বিষধর কোনো সাপ! সেই সাপ যদি কাটে কোনো সোনার লখিন্দরকে? তাহলে কী করবে বেহুলা? প্রথা মেনে সাপে কাটা স্বামীর দেহকে কলার বুরায় শুইয়ে দিয়ে, দেহের শিয়রে প্রদীপ জ্বেলে, কলার বুরাটিকে লাল কাপড়ে চারিদিক ঢেকে দিয়ে সে কি দেবে দেহের ভাসান? নাকি ছোট্টো গয়না নৌকায় করে স্বামীকে সঙ্গে করে বেহুলাই ভাসবে নিজে?
বর্ষায়, গাদলায়, এইসব ভাসানের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, নরসুন্দায় এমইরকম কত ভাসান দেখেছি! যদিও, সেই সব ভাসানে কোনো লখিন্দর থাকতো না। থাকতো প্রদীপ আর সামান্য খানাদানা। লাল কাপড় দিয়ে ঘেরা এইরকম বুরা দেখলেই আমরা বুঝতাম, কারো কোনো ‘মান্নত’ ছিল। তাই শিন্নি দিয়ে হয়তো তারা দিয়েছে এই ভাসান। অথবা হয়তো কোনো পাড়াকে কোনো মহামারী ধরণের রোগমুক্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো কবিরাজ কোনো রোগ-কে ‘চালনা’ দিয়েছে।
বর্ষায়, গাদলায়, মনে পড়ে কুবের-এর কথা। ‘যে যারে ভালোবাসে সে তারে পায় না কেন’ প্রশ্নের কথা। মনে পড়ে, বৃষ্টি এলে টিনের চালের কোন ফুটো দিয়ে ঘরে পানি পড়ছে তা বন্ধ করার জন্য মায়ের বা দাদির চেষ্টার কথা। মনে পড়ে, বৃষ্টিতে যখন ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর, টিনের চালে বৃষ্টির বাজনা ছাড়া পৃথিবীতে যখন আর কোনো সুরমূর্ছনা নেই তখন সেই বরিষণ মুখরিত রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঘরের ভেতর একটা হারিকেনের আলো মিটমিট করে সারারাত ধরে জ্বলতো।
সেই আলোর চারধার ঘিরে পরীরা নাচতো সারারাত। টিনের চালে যে বাজনা তুলতো আকাশ থেকে নেমে আসা জলধারা, সেই ছন্দে পরীরা মোহাছন্ন হয়ে নাচতে-নাচতে ঘোরগ্রস্ত হয়ে যেতো। নাচতে-নাচতে ভুলে যেতো কখন পেরিয়ে গেছে তাদের নিজেদের রাজ্যে ফেরার সময়।
ভুল করা পরীরা মাটির পৃথিবীতে কুবের-এর মতন কোনো এক ধীবর-কে বিয়ে করে, গণেশ-এর মত কোনো এক বোকা-কে বিয়ে করে থেকে যেতো মানুষের সংসারে। আর তারপর আবারো কোনো এক বর্ষায় শুরু হতো মেঘের ভীষণ গুরুগুরু। শুরু হতো গাদলা। যেই বাদলা দিনে, গাদলায়, বৃষ্টির সঙ্গীতে পথভুলে শ্যামকালিয়ার প্রেমে পড়ে মানবীরূপে সংসারে এতোদিন টিকে ছিল পরী, সেই একই রকম বাদলা দিনে, কোনো এক গাদলায়, পরীর ঘরে ঢোকে বিষধর সাপ। ফলে, বর্ষায়— গাদলাতেই— লখিন্দরের দেহ নিয়ে কল্পলোকের সন্ধানে পরী আবার বেহুলারূপে গাঙ্গে দেয় ভাসান।