দূরত্ব । রাওয়ান সায়েমা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ এপ্রিল ২০১৫, ৫:০০ অপরাহ্ণ, | ২৮২৪ বার পঠিত
সমাজের কতশত বিশুদ্ধরা বিশুদ্ধতার মুখোশ পড়ে ছেনালি করে বেড়ায় অথচ যে ছেনাল তারও সরলতা আছে আত্মপ্রবঞ্চনা তো অন্তত করে না নিজের সাথে , সেই সরলতাটুকু ছিল ‘উজাক বা ডিসটেন্স ‘ সিনেমার আন্ট্যাগোনিষ্ট এর। আর আট দশটা সংস্কৃতির সান্নিধ্যে দশ ফুট উঁচু উন্নাসিকতা নেই যার বরং পাশের আর দশটা বাড়ির ছেলের মতই বেড়ে ওঠা তার ক্রোধ , ধরাবান্ধা নীতি- নৈতিকতা মূল্যবোধ , যৌনাকাঙ্ক্ষা আর অবদমনের ফলে উৎপন্ন হিপোক্রিসি মাখা জীবন ।
বাবা মা ও ধর্মের নীতি আদর্শের বুলি-কথা ও একই সাথে সমাজ নামক আমাদের সংঘের সেই বুলি-কথার বিপরীতের কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে বের হয়ে আসা এক উন্নত কনজ্যুমার প্রডাক্ট যার হয়ত কোনদিনই জানার সুযোগ হবে না সে তুচ্ছ প্রডাক্ট মাত্র , অথচ আমি তুমি সে তাকে গালাগালি দিয়ে যাব সে জানে না বলে অথচ আমরাই সক্ষম না তাকে জানার সেই সুযোগটা দিতে!-এমনই এক আন্ট্যাগোনিষ্ট। প্রটাগোনিষ্ট ছেড়ে লেখার শুরুতেই কেন আন্ট্যাগোনিষ্টকে নিয়ে এসেছি? নুরি বিলগে জাইলানের ধরণই এমন। প্রটাগোনিষ্ট বা এন্টিগোনিষ্ট কেউ আর কারো চরিত্রে থাকে না বরং একীভূত হয়ে যায় আমাদের চারপাশের মানুষজন তথা তোমার আমার মত , যাদের চরিত্রে
ভালো মন্দ দুইদিকই থাকে এবং তা প্রকাশ পায় পরিস্থিতিভেদে। তাই হয়ত এত আপন লাগে , আনন্দিত হয়ে বলে উঠি আক্ষরিক অর্থেই সিনেমা দেখলাম বলে। আর পুরাদস্তুর সমসাময়িক বিষয় বলেও বোধহয় কেননা আজকের সমসাময়িক পাঁচশ বছর পরের মডার্ন ক্লাসিক না হয়ে যায়! অইত ওর আমার তার যে ক্রাইসিস মানে মধ্যবিত্ত মানসিকতা ভাঙ্গার , কেউ হয়ত ভাঙ্গছে তাও গায়ে আঠার মত লেগে থাকে কিছু , কেউ হয়ত প্রিটেন্ড করে ভাঙ্গার কিন্তু আবার জড়িয়ে যায়।
যাবে না কেন মায়ের পেটে ফিটাস হওয়ার পর থেকেই বিবর্তনের জিনের উত্তরাধিকার ও নিজস্ব বোধ জন্ম নেওয়ার আগেই তা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য যে লোহার মাকরজাল তা মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে ঠাসিয়ে ঠাসিয়ে যে হীনমন্যতার জন্ম দিয়েছে তা ভেদ করে মধ্যবিত্ত মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসা খুব বেশীই কষ্টকর বা বের হয়ে আসলেও তার রুট , শেকড় বলি বা পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতা বলি তার সাথে যে সাংঘর্ষিক অন্ত-দ্বন্দ্ব তাই পূর্ণাংগভাবে তুলে ধরেছেন নুরি এই সিনেমাতে।
সিসিলিকে এর আগে এমনকি ফোর্ড কপোলও যেভাবে দেখাননি ভাবলাম তর্নাতোরে যেভাবে দেখিয়েছেন তা নিয়ে একটা লেখা লিখে ফেলব। বাদ গেল ডেভিড লিঞ্চ কে পেয়ে। সমাজের অচ্ছুত বিষয়গুলোকে এবং অবদমন সুরিয়ালিজমের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। লেখার আগে এস.এম.সুলতান এর বিমূর্ততা আমাদের দেশের জন্য কেন জরুরী নয় এই সম্পর্কিত সাক্ষাৎকার পড়া ছিল বিধায় বারবার যাচাই করে নিয়েছিলাম এখনকার এ সমাজ যেখানে আমি তুমি সে ও ওরা সবাই বিশৃঙ্খল এর শৃঙ্খলে আবদ্ধ এবং আমাদের মন মানসিকতার সেই মরালিটিটা এখন আর সেভাবে কাজ করে না বরং ডিজায়ার আস্তে আস্তে গিলে খাচ্ছে আমাদের ছাপোষা মোরালিটি আর আমরা এখন সোসাইটির তৈরি করে দেওয়া ইলুশনে পেট ভর্তি ক্লান্ত পথিক যার পথ নেই ফলে গতিও নেই। সবকিছু ঠিকঠাক,সময়ও,হ্যাঁ ডেভিড লিঞ্চ এর সারিয়ালিজম জমবে সঙ্গে বুনুয়েল ,দালির কারসাজি তবুও কেন জানি লেখা জন্ম দেওয়া যাচ্ছিলোনা।
এরপরই এইত বর্ষামুখর দিনে নুরি বিলগে জাইলানের ‘ডিসটেন্স’ সিনেমাটি দেখে কয়েকঘন্টা বাকরুদ্ধ অস্থিরতায় কাটালাম মানব মনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্রাইসিস দেখে। কয়েকটি পিরিওডে ভাগ করলে সিনেমাটির যাচিত অসাধারণ সাধারণত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে।
রিলেশনের বিবর্তনে প্রি – মডার্ন , মডার্ন উত্তীর্ণ হয়ে পোষ্টমডার্ন এ চলমান যদিও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তিনটিই একসাথে কম বেশিভাবে একইসাথে চলমান। এইরকমই সময়ের স্রোতকে ধাবমান রাখতে গিয়েই যারা একটু ঘুরেছে মানে যারা অনুকম্পিত হয়ে সমাজটার অনুরণন ঘটাচ্ছে তাদেরই একজন প্রটাগোনিষ্ট চরিত্র। আগেও বলেছি নির্দিষ্ট প্রটাগোনিষ্ট এর রোল সেভাবে নেই এটা প্রটাগোনিষ্টকেন্দ্রীক একপেশে সিনেমাও না।
সিনেমার শুরুতেই আমরা এক স্বনামধন্য না হলেও কৃতকর্মে সাফল্য ফটোগ্রাফার ও ডিরেক্টর এর নিঃসঙ্গ নৈর্ব্যক্তিক জীবন দেখি। না না এ ফটোগ্রাফার মাইকেল আঞ্জেলো এর “Blow Up” এর ফটোগ্রাফার এর মত অতি আধুনিকতায় ঝলসিয়ে দেওয়া ফটোগ্রাফার নয় এ ফটোগ্রাফার গড়পড়তা ম্যাটমেটে নিজের জমিটুকু , সংসারটুকু , ধর্মটুকু আঁকড়ে ধরা মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মধ্যবিত্ত মানসিকতার বেড়াজালে বেড়ে ওঠা এলিয়েন ছেলেটি যে অমলকান্তির মত হয়ত রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। হয়ত শহীদ কাদরীর মত করাতকলের শব্দ শুনে , জুতোর ভেতর মুজোর ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া মানুষ হয়ে জন্ম নেয়নি বলেই প্রকৃতির সে নিজস্ব স্বভাবজাত গাম্ভীর্য ও হারমনি তার মধ্যে ছিল তবুও সেও তো মানুষ তাই হয়ত গ্রাম থেকে আসা সেই ছেলেটি ইউসুফ যার হয়ত আট দশটি স্যাহিত্যের সান্নিধ্যে এসে বারো হাত বাকুরের চৌদ্দহাত বিঁচির মত অহমিকা বা আদিখ্যেতা ছিল না , তার প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞার যে বহিপ্রকাশ তা আবার আমাদের তৈরি করে দেয়া তৈলাক্ত পিচ্ছিল তবু প্রগতিশীল রুচির ধারে কাছে থাকে না বলে আমরা আবার হিপোক্রিসি করে বসি এবং তারপর সে কথা অকাতরে ভুলে যেয়ে বা চোখে না দেখে কানে না শুনে অবুঝটি ভালোটি লক্ষীটি হয়ে থাকি।
এ গল্পের মূল বিষয় আমাদের সমাজেও লাল ফল ওয়ালা পরগাছের মত অরন্যের ডালে জায়গায় জায়গায় জড়িয়ে থাকে। প্রায়ই চোখে পড়ে , পা দিয়ে হালকা আনমনে মাড়িয়ে দেয় তবু মনের চোখে গতানুগতিক হয়ে যাওয়াই শনাক্ত করা যায় না। প্রটাগোনিষ্ট এর একা ভবঘুরে বাওড়া জীবনের যে পরিতৃপ্তি তা হঠাৎ করেই ব্যাহত হয় গ্রাম থেকে আসা তার দুরসম্পর্কীয় আত্মীয় আসলে। ‘উজাক বা ডিসটেন্স’ এর আগে ‘ক্লাউডস অব মে’ নামে তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মূল গল্পে এই দুই চরিত্রের উপস্থিতি ছিল , সেই সিনেমার সারসংক্ষেপ বললে এক ফটোগ্রাফার কাম ডিরেক্টর তার নিজের বাবা মা কে দিয়ে অভিনয় করিয়ে ডকুফিকশন জনরায় সিনেমা বানায়। সিনেমার মূল গল্প হল তাঁর ফিল্মে কাজ করার সময় এই উজাক সিনেমার এন্টিগোনিষ্ট ছেলেটির রাজধানী যাওয়ার ইচ্ছা শুনে এবং সিনেমা শেষ করার পর তাকে রাজধানীতে চাকুরীর ব্যাবস্থা করে দেওয়ার অঙ্গীকার দেয় এবং সেটা আক্ষরিক অর্থেই সিরিয়াসলি নিয়ে আন্ট্যাগোনিষ্ট কারাখানার চাকুরী ছাড়ে।
কিন্তু সেই ইনডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকার রাষ্ট্রের শোষণ এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর জন্য নিজের পরিবারকে ধরে সিনেমা বানিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় নিজে আবার রাষ্ট্রের মত আশ্বাস দিয়ে ভঙ্গ করে চলে যায় হাজার মফস্বলের মত সিনেমার হিরো হওয়ার স্বপ্ন লালন করা ছেলেটির বুক চিড়ে। এখন উজাক বা ডিসটেন্স এর গল্পের মূল থিম হল সেই ‘ক্লাউডস অব মে’ এর ছেলেটি চাকুরীর খোঁজে বা রাজধানীর নেশায় এই ফটোগ্রাফার কাম ফিল্মমেকারের বাড়িতে উঠে তার দৈনন্দিন স্বাধীনতার ব্যাঘাত ঘটায় কেননা পোষ্ট মর্ডানিজ রিলেশনশিপ আমাদের বাধ্য করে ব্যাক্তি স্বাতন্ত্র্য, বিচ্ছিন্ন ও অসামাজিক কাঠিন্যে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যেতে। আত্মীয়ের চাকরী খোঁজার ব্যার্থ চেষ্টা ,আত্মীয় ও তার অবদমন , চিন্তা ভাবনার দূরত্ব ,পরিবারের ব্যাক্তিবর্গের সাথে তাদের আচার আচরণ , ভয়েরিজম , একাকীত্ব মেটাবার উপায় সব কিছু নুরি বিলগে জাইলান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন হিপোক্রিসিটা কে কিভাবে কোন পরিস্থিতিতে করে।
প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায় পশ্চিমে পাহাড়ের কোলে যে গ্রাম সে গ্রামকে পেছনে ফেলে পুবের যেদিকে সেই হাইওয়ে যা ইউসুফকে বহুবছর বহুমুখী শহুরে হাতছানি দিয়েছে তার কাছে পরাজিত হয়ে বহুজাগতিক স্বপ্ন নিয়ে তার বাড়ি ছেড়ে হাইওয়েতে এসে গাড়ি ধরার দৃশ্য ,দূরের পুবের সূর্য উঁকি যে দিচ্ছে তা বুঝা যাচ্ছে পশ্চিমের গ্রামের শেষ মাথায় আলোর উপস্থিতিতে।সে এক চিলতে আলোটাকে সাবটেক্স ধরলে বোঝা যায় পূবের পাহাড়ের ওপাশেই আলো বা তার জাগতিক পরিবেশের মুক্তি তাই যেন ছুঁয়ে আলোকিত তথা আনন্দিত হতে যাচ্ছে ইউসুফ পরিচিত শিকলবাধা পরিবেশ ছেড়ে। এক শটেই ইউসুফ চরিত্রের ভুত ভবিষ্য বলে দেওয়া হল এমনকি কালার সাইকোলজি মেইনটেইনস করে। দ্বিতীয় শটে আমরা মাহমুদ নামের চরিত্রকে দেখি তার বায়ে তাকিয়ে থাকতে যেখানে ডিফোকাশে একজন নারীকে নিজের পোষাক খুলতে দেখা যায়।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিভিন্ন অনুশাসনের কারনে ফ্রয়েডীয় সেকেন্ডারী রিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এখনো যে মানুষদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে এবং তা অবশ্যই মানসিক তাইই ফোকাশে থাকা মাহমুদের দোলা-চল-মনোবৃত্তির অভিনয়েই উপস্থাপন করা হয়েছে, যা তৃতীয় শটেই আমরা প্রমাণ পাই জীবনের কষাঘাতে পিষ্ট হয়ে শরীর বিকাতে বাধ্য হওয়া মেয়েটি পথচারীর কুচকানো চোখ উপেক্ষা করে দ্রুত রাতের ঘুমন্ত রাস্তায় হারিয়ে যাওয়া দেখে। এরপর মাহমুদের ব্যাচেলর জীবনের সাতকাহনকে কয়েক গন্ডায় দেখিয়ে নুরি প্রমান করে দিলেন কিভাবে পোষ্টমর্ডান রিলেশনে এসে ব্যাক্তি মানুষ জাতি , কম্যুনিটি , নেইবারহুড , ফ্যামিলি ছেড়ে এককেন্দ্রীক হয়ে উঠছে এবং তা হয়ে ওঠার কারনগুলোও চোখে আঙ্গুল দিয়ে ধরে ধরে দেখিয়েছেন । স্পিনোজার সেই তিন প্রাইমারী আবেগ যথা বাসনা , সুখ ও বেদনা কিভাবে পোষ্টমর্ডান ক্যাপিটালিষ্ট সোসাইটিতে এসে শুধুমাত্র সেকেন্ডারী আবেগ তথা আশা ও ভীতি , সংকল্প ও হতাশা , স্বস্তি ও প্রত্যাশার আলগা স্তর দিয়ে কাঠখোট্টা ভাবে চলাফেরা করছে তাও তিনি ব্যাপক প্রাকৃতিকভাবে চিত্রায়ন করেছেন। ইউসুফ এর আসার খবর বেমালুম ভুলে গভীর রাত পর্যন্ত প্রতীক্ষা করিয়ে মাহমুদ ফিরে এসে বিন্দুমাত্র অনুতাপ না করে মুখে সরি অথচ নির্বিকার মুখভঙ্গি দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন ইউসুফ ও মাহমুদের অর্থনৈতিক ও মানসিক অবস্থার অবস্থান।
আবার সেইদিনই মাহমুদের বাসার সামনে অপেক্ষমান সময়ে ইউসুফ রাস্তায় একটা সুন্দরী মেয়েকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাওকে না দেখে চোখে সানগ্লাস ও সিগারেটে সুখটান দিয়ে রাস্তায় পার্কিং করা গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ফ্ল্যাটিং এর চেষ্টা করে কিন্তু পরক্ষণেই গাড়ির আলার্ম বেজে উঠলে এবং সামনের বাড়ি থেকে গাড়ির মালিক চেঁচানোর ফলে পরিবেশটা স্যাটায়ার হয়ে উঠে। এই যে একটা গ্রাম থেকে ছেলে শহরে এসে খাদ্য , বাসস্থান এর জায়গা ঠিক করতে পারল না , শহরটাকে বুঝে উঠতেই পারল না অথচ ম্যাস-মিডিয়ার হিরোইজম-ফ্যান্টাসি যে তাকে কিভাবে দখল করে আছে এবং তা যে এভাবেই ব্লাষ্ট হয়ে ছাপোষা ডিজায়ার গুলোকে উশৃঙ্খল বানিয়ে ছাড়ছে তাদের নিজেদের অজান্তেই এবং তা যে কত সহজভাবে বলা যায় তাইই শেখা যায় নুরির সিনেমা দেখে।এরপর ডাইনিং টেবিলের মুখোমুখি বসে থাকা ইউসুফ এর অর্থনৈতিক মন্দার কারনে তার বাবা ও তার ফ্যাক্টরীর চাকুরীর বসে যাওয়ার ঘটনা বলে।
এবং যেহেতু অভিজ্ঞতা ও ইন্টেলেকচুয়ালী ইউসুফ মাহমুদকে বড় মনে করে তাই কিছুটা মতামত শুনার জন্যই সে উল্লেখ করে যে সে এখন নাবিক হিসেবে কাজ করতে চায় তাহলে ডলারে টাকা কামাবে এবং পরিবারের সচ্ছলতা আনবে যেমনটি ঠিক তেমনটি করে তার বিভিন্ন জায়গা ঘুরাও হবে। এ কথা বলার পর আট দশটা দেশের সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসা মাহমুদের উন্নাসিকতা কিছুটা হলেও প্রকাশিত হয় যখন সে বলে এত নিঃসঙ্গতা ইউসুফ বহন করতে পারবে কি না বা এত স্থান ঘুরার আদৌ কোন দরকার আছে কিনা যেহেতু প্রত্যেকটা স্থান শেষমেষ একটা জায়গায় যেয়ে একই। নতুন পরিবেশ আসা ইউসুফ যার সরলতাটা এখনো রয়ে গেছে সে বলে ফেলে যে মাহমুদ ঘোরাঘুরি করতে পারলে সে পারবে না কেন। এরপর একটু হলেও মাহমুদের উন্নাসিকতা হোঁচট খেয়ে যেতে না যেতেই তখনো সেই উন্নাসিকতা থেকেই আন্ডারএষ্টিমেট করে বসে হাই কালচার ও লো কালচার নামক নাক সিটকানো রুচি রুচি খেলার অরুচি থেকে তাও আবার দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন এর থিওরী ঘুরে ফিরে।
এই থিওরি মতে একই শব্দ বা বাক্যের একাধিক অর্থ আছে। যেহেতু প্রতিটি শব্দ একটি ইমেজ বা ছবির প্রতিনিধিত্ব করে তা শব্দানুযায়ী সে বাস্তব বা অবাস্তবই হোক না কেন। ফলে ব্যাক্তিমানুষ কোন কথাটি কিভাবে গ্রহণ করবে তা তার ব্যাক্তিগতভাবে দেখে আসা বাক্যের বা শব্দগুলির ইমেজ, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে এর উপর নির্ভর করবে ।পুরো সিনেমা জুরে আমরা এই ডিকনস্ট্রাকশন এর দ্বন্দ্ব নানাভাবে দেখতে পায়।
একটা মাটির পুতুলও বানাতে গেলেও মাটি, আগুন ,আবহাওয়া সহ কত কিছুর স্বভাব জানতে হয় তা যখন মানুষ আর্টকালচার এর সাথে জড়িত তখন তার কারবার মানুষ , মানুষের স্বভাব নিয়ে ফলে মানুষের আদি অন্ত বর্তমান না জানলে কেমন করে মানুষ নিয়ে কারবার তথা আর্টকালচার করবে! ? আর ভালোভাবে জানতে হলে মুক্ত থাকতে হবে মন তথা মস্তিষ্ক। পনেরশ শতকে ফ্রান্সিস বেকন বলে গেছেন ৪টি পূর্বসংষ্কার থেকে মনকে মুক্ত থাকতে হবে সেগুলো ক্রমানুসারে মানবীয় পূর্বসংস্কার, ব্যাক্তিগত পূর্বসংষ্কার,জনশ্রুতিমূলক পূর্বসংষ্কার ও পরিকল্পিত পূর্বসংষ্কার। এবং এই চারটি পূর্বসংষ্কার সম্পূর্ণরুপে না ভাঙ্গলে আমি তুমি ও সে যেই হিপোক্রেসিটা মাঝে মাঝেই নিজের অজান্তেই করে ফেলিনা তা হতে বের হতে পারব না বরং মুখে আমরা পকড় পকড় করে কাজে যেয়ে ঠিকই হিপোক্রিসিটা বরাবরই করে ফেলব যেমনটি এই সিনেমার মাহমুদ ও ইউসুফ করে বসে পদে পদে।
মূলত এই সিনেমাটা পোষ্টমর্ডান সোসাইটির স্বরূপ বিশ্লেষণ করে যেখানে নারী আর বউ হতে চাই না বরং পার্টনার হতে চায় , মানুষগুলোর ক্রাইসিস যেখানে ইন্ডিভিজুয়াল আইডেন্টিটির যা তাকে ক্রমাগত ব্যাক্তিস্বার্থের দিকে নিয়ে যেতে যেতে নার্সিসাস করে তুলছে। ক্যাপিটালিষ্ট সোসাইটি ব্যাক্তিগতসার্থের জন্য তাদেরকে প্রডাক্ট বানিয়ে ফেলছে এবং তাদের কনজুম করছে। আর তাদের সবার পোষাক রুপে থাকে ক্রিসপি স্পাইসি হিপোক্রিসি যা বাধ্য করে মানুষগুলোকে বিছিন্ন হয়ে যেতে এবং নিজের মধ্যে বুদ হয়ে সময়টাকে কাটিয়ে দিতে ঠিক যেমনটি শেষ দৃশ্যে মাহমুদ জাহাজ চলে যেতে দেখে ঠিক তেমনটি করে জীবনও চলে যায় একা পথে কোন এক অজান্তের নিরালায় ।
শেষটা কবিতায় হোক—
‘ঠিক আমাদের সামনে কাটাতাঁর পেরিয়ে
বেড়ার ওপাশে ঝোপের মধ্যে দাড়িয়ে আছে
এক এরোপ্লেন
পাশে এক বংশীয় কিছু ঝুলন্ত দোলনার দল নিশ্চুপ
বসে আছে
আর এদিকে নিঃসঙ্গতা বেটে নিচ্ছিলো আকাশের শিশির
ও এক ল্যাম্পপোষ্টের নিচে শুয়ে থাকা নিজের
অজান্তের একান্ত সময়টুকু উপভোগরত
রেললাইন।‘