কুলাউড়া জংশন ও অন্যান্য কুহক । মঈনুস সুলতান
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ৬:০৪ অপরাহ্ণ, | ২৭৮৬ বার পঠিত
সুহাইল সুহাইল
বুকের বাঁ পাশে এত শূন্য খাদ
সৌরকলঙ্কের মতো শিখার উচ্ছ্বল আতশবাজি,
কোথায় আমার হৃৎপিণ্ড?
এত যে জনতামুখর মজলিশ
এত রাসায়নিক কোলাহল,
চোখে রূপালি কাম
আর ক্লান্তির তেজস্ক্রিয় অনল —
কেন যে আমি একা হয়ে পড়ি
নিঃশব্দে-ডুবে-যাওয়া চরের মতো
একা…একা… গভীর গভীরতর;
অথচ কোনোদিন নিঃসঙ্গতাকে প্রিয় সম্বোধনে ডাকিনি,
বলিনি কথা বাষ্পীভূত গাঢ় স্বরে,
কররেখা আঁচ করার মতো দেখিনি তার মোহন মুখশ্রী।
হায়…নিঝুম নির্জনতা
তোমার চারু চোখে কি কেবলি বিষণ্ন লাবণ্য,
তুমি কি প্রতি নিশীথে অরেঞ্জ বর্ণের স্পেস্-বলাকায়
উড়ে যাও মহাশূন্যে
অথবা ফেরেশতার অশরীরী ডানায় ভ্রমণ কর
চিত্রা বিশাখার কক্ষপথ!
জ্যোতির্বিজ্ঞানীর মতো তাকিয়ে থাকি আকাশে
বিযুক্ত হৃদয় মানুষ আমি কোথায় যাব,
কোথায় পাবো প্রশান্তির অশ্রুমর্মর সোম?
নীলিমার যূপকাঠ থেকে ধূমকেতু ধূসর রজ্জু
ফাঁসির মুদ্রায় রোধ করে কণ্ঠ
উঁইঢিবির মতো পৃথিবীকে আপন জেনে
পদযুগল গেড়েছে শিকড় —
মগজে নক্ষত্রনিনাদ আমি কোন পথে যাব?
আজগুবি অবাস্তব
পাহাড় থেকে রূপালি জলের রেলগাড়ি
ঘণ্টা বাজিয়ে নুড়িপাথর বালুকায়
চলে আসে আজ সমুদ্রের মোহনায়
তোমার ছনে-ছাওয়া গোলকুটির
জেব্রাবন পিঁপড়ার ঢিবি পাড়ি দিয়ে সুদূর সাভানায়
শুনতে কী পাও আমিনাতা — বহতা জলের নিনাদ?
আমার প্রেষণা আজ নিখাদ।
অনুপম মানবী তুমি আমিনাতা বাঙগুরা
ছড়াও ঘাসের বীজ একাকী আঙিনায় উর্বরা
চয়ন করো মাকড়শার জাল
ভুবনচিলের পালক ধরে থাকো কৃষ্ণ করপুটে
কোমরে বাটিকের র্যাপার লিলুয়া বাতাসে বেহাল
ভাসি মোহনায় — নদীর নোনাজলে পালতোলা বোটে।
তোমার বিষয়আশয় — জাদুটোনা মরমী মায়াময়
সহজে বোঝা ভার তারুণ্যের তুকতাক
শিকড়ে মাখাও পশুর মেধ
বাজাও শঙ্খ — চৌকাঠে দাও খড়ির আঁক।
আজ বিকালে মৃদু দোলে আমার আশ্চর্য এ জলযান
মনে হয় তুমি আছো আমিনাতা খুব কাছে
আমার হৃদয়মাঝরে ধুকপুক করে তোমার প্রাণ।
আসতে পারো যাদুবলে স্রেফ উড়ে
প্রত্যাশার ধূপ নীরবে পোড়ে
খাড়ির কোমর জলে দাঁড়িয়ে
বালু ছেঁকে খুঁজতে তো পারো খাঁটি সোনা
জলমহালের ঘোলা শীশে ছায়া ফেলে
কালপুরুষের বঞ্চিত বাসনা।
শ্বাসমূলের বনে ঘন হয়ে ছায়া নামে
জোড়া শুশুক ভাসে নায়ের বামে
আসো — নদীজলে নেমে যুগলে করি গোধূলির স্তব
কী আসে যায় আমিনাতা
হলোই বা তাবৎ কিছু আজগুবি অবাস্তব।
কুলাউড়া জংশন
কাজলা কইতরের ডানায় জ্বলে
সুরমাগোধূলির ধূপকলি,
উড়িয়ে ধোঁয়ার ধূসর ধূমকেতু
কয়লার ইঞ্জিনখানি চলে যায় কাঁঠালতলি;
প্যাসিঞ্জার নয় সে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে —
বাঁকে তার কলসি… আধছেঁড়া শিকে
বাতিগুলো এখনো জ্বলেনি যে এদিকে;
রেললাইনে বসে তাস পিটে —
গামছা মাথায় জনাকয় মুটে-মজুর,
ওভারব্রিজে লাঠি ভর দিয়ে হাঁটে
মানুষ এক মজবুর,
হলকুম খুলে জিকিরে মাতে
ডাউনট্রেনে-আসা খোঁড়া ভিখারি,
দাঁড়িয়ে তার পাশে আলতা পায়ে এক নারী…
কোন ট্রেনে এল সে —
গলায় কী তার জড়োয়ার সোনালি বন্ধন,
এসবের খতিয়ানে কেলনারে জমে
গুলতানির নন্দন;
পান-বিড়ি চা-গরমের কোলাহলে কাহিল
সারা দিনমান কুলাউড়া জংশন,
বুকস্টলে ঝিকঝিক শব্দের ভেতর
পত্রিকার অক্ষরতন্ত্রে কারা করে
সাম্প্রতিক তথ্যের তর্পণ!
হংসধ্বনির রঙিন তান
বৃক্ষের কাণ্ড কুঁদে বানানো যেতে পারে
ভারী বজরা, সিন্ধুকের মতো কফিন
কিংবা ঝর্ণানুড়িময় রোদে ঈষৎ রূপালি মানবী
নৌকার গলুইতে আঁকা গৌতম প্রতীকে জমে যে জল
অরুণিম ঊষার দিকে উড়ে-যাওয়া কাকাতুয়া
আলোর দোলাচলে হয়ে যেতে পারে ছবি।
ঝর্ণা-সজল ধারাপ্রতিমায় গড়ানো দ্যুতিময় নুড়ি
পাড়ে ফেমিং রেডের জেওরে সে অনুপম,
নহরে পাপড়ির লোহিত প্রতিবিম্ব
তরুতে মিশে যায় মানবী
বাস্তবের সাথে খোয়াবের তারতম্য খুবই কম।
গাছের খোড়লে বাস করে অন্ধ কাকাতুয়া
আমার সামনে এসে দাঁড়ায় যে সচল তরুবর —
আকাশ-করুণ শিশিরে তার পালক ধোয়া
হৎপিণ্ড চিরে পাঁজরের কড়িবর্গায়
তৈরি করি একটি ঘর।
অভ্রের জাফরিতে বোনা সে-খোয়াবমঞ্জিল,
কিসের সুর যেন ঘুরে ফেরে
অলীক প্রসূনের আবীর-ছড়ানো পাপড়িতে
শূন্যতা বাস করে হালফিল।
মননের ঘোর অমাবস্যায় এ তরু ঝর্ণা হয়
ঝুরে ঝুরে বাজায় হংসধ্বনির রঙিন তান,
গৃহহীন মানব — বর্ণের বিধুর মহলে
হয়েছিল ক্ষণিকের মেহমান।