প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ থেকে কয়েকটি কবিতা / ফকির ইলিয়াস
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জানুয়ারি ২০১৫, ৫:৪৭ অপরাহ্ণ, | ২৯৩৭ বার পঠিত
বৃষ্টিবাদী কার্তিকের হাত
নোঙর ফেলেনি কেউ,
তবু দেখি দাগ লেগে আছে বন্দরের হাড়ে
উড়ছে বাষ্প- সাগরমাতৃক প্রেমার্দ্র সকালে
সবকিছু ভুলে, দাঁড়িয়ে আছে যারা
অথবা নাড়ছে হাত- বিদায়ের
ফিরে আসবে বলে যারা কথা দিচ্ছে
তাদের উদ্দেশ্যে।
যারা ফিরবে না- তাদের বিরুদ্ধে কোনও
অভিযোগ নেই আর
বরং যারা বৃষ্টিবাদী কার্তিকের হাত ছুঁয়ে
ভালোবাসার কথা বলেছিল,
সমূহ হিসেব-নিকেশ আজ
তাদের সাথে। যারা বেঁচে আছে
এবং থাকবে যারা
তাদের জন্যেই বছরের নতুন দিন।
নতুন অন্নের ভাপ
নতুন বিরহবিতর্ক, প্রেম-উৎসব
সবকিছু
সবকিছু ।
ঘোরবাস্তবতা
ঘুম আমাকে অনেক স্বপ্ন দেখায়। যখন ঘোরের ভেতরে থাকি, দেখি—
যে ছাইসমগ্রের উষ্ণতা দানা বেধে উঠেছিল আমার বুকের দুপাশে, ওরা
এখন চলে যাচ্ছে সমুদ্রে। স্নান সারবে বলে দুটি পাখি উড়ে এসে জুড়ে
নিচ্ছে সেই মহাগড়। আর অশ্রুর অমাবস্যা যে রাতকে পোশাক পরিয়েছিল
সেই মধ্যরাতের ছায়া অনুসরণ করছে সবকটি জীবনের সোনালী স্তবক।
আমাকে যে নারী পড়তে দিয়েছিল ঘোরবাস্তবতার অভিধান— সে এখন
আর এই দেশে থাকে না। কোথায় থাকে সেই ঠিকানাও নেই আমার কাছে।
দূরালাপ কিংবা আন্তর্জালের ছাপচিত্র, আর কুয়াশা জড়ানো প্রিয় ভোরও
জানে না প্রাক্তন প্রেমিকারা মায়াঘোর জাগিয়ে কোথায় চলে যায় !
আমাকে বিরহ উপহার দিয়েছিল যে ঢেউগুচ্ছ, আমিও এখনও তাদের
কাছেই ফিরি। প্রাণকে পরিণত বিচ্ছেদী গেয়ে নিঃশ্বাস নিতে হয়।
যে ঘোর ভালোবাসি এখন—
দেখি, তার পাশেও পড়ে আছে সিলিকন ভ্যালীর জং ধরা মুদ্রাছায়া ।
প্রান্তিক পক্ষশক্তি
আমিও অনেকটা টিপসই জানা মানুষ। বৃদ্ধাঙুলের রেখায় যে কালো কালি
লেগে থাকে তার দিকে তাকিয়ে চিনি আঁধারের পরিচয়। জানি,নিরক্ষর
নদীদের জন্মঠিকানা। পাহাড়ের আত্মদানের ইতিহাস।চূড়ার অতীত জীবনী।
যারা কিছুই জানে না বলে দাবী করে, তারা কিছুটা হলেও জানে গৃহপ্রবেশের
কৌশল। আমি এ বিশ্বাস স্থাপন করেছি পাতাদের হাতে হাত রেখে।দক্ষিণের
মৃদুহাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে নিতে তাকিয়েছি দূরের সমুদ্রপাথরের দিকে।অবেলায়।
আমি কী কখনও বেলাচিহ্নের পূজারি ছিলাম!কখনও কী চেয়েছি একহাতে
খুলে দেখতে তোমার দেয়া ঘামে ভেজা প্রেমপত্র ! অথবা রুমালের ছায়া
পাচার করে আমি কী চেয়েছি, গড়ে তুলতে ভোগের লাল-নীল দালান !
কেউ আমার পক্ষে দাঁড়াক, তা আমার কাম্য ছিল না। আমার কন্ঠে—
কন্ঠ মিলিয়ে সুর তুলে উড়ে যাক কোনও হলদে পাখি, তা-ও চাই নি
আমি।তারপরও আমার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল চাঁদ আর তার প্রতিবেশিরা।
নিকষিত বৃক্ষের ভ্রূণে
পাঠের আনন্দ নিয়ে ভাসে নদী। ছানিপড়া চোখের ভেতর
যে ঘুম জমে আছে, তা আমাকে দেখতে দেয় না অনেক
কিছুই।তবু তাকাই – বৃষ্টির আলো এসে ঝাপটা দেয়
শিমুল শাখায়। আবার বসন্ত এলে যে পাখি ফিরবে ঘরে,
আমি তার অপেক্ষায় থাকি।
প্রেম,প্রতীক্ষার অণুসূত্র জানে। ভ্রূণ জানে জন্মের গন্তব্য।
আমার দেখার প্রান্তে সেই গন্তব্যের মায়াজাল ছড়িয়ে
থাকে- আমি তাকে বলি সংসার,আমি তাকে বলি ছায়া।
তুমি ছায়াবীথি হও।
নিকষিত টলটলে জলের মত ভাসাও আমাকেও,
এখানে সমুদ্র ছিল,সেকথা সবাই জানুক
এই আকাশ দেখুক নবায়নের হলুদ কঙ্কাল।
বীজ আর বীক্ষণের শিয়রে
মাঝে মাঝে খুব বেশি ভুল করে ফেলি। অভিমানী পৃথিবীর
দিকে তাকিয়ে দেখি ক্ষয়িষ্ণু বোধের বিকেল, আমাকে গ্রাস
করতে এগিয়ে আসছে। যারা আমার সাথী ছিল , তারা সবাই
বেছে নিয়েছে অকাল অবকাশ। পেরিয়ে মধ্যবয়স তারা আর
কোনো নদীতেই কাটতে পারছে না সাঁতার।অথচ আমরা বার
বার ভাসবো- ডুববো , তারপর কৌশলী ডুবুরীর মতো ভিড়ে
যাবো রৌদ্র উপকূলে, এমন একটা প্রত্যয় ছিল খুব গোপনে।
সব গোপন , সকল সময় আর লুকানো থাকে না। রহিত রাত
এসে আলিঙ্গন করলে একান্ত বিরহও হয়ে যায় মায়াবী বুনন।
বীজ আর বীক্ষণের শিয়রে বসে শুধু হাত নাড়ে ভুলের রুমাল।
সে ও ধারণ করে রেখেছে কিছুস্মৃতি,বৈশাখে আমাকে দেবে বলে।
লিখিত প্রবন্ধের পাতায়
একদিন আমরা সগর্বে ভাড়া দিতে চাইবো বৃষ্টিকুসুম ঘুম। যারা অনাদি কাল
অনিদ্রায় আছে, তাদের কাছে গিয়ে দিতে চাইবো রাতের ঘনিষ্ট বিবরণ।কতোটা
হাতে নিলে পরখ করা যায় শিশির, কতোটা পা ভিজে গেলে দেয়া যায় অর্ধমৃত
নদীর সংজ্ঞা- সব কিছুই খোলাশা করতে চাইবো, লিখিত প্রবন্ধের পাতায়।আর
যারা দলিল লেখক, তাদেরকেও ‘লেখক’ অভিধা দিয়ে সেরে নিতে চাইবো স্থগিত
উপনির্বাচন। যারা কখনও ভোটের রাজনীতি শিখেনি, তারা আমাদের এই সহজ
বন্দোবস্ত দেখে নোয়াবে মাথা। যাদের চুল আছে- কিংবা যারা টাকমাথায়
ব্যবহার করেছে দীর্ঘ চুলের জন্য বনজ মহৌষধি, তারা সকলেই এসে দাঁড়াবে
আমাদের পেছনে।অতঃপর ‘স্পেস ফর রেন্ট’ লেখা ব্যানার হতে শিশুরা জমাবে
কুচকাওয়াজ। অনাবাদী নক্ষত্রগুলোর পালক ঝরতে দেখে কাঁদতে থাকবে একটি
বুড়ো জারুলবৃক্ষ।
আসন বিষয়ক জলবিন্যাস
বসার জায়গা নেই।নেই দাঁড়াবার জায়গা।থমকে আছি
নেই ভবিষ্যতগামী আকাশের ছায়া।
তবু আশ্রয় চাই বলে মাটির কাছে পেতেছি হাত,
বায়ুমিশ্রণে শুদ্ধ করছি আয়ু, কবিতা লিখবো বলে
মেঘের মনকে বলেছি ভালোবাসি।
কোনও পরব না জেনেই সাজিয়েছি রোজনামচার পাতা
একটি আকাঙ্খা বার বার করেছে জলবিন্যাস
আহা! বড় কবির পাশে বসে আমিও যদি আদৌ কবি
হতে পারতাম!
অথবা যদি দেখতে পারতাম, সুতোশিল্পে কত মায়াছানি
দিয়ে জড়িয়ে থাকে বুকের বোতাম। কত লালসায়—
কামুক নদীস্রোতে হাত দিয়ে আমরা পরস্পরকে
বলতে পারি-‘ভালোবাসি’ !
মায়াশিশির
হতে পারে এ-ও আমার ভ্রম—
শস্য এবং শিষ্যের পার্থক্য জানি না।
পৌষের মায়াশিশিরে ডুবে থাকে যে সবুজ আলুক্ষেত-
বুঝি না তার গৌরবের ভাষা।মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা
খনিজের ঐতিহ্য।
হতে পারে এ-ও আমার পরাজয়—
যে কান্নার ধ্বনি কোনও অশ্রুপাত ঘটায় না
অথবা যে ভোর আলোবিহীন দিনের সূচনা করে,
আমি তার বশ্য হয়েই করেছি কালাতিপাত।
শস্য খুঁজতে গিয়ে দেখেছি,
জমিতে পড়ে আছে অগ্রহায়ন পরবর্তী কাঁচি’র দাগ
উচ্চকিত নাড়াকন্ঠ-
তার শিষ্য ভেবেই আমাকে বিলিয়ে দিয়েছে
অজস্র বিরহ।
হতে পারে এ-ও আমার অপারগতা—
আজীবন পরম শীতের আরাধনা করে যে প্রেমিকাকে
দিতে পারিনি মাঘের উষ্ণতা, তার কাছে
ক্ষমা চাইতে পারিনি বলে, কুয়াশাও ঝরে পড়েনি
আমার মাথার উপর।
শুধু উড়ে গেছে মেঘ- উড়ে গেছে পাখি
অনেক দূরাকাশ দিয়ে
বসন্তের ঝড় যেমন যায় বিজলি বাজিয়ে ।
কেউ কেউ জানতে চাইবে
অনেকের ভালো লাগে না বিচ্ছেদভৈরবী।যারা শালুক সন্ধানে
মাড়িয়েছিল বিলের ছায়া, তারা দেখেছে হাওয়ার ভরাট সামন্ত
কী যাদু নিয়ে লিখে রাখে পাখিদের কোলাহল। কবিতার খাতায়
প্রিয়তমার নাম লিখে রাখার সাহস দেখাতে পারেন ক’জন কবি।
অথবা যার কোনো আরাধনা নেই- সেই মানুষটি পাপ মোচনের
পরীক্ষা পাতায় কেমন কান্নার ছবি আঁকে, সেই স্ন্যাপশট
কত গভীরে তুলে রেখেছে বসন্তের যাদুঘর।
বিরহ অনেক কিছুই জানতে চায় জীবনের কাছে। অপঠিত
সেই ধারাপাত পড়ে যারা শুদ্ধ হবে,
হয়তো তাদের কেউ কেউ একদিন জানতে চাইবে
এই জননগরে আসলেই কোনো প্রেমিক-প্রেমিকার
বসবাস ছিল কী না!
সোহাগপুরের বিধবারা
সোহাগপুর থেকে যে বিধবারা ঢাকায় এসেছিলেন, তারা
এখনও খুব ভীত। তাদের চোখেমুখে এখনও একাত্তরের শোক,
স্বামী হারানোর বেদনা,আর গ্লানি-সেই জল্লাদদের প্রতি,যারা এখন কী না
এই বাংলাদেশে শান্তির বাণী শোনায়!
তারা দিতে এসেছিলেন হলফনামা- একজন খুনি রাজাকারের
বিরুদ্ধে, যে বলছে এ দেশে কোনও মুক্তিযুদ্ধ হয় নি!
আমরা যারা একাত্তরের গণহত্যা দেখেছি, তারা শেরপুর
কিংবা মীরপুরের কসাইদের চিনি। জানি –
চট্টগ্রামের জল্লাদদের নাম, বদরবাহিনীর সেই নোংরা খানে দাজ্জাল
কী জিঘাংসু হাত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মজলুম মানুষদের
উপর। রক্তে ভেসেছিল – কর্ণফুলি-পদ্মা-বুড়িগঙ্গা
মেঘনা-সুরমা-যমুনার চর।
যারা বিরত ছিলাম সত্য বলা থেকে, আমরা যারা সাক্ষী
হতে পারিনি,
তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে
এসেছিলেন সেই বিধবারা- যারা বলছিলেন
আমরা বিচার চাই, মাননীয় বিচারক-
সুবিচার চাই আরো একটিবার।
এই বাংলায় আবার দেখতে চাই একাত্তরের বিজয় পতাকা।