নীরবতা ভেঙে ভেঙে ও অন্যান্য কবিতা । ফকির ইলিয়াস
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ ডিসেম্বর ২০১৩, ৬:৫৮ অপরাহ্ণ, | ৩৭১৭ বার পঠিত
হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়ে শাদা শালিকছানার দল। এই নদীতীরে তারা এর আগে কখনও আসেনি। ঢেউ দেখবে বলে যে মানুষটি নদীর উদ্দেশে যাত্রা করেছিল- সেও হাঁটছে পাখিদের পাশাপাশি।
সুখ এবং দুঃখের সমান্তরাল ছায়া ব’য়ে যে মেঘ চাঁদ স্পর্শ করে, কিংবা আলো এবং আঁধারের রোজনামচা লিখে রাখে যে আদিম সূর্য, আমি সেই চন্দ্র-সূর্যের মাঝেই পাখি ও মানুষের ভবিষ্যত খুঁজি। যে পাখিছানা একদিন বড় হয়ে আকাশে উড়বে অথবা যে শিশু একদিন পরিণত বয়সে বিশ্বে উড়াবে মানবতার পতাকা, আমি তাদের জন্যই লিখে যাই আমার কবিতা। জানি, ‘কবিতা লিখে কিছুই হয়না’ তারপরও পংক্তির রঙিন কররেখায় বার বার লিখিত হয় আমার জীবন।
জীবনের প্রতি আমার কোনো অনুযোগ নেই। যা আছে, তা কেবল বর্ষা এবং বসন্ত ঋতুর প্রতি। কারণ বর্ষা আমাকে উদাস দুপুরে তার বুকে ভাসতে দেয়নি। আর বসন্ত দেয়নি আমাকে প্রাণখুলে তার কৃষ্ণচূড়ার লালআভা।
আমি রঙের মাঝেই আমার বিগত দিনগুলোকে মিশিয়ে দিতে চেয়েছি। তারপর নীরবতা ভেঙে ভেঙে বিরহসমগ্রের কাছে খুঁজেছি ঠাঁই। এই মাটির প্রতি গভীর বিশ্বাসে, প্রেমিক যেমন প্রেমিকার হাত ধরে বার বার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, পুষ্প যেমন ঝরে পড়ার প্রত্যয়ে খুব ভোরে শিশিরের সাথে প্রতিজ্ঞা করে।
যে চাঁদ গীটার বাজাতে জানে
এখানে একটি নদী ছিল। সেই নদীর তীরে বসে কাঁদতো একটি চাঁদ। চাঁদটি ভিটেহীন ছিল একশ দশক। গল্পটা এভাবেই শুরু হয়। আমরা জেনে যাই গৃহহীন প্রতিপত্তিবানদের অতীত ইতিহাস। তারপর হাঁটি। হেঁটে যাই ঘাট পর্যন্ত। যে ঘাটে একদিন ভিড়তো ভাঙা নৌকো। নৌকোর তলানি থেকে পানি সেচে এই এই নদীতেই ফেলে দিতো প্রাজ্ঞ মাঝি। আমরা মাঝির হাতের কারুকাজ দেখতাম। আর দেখতাম শেষরাতেও নদীপাড়ে থামে না মানুষের কোলাহল। নদী পারাপার।
এখানে একটি ঝড় ছিল। সেই ঝড় এখন হারিয়ে গিয়েছে অন্য কোনো দেশে। তাই এদেশের মানুষ ভুলে গেছে কীভাবে ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সাজাতে হয় জীবন। অথবা ঝড়ের মতোই মাঝে মাঝে কীভাবে সবকিছু তছনছ করে দিতে হয়। যে ভাবে হায়েনা শত্রুশিবির এই মানুষেরাই ভেঙে দিয়েছিল একাত্তরে।
নির্বাসিত ঝড় আর ভিটেহীন চাঁদ এখন একটি দ্বীপে অবরুদ্ধ জীবন কাটায়। ঝড়- দুঃখ সহ্য করতে পারলেও, চাঁদ তা পারে না। আমরা সেই কান্নার ধ্বনি প্রতিরাতে শুনি চাঁদের গীটারে।
বিফল পাহারাদার
আমার কাছে চমকে দেবার কোনো চেরাগ নেই। নেই পুড়িয়ে দেবার জন্য আগুনের কোনো হলকা। এই যে বনবিথী আমাকে শাসন করে, তাকে ঢেকে দেবার জন্য আমার হাতে নেই কোনো রঙিন পোশাক। বেআব্রু নদীর পাশেই শিথান পেতে, যে আমি ঘুমিয়েছিলাম অনন্তকাল- তার হাতে দেবার মতো নেই একটি গোলাপ।
আমি পাতার পরিহাস দেখেছি। দক্ষিণমুখি ঢেউয়ের আঘাত যখন স্পর্শ করেছে আমার কনুই- অনুভব করেছি কীভাবে ভেঙে পড়ে পাড় আর কীভাবে ভিটে বদলায় মেঘনা পাড়ের মানুষ।
থৈ থৈ বসন্তের বন্যায় দাঁড়িয়ে তোমাকে একটি নক্ষত্র দেবার মতো সাহস আমার কোনো কালেই ছিল না। আর ছিল না বলেই সংসার আমাকে পরিত্যাগ করেছিল অনেক আগে, আমি একাই আনমনে হয়ে গিয়েছিলাম ভাসমান মেঘের বিফল পাহারাদার।
জন্মান্ধ ভোরের গান
কিছু কাঁটা রেখে যাবো। কিছু গোলাপ, বিলাপ করে ডাকবে তোমার নাম- পরিণাম কিছুই জানি না। কবিদের পরিণাম জানতে নেই। উচ্ছ্বসিত ঢেউয়ের জ্যোতি দেখে কেবলই নিবারণ করে যেতে হয় চোখের অশ্রু। আর সমষ্টিগত মাটির নিবেদিত আলোক্ষেত্র।
কিছু জল রেখে যাবো। কিছু অনলের কাছে দাঁড়িয়ে- সাক্ষী দেবো আমিও প্রত্যক্ষ করেছি মৃত্যুর অনর্গল হাসি। যে হাসি দেখে সজীব থাকে ঘাসের বুকে জেগে উঠা সবুজ সমাধি।
রেখে যাবো শব্দ–শব্দের কফিন এবং কয়েকটুকরো কালো কাপড় তুমি সেই কাপড় আকাশের গায়ে জড়িয়ে, সাজিয়ে দিও সবটুকু রাতের শরীর। আর লিখে দিও- এই কাব্যজনক একটি মৃত নদীর মতো জন্মান্ধ ছিল।
দমের নোঙর
তোমাকে দেখি নি চোখে , হে নদী – নদের বান্ধব
অথচ একদিন তোমাকেই দিয়েছিলাম সব
ধূলো-বালি, নুড়ি -খড়
অথবা প্রেমিকার হাতে ছোঁয়া পৌষের ঝড়
রাখিনি কিছুই গোপন- ছবিগুলো জলের সাকারে
জানি, যে জানে মন্ত্রকথা কেবল সেই দিতে পারে
উজাড় প্রাণের পাখি, কলরব ভোরের বাগান
ফুলের পাপড়ি আর ভরাগাঙে বিচ্ছেদি গান
যেভাবে মাঝির ধ্যানে কেটে যায় হাজার বছর
আবার মিলন হবে- ঢেউ পাবে দমের নোঙর…
ফকির ইলিয়াস –
কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা – ১১।
সাম্প্রতিক প্রকাশিত গ্রন্থ- ‘ ছায়াদীর্ঘ সমুদ্রের গ্রাম’ ( কবিতা ), ‘ গুহার দরিয়া থেকে ভাসে সূর্যমেঘ ( কবিতা ) , ‘চৈতন্যের চাষকথা’ ( গল্প ),
কবিতার বিভাসূত্র ‘ ( প্রবন্ধ )।
email- baul98@aol.com