চারবাক । মঈনুস সুলতান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ নভেম্বর ২০১৪, ৩:০৩ পূর্বাহ্ণ, | ২১২৪ বার পঠিত
মঈনুস সুলতান একসময় কবিতায় নিমগ্ন ছিলেন, গত শতকের সত্তরের দশকশেষ ও আশিসূচনায় বাংলাদেশের কবিতাবৃত্তে আবির্ভাব ঘটে তাঁর, লিখতেন কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্পও। যদিও পরবর্তীকালে তিনি ভ্রমণগল্পকার হিশেবে মশহুর হয়ে ওঠেন, লাভ করেন পাঠকপ্রিয়তাও। নব্বই দশকের মাঝামাঝি তাঁর পয়লাজীবনে লেখা কিছু গল্প ও কবিতা গোছগাছ করে পৃথক দুইটি বইও বেরিয়েছিল। প্রকাশ না-থাকলেও কবিতা তিনি লিখে চলেছেন আজও নিরবচ্ছিন্ন। নব্বইয়ের প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিষয়ে লেখাপড়া করেন কয়েক বছর। এ-দশকের শেষ পাঁচটি বছর কাটে তাঁর ইন্দোচীনে। লাওস বলে বিশ্বপরিসরে স্বল্পপরিচিত দেশে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভের দায়িত্ব পালন করেন। তখন দূরপাহাড়ের প্রকৃতিতে বিচ্ছন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের চালচিত্র নিয়ে রচনা করেন কিছু ভ্রমণগল্প। এ সময় পেশাগত কাজে বহুবার ভ্রমণ করেন ইন্দোচীনের অন্য দুইটি দেশ ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া। অধুনা প্রায়-বিস্মৃত ভিয়েতনাম যুদ্ধের তৃণমূলে ইম্প্যাক্ট সম্পর্কে কিছু তথ্যও সংগ্রহ করেন। অতঃপর সহস্রাব্দের সন্ধিক্ষণে ফিরে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের অ্যামহার্স্টে। খণ্ডকালীন অধ্যাপনার পেশায় যুক্ত থাকেন য়্যুনিভার্সিটি অব্ ম্যাসাচুসেটস্ এবং স্কুল অব্ হিউম্যান সার্ভিসেস্ নামক দুইটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে। এ-সময় শান্তির পদযাত্রায় যুথবদ্ধ মানুষদের যুদ্ধবিরোধী কাফেলায় শরিক হন এবং সক্রিয়তার অংশ হিশেবে মধ্যপ্রাচ্যযুদ্ধে মৃত ও ক্ষতিগ্রস্তদের তথ্যোপাত্ত সংগ্রহপূর্বক বাংলায় বই রচনা করেন। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারী কায়েম হলে তিনি ফি-বছর ওখানে যান পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনে। পেশাগত ওছিলা হিশেবে লিপ্ত থাকেন কখনো ভিজিটিং প্রফেসার, কখনো প্রশিক্ষক কিংবা কন্সালট্যান্ট হিশেবে। ভিজিটিং স্কলার হিশেবে লেখক দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া নগরীতে বছর-দুয়েক বাস করেন। একই সময় ভ্রমণ করেন জিম্বাবুয়ে ও মোজাম্বিক একাধিকবার। মেক্সিকো সিটিতেও কিছুদিন কন্সালটেন্ট হিশেবে কাজ করেছেন। প্রাচীন মুদ্রা, সূচিশিল্প, দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি, ফসিল ও পুরনো মানচিত্র সংগ্রহের নেশা আছে লেখকের।
. এখানে ছাপা হচ্ছে তাঁর একগোছা কবিতা। — রাশপ্রিন্ট সঞ্চালক।
আঁধারের রূপালী ঝাড়
হয়তো আমার চাই বল্গা হরিণ
নতুবা কেন যে পথ চলি ভলগা উপত্যকায়,
পায়ের নিচে তুহিন তুষার, ফারের টুপি
শ্বেত ভালুকের চামড়ার বিশাল চাপকান,
হাতে চকচকে বর্শা —
হিমেল নিঃসঙ্গতায় পিছনে একাকী অনুসরণ করে
কৃষ্ণ লোমশ আফগান হাউন্ড!
অথবা যেন বসে আছি অনন্তকাল স্প্যানিশ প্রস্তরে
মুর রূপসীর মতো চপল ঊর্বশী ঝর্ণায়
গহীন রজনীতে তৃষ্ণার্ত হরিণের মতো দল বেঁধে নেমে আসে —
নক্ষত্রের সুবর্ণ নীল কমলালেবুরঙ ছায়াপথ
আমি বসে থাকি প্রস্তরবৎ!
কেথায় যেন ফেরাউনের কফিন ঘিরে
কোলাহল করে কথা কয় কতিপয়
প্রত্নতাত্ত্বিক বাদুড়।
ওই মমির মিশরী স্মৃতি, ওই কুহক কল্পনা
আমার চোখের শিশিরে আঁকে —
জেব্রার মতো নকশাকাটা স্বপ্ন!
পৌরাণিক নিঃসঙ্গতায় আমার চাই বল্গাহরিণ
অথচ আফগান হাউন্ডের জ্বলজ্বলে সবুজ চোখ
চেতনার সৌরলোকে জ্বালিয়ে রাখে
আঁধারের রূপালি ঝাড়!
হীরকচূর্ণের নীল দ্রবণ
জানি তোমার এ ঘুম ভাঙিবে না —
. ভাঙিবে না আর কোনোদিন।
শিলালিপির মতো স্থবির তোমার স্মৃতি
দ্যাখো কেমন সবুজ সজীব আজো
মানুষ মুখর ঊর্মির মতো বিস্মৃতি ভালোবাসে বড় বেশি —
অথচ তুমি ভুলোনি
মনে হয় ভুলিবে না কোনোদিন —
. সেই বৃষ্টিভেজা কাঠের বাড়ি
. টালির ছাদে গিরেবাজ কবুতরের গল্প;
সে কার জড়োয়া কাঁকন রিমঝিম শব্দে চন্দ্রাহত বিধুর,
প্রত্যাশার আবলুস আন্ধারে আরশিতে আরতির দীপ জ্বালে !
তোমার পদযুগল পর্যটনে ব্যস্ত
ধমনীতে লাফাচ্ছে রক্তিম উচ্ছ্বাস —
গতি এবং উষ্ণতা যদি জীবনের মর্মকথা হয়
তথাপি হতাহত মৃত তোমার হৃদয়;
তুমি পান করেছ চন্দ্রাহত হীরকচূর্ণের নীল দ্রবণ —
মর্মান্তিক গোধূলির অন্তিম আবেগে স্তব্ধ তোমার ভ্রমণ!
জোনাকি, শিশির, শঙ্খে চিত্রিত পৃথিবী অনেক … অনেক দূর …
স্নায়ুতে শুক্লপক্ষের প্রগাঢ় তিমির
করতলে পতঙ্গের হরিৎ পাপড়ি, গোলাপের বিষন্ন ডানা —
তুমি কোথায় যাবে?
কারা আলেয়ার মতো ডাকছে তোমাকে গভীর নিশীথে!
তুমি পান করেছ চন্দ্রাহত হীরকচূর্ণের নীল দ্রবণ …
তোমার করোটিতে কষ্টের হিম স্পর্শ
ঝাউবনের মতো নেশায় গভীর নিসর্গ
মেঘালোকে ডোবা সবুজ পত্ররাজি —
যেন কার দীর্ঘশ্বাসের মতো করুণ বাতাস!
মর্মর পাথরের চোখে নক্ষত্র অগ্নিতে জ্বলে অশ্রুর লাবণ্য
মনে হয় বুঝিবা পাষাণেরও প্রাণ আছে হর্ষবিধুর …
তুমি শ্মশানচারীর মতো নিদ্রাবিমুখ … ঘোর অমানিশায়
জানি তোমার এ ঘুম ভাঙিবে না
. ভাঙিবে না আর কোনোদিন!
রাজার দিঘি
তখনো রেলগাড়ির হয়নি চল
মজেনি রাজার দিঘি — রোহিতের রাঙা লাস্যে ভরা জল,
ডানায় আকাশগঙ্গার বাতিঘর ছুঁয়ে
দিঘিতে নামে তুন্দ্রার তিনটি সোয়ান —
পাখসাটে ভাঙে মুনাজাতরত দরবেশের গভীর ধেয়ান;
দূরের মানুষ তিনি … বহুদিন হয় ছেড়েছেন ঘর
স্মৃতিনামায় তার বালুকাচিত্রময় দেশের খবর;
খুব কী বেশিদিন আগের কথা —
খানিক সত্য খানিক যাদুময় বাস্তবতা,
সিপাহী যুদ্ধের সৈনিক … হাতে তার তারকার তরবারি
বাঁধে বটের ডালায় অশ্ব —
জটাজূট সন্ন্যাসী এক ত্রিশূলে গেঁথে দূর্বাঘাস
ছড়ায় সর্বভূতে তন্দুল ছাইভস্ম;
কোন সে রাজা কবে খুঁড়েছে জলের সাবুজিক নহর —
জেনে ফায়দা কী এসব সমাচার,
আকাশ পরেছে নক্ষত্রের মেহদী … প্রতিফলনে ভাসে
গুপ্তধনের ভেলা … পিতলের কলসিতে কঙ্কনের ঝংকার!
চাঁদের দোকানপাট
দরগার পুকুরঘাটে বসে হয়ে যাই
অউলাঝাউলা অরুণাভ আশেক,
হাজার-দানার তসবি টিপে
ধরি নিত্য বর্ণালি ভেক;
ফণিমনসায় লোটে যে প্রজাপতি
ডানায় পরাগ বীজে মারফতি
অন্ধ সে অজানা অংকুর,
চোখের ঝরনাতলে খেলা করে
সোনার কৈ-মাগুর;
মিনারের শিথানে বসে ঝিমোয় সপ্তর্ষি
উড়ে জোছনামাখা কাজলা কইতর
নিশুতি রাতে জিকিরে-জিকিরে হই জরজর;
আছে কী আমার সুহৃদ-স্বজন
চৌদেওয়ারি চন্দনের খাট,
আন্দেরা ডেরায় দেখো
সাজাই চাঁদের দোকানপাট।