রোড টু কালাগুল টি এস্টেট / মলয় বৈদ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ আগস্ট ২০১৪, ৭:৫৪ অপরাহ্ণ, | ৩৪৩৬ বার পঠিত
- মলয় বৈদ্য। জন্ম, বেড়ে-ওঠা ও রুটিরোজগার সবকিছুই সিলেটে। একটা অসরকারি সংস্থার জনপ্রয়াসী শিক্ষাপ্রসার বিভাগে কাজ করেন। কাজের সুবাদেই ঘুরেছেন বিস্তর, স্বদেশে তো বটেই এবং বহির্দেশেও, পদব্রজে পাহাড়প্রকৃতি দেখা তাঁর প্রিয় প্যাস্টাইম। বসতভিটা চা-বাগানঘেরা লোকালয়ের চৌহদ্দিতে হওয়ার কারণে লেখক এই নির্জন ভুবনের বহু অনবলোকিত মুখরতার খবর রাখেন। অসম্ভব বাচনিক রসবোধসম্পন্ন মলয় বৈদ্য ওই-অর্থে রেওয়াজি লিখিয়ে না-হয়েও সম্প্রতি সেসব অনবদ্য কথাকাহনগুলো লিখতে ব্যাপৃত হয়েছেন। রাশপ্রিন্ট তাঁর রচনাগুচ্ছ প্রকাশ করছে নিয়মিতভাবে। চায়ের দেশের গল্পগাছায় পাঠকের তেষ্টা জুড়াক।
এ আমার হৃদ-পথ। আশৈশবের যোগাযোগ-সম্পর্ক। যেন জগতের সকল রাস্তা এই পথে এসে থেমে যায়। মেঠো পথ; আঁকাবাঁকা। পথের বুক ধরে সবুজ ঘাস বাসা বেঁধেছে, দু-পাশে শুধু বালি আর বালি। পথের দু-পাশ দিয়ে ঝর্ণা-ছড়া প্রবহমান। ছড়ার পাড় জুড়ে বাহারি ফার্নের ছড়াছড়ি। বহমান ধারার ঝিরিঝিরি কলকল ধ্বনি সবসময় কানে বাজে। আর দু-পাশ জুড়ে সবুজের গালিচা, দিগন্তজোড়া চা-বাগান। বাগানের মাঝে মাঝে ছায়াবৃক্ষ; মালাকানা, শিরিশ, কড়ই, কোথাও-বা আম-কাঁঠাল আরও কত-কী বনবীথি! কোথাও-বা বাঁশবাগান, পেঁচাবাঁশ। পেঁচাবাশের করুল আর হাঁসের মাংশ দারুণ ব্যঞ্জন। খাদিম আর কালাগুলের মধ্যবর্তী কাটাটিলা। ফরেস্ট এরিয়া। হালের জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য। কাটাটিলার এক মজার দৃশ্য হচ্ছে, এখান থেকে ছড়ার ধারাগুলো দু-ভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তরে কালাগুল চা-বাগান অভিমুখে, উত্তরকাছ পরগনার দিকে এবং দক্ষিণে খাদিম চা-বাগানের দিকে, দক্ষিণকাছ পরগনাগামী। এর একটু ভেতরের দিকে চারদিক টিলাঘেরা বোমাঘর। জনশ্রুতি আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশবাহিনী এখানে বোমা সংরক্ষণ করেছিল্।
আমার শৈশব-কৈশোরের অনেকটা সময় কালাগুল চা-বাগানে কেটেছে। প্রথম ইশকুল-বন্ধুতা-আড্ডা বাগানের চৌহদ্দিতে। মনে পড়ে চৈত্র-বৈশাখ মাসে ইশকুল থেকে এসেই বই-খাতা ছুঁড়ে ফেলে বন্ধুরা মিলে জঙ্গলে। সাথে ছুরি-চাকু, নুন-মরিচ সম্বল। গাছে আম সবে গুটি হয়েছেে, আঁটি বাঁধেনি। গাছে উঠে আম পাড়া। টিলায় উঠে রামকলাগাছের ডাগুয়া কেটে আনা। তারপর কোনও গাছের তলায় বসে কলাপাতায় আমভর্তা বানিয়ে খেয়ে নেয়া। তারপর, মোষ-তাড়ানো। হ্যাঁ, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো আর-কি। বনের বানরগুলোর সাথে বাঁদরামি। যৌথ অভিযান। দলে ভাগ হয়ে ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি। প্রায়শই আমাদের সাথে আগ্নেয়াস্ত্র থাকত। দেশজ, পরিবেশবান্ধব অস্ত্রশস্ত্র। বাঁশ। গুলোলবাঁশ আর পোড়া গুল্লি। আঁঠাল মাটির পোড়ানো গুল্লি। এ নিয়েই আমাদের বাহিনী শত্রুর মোকবেলায় সদা তৎপর। কখনো-বা বনমোরগের তল্লাশে। আবার কোনো দিন ছড়ায় বাঁধ দিয়ে মাছ ধরা। তারপর ডালপালা জ্বালিয়ে মাছ-কাঁকড়া পুড়িয়ে খাওয়া। উহ! কত-না মজার সে আহার-বিহার! একেক দিন আমাদের একেক ধরনের অভিযান ছিল। কোনো দিন আবার কাঁঠালগাছের উপর ছিত্তম যেত। গাছের কাঁঠাল সব পেড়ে রামকলার পাতায় কেটে কষ বের করে জমিয়ে আঁঠা বানিয়ে দোয়াঙ বানাতাম। তারপর দোয়াঙে উঁইপোকা বিঁধে পাখি শিকার। কখনো পোক্ত কাঁঠাল পেড়ে পাকানোর জন্য মাটি খুঁড়ে জঙ্গলেই রেখে আসতাম। পরে গিয়ে দেখতাম কাঁঠাল পেকেছে । সবাই মিলে আচ্ছাসে খেতাম। আবার কখনো দেখতাম বনবিড়াল বা টলা কাঁঠাল সাবাড় করে ফেলেছে।
তবে সবচে মজার ও আনন্দের ছিল ভাদ্র-আশ্বিনের জোছনা সেবন। বড়সর্দারের বেটা উপেন, টিলাবাবুর পুত কিরণ, গনৈশ, বিরেন ও আমি মিলে এবং আরো কয়েকজন সন্ধ্যারাতে কালাগুল রাস্তার চানমারি কালভার্র্টে আড্ডা দিতাম। শরতের ফুটফেুটে চাঁদ-জোছনা। সে-এক অপরুপ দৃশ্য! চা-গাছ আর ছায়াবৃক্ষের আলো-আঁধারি খেলা। খেয়াল করলে দেখবেন দূরদিগন্তে কারা যেন নৃত্য করছে। ভাদ্রের একটু-আধটু কুয়াশায় দৃশ্যটা পুরোমাত্রায় দৃষ্টিতে আসে না। নীরব-নিস্তব্ধতায় দুরের কী-সব আওয়াজ কানে ভেসে আসে। পুরোটা মালুম হয় না। গা ছমছম করা, কোনো অশরীরীর কাণ্ডকারখানা মনে হতে পারে। পাশের গোরস্থান গায়ের লোমগুলো আরো খাড়া করে দেয়। মোটেও ভয় পাবেন না। পাশেই আমরা ধুনি জ্বেলে রেখেছি। বড়দের থেকে শুনেছি, আগুন ও লোহালক্কড় থেকে ভূতপেত্নিরা দূরে থাকে। সবকিছুই আমাদের মজুদে আছে। ধুনিতে ওস্তাদ উপেন আলু আর কাকড়ার বারবিকিউ বানাচ্ছে। তখন এটা আমাদের খুব ফেবারেইট ছিল। সাথে জলপ্রসাদ। আহা রে! কতকাল এর স্বাদ থেকে বঞ্চিত! হঠাৎ শুনবেন কালভার্টের নিচ দিয়ে বয়ে-চলা ঝর্ণায় ঝফাৎ ঝফাৎ আওয়াজ। ভয় পেলেন? ভয় পাবার কোনও কারণ নাই। খেয়াল করে দেখুন, শিয়ালের দল জলে কাঁকড়াশিকারে মত্ত। কিরণ মনে হয় একটু ভয় পেয়েই যায়, গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে “আকাশের ঐ মিটি মিটি তারার সাথে কইব কথা / নাই-বা তুমি এলে”। রাত বাড়তে থাকে, চোখের তারা টিপ টিপ করে, হাই ওঠে। আমরা উঠে পড়ি, এক সাথে গলা মিলাই “এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদীতটে…। এভাবেই কেটেছে আমার শৈশব-কৈশোরের অনেকটা। সোনালি-স্বপ্নিল সেসব দিনরাত। কতদিন কতবার মনে করেছি, আরেকটা সন্ধ্যা কাটিয়ে আসব সেই কালভার্টে, সবার সাথে। সময় যেন আর হয়ে ওঠে না।
আজ যখন কর্তব্যকাজে এ পথ দিয়ে যাতায়াত করি, তখন আনমনা হয়ে পড়ি। জাগায়-জাগায় জিরান নেই। খুঁজে দেখি সেসব জায়গাগুলো। সেই আমগাছটা, কাঁঠালগাছটা। দেখি সিন্দুরআমের গাছটা আর নাই। সিঁদুরে-লাল টুকটুকে আম ছিল গাছটার। কালিথানের পাশ ঘেঁষে গোলাপজামের গাছটাও নাই, যে-গাছের ডালে ডালে ডাহুক খেলতাম, খেলাটা জলে ‘লাই’ খেলার মতন। পাশের আঞ্জির (পেয়ারা) গাছটিরও অস্তিত্ব আর নাই। বন্ধুদের অনেকের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। তবে মনে হয় তারা যেন সেই আগের মতো আমার সাথে মিশতে পারে না। দূরত্ব অনুভব করে। জানি না কেন এমন হয়। চেনা মানুষগুলো কেমন বদলে যায়। নাকি নিজের থেকেই মানুষ বদলে যায়? সবাই?