দুই’টি গদ্য / আনিকা শাহ
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ জুলাই ২০১৪, ৬:০১ অপরাহ্ণ, | ২১০৯ বার পঠিত
পরদেশী মেঘ ______________
ভিন্ন ভিন্ন শহরে থেকেও একই দিনে আমাদের চার্চে যাওয়া হল। তুমি আর্মেনিয়ান চার্চে গেলে, আমি চট্টগ্রামের ক্যাথলিক চার্চে। তোমার খুব স্মৃতিবিজড়িত জায়গা, খুব প্রিয়, কষ্ট খুঁচিয়ে তোলার আকর্ষণের মতো; আমার কাছে অচেনা, অপরিচিত।
আমার সামনে যিশুর অবয়ব ছিল, আমি তোমার কথা ভাবছিলাম অনবরত। প্রার্থনা ছিল না আমার কোনো, তোমার ছিল কি না জানি না।
এখানে আসা অব্দি বৃষ্টি পড়ছে। ট্রেনে ওঠার আগে থেকেই আকাশে মেঘ ছিল, আর ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল। এসি কম্পার্টমেন্টে বসে দেখছিলাম জানালার বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। দুই পরত দেওয়া কাচের মাঝে জমে থাকা পানি ট্রেনের তালে তালে কাঁপছিল। সাইবেরিয়া-শীতল ঘরে কেন বসে থাকতে চাই আমরা? নিজেদের শীতলতাকে স্বাভাবিক করে তুলতে?
টানা বৃষ্টি ঘণ্টা দু’য়েকের বিরতি নিলে আমরা হাঁটতে বের হয়েছিলাম। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা ইটের দেয়ালের বাসার দিকে চোখ পড়ল – জানালার পাশে হেলান দিয়ে এক ভদ্রলোক বই পড়ছিলেন, হারিকেনের আলোয়। দেখে ভালো লেগেছিল আমার, অবাকও হয়েছিলাম (কেন অবাক হয়েছিলাম? জীর্ণ ঘরে থাকা মাঝবয়সী লোকের ইংরেজি বই পড়ার দৃশ্য আমাদের চিন্তায় কল্পকাহিনি বলে?)।
আমার বন্ধু, বন্ধুর বন্ধু, দু’জনেরই মেজাজ খারাপ ছিল সারাদিন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দু’জনেরই মোবাইল নষ্ট হয়ে গেল। ফোন করতে পারছিল না কাউকে ওরা, কথা বলতে পারছিল না কারো সাথে।
‘অনেক কথা বলি আমরা। কিছুই বলি না!’*
আমরা বাতিঘর-এ গিয়েছিলাম। অগুণতি বইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ, বসে বসে বই পড়তে দেখেছিলাম অনেককে (এবার অবাক লাগে নি আমার)।
বাতিঘর থেকে চার্চটা অনেক কাছে। আমার জানা ছিল না চার্চটার কথা, যাবার কথাও ছিল না, অথচ যাওয়া হল (কী অদ্ভুত কাকতাল!)। অনেককে দেখলাম প্রার্থনারত। আমি প্রার্থনা করি নি, কনফেসও না। (‘এখানে কনফেশন বক্স আছে? জানো?’
‘আছে নিশ্চয়ই। কেন? কনফেস করতে চাও?’)
তখন বলি নি – আমি কনফেস করতে না, কেবল বসে থাকতে চেয়েছিলাম কনফেশন বক্সে। যেন ঈশ্বর না-বলতেও সব কথা বুঝে নেবে, আমার না-জানাগুলোও।
আমার বন্ধুর বাড়ির ঘড়িতে গির্জার ঘণ্টার শব্দ হয়…
ভিন্ন ভিন্ন শহরে থেকেও আমাদের চার্চে যাওয়া হল, একই দিনে। তোমার খুব স্মৃতিবিজড়িত, প্রিয় স্থান (কেন কষ্ট খুঁচিয়ে তোলার আকর্ষণ সেখানে তোমার? কেন বলো নাই? কেন জিজ্ঞেস করি নাই আমি?), আমার কাছে অচেনা, অপরিচিত।
*লুনা রুশদী-থেকে ধারকৃত _____________________# #
অভ স্টোরিজ অরেঞ্জ অ্যান্ড ব্লু ____
আমার বাসা থেকে ভার্সিটি যাবার পথে একটা নদী পড়ে। দু’দিকের সাজানো তীর আর উপরের ব্রিজের মাঝে পড়া ছোট্ট একটা নদী। সেই নদীর পাশ দিয়ে যেতে প্রায়ই আমার মনে পড়ে, একজন বলেছিল, ‘অতি নিকটে গেলে মানুষ নদী হয়ে যায়’*।
শহরের ব্যস্ততম ফাস্টফুড শপগুলার একটাতে বসে আমি এসব ভাবছি। দোতলার সিঁড়ির কাছের ছোট্ট একটা টেবিলের সামনে খাবার নিয়ে বসে আমি এসব ভাবছি। পাশ দিয়ে মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, জানলার আবছা কাচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখা যাচ্ছে আলো-মরে-আসা বিষণ্ন বিকাল।
একেকটা মুহূর্তও কবিতার মতো হতে পারে।
আমার সুপারভাইজার আমাকে একবার তাঁর স্ত্রীকে প্রথম দেখবার দৃশ্যটার কথা বলেছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ চোখে পড়ল করিডর দিয়ে, হন্তদস্ত, এক মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে, এদিক-সেদিক তাকিয়ে বোধহয় কিছু খুঁজতে খুঁজতে। হাতে ধরা গাদাখানেক বইপত্র, মুখে এসে পড়া এলোমেলো সোনালি চুল, চেহারায় বিহ্বল ভাব। তাঁর মনে হল, যেন ভারমিয়ারের পেইন্টিং থেকে উঠে আসা কোনো মূর্তি চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল, আর সে যাবার সময় কী যে হয়ে গেল, কিচ্ছু বোঝা গেল না। কী অদ্ভুত এক শিহরন সারা শরীরে বিদ্যুতের মতো খেলে গেল, কিছু বুঝে ওঠার আগেই। এক ঝাপ্টা ঝড়ের মতো কী যেন সব ওলট-পালট করে দিয়ে গেল, ধরতে পারা গেল না। সেই মুহূর্তটা…. সেই মুহূর্তটা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন – আহ্! দ্যাট ওয়াজ পোয়েট্রি…
শহরের ব্যস্ততম ফাস্টফুড শপগুলার একটাতে বসে আমি এসব ভাবছি। আর মাঝে মাঝে এই সময়ের সাথে গুলিয়ে ফেলছি সেই সময়টা যখন এমনই অন্য কোনোখানে বসে সত্যিই একদিন আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
তুমি বোধহয় নদী হবার ভয়েই কাছে আসো নি।
এই কাল্পনিক চিঠির কিছু নিয়ে আর অধিকাংশই বাদ দিয়ে যদি লিখেও ফেলি কখনও, তারপরও তোমাকে পাঠানো হবে না। তুমি জানতেও পারবে না যে আমার আর-দশটা দিনের মতন প্রায় একই রকম বৈচিত্র্যহীনতায় ভরা আজকের দিনটায় এমন একটা মুহূর্ত এসেছিল, ভিড়ে-ভরা ঘরের ভিতর জানলার আবছা কাচ ভেদ করে আসা বিকালের কমলা আলোয় এমন অদ্ভুত উপলব্ধির একটা মুহূর্ত এসেছিল। তুমি জানতেও পারবে না যে এই মুহূর্তটা… এই মুহূর্তটা, দিজ ইস পোয়েট্রি…
*প্রণবেশ দাশ-থেকে ধারকৃত ________________# #