গোর্কির ‘মা’- একবিংশ শতাব্দীর পাঠ / ফাহিমা আল ফারাবী
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুলাই ২০১৪, ৯:৩০ অপরাহ্ণ, | ২২০৮ বার পঠিত
অবশেষে ‘মা’ শেষ করলাম।
পুষ্পময়ী বসুকে প্রণাম, তার কারণেই বইটা যথাযোগ্য ভাবে উপভোগ করা গেল। এত প্রাঞ্জল, সৃজনশীল আর আন্তরিক অনুবাদ ইহজীবনে পড়েছি বলে মনে পড়ে না। ভদ্রমহিলা মন-প্রাণ ঢেলে অনুবাদটি করেছিলেন, বোঝাই যায়।
একবিংশ শতাব্দীতে ‘মা’ এর পাঠ নি:সন্দেহে অন্যতর হবে। মা এমন সময়ে গোর্কি লিখেছিলেন যখন সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন সাধারণের মনে দানা বাধছে। মানুষের মাঝে সমতার বিধানের মাধ্যমে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মশগুল এক দল তাজা তরুণ প্রাণ, যাদের আহবায়ক ও নেতৃত্বপ্রদানকারী স্বত্বা পাভেল, উপান্যাসের শিরোনাম্নী চরিত্র পাভেলেরই মা। প্রাথমিকভাবে ধর্মভীরু, কোমল মা নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে মিশে যায় ছেলের মিশনের সাথে, সত্য ও ন্যায়ের এক পৃথিবী প্রতিষ্ঠার কর্মযজ্ঞে। ওদের চোখের জ্বলে ওঠা আগুনের সাথে একাত্মা হয়ে ওঠে মা, শুরু হয় তার নতুন জীবন।
১৯০৭ সালে বইটির প্রথম প্রকাশের সময়কালে এবং পরবর্তীতেও ‘মা’ বিবেচিত হয়েছে গোর্কির অন্যতম শ্রেষ্ঠ, এমনকি বিশ্বসাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর একটি হিসেবে। সমাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধী কোন লোকও অস্বীকার করতে পারবে না বইটির সাহিত্যগুণের কথা। বইটির প্রায় আগা-গোড়াই সমাজতন্ত্রের স্বপক্ষে যুক্তি ও আবেগজাত সমর্থন প্রদানে নিয়োজিত, একবিংশ শতাব্দীর পাঠকের কাছে যা প্রায়শই একঘেয়ে ও অপ্রাসঙ্গিক ঠেকতে পারে। অনেকের কাছে একে মনে হতে পারে এক রাজনৈতিক প্রোপ্যাগান্ডামূলক লেখনী, অনেকেই আবার প্রোপাগান্ডার ‘প’ না বুঝেও শুরু করে রেখে দিতে পারেন বইটি অসমাপ্ত অবস্থায়, কিছু না বুঝে। ‘মা’ কি তবে একবিংশ শতাব্দীর পাঠকের কাছে আর প্রাসঙ্গিক থাকছে না?
সমস্যা হল, ‘মা’ কোন নিছক উপন্যাস নয়, এর উৎপত্তি ও ব্যাপ্তি দুইই এক নির্দিষ্ট ভাবাদর্শের কাঠামোয় মাপা। বিংশ শতকে শ্রমিক-বিপ্লবের মাধ্যমে যে শোষণশূণ্য নতুন মানব সমাজের দিশা খুঁজে পেতে দিয়েছিলেন কার্ল মার্ক্স, তারই বাস্তবায়নের রূপরেখা যেন রচনা করেন গোর্কি, যার ঐতিহাসিক অনুকরণ আমরা দেখি বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানে। বইটি পড়লে বোঝা যায় নতুন সমাজ গঠনে কতটা দৃঢ়সংকল্প ছিলেন লেখক, সত্যের পুনরুদ্ধার ও বিকাশে (‘সত্য’ এখানে মানুষের সমতার সমার্থক) তার এতটুকু সন্দেহের অবকাশ ছিল না।
“শ্রমের শেকলে বাধা মানুষের জীবনে সত্যের আগ্রহ, সত্যনিষ্ঠ বুদ্ধি দান করবে বলে সর্বস্ব পণ করেছে যারা, শুনতে শুনতে তাদের ওপর শ্রদ্ধায় মা’র মন ভরে ওঠে।”
“কিন্তু রদ্দা মেরে সত্যকে মারা যায় না বুঝলি?”
“যে ঐতিহাসিক ন্যায়ের দাবী উঠেছে আজ আকাশে বাতাসে, তার নিদারুণ চাপ থেকে আত্মরক্ষা করার মত কোন যুক্তি নেই আপনাদের ভান্ডারে।”“সত্য আর ন্যায়ের পথে চলেছে আমাদের সন্তানেরা- মাথার ওপর এক নতুন আকাশ রচনা করে।”‘
‘মা’ এর প্রকাশের পর একশো বছরেরও বেশি অতিবাহিত হয়ে গেছে। এর মধ্যে পৃথিবী কাঁপিয়ে গেছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, ইউরোপকে তছনছ করে হয়ে গেছে দু-দু’টো বিশ্বযুদ্ধ, বার্লিনের দেয়াল গড়ে উঠেছে আবার ভেঙেও গেছে, পৃথিবীর ভারসাম্য পালটে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে হয়েছে ১৫ টি দেশ। এই সবকিছুই পাশ্চাত্য চিন্তাধারায় এনেছে আমূল পরিবর্তন। সত্য ও ন্যায়ের ধ্বজাধারী, যুদ্ধের নামান্তরে প্রগতি ও উন্নয়নের পৃষ্ঠপোষক ‘আধুনিকতাবাদ’ এর বিরোধিতা করাই বরং এখন পৃথিবী জুড়ে পণ্ডিতমহলের পরম আরাধ্য দায়। ‘সত্য’ কি? কিছুই না। ‘ন্যায়’ কি? সবই ভ্রম। আপেক্ষিকবাদ পৃথিবীকে এক বিশাল উর্ণাজালের মাঝে ফেলে নাচাচ্ছে।
এমনতর পরিস্থিতিতে, যখন সত্য আর মিথ্যার ফারাক ওই preferred belief এর মধ্যে সীমাবদ্ধ, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন যখন ভূলুণ্ঠিত- মায়ের অশ্রুর স্বান্তনা তখন কে যোগাবে? মাকে কে বলবে, আমরা এখন আর অনির্বচনীয় সত্যে বিশ্বাস করি না, আমাদের কাছে ন্যায়ের সংজ্ঞা আজ ভিন্নতর? নিলভনার চোখের জলে যখন আমাদের চোখের জল নির্ভেজাল মিশে যায়, গোর্কি যেন মুচকি হাসেন আড়ালে বসে, ঘন গোফের আড়ালে তা অনেকটা ঢেকে যায় অবশ্য…
. __________________# #