পাতালভূমি / এমদাদ রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ মার্চ ২০১৪, ৭:১৯ অপরাহ্ণ, | ২৬৮৪ বার পঠিত
প্রথম মায়ের প্রসববেদনা পৃথিবীর মনে আছে
: সুমন চট্টোপাধ্যায়
এই আলেখ্যকে প্রণাম করুন। কেননা, ঝড়ো হাওয়া বইছে। প্রতি মুহূর্তে ধেয়ে আসছে আগুনমুখা গোলা। তাই, এ আলেখ্যকে প্রণাম করুন। ঘনিয়ে আসছে জীবন! পরস্পরের নিকটবর্তী হচ্ছে দুই বন্ধু, দুই সহোদরÍজীবন ও আগুন।
খুনখুনে আওয়াজ করছে প্রস্তরিত হাড়। মানে গান, খা-বদাহন! এ গানই আমাদের জীবন, আমাদেরই জীবিকা।
কথাগুলো জটিল নয়। শুনুন, নিজেকে উন্মুক্ত করার এটা একটা কৌশল। সুতরাং, কোনও জটিলতা থাকার কথা নয়। আপনি উসখুস করছেন কেন? কথাগুলো শুনুন। তাছাড়া আপনার ট্রেইনের আজ চার ঘণ্টা লেট। অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। মারা গেছে সাত জন। কয়েকজন এমন বীভৎসভাবে থ্যাঁতলে গেছে যে তাদের মানুষের মৃতদেহ বলে মনেই হয় না। তবে, একজন বৃদ্ধকে শনাক্ত করা গেছে।
মৃত বৃদ্ধের মুখে যন্ত্রণার তীব্র একটা ছাপ। আপনি দেখলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারতেন এবং কাঁদতেন। কী, আপনার কোনও প্রশ্ন নেই? জানতে চান না, মৃত বৃদ্ধের মুখে যন্ত্রণার যে ছাপ, তার কী মানে? শুনুন, বোকার মতো হাসবেন না। আপনি বোকা নন। সুস্থবুদ্ধির একজন সংসারী মানুষ। আমার কথাগুলো কানে তুলছেন না। না?
মৃত্যুকে ভয় পান আপনি?
কিংবা, প্রতিদিন যে একটু একটু করে জরাগ্রস্ত হচ্ছেন, টের পান?
আপনাকে রেল দুর্ঘটনায় নিহত এক বৃদ্ধের কথা বলছিলাম। বৃদ্ধের মুখে যন্ত্রণার ছাপ, যেন আগুন। যেন ঝলসানো মাংস! লোকটি ঠিক তিন দিন আগে একটা স্বপ্ন দেখেছিল’তার গায়ে জড়ানো ধবধবে কাফন। স্বপ্ন ভাঙার পর সে আর ঘুমাতে পারেনি। স্বপ্নে যে-জায়গাটায় তাকে খাটিয়ায় তোলা হলো, সেটা তার চল্লিশ বছর আগের ফেলে আসা গ্রাম।
শুনুন, আমি মানুষের ভবিষ্যৎ জানি। জানি যে আপনি আগামী মাসের সাত তারিখ হঠাৎ মারা যাবেন। ডেডবডি অফিস থেকে হাসপাতাল চলে যাবে। কর্তব্যরত ডাক্তার আপনাকে মৃত বলে ঘোষণা করবে। আপনি মারা যাওয়ার কয়েকদিন পর আপনার বড় ছেলে তার এক বন্ধুকে খুন করবে আর আপনার স্ত্রী, মেয়ে, ছোট ছেলে আপনার জন্য দুপুরে, সন্ধ্যায়, রাত্রে কিছুদিন কাঁদবে। বড় ছেলেটা আর বাড়ি ফিরবে না। বাসায় পুলিশ আসবে। র্যাব এসে তল্লাশি করবে। রাতবিরেতে আপনার বাসায় অপরিচিত লোক ফোন করবে। দেখুন, আমি সব জানি।
আরে, আপনি দেখি অস্থির হয়ে পড়েছেন! বলেছি তো ট্রেইনের আজ চার ঘণ্টা লেট। অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। আর আপনাদের মতো লোকদের দেখে আমার হাসি পায়। আপনারা আমাকে ভাবেন পাগল, বদ্ধউন্মাদ। বলেন, ওকে পাবনায় পাঠানো উচিত। কিন্তু আমি হাসি আপনাদের নিয়ে। আপনাদের ঘরে কালো একটা বেড়াল থাকে আর থাকে খাঁচাবন্দি পাখি। বেলকনির নিঃসঙ্গতায় পাখিটা ডানা ঝাপটানি মারে দিনরাত। বাতাসের ধাক্কায় এদিক-ওদিক থেকে উড়ে আসে বেওয়ারিশ লাশ। মানে গাছের মৃত পাতা। এই তো জীবন আপনাদের, দিব্যি বেঁচে থাকার! কিন্তু আপনারা এতো বোকা, বোকার হদ্দ, মাত্র পাঁচ মিনিট পর কী ঘটবে জানেন না। কিন্তু আমি যে অদৃষ্টের বংশধর। সব জানি। আপনার সবকিছুই জানি আমি। আপনার আত্মহত্যার প্রচেষ্টার কথা মনে আছে? এই পর্যন্ত বার তিনেক আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। না?
নিহত বৃদ্ধের মুখটা দেখে কিছুক্ষণ কেঁদেছি। এক মানুষের মুখের সঙ্গে আরেক মানুষের মুখের এতো মিল থাকতে পারে, জানা ছিল না। যদি আপনিও দেখতেন, হয়তো আপনারও লোকটাকে পরিচিত মনে হতো। আপনার বাবা কিংবা চাচা কিংবা দাদা, যে কোনও একজনের সঙ্গে আপনি মিল খুঁজে পেতেন। কিন্তু মুখের ওই যন্ত্রণার ছাপটা!
দেখুন, আমি আপনার পায়ের কাছে একটা কুকুরের মতো পড়ে আছি। আপনি খেয়াল করছেন না। আমার কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে না, আপনাকে ঠিকই দেখছি। কিছু কথা বলার ছিল। অনেকদিন ধরে কিছু কথা কাউকে বলার চেষ্টা করছি, কিন্তু কেউ কারও কথা শুনতে চায় না ভাই। আপনি হয়তো মারদাঙ্গার সিনেমাগুলো একের পর এক দেখে ফেলতে পারবেন। আপনারা কেন যে রক্তারক্তি দেখতে পছন্দ করেন, কে জানে। কিন্তু কেউ কারো কথা শুনতে চান না! অবশ্য কারও কথা না-শুনেও এ জীবন দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়, মালকড়ির জোর থাকলেই হলো। লোকে আপনাদের উন্মাদ বলবে না। পাবনায় পাগলাগারদও বসাতে হবে না সরকারকে।
তো শুনুন, আপনার সঙ্গে গল্প করছি যখন, তখন অনেক কিছুই তো বলতে হয়। মায়ের কথা দিয়ে শুরু করি? না, নিজের কথাই বলি; বাবার মৃত্যুর এক মাসের মাথায় আমি একটা খুন করি…এ কী! আপনি ঘামছেন? এতো চিন্তার কী আছে ভাই? এটা রেলওয়ে স্টেশন। কতো রকমের মানুষ থাকে এখানে। লোকগুলোর মুখের দিকে ভালো করে তাকান। আপনি যাদের চোর-বাটপাড় কিংবা বদমাইশ বলেন, তাদের একটু দেখুন। মানুষের মুখ সবচেয়ে জটিল, নাকি পানির মতো স্বচ্ছ, সহজ? নির্ঘাত বিভ্রান্ত হবেন। এই বিভ্রান্তিটুকু নিয়ে এখন ভাবতে থাকুন। না হলে এই চার ঘণ্টা সময় কীভাবে কাটাবেন? ওই দেখুন না, দুটি নারী আপনার ডান দিক থেকে হেঁটে আসছে। এদের একজনের বাড়ি কুড়িগ্রাম, আরেকজনের নোয়াখালি। একজনের নাম সখিনা, আরেকজনের নমিতা।
আপনি কি দুশ্চিন্তা করছেন? এসব ছেড়ে জীবনের কোনও সুখি মুহূর্তের কথা ভাবুন। ভানুমতির খেলা দেখেছেন কখনও? কিংবা বায়োস্কোপ? ‘এরপরেতে কী হইলো, কুতুব মিনার আইস্যা গেল’ … নাহ্ আপনাকে নিয়ে ভারি মুশকিল হলো দেখছি! জগতে এতো বেরসিক লোকও থাকে! একটু ভাবুন না, মাত্র তো চার ঘণ্টা!
খুব তো বকবক করছি, আপনি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছেন না। শুনুন, আমিও একদিন মানুষ ছিলাম। ওই খুনটা করার আগ পর্যন্ত। বাবার মৃত্যুর মাসখানেক পর খুনটা করি। আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু ছিল। তাদের নাম আজ আর মনে নেই। ভুলে গেছি। আজ যদি এ্যারেস্ট হই, পুলিশকে তাদের নাম বলতে পারবো না। যাকে খুন করি, তার নামটাও ভুলে বসেছি!
ভাই, আমি আপনার পায়ের কাছটায় কুকুরের মতো বসে আছি। আমার দিকে না তাকান, ওই মেয়ে দুটোর দিকেও তো তাকাতে পারেন। আপনার মিষ্টি মেয়েটির মতো নয়? ভাবুন না একটু। ট্রেইন আসবার আগেই হয়তো নিজের ছেলেবেলাটাকে একবার মনে পড়ে যাবে। আপনার জন্ম নিশ্চয় আঁতুড়ঘরে হয়েছিল? জন্মেই নাকে লেগেছিল নেবুপাতার ঘ্রাণ। ঠিক বলছি? নেবুপাতার ঘ্রাণটাই ছিল পৃথিবীর প্রথম আস্বাদ। তারপরই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিলেন। ভয় পেয়েছিলেন, নাকি দুঃখ? এই দুটো তো মানুষকে কাঁদায়! কিন্তু মানবশিশু কাঁদবে কেন ভাই?
দেখুন, আমি কেবল বকবক করছি, কিন্তু মুখ দিয়ে কিম্ভূত কিছু শব্দ ছাড়া কিছুই বেরুচ্ছে না। আপনিও মাথামুণ্ডু বুঝছেন না। শুনুন, যেদিন থেকে পাথর খাওয়া শুরু করলাম, সেদিন থেকে আমি আর মানুষ থাকলাম না। সবচেয়ে বেশি পাথর খাই ভার্সিটি লাইফে। থার্ড ইয়ারে ওঠার পর ভালো মতো পাথর খাওয়া শিখে ফেললাম। প্রথম প্রথম নুড়িগুলো খেতাম। তারপর ডিম সাইজ। তারপর একদিন ফুটবল সাইজের পাথর খাওয়া শুরু করলাম। বছরখানেক পর খেয়াল করলাম মুখে দাঁতগুলো নেই! তখন কী আর করি! গিলতে শুরু করি। দাঁত নেই, তো গিলে ফেলো। অবশ্য এটা মনে আছে, থার্ড ইয়ারে ওঠার পরই খুনটা করি। তারপর থেকেই পলাতক। তারপরই বদলে গেল সবকিছু। আমি পাথরখেকোর দলে নাম লেখালাম! এখন পাথরও চিবুতে পারি না ভাই। আগে তো দাঁতে পিষে গুঁড়োগুঁড়ো করে খেতাম। মনে হতো মিছরিদানা খাচ্ছি! আমার পেটটাকে মেশিন বলতে পারেন। শালা সব হজম করে ফেলে। কোনও দিন ইচ্ছা হয় নিজের একটা চোখ উপড়ে মাছের মাথা খাওয়ার মতো চুষে খেয়ে ফেলি। পৃথিবীতে পাথরের অভাব হবে, জানা ছিল না। হয়তো একদিন সব পাথর গিলে শেষ করবো। ঠিক করে রেখেছি, তখন মানুষের চোখ খাবো। একটা একটা মানুষ ধরবো, একটা করে চোখ উপড়াবো আর খাবো। একচক্ষু মানুষে রাষ্ট্র ভরে যাবে। আমি দাঁতের জন্য কথা বলতে পারি না, যারা পারে; তারা অন্ধ হয়ে যাক। চোখগুলো যেদিন শেষ হয়ে যাবে, তখন মানুষের কানগুলোকে টেনে ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে পুরবো। হাঃ হাঃ। কান টানলে মুণ্ডু! কানের পর খাবো মানুষের মুণ্ডু। ধড়গুলো ফেলে দেবো। মানুষের নোংরা নোংরা হাত, পা, পাছাগুলো খাবোই না। পৃথিবীতে যদি সাত’শ কোটি মাথা হয় আর দিনে যদি একটা করেও খাই, তাহলে সাত’শ কোটি দিন! ভাবুন তো, সেদিন কী হবে, যখন আমি ছাড়া পৃথিবীতে কেউ থাকবে না? আহা, স্বাধীনতা! মুখের কিম্ভূত শব্দগুলো আর কেউ শুনবে না। আর কেউ পাগল কিংবা উন্মাদ’ এইসব হাবিজাবি ভাববে না। তখন আমার নিঃসঙ্গতা ঘুচাতে বাম পাঁজরের হাড় থেকে জন্ম নেবে অপরূপা হাড়খেকো নারী। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে মানুষের হাড়গোড় খাবে। আপনাকে বেশ আগের একটা ঘটনা বলি…
এই দেখুন, কী বলতে গিয়ে কী বলছি! ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে নিহত বৃদ্ধের কথা বলছিলাম না? লোকটার নাম আবদুল আজিজ, গ্রাম : রামচন্দ্রপুর, থানা : কমলগঞ্জ, জেলা…বৃদ্ধ তার নিজ গ্রামে মরতে চেয়েছিল। তার দেখা স্বপ্নে এরকম একটা ইঙ্গিতও ছিল। গত চল্লিশ বছর সে তার গ্রামে যায়নি। শহরে ছেলের বাসায় একটু একটু করে মরছিল সে। এমনকি একাত্তর সালেও না।
আচ্ছা, বলতে পারেন, যুদ্ধের সময় কবর খোঁড়া কি বন্ধ হয়ে যায়?
দেখলেন, গল্প করতে করতে ঘণ্টাখানেক সময় পার করে দিয়েছি। আর ঘণ্টা তিনেক অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আপনার মুখে তো কোনও অভিব্যক্তিই ফুটছে না। মুখে যন্ত্রণার চিহ্নও নেই। আবার নিজের ছেলেবেলাটাকেও মনে আনতে চেষ্টা করছেন না। কেন? আপনার মনে কোনও নদী নেই, রাতদিন যার কুলুকুলু সুরধ্বনি শুনতে পান? আমি জানি আপনি নিয়মিত ফিল্ম দেখেন। অমিতাভ বচ্চন বলতে অজ্ঞান। ‘ও-সাথি রে, তেরে বিনাহি কিয়া জিনা’ ‘কলিটা প্রায়ই তো গুনগুন করেন। তার মানে আপনার ভেতর এখনও একটা ভ্রমর বেঁচে আছে। তার মানে আপনি এখনও পুরোপুরি জরাগ্রস্ত নন। তো চোখ বন্ধ করে, বাড়ির পেছন দরোজা দিয়ে একটু উঁকি মারুন। দেখবেন আপনার বন্ধু আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। তার হাতে একটা বাঁশরি। ঠিক এভাবেই, একটু একটু করে আপনি আপনার ছেলেবেলায় ফিরে যেতে পারবেন। ফিরে যেতে পারবেন ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছটার তলায়।
ঢুলছেন দেখি! ঘুম পাচ্ছে? তাহলে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু সাবধান! বিপদ আছে। স্টেশন এলাকাটা অপরাধপ্রবণ। রাজ্যের সব চোর বাটপাড় এখানে ওত পেতে আছে। আপনাদের মতো লোক এলে তাদের জীবন ধন্য হয়। হয়তো ঘণ্টা দুয়েক পর জেগে উঠে দেখবেন, সবকিছু চুরি হয়ে গেছে আর আপনি করুণ দৃষ্টিতে মাথাকাটা পুরুষাঙ্গের দিকে তাকিয়ে আছেন!
মৃত বৃদ্ধের মুখে যে তিক্ততার, যে যন্ত্রণার ছাপ, সেটা আর কিছু নয়’ নিজগ্রামে মরতে না পারার ক্ষোভ তার মুখে অচল মুদ্রার মতো রেখে গেছে সে। মাঝে মাঝেই আমাদের সঙ্গে এইসব ব্যাপার বেশ মিলে যায় ভাই। মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ড আগেও আমরা ঘোলাটে চোখে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকি। কেন? পৃথিবী তখন কী বলে আমাদের?
না, আমি ভুল মানুষ ধরেছি। আমার মতো একটা লোক এতোক্ষণ ধরে বকবক করে যাচ্ছে, এদিকে কোনও খেয়ালই নেই। শ্রবণ বধির নাকি? এরচে স্টেশনের হিজড়েগুলোর সঙ্গে কথা বলাও তো ভালো। ভেবেছিলাম শিক্ষিত লোক। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। মৃত বৃদ্ধের কথা মনে আছে তো? মানুষটা মরে গিয়েও মুখে যন্ত্রণার একটা অভিব্যক্তি রেখে যেতে পেরেছে!
আচ্ছা, মৃত্যু-টৃত্যু নয়, আপনার জীবন নিয়েই কথা বলি। আপনি প্রায়ই ভাবেন একটু শান্তিতে খাবেন, শান্তিতে ঘুমাবেন, শান্তিতে মরবেন। স্ত্রীর পাশে শুতে গিয়ে প্রতিদিনই একবার করে মৃত্যুর কথা ভাবেন। ভাবেন না? খোঁজ নিলে দেখবেন, আপনার স্ত্রীও এই বিষয়ে ভাবছেন। কিন্তু ভেবে দেখুন, শান্তিতে খাওয়া, শান্তিতে ঘুমানো এবং মরা ব্যাপারটা কী? ফাঁকি আর তামাশা ছাড়া আর কী বলা যায় ব্যাপারটাকে? কেউ কখনও কোনওদিন শান্তিতে মরতে পেরেছে ভাই? ভেতর থেকে স্বয়ং প্রাণটাই বের হয়ে যাচ্ছে, আর মানবজাতি বলছে : শান্তিতে মলবো, আম্মু আমি শান্তিতে মলবো…মৃত্যু শান্তির হলে বিশ্বযুদ্ধগুলো হতো? তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনার কথা কেউ ভাবতো? ভাবুন তো দেখি, মানুষ শান্তিতে ঘুমাচ্ছে, খাচ্ছে আর মরছে। শালা ওঁম শান্তির বাচ্চারা!
তারচেয়ে আমি যদি বলি’ পাথর খাবো, ভরপেট পাথর নিয়ে ঘুমোবো, পাথর পেটে মরবো, অনেক স্বস্তিকর না ব্যাপারটা? শালার শান্তিতে ঘুমানো! মুখে মুতে দিতে ইচ্ছে হয়। আমি তো ঠিক করেই রেখেছি, পৃথিবীর সমস্ত পাথর সাবাড় করার পর শান্তিতে ঘুমাতে চাওয়া শালাদের চোখগুলো খাবো, কানগুলো খাবো, তারপর খাবো মাথাগুলো। আমার পাঁজর থেকে জন্ম-নেওয়া নারী তাদের হাড়গুলোকে খাবে। ঝাড়েবংশে খেয়ে শেষ করবো এইসব শান্তিতে খেতে, ঘুমাতে ও মরতে চাওয়া লোকগুলোকে।
ভেবে পাই না লোকগুলো কেন আমাকে পাথরখেকো ওসমান বলে ডাকে না! গাধার মতো উন্মাদ, পাগল এইসব হাবিজাবি ভাবে। আপনি কিন্তু আমার নামটা জেনে গেলেন! পাথরখেকো ওসমান। আপনার বড় ছেলের নামও ওসমান। ঠিক বলেছি না? ওসমান যে একটা মাকড়শার জালে ক্রমশ আটকা পড়ছে, তার খবর রাখেন জনাব আতাউর রহমান? আপনার নাম আতাউর রহমান। পিতা সিদ্দেক আলী, মাতা খায়রুন্নেছা, স্ত্রী শামসুন্নাহার। মেয়েটার নাম সুমনা। আমার বোনের নামও সুমনা। মায়ের নাম শামসুন্নাহার। বাবা আতাউর রহমান। দাদা…দেখলেন, আপনার সঙ্গে আমার বংশগতি হুবহু মিলে যাচ্ছে! অথচ আমি কিনা পাথরখেকো!
আমার বাবা ছিল গাছখেকো। শহরের দেড়’শ দু’শ বছরের পুরোনো গাছগুলোকে সে খেয়ে ফেলেছিল। আর আমার দাদা সিদ্দেক আলীর কথা শুনবেন? সে ছিল ভূমিখেকো। শহরের যে-পাড়ায় সে থাকতো, সেখানকার হিন্দুদের ভিটাগুলো প্রথমেই খেয়ে শেষ করল। তারপর খেলো ম-পের মূর্তি আর মন্দিরগুলো। মা-কালীর অনেক মূর্তি ছিল, তারা একযোগে দাদার পেটে গিয়ে ঢুকলো। সন্ধ্যাবেলায় আরতির শঙ্খ আর বাজলো না। ঢোল-করতালের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল।
মন্দিরগুলো খাওয়ার পর সে খেলো পুরাকীর্তি আর পীঠস্থানগুলো। খেতে খেতে সে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। খেতে লাগল শহরের লাগোয়া টিলাগুলো। টিলাগুলো খেতে খেতে যখন আর কিছুই বাকি থাকল না, তখন এলো একাত্তর। মানে যুদ্ধ। বলুন তো, যুদ্ধের সময় কবর খোঁড়া কি বন্ধ হয়ে যায়? মরা মানুষের গোর দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়? বধ্যভূমিগুলোতে লাশের স্তূপ পড়ে থাকে?
আমার দাদা তখন মানুষ খাওয়া শুরু করল। প্রথমে খেলো গুলিখাওয়া মরা মানুষ, তারপর মরা মানুষ আর মুখে রুচলো না। চারপাশে এতো অসহায় জীবন্ত মানুষ দৌড়চ্ছে, এদের রেখে কেন সে মরা মানুষ খাবে? প্রথম দিন সে একুশ জন জীবন্ত মানুষ খেয়েছিল!
আমরা ভয় পেতাম ভূমিখেকো দাদার মানুষখেকোয় রূপান্তর দেখে।
বুঝলেন, শুধু বাঘ-সিংহ না, মানুষও মানুষখেকো হয়। সুতরাং ওসমানকে ফেরান। ও ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছে মাকড়শার জালে। আপনি মারা যাওয়ার কয়েকদিন পর সে একটা খুন করবে। আপনার স্ত্রী ও সন্তানরা আপনার জন্যও কাঁদবে, ওসমানের জন্যও কাঁদবে। বাসায় পুলিশ আসবে। র্যাব এসে তল্লাশি করবে। তারপর একদিন মাঝরাতের ক্রসফায়ারে…আর একটা কথা। আপনার স্ত্রীকে আজ বাসায় গিয়েই বলবেন, কাজের মেয়েটার দিকে খেয়াল রাখতে। সারাদিন এতো খাটুনি যায় মেয়েটার ওপর দিয়ে! ওর এখন বিশ্রাম দরকার। ও গর্ভধারণ করেছে। ওসমান বাবা হবে!
শুনুন, আজ ট্রেইন আর আসবে না। শিডিউল বাতিল হয়েছে। সিরিয়াস অ্যাক্সিডেন্ট তো। বগিগুলোকে টেনে তুলতে হবে। তাহলে এখানে থেকে আর কী করবেন? বাসস্ট্যান্ডে চলে যান। আমিও আর থাকতে পারবো না। বার্তা আসছে। কানের কাছে একদল লোক করুণ গলায় কিছু বলছে। তাদের কথা শুনছি আজ সাত বছর। ওরা এমন একদল মানুষ, যারা মানুষের ভবিষ্যতের কথা বলে। একদল লোক, সত্যি বলছি ভাই, ওরা একদলই হবে। এদের মধ্যে শিশু যেমন আছে, তেমনই আছে নারী আর ঘেঁষঘেঁষে গলার কয়েকজন পুরুষ। তারাই আমাকে পাথর খাওয়া শিখিয়েছে। ভাতের গন্ধ তারা সহ্য করতে পারে না। তারা বলেছে, পাথরের জন্য পৃথিবীতে কোনওদিন যুদ্ধ বাঁধবে না।
অনেকক্ষণ বকবক করলাম। এবার কিছু খেতে হবে। আপনি ট্রেনের জন্য বসে থাকবেন না বাসস্ট্যান্ডে যাবেন, তা আপনার ব্যাপার। আমার এখন খিদে পেয়েছে। রেল-লাইনের পাথরের টুকরোগুলো দেখছেন? ওই যে দেখুন…এখন এগুলোই আমার খাদ্য। কিছুদিন এই টুকরোগুলো খাবো। এগুলো শেষ হলে অন্য কোথাও চলে যাবো। আমার এই পাথরখেকো জীবনটা ভ্রাম্যমাণ। এই ভ্রাম্যমাণতাই আমার বেঁচে থাকবার মন্ত্র। সুতরাং, এ আলেখ্যকে প্রণাম করুন।
এই আলেখ্যটা কোনও সাত দিন কি সাত মাস কি সাত বছরের নয়, এমন কী কোনও নয়া বসতেরও নয়, এমনকি; সেটা মায়ের গর্ভে দশ মাস দশ দিনেরও নয়, ‘ব্যাপারটা ঘটছে আজ সাত হাজার বছর ধরে। কী, জটিল মনে হচ্ছে হিসাবটাকে? ব্যাপারটা আর কিছুই না, ছাদের ওপর শুধু ছারপোকা আর খোলা জানলা দিয়ে দেখা আধখানা চাঁদ। বুদ্ধপূর্ণিমার মরা ম্লান আলো। এই মরা ম্লান আলোয় শ্বাস ফেলে বাঁচতে চায় রক্তমাখা গোলাপ।
আমার তখনই কথা হয় বনবালার সঙ্গে।
বনবালা ফিসফিস করে : নোঙর তুলিয়া নিলে মাটিতে পড়ে থাকে দাগ। জানি না, নোঙর না মাটি, কার থাকে বেশি অনুরাগ!
তখন আমার নাকে নিশিরাতের ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণে মিশে থাকে অনেক কুকুরের কান্না আর জানি না কেন, তখন শেয়ালদের উল্লাসের কথা মনে পড়ে। ঘ্রাণের মানেও বদলে যায়। গন্ধ তখন ভাঁটফুলের। তখন মাথার ওপর নেমে আসা রাত যে বিস্তারে তার শাখাপল্লব মেলে দিয়েছে বুদ্ধপূর্ণিমার ম্লান চাঁদের তলায়, তখন রক্তে কোন আলোড়ন টের পায় বনবালা?
শুনুন, আমি তার কেউ না, তবে কেবল একদিনই দেখেছিলাম তার চোখে কান্না, আর কান্নার ভেতর থেকে জেগে ওঠা দুটি চোখ ‘দগদগে!
বনবালার ঘুম আসে না। পুলিশ বখরা চায়। ভূমি তাকে নিরাশ্রয় করে রাখে। যেন সে পরগাছাও না। বনবালার পা নেই। তবে শক্তিশালী ঊরু আছে। সেখানে নদী আছে। নদীর জলে পাপ পুণ্য আছে। রক্তপুঁজও আছে। রক্তপুঁজের নিজস্ব একটা গন্ধও আছে।
এই গন্ধের নাম কী জানেন? ‘বিষকাঁটালি।
আমার কথাগুলো বড়োবেশি এলোমেলো মনে হচ্ছে, না? মনে হলে হোক, আমার কাজ হলো কাউকে বলে যাওয়া, এই যেমন আপনাকে বলছি। শুনুন, আমি আজও জানি না, নদী না রাক্ষসী না বনবালা, কী তার নাম!
জানেন, ছাদের ওপর দিয়ে ছারপোকা হেঁটে যায়। শালার রক্তের বড়ো নেশা। এই তো খানিক পর যখন বাতিগুলো আর জ্বলবে না, তখনই ফোকর গলে ঢুকে পড়বে। টেরও পাওয়া যাবে না, রক্তচোষাটা এতোই সন্তর্পণ! বুকটা খাঁ-খাঁ করে। লবণের নেশা জাগে। কিন্তু লবণ? ঘাম ভেজা ঠোঁটে জিব ছুঁয়ালে কামরাঙার লোভ জাগে, এতোই নোনতা! ঘামে এতো লবণ আমাদের!
বনবালার হাতে ছিল সবুজ চারগাছি চুড়ি। হঠাৎ মনে পড়লে এই সবুজ, বনবালার কথা কানে চুপিচুপি বাজায়, যেন এই চাঁদের আলোর ভেতর, রক্তমাখা গোলাপের ভেতর শুয়ে বনবালার নাভির গন্ধ নিচ্ছি। সে ফিসফিস করে ‘জানি না, নোঙর না মাটি, কার থাকে বেশি অনুরাগ…বনবালার চুড়ি সবুজ, কপালের টিপ সবুজ, ব্লাউজের লেস সবুজ, হাঁসুলি সবুজ আর নাভির গর্তে শুধু লবণ।
এই যে এতোক্ষণ এই কথাগুলো আপনাকে বললাম, আপনি তার কোনও মানে বের করতে পারবেন? পারবেন না। এসব এমন এক গোপনতা, আপনার আমার সবার রক্তেই শুধু খেলা করে।
দেখুন, আপনাকে বলার জন্য আজ এতোটা সময় নষ্ট করলাম। জানেন, আর কোনও দিন, আর জীবনে কোনও দিন এই হাত কোনও সুন্দরের স্পর্শ পাবে না। এক সময় বনবালা ছিল। আদিগন্ত সবুজ বনভূমির মতো ওর হাতে ক’গাছি সবুজ চুড়ি। ও যখন হাসতো, মুখ থেকে ঝরে পড়তো পাতা। আচ্ছা, আপনাকে আপনার শৈশবটাকে মনে করতে বলেছিলাম, পেরেছেন? মনে করার চেষ্টা করুন না ভাই। বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে ছেলেবেলার গান, ‘বিষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর নদেয় এলো বান,’ মনে করুন, টাপুরটুপুর করে বৃষ্টি পড়ার কোনও শব্দই কি আপনার কানে এসে ধাক্কা খাচ্ছে না?
অথবা বানের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে বসতবাড়ি? কী, নেই এসব? আপনার তো তাহলে কিছুই নেই। বেঁচে আছেন কী নিয়ে? বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে ছেলেবেলার গান, বিষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর নদেয় এলো বান…জীবন তখন উদ্দাম, উচ্ছল প্রাণের স্রোতে ছলাৎ…দেখুন, আমি আপনাকে কতোভাবে ধাক্কাচ্ছি। অথচ আপনি পারছেন না। জানেন, বনবালাই শেষ, এ জীবনে আর কোনও সুন্দরের দেখা পাবো না। আর কোনওদিন সুন্দর এসে ধরা দেবে না! আমি উদ্বাস্তু, শরণার্থী। আমার বাস্তুভিটা খেয়ে ফেলেছে এক রাক্ষসী। সে নদী না রাক্ষসী না বনবালা, নাম জানি না। আমি যাকে খুন করেছি তার নামও মনে নেই। আজ যদি পুলিশ আমাকে এ্যারেস্ট করে? তার নাম বলতে পারবো না। সে দেখতে কেমন ছিল, তা-ও মনে নেই…বনবালার কথা আপনাকে বলছিলাম, না? ওর দেওয়া ধাঁধাটা আমি ভাঙতে পারিনি। নোঙর তুলিয়া নিলে পড়ে থাকে দাগ, নোঙর না মাটি কার থাকে বেশি অনুরাগ? বনবালার নোঙরও ছিল না, আর মাটি, অনুরাগ! মাটি কোনওদিন ওকে চায়নি।
দেখুন, আপনার মুখেও যেমন আমার মুখেও তেমনই, মায়ের প্রসব বেদনার ছাপ। একটা গান শুনেছিলাম : ‘প্রথম মায়ের প্রসববেদনা পৃথিবীর মন আছে’।
প্রতিদিন একটা স্বপ্ন দেখি জানেন, দেখি যে এইমাত্র জন্ম নেওয়া একটা শিশুকে ঘিরে বসে আছে কিছু লোক। লোকগুলো জন্মান্ধ। পাথরখেকো ওসমানের দুচোখ ঘিরে কখনওই লাগাতার ঘুম নামে না। পেটের আগুনে পাথরগুলো ভেঙে গুঁড়ো হয়, যেন মুখোমুখি দুদল জওয়ান পরস্পরকে গুলি করছে! চোখ আর জোড়া লাগে না। ওসমানের চোখে তন্দ্রার ঘোর এলে জন্ম নেয় মানবশিশু। তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখে জন্মান্ধ কিছু লোক। তো কী যেন বলছিলাম…ও হ্যাঁ, একটা অদ্ভুত লোকের কাহিনি বলতে শুরু করেছিলাম। আপনি শুনছেন আমার কথা? প্রথম মায়ের প্রসববেদনা সব মানুষের মুখে! এ কী ভাই, বাড়ি ফেরার জন্য একেবারে হন্যে হয়ে উঠেছেন দেখি!
অবশ্য আপনারই-বা কী দোষ, আমি তো এমন কিছুই বলছি না, কিছু কিম্ভূত শব্দ ছাড়া। পাথর খেতে খেতে দাঁতগুলোও খেয়ে ফেলেছি। অপেক্ষা করছি আর কিছু দিনের ভেতর মুখের জিবটাও খসে যাবে। চালান হয়ে যাবে পেটে। আমার পেটটা ভাই মিকশ্চার মেশিন!
আপনাকে একটা লোকের কথা বলি। তাকে প্রথম যেদিন দেখি, তখন পাগল ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। বন্ধুরা বলতো লোকটা ডাকাত। কেউ কেউ বলতো লোকটা খুনি, ছদ্মবেশ ধরেছে। লোকটা সারাক্ষণ বিড়বিড় করতো। কাঁধে সব সময় ঝোলানো থাকতো একটা খালি রেডকাউয়ের টিন। ওই টিনের ভেতর কথাগুলো বলতো সে। কথা নয়, বিড়বিড় করতো। একটা চিটচিটে জিন্সের প্যান্ট রশি দিয়ে কোমরে আটকানো আর চিটচিটে লাল একটা জ্যাকেট। দেখুন, এই যে রকম আমি পরে আছি। দেখুন না ভাই, এতোক্ষণ আপনার পায়ের কাছে কুকুরের মতো পড়ে আছি, একবারও কি তাকানোর কৌতূহল হয়নি? লোকটার থুত্নিতে কয়েকগোছা দাড়ি ছিল, এই যেমন আমার থুত্নিদাড়ি। লোকটাকে দেখতে হো-চো-মিন হো-চো-মিন লাগতো। আমাকে লাগছে? না, আমি ভাই ব্যর্থ। আপনাকে কোনওভাবেই বাগে আনতে পারছি না। আচ্ছা, হো-চো-মিনের গল্প বাদ। আপনার সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপ করি। ভোট দেন?
যখন পাথর খাই, মানে গিলে ফেলতে চাই, তখন কী করি জানেন? তখন ভাবি যুদ্ধের কথা। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম…অগুনতি। একটা জাপান, একটা জার্মান, একটা মার্কিন, একটু চীন, একটুখানি নাগাসাকি, একটুখানি হিরোসিমা। লাখ লাখ খুনি, লাখ লাখ খুলি আর কটিদেশ। অর্ধদগ্ধ চুল, ছিটকে পড়া মগজ এইসব ভাবতে ভাবতে পাথর গিলতে হয়। না হলে বমি আসে। গলা ঠেলে পাথরগুলো নামতে চায় না। পৃথিবীতে ভাত খাওয়াই শুধু কঠিন কাজ? আপনি কী বলেন? পাথর খেয়ে দেখেছেন কখনও? যে-ভাত থালা ভরে মাছে আর ঝোলে মেখে খান, তা কি সত্যি সত্যি ভাত?
ডিমের মতো দেখতে ঠান্ডা নিরেট কঠিন একেকটা পাথর পেটে চালান করতে গিয়ে মাঝে মাঝে গলায় আটকে যায়। তখন হাঁসফাঁস করি। তখন মরে যেতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু মরবার ইচ্ছাটা তীব্রতা পায় না। মানুষের মাথা খাওয়ার লোভ লকলকিয়ে ওঠে। ঢোকের পর ঢোক গিলে পাথরগুলোকে জায়গা মতো পৌঁছে দিই। আচ্ছা, চুপি চুপি একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করি Íঅহল্যাকে চিনেন?
এ কী! বাঁকিয়ে চুরিয়ে কী রকম এক তাচ্ছিল্যের ভাব এনেছেন মুখে! কি সরকারকে গালিগালাজ করছেন? মনে মনে সরকারের পুটকি মারছেন? কোমরে জোর আছে? সরকারের পাছা দিয়ে আস্ত রেলগাড়িটা ঢুকিয়ে দিলেও কিছু হবে না ভাই। জানতে চাচ্ছি, অহল্যাকে চিনেন?
জানেন, আমার স্মৃতিতে কীভাবে যেন একটা মশারি এখনও জীবন্ত হয়ে আছে! কোথায় না কোথায় রাত কাটাই, স্টেশনে না বাস-ডিপোতে না টার্মিনালে, আমার আবার মশারি! কিন্তু রসুন-পেঁয়াজের টাটকা গন্ধের মতো কিংবা লালপেড়ে কোরা শাড়ির মতো একটা মশারি, বনবালার চুড়ির মতো সবুজ একটা মশারি। তাতে বনবালার মুখ। তার মুখে একটাই কথা ‘নোঙর তুলিয়া নিলে মাটিতে পড়ে থাকে দাগ। জানি না, নোঙর না মাটি কার থাকে বেশি অনুরাগ’ একটা প্রশ্ন। কতো সহজ স্বাভাবিক প্রশ্ন বনবালার মুখের! অথচ আজ অব্দি এই প্রশ্নের উত্তর পেলাম না! আর তাই মশারিটা রয়ে গেছে।
মানুষ কেন গান গায় বলতে পারেন? পারেন বা না পারেন, আমার কথাটা শুনুন, আমিও গান গাই। শুনলে মনে হবে এলোকেশী কাঁদছে। অর্থহীন কথা পাশাপাশি বসিয়ে গান ‘যাক ভেসে যাক, বাতাসে চেনা অচেনা ফুলের গন্ধঘ্রাণ, ভেসে যাক দূরে দূরে/দূর থেকে যাচ্ছে শোনা র্ছরা গুলির ডাক, ধাবমান পাখির ঝাঁকে/যাচ্ছে ভেসে, অচেনা ফুলের গন্ধঘ্রাণ…
হয়তো প্ল্যাটর্ফমের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছি। বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে। তখন এদিক-ওদিক তাকালে দেখা যায় স্টেশন মানুষেরই বসতবাড়ি আর সেই বাড়ির আঙিনায় নমিতা ও সখিনা কতো রহস্যময়। থাম ঘেঁষে দুটি বুড়ি শুয়ে আছে। থুত্থুড়ে। জিরজিরে। ঘুমাচ্ছে না মারা গেছে? মরে গেলে ভালো হয়। মানুষ তো মরবেই। ভাতখেকোরা মরে যাক। একমাত্র আমি, এই পাথরখেকো ওসমান শুধু বেঁচে থাকবে। বিরান প্রান্তরে যুদ্ধশেষের সৈনিকের মতো নিঃসঙ্গতার গান গাইবে’ ভেসে যাক দূরে দূরে বাতাসে ফুলের গন্ধ…গানটা আনন্দের না বেদনার? খুব কি করুণ?
বাতাসের ঝাপটা এসে গায়ে লাগে। নোনা বাতাস। আমি থুত্থুড়ে বৃদ্ধের মতো ভাঙা করুণ গলায় কথা বলি, গান গাই। পৃথিবীতে রাত কেন নামে, এ বিষয়টাকে গানে নিয়ে আসি। রাতের নেমে আসা এই পৃথিবীর জন্য কতোটা দরকার? আমি নেমে আসা অন্ধকারের ভেতর দিয়ে শুধু সার বেঁধে ঘুমিয়ে থাকা মানুষদের দেখি। সব মানুষ মৃত কিংবা অর্ধমৃত। শ্বাস নিচ্ছে কিংবা নিশ্চুপ। শান্তিতে ঘুমাতে, খেতে, মরতে স্টেশনের প্ল্যাটর্ফমে এসে রাত কাটাচ্ছে! কাতরাচ্ছে। হাত-পা ছুঁড়ছে। দেয়ালে মাথা ঠুকছে। কারও মুখ বেয়ে বমির সঙ্গে বেরিয়ে পড়ছে পচাগলা ভাত, মাছ, হাবিজাবি’ যেন মানুষ না; কুকুর কিংবা শকুন। বমি করি আমিও। ভেতর থেকে বের হয় অজীর্ণ পাথরের গুঁড়ো, কিংবা টুকরো।
প্রায়ই দেখি সঙ্গম করছে মানুষ ও কুকুর। মানুষের সঙ্গম বড়ো ত্রস্ত, ব্যাকুল। কিন্তু কুকুরের সঙ্গম? জানেন নিশ্চয়? নমিতা, সখিনা এবং তাদের সখিরা পুলিশের বখরা আদায়ে ব্যাকুল সঙ্গম সারে। ময়লা ময়লা নোট, কয়লা কয়লা নোট Íএভাবে, এভাবে…হিজড়েরাও রং মেখে দাঁড়িয়ে আছে। হেসে ঢলে পড়ছে পরস্পরের গায়। এদের কেউ আবার পান খেয়ে রাঙাঠোঁট, আর মালগাড়ির ওয়াগনগুলোর আড়ালে পরনের শাড়ি হাঁটু বেয়ে কটিদেশে পৌঁছে যায়, প্যান্টের জিপার ফাঁক হয়, লুঙ্গি খসে পড়ে।
বাতাস নোনা ধরা। কারও মুখে গান নেই, এমনকি পাখির গানও কানে আসে না, যেন সবাই ষড়যন্ত্র করছে, কিংবা আঁতাত। আমি তাই শূন্যস্থান পূর্ণ করি। ‘প্রথম মায়ের দুধের গন্ধ সব মানুষের মুখে’ ‘এই কথাটা কে বলেছিল মনে করার চেষ্টা করি। বারকয়েক গুনগুন করে আমার সেই অনর্থক কথার গানটাও গাই’ বাতাসে ভেসে ভেসে যাক, ফুলের গন্ধঘ্রাণ…পৃথিবীতে রাত নামে কেন বলতে পারেন?
আর এই গান গাওয়ার সময় কেবলই মনে হয় অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে ধুপধাপ নামি। সিঁড়ি ভাঙার শব্দ হোক। ধুপধাপ। শিড়দাঁড়া বেয়ে নামতে থাকুক শীতল স্রোত। প্রবল প্রখর অন্ধকারের ঢেউ আমাকে ঘাড় ধরে পাতালে নিয়ে যাক। নমিতারা খদ্দেরের খোঁজে এদিক-ওদিক হাঁটুক। থুত্থুড়ে বুড়ি দুটি ঘুমের ঘোরে বিগত দিনের স্বপ্ন দেখুক। দেখুক পদ্মা কেমন ফুঁসে উঠছে রাক্ষসীর মতো। দেখুক যমুনা দাঁতাল হাসি হাসছে। দেখুক মেঘনা লুটেপুটে খাচ্ছে বসতির ভিটেমাটি। অথবা তারা সাপ দেখুক, দেখুক বন্দুকের গুলি বুক বরাবর ছুটছে, দেখুক দাউদাউ আগুনে বাড়িঘর পুড়ছে। দগ্ধ মাংসের গন্ধ তাদের নাকে এসে লাগুক। শুধু আমার নাকে যেন ভাতের গন্ধ না লাগে। এই গন্ধ আমি ভয় পাই। খুব ভয় পাই।
আপনাকে একটা লোকের গল্প বলছিলাম, না? ওমা ভুলে গেলেন দেখি! জানেন, আজ বহুদিন পর আপনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মুখ দিয়ে মা শব্দটা বেরুলো। তো, ওই লোকটা দেখতে কেমন ছিল জানেন? ঠিক আমাকে যেমন দেখছেন। এদিকে একটু তাকান না ভাই। এই সেই লোক, ঠিক যেন এই আমি, আমিই সেই লোকটা। আমাকে দেখলেও লোকে ভাবে লোকটা খুনি, ডাকাত। কেউ বলে…
লোকটা পোস্টঅফিসের সিঁড়িতে বসে কাকে যেন প্রতিদিন চিঠি লিখতো। ওকে পোস্টঅফিসে না পেলে রেলওয়ে স্টেশনে চলে আসতাম। দেখা যেতো প্যাসেঞ্জারদের ভিড়ে রেডকাউয়ের টিনে মুখ লাগিয়ে বিড়বিড় করছে লোকটা।
এই আখ্যানের এখানেই সমাপ্তি। আর টানতে পারবো না। অনেক চরিত্রের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিলাম। দিলে কী হবে, চরিত্রগুলো ঠিক দাঁড়াতে পারেনি। আচ্ছা, বনবালার কথা মনে আছে? বনবালা?
এ-কথা আগেই বলেছিলাম, জীবন ভ্রাম্যমাণ। ভ্রাম্যমাণতাই বেঁচে থাকবার মন্ত্র। একমাত্র শক্তি। এ শক্তিতেই পরস্পরের নিকটবর্তী হতে থাকে দুই বন্ধু, দুই সহোদর’ জীবন ও আগুন। সুতরাং প্রণাম করুন। এ অসমাপ্ত আলেখ্যকে প্রণাম করুন আপনি। কেননা, প্রতি মুহূর্তে ঝড়ো হাওয়া বইছে। প্রতি মুহূর্তে ধেয়ে আসছে জীবন। তাই, এ আলেখ্যকে প্রণাম করুন।
ঘনিয়ে আসছে জীবন! খুনখুনে আওয়াজ করছে প্রস্তরিত হাড়। হাড় মানে গান, মানে খা-বদাহন! ও পাথর, হাড়ের আগুন, জ্বলো। জ্বলো অগ্নি’ এ আমার মন্ত্র। নিজেকে উন্মুক্ত করার এটাও একটা কৌশল।
‘পাতালভূমি ও অন্যান্য গল্প’ । প্রকাশক চৈতন্য । বারুতখানা, সিলেট tzchoitonno@yahoo.com । ০১৭১৮ ২৮৪৮৫৯, ০১৭১৪ ৬১০০৬১ । প্রচ্ছদ তৌহিন হাসান, দাম ১৫০ টাকা