ইরফান । হাসান শাহরিয়ার
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ জানুয়ারি ২০১৪, ৬:৩৯ অপরাহ্ণ, | ২৬৭৫ বার পঠিত
অনেক অনেক গলাকাটা দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে- প্রত্যেক রাইতে আমি ডুইবা যাই গভীর ঘুমে। সকাল হইলে, তাদের না থাকাটারে আমার কাছে জম্তি রাইখা- ঐ দুঃস্বপ্নগুলা উধাও হইয়া যায়। এই না থাকাটার থাকে একধরনের ভার; যেই ভার নিয়া- আমি দুলতে থাকি সারাটা সকাল- প্রতিদিনকার একরকম ঘরে, একরকম বারান্দায়, একরকম টেবিলের পাশে, একরকম পাকঘরে। পাকঘরটাই আমার প্রিয়। বেশি প্রিয়। খাবার বানাইতে বানাইতে প্রতিদিন আমি- পশ্চিম দিকে মুখ ফিইরা থাকা জান্লাটার সামনে গিয়া দাঁড়াই। আস্তে আস্তে। দেখি- মুখোমুখি পাশের ফ্ল্যাটের পূর্ব দিকের জান্লাটারে। তার পাশে পানির পাইপজোড়া ছাদ পর্যন্ত উইঠা গেছে। আর দেয়াল ধইরা ঝুইলা আছে একটা প্যাপিরাস গাছ। এই প্যাপিরাসের ফ্যাকাসে পাতাগুলার উপরে কোন কোন দিন আমার ইরফান আইসা বসে। আমার দিকে তাকাইয়া হাত নাড়ে। হাসে। আমার সাথে কথা বলে। চুপে চুপে। আমিও বলি। চুপে চুপে।
সকাল ১০টার মত বাজে। আমার রাজপুত্র টেবিলে বইসা আছে, মাথা নিচু কইরা। মানে এখন সে নাস্তা করতে চায়। অনেক সকালে ঘুম ভাঙ্গে তার। তারপর শুরু হয় আকাশ দেখা। আমি ঠিক বুঝি না, আকাশের দিকে চাইয়া এতক্ষণ সে কি দেখে। জিজ্ঞাস্ করলে বলে- আকাশের সাদা অংশটা তার ভাল লাগে। ঐ অংশটাতে সাতটা রঙ লুকাইয়া থাকে। তখন নাকি তাদের ফ্রিকোয়েন্সি ভিন্ন, ওয়েবলেংথও ভিন্ন কিন্তু-দৌড়ায় একসাথে। রংগুলা কিভাবে এইভাবে মিইলামিইশা সাদায় একাকার হইয়া থাকে- এইটাই বুঝতে চায় সে। ইস্কুলের স্যাররে জিজ্ঞাস্ করলে, জানোয়ারটা নাকি আমার রাজপুত্রটারে ধমক দিছিল। কত্ত সাহস!
সকালে আমার রাজপুত্রের পছন্দের খাবার একটা ডিমপোস আর এক প্লেট পোলাও। প্রায় সকালে আমি শুধু তার লাইগাই এইটা বানাই। আজকেও বানাইছি। ‘তোমার আকাশ দেখা হইছে, বাবা?’ আমি খুব অবাক হইলাম। রাজপুত্র আমার দিকে চোখ লাল কইরা চাইয়া আছে। তার ঠোঁট কাঁপতেছে।
-কি হইছে বাবা?
– সকালে তুমি আব্বারে নাস্তা দাও নাই ক্যান? আব্বা না খাইয়া অফিসে গেল।
– তোর আব্বা বাইরে খাইয়া নিবো।
– বাইরে খাইবো ক্যান?
– এইটা তুই বুঝবি না। তুই নাস্তা কর্।
– তুমি আব্বারে নাস্তা দাও নাই ক্যান?
– ওই মাগিটা আসছিল। তোর আব্বা কাল ঐ মাগিটার সাথে শুইছে! মাগিটাই ওরে খাওয়াইবো। তুই চিন্তা করিছ না।
– কালকে তুমি আব্বারে রুমে তালা দিয়া রাখছিলা।
– ত কি হইছে। বদমাইশটা ভ্যান্টিলেটর খুইলা বাইর হইছে।
– ভ্যান্টিলেটর কাঠের। ঐটা দেয়ালের সাথে আটকানো। ঐটা রাতের বেলা বিনা শব্দে কেউ খুলতে পারবো না।
– বদমাইশটা পারে। বদমাইশটা জাদু জানে।
– তুমি সামনের দরজায়ও ত তালা দিয়া রাখছিলা!
– তুই খা। মাগিটা আসছিল। বদমাইশটা মাগিটার সাথে শুইছিল। তুই খা। তুই বুঝবি না। তুই খা।
– তোমারে কে বলছে আসছে? তুমি কখন দেখছো আসছে?
– তুই খা। মাগিটা আসছিল।
রাজপুত্র প্লেটটা ফ্লোরে আছাড় মারলো। কান্নায় চোখ টলমল করতেছে তার। আর আমার বড় মায়া লাগতেছিল। ‘আম্মা, তুমি ভুল দেখ। মিথ্যা দেখ’- বলতে বলতে, কাঁদতে কাঁদতে পোলাটা আমার না খাইয়া উইঠা গেল। তারপর তার দরজাটা বন্ধ কইরা ফেলল। সে এখন আকাশের দিকে চাইয়া- লুকাইয়া থাকা রংগুলারে খুঁজবো। তার কোন দোস্ত নাই। একা একাই তারে খুঁজতে হইবো। কাঁদতে কাঁদতে। তার টলমল চোখ হয়ত রংগুলারে সাজাইয়া নিবো একটা সময়; প্রিজমের মত।
মাথাটা আমার ঝিমঝিম করতেছে। রাগ উঠতেছে। মনে হইতেছে, একটা দা নিই। তারপর পাশের বাসার মাগিটারে কোপাইতে কোপাইতে রক্তাক্ত করি। তারপর তিনতলার মাগিটারে। তারপর দুইতলার। তারপর সামনের বিল্ডিংয়ের মাগিগুলারে। বদমাইশটা যখন বারান্দায় আসে, মাগিগুলা জান্লায় আইসা খাড়াইয়া থাকে। আমি জানি, কাল রাইতে পাশের মাগিটা আসছিল। পাকঘরের কোণায় বীর্য পইড়া ছিল, লালা পইড়া ছিল। আর সে সব দেখছে। ইরফান। আমারে বলছে। চুপে চুপে।
ইরফানের কথা আমি- কাউরে বলতে পারি না। সে প্যাপিরাসের পাতায় বইসা থাকে, দেয়াল ধইরা ঝুইলা থাকে। কার লাইগা? আমার লাইগা। শুধু আমার লাইগা। তারে কেউ দেখে না। তারে শুধু আমি দেখি।
দুই.
আমার রাজপুত্র তখন ছোট। একদিন পশ্চিমের জান্লাটাতে চাইয়া দেখি- দেয়াল ধইরা ঝুইলা আছে ইরফান। প্যাপিরাস গাছটা তখন ঐখানে ছিল না। ইরফানরে দেইখা আমার হাত থেইকা মসলার বাটিটা নিচে পইড়া গেল। বাসায় তখন আমি একা। আর আমার ছোট্ট রাজপুত্র ঘুমাইতেছিল বেঘোরে। ইরফান আমারে বলল- ‘কেমন আছ মিতা’? আমি দেখলাম একটা বিষন্ন মুখ। যেই হাত ছুইটা যায়, তারে আর ধরতে না পারার যন্ত্রণা। চোখের নিচে তখন যেন একটা গিরিখাদ। ভাসতেছে। তার অন্ধকার। ছুইটা গেছে যা, তার উধাও হইবার ছবি; পতিত হইলে পরে- তার আর্তনাদ শুনার অপেক্ষা। আমি কোন উত্তর দেই নাই। সেও আমারে আর কিছু জিজ্ঞাস্ করে নাই।
তারপর থেইকাই ফ্লোরে বীর্য পইড়া থাকে। লালা পইড়া থাকে। আমি অন্য রুমে গেলে- বদমাইশটা জান্লায় দাঁড়াইয়া মাগিগুলার সাথে তামাশা করে। আমি গোসলে গেলে পাশের বাসার মাগিটা ঘরে চইলা আসে। বদমাইশটা ঘর থেইকা বাইর হইলেই সিঁড়িতে মাগিগুলা তারে আগলাইয়া ধরে। আমি এইগুলা দেখি। যখন ঘুমাইতে যাই। যখন একা থাকি। আমার দুঃস্বপ্নগুলা হুবহু মিইলা যায় ইরফানের কথার সাথে। সে শুধু আমারে আরো সাবধান হইতে বলে। খুব সাবধান।
একদিন বদমাইশটা বলল- চল। ডাক্তারের কাছে।
– কেন?
– ইদানিং তুমি আমারে নাস্তা দিতেছ না। খাবার দাও না ঠিক মতন। খালি গালি দাও।
– ডাক্তার কি করবো তাইলে?
– কিছু না। আমি এইগুলা ডাক্তাররে বলছিলাম। ডাক্তার হাইসা বললেন তোমার সাথে দেখা করতে চায়।
– তুই একটা বদমাইশ।
ঠিক আছে। এইটা তুমি ডাক্তাররেও বইল। পারলে তারেও একটা গালি দিও। এখন একটু সাইজা নাও। ঠিক আছে! না সাজলেও চলবো। এত সুন্দর তুমি। মাঝে মাঝে তোমারে ঘরে একলা রাইখা যাইতে ভয়ই লাগে আমার! চল তাইলে।
বদমাইশটা আমারে ডাক্তারের কাছে নিয়া গেল। দেইখাই ডাক্তারটারে খুব ভাল লাগলো আমার। ফর্সা, লম্বা। সুন্দর। ইরফানের মত। কথাবার্তায় শান্ত। বাংলা বলেন স্পষ্ট। কিন্তু হারামিটা কিছুক্ষণ পর খুব ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন শুরু করলো আমারে। বদমাইশটা তখন বাইরে বসা। ডাক্তার জিগাইল- আপনার স্বামী কেমন?
-মানে?
– বিছানায়?
আমার কান গরম হইলেও তার মত কইরাই শান্তভাবে জবাব দিলাম- ‘ভাল। আমারে খুব আনন্দ দেয়’। দেখলাম ডাক্তার একদম বিচলিত হয় নাই। সে একের পর এক প্রশ্ন করতেই লাগল। তারপর আমারে নিয়া অনেকগুলা সেশন হইল। অষুধ খাইলাম অনেক। ঘুম বাড়লো অনেক। কিন্তু বদমাইশটার বদমাইশি গেল না। মাগিগুলা আসতে লাগলো একের পর এক। রাতের পর রাত। ফ্লোরে বীর্য পইড়া থাকে। সকালে কাঁদতে কাঁদতে মুছি আমি। সে আমারে শান্তনা দেয়। সে আমারে সব বইলা দেয়। কোন মাগিটা আসছিল আজকে রাতে। চুপে চুপে।
বদমাইশটা আমারে আর কোনদিন কোন ডাক্তারের কাছে নেয় নাই।
তিন.
আমার বয়স যখন সতের, ভাইয়া সোনালী ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হইলেন। গ্রামের মানুষ তখন ভাইয়ারে নিয়া গর্ব করা শুরু করল। পরিবারে বরাবরই ভাইয়া ছিলেন কর্তা। যদিও আমার আম্মা ছিল। আমার আব্বাও ছিল। আম্মা একমনে ঘরের কাজ করতেন। আব্বা- সকাল হইলে ঘরের দাওয়ায় বইসা কোরআন পড়তেন। একদিন শুক্রবার জুম্মার পরে ঝাঁকড়া চুলের এক পোলা নিয়া ঘরে আসলেন ভাইয়া। সকাল থেইকাই বাড়িতে একটা অস্থিরতা, তড়িঘড়ি দেখতেছিলাম। পোলাটা আসায় এই অস্থিরতা আরো বাইড়া গেল। ঝাঁকড়া চুলের পোলাটা পাশের গ্রামের। চাকরি করে শহরে, একটা সারের কোম্পানিতে। ঝাঁকড়া চুলের পোলাটার সাথেই আমার বিয়া হইল। ঝাঁকড়া চুলের পোলাটাই আমার রাজপুত্রের বাপ।
আমাদের বাড়ির পাশে আরেকটা বাড়ি ছিল। আমরা বলতাম- ভাঙ্গা বাড়ি। বাড়িটার চারপাশ ভাঙ্গা ছিল। ঘরগুলাও ছিল ভাঙ্গা। ভাঙ্গা বাড়িটাতে থাকত ইস্কুলের বাংলা মাস্টার। তার বাপেরে নিয়া। তার মায়েরে নিয়া। তার ছিল একজোড়া বোন। বোনগুলা ছিল খুব মিষ্টি। বোনগুলা ছিল লাল টুকটুকে। তারা সকালে আমার বাড়িতে আসত, বিকালেও আসত। আমরা একসাথে খেলতাম। আমরা অনেক কথা বলতাম।
বাংলা মাস্টার কবিতা লিখতো। তার টুকটুকে বোনজোড়া সেই কবিতাগুলা নিয়া আসত আমার কাছে। আমারে পইড়া শুনাইত। কবিতাগুলা আমার ভাল লাগত না। বোনজোড়ারে আমি বলতাম- ‘মাস্টার এত ফালতু কবিতা কিভাবে লেখে’? একদিন তারা আমার কাছে একটা চিঠি নিয়া আসলো। মাস্টারের চিঠি। আমারে না জানাইয়া- চিঠিটা আগেই পইড়া ফেলছে বইলা তারা খুব লজ্জা পাইতেছিল। তারা মিটমিট কইরা হাসতেছিল। আমি তাদের গাল টিইপা দিলাম। চিঠিটা খুললাম।
‘মিতা, তুমি এই বাড়িতে আসলে আমরা দুইজনে মিইলা ভাঙ্গা বাড়িটা মেরামত করবো।– ইরফান’।
বিয়ার দিন- ঝাঁকড়া চুলের পোলাটার সাথে যখন গাড়িতে উঠলাম, তখন সন্ধ্যা। আলোর উপরে অন্ধকার। আমি একটুও কাঁদতেছিলাম না। কাঁদতেছিল সবাই। ভাইয়াও। আমি দেখলাম- টেন্টের কাপড়গুলা সরাইতেছে ইরফান। চেয়ারগুলা সরাইতেছে ইরফান।
চার.
চারদিকে ছড়াইয়া থাকা পোলাও, ডিম, কাচের টুকরাগুলা সরাইয়া ফ্লোরটা পরিষ্কার করলাম। একবার গিয়া রাজপুত্রের দরজায় ধাক্কা দিলাম। সে কোন কথা বলল না। দরজাও খুলল না। আমি আবার পাকঘরে ফিইরা গেলাম। পশ্চিমের জান্লাটার দিকে চোখ রাখতেই ইরফান আমারে বলল- ‘তোমার ছেলেটা খুব ভাল, মিতা’। আমি কিছু বললাম না। সে আবার বলল- ‘তোমার স্বামীটাও খুব ভাল’।
-হুম।
– খারাপ অভ্যাস সবার থাকে।
– হুম।
– মিতা, তুমি আপেল কাটার ছুরিটা আর টেবিলে রাইখো না।
– কোথায় রাখবো?
– তোমার বালিশের নিচে। যখন তুমি ঘুমাইতে যাও তখন।
– কেন?
– এমনিতেই।
– আচ্ছা।
– তোমার স্বামীটা খুব ভাল মিতা।
– হুম।
– খারাপ অভ্যাস সবার থাকে।
– হুম।
পাঁচ.
অনেক অনেক দুঃস্বপ্নের ভারে আমি তখন গভীর ঘুমে। অচেতন। তবু মনে হইল, কে যেন ডাকতেছে আমারে। ‘মিতা, উঠো। সকাল হইছে’। ঘুম ভাইঙ্গা গেল আমার। দেখি বদমাইশটা অফিসে যাওয়ার লাইগা তৈরি হইছে। আর আমার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেছে। সকাল সকাল তারে দেখলে এমনিতে খুব রাগ হয় আমার। দুঃস্বপ্নগুলা সমস্ত গতরে কামড়াইতে থাকে তখন। সে হাসতেছিল। নিঃশব্দে। আমার মাথায় হাত রাইখাই বলল- ‘উঠবা না? সকাল ত হইয়া গেছে। আজকে থেইকা বাবুর ইস্কুল খোলা। ওর লাইগা নাস্তা বানাও। আমি অফিসে গেলাম’।
আমি কোন কথা বললাম না। তার চইলা যাওয়ার অপেক্ষা করতেছিলাম। সে মাথা থেইকা হাতটা সরায়ে নিল। তারপর আচমকা পাশের ড্রেসিং টেবিল থেইকা আপেল কাটার ছুরিটা হাতে নিল। আমার দিকে তাকাইল। আবারও হাসলো। তারপর এক নি;শ্বাসে অনেকগুলা কথা বইলা গেল। আমি কিছু শুনলাম। আর কিছু শুনলাম না। ‘এইটা তোমার বালিশের নিচে রাখছিলা ক্যান, মিতা? বালিশের নিচে ছুরি রাইখা কেউ ঘুমায়? তোমার কিছু কাটতে ইচ্ছা হইলে আমারে বলবা। আমি কাইটা দিবো। মনে নাই, একবার আপেল কাটতে গিয়া হাত কাইটা ফেলছিলা! কত রক্ত পড়ছে! তুমি কাঁদতেছিলা। তোমার কান্না দেইখা অনেক কষ্ট লাগছিল আমার। এইটা টেবিলের উপরেই থাক। আমি অফিসে যাইতেছি। মেঘনার উপরে নতুন ব্রীজটার উদ্বোধন হইবো সন্ধ্যায়। কোয়ার্টারের অনেকেই যাইতেছে দেখতে। আমি আইসা তোমারে নিয়া যাবো। তুমি তৈরি হইয়া থাকবা। আমরা দুইজন অনেক রাত পর্যন্ত ব্রীজের উপর হাঁটবো……’