উৎসবে মধ্যবিত্তের “পুতুল কন্যারা” । ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, ৭:২১ অপরাহ্ণ, | ২০৮১ বার পঠিত
১
আজ থেকে প্রায় বছর বিশেক আগের ঘটনা। বাবার মৃত্যুর মাস ছয়েক পরে আমার ফুপাতো বোনের হুলুস্থুল বিয়ের অনুষ্ঠান। বিয়ের উৎসবে আমার মা কে অতি সমাদরের সাথে দাওয়াত দেয়া হলো। দুই ভাই, মা আর আমি নোয়াখালীর গ্রামের সে বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলাম। কাবিন যখন পড়ানো হবে তখন আমার ফুপু আমার মা কে নতুন বউয়ের কাছে আসবার জন্য ডাকতে লাগলেন। হঠাৎ ভরা মজলিশে আমার সরকারী কর্মকর্তা চাচা বলে উঠলেন “ভাবীকে এখান থেকে নিয়ে যাও, উনি বিধবা, বিয়ের অনুষ্ঠানে সমস্যা হয়”। আমার মনে পড়ে আমার মা কোন কথা না বলে আমার হাত ধরে খুব দ্রুত বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে পেছনের খোলা জায়গায় চলে আসলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে আম্মা একটা মাটির ডিবির উপর আমাকে নিয়ে বসে থাকলেন। বাড়ির হৈ চৈ আমাদের দুজনের কানে আসছিলো, বিয়ে পড়ানো হলো, খাবারের আওয়াজ কানে আসছে। আর পেছনের সেই জায়গাটায় বিয়ের খাবারের লোভে ঘুরঘুর করতে থাকা গ্রামের কুকুরগুলো কেবল আসা যাওয়া করছে। আমি আমার মা কে কখনই এভাবে একলা কোথাও বসে থাকতে দেখিনি। আমার ৫০ ছুঁই ছুঁই মা বিয়ের পরদিনই ঢাকায় চলে আসলেন এবং তার কিছুদিনের মধ্যে প্রথমবারের মতো তার ব্রেইন স্ট্রোক হলো।
উৎসবকে ঘিরে নারীর অভিজ্ঞতার কথা লিখতে গিয়ে আমার প্রথম নিজের জীবনের এই ঘটনার স্মৃতিটাই বারবার মনে পড়ছিল। আমি দিব্যি মনে করতে পারি সেই সাত বছর বয়সে আমার জীবনের সেই ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে আমি কিছু একটা শিখেছিলাম, কিছু একটা ভিন্ন বাস্তবতা আমি প্রথমবারের মতো দেখতে পেয়েছিলাম। আমি প্রথমবারের মতো বুঝে নিয়েছিলাম “বাবা থাকা আর না থাকার” মধ্যে অনেক বড়ো পার্থক্য আছে। আর সেই পার্থক্যে আমার মধ্যবিত্ত মায়ের কোন একটা “খারাপ” কিছু ঘটেছে। নারীর “স্বামী” মরে যাওয়া যে বিশেষ সুবিধার বিষয় নয়, আর সেকারণে যে নারীকে নানান সমস্যায় পড়তে হয়, আর সে সমস্যায় পড়বার সাথে সাথে (আবেগের কথা বলছি না এখানে) “কারণ” হিসেবে ঐ নারীকেই যে সামাজিক নানারকম মন্দ কথাবার্তা শুনতে হয় বা শোনার সম্ভাবণা তৈরী হয় সেটা আমি সেই ছোটবেলাতেই আমার মধ্যবিত্ত মা কে দেখে শিখে নিয়েছিলাম।
২
সময় পেরিয়ে গেছে। ৯১ সনের সেই সাত বছরের ছোট মেয়ে ২০০০ সনের শুরুতে ১৬ বছর বয়সী কিশোরী। উৎসবের কাহিনী আমি তখন পত্রিকায় পড়তে পারি। মনে পড়ে তখন আমি সবেমাত্র কলেজের ছাত্রী এবং ২০০০ সনের ১লা জানুয়ারীর “মিলিনিয়াম বাঁধনের” ঘটনার ছবি সমেত সংবাদপত্রের খবরগুলো আমাকে আমার অভিভাবকরা দেখতে দিতেন না। আমি জানতাম ঐ সংবাদগুলোতে এমন কিছু আছে যেটা আমার জানা যাবে না। আশপাশের সবাই বাঁধনকে নিয়ে নানান আলোচনা সমালোচনা করতেন। যার মূল বিষয় ছিল “বাঁধনের সমস্যা আছে, না হলে সে এতো রাতে বন্ধুসহ টিএসসিতে যায় কেন?”
স্নাতকোত্তর পড়াশুনা শেষ করে গবেষক আমি গবেষণার প্রয়োজনে যখন বাঁধনের সেই ঘটনা নিয়ে পত্রিকার কভারেজগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিলাম তখন আমার সেসময়কার একটি লিডিং নিউজ পেপারের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার খোলা চিঠিপত্রের আসরে জমে উঠে একটি জম্পেশ তর্কাতর্কির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। ঐ খোলা আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল “নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনে বাঁধন শাড়ি পড়েছে কেন?”। আলোচনায় যারা অংশ নিয়েছিলেন পত্রিকায় তাদের যে চিঠিপত্র ছাপা হয়েছিল তার মূল উপপাদ্য অনেকটা এমন যে “মিলেনিয়াম সেলিব্রেশন একটা পশ্চিমা সংস্কৃতির বিষয়। অপসংস্কৃতির উন্মাদনাতেই এমন একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেলো”। পত্রিকায় প্রকাশিত খরবগুলো যদি একটু গর করে পড়া যায় দেখা যায় খবরগুলোর আলোচনায় এসেছিল বাঁধনের সাথে অভিযুক্তের কথোপকথন, বাঁধনের চালচলন কি রকম, ঘটনার সবিশেষ বর্ণনা, ছবিতে যে অভিযুক্তকারী তিনিই এবং আটককৃত ভদ্রলোক একই ব্যক্তি কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি নানান কিছু। অর্থাৎ প্রকাশিত সংবাদগুলোর মধ্যে আমি একধরনের দূর্ঘটনাজনিত বৈধকরণের প্রবণতা খুঁজে পেয়েছিলাম। বারবার আমার খবরগুলো পড়ে মনে হচ্ছিল সংবাদগুলো বলতে চায় টিএসসিতে উৎসবের ঘনঘটার মাঝে নারীর শাড়ি টান দিয়ে একদল পুরুষ খুলে ফেলেছে এটা স্বাভাবিক কোন বিষয় নয়। আমিও বলছি এটা স্বাভাবিক বিষয় নয় বরং অপরাধ। আমার ভাবনার সাথে সংবাদপত্রের প্রকাশিত সংবাদের পার্থক্য কেবল এই যে তারা আমার মতো করে একে অপরাধ চিহ্নিত না করে একটা আকস্মিক ঙ্খলন বলতে সে সময়ে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলেন।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে অপরাধকে ঙ্খলন বললে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়? একদিকে বিষয় তো ঠিকই। ঙ্খলন তো সামাজিকভাবে তেমন ভাল কোন ঘটনা না যে অপরাধকে ঙ্খলন বলাটাই সমস্যা। কিন্তু আপনি যদি একটু নজর দেন দেখতে পাবেন যে বিষয়, ঘটনা কিংবা আচরণ স্পষ্টভাবে অপরাধ সেটাকে যখন আমরা ব্যক্তিক ঙ্খলন বলছি তখন আসলে আমরা অপরাধকে কেবল ব্যক্তির ভুল বা অন্যায় হিসেবে দেখবার মধ্যে দিয়ে অপরাধের মাত্রাকে অবমূল্যায়ণ করবার রাস্তা তৈরী করে দিচ্ছি। একই সাথে অপরাধীর অপরাধের ভারও কমে যায়, বিশেষভাবে যার সাথে অন্যায় করা হলো তার অভিযোগ ভীষণভাবে হালকা হয়ে যায়। এবং এই পুরো প্রক্রিয়ায় অপরাধীর ঐ বিশেষ অপরাধ করতে পারার জন্য যে সমাজ- এমনকি সংস্কৃতির নানান ক্ষমতার ব্যাপার স্যাপার জড়িত সেগুলো আমাদের আর চোখে পড়ে না।
যখনই আপনি কোন অন্যায়কে ঙ্খলন বলছেন তারমানে আপনি আসলে ঙ্খলনের কারণগুলোও খুঁজে বের করবেন। যখনই কারণ খুঁজে বের করতে চাইবেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজের ক্ষমতবান তার ক্ষমতার বলে নিজের ঙ্খলনের কারণ অন্যের উপর দায় হিসেবে বর্তাতেই কাজ করবে, অন্যের ঘাড়ে দিতে পারলেই খুশী হবে। এই একই বাস্তবতা আমরা ২০০০ সনের ইংরেজী বর্ষবরণ উৎসবে যৌনহয়রানির শিকার বাঁধনের বেলাতেও দেখতে পাই। দেখতে পাই বলেই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠে “নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনে শাড়ি পড়া উচিত কি অনুচিত”, দেখতে পাই বলেই “টিএসসির সেই ঘটনাকে আমরা আমাদের রোজগেড়ে জীবনের বাইরের একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা বলে চোখের বাইরে রাখতে চাই”, অন্তত এটা ভেবে আমি আমরা মধ্যবিত্তের অনেকেই স্বস্তি পেতে চাই যে “কিছু দুষ্ট লোকের উচ্ছৃঙ্খলতায় এমন ঘটনা ঘটলো”, বাঁধনের মতো ওতো রাতে উৎসবে আমরা মধ্যবিত্তের নারীরা যাবো না, আমাদের এসব পোহাতেও হবে না এই ভাবনাগুলো ভেবে, আমাদের সমাজ কাঠামোতে নারী বিদ্বেষী মনোভাব আছে কি নেই সেই নিয়ে গভীর ভাবনায় না গিয়ে বাঁধনের ঘটনাকে একটা আকস্মিক দূর্ঘটনা বলে নিদেনপে একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়তে পারি।
এখন প্রশ্ন হলো আমাদের ব্যাগ ছিনতাইকারী নিয়ে যায় কিংবা রাস্তাঘাটে আমাদের দূর্ঘটনা হলে হাত পা ভেঙ্গেও যায়। সেই দুর্ঘটনা আর বাঁধনের দূর্ঘটনাকে কি আমরা এক মাত্রায়, একই সামাজিক অর্থে দেখতে পাই? নাকি এই ব্যক্তিক ঙ্খলনের দূর্ঘটনায় পতিত নারী আমার মায়ের মতো উৎসব ছেড়ে দিয়ে খাবারের লোভে ঘুরঘুর করতে থাকা কুকুরের সাথে একত্রে ঘরের পেছনে মাটির ডিবিতে সন্তান সহ একা একা চুপ করে বসে থাকতে বাধ্য হন? যদি বাধ্যই হয়ে থাকেন তবে উৎসবের আন্তরিক আয়োজনে নারীর অবস্থানটা আসলে কি?
৩
মধ্যবিত্ত এক মধ্যবয়সী কর্মজীবি নারী বলেন “আমার বর উৎসবে আমার পছন্দের মানুষজনকে দাওয়াত দিতে দেয়। ও সবসময় আমাকে দিয়েই দাওয়াতটা দেয়ায় তাতে অনেক আন্তরিক লাগে..আমার বরই এটা বলে। আমার বন্ধু বান্ধব? আসলে বিয়ের পর কি ওভাবে সংসারের নানান কাজে নিজের কোন বিশেষ জায়গা থাকে!..এখন ওর মানুষই আমার..”। অপর আরেক বত্রিশের নারী বলছিলেন “শোনেন বিয়ে মানেই একজন মেয়ের জন্য তার নিজের জায়গা ছেড়ে অন্য একটা নতুন জায়গায় আসা। সেখানে একজন বউয়ের অনেক বন্ধু বান্ধব থাকবে, আর তারা ঘরের ভেতর হৈ হুল্লোড় করবে সেটা ঠিক মানায় না”। আটত্রিশের আরেক মধ্যবিত্ত নারী বলেন “আমার হাজব্যান্ডের পরের দাওয়াতে আমি তারসাথে কোন শাড়িটা পড়ে যাবো সেটা ঠিক করাই মনে হয় আমার একমাত্র সামাজিক কাজ”।
আমার হঠাৎ প্রশ্ন জাগে নারীর বয়ানে এই যে “ওর মানুষই আমার”- এই কথাটা বৈবাহিক সম্পর্কের দুইপক্ষ নারী এবং পুরুষ উভয়ের বেলায় কি সামাজিকভাবে একইরকমভাবে খাটে? যদি না খেটে থাকে তাহলে সামাজিক অংশগ্রহণের নানান উৎসবে নারীর সামাজিক ভূমিকাটা কি কি হতে পারে? এই ভূমিকা ঠিকমতো পালন করবার জন্য পূর্বশর্ত হিসেবে কোন কোন বৈশিষ্ট্য নারীর থাকতে হয়? নারী এই ভূমিকাগুলো কি কি মাধ্যমে কি কি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পালন করে থাকে? আর পালন না করলে কি কি ধরনের সামাজিক মান সেই নারীকে ঘিরে তৈরী হতে পারে?
৪
আমরা আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষিত সারাবছর নানান ধরনের উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে যাই। জাতীয়, সাংস্কৃতিক, বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক এমনকি আঞ্চলিক নানান ধরনের উৎসব আমরা দেখতে পাই। পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ভাষাদিবস, দূর্গাপূজা, ঈদ ইত্যাদি সহ নানান ধরনের আঞ্চলিক পার্বণও আমাদের আছে। উৎসব আয়োজনে নানান রকমের আমেজ থাকে, নানান ধরনের কর্তব্য- দ্বায়িত্ব কাজকারবার জড়িত থাকে। কর্তব্যের সাথে আবার জড়িত থাকে উৎসব আয়োজনের কর্তার নাম এবং তার ভূমিকাও।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান “উৎসবের আমেজটাই অন্যরকম। কতো কিছু কেনা হয়, বাড়ি ঘর সাফসুতরা করা হয়, রান্নাবান্না হয়..ভীষণ আনন্দের একটা পরিবেশ। তবে এটা ঠিক আমি আমার ভাইয়ের মতো কেবল উৎসবে গা এলিয়ে শুয়ে থাকতে পারি না, এমনকি আমার মনও চায় না। আমাকে বাড়ির মেয়েদের সাথে কাজে হাত বাটাতে হয়, এমনকি পরীক্ষা থাকলেও”। আরেক নারী শিক্ষার্থী বলছিলেন “আমার বর ঈদের দিন নামাজ পড়ে এসেই ঘুমাতে যায়। তার কোন খেয়াল থাকে না। কোরবানির ঈদে সে কোরবানি দিয়ে এসেই ঘুমিয়ে যায়। আমি কি করছি, কিভাবে কি ম্যানেজ করছি সেসবে সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকে না। একটু একসাথে কাজ করা, ঘর গৃহস্থালীর দিকে নজর দেয়া এসবে সে নাই। কেবল বিকেলে তার বন্ধুদের বাসায় দাওয়াত এর কখনই কোন হেরফের হওয়া যাবে না”। স্কুলে মাস্টারি করেন এমন এক মধ্যবিত্তের নারী বলছিলেন “যেকোন বড়ো উৎসবে আমার কাজ বাসায় থাকা, বাসার সবকিছু গোছগাছ করা, কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে ফিটফাট থাকা, অনেকটা পুতুলের মতো। নিজের বাবার সংসারে এমনই ছিল, এখন নিজের বিয়ের পরে শ্বশুড়বাড়িতেও এরচেয়ে ভিন্ন কিছু কখনই হয় না”।
আমরা যখন শোকেসে পুতুল সাজাই কোন পুতুলকে কখন কোনটার সাথে কোন কোন রঙে গুছিয়ে রাখবো সেও আমরা ঠিক করে দেই। নারীদের সাথে কথা বলতে গিয়ে উৎসবে মধ্যবিত্ত নারী আমাদেরকে আমার অনেকসময় সেই শোকেসে সাজিয়ে রাখা পুতুলের মতোই মনে হচ্ছিল। পুতুলের নানান পোশাক আমরা বানাই, আমাদেরকে আমাদের পরিবার আমাদের কাছের পাশের অনেক মানুষরাই নানান ধরনের পোশাক দিয়ে থাকেন। পহেলা বৈশাখে আমরা রমণীদের সাজসজ্জাই বর্ষবরণের চেহারা বহন করে বেড়ায়, এমনকি দূর্গা পূজায়, ঈদেও। কিন্তু আমরা ঐ শোকেসের পুতুলের মতোই নিজেদের অভিজ্ঞতায় নানান সময়ে কিছু নির্দিষ্ট পরিসরে উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেবার বাধ্যবাধকতা অনুভব করতে থাকি। এই প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন বেতারে কর্মরত পয়ত্রিশের নারী। তিনি বলেন “আমি আমার বাবা মা’র একমাত্র সন্তান। বিয়ে হয়েছে প্রায় বছর দশ। কোন একটা ঈদ আমি বর নিয়ে, বাচ্চা নিয়ে আমার মা বাবার সাথে করতে পেরেছি এমন কোন নজির আমার নেই। এমনকি পহেলা বৈশাখেও বাড়িতে সবকিছু করে রেখে আমি বিকেলে আমার মাকে দেখতে যাই”। আরেক নারী বলছিলেন “আমরা তিন বোন। ভাই নেই। আমি সবার বড়ো। বাবা মার সাথে ঈদ করতে যে বার শ্বশুড় বাড়ি থেকে এসেছিলাম সেবার আমার বর কিন্তু ঈদ করেছিল তার নিজের বাবার বাড়িতে। আমার মাথায় সবসময় একটা প্রশ্ন ঘুরে এমনটা কি কখনই হতে পারে না যে আমি আমার বরের মতো কেবল নিজে আমার বাবা মার সাথে ঈদ করতে পারি, বর করুক তার বাবা মার সাথে?”।
বিবাহিত নয় যে নারী তার অভিজ্ঞতাতেও একই রকমের প্রদর্শনীর ব্যাপার স্যাপার দেখতে পাওয়া যায়। ঢাকা শহরে আমার নিজের যে কজন মধ্যবিত্ত নারী বন্ধুবান্ধব আছে আমাদের সকলের কোরবানী ঈদ নিয়ে একটা সাধারণ মন্তব্য হলো “বাসায় আসিস…আসতে পারবি না জানি তারপরেও বললাম”। আমি অবিবাহিত নারী নিজের পছন্দ মতো বিভিন্ন সম্পর্কের মানুষকে নিজের জীবনের নানান উৎসবে আমন্ত্রণ করবার, নিজে ঘুরতে যাবার পূর্ণ স্বাধীনতা বোধ করেছি বলে আমার মনে হয় না। বরং একধরনের অলিখিত নিয়মে নারী হিসেবে কোন উৎসবে আমাকে ঘরে থাকতে হবে, কোন উৎসবে কোন কোন সময় আমি ঘরের বাইরে থাকতে পারবো, কোন উৎসবে আমি অংশ নিতে পারবো কোনটায় না, কোন পোশাকে কোন অনুষ্ঠানে কি বেশে আসবো এই নানান বিষয়াদি আমি আমার জীবনে নানান সময়ে সমাজ- পরিবার- অভিভাবক এমনকি মূূল্যবোধের মাধ্যমে পূর্বনির্ধারিরত চেহারায় উপস্থিত থাকতে দেখেছি। ২৫ বছর বয়সী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক নারী বলছিলেন “ঈদে আমি সবসময় দেখেছি আমার ভাইকে ঘুরে বেড়াতে। এক্কেবারে ছোটবেলা ছাড়া মানে ১৪ বছরের পরে আমি কখনই বাসা ছেড়ে ঈদের দিন অন্য বাসায় গিয়েছি বলে আমার মনে হয় না। আমি ১৩/ ১৪ বছর বয়সে একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম, মনে আছে আমার বাবা আমি ফিরে আসতেই আমাকে বলেছিলেন ‘মা তুমি বাইরে গেছো? মানুষজন যদি এসে দেখে বাড়ির মেয়ে নাই কি বলবে বলো!’ আমার বাবার সেই ছি ছি আমার মাথায় এমন করে গেঁথে গিয়েছিল যে আমার ইচ্ছাটাই মরে গেছে”। শারমিনা মজার একটি কথা বলছিলেন। তিনি বলেন “এখন তো অনার্স শেষ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ। যতোদিন পড়েছি কোনদিন বৈশাখে বেড়াতে যেতে চাওয়ায় আমার পরিবারের মানুষজন আমাকে কখনই কিছু বলেননি। এইবারেই একটি মজার কাণ্ড হলো, মা বলে উঠলেন তোমার এইসব বন্ধুদের সাথে টিএসসি যেতে হবে কেন? তোমার না পড়াশুনা শেষ! তাহলে এদের সাথে ঘুরতে হবে কেন? বাসায় থাকো। আমি আমার মাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম”।
নারীর অভিজ্ঞতায় উৎসবের নানান আমেজ নারীকে তার শরীর, তার সাজসজ্জা, তার ইমেজ, তার কথা এমনকি তার আন্তরিকতা দিয়ে বহন করতে হয়। ২৫ বছরের মধ্যবিত্ত নারী জানান ‘আমার বাবা বিয়ের কোন দাওয়াতে গেলে আমার পোশাক আশাক নিয়ে খুবই খুঁতখুঁতে হয়ে যান। বাবার মূল বিষয় থাকে তার যে অনেক টাকা সেটা আমার সাজসজ্জায় ফুটিয়ে তোলা..আর আমি কখনই জীবনে টাকা দেখানোর কোন হ্যাঙ্গার হতে চাইনি’। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করছেন সে নারী জানান “উৎসব বিশেষত বিয়ে বাড়ি এমন একটা জায়গা যখন অন্দরমহল বিশেষত যেসব পরিবার রণশীল তাদের মেয়েদেরকেও দেখা যায়। আমার কর্পোরেট বরের জন্য এই বিয়ে বাড়িতে আমার সাজসজ্জা কেমন হচ্ছে সেটা খুবই প্রেস্টিজিয়াস বিষয়..খেয়াল করে দেখবেন এখন টিভিতেও এমন বিজ্ঞাপন দেখায়..যে বিয়ের অনুষ্ঠানের আগে বাড়তি ওজন ঝেড়ে ফেলা হচ্ছে…”।
তারমানে হলো নানান উৎসবে নারী আমাকে আমার সাজসজ্জায় উৎসবের আমেজ ধরে রাখতে হবে। সেটা আপনি বসন্তের আগমন বলেন, একুশের কালো সাদা শাড়ি বলেন, কিংবা বৈশাখের লাল পাড়। কিন্তু বৈশাখের লাল পাড়ের শাড়ি পরিহিতা নারী যেমন বৈশাখকে বহন করে তেমনি পান্তা ভাত খাওয়াও এই শহুরে সংস্কৃতিতে বৈশাখের আগমনের কথাই বলতে থাকে। নারীকে উৎসবের দায় নিতে হয়, সেটা আনন্দময় করবার জন্য যেমন তেমনি উপস্থিতিতে যেন উৎসব যেন নিরানন্দময় না হয় সে দায়ও নারীর। সেই একই সুত্রে উৎসবের মাঝে নারীর নিরাপত্তা বজায় রাখবার দায়ও নারীর নিজের। বাঁধনের মতো নিউ ইয়ারে শাড়ি পড়লে তাই তার নিরাপত্তা নাও থাকতে পারে, আমার মায়ের মতো বিধবা হলে কুলণা বলে উৎসবের আমেজ নষ্টও হতে পারে। আবার আপনি যদি নারী হোন তাহলে উৎসবের আদর্শ মোতাবেক আপনার সুনিপূণ সাজসজ্জা আপনার অভিভাবক মূলত আপনার দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত পুরুষের স্বচ্ছলতা, মতা এমনকি আন্তরিকতার প্রতীকও হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ উৎসবের মধ্যবিত্ত নারী অনেক সময় সেই শোকেসের পুতুল নারী যাদের রঙ, চুল, কি কি নাড়াতে পারে, কেমন কেমন নাচতে পারে সে নিয়ে আমাদের মাথাব্যথার সীমানা থাকে না।
ছবি গুলো শিল্পী সত্যজিৎ রাজন‘র আঁকা
৫
কথা শুরু করেছিলাম আমার নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে। আমার মায়ের বিয়ে বাড়িতে আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগেকার এক “কুফা” হয়ে উঠার ঘটনা দিয়ে। উৎসবের নানান আয়োজনে কিছু মানুষ থাকে যারা কিনা উৎসবের হর্তাকর্তা, যাদের হুকুমে কোরবানীর গরুটা কেনা হয়, পূজার খরচটা নির্ধারিত হয়, কাকে কাকে শাড়ি কিনে দেয়া হবে আর কাকে কাকে নয় এসব নির্ধারিত হয়, এমনকি দাওয়াতের তালিকা যাদের ছাড়া কখনই ঠিক হয় না। নারী অভিজ্ঞতায় এই নির্ধারক বেশিরভাগ সময়ে আমাদের এই পুরুষপ্রধান সমাজে, পুরুষালী ভাবনার সমাজে “পুরুষ” এজেন্ট হিসেবে হয়ে থাকেন। কর্তার সংসারের কর্তারাই উৎসবের কর্তার চেহারা নেন। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা এখনকার আর্থসামাজিক পরিসরে নারীর জীবনেও হয়তো নানান পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু এখনও উৎসবের কর্তা মধ্যবিত্তের নারী তার নিজ স্বত্তায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়ে উঠতে পারেননি। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় নারীর নানান সামাজিক পরিচয়, তার সম্পর্ক, তার সৌন্দর্য্য, তার কর্মপটুতা ইত্যাদি নানান কিছু দিয়ে আসলে বিভিন্ন সামাজিক উৎসবে নারীকে তার উৎসবে অংশ নেয়ার সমতা প্রমাণের মাপঝোকের মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত যেতে হয়। সমাজ নারীকে মাপতে থাকে বলেই উৎসবের নেতিবাচক অঘটনের দায় নারীকে নিতে হয়, যেমন আমার মায়ের বিধবা পরিচয়। তেমনি ২০০০ সনের বাঁধনের শাড়ি পরিহিতা বয়কাটচুলের বাহারের ভার আমাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দেয় আমাদের জন্য উৎসবের পরিসর কোন বিশেষ আনন্দের কল্পনার জগত আনতে পারে না। উৎসবের দায় আমাদের, কিন্তু উৎসব কখনই আমাদের না।
আশাবাদী একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে আজকের লেখাটা শেষ করতে চাই। আমার পরিচিত বন্ধু নারীর বয়স ২৯ বছর। চেনা পরিচিতির ভিত্তিতে তারই পছন্দের এক পুরুষের সাথে তার বিয়ে ঠিক হলো। মধ্যবিত্ত আমার সে নারী বন্ধু ঠিক তার বাগদানের আগের দিন জানতে পারলেন হবু শ্বশুড়বাড়ি থেকে তারজন্য একটা শর্ত রাখা হয়েছে। তার হবু শ্বশুড় জানালেন যেহেতু হবু বউয়ের মা এবং বড়ো বোন দুজনই অল্পবয়সে বিধবা হয়েছেন তাই তিনি চান মেয়েটি যেন তার চাকুরী ছেড়ে ঢাকার বাইরে শ্বশুড়বাড়ীতে থাকতে চলে আসেন। কারণ তারা মনে করেন এই দুই নারীর সাথে থাকলে তাদের হবু বউয়ের কুফা লাগবে এবং তাদের ছেলেও মেয়েটির বাবা, বোনের বরের মতো করে আগেভাগে মারা পড়বে। বাগদানের ঠিক আগের রাতে নারী এই ঘটনাটা জানতে পেরে তার পছন্দের পুরুষকে বিয়ে না করার স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেন এবং তিনি বাগদান ভেঙ্গে দেন।
আমার এই বন্ধু নারীর ঘটনার বরাতে আমি কেবল একটা সাহস আর জোরের কথাই বলতে চাই। উৎসবের আয়োজনে, উৎসবে অংশ নেয়ার এমনকি প্রাণখুলে আনন্দিত হবো কি হবো না সে অনুমতি আমরা নারীরা আর কতোদিন পুরুষালী ক্ষমতার সমাজের মাপঝোকের হাতে রেখে দিবো? আর কতোদিন অন্তরে নয় বরং কেবলই পোশাকে, কেবলই স্বীকৃতিহীন দ্বায়িত্বের ভারে উৎসবের দায় বহন করে বেড়াবো?