পুরনো গদ্যের বাক্স থেকে ৪ টি খুঁটি… । তালাশ তালুকদার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩, ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ, | ৩৫৪০ বার পঠিত
কবিতার অর্থ বোঝা কিংবা না বোঝা নিয়ে…
নকটার্ন! আপাত-দুরূহ এই ইংরেজি শব্দটির দুটি অর্থ রয়েছে। একটি হচ্ছে বিশেষ পাশ্চাত্য সুরের কম্পোজিশন-যা ঘুম ঘুম সুরেলা মায়া ছড়িয়ে দেয়। অন্য অর্থেঃ রাত্রি-শিল্প- A work of art dealing with night (Webster); যা সরলভাবে পকেট অক্সফোর্ড অভিধানে জানানো হয়েছে Picture of night Scene’।
কবিতায় যদি কোন জগতের অস্তিত্ব থেকে থাকে তা হলো অনুভবের জগৎ। আর অনুভব তখনই হয় যখন শ্রুতি আর অবলোকনের ভেতর শব্দ অপরিমেয় শরীরি শক্তিরুপে অবস্থান করে। শব্দই তাকে উন্মুক্ত করে আর এমনই দ্রবীভূত এক আত্মিক যেখান থেকে ভাষাকে ডাবিং করিয়ে বস্তু সম্পর্কে পাঠককে উপলব্ধি করায়। কবিতা তো সেই অনুভব যেখানে জল দেখা গেলেও তার মাঝে অবস্থিত হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের দেখা পাওয়া ভার! তবু ঐ জলেতে তাদের বাস। কবিতা এমনই। অনেকটা বাতাসের মতো দেখা যায় না তবু পাতা নড়াতে কিংবা শরীরে কোন অদৃশ্যের স্পর্শ পেলে অনুভব করা যায় মাত্র। কিন্তু সমূহ ব্যাখ্যা করা আদৌ যায় কি, বাতাসের? ব্যাখ্যা করতে গেলে দেখবেন হিমশিম খাচ্ছেন, শেষমেষ বলতে বাধ্যই হবেন, দেখুন ভাই, আপনি বরং খালি গায়ে ব্রীজের উপর দিয়ে একটু হেঁটে আসুন, আপনি ঠিক বুঝে যাবেন। কবিতা ঠিক এরকমই অনুভবের সঙ্গীতে মিশে থাকে। আপনাআপনি তাকে ব্যাখ্যা করার উপযুক্ত ভাষা পাওয়া মুশকিল।
পিকাসোর চিত্র প্রদর্শনীতে একজন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, ‘আপনার ছবি তো বুঝি না, একটু বুঝিয়ে দিন। পিকাসো উত্তর দিয়োছিলেন, ‘আপনি কি পাখির গান বোঝেন?’ আসলে কবিতা মানে বাতলে দেবে না পথ, ‘সে শুধু হয়ে উঠতে থাকবে’ আমার কাছে অন্ততঃ ম্যাকলিশের অমন উক্তিই শেষ পর্যন্ত কবিতার বিচারে তুল্য। তবু কবিতার কোন সংজ্ঞা থাকতে নেই। ‘তবু’ নামক কোন সমালোচক এমন শব্দ উচ্চারণ করলে বলতে পারি ‘বরং তুমিই লেখোনাকো কবিতা’। কেননা এ সত্ত্বার অভিব্যক্তি কোনো একটি নির্দিষ্ট ধরনে হয় না, নানা বিকল্পের মাঝে বিচ্ছুরিত তার নির্মিত প্রকরণ, বরং তুমিই লেখোনাকো একটি কবিতার প্রতি মনোযোগী হলেই এর সম্ভাব্য মীমাংসার দিকে যাত্রা হতে পারে আমাদের।
এক্ষেত্রে শুধু শঙ্খঘোষের একটি কবিতা দিয়েই উত্তরের ইতি টানব আমি।
‘যে লেখে সে কিছুই বোঝেনা
যে বোঝে সে কিছুই লেখেনা
দু-জনের দেখা হয় মাঝে মাঝে ছাদের কিনারে
ঝাঁপ দেবে কিনা ভাবে অর্থহীনতার পরপারে!’
বর্তমান সময়ের সমালোচনা সাহিত্য…
সমকালীন ক্ষমতাবানদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে গুণগান। গ্রন্থালোচনার নামে মুদ্রণ পারিপাট্য, প্রচ্ছদের সৌকর্য, দামের যৌক্তিকতা বিষয় অগ্রগন্য। সমালোচনার সারবস্তু না জেনে সমালোচনার অলিন্দে প্রবেশ। নিজের জায়গা হারানোর ভয়ে দলবদ্ধভাবে সম্ভাবনাময় কবিকে মানসিকভাবে আহত করা। ইয়েটস ‘দ্য স্কলার’ জীবনানন্দ দাশ ‘সমারূহ’ কবিতায় বিরূপ সমালোচকদের অগ্রাহ্য করেছেন। আবার হুগোও নিন্দাভাষ্যকারী সমালোকচকদের বলেছিলেন- কিল দ্য ডগ, হু ইজ এ রিভিউয়ার।
এ যুগে এসে কেউ মিল্টনকে বড় কবি বলতে ইতস্তত করবেন কিনা সন্দেহে। হয়তো বা ডক্টর জনসনের সময়েই মিলটন গুরুত্ব হারাচ্ছিলেন, তাই বলে ডক্টর জনসন মিলটনকে যে দন্ডাজ্ঞা দিয়েছিলেন সেটা কি বস্তুনিষ্ট সমালোচনা বলা যেতে পারে? কীটস-এর মৃত্যুর কারণও নাকি সমালোচকরা। সে-সময়কার প্রভাবশালী সাহিত্য পত্রিকা ব্যাকউড ম্যাগাজিন কবিকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে চলেছিল। ভলতেয়ার তাঁর Philosophical Dictionary- তে দান্তে সম্বন্ধে যা-কিছু বলেছেন সেটা কি দান্তের সাহিত্য পড়তে আর বুঝতে আমাদের সহায়ক হবে? বুদ্ধদেব বসু-র মতো সুবেদী সমালোচকও সর্বক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষা করতে পারেননি। এমি লওয়েল দি ওয়েস্ট ল্যান্ড সম্বন্ধে বলেছিলেন a piece of tripe- জঞ্জালমাত্র। মিডলটন মারে এটাকে জঞ্জালই ভাবতেন। রোমান্টিক কবি শেলি বলেছিলেন একজন চোর যেমন অভাবে পড়ে চৌকিদার হয় তেমনি একজন ব্যর্থ লেখক হয়ে যায় সমালোচক। মনে নেই কোথায় পড়েছিলাম যে গ্যয়টে উপহাস করে বলেছিলেন- kill that dog, he is a reviewer.
তারপরও বলি, সমালোচনা একদিকে যেমন বকাবকি দিয়ে, ফোপরদালালি বা উষ্মা বা রক্তচক্ষু শাসানি দিয়ে কবি-লেখককে ডুবিয়ে দেয় তেমনি ডুবে যাওয়া লেখককে উদ্ধারও করে। তেমন সমালোচকরা সাধুবাদ পেতেই পারেন।
কবিদের সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে একটা বিতর্ক বরাবরই আছে
উত্তর; সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে বিতর্ক এইটা অহেতুকই মনে হয় আমার কাছে। গ্রামে একজন কৃষক যদি পাচুন, কাচি, জোয়াল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে তখন কি সে দায়বদ্ধাতার কথা মাথায় রেখে কাজ করে? কিংবা একজন সেটেলম্যান্টের অফিসার যখন অফিস করে সে কি তখন দায়বদ্ধতার কথা মাথায় রেখে কাজ করে নাকি অফিসের ডেকোরোমের ভেতর কাজ করে? তখন কি তারা সমাজের উপকার করছে বলে কি সেগুলো করে? তা তো নয়, সে একটা সিস্টেমের ভেতর দিয়ে এগোয়। সে যা করছে তা জীবনধারণের জন্যই করছে। কিন্তু কাজগুলো অটোমেটিকভাবে সমাজের উপকারে লাগে। যে ভাল লোক সে কারোর উপকার করতে না পারুক অন্তত অপকার তো করেনা। এই অপকার না করতে পারাও সমাজের ভাল কাজ। কেননা তার দ্বারা অন্তত সমাজ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেনা। দেখবেন, এটাও কিন্তু আপনার অজানাতেই সমাজের দায়বদ্ধতার ভেতরে পড়ে যাচ্ছে। কীটস-এর কথা যদি বলি, তিনি কিন্তু স্যোশাল কমিটমেন্টর কথা বলেননি, কিন্তু তার কবিতা কি সমাজের কোনও অপকার করেছে? একজন কবি তার নিজের মুক্তির কথা লিখছেন, তা পাঠক্রমের অন্যেরও মুক্তি অনুভব করছে। কবি তো আর দেবী স্বরসতীর সঙ্গে দায়বদ্ধতার চুক্তি করে লিখতে আসছেন না। তবে কবির দায়বদ্ধতা থাকে লেখার কাছে, নিজের কাছে।
গৌতম বুদ্ধ গৃহত্যাগ করার পর একবার গৃহে এসেছিলেন। তখন তার স্ত্রী তার পুত্র রাহুলকে বলেছিলেন বুদ্ধের অনেক সম্পদ আছে, তাঁর কাছ থেকে তা চেয়ে নিতে। সেই মতো রাহুল বুদ্ধের কাছে থেকে সম্পদ চাইলে বুদ্ধ বলেছিলেন আত্মদীপ ভব। অর্থ্যাৎ, নিজেকে প্রজ্জ্বলিত করো। প্রকৃত কবি-লেখকরাও নিজেই নিজেকে প্রজ্জ্বলিত করতে করে রাখে।
তালাশ তালুকদার
কবি
০১৭১০১৮৬৯৮২ / talash.talukder@yahoo.com