শোয়েব শাদাবের কবিতা: রক্তের গভীরে ঘাইমারা বিষধর শিঙের বিবৃতি । সুস্মিতা চক্রবর্তী
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ ডিসেম্বর ২০১৩, ৫:০১ পূর্বাহ্ণ, | ৪৪৩৯ বার পঠিত
বুক যেন চিতাকাঠ, রাত্রিদিন জ্বলে আর জ্বলে
চোখের বরফ ঢেলে করাবো শীতল কতো আর
আকাশ সেও তো হয় কেঁদে কেঁদে নিঃশেষে নির্জল।
( চিতাকাঠ; পৃষ্ঠা ১১)
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, বালুচরের সম্পাদক যখন জানালেন যে, তাঁরা এবার আশিক দশকের কবিদের নিয়ে কাজ করতে যাচ্ছেন এবং আমাকে শোয়েব শাদাবের ‘অশেষ প্রস্তর যুগ’ বইটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে, তখন আমি একজন কৌতুহলী পাঠক হিসেবে শাদাবের কবিতা পড়ে তাঁকে বোঝার চেষ্টা করার সুযোগ নিয়েছি মাত্র। কিন্তু সেই সুযোগ আমার জন্য স্বস্তির হয়নি। শাদাবের কবিতা আমাকে অস্বস্তিকর উপলব্ধির দিকে ঠেলে দিয়েছে বারবার। আশির কবিদের নিয়ে প্রচলিত বিশ্বাসগুচ্ছের বিপরীতে দাঁড়ানোর ঝুঁকি নিতে হয়েছে। তাজা জীবন আর মলিন মৃত্যুর দোলাচলে দুলতে থাকার বিবরণ এই লেখা।
আশির দশকে এক দল সাহিত্যকর্মীর পদচারণা ঘটেছিল এই বঙ্গে যাঁরা সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিকে আপাদমস্তক ধারণ করে নিরন্তর কাব্যচর্চার মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবনকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। যুগের অসুখকে তাঁরা টের পেয়েছিলেন, এবং তথাপি, যুগ-সমাজের ভয়ঙ্কর চাপের মুখে মুষড়ে পড়েছিলেন। তাই, আশির দশকের কবিদের মধ্যে অনেককেই দেখা যায়, সমাজ-সংসার-মানুষ থেকে পলায়নরত; অনেকে যুগের সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় আতিবাহিত করছেন গভীর নির্জন দ্বীপে বন্দী জীবন। কবি শোয়েব শাদাব এদেরই একজন। একদার ‘Hat’ আর ‘Cigar’-কাঁপানো কবি আজ তাঁর গ্রামের বাড়িতে নির্জনে সময় পাড়ি দিচ্ছেন কবিতা থেকে অবসর নিয়ে। সেই কবেই তিনি তাঁর সময়কে চিহ্নিত করেছেন ‘অশেষ প্রস্তর যুগ’ বলে। আজ যখন পৃথিবীর সবচাইতে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র একের পর এক দুর্বল রাষ্ট্রের মানুষকে সদর্প ঘোষণাসহ পাঠিয়ে দিচ্ছে ‘প্রস্তর যুগে’ – এই বিভৎস সময়কে কবি কোন নামে ডাকতেন?
শোয়েব শাদাবের মতো তরুণ কবিরা বাংলা কবিতার গায়ে পরিয়েছিলেন তরুণ পিরান। অশেষ প্রস্তর যুগ গ্রন্থটির শুরুতে গা-ণ্ডীব-সম্পাদক তপন বড়ুয়ার বয়ান থেকে এ বিষযে দু’চার লাইন হাজির করা যাক:
সংবেদ, অনিন্দ, একবিংশ ঘুরে আমরা তখন গা-ণ্ডীব করার কথা ভাবছি – নতুন কিছু করার উন্মাদনায়। নতুন কবিতার কথা বলতে গিয়ে ওরা সে সময় সিদ্ধান্ত নেয় প্রচলিত পদ্য-চর্চা ত্যাগের। কারণ তখন ওপারে শক্তি-সুনীল আর এপারে রাহমান-মাহমুদ এর নেতৃত্বে বাঙালী কবিকুল পদ্য রসে পুরো বাঙলা ভাসিয়ে দিচ্ছিলো। বিনয়-উৎপলের ক্ষীণ চেষ্টা ছাড়া পূর্বসূরীদের মধ্যে কোনো ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছিলো না। এভাবেই গাণ্ডীব এবং শাদাবের যাত্রা শুরু। (অশেষ প্রস্তর যুগ; পৃষ্ঠা ৭)
তপন বড়ুয়ার বরাতেই জানা যায়, কবির অসুস্থতার কথা ও সেকারণে নিজের বইয়ের পান্ডুলিপি তৈরী করতে সমর্থ না হওয়ার কথা, গ্রামের বাড়ীতে তাঁর শেকল-বন্দী হয়ে কাটানোর কথা, আর কবিতার বেলাভূমিতে কী কী বিষয়ে কবির আগ্রহ ছিল সেসব কথা। তিনি উল্লেখ করেছেন শোয়েব শাদাব তাঁর কবিতায় বেছে নিয়েছেন আদিম চিত্রকলা, গুহাচিত্র, আদিম মানব সমাজ, বাংলা লোকগীতি ইত্যাদি বিষয়। শাদাবের ত্রিশটি কবিতা আছে অশেষ প্রস্তর যুগ বইটাতে। প্রায় সবগুলি কবিতাতেই অনুসঙ্গ হিসাবে এসেছে আদিম মানুষের জীবনচিত্র – কখনো শিকারের মধ্য দিয়ে, কখনো সিংহের থাবায়, কখনো বর্শার সুতীক্ষè ছোবলে, কখনো সিংহের কেশরের উদ্দামতায়। এসেছে টোটেম-ট্যাবু, এস্কিমোদের অনুসঙ্গ। কবি তার মনোজগতে প্রাচীন মানুষের জীবিকা-জীবন ও তাদের প্রাকৃতিক বাসভূমি-সংগ্রাম-নগ্নতা ও শিকারের পরিস্থিতিকে স্থান দিয়েছেন ব্যাপক মাত্রায় যার প্রকাশ ঘটেছে অধিকাংশ কবিতা জুড়ে। এ সকল বিচারে শোয়েব শাদাবের কবিতার পুস্তকের নাম নির্বাচন যথার্থই হয়েছে।
লক্ষ না-করে উপায় থাকে না যে, নির্মম সমাজবাস্তবতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, পুঁজিবাদের করাল আগ্রাসন, মানুষের নৈতিক অবক্ষয় – এসব জঞ্জালে ঠাসা সমাজ-পাটাতনে বসত করতে করতে কবি শাদাব ছিলেন বিমূঢ়, হতাশ। জাগতিক জীবনের সমস্ত অন্ধকারকে পাশে রেখে কবি হয়েছিলেন ধ্যানস্থ। চরম সামাজিক অসাম্যের মাঝে পথ হাঁটতে হাঁটতে সমাজ-অসারতার পাঁকে পড়ে নিজেই খুন হয়ে গেছেন শাদাব; বিকলাঙ্গ মানুষের মত ক্রমেই গড়িয়ে গড়িয়ে রাস্তা চলেছেন – এরকম অনুসিদ্ধান্ত করার পরিস্থিতি আছে তাঁর গ্রন্থে। তারই সুর অনুরনিত হয় তাঁর কবিতায়:
গড়িয়ে গড়িয়ে যাই
বুকে পিঠে হাঁটা একজন পা-কাটা মানুষ
নিমখুন
যেতে যেতে ঘুরে দেখি কতোখানি যাওয়া হলো সঠিক বেঠিক
বুকে পিঠে হাঁটা যেমন একজন পা-কাটা মানুষ
নিমখুন
(আবহমান; পৃষ্ঠা ১০)কিংবা প্রথম কবিতা ‘স্বগতোক্তি’তেও শোনা যায় এরকম উপলব্ধি:
নষ্ট দ্রাঘিমায় এসে গেছি হে দেবদূত!
…
প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকূপে পড়ে থাকি
বিকল জšত্তর মতো পঙ্গুতায়Ñ আর
স্তব্ধ পরাধীনতায়।
(স্বগতোক্তি; পৃষ্ঠা ৯)
কবি তাঁর সময়কালে দেখেছেন কীভাবে তাঁর আশেপাশের মানুষজন খ্যাতির মোহে মিডিয়া আর বাজারের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছে অহরহ। এসব দেখে শাদাব ব্যাথিত হয়েছেন; ক্লান্ত হয়েছেন কখনো কখনো। একরাশ না-পাওয়া নিয়ে কবি অপেক্ষার কাল গুণেছেন সুদিনের প্রত্যাশায়; লোভের ফাঁদে কোথাও পা বাড়াননি। তাই শোনা যায় তার কবিতায়:
স্ফটিক জলের নিচে যাইনি তো তেড়ে- ছদ্মবেশে
সোনালী মাছের লোভে যাইনি কখনও
মরুভূমি পিপাসায় কাতর থেকেও
নদীকেই গিলবো বলে বাড়াইনি মুখ।
(চিতাকাঠ; পৃষ্ঠা-১১)
যুগ-যন্ত্রনায় ধ্বস্ত, পরিশ্রান্ত কবি আশ্রয় খুঁজেছেন প্রকৃতির কাছে। উত্তপ্ত মরুতে হাঁটতে হাঁটতে তিনি পিপাসার্ত হয়েছেন; বৃষ্টির শীতল জলে শান্ত হতে চেয়েছেন বার বার। শান্তির আশ্রয়ের জন্যে কবির হাহাকার তাঁর কবিতা জুড়ে:
ঊষর বালিতে হেঁটে দিনে দিনে খুন হলো পা
মেঘ, বৃষ্টি হবে কবে? কবে তুমি উঠবে রামধনু?
(চিতাকাঠ; পৃষ্ঠা ১১)
কিংবা
জন্ম-জন্মান্তরের মরুময় পথ
তুমি ঘর দেবে কবে ছায়াময় শীতল আশ্রয়?
(চিতাকাঠ, পৃষ্ঠা ১১)
শোয়েব শাদাব তাঁর জগতকে অবলোকন করেছেন ভয়ঙ্কর পৈশাচিকতার মধ্যে। কোথাও কোনো আশার আলো তিনি দেখতে পাননি তাই পাঠকের জন্যও তাঁর কোনো আলোর নিশানা নেই। রূঢ় বাস্তবতা থেকে নিজেকে তিনি আড়াল করতে চেয়েছেন, মৃত্যুর কাছে বার বার নিজেকে সমর্পন করেছেন। নেশার স্বপ্নময় ভুবনে তিনি আবিষ্ট থেকেছেন। ‘হেমলক’ কবিতায় তারই কথা শোনা যায়:
অপেক্ষা অপেক্ষা তবে, যাদুকরী আফিমের চাওয়া?
(হেমলক; পৃষ্ঠা ৪১)কিংবা ‘দেয়ালছবি’ কবিতায়:
দেয়ালে ঝুলছে ছবি।
অথচ ছিলাম সমুদ্রের নীল শৈবালে
অস্ফুট অমাময়ী পপির স্বপ্নে।
(দেয়ালছবি; পৃষ্ঠা ২৭)
নারীর প্রতি শাদাব বারবার হানেন স্থূল আঘাত। হয়তোবা নারীসঙ্গের অভিজ্ঞতাই তাঁর তিক্ত। নারীজাতির প্রতি গভীরতর বিদ্বেষ তার কবিতায় প্রায়শই ধরা পড়েছে। ঘৃণায় বুঁদ হয়ে যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই তিনি নারীকে আক্রমণ করেছেন। তাঁর পুরুষালী সত্তা প্রবল হয়ে উঠেছে কবিতার পরতে পরতে। এই সঙ্কীর্ণ বোধ থেকে তিনি নিজেকে শেষপর্যন্ত রক্ষা করতে পারেননি। সম্ভবত এটাও সেই যুগ-সময়েরই বৈশিষ্ট্য যা থেকে কবির মুক্তি ঘটেনি। সেজন্য অনেক পুরুষ-কবির মত তিনিও নারীর কাঁধে দোষ চাপিয়ে তাঁর কাব্য-বন্দুক তাক করেছেন:
হাড়ে হাড়ে মজ্জায় শীতের কী কাঁপুনি
চুমুকে রক্ত খায় নারীরূপী বাঘিনীস্নানাগারে রাতভর স্নান করে ডাকিনী
জলের শব্দ শুনে আমি কিগো ডাকিনি?
(অযোনিজ; পৃষ্ঠা ২৫)
এভাবে নারীকে কখনো ‘বাঘিনী’ কখনো ‘ডাকিনী’ কখনো ‘ভালুক’ বলে আশির দশকের উজ্জ্বল তরূণ কবি নারীর প্রতি যে অশ্রদ্ধা ও তীব্র ঘৃণা দেখিয়েছেন, এ যুগের কবিদের মধ্যেও তার কমতি নেই। উদাহরণ হিসেবে নব্বইয়ের দশকের একজন কবির নারীবিষয়ক উপলব্ধির পঙ্ক্তি:
এই নাও,
এবার আমাকে খাও,ডাকিনী পাথর,
পদতলে
পড়ে আছে বন্ধুদের রোগা হাড়গোর
(নিবেদন;পৃষ্ঠা ৪২, উটপাখি, ৪র্থ বর্ষ, ৭ম সংখ্যা)
কিংবা
ভয়াল বাতাসে
ডাকিনীর চুল ওড়ে
রাত্রির প্রান্তরে
(রাত্রি-ঝড়ের গান; পৃষ্ঠা ৪৩, উটপাখি, ৪র্থ বর্ষ, ৭ম সংখ্যা)
এভাবে নারীকে ‘বাঘিনী’ ‘ডাকিনী’ বলে অনেক কবিই নারীদের প্রতি তাদের বিষোদগার করেছেন। নারীর প্রতি পুরুষ-কবিদের এ অবস্থান প্রাচীন সময় থেকে শুরু করে আজো শক্তিমান। জানা কথা, বাংলা কবিতা এই গোটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন নয়। যেখানে সমাজের সর্বত্রই নারীকে দেখা হয় পুরুষের অধস্তন আর ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ হিসাবে, সেখানে কবি-পুরুষদের অনেকেই তার ব্যতিক্রম নন – এটা পরিস্কার।
আমাদের ক্ষমতাধর পুরুষ কবিরা নারীকে হয় নিছক যৌনব¯ত্তরূপে বন্দনা করেছেন, নয়ত নারীকে তারা দেখিয়েছেন নরখাদক হিসেবে। শাদাব এই দ্বিবিধ দর্শনেই পারঙ্গম। নারীকে ‘বাঘিনী’ ‘ডাকিনী’ বলেই তিনি খ্যান্ত হন না – রমনলিপ্সা তাঁকে অস্থির করে রাখে। বাব বার যৌন কামনায় তিনি উদ্দীপিত হন; রক্তে গুমরে ওঠে এ তৃষ্ণা। প্রথম কবিতা ‘স্বগতোক্তি’তেই কবিকে অনেকখানি বোঝা যায় যখন তিনি বলেন: “রক্তের গভীরে যেন ঘাই মারে বিষধর শিং!” “বিকল জন্ত্তুর মতো” তিনি নিজেকে নিয়ে কাটাছেঁড়া করেন। তাঁর কামনা তাঁকে অহরহ পোড়াতে থাকে। তাঁর বয়ানে শোনা যাক:
উরুর আগুন চেপে যৌবন বল্লম
কেঁপে উঠি মধ্যরাতে-
স্বপ্নের ডানার মতো নেমে আসে সংখ্যাহীন সিল্কের বালিশ
হাতের কলম দড়ি ছিঁড়ে
সাপ হয়ে যায়
সাপ, ময়ুর।
(স্বগোতোক্তি; পৃষ্ঠা ৯)
এভাবে শরীরের অচরিতার্থ কামনাকে চাগিয়ে রেখে তিনি শেষপর্যন্ত ‘পূর্ণাঙ্গ পুরুষ’-ই থেকে যান:
অতঃপর,
ফুলের কঙ্কাল থেকে নিঃসৃত সৌরভ
তরল মৃত্যুকে পান করে
বিষাদে বিনাশে হই পূর্ণাঙ্গ পুরুষ।
(স্বগতোক্তি; পৃষ্ঠা-৯)
নারীজাতির প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গী তাকে একরকম সঙ্কীর্ণই করে রাখে। সমগ্র নারীকে ঘিরে তাঁর ঢালাও তিক্ততার উষ্মা প্রকাশ ঘটে:
অদ্ভুত খোলস খুলে নারী শুধু ঢালে উষ্ণতাই
ভেনাসের দীপ্ত স্তন ইচ্ছার আবেগে ভারানত
তৃষ্ণার্ত প্রেমিক পোড়ে পান্ডুর দহনে বিপরীত (চিতাকাঠ; পৃষ্ঠা ১১)
একপর্যায়ে বুভুক্ষু কবি মৃত্যুকে ডেকেছেন নারীরূপে আসার জন্য যেন তিনি অনন্ত রমণে মিশে যেতে পারেন তার মাংসে-মজ্জায়:
ওগো মৃত্যু! মানবীর রূপ ধরে এসো দেবী, ডেকে
নাও শয্যায় তোমার…অনন্ত রমণে আমি গলে
মিশে যাবো অনন্ত তোমার মাংসে মজ্জায়।
(দৃশ্যভুক; পৃষ্ঠা ২৪)
শোয়েব শাদাবের অনেক কবিতাতেই প্রস্তর যুগের নানান অনুসঙ্গ-উপাদান এসেছে ঘুরেফিরে। কবি তাঁর যুগকে বর্বর যুগ হিসেবেই নির্দেশ করেছেন। এক্ষেত্রেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়। ‘আধুনিক’ যুগের শ্রেয়ত্বের প্রশ্নাতীত বিবেচনাবোধ থেকেই কিন্তু তিনি তাঁর সময় ও মানুষকে ‘প্রস্তর যুগের’ পশ্চাৎপদতা দিয়ে শনাক্ত করেছেন। এবং প্রস্তর যুগের রমনী ছাড়া আর কিছু গভীরভাবে তাঁকে টানেনি। ‘স্বপ্নময়’ রমনীর খোঁজ করেছেন ‘অশেষ প্রস্তর যুগ’ কবিতাটাতে হন্যে হয়ে। তাঁকে তাই বলতে শুনি:
সবই আছে ঠিকঠাক প্রস্তরীয় যুগেও যেমন
শুধু সেই পৃথিবীর স্বপ্নময় মানবী কোথায়
অনার্য দর্পিত স্তন যার
ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব।
(অশেষ প্রস্তর যুগ; পৃষ্ঠা ৪৫)
কবি এই কবিতায় মহান মানবীর অভাবকে প্রত্যক্ষ করলেও যৌনবস্তু হিসেবে নারীদেহের তীক্ষ্ণতা কিন্তু তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না। পাহাড়ী নারীর শরীরকে মনে মনে মন্থন করেছেন তিনি এভাবে:
আখের পাতার মতো ধারালো শরীর
দুলিয়ে দুলিয়ে নাচে পাহাড়িয়া নারী
(অশেষ প্রস্তর যুগ; পৃষ্ঠা ৪৪)
আবার একই কবিতাতেই কবি শুঁকেছেন যৌবনের গন্ধ। চলুন শোনা যাক তাঁর কবিতাতে:
বাতাস আনছে বয়ে
ভয়ংকর যৌবনের গন্ধ
ধূপের গন্ধের মতো মর্মভেদী
আর বিষাক্ত বর্বর!
(অশেষ প্রস্তর যুগ; পৃষ্ঠা ৪৫)
ভয়ঙ্কর পৈশাচিকতার মধ্যে শোয়েব শাদাব তার দিন পাড়ি দিয়েছেন। মৃত্যুর কাছে আশ্রয় নিতে চেয়েছেন। জীবন থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। নিজেকে নিঃশেষ করেছেন নেশার রাজ্যে। বাস্তবতার সাথে পাল্লা দিতে না পেরে নিজেকে পরাজিতের দলে ভিড়িয়েছেন। তাঁর কবিতায় দু’একবার পরিতাপের সুরও বেজে উঠেছে:
পাখি, পরাজিত আমি
এই যজ্ঞে।
পরিতাপ নেই?
গর্জে ভারি ভারি হাতিয়ার
আরম্ভ পাথরে
ডানার শব্দ তবু শব্দেও থামে না
(অশেষ প্রস্তর যুগ; পৃষ্ঠা ৪৬)
সমাজজীবন থেকে প্রবল বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সুরে আর করাল শূন্যতায় খাবি খেতে খেতে কবি বিষাদে ম্রিয়মান হয়ে পড়েছেন। তাই একঘেঁয়েমীর মত শোনালেও তাঁর কবিতায় একাধিকবার এসেছে শূন্যতার অগ্নিশিখা। এই আগুনেই তিনি সহস্রবার পুড়েছেন, বিশ্লিষ্ট হয়েছেন আত্মদহনে:
হৃদয়দুহিতা লীন হয়ে আছে মৃত্তিকাতলে
দূর পাহাড়ের প্রাচীন গুহায় কবরেখা-প্রতিলিপি
বাম পাঁজরের শূন্যতা শুধু বিদ্যুৎরেখা জ্বালে।
(কাঠের ঘোড়া; পৃষ্ঠা ১২)
শূন্যতার গহ্বরে ডুবতে ডুবতে, মৃত্যুর গহীন জড়ত্বে বসে থেকেও শাদাব শোনেন প্রাচীন কোনো সম্রাজ্ঞীর কথা। ‘পরস্পর’ কবিতায় তার এ বোধ প্রবল হয়ে ওঠে:
ভূত হয়ে বসে থাকি
যতোক্ষণ চেতনা থাকে, অন্ধকারে।
আমার পা বেয়ে পিঁপড়ে উঠে
চোখের কিনারে বসে।
আমাকে শোনায় কোনো মৃত্যুর গল্প
কিংবা প্রাচীন কোনো সম্রাজ্ঞীর কথা।
(পরস্পর; পৃষ্ঠা ১৩)
বইটার সবশেষের কবিতার কিছুটা ছত্রে কবি খানিক আদিম মানুষের বন্দনা করেছেন। সকল স্তব্ধতার মাঝে তিনি তাঁর সময়ের মানুষকে আদিম মানুষের চাইতে পরাজিত রূপে দেখিয়েছেন:
সূর্যদেবতার শক্তি ছিলো তোমার বাহুতে
রোমশ শরীরে
আজ নিঃশেষ
আজ পরাজয়।
(অশেষ প্রস্তর যুগ; পৃষ্ঠা ৪৭)
শেষপর্যন্ত কবি পরাজয়ের গানই গেয়েছেন কবিতায়। কেননা তাঁর স্বপ্নের কাঙ্খিত শহরের খোঁজ তাঁর জানা ছিল না। আর এ কারণেই শাদাবের জিজ্ঞাসা:
কোথায় নকশাময় চিত্রিত শহর?
রৌদ্রের বন্দর
তা কি সেই অমালোক সমুদ্রের পাড়ে?
(অশেষ প্রস্তর যুগ; পৃষ্ঠা ৪৭)
কবি তাঁর যুগের সমস্ত অসামঞ্জস্যকে ধারণ করেছিলেন অত্যন্ত কুৎসিতভাবে। তাই তাঁর কবিতায় মানুষের অন্ধকার দিকগুলিই উঠে এসেছে বেশী করে। শাদাব তাঁর সময়কে বাক্সবন্দী করেছেন প্রস্তর যুগের রক্তক্ষয়ী খুনোখুনির মধ্যে। তিনি তাঁর চারপাশে কোনো সুন্দরের গান শেনেননি – দেখেননি কোনো মানবিকতার ছবি। তাইতো ঘুরেফিরে শোয়েবের কবিতায় উঠে এসেছে নানা মাত্রায় অসুন্দরের চিত্রলিপি:
সুন্দর, তুমি আটকা পড়েছো বাস্তবতার কলে
বিস্ময় জাগে বিস্ময় জাগে বিস্ময়
আনন্দ তবে নন্দনেরই কাল
(আনন্দ তবে নন্দনেরই কাল; পৃষ্ঠা ১৯)
কবির ‘সুন্দর’ সত্যিই আজো আটকা পড়ে আছে বাস্তবতার খাঁচায়। আমরা এই একুশ শতকে বাস করেও সেই সুন্দরের হদিশ করে চলেছি।
* লেখাটি সম্ভবত ২০০৪ বা ২০০৫ সালে ‘বালুচর’ নামে একটি ছোটকাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। আমাদের কিছু ‘নিষ্পাপ’ সাহিত্যানুরাগী- পাঠকের কাছ থেকে লেখাটির জন্য সেই সময়ে, বলতে গেলে ব্যাপক বাক্যবাণে জর্জরিত হয়েছিলাম! স্বীকার করা দরকার যে, তারা সকলেই পুরুষ ছিলেন! আর ‘নির্দোষ’ আমি তখন, যার-পর-নাই অবাক হয়ে সকল নিন্দা-মন্দ হজম করেছিলাম।এরপর থেকে ঠিক করেছিলাম, আর কোনো কবির কবিতার বই নিয়ে আলোচনাই করব না ! এখনও এর ব্যত্যয় ঘটে নাই!:) আজ অনেক বছর বাদে পুরোনো সেই লেখাটিতে চোখ পড়ল।
বানান, ভাষারীতি ও মতামত লেখকের নিজস্ব