ইথার । হাসান শাহরিয়ার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ ডিসেম্বর ২০১৩, ৫:৪৮ অপরাহ্ণ, | ২৭০৫ বার পঠিত
এমন কি হইতে পারে যেন একদিন এক দুপুরে রোদের তাপ নিতে জানালার পাশে আইসা দাঁড়াইলাম আর তখন আরো – আরো বেশি শীত লাগতে শুরু হইল আমার; যেন আমি উদাম মন বিছাইয়া দিছি শ্রীহট্ট নগরের রাজ্যহারা রাস্তাগুলার ‘পরে আর তাদের একহারা গড়নের সাথে নিজেরে একাকার কইরা দিতে দিতে বুঝতে থাকলাম – আমি পাগল রোদ পোহাইতেছি না আর বরং রোদ পোহাইতেছে আমারে; চুষতে চুষতে; আমার গতরে বিলাইতে বিলাইতে তার রোদক্ষেত্র। তখন কি মনে হইবো কেউ আসতেছে আমার দিকে- কিসব না জানা আকুতি নিয়া – যার সাথে আজতক দেখা হয় নাই আর কথা হয় নাই বেদুঈনের চোখের মত গাঢ় এক ছাদের নিচে বইসা- যেই ছাদ আড়াল কইরা রাখে ভীড় আর রণ-প্রান্তর। সে হাত বাড়াইয়া আমারে একজোড়া চোখ দিবো কিন্তু আমি আবদার করমু একজোড়া জানালা দিতে। সে আমারে একজোড়া জানালা আইনা দিবো আর আমার আকাশটা টুকরা টুকরা হইয়া যাইবো!
আমার নাম ইথার। হাইগেন আলোর তত্ত্ব খাড়া করতে গিয়া এই নামে এক মিথ ছড়াইয়া দিছিলেন। যদিও বিজ্ঞানে কোন মিথ বাঁইচা থাকে না বেশিদিন। নতুন ডেভেলপমেন্টের কাছে পুরান ডেভেলপমেন্টগুলা উইড়া যায়- যেমন উইড়া গেছিলেন হাইগেন। কিন্তু উইড়া যায় নাই তাঁর ইথার। মিথ্যাগুলা, কল্পনাগুলা হইল ইথার- আমাদের চাইরপাশে কি রকম বিস্তৃত হইয়া পইড়া থাকে; ইথার!
আমি এইখানে নতুন আসছি। এই শ্রীহট্ট নগরে। পড়তেছি একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে; ইংরেজি বিভাগে। এইখানে আমার আত্মীয় বলতে আমার বড় ভাই; আপন বড় ভাই। কিন্তু আমরা দুইজন আলাদা থাকি। আমি আম্বরখানার এই হোস্টেলে –যেইটার কোন নাম নাই; যেইটা মূলত একটা সমবায় অফিস। অফিসের একদিকে চমৎকার এই হোস্টেলটা করা হইছে মূলত অফিসে যেইসব নারী এমপ্লয়ী আছে- তাদের থাকার লাইগা। তারা অবশ্য ফ্রি থাকেন না, মাস শেষে ভাড়া গুনতে হয়। ফলে মালিক যে- তাঁর একটা বাড়তি ইনকামও বলা যাইতে পারে এই অফিস। এই মালিক আমার ভাইয়ের রাজনৈতিক মিত্র। কাজেই আমার লাইগা একটা সিঙ্গেল রুমের ব্যবস্থা করতে কোন অসুবিধা হয় নাই তার। যদিও এইখানে একা একা থাকতে আমার মোটেও খারাপ লাগে না- তবুও আমার ইচ্ছা করে আমি ভাইয়ার সাথে গিয়া থাকি। ভাইয়ারে যখন বলি- ‘আমরা দুইজন একসাথে থাকি না ক্যান, ভাইয়া’? ভাইয়ারে খুব উদাসীন দেখায়। আমারে পাল্টা উত্তর দেন- ‘ধুর, আমি সারাদিন কই কই থাকি! তুই একলা একলা কেমনে থাকবি’!
এখন দুপুরটারে আমার সিলেটের ছোট ছোট টিলাগুলার মত মনে হইতেছে। কি যেন হারাইয়া বইসা আছে সে অথবা কি যেন হওয়া হইল না তার। যেমন মনে হয়- শ্রীহট্টের টিলাগুলা পাহাড় হইতে না পাইরা তার খাড়া অহমিকাটারে ব্যপক মিস করে যখন তখন। আমি জানালার পাশে দাঁড়াইয়া আছি আর দেখতেছি কতরকম মানুষ, সিএনজি, টমটম – যারা কত কিছু ভাবতে ভাবতে, করতে করতে রাজ্যহারা রাস্তাগুলা পার হইতেছে; পার হইতেছে আমার চোখের দাওয়া। দেখতে দেখতে আমার চোখের চশমাটা ঝাপসা হইয়া আসে।
ক্লাস ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া হয় না আমার। ক্লাস শেষ হইলে আমার বন্ধুরা কোনদিন শপিং মলে যায়, নাইলে কোন রেস্তোরায়। আমিও যাই। তাদের সাথে ঘুরি, খাই; তারপর ফিইরা আসি এই আস্তানায়। মাঝেমাঝে পাশের রুমের বৃষ্টি আপার সাথে বাজারে যাই; টুকটাক বাজার করি। অবশ্য ভাই আমার ঠিক সময়ে সব ব্যবস্থা কইরা দিয়া যান। খালি আমার অভাবের কথা একটা কল দিয়া জানাইতে হয় তারে। এইভাবে- দিন কাটতেছে আর এই শহরটার সাথে আমি মিইশা যাইতেছি। একটু একটু কইরা বাইড়া উঠতেছি। শুনতেছি মস্তিষ্কের বিভিন্ন বার্তা যেইগুলা আমার শরীরের কোথাও কোন কোন দিন গভীর ঘোর তৈরি করে। আমি অস্থির হইয়া উঠি।
ক্লাসের প্রথম দিন থেইকাই আমার অনেক বন্ধুবান্ধব জইমা যায়। আমি সিলেটের বাইরে থেইকা আসছি – এই কারণে আমারে নিয়া তারা অনেক আগ্রহও দেখায়। তারা সবাই সিলেটি বলে। ভাইয়ার কাছে শুনছিলাম সিলেটের নিজের ভাষা নাগরী’র কথা। এই ভাষার নাকি নিজস্ব বর্ণমালাও আছে। তারা আমারে জিজ্ঞাস্ করে অনেক কথা। আমার খুব ভাল লাগে; জায়গাটারে নতুন মনে হয় না মোটেও। নয়ন নামে একটা ছেলে রেস্তোরায় আইসাই আমার সাথে তুই-তোকারি কইরা কথা শুরু করে। যেন এই মাইয়াটারে সে কতদিন ধইরা চিনে। প্রথমে আমার একটু আন্-ইজি লাগলেও জলদি নিজেরে মানায়া ফেলি। নয়নের বাড়ি জগন্নাথপুর। তার এই ঘটনাটা ভাইয়ারে জানাইতেই ভাইয়া হো হো কইরা হাইসা উঠছিল। আমারে বলছিল- ‘আরে বেকুব, এই পোলাই ত আসল জিগরি দোস্ত। এক্কেবারে দিলখোলা’ !
আব্বা-আম্মার সাথে থাকার সময় রান্না শিখি নাই। এইখানে এইটা একটু একটু শিখতেছি। মাঝে মাঝে ভাইয়া আইসা জিজ্ঞাস্ করেন- ‘অইক্, কি রান্না হইছে’? আমি বরাবরের মত উত্তর দেই- এই ভাজি করছি আর সাথে ডিম। সেই ভাজি করছি আর সাথে ডিম। মাংস আর মাছ রান্নাটা এখনো শিখতে পারি নাই। তাই আপাতত ভাজি দিয়াই কাজ চালাইতেছি। আমার ভাইয়ার অথবা বৃষ্টি আপাদের এইগুলা নিয়া কোন মায়া নাই। ভাইয়া মাঝে মাঝে আইসা একটু গম্ভীর হইয়া আমারে শুনাইয়া দেন- ‘নিজের কাজ যে নিজে নিজে শিখতে পারে না, তার লাইগা আমার কোন ভালবাসা নাই!’
আমার ভাইয়া ভবঘুরে না। তার আয়রোজগার আছে। তবে তার কোন সঞ্চয় নাই। তার দোষ আছে যেমন তার মেজাজ খিটখিটে আর পরিবারে তার আচরণ একজন স্বৈরাচারের মত। সে কাউরে পাত্তা দেয় না। তবে বুঝদার কাউরে পাইলে তার পিছে পিছে ঘুরে। তার ভক্ত হইয়া যায়। আমি জানি – তার মনে কোন ভক্তি নাই। সে ঘুরতেছে আসলে তার ভাল লাগাটার পিছে। এইটা শেষ হইলেই তার দিকে সে আর ফিইরাও চাইবো না। আমার ভাইয়া কবিতা লেখে। এইটাও আমার কাছে একটা ভয়াবহ দোষ বইলাই মনে হয়। মনে হয়, ভাইয়াটা আমার একটা বড় রকমের অপদার্থ। আমি ইংরেজি সাহিত্য নিয়া পড়তেছি। কীট্স্, এন্ড্রু মার্বেল, জন ডান, ম্যাথু আর্নল্ড, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ এদের কবিতা দিয়াই আমার পাঠ শুরু হইছে। আর আমার মনে হইছে- কবিতা শব্দের ঝাড়-ফুঁক ছাড়া আর কিছু না। কবিতা হইল ব্যর্থদের আস্ফালন, আহাজারি আর সফলদের সৌখিনতা। যারা পলাতক, কবিতা তাদের অলংকার। এরা ভন্ড; মিথ্যা দিয়া চারপাশটারে হিপ্নোটাইজ কইরা রাখে। এরা সহজ কইরা কোন কথা বলতে পারে না। যা বলে – তা তারা বিশ্বাস করে না। এক প্রপঞ্চময় জিন্দেগি এদের নিয়তি। আমি জানি, আমার ভাইয়া এই শহরে আমি ছাড়া আর কারো কাছে কবিতা নিয়া যায় না। এইখানে তারও আর কেউ নাই। তার কবিতা ভাল লাগার ত কোন প্রশ্নই আসে না। কোন কোন দিন সে আমার কাছে আসে তার নতুন কবিতাগুলা নিয়া। খুব বিরক্ত হই –এইটাও তারে স্পষ্ট কইরা বুঝাইয়া দেই আমি। ‘ইথলিং’- এই নামে সে আমারে ডাকে। আমি উত্তর দেই- ‘কি’?
— ‘একটা কবিতা লিখছি, শুনবি’?
আমি কোন উত্তর দেই না। ভাইয়া কবিতা পড়তে থাকে। সে যখন কবিতা পড়ে – দেখি তার চোখ মুখ শরীর জইমা যাইতেছে; এইটা আমারে আরো বিরক্ত করে। তার কন্ঠ ভারি হইয়া আসে, সে থর্থর্ কইরা কাঁপে। কবিতা শেষ হইতে না হইতেই আমি তারে তিরস্কার করি- ‘এখনো শেষ হয় নাই!’ ভাইয়া কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কিছুক্ষণ চুপ কইরা বইসা থাকে ফ্লোরের দিকে চাইয়া। তারপর মাথা তুইলা আমার দিকে চায় আর আমারে জিজ্ঞাস্ করে- ‘আরেকটা শুনবি?’
একটু একটু কইরা মিইয়া আসতেছে এই দুপুরের রোদ। আমি দেখতেছি কিন্তু মন দিতেছি না মোটেই যেমন মন দিতে ইচ্ছা করতেছে না –এইটা ভাবতে- আমার রান্না করা দরকার; দুপুরের রান্না আমার হয় নাই। আমার মন বিষন্ন না; কারো লাইগা আমি অপেক্ষাও করি না। জানালা ধইরা এই মিইয়া যাওয়া রোদের পাশে আমার শুধু দাঁড়াইয়া থাকা। চশমাটা ঝাপসা হইয়া আসলে– রুমাল দিয়া মুইছা ফেলা। আমার কোন একাকিত্বতা নাই, শূন্যতাও নাই। যা আছে– তা হইল – এই না থাকার মাঝখান দিয়া চুপে চুপে একদিকে হাঁইটা যাওয়া। জানালার পাশে, নিইভা আসা রোদের সাথে আমার এই নির্বাণ-স্থিরতা; যার কোন লক্ষ্য নাই, কোন অর্থ নাই।
হাসান শাহরিয়ার
জন্ম ৪ নভেম্বর ১৯৮৫
ইমেল : jhs.phy@gmail.com
কবিতার বই বেরিয়েছে: ‘বালির ঘর’ বইমেলা ২০১৩