ইটস হাই টাইম স্টার্ট রাইটিং ‘হার’ স্টোরি / ইরফানুর রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ ডিসেম্বর ২০১৩, ৫:২২ পূর্বাহ্ণ, | ২০০১ বার পঠিত
দেবযানীর বস্ত্রহরণ বাংলাদেশের কিছু পুরুষের ‘নিদ্রাহরণ’ করেছে। তাঁরা ”ভারতীয় মেয়েদের চরিত্র খারাপ” জাতীয় শস্তা কথাবার্তার মাধ্যমে ‘দেশপ্রেম'(?) দেখাচ্ছেন। মজার ব্যাপার হলো, ভারতীয় স্বার্থে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের বিরুদ্ধে এঁদের কোনো বক্তব্য নাই, থাকার কথা না। ভারতের কেইসটা অন্যরকম। দেবযানীকে ভারতীয় মিডিয়া ‘মাদার ইন্ডিয়া’ বানিয়ে দিচ্ছে। আদি Mother India সামন্তবাদের বিরুদ্ধে নারীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের উজ্জ্বল দলিল, ভারতীয় মিডিয়ার ‘মাদার ইন্ডিয়া’ কর্পোরেটকালের পতাকা-বলিউড-ক্রিকেটের দোসর, মাতৃকাচিহ্ন মুছে ফেললে মা স্রেফ হলমার্কের কার্ড। এই সেই কর্পোরেট রসে ডুবে থাকা বিচিত্র জাতীয়তাবাদ, এতে কোনো সন্দেহ নেই, এর রক্তে-মাংসে-অস্থি-মজ্জায় পুরুষতন্ত্র।
এই কর্পোরেট-ফ্রেন্ডলি পুরুষতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের কাছে নারীর জীবনের চেয়েও ‘ইজ্জতের’ দাম বেশি, বীরপুরুষরা ‘ইজ্জত’ নিয়ে কাবাডি কাবাডি কাবাডি খেলবেন, কেউ ‘ইজ্জত নেবেন’ আর কেউ ‘ইজ্জত বাঁচাবেন।’ তাঁরা চান নারীরা ‘প্যাসিভ ভয়েস’ হয়ে থাকবেন, নারীরা কখনোই কোনো কিছুর কর্তা হবেন না, নারীরা ‘কৃত’ হবেন। রবি, মোবাইল কোম্পানি না, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- ঠাকুর ছাহাবের ছোট্ট ‘বীরপুরুষ’-এর মতোই এই বড়ো বড়ো বীরপুরুষরা ভাববেন “মনে করো যেনো বিদেশ ঘুরে, মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে…”
সেই ‘মায়ের ইজ্জত’ বাঁচাতে কংগ্রেস-বিজেপির বীরপুরুষদের মধ্যে সংলাপ সমঝোতা হয়ে গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাদার ইন্ডিয়ার বস্ত্রহরণের বিরুদ্ধে তাঁরা জাতীয়তাবাদী জিহাদে জেগে উঠেছেন, পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে তো সেই দিনই গোপন মিলমিশ হয়ে গিয়েছিলো যেই দিন ‘ভালো’ যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি ধরেছিলেন আর ‘খারাপ’ দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেছিলেন।
কিন্তু, তাহলে কি, সেদিনের দ্রৌপদী আজকের দেবযানী?
না। আধুনিকতার আয়রনিটা হলো, এটা নিপীড়িত গোষ্ঠীর মধ্যেই তৈরি করে নিজস্ব রাজাকার, দেবযানীও তেমন একজন। এমন শ্রমিক পাওয়া যায় যে মালিকের পক্ষে, এমন নারী পাওয়া যায় যে পুরুষতন্ত্রের পক্ষে, এরা গায়ে গতরে শ্রমিক/নারী হলেও মগজে মননে মালিক এবং পুরুষতন্ত্রের পাহারাদার হিসেবে কাজ করে।
আধুনিক এই অমহাভারতে দ্রৌপদী হচ্ছে দেবযানীর গৃহকর্মী। অই গরীব মেয়েটাকে দেবযানী যখন অমহাভারত থেকে মার্কিন মুলুকে নিয়ে গেছিলেন, ভিসার আবেদন অনুসারেই কথা ছিলো মেয়েটাকে বেতন দেবেন মার্কিন মান অনুসারে, তিনি কথা রাখেননি। মেয়েটাকে দিয়ে কাজ করাতেন সপ্তাহে ৪০ঘন্টার বেশি। তো, দেবযানীকে যেভাবে আসামীর মতো রাস্তা থেকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আটক করা হয়েছে ও বিবস্ত্র করে তল্লাশি করা হয়েছে, একজন ডিপ্লোমেটের সাথে এরকম আচরণ লিগ্যাল কিনা সেটা নিয়ে ডিপ্লোমেটিক লেভেল মার্কিন মুলুকের সাথে ভারত নেগোসিয়েশান করতেই পারে। কিন্তু সেটার পাশাপাশি আর কি কি হচ্ছে? দেবযানীকে ‘মাদার ইন্ডিয়া’ বানিয়ে ‘মায়ের বেইজ্জতির বিরুদ্ধে’ জাতীয়তাবাদী জিহাদের আবেগ তৈরি করা হচ্ছে, সেই আবেগে ভেসে যাচ্ছে দেবযানীর গৃহকর্মীর শ্রম শোষিত ও প্রতারিত হওয়ার বেদনা, [কর্পোরেট] এমপাওয়ারমেন্ট অফ উমেনের নেসেসারি ইল্যুশনে গরীবের মেয়ে নারী না! সামনে আসছে ইলেকশন, তাই ‘উন্নয়নের বিলবোর্ড’ হিসেবে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস Satyagraha সিনেমা বানিয়ে ভারতবাসীকে দীক্ষা দিচ্ছে গান্ধীবাদী ‘চেতনায়’, আর বিজেপি বলছে তাঁরা তাঁদের ধর্মীয় ‘অনুভূতির’ সাথে কর্পোরেট সহানুভূতি মিলিয়ে ‘মহাপুরুষ’ নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে শাইনিং ইন্ডিয়ার বিকাশ ঘটাবে।
আদি মহাভারতে কৃষ্ণের কৃপায় দ্রৌপদীর শাড়ি অলৌকিক হয়ে উঠেছিলো, বলিউডে কাপুরের কৃপায় মাধুরীর ঘাগড়া অলৌকিক হয়ে ওঠে, চার হাজার বছরে মানসিকতা বিশেষ বদলায় নি। কিন্তু আধুনিক অমহাভারত এবং এর আশেপাশের দেশগুলোর দ্রৌপদীদেরকে এইসব মহাপুরুষ আসল পুরুষদের কৃপার ওপর নির্ভর না করে নিজেদেরই কর্তা হয়ে উঠতে হবে। নইলে দুঃশাসন দেবযানীদের নরকে পরিণত হবে উপমহাদেশ।