পাপড়ি রহমান এর ভাবের লণ্ঠন ভাবের বাতি ৩
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৩, ৭:১৭ অপরাহ্ণ, | ১৭৮৫ বার পঠিত
মীনকন্যা
৬
মাছ লোভে যে পাখিটি জলস্পর্শে বসে থাকে তার নাম মাছখেকো হলে বেশ হতো। তাতে কিছু কিছু মীন হীন অথবা নিম হয়ে সাঁতরে যেতে পারতো আরো খানিকটা জীবন ! কি অবাক বাপু ! মীনকুলের এই বেঘোর শত্রুকে মাছরাঙা অভিধেয় করেছে মানুষ ! তাতে করে বুঝা যায় শকুন দেখে কেন আমাদের ময়ূরের কথা মনে আসে ! অথবা দোঁপাটি-ফুলের-বনে জলজ্যান্ত দাঁড়াস সাপকে অযথাই বাড়িঘর বানিয়ে দেয়ার পায়তারা কেন করি? মাছখেকো আছে জেনেও আমি মীনকুলের কন্যা হয়েই জলে নেমেছি। পটু নই সন্তরণে, কিছু চোরাজল উদরে ঢুকে গেলে ভেসে থাকা ছাড়া উপায়ও না জানি। তবু আমি মীনকন্যা বটে ! মাছরাঙা ছল নাম নিয়ে কিছুতেই ছলনা শিখিনি।
উড্ডয়ন
৭
রুদ্ধ দ্বারের সামনে দিয়ে সবুজ হেঁকে চলে গেছে কত সব্জীওয়ালা, তাদের সাথে কোনোদিন দেখা হলো না ! কুলফিমালাইয়ের দিন উজাড় হয়েছিল ঢের আগে। ইগলুর ঘন্টা শুনে যেসকল গান সুর হয়ে অবিরাম ঝরে যেত, পাশের বাড়ির নওল কিশোর প্রেমে পরেছিল তার-ই ! মাইরি বলছি, আমার প্রেমে কিন্তু কিছুতেই নয় ! আমি বুনছি নকশি কাঁথার ঝালর আর ঢোলকউদর নিয়ে পা ছড়িয়ে বেশ উদাস বসে আছি ! নতুন পুতুল কেনার দিন তখন সমাসন্ন ! নারীরা ক্রমে এভাবেই অন্ধ হতে থাকে ! আর ভুলে যেতে থাকে বেনিআসহকলার যাবতীয় কারিকুরি ! বিভ্রমে পড়ে তার উড়িবার দাফনা, যাতে লেগেছিল তমোহর মেঘের আবীর ! বেনিআসহকলার শিল্পনগরী নাগাসাকি নাম নিলে ফের সে বুঝি উড়ে যেতে চায়? তখন কিছু পরবাসী মেঘ এসে আঙুলে ফুটিয়ে তোলে অস্ফুট জলজমুদ্রা !
একালের রূপকথা !
৮
এক মানুষীকন্যাকে পেলেপুষে বড় করে তুলেছিল পাখিচিল। কারণ পাখিচিলের ছিলনা কোনো কন্যা সন্তান । ফলে সেই কন্যা তাকেই চিনত বিপদে-আপদে-দুঃখে আর বিষাদে ! পাখিচিলকেই সে জানত ‘মা’ বলে ! যদিও তার নিজের মা ছিল। শুধু সেই মায়ের অন্তরে কন্যাশিশুর জন্য কোনো স্নেহ বরাদ্দ ছিলনা ! তাঁর যত স্নেহ ছিল পুত্রসন্তানকে ঘিরে। কি করা?
জগতে কত কিছুই তো বেনিয়মে চলে, চলেনা?
তো সেই কন্যা এতদিনে নিজেই সোমত্ত হয়েছে। পেটে ধরেছে দুই/একটি মানুষেরই ছানা। কিন্তু তার বিপদ বা বিষাদ কি তাতে ঘুচেছে? ঘুচেছে কি তার সীমাহীন একাকীত্ব? অথবা সে কি পেয়েছে কোনো নিরাপদ আশ্রয়? তার নিজের ছানারা এতদিনে বলে ‘আমাদের মা আমাদের জন্য কি করে?’ ‘মায়েরা কি কিছু করে নিজ ছানাদের জন্য? ছানারা তো নিজেই তুলে আনে জ্ঞান আর গরিমা। নিজেরাই চিনে ফেলে জগতের ভাল-মন্দ যত!’
জগতে কত কিছুই তো বেনিয়মে চলে, চলেনা? এই যে এখন বেশ কিছু হীম ঝরছে সূর্যের গায়ে। দিবাকর তাতে গুটিয়ে নিয়েছে ক্রোধের ফণা ! আর হাওয়া যত লাগছে গায়ে, শীতের গ্রাসে ডুবে যাচ্ছে ত্বকের পেলবতা ! এইসব বিষাদক্লিষ্ট দিন আর রাত্তির ! চারপাশে খালি অপমান আর হিংসার তুষে জ্বলছে আগুন !ধ্বিকি ধ্বিকি ! জ্বলছে !
জীবন থাকতে নেভানো যায়না এই আগুন!
একদিন নিরুপায় চিলুনিকন্যা চলে যায় পাখিচিলের কাছে। মনে বড় আশা, যদি কিছু ঘাস বুনে আসা যায় অন্তরে?
অথবা একটা নদীই যদি বইয়ে দেয়া যায় মনের গোপন ঘরে ! কিংবা কিছু আদরের ওম নিয়ে থাকা যায় কিছুক্ষণ ! চিলুনিমা ত্রস্তে জড়ো করে কিছু খড় আর শুকনো পাতা। আহা ! বাছা আমার এতদিন পর এসেছে, তাকে খানিক ওম দেয়া দরকার। একেবারে কালসিটে ভোরে উড়ে গিয়ে ঠোঁটে করে নিয়ে আসে খাদ্যখানা। নিজের পাখনা ছড়িয়ে দিয়ে তুলে আনে রোদ্দুরকনা ! যাতে করে চিলুনিকন্যাকে দেয়া যায় আরো কিছুটা উত্তাপ। কিছু স্নেহ আর ভালবাসা ! ওম পেয়ে ঘুমায় কন্যা বেঘোরে, যেনবা সোনার পালংক আর তুলাতুলা তুলোট বালিশে।
ঘুমঘোরে তাকিয়ে দেখে চিলুনিমা তার ডানায় ফের তুলে আনছে রোদ্দুরকনা ! আর কিছু কমলানেবু, দুই একটা পাকা নোনা ! চার-পাঁচটা কুল আর সামান্য শুঁটির দানা। আহা, চিলুনিমা কেমন বুড়িয়ে গেছে ! গলার নিচে ঝুলে গেছে বয়সী পালক। তিরতির কাঁপছে তার হাতদুটো। চোখের পাতায় ফুটে আছে রক্তজবা, যেনবা দিচ্ছে আসন্ন মৃত্যুর আভাস ! মৃত্যুকে এড়ানোর সাধ্য কি আর আছে চিলুনিমায়ের? চিলুনিমারও এতদিনে হয়েছে নিজের একটি কন্যা এবং সেও সোমত্ত হয়েছে ! আর চিলুনিমায়ের সঞ্চয় বলতে আছে তার দুটি মাত্র সোনার মোহর !
চিলুনিমা নিজ কন্যাকে বলে ‘ এই দুটির একটি মোহর পালিত কইন্যাকে দিও, বুঝলা?’
চিলুনিকন্যা কোনোদিন সোনাদানার লোভ করেনি, লোভ করেনি বিত্ত বা পরধনে্। চিলুনিকন্যা কিছুতেই হয়তো নেবেনা ওই সোনার মোহর ! সে তো স্নেহের ওম সন্ধান করেছে জনমভর। চিলুনিমা তাকে সেই ওমে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে কত্তদিন ! এই যে হীম নেমেছে পথের বাঁকে, উষে ভিজে গেছে পাখিচিলের ডানা—তবুও সে তুলে এনেছে রোদ্দুর আর উঞ্চতা—শুধুমাত্র পালিতা মেয়েটিকে নিরাপদ রাখার জন্য ! দেখে ঘন হয়ে শিশির ঝরতে শুরু করে চিলকন্যার চক্ষু বেয়ে, আর জনপদে তীব্রশীত ঝাঁপিয়ে নামে !নামতেই থাকে ! জগতে কত কিছুই তো বেনিয়মে চলে, চলেনা?
-
পাপড়ি রহমান
-
স্বল্পপ্রজ লেখক পাপড়ি রহমান সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই কম-বেশি বিচরণ করেছেন। তবে স্বাছন্দ্য বোধ করেন গদ্য লিখতে। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাসগুলি একেবারের ভিন্নধারার রচনা বলে মনে করেন সমালোচকগণ। রচনাশৈলিরগুনে যা ইতোমধ্যেই তাঁকে সিরিয়াস লেখক হিসাবে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে । তাঁর রচিত ছোটগল্পগুলিতেও খুঁজে পাওয়া যায় স্বতন্ত্র টিপছাপ। করেছেন নানাবিধ উল্লেখযোগ্য সম্পাদনা। আছে গবেষনাগ্রন্থ ‘ভাষা শহীদ আবুল বরকত’। যা বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত।
-
ইমেইল যোগাযোগ papree.rahman@gmail.com