রাসকোলনিকভ ও আমি । ফাহিমা আল ফারাবী
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ডিসেম্বর ২০১৩, ৩:১৭ অপরাহ্ণ, | ৫৩৪৭ বার পঠিত
‘অপরাধ ও শাস্তি’- যেকোন সাহিত্যানুরাগীর কৈশোর-তারুণ্যের অবশ্য-পাঠ্য একটা বই। স্বভাবসিদ্ধ নিয়ম-বিরাগের কারণেই অবশ্য-পাঠ্য, অবশ্য-দেখনীয় জিনিসগুলো আস্বাদন করা হয় আমার দেরিতে। সে যা-ই হোক, দস্তয়ভস্কি সম্পর্কে এতদিন শুনে এসেছি, কিন্তু কেউ কোনদিন বলেনি (ইদানিং অনু ভাই ছাড়া) আগে কেন এই লোকের এত খ্যাতি, কোথায় তার কৃতিত্ব। ‘অপরাধ ও শাস্তি’ পড়ার পর যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তারই খানিকটা (পুরোটা করা সম্ভব না, প্রতি মুহূর্তের এত চমক লেখার সময় বা স্থান সংকুলান কি করে করি?) এখানে লিপিবদ্ধ করতে চাই।
‘অপরাধ ও শাস্তি’ এক আধুনিক শিক্ষিত দরিদ্র যুবার বিভ্রান্ত, তত্ত্ব-ভারাক্রান্ত মনের গতিবিধির সুচারু বিশ্লেষণ। সুচারু না বলে আরও ভাল হয় পুঙ্খানুপুঙ্খ বললে। দস্তয়ভস্কির বাচন ও বিশ্লেষণভংগি, পাঠক মাত্রেই জানেন, এত গভীর যে সময়ে সময়ে পিলে চমকে ওঠে; রাসকোলনিকভ ও অন্যান্য চরিত্রগুলোকেও এত জীবন্ত, তাদের মনের প্রতিটি ভঙ্গিমা এত নিখুঁত ও রক্ত-মাংসের রূপে উঠে আসে যে শিউরে উঠতে হয়। আর এখানেই লেখকের কৃতিত্ব। Dostoyevsky gets under your skin- ইলেক্ট্রনের গতিময়তায় যে সূক্ষ্ম-জটিল ভাবনাগুলো আমাদের মনে উপলব্ধির অবতরণ হবার আগেই হানা দিয়ে নিমেষে সরে যায়- সেই অধরা প্রতিটি অনুভূতি ও অসমাপ্ত কথা-বাক্যকে ধরে ধরে শৈল্য-চিকিতসকের মত নিপুণ হাতে কাটাছেড়া করেন ফিয়োদর। আর ছুরির প্রতিটি পোঁচে যেন রাঙিয়ে ওঠে পাঠকের মন।
‘Crime and Punishment’ is mostly the reflection of a demented mind- the person being Raskolnikov mainly, but the other characters show equal inconsistencies, contradictions- এক অপ্রশমিত অস্থিরতা। প্রতিটি চরিত্র রাসকোলনিকভের মত দ্বিধাবিভক্ত নয় যদিও- এই বৈশিষ্ট্য তার নিজস্ব, যেমনটা তার নাম ইঙ্গিত করে। রাসকোলনিকভের প্রতি মুহূর্তের পরস্পরবিরোধী চিন্তাধারা- অপরাধবোধ, প্রবোধ ও সর্বোপরি তার আত্মসংঘাতমূলক ব্যক্তিত্বের প্রত্যেক লহমার ভাঙন ও গড়নই উপন্যাসের প্রায় সম্পূর্ণ আধেয়ের উপজীব্য। দারিদ্র্য ও ব্যক্তিক সংকটে জর্জরিত রাসকোলনিকভ যেন বন্দী নিজেরই চিন্তা-চেতনার কাছে, বদ্ধমূল ধারণার প্রতি। তার মতে- পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে, এক দল সাধারণ এবং অপর দল অসাধারণ। যেহেতু এই অসাধারণ ব্যক্তিবর্গই জগতের তাবত পরিবর্তন ঘটায়, সুতরাং এটাই স্বাভাবিক যে সাধারণ নিয়ম-কানুন, আইন তাদের প্রতি প্রযোজ্য হবে না। এই হাইপোথিসিস থেকে সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত টানে- এই ব্যক্তিরা, যারা অসাধারণ, নিজস্ব বা গণমানুষের স্বার্থে তাদের যে কোন অপরাধ সংঘটনের অধিকার আছে। যেহেতু তারা অসাধারণ, তারা সমাজের সাধারণ্যের যাবতীয় আইনের উর্ধ্বে এবং স্বভাবতই তারা নিজের ও মানুষের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য যে কোন কাজে প্রবৃত্ত হতে দ্বিধা বোধ করবে না।
আর তাই রাসকোলনিকভ একটি খুন করে। খুন করার পেছনে অনেক বস্তুগত কারণ আছে, কিন্তু সেসব ছাপিয়ে আছে তার আত্ম-শ্লাঘা। কিন্তু তার আত্ম-গরিমা বাধা-গ্রস্থ হয় যখন সে দেখে সাধারণ মানুষের মতই তাকেও বিবেক-দংশনে মাথা কুটতে হচ্ছে। তবে কি সে অসাধারণদের দলে পড়ে না? এত কিছুর পরে শেষমেষ কি এটাই সত্য-প্রতিপন্ন হতে যাচ্ছে যে সে-ও আর দশ ছাপোষা লোকের একজন? খুনির বিবেক ও অতি-মানব-হতে-চাওয়া এক তরুণের টানাপোড়েনের গল্প রাসকোলনিকভের গল্প। এমন এক অদ্ভুত সময়ে তার জন্ম যখন নীতিবোধগুলোকে মানুষ নতুন চোখে পরখ করে দেখছে, ব্যক্তি ও সমাজে পরস্পর-সম্পর্ক হচ্ছে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ, বাতাসে ঘুরে ফিরছে শৃঙ্খল ভেঙে নতুন সমাজ গড়ার বিপ্লবী আভাস। ‘অপরাধ ও শাস্তি’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ সালে, কার্ল মার্ক্সের ম্যাগনাম ওপাস গ্রন্থ ‘দাস ক্যাপিটাল’ ১৮৬৭ তে। ‘অপরাধ ও শাস্তি’ যখন প্রকাশ হয় শোষনের নিয়মতান্ত্রিকতা সূক্ষ্মভাবে চিহ্নিত করে গোড়া থেকে নির্মূল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মার্ক্স। ভাবি, রাসকোলনিকভের পরিণতি তাকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলত কি?
দস্তয়ভস্কি ক্ষমতাধর লেখক, তা বলেই না যে আদর্শ-বিশ্বাসকে মেনে নিতে পারেন না, সেই ভাবধারায় বিশ্বাসীকে নিয়েই লিখে ফেলেন আস্ত উপন্যাস! টলস্টয়ের মতই তিনিও খৃষ্টীয় ধর্মানুরাগী, উপন্যাসের শেষে অবিশ্বাসী রাসকোলনিকভের বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ তার ধর্মীয় দৃষ্টিভংগিরই এক রকম প্রতিফলন বলা যায়। ‘অপরাধ ও শাস্তি’ কে তাই হয়ত নিতশের বিখ্যাত উক্তি- “God is dead” এর একটি প্রতিক্রিয়া-স্বরূপ হিসেবেও দেখা যায়। দস্তয়ভস্কির কাছে ঈশ্বরের মৃত্যুর সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করে সব কিছু, ঈশ্বরের অনস্তিত্বের সাথে সমস্ত কিছু নিরর্থ হয়ে পড়ে। তাই ত অবিশ্বাসী রাসকোলনিকভের বোধদয় হয় অবশেষে, সোনিয়ার ভালবাসায় পুনরুজ্জীবিত হয়ে নবজীবনে পদার্পন করতে প্রস্তুত হয়। রাসকোলনিকভের এই ‘নবজীবন-প্রাপ্তি’ যেন স্মরণ করিয়ে দেয় দস্তয়ভস্কির প্রায় অবিশ্বাস্যভাবে শেষ মুহূর্তে মৃত্যুদন্ড থেকে বেঁচে যাওয়া এবং সাইবেরিয়ায় চার বছরের কারাভোগের কথা। উপন্যাসের শেষের এই কথাগুলো দস্তয়ভস্কির জীবনের আলোকে যেন এক সম্পূর্ণ সত্যে রূপান্তরিত হয়ঃ “রাসকোলনিকভ এ-ও জানত না যে তার নবজীবনপ্রাপ্তি অমনি-অমনি ঘটছে না- এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে, এর জন্য তাকে অনেক মূল্য দিতে হবে ভবিষ্যতে বিপুল কীর্তি স্থাপন করে।…”
রাসকোলনিকভের কথা জানা নেই, কিন্তু তার স্রষ্টা নবজীবনলাভের বিপুল খেসারত দিয়েছেন, ১১টি উপন্যাস, ৩টি উপন্যাসিকা, ১৭টি ছোট উপন্যাস, ও অন্যান্য লেখনীতে। ক্ষুরধার লেখনীর গুনে স্বীকৃত হয়েছেন বিশ্ব-সাহিত্যের সবচে’ বড় মনস্তাত্ত্বিক লেখকদের একজন হিসেবে। ‘অপরাধ ও শাস্তি’ পড়লে যে কারো কাছেই তার কারণটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
কিন্তু এই লেখার নাম ‘রাসকোলনিকভ ও আমি’ কেন? ‘আমি’টা এখানে কোত্থেকে এল? বইটা পড়তে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে রাসকোলনিকভের অস্থির-চিত্ততা, বিপরীত-ধর্মী চিন্তার সাথে অদ্ভুত ভাবে নিজের মিল খুজে পাওয়াটা রীতিমত অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। রাসকোলনিকভের তত্ত্বকে আমি নিজেও একরকম সমর্থন করি, কিন্তু খুন করার সাহস বা ক্ষমতা কোনটাই হত কিনা জানি না। কিন্তু কোনভাবে করে ফেললে ফলাফল নির্ঘাত রাসকোলনিকভের দৃষ্টান্তই অনুসরণ করত। প্রতি মুহূর্তে তাই শিউরে উঠেছি দস্তয়ভস্কির অমানুষিক লেখনী-শক্তির কথা ভেবে…কোন বইয়ের চরিত্রের সাথে এতটা ভয়াবহভাবে কখনো মিশে যাইনি যেমনটা হয়েছে রাসকোলনিকভের বেলায়। আবেগ, অপরাধবোধ, দ্বন্দ্ব ও পরাহত বিদ্রোহের মূর্ত রূপ রাসকোলনিকভ- তাকে শব্দ-বাক্যের বর্ণে যে নিখুত উপায়ে লেখক জীবন্ত করে তোলেন তার দৃষ্টান্ত বিশ্ব-সাহিত্যেও বোধ করি কমই আছে। যুগে যুগে পাঠকেরা পড়বে, শিহরিত হবে রাসকোলনিকভকে আবিষ্কার করে, সাহিত্যের অমর আকাশে অক্ষয় হয়ে থাকবে দস্তয়ভস্কির নাম।
ফাহিমা আল ফারাবী
লেখক হবার স্বপ্নে বেড়ে ওঠা, সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বই। সাহিত্য ও সিনেমা জীবনের মূল ইন্ধন, উদ্দেশ্য ও প্রেরণা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। ইমেল: fahima.farabi@gmail.com