কাজী মামুন এর দুইটি গদ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ নভেম্বর ২০১৩, ৫:০৯ অপরাহ্ণ, | ২০৪৮ বার পঠিত
ছায়া যোদ্ধা; বিপ্লবী চে’র গল্প সিআইএ এজেন্ট ফেলিক্স এর মুখে অনুবাদ গদ্য
পলায়ন অসম্ভব ছিল। কামরার পিছন দিকে শিক দেয়া একটা জানালা ছিল কিন্তু স্কুলঘরটা চারপাশ থেকেই ঘিরে রেখেছিল সেনাবাহিনী। বলিভিয়ানরা কোনো যুদ্ধবন্দী চায়নি, বিপ্লবীদের লাশ চেয়েছিল। ওরা হুকুমের চাকর। কোনো কিছু না বলেই আমি ফিরে গেলাম চে’র ঘরে যেখানে সে হাত পা গুজে পড়ে আছে এক কোনে।
চে’র জীবদ্দশায় তোলা শেষ ছবি, মাঝে বিপ্লবী চে তাঁর ডানদিকে ফেলিক্স
আট ফুট প্রস্থ আর দশ ফুট দৈর্ঘের ছোট্ট একটা কামরা, মাটির দেয়াল। ছোট্ট জানালাটাই ছিল ঐ কামরায় আলোর একমাত্র উৎস। সামনের দিকে এক পাটের সরু একটা দরজা। চে শরীর এলিয়ে ছিল কামরার একপ্রান্তে একটা পুরোনো কাঠের বেঞ্চির পাশে, অন্যপ্রান্তে আন্টোনিও আর আরটুরু’র লাশ।
আমি আরো ভালো ভাবে পরীক্ষা করলাম তাকে। ভঙ্গুর প্রায় শরীর। নোংরা-ছেড়া কাপড়, বোতাম বিহীন শার্ট, একজোড়া আসল জুতাও নেই পায়ে- এক টুকরো চামড়া পায়ে মুড়িয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা।
আমি চে’র কাছাকাছি উঠে দাঁড়ালাম, আমার বুটের পাশে তাঁর মাথা, যেমনটা চে একসময় দাঁড়িয়েছিল আমার প্রিয় বন্ধু ও সহযোদ্ধা ২৫০৬ ব্রিগেড এর নেস্টর পিনো। ‘বে অব পিগস’ (কিউবান বিপ্লবী সরকারকে উৎখাতে মার্কিনী এক গোপন অভিযান) এর সময়ে ধরা পড়েছিল। ক্যাস্ট্রো’র সৈন্যরা তাকে প্রচন্ড মারধোর করছিল পিনোকে যখন সে ওদের বলে দিয়েছিল যে, সে আসলে বাবুর্চি বা রেডিও অপারেটর নয় বরং প্যারাট্রুপ ব্যাটালিয়ান এর কমান্ডার। সমুদ্র পাড়ের এক কাচাবাজারে মাটিতে পড়ে মার খাচ্ছিল পিনো। হঠাৎ মার বন্ধ হওয়ার পর পিনো দেখলো তাঁর মুখের কাছে এক জোড়া চিকচিক করা বুট। সে মুখ তুলে উপরে তাকিয়ে দেখলো- চে গুয়েভারা তাঁর দিকে নিষ্প্রভ তাকিয়ে আছে। “আমরা তোমাদের সকলকে হত্যা করবো”- এটা চে পিনোকে এমনভাবে বলেছিল, যেমন সাবলীলভাবে ছোট বাচ্চাদের বলা হয় আগামীকাল স্কুল তোমাদের। পিনো বেঁচে গিয়েছিল। এখন পরিস্থিতি উলটো, চে আমার পায়ের কাছে একদলা আবর্জনা’র মতো।
আমি বললাম- “চে গুয়েভারা, আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই”
এমনকী তখনও যে একজন কমান্ডার এর মতো উত্তর দিল- “আমাকে কেউ জেরা করতে পারে না!”
“কমান্ডার” সে আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে সেই বিষ্ময় নিয়ে আমি বললাম “আমি তোমাকে জেরা করতে আসিনি। আমাদের আদর্শ ভিন্ন। কিন্তু আমি তোমার গুণমুগ্ধ। তুমি কিউবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলে, এখন দেখো নিজের দিকে, তুমি এ পর্যায়ে এসেছ কারণ তুমি তোমার আদর্শে বিশ্বাস করো। আমি এসেছি তোমার সাথে কথা বলতে” সে আমার দিকে এক মিনিটের মতো নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো, এরপর রাজী হলো কথা বলতে, জিজ্ঞেস করলো সে উঠে বসতে পারে কিনা। আমি সৈন্যদের হুকুম দিলাম তাঁর বাধন খুলে দিয়ে বেঞ্চিতে বসতে সাহায্য করতে। তাঁর পাইপের জন্য তামাক দিলাম।
যে স্কুলঘরে বন্দী ছিলেন চে গুয়েভারা।
সে কৌশলগত কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলবে না। নির্দিষ্ট কিছু অপারেশন নিয়ে যখন আমি প্রশ্ন করলাম, সে উত্তর দিল- “তুমি জানো আমি এর উত্তর দিতে অপারগ!”
কিন্তু সাধারণ প্রশ্নগুলোর সে সুদীর্ঘ উত্তর দিল, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম- “অন্য আরো দেশ থাকতে সে বিপ্লবের জন্য বলিভিয়াকেই বেছে নিলে কেন?”
সে আমাকে বললো, সে অন্যান্য জায়গাও বিবেচনা করেছে- যেমন ভেনিজুয়েলা, মধ্য আমেরিকা, ডমিনিকান রিপাবলিক। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখেছে কিউবা যখন অস্থির অবস্থা তখন আমেরিকান ইয়াংকিদের কারণে বিপ্লব ব্যার্থ হতে। সুতরাং ভেনিজুয়েলা, নিকারাগোয়ার মতো দেশগুলোতে বিপ্লব অসম্ভবপর ছিল মার্কিন ইয়াংকি সাম্রাজ্যবাদ এর কারনে। এমন একটা জায়গা থেকে শুরু করা দরকার ছিল যেটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে, যেটাকে মার্কিনীরা কম গুরত্ব দিবে। বলিভিয়া এদিক থেকে ঠিক ছিল।
“এরপর”- সে আরো যোগ করলো “আমরা একটা দরিদ্র দেশ খুজছিলাম- বলিভিয়া দরিদ্র। এছাড়া, বলিভিয়ার পাঁচটা দেশের সাথে সীমান্ত আছে, আমরা যদি এখানে সফল হতে পারি তাহলে একে একে আর্জেন্টিনা, চিলি, ব্রাজিল, পেরু, প্যারাগুয়েতেও যেতে পারবো।“
সে আমাকে বলেছিল যে সে বিশ্বাস করে যে বলিভিয়ায় তারা সমর্থন হারাবে কারন এখানকার মানুষ অনেক বেশি প্রাদেশিক। “তারা বিপ্লবকে বৃহৎ পরিমন্ডলে চিন্তা করতে পারে না- যে একটা আন্তর্জাতিক গেরিলা বিপ্লব বঞ্চিত জনগোষ্টির জন্য কাজ করছে- বরং একটা স্থানীয় সমস্যা হিসেবে দেখে ”
আমরা কিউবা সম্পর্কেও কথা বললাম। সে স্বীকার করলো যে মার্কিন বয়কটের কারণে কিউবান অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। “কিন্তু তুমিও এর জন্য দায়ী”- আমি বললাম চে কে “তুমি ডাক্তার হয়ে কিউবান ন্যাশনাল ব্যাংক এর প্রেসিডেন্ট, একজন ডাক্তার অর্থনীতি সম্পর্কে কী আর জানতে পারে?”
“আমি তোমাকে একটা কৌতুক বলি”- চে বললো- “আমরা একদিন একটা মিটিং এ বসে ছিলাম- ফিদেল আসলো- এসে জিজ্ঞেস করলো একজন dedicated economista’র কথা। আমি ভুল শুনলাম, ভাবলাম সে জিজ্ঞেস করছে dedicated comunista’র কথা। আমি হাত তুললাম”- সে হাসলো “এরপর ফিদেল আমাকে কিউবান অর্থনীতির মাথা বানিয়ে দিল” সে আফ্রিকা সম্পর্কে কথা বলতে অসীকৃতি জানালো, যখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে আমাদের কাছে খবর আছে যে তোমার ১০ হাজার গেরিলা আছে আফ্রিকায়, কিন্তু তাঁর আফ্রিকান গেরিলারা ছিল অকর্মন্য, সে হাসলো দুঃখের হাঁসি বললো “যদি সত্যি আমার ১০ হাজার গেরিলা থাকতো তাহলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। কিন্তু তুমি ঠিক, আফ্রিকানরা সত্যি সত্যিই খুবি খারাপ যোদ্ধা।”
ফিদেল সম্পর্কে কথা বলতে সে অস্বীকার করলো। ফিদেল এর নাম আসার পর তাকে এড়িয়ে যেতে দেখলাম। আমার কাছে মনে হলো বলিভিয়ায় সাহায্য না করার কারণে সে কিউবান একনায়কের প্রতি বিরক্ত। কিউবান খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য ফিদেলের দায় এর কথা স্বীকার করলো চে, যদিও সে সরাসরি তাঁর সমালোচনা করলো না।
দুপুরে হেলিকপ্টার আসার আগে পর্যন্ত আমি আর চে প্রায় দেড় ঘন্তা কথা বললাম। আমি বাইরে গিয়ে দেখলাম নিনো দে গুজমেন মেজর সয়সিডো’র কাছ থেকে একটা ক্যামেরা নিয়ে এসেছে যে বন্দীর ছবি চায়। এর আগে আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই বলিভিয়ান ক্যামেরা নষ্ট করে ফেলেছিলাম। এরপর নিনো আমার সাথে চে’র একতা ছবি তুললো আমার প্যানটেক্স দিয়ে। জীবদ্দশায় এটাই চে’র সর্বশেষ ছবি।
কামরায় ফিরে গিয়ে আমরা আলোচনা চালিয়ে গেলাম। চে অবাক হলো যে আমি তাঁর সম্পর্কে এতটা জানি, এবং কিউবা সম্পর্কেও। “তুমি বলিভিয়ান না”- চে বললো।
“না আমি বলিভিয়ান না। তোমার কী মনে হয়, আমি কোথাকার?”
“তুমি পোর্টেরিকান বা কিউবান। যেখানকারই হও তোমার প্রশ্নের ধরন থেকে আমি নিশ্চিত তুমি সি আই এ’র লোক।”
“ঠিকই বলেছ কমান্ডার। আমি কিউবান। আমি ২৫০৬ ব্রিগেড এর সদস্য ছিলাম। বস্তুত, ‘বে অব পিগস’ অপারেশনে আমি কিউবার ভিতরে থেকে কাজ করেছি।”
“কী নাম তোমার?”
“ফেলিক্স। শুধু ফেলিক্স কমান্ডার।” এর বেশি কিছু বলতে চাইলেও সাহস পেলাম না। কারণ তখনও সম্ভাবনা ছিল যে সে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পারে। আমি চাচ্ছিলাম না তাঁর সাথে সাথে আমার পরিচয়ও বের হয়ে যাক।
“হুম” চে বললো। আর কিছু না। আমি জানি না তখন সে কী ভাবছিল, আমি জিজ্ঞেসও করিনি।
কিউবান অর্থনীতি নিয়ে আমরা আরো একবার কথা বলতে শুরু করলাম, তখনই একটা গুলির শব্দ, সেই সাথে একটা শরীরের মাটিতে পড়ার শব্দ। এনিসিতো কে হত্যা করা হয়েছে পাশের রুমেই। চে কথা বলা বন্ধ করে দিল। সে গুলির শব্দ সম্পর্কেও কিছু বললো না কিন্তু তাঁর মুখ দেখলাম দুঃখভারাক্রান্ত, ডানে বায়ে মাথা দোলালো সে অসংখ্যবার।
অপরিহার্য্য কিছু কাজ করছিলাম, আসা যাওয়া করছিলাম চে’র কামরা আর কাগজপত্র রাখা টেবিলে ছবি তোলার জন্য। আমি তাঁর ডায়রি’র ছবি তুলছিলাম যখন গ্রামের স্কুলশিক্ষক আসলো।
দুইটি সিনেমার পোষ্টার
“ক্যাপ্টেন?”
“হুম বলো!”
“তোমরা কখন তাকে গুলি করবে?”
“এ কথা আমাকেই জিজ্ঞেস করছো কেন?” বললাম আমি।
“কারন রেডিও ইতিমধ্যে প্রচার করছে যে লড়াইয়ে আহত হয়ে সে মারা গেছে”
বলিভিয়ানরা কোনো সুযোগ নিতে চাচ্ছিল না। রেডিও খবরই চে’র ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমি পাহাড় থেকে নিচে নেমে চে’র রুমে গেলাম। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম- “কমান্ডার আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি কিন্তু বলিভিয়ান উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ এসেছে…”
তাঁর মুখ সাদা কাগজের মতো বিবর্ণ দেখালো “এটাই ভালো ফেলিক্স, আমার কখনোই জীবিত ধরা পরার কথা না”
আমি জিজ্ঞেস করলাম তাঁর পরিবারের জন্য কোনো বার্তা আছে কিনা। সে বললো- “ফিদেল কে বলো যে আমেরিকায় অতি শীঘ্রই সে একটা সফল বিপ্লব দেখতে পাবে” কিন্তু বললো এমনভাবে যেন সে ফিদেলকে দোষ দিচ্ছে তাকে এভাবে বলিভিয়ান জঙ্গলে ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। “আর আমার স্ত্রীকে বলো আবার বিয়ে করতে। আর সুখী হতে।”
এরপর আমরা কোলাকুলি করলাম, এটা আমার জন্য অনেক আবেগঘন এক মুহুর্ত ছিল। আমি আর তাকে ঘৃণা করতে পারলাম না। তাঁর সত্যিকারের সময় এসেছে, আর একজন প্রকৃত মানুষের মতোর ব্যবহার সে করছে। সে মৃত্যুকে মোকাবেলা করছে সাহস আর সাবলীলতার সাথে।
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। দুপুর একটা। আমি বেরিয়ে গেলাম যেদিকে মারিও টেরেন আর লেফটেনেন্ট পেরেজ দাঁড়িয়ে আছে। আমি টেরেন এর দিকে তাকালাম। তাকে দেখে নেশাগ্রস্থ মনে হলো। আমি টেরেনকে নির্দেশ দিলাম চে কে যেন মুখের উপর গুলি করা না হয় বরং ঘাড় নিচু করে। এরপর আমি পাহাড়ের উপরের দিকে ওঠে নোট নিতে শুরু করলাম। গুলির শব্দ যখন শুনলাম তখন ঘড়িতে ১টা বেজে ১০ মিনিট।
চে মৃত।
‘সংশোধনমূলক ধর্ষণ’ এর নির্মমতা
২০০৮ সালে ইওডি সিমেলেইন নামের এক নারী ফুটবল খেলোয়াড়কে গণধর্ষণের পর উপর্যোপরি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে ফেলে রাখা হয় জোহান্সবার্গের কাছাকাছি ‘কাওয়া থিমা’ নামের এক ছোট্ট শহরে। ২০১০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে রেফারীর দায়িত্ব পালন করবার কথা ছিল তাঁর। সমকামী হওয়াই ছিল তাঁর একমাত্র অপরাধ। এরকম ঘটনা আরো অসংখ্য দক্ষিণ আফ্রিকায়, আরেক মেয়ে নক্সোলো নগোয়াজা, বয়স ২৪, ২০১১ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করে ফেলে রাখা হয় তাঁর লাশও। আগের দিন রাতেই তাকে দেখা গিয়েছিল এক মেয়ে বান্ধবীর সাথে স্থানীয় এক বার এ।
যৌন নিপীড়ন এর হারের দিক থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা অবস্থান করছে শীর্ষে। ২০০৯ এর এক সরকারী জরীপে দেখা যায় প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে কখনো না কখনো কোনো মেয়ের সাথে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে তাঁর অনিচ্ছায়। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই আবার ধর্ষণ করেছে একাধিক মেয়েকে। এর আগের এক গবেষণায় দেখা যায়, মেয়েরা ধর্ষিত হচ্ছে বেশি বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন বা সহকর্মীদের হাতেই।
নারী বা পুরুষ সমকামীদেরকে সংশোধন করার উদ্দেশ্যে ওখানে প্রচলিত আছে ‘সংশোধনমূলক ধর্ষণ’ নামের এক নির্মম প্রথা। বেশিরভাগ সময়ই যার ভুক্তভোগী হতে হয় মেয়েদেরকে। কখনো ধর্ষণের পর ধর্ষিতাকে হত্যা করে মৃতদেহ ফেলে রাখা হয় এখানে ওখানে।
সংশোধনকারী ধর্ষণ এর শিকার হয় শিশুরাও। এবং কখনো কখনো পরিবারের হাতেই অথবা পরিবারের স্বীকৃতিতে। সিমফিওয়ে থান্ডেকা এরকম ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনবার। ১৩ বছর বয়সে প্রথম, তাঁর চাচার হাতে, কারণ চাচা তাঁর ‘ছেলে-ছেলে’ ভাব সংশোধন করতে চেয়েছেন। সে তখনও জানি না ধর্ষণ কী! তখন তার তের বছর বয়স। পরদিন সকালে বিছানা ছাড়ে রক্তাত্ত্ব অবস্থায় অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়ে। মা’কে, দাদীকে বলে সে ঐ ঘটনা। ওরা তাকে চুপচাপ থাকার নির্দেশ দেয়। কিছু বছর পর তার চাচার সিদ্ধান্ত নেয় তাকে বিয়ে দিলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্য চাচা তাকে নিয়ে যায় এক বন্ধুর বাড়িতে। এরপর তাকে বলে- ঐ পুরুষের সাথে যৌনসম্পর্ক করতে কারণ তাকে তার বিয়ে করতে হবে। চাচার ঐ বন্ধু কয়েকবার ধর্ষণ করে সিমফিওয়েকে, প্রহার করে। এরপর দিন তাকে ফেরত পাঠানো হয় চাচার বাড়িতে- বলা হয় সে সমকামী, এজন্য তাকে বিয়ে করবে না সে। পরবর্তীতে হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারে সিমফিওয়ে শিকার হয়েছে এইডস এর। যা সে পেয়েছে চাচার হাতে ধর্ষণের পর। এমনকি তার মাও জানতো যে তার চাচার এইডস আছে। এরপর সে ধর্ষিত হয়েছে স্থানীয়গীর্জার পাদ্রীর হাতেও।
২০০৪ সালে, পার্ল মালি প্রথম ধর্ষিত হয় ১২ বছর বয়সে। তার মা সেই ধর্ষণকারীকে নিয়ে এসেছে স্থানীয় গির্জা থেকে। এরপর বহুবার সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে একই পুরুষের হাতে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত। মা চেয়েছে সে যেন সমকামিতা থেকে সংশোধিত হয়ে ওই লোককে বিয়ে করে। পার্ল মালির কোনো উপায় ছিল না। প্রথমদিনধর্ষণের সময় সে যখন যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল। বাইরে থেকে মা তাকে ধমক দিয়ে বলেছে চুপ কর থাকতে। এমনটা চলতেই থাকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। ২০০৯ সালের মার্চে বাধ্য হয়ে ঘর ছাড়ে পার্ল। ততদিনে সে গর্ভবতী। এরপর পুলিস তাকে আবার ফেরত পাঠায় মায়ের বাড়িতেই। কিন্তু সন্তান জন্ম নেয়ার পর মা তাকে বের করে দেয় বাড়ি থেকে বলে- সে ঐ সন্তানকে স্পর্শ করলে সেও সমকামী হয়ে যাবে। পার্ল এখনও তার সন্তানকে দেখতে যেতে পারে না। এখনও সে সমকামী।
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ‘সংশোধনমূলক ধর্ষণ’ এর এই প্রথায় সমর্থন দেয় সমাজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ এমনকি অনেকক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর পরিবারও।
শুধু মেয়েরা কেন? এই সংশোধনমূলক ধর্ষণ থেকে রক্ষা পায় না পুরুষরা এমনকি হিজড়ারাও। ২০০১ এ, তেবোগো মোতসোয়াগি নামের একজন হিজড়া উপুর্যপরি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন সাতজন পুরুষের হাতে। ১৯৯৪ সালে থ্যামসাঙ্গা মূলি নামের একজন পুরুষ শিকার হয়েছেন গণধর্ষণের, ধর্ষণকারী একজন পুরুষ বলেছে তাকে ধর্ষণ করা হচ্ছে তাঁর পুরুষত্ব ফিরিয়ে আনার জন্য।
সমকামীদের বিয়ে অনুমোদন দেয়া দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থান প্রথম দিকেই। সেই ১৯৯৬ সাল থেকে সমকামীরা অধিকার পেয়েছে বিয়ে করার। কিন্তু মেলেনি সামাজিক স্বীকৃতি। পুলিশের হিসাবে ২০১১ থে ২০১২’র মধ্যে ২৪৯ টি যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে ছোট্ট শহর এই কাওয়া থিমাতেই।
(জুলাই ২৭, ২০০১৩ তে নিউইয়র্ক টাইমস এ প্রকাশিত ক্লেয়ার কার্টার লেখা নিবন্ধ অবলম্বনে)
- কানাডায় বসবাসরত পিএইচডি গবেষক (গবেষণার বিষয়ঃ কম্পিউটার বিজ্ঞান), ব্লগার ও ফেসবুকার (২০০৭ থেকে) এবং মনোযোগী পাঠক (ছোটবেলা থেকে)।
- যোগাযোগঃ kazimamun@gmail.com